রোজ সন্ধ্যার পর থেকেই ওরা কাকরাইল মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ইদানিং অনেকেই বোরকা পরে দাঁড়ায়। কে বেশ্যা, কে ঘরনি বোঝা মুশকিল। এত সুন্দর একটি ধর্মীয় পোশাক ওরা এমন গর্হিত কাজে ব্যবহার করে। কী করবে? বেশ্যা হলেও তো ওদের সামাজিক লজ্জাটা আছে। যেতে যেতে রোজ এ কথা ভাবে সুমন। কারণ অফিস থেকে এ পথেই হেঁটে যায় সে। বাসায় যাওয়ার এটাই একমাত্র পথ। পথের পাশে ওদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে।
যেতে যেতে দাঁড়িয়ে থাকা নিশিসুন্দরীদের শরীর দেখে। বুকের উচ্চতা মাপে। কোমরের ভাজ খোঁজে। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট চেটে বাসায় গিয়ে বাথরুমে ঢোকে। বের হয়ে বিছানায় মিনিট বিশেক নিথর হয়ে পড়ে থাকে।
রোজই সুমনের ইচ্ছে হয় দরদাম করার। সাহস হয় না। মানুষের শরীর নিয়ে দরদাম। টাকায় পাওয়া যায়। ভাবতে কেমন গা শিরশির করে। পুলকিতও হয়। তাই আজ সাহস করে দাঁড়ায়। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী এক রমনীর সামনে দাঁড়াতেই: কী লাগব না কি? এক্কেবারে টাইট অ্যাহনো।
সুমন একটু লজ্জা পায়। এদিক-ওদিক তাকায়। পরিচিত কেউ দেখে ফেলছে না-তো? বুকের ঢিপঢিপানিটা বাড়ে। আস্তে করে বলে, হুম। কত নিবি?
একঘণ্টা না কি সারা রাইত—চিকন সাপের ফণার মতো ঘাড় বাঁকা করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সুন্দরী।
সুমন ভাবে। মনে মনে বলে, একঘণ্টায় কী হবে? এই তো জীবনের প্রথম। মুচকি হেসে বলে, বাসা খালি। সারা রাইত।
বেশ, তাইলে তিন হাজার।
ধুর মাগি। অ্যাত চাস ক্যান? রাস্তার বেশ্যাগো অ্যাত দাম? তাইলে তো সানি লিওনরেই আনতে পারি।
তাইলে যা, আমার কাছে আইছোস ক্যান? এক টাকার কাবিনে কাউরে বিয়া কইরা লঅ।
যাহ খানকি মাগি! মাসে কামাই আট হাজার। আর ও এক রাইতেই…। ব্যবসা তো ভালোই জমাইছোস। সারা রাইত খাড়ায়া থাকলেও কাউরে পাবি না।
ক্ষেপে যায় স্বঘোষিত নিশিসুন্দরী। বলে, ওই খানকি মাগির পোলা, অ্যাতো চটাং চটাং কথা কস ক্যান? কামাই নাই, তয় মাগি খোঁজস ক্যান? কয়জনরে তুই বিনাপয়সায় নষ্ট করছোস? চুতমারানির পো, কাম ফুরাইলেই খিস্তি-খেউর, থু-তু ছিটাস বেশ্যার গায়!
চুপ শালি। চিল্লাস ক্যান। এক হাজার দিমু যাবি কি না কঅ।
বলতেই চারদিক থেকে সুমনকে ঘিরে ধরে রাতের অপ্সরীরা। সুন্দরী সেখানে একাই না। আরও কয়েকজন ছিল। সবাই ছুটে এসে ঘিরে তাকে। চেঁচিয়ে বলে, দিনের বেলা সাধু সাজো? বড় বড় বুলি আওড়াও। আন্ধার রাইতে চুপি চুপি খানকি মাগির শরীর টোকাও? তোরা ধর শালারে, ধর। আইজকা অরটা ভোতা বানায়া দিমু। যেন সারা জীবনেও না খাড়ায়।
তারপর আর কিছুই মনে নেই সুমনের। সকালে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে তাকাতেই হাসপাতালের সুন্দরী সেবিকা দাঁড়িয়ে। অস্ফুট স্বরে সুমন জানতে চায়, আমি কোথায়?
নার্সের মুখে সলাজ হাসি—আমাকে দেখার পর নিশ্চয়ই নিজের ঘর মনে হওয়ার কথা নয়। আপনি এখন হাসপাতালে। রাস্তা থেকে তুলে এনে কারা যেন রেখে গেছে। আত্মীয়-স্বজন কেউ থাকলে খবর দিন।
সুমন অসহায় চোখে নার্সের দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে, না, এই শহরে আমার আর কেউ নেই।
তাহলে এই নিন, ফার্মেসি থেকে এ ওষুধগুলো আনতে হবে।
সুমন সম্ভিত ফিরে পায়। হাতের ঘড়ি, আঙটি, মানিব্যাগ, মুঠোফোন কিছুই নেই। তিন হাজারেরও বেশি লোকসান হয়ে গেল। ব্যথাটাও চিনচিন করে বেড়ে উঠছে।
দুই.
কখনো কখনো এমনও হয়। আজ যেটা ঘটলো, পরদিন তার ঠিক উল্টো। প্রতিদিন তো একই ঘটনা ঘটে না। মন-মেজাজও এক রকম থাকে না।
শহরে রাতের অন্ধকারটা যেমন হয় আর কি? সোডিয়াম লাইটের আলো-আঁধারির খেলা। আলো-ছায়ার খেলার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এক নিশিসুন্দরী তার খেলার অংশীদার খোঁজে। অংশীদারের নজর আকর্ষণে পার্স খুলে পুনরায় গাঢ় লিপস্টিক লাগায় ঠোঁটে। ঠোঁটটা এবার চিকচিক করে ওঠে। ওই গানটা মনে পড়ে—পিঙ্ক লিপস না কী যেন?
রাতও বাড়তে থাকে। রাস্তায় সবাই তো ঘরমুখো মানুষ। দুই/একজন পথচারী ফিরে তাকায়। কেউ বা আড়চোখে দেখে। আজ আর বোধ হয় খেলাটা জমলো না। নরম বিছানা, তুলতুলে বালিশ, দামি পারফিউম আজ আর কপালে নেই। সে সব না হয় না-ই থাকলো, কোনোভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পারিশ্রমিকটা তো দরকার। দেয়ালে হেলান দিয়ে বা মহল্লার চিপাগলিটা হলেও সমস্যা ছিল না। শুধু একটা মাঠ দরকার। খেলতে যে হবেই। ট্রফি নিয়েই তো ফিরতে হবে তাকে।
পৃথিবীতে সবাই খেলছে। যে যেভাবে পারছে। খেলছে সৃষ্টিকর্তাও। খেলছে তার সৃষ্টির সঙ্গে। নিশিসুন্দরীও খেলছে। সবার সঙ্গে। ভদ্র ইতর চোর বাটপার পকেটমার ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার শিক্ষক সাংবাদিক ও নেতার সঙ্গেও। খেলছে দিনে-রাতে আলো-অন্ধকারে। নরম আলোয় ভোরের সকাশে। সবার খেলার ধরন এক। শুধু মাঠ ভিন্ন। তবে দর্শকশূন্য। এই খেলাকে সবাই বলে পাপ। সুন্দরী বলে, এও এক খেলা। আদিম খেলা। সে-ও খেলোয়াড়। তাই প্রতিপক্ষ খোঁজে। পাপ-পুণ্যের হিসাব কষার সময় থাকে না তার। কেউ তো সহজে রাজি হয় না। খেলদণ্ড সায় দিলেই না প্রতিপক্ষ মিলবে। কখনো কখনো চুক্তিতে বনিবনা হয় না। আজকাল মানুষ সবকিছুই সস্তা খোঁজে।
ফুটপাতে এলেই সবকিছুর দাম কমে যায়। ওগুলোই একটু রঙিন মোড়কে বন্দি করে অত্যাধুনিক শপিংমলে নিলেই দাম তিনগুণ। হায়রে কপাল! আফসোস হয় নিশিসুন্দরীর। দামি শাড়ি নেই। নেই প্রসাধন। কিভাবে ধরে রাখা যাবে উন্মাতাল যৌবন? মাঝে মাঝে হতাশ হয় সে। চাহিদা পড়ে যাচ্ছে। ভাবে, না কি জগতের মানুষগুলো ভালো হয়ে গেলো একদিনে? কি জানি! হবে হয়তো। তাহলে আমি খারাপ কেন? কেন এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছি?
আদিম খেলায় শরীর, রূপ, যৌবনই সব। রূপ-যৌবনে ভাটা পড়লেই দেখা যাবে দুনিয়াটা বড় স্বার্থপর। কম তো আর হলো না। বয়স গড়িয়েছে চল্লিশের কোটায়। অর্ধাহারে অনাহারে শরীরেরও ভগ্নদশা। কর্মজীবী বলে নেওয়া মহিলা হোস্টেলেও জনারণ্য। ব্যক্তিত্ব নেই। কেউ কাঁদে, কেউ হাসে। কারও ফোনে ফিসফিস কিংবা শীৎকার। তবু আশার জাল বোনা। প্রতিরাতেই সে জাল কাটে ভিনদেশি ইঁদুর।
ভাবতে ভাবতেই পায়ের কাছে কিছু একটা পতনের শব্দ। আস্ত একটা দীর্ঘদেহী মানুষ। পড়ে যেতেই পারে। ফুটপাতের যে অবস্থা। সিটি করপোরেশনের খোঁড়াখুঁড়ি আর শেষ হয় না। সুন্দরীকে মানুষ যেমন খোঁড়ে। এ কি! পড়ে ওঠার নাম নেই। কাঁধের ঝুলিটাও দূরে পড়ে আছে। কারও এগিয়ে আসার আলামত নেই।
মানুষটি হয়তো একা। পতিত পুরুষের দিকে ঝুঁকে একবার পরখ করে সুন্দরী—নাহ, জ্ঞান নেই। কী করব? জায়গাটা পালটাই। শালা, কপালটাই খারাপ। পড়বি তো পর মালির ঘাড়েই? বলেই দুই পা এগোয়। একটু থেমে পিছন ফিরে তাকায়। বিড় বিড় করে বলে, পড়ার আর জায়গা পেলি না। নাহ, সেভাবেই পড়ে আছে। মানুষটিকে দেখে সুন্দরীর মনে হলো, রাস্তার কুকুর-বেড়াল আর কি। সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছে সবাই। ওরা কী মানুষ সবাই? তাহলে এই পতিত যুবক আর পতিতা যুবতী? তাদের কী জাত? মনে মনে ভাবে, আমরা হয়তো মানুষ নই। মানুষগুলো ওদের মতোই। দয়া নেই, দায় নেই। মন নেই, প্রেম নেই।
সুন্দরী ঘুরে এসে আবার পতিত যুবকের পাশে দাঁড়ায়। অচেতন হয়ে আছে লোকটা। সুন্দরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কী করবে, ভেবে পায় না। লোকটার জন্য মায়াও হয়—সারা জীবন তো খারাপ কাজই করে গেলাম! এ কেমন পরীক্ষা! ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্ত নেয়। হাত তুলে একটা রিকশা ডাকে। মধ্যবয়সী এক রিকশাঅলা মুখে গান তুলে এগিয়ে আসে। রিকশা থামিয়ে বলে, ও সুন্দরী, ডাকছো কেন?
ভেতরে রাগ এলেও সুন্দরী ভদ্রভাবেই বলে, লোকটা মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে।
তো, আমি কী করুম?
আগে রিকশায় তোল।
রিকশাচালক আর সুন্দরী মিলে ধরাধরি করে লোকটাকে রিকশায় তোলে। রিকশাঅলা অবাক—কই যাইবেন আপা?
মেডিক্যালে নিয়া চলো।