এক
চারদিকে ঢের আবাদি জমি। এক আবাদে ধান ওঠে তো অন্যটায় সরিষার বীজ বোনা হয়। পাট যেতেই গমের চারা বেড়ে উঠতে থাকে লকলক করে। একদিকে ফুলকপি-বাঁধাকপি-মূলা, অন্যদিকে পিঁয়াজ-রসুন-মরিচের আবাদ। একটার পর একটা ফসল লেগেই আছে বছরজুড়ে। এর মাঝেই তটস্থ হরিণীর মতো দিব্যি জেগে আছে মনোহরা অঞ্চলটা। তবে একেবারে অজপাড়া বলা চলে না একে। কেননা পাকা দালান-কোঠা আছে অনেক। মার্কেট আছে—সেখানে আজকাল মেয়েরা ঘুরে ঘুরে বাজার-সদাই করে। চারদিকে এখন শহুরে আমেজ। ক’খানা মক্তব-দুইখানা মাদ্রাসা, প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্কুল-সব মিলিয়ে মফস্বলের দিকেই জোরটা বেশি। রাস্তাঘাট কিছু কাঁচা, তবে বেশিরভাগই পাকা-আধা পাকার মিশেল।
গ্রামের নাম হরিৎপুর।
রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাথায় ঠেলে, সেই বিহান বেলায় বেরিয়ে যায় তিন বাটির টিফিন ক্যারিয়ারে দুপুরের খাবার আর কালো ছাতাটা হাতে ঝুলিয়ে। আদপে সে একজন কেরানি, বিজয়নগর হাইস্কুলে যার সকাল-দুপুর বাঁধা। সপ্তাহান্তে একদিন ছুটি মেলে—প্রতি শুক্রবার। তাই বলে কি আর জিরান আছে তার? ওই দিনের জন্যই তো সব কাজ জমে থাকে। ফলে ফুসরত মেলে না আরামের।
সামান্য পয়সা কেরানিগিরিতে। মাস অর্ধেক যেতে না যেতেই মাইনের পুরুটা শেষ, পকেট ফাঁকা। বউ, তিন মেয়ে নিয়ে বাকি অর্ধেক মাস খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমে দিন গুজরান। মাসের শেষ ক’টা দিন তো ওদের চোখের দিকে তাকাতেই পারে না! অপারগতার লজ্জা বুকে শিন্শিন্ ব্যথা তোলে। দাম্পত্যের শুরুর দিনগুলো ভালোই ছিল তাদের—কেবল দুই জন। আমোদে আহ্লাদে কেটে গেছে। তারও আগে বাপজানের লঙ্গরখানায় খাওয়া-দাওয়া। চিন্তা ছিল না কোনো, চলে যেতো অনায়াসে। এই যে বিয়ে করে আলাদা সংসার পাতা, সন্তান-সন্তুতির মুখ—আস্তে আস্তে দুর্বিষহ জীবনের শুরু। ২ থেকে ৫-এ যখন পৌঁছলো মুখ, সেই যে শুরু হলো অভাব-অনটন স্থায়ীভাবে, আর কমেনি। দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এখন রীতিমতো টানাটানি, নুন আনতে পান্তা ফুরায়।
দু’আনার চাকরি, খাওয়ানোর মুরোদ নাই, কেবল মুখে বড় বড় বুলি— এ রকম কথা বউয়ের মুখে শুনতে হয়নি কোনো দিনই। এখানে সান্ত্বনা যেমন বড়, তেমনি আক্ষেপও তার। কেননা, তার মতো বাইরে যারা গো-বেচারা ভালো মানুষ—তারা ঘরে ঠিক উল্টো, বেপরোয়া। প্রয়োজনে দু’চার কথা বলে বাইরের কারও ওপর রাগ ঝারতে পারে না কখনোই তারা; রাগ দেখায় ঘরে ফিরে বৌ-সন্তানদের সঙ্গে। তবে এই রাগারাগিরও তো একটা উছিলা থাকা চাই? কেরানির বেলায় তা হয় না। এক্ষেত্রে সে অসহায়। স্ত্রীর মতো মেয়ে তিনটাও বড্ড লক্ষ্মী। মায়ের মতো অনাহারী-অর্ধাহারী থেকে যায় দিনের পর দিন—মুখে টু শব্দটি পর্যন্ত করে না! তবু অক্ষম বাপের মন বারবার পরাজিত হয় শুকনো মুখগুলোর কাছে। ওদের ম্লান চেহারা দেখলেই ভয় হয়। সে অনুধাবন করে—ওরা রাগলে ভালো হতো। ওরা তার অক্ষমতার কথা বলে তুলনায় গেলে শান্তি পেতো। কারণ তখন চেঁচিয়ে বলতো—পারি না বেশ করি। প্রয়োজনে গালি দিতো। ঝগড়া করতো। মনটা হালকা হতো। কিন্তু ওদের কাছে বারবার হেরে যায়—ওরা সে সুযোগ দেয় না। অথচ কে না চায়, বউ-সন্তানদের মুখে একটু হাসি ফোটাতে? ওরা এতই নিস্পৃহ থাকে যে তাকে ভেতরে ভেতরে পুড়ে মরতে হচ্ছে নিয়ত। অন্তরে তীব্র জ্বালা, যে জ্বালা সামলানো কঠিন।
বড় মেয়েটা নীলাম্বরী। তার নিলুমা। কী শান্ত! ধীর-স্থির আকাশের মতো বিশালতা নিয়ে যেন ওর জন্ম। ডাগর ডাগর চোখে যেন মায়ার পসরা ঝরে। তাকালে যেন হৃদয়টা উথলে ওঠে। ওর বিস্ফারিত চোখ যেন তাকে পড়ে নিতে পারে মুহূর্তে—তার মৃত মায়ের মতো। এই মেয়েটার গম্ভীর কথায় তার মনে শঙ্কা জাগে খুব। মেয়েটার বিয়ের বয়স হতে চলেছে অথচ তার কাছে মনে হয়—এই তো সেদিন না ওর জন্ম হলো! একটি শিশু, পৃথিবীতে আসার সে কী প্রাণান্ত পরিক্রমা? সদ্য বিয়ে করা দম্পতির যৌবন কামকেলির ফসল-মায়ের প্রথম গর্ভধারণ ক্রমের সূত্রপাত! অতপর, মা যখন প্রসূতি—সন্তান প্রসবের সে কী বর্ণনাতীত কষ্ট? তারপর, এক সূতীক্ষ্ণ চিৎকারে বাতাস কাঁপালো একটি প্রাণ, একটি কন্যা। এই তো সেদিন—হামা দেওয়া থেকে গুটিগুটি পায়ে হাঁটা, ফ্রক ছেড়ে সালোয়ার কামিজ—দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেলো মেয়েটা! মেয়ের মা মাঝে-মাঝেই তাড়া দেয়, ‘একটা ভালো পাত্র দ্যাখতে বলো ঘটককে। আর কত দেরি? এবার মেয়েটার বিয়ে দাও।’ সে গা লাগায় না। সে তো জানে, মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সঙ্গতি তার কত দুর্বল এই বাজারে! আর্থিক অবস্থা কতটা সঙ্গীন! আবার ভাবে কিনা—ওর মায়ের কথাও তো ঠিক, আর কত দিন মেয়েকে বাপের বাড়িতে? না না! ছি ছি রব ওঠার আগেই বিয়ে দিতে হবে। এ সমাজ দূর থেকে বয়সকে এখনো কটু চোখে দেখে।
কিন্তু মেয়েটার চোখের দিকে তাকালে সত্যিই সে ভরসা পায়। মেয়ে তার যেন দমার পাত্রী নয়। ওর চোখে স্পষ্ট দেখতে পায়, সমাজের কলুষতা ওকে ঢাকতে পারবে না কোনোদিন।
মেজোটা হৈমন্তী। তার হৈম। স্নিগ্ধ মোলায়েম রেশম যেন। যেন কাশ ফুলের মতো নরম, পেল্লব চাহনি। শরতী মেঘের ভেলার মতো তার উপস্থিতি, সাদা বরফরঙা। এই আছে তো এই ভুস, হাওয়ায় যেন উড়ে উড়ে বেড়ায়। যখন দৃশ্যমান কেবল ভেসে ভেসে চলে ঘরের এ কোণ থেকে ও কোণে। বাড়ির এ মাথা থেকে ও মাথায়। ওরা বড় হচ্ছে আর তাকে তার দৈন্য অট্ট-উপহাস করছে। এই দৈন্য সুখের নাগাল না পাওয়ার দৈন্য, একটু ভালোভাবে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য যে সচ্ছলতা, তার দৈন্য। অর্থের দৈন্য—আদতে এটাই তো মুখ্য! অর্থ চাই চারদিকে, কেবলই অর্থ আর অর্থ। অর্থ থাকলে স্বাচ্ছন্দ্য আসবেই। যে উপায়েই আসুক না কেন, এই সমাজ সংসারে নিশ্চিত মূল্যায়ন বাড়বেই। বেঁচে থাকারও যেন একটা কিছু মানে হয় তখন।
ছোটটা তটিনী। তার টিনু। নদীর মতোই উদ্দাম-উচ্ছ্বল, কলবল-ছলবল করে দিনভর। কেবল হাঁটা শিখেছে। কথার খই ফোটে মুখে। ডালিম বিচির মতো দুটো সাদা দাঁত সামনের পাটিতে—যেন মুক্তোদানা। এ দিয়েই চিবিয়ে চিবিয়ে লেবুঞ্চুশ খায়।
সপ্তাহান্তে একদিন শুক্রবার ওরা তাকে ব্যস্ত রাখে কিংবা সে ওদের। ওই একদিন সে নিজেকে বিলিয়ে দেয় বাবা হয়ে বাবার মতো। বাদ বাকি ছ’টা দিন খাটুনি আর খাটুনি। সামান্য কেরানির চাকরি তো, না খাটলে কি পয়সা দেবে কর্তৃপক্ষ? এমনি এমনি কি জগতে কেউ কিছু দেয়? সবখানে খাটা-পয়সা বিনিময় যে!
ওদের মা সুহাসিনী বেগম, যেন অপ্সরা। সত্যি সত্যি অপ্সরার মতো দেখতে নয় অমন সুশ্রী—মনে আর গুণে এই আর কী! দেবীসম হৃদয় তার, দেবীই বলতে গেলে। তা না হলে কি এক কেরানির অগোছালো সংসারে অবহেলায়-অযতনে, উপেক্ষায়-অমানবিকতায়, কষ্টে-অভাবে-সংগ্রামে টিকে থাকতে পারতো? না কি এই ঘুণে ধরা সংসারটাকে এদিক ওদিক ‘মায়ার ঠেক’ দিয়ে টিকিয়ে রাখতে পারতো? ক’পয়সা আর মাইনে পায় সে? মোটের ওপর উপরি কামাই যে তাকে দিয়ে হয় না! সুযোগ আছে কিন্তু বিবেক তো হারিয়ে যায়নি। ফলে সম্বল কেবল মাসিক বেতন।
দুই
চাকরিটা পেয়েছিল ভাগ্যের জোরে। কী এমন লেখাপড়া তার? অশিক্ষিত, হাল ঠেলা মজুর বাপের পাঁচ নাম্বার সন্তান। ভাইবোন মোটে এগারজন টিকেছিল—জীবিত। চারজন আঁতুড়েই বিদেয় নিয়েছিল। মায়ের সন্তান প্রসবের সে কী মহড়া? মা যেন নিরলস মাতৃত্বের স্বাদ পেতে চাইতেন। বিয়ের প্রথম পঁচিশ বছরের কোনো দুই বছর পরপর তার কোল খালি যায়নি। যেখানে এতবড় পরিবার সামলাতে বাপ হিমশিম খেতেন, সেখানে পড়ালেখা—সে তো স্বপ্নাতীত। যেদিন বুঝতে শিখেছে, সেদিন থেকেই লাঙল ধরেছে। তার বাপজানের সঙ্গে সঙ্গে বলদের ল্যাজ ধরে ধরে এগিয়েছে। দুই-পাঁচ দিনেই শিখে গেছে সব। বাপজান খেতে গেলে তার হাতে লাঙল ধরিয়ে দিয়েছে। দিব্যি তাড়িয়ে নিয়ে গেছে অবলাদের। বংশানুক্রমে সে কৃষক। বংশ-পরম্পরায় ক্ষেতমজুরদের আওলাদ সে। রক্তের ধারাতেই যে হালের কৌশলগুলো মিশেছিল গভীর মৌনতায়, তা শিখতে তেমন পাঠের দরকার হয়নি। একটু তালিম পেতেই ধরে নিয়েছে সব কৌশল।
কৃষকই হতো। হয়েও যাচ্ছিল। কিন্তু কোন বাগে যে হাই স্কুলের পাঠটা ধুঁকতে ধুঁকতে কোনো রকমে শেষ করতে দিয়েছিল তার বাপজান, সেটাই এক বিরাট রহস্য! এই শিক্ষার জোরেই তো বেঁচে যাওয়া। নইলে তো বাপদাদার পেশাকেই আঁকড়ে থাকতে হতো। শেষমেশ উদ্ধার করেছে সে, বড় চার চারটে ভাই থাকাতে তার প্রয়োজন যে নিদারুণভাবে লাগবেই ক্ষেত—খামারির কাজ এ রকমটা মনে হয়নি বাপের। মায়েরও একটু আস্কারা ছিল তার বেলায়—একটু নয় অনেকটাই। মায়ের কূলের দূর দূরতক সম্পর্কের কোনো এক আত্মীয় নাকি মস্ত শিক্ষিত ছিল। প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। যখনকার সময়ে পাঁচ/সাত গ্রামে ঘুরে একজন মেট্রিকুলেশন পাস লোক পাওয়া যেতো না, তখন এই আত্মীয় ছিল আই এপিটিআইবিএ। ফলে তার মায়ে প্রায়ই ছেলেদের চাকরিজীবী বানাতে স্বামীর সঙ্গে তর্কে যেতো। উদাহরণ টানতো সেই আত্মীয়ের। তার বাপজান এই সব থোড়াই কেয়ার করতো? শুনতো ই না স্ত্রীর অহেতুক বকবকানি! তার বাপজানের সব কিছু নগদে হিসাব। শ্রাবণে হাল জুতলে যেখানে মাঘে ফসলের দেখা, সেই ফসল থেকে কড়কড়ে টাকা আসে হাতে—সে কি চাইবে দীর্ঘ একযুগ কিংবা তারও বেশি সময় পাঠোদ্ধার কর্মে অন্নধ্বংস করে তার সন্তানেরা, তারপর কিনা শিক্ষিত হয়? তিনি তা চাননি কারও বেলাতেই। আর চাননি বলেই তার ভাইবোনেরা গণ্ডমূর্খ থেকে গেছে—সে ছাড়া।
তার বাপজান তখনো জীবিত। বয়সে ভারী শরীর, জমিনে আসতে পারে না। ছেলেরাই আসতে দেয় না। কিন্তু টনটনে জ্ঞান রাখে চাষবাসে এখনো। সেদিন রোদ ছিল বেখাপ্পা। বেতের মাথাল কি পোড়া রোদের ত্যাজ মানে? দর দর করে ঘাম ঝরছিল কপাল বেয়ে, গা বেয়ে। সে আর তার ভাইরা সবাই গোছনেংটি দিয়ে আমনের ক্ষেতে পটাপট ধানের চারা গাঁথছে। পাশের আইল দিয়ে বিজয়নগর হাই স্কুলের হেড মাস্টার মাইজুর আলম যাচ্ছেন। বাম হাতে লুঙ্গিটা টাক্নু থেকে একটু উঁচিয়ে ধরে জলকাদা মাড়িয়ে সাবধানে পা ফেলছেন, যেন গুনে গুনে। ডান হাতে ছাতার ডাঁট ধরা। হঠাৎ দাঁড়ালেন তার বরাবর এসে। তাকে ডাকলেন। সবাই সালাম ঠুকলো।
—রতন!
—জি স্যার।
—ক্ষেতের থাইক্কা উইট্যা আমার সাথে আয়সাইন একটু ইস্কুলে। তরে চাহরি দিমু।
টাস্কি খায় সে—সে আর চাকরি? ঠাট্টা নাকি? কিন্তু মাইজুর মাস্টর তো বেস্তি কথা বলার লোক নন? তাইলে? আবার তার হুকুম অমান্য করার সাহসও কারও নাই। বড় ভাইদের দিকে আড়ে আড়ে তাকায় সে। ওরা ততক্ষণে নিজ মনে ধানের চারা গাঁথছে। তার বাজানের কথা মনে পড়ে। বাজান কি রাজি হবে?
—স্যার, বাজান!
—হয়, আমার কথা অইসে তর বাজানের লগে। তাড়াতাড়ি আয় ইস্কুলে। বালা কাফর চোফর ফইরা আইস।
সে যখন বাড়ি ঢুকে তার বাজান তখন পুব ভিটের নারকেল গাছের তলায় বসা। হাতে হুক্কা। তাকে দেখেই বাজান তাড়া দেয়। ভাবে, তাইলে বাজানও কি চেয়েছিল তার পাঁচ নম্বর সন্তান চাকুরে হউক? এতদিন বুঝায় নাই ক্যান?
মাইজুর স্যার সেদিন তাকে নিজের টেবিলে বসিয়ে দরখাস্ত লেখায়। পরের সপ্তাহে পরীক্ষা, কেরানি নিয়োগের। ফেয়ার পরীক্ষা হয়। ভাইভা বোর্ড বসে। সে নিয়োগ পায়।
এবং সেই থেকে টানা বত্রিশ বছর। কর্তব্যে অবহেলা করেনি জেনেশুনে। মাইজুর স্যার আজ নেই। তার স্মৃতি আছে বহু। সেও একদিন থাকবে না। তারও কি স্মৃতি থাকবে?
ওপরের ঘটনাগুলো যার সে সুলায়মান মিয়া, একদা যে বিজয়নগর হাই স্কুলের কেরানি ছিল, যে কিনা আজ থেকে তেরো বছর আগে ইহধাম ত্যাগ করেছে, যে কিনা অবিবাহিত তিন মেয়ে, স্ত্রী সুহাসিনী বেগম আর কিছু গুণগ্রাহী আত্মীয় স্বজন রেখে গিয়েছিল হরিৎপুরে। তার মৃত্যুর কিছুদিন পর পৈতৃক সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা হয়েছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে। সুলায়মান মিয়ার ভাইদের আর্থিক অবস্থাও ভালো চলছিল না বিধায় মেয়েদের নিয়ে সুহাসিনী বেগম তার বাপের বাড়ি চলে যায়। নিজেদের সংসার চালাতে যাদের উদয়াস্ত ভাবতে হয় তারা অন্যের সংসার কিভাবে চলছে সে চিন্তা তেমন করে না—চাই সে সহোদরই হোক না কেন। ফলে শেষ দিকে সুলায়মান মিয়ার পরিবারের খবর খুব একটা রাখেনি পরিবারের কেউ।
তিন
বিজয়নগর হাই ইস্কুলের কেরানি সুলায়মান মিয়ার জায়গাতে এখন অন্য একজন নিয়োগ পেয়েছে। তার মৃত্যুর পর এই সামান্য এক কেরানির পদ নিয়ে কত তেলাতেলি? কত চালবাজি? কত কারে ধরাধরি? স্কুল কমিটির সভাপতি থেকে চেয়ারম্যান, এলাকার পাতি নেতা থেকে উঁচু নেতা কেউ বাদ যায়নি। অবশেষে প্রভাবশালী কোনো এক বয়োজ্যেষ্ঠ নেতার বলিষ্ঠ হাতের গায়েবি ছোঁয়ায় নিয়োগ পেয়েছে জমির আলীর ছেলে নওজের আলী। নওজেরের নিয়োগ নিয়েও অনেক ঝামেলা হয়েছে কিন্তু নেতাজির ইচ্ছা বলে কথা! পাল্টে গেছে সবকিছু।
এই নওজের আলীর শিক্ষা বহু ওপরে সুলায়মান মিয়ার তুলনায়। বিএ পাস দিয়ে বেশ কিছুদিন বেকার ছিল। ঘুরে বেড়িয়েছে এলাকায়। তবে সক্রিয় ছিল রাজনীতিতে। এতে ভর করেই চাকরিটা বাগিয়ে নেয়। ক্যান্ডিডেট অনেকেই ছিল নওজের আলীর চেয়েও শিক্ষা-দীক্ষায়, সামর্থ্যে-জ্ঞানে অনেক এগিয়ে।
—কিতা মিয়া নওজের, অত চিন্তা করো কিতার লাইগ্গা? চিন্তার কুস্তা নাই। চাহরি অইব দেক্বা। খালি নেতারে খুশি করণ লাগব। ফারতা না নাকি তা?
—কিতা যে কইন বাই। ফারুম। আফ্নে খালি চাহ্রির বেবস্তা করয়ইন।
নেতাকে খুশি করার ইঙ্গিত নওজের বুঝলেও কততে নেতা খুশি হয় তা ঠাহর করতে পারে না। ফলে তাকে যেতে হয় নেতার খাস লোকের কাছে। চূড়ান্ত দফা রফায় নেতার খাস লোক খুশি হয়, তার মানে নেতা খুশি হয়। ফলে নওজের আলীর জব হয় বিজয়নগর হাই স্কুলের কেরানির পদে।
চার.
—চাচা, আমার বড় মাইয়ারে কেরানির ফোস্টে চাহরিডা দিলে বড় উফকার অইতো।
—তোমার মাইয়া কেরানিগিরি করব? ইডা কোন কতা কইলা সুলায়মানের বৌ?
—না চাচা, আফাদত একটাতে ডুকলে ফরে অন্য চাহরি ফাইলে যাইবগা। চাহরির যা আকাল!
—ঠিহাসে। আমার যথাসাধ্য চেষ্টা তাক্ব তোমার মাইয়ার জইন্য। সুলায়মান মিয়ার মাইয়া এই চাহরি ফাইতনা ত কেডা ফাইত? চিন্তা কইর না। বাড়িত যাওগা।
স্কুল কমিটির সভাপতির কথায় সুহাসিনী বেগমের চিন্তা কি স্থির থাকে? প্রতিদিন নতুন নতুন সংবাদ আসে। কে বা কারা যেন চাকরি বাগিয়ে নিয়ে গেছে। আগে থেকেই নাকি সব ঠিক ঠাক করা আছে। ইমুকের চাকরি হবেই। তমুকেরটা পুরা কনফার্ম। এই যে পরীক্ষা, ভাইভা কেবল আইওয়াশ। সুহাসিনী বেগম ভাবে, মেয়ের এই চাকরিটা না হলে যে আর চলে না সংসার। স্বামীহীনা নারী, এর বেশি কী বা করতে পারে? তার তো আর সেই ক্ষমতা নেই যে নেতাদের সঙ্গে দু’কথা বলতে পারে মেয়েটার চাকরির ব্যাপারে। তবু বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে গিয়েছিল এমপির কাছে, আশ্বাসও পেয়েছিল। কিন্তু শেষে চাকরিটা হয়নি। অতপর সে বছরই সব গুটিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায় সুহাসিনী।
নীলাম্বরী নিলু তখন এমএ পড়ছে। বাংলায় অনার্স করেছে ভালো ফল নিয়ে। কেরানি বাবা সততার যে বুনিয়াদটা গড়ে দিয়েছিল মেয়ের জীবন নিজ হাতে, সেটাতে ভর করে যেন সর্পিণীর মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখছে সে। শেখাচ্ছে ছোট বোনদের। যে সুহাসিনী বেগম একদিন টনটনে ছিল আত্মসন্মানবোধে, সেও মেয়ের কাছে নুইয়ে পড়েছে। মেয়ের শত নিষেধকে উপেক্ষা করে, সুহাসিনী বেগম ধরনা দিয়েছে এর-ওর কাছে।
পাঁচ.
বিজয়নগর হাই স্কুলের বার্ষিক ইন্সপেকশন। এই থানার অধীনে বদলি হওয়া নয়া অফিসার ইন্সপেকশনে আসছেন। গত কয়েকদিন ধরে স্কুলের কর্মচারী-শিক্ষকদের মধ্যে প্রচণ্ড ব্যস্ততা লক্ষ করা গেছে। প্রতি বছর ইন্সপেকশনের শুরুতে হালকা তোড়জোড় শুরু হয়। এবছর একটু বেশি।বিগত বছরের ফাইলপত্র রেডি করা, অ্যাকাউন্সের হিসাব-নিকাশ ঠিকঠাক করা-কেরানি নওজের আলীর পোয়াবারোটা বাজছে। প্রধান শিক্ষক সজল আশফাকের চওড়া কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হচ্ছে সকাল থেকেই। শুনেছেন, অসম্ভব জেদি মহিলা এই অফিসার। কোনো গোঁজামিলের সুযোগ নেই। পান থেকে চুন খসলেই নাকি শাসিয়ে যান আচ্ছা করে।
সজল আশফাক নিজে সবকিছু দেখাশোনা করছেন। তিনি কারও ওপর ভরসা করতে পারছেন না। প্রতিটা ফাইল ঘেঁটে লাইন বাই লাইন চেক করছেন—ফাইনাল চেক। বানান থেকে শুরু করে বাক্য ব্যাকরণসিদ্ধ হয়েছে কি না, দেখে নিচ্ছেন। অ্যাকাউন্সের হিসাব মেলাচ্ছেন ক্যালকুলেটর টিপে টিপে। বিগত বছরের হিসাবের কোথায়, কতখানি গরমিল তিনি জানেন। ভাবছেন, কিছু একটা বুঝিয়ে এ যাত্রায় যদি পার পাওয়া যায়।
সমস্ত কাজ গুছিয়ে এনেছেন দুপুরের আগেই। এখন সরকারি গাড়ির অপেক্ষায় স্কুলের বারান্দায় পায়চারী করছেন সজল আশফাক। এতক্ষণে অফিসার পৌঁছে যাওয়ার কথা কিন্তু দেরি হচ্ছে। পিয়ন বিশু মণ্ডল ব্যস্ত আছে আপ্যায়নের মেনু সাজাতে। রহম শেঠকে পাঠানো হয়েছে দুপুরের খাবার নিয়ে আসতে। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টারের বাড়িতে রান্না হয়েছে।
অপেক্ষার প্রহর বাড়ছে, সজল আশফাকের চিন্তাও বাড়ছে। একসময় তিনি দেখতে পেলেন, একজন মহিলা রোদ মাথায় নিয়ে মাঠ কোণাকুণি হেঁটে আসছেন অফিসের দিকে। সঙ্গে অবশ্য দু’জন লোক রয়েছে। মহিলার পরনে সাদামাটা শাড়ি।
—এক্সকিউজ মি, আমি ইন্সপেক্টর নিলু।
—আস্সালামুআলাইকুম ম্যাডাম। আমি সজল আশফাক। প্রধান শিক্ষক। ভেতরে আসুন ম্যাডাম।
মহিলার বয়স ৩৮/৪০ শের কাছাকাছি। মেদহীন পাতলা গড়ন। অতি সাধারণ বেশভূষা। চোখ থেকে রোদ চশমাটা নামিয়ে টেবিলে রাখলেন নিলু। শরবত এলো—তরমুজ এলো, আপেল-কমলার কোয়া এলো—কিছুই মুখে তুললেন না তিনি। কেবল পানির গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়ালেন।
ইন্সপেকশন শেষে নিলু যখন ফিরতি পথ ধরলেন তখন পর্যন্ত বিকেল স্কুল মাঠের পশ্চিম পাশের জাম-কড়ই গাছের পাতার ফাঁক গলিয়ে বিকেলের রোদেরা তখন মরা ঘাসে খেলা করছে। নিলুর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। বাবার কবরটা অনেকদিন দেখা হয়নি, মেরামত করাও জরুরি হয়ে পড়েছে বোধ হয়—দেখা দরকার—সেই উদ্দেশ্যে তিনি স্কুল মাঠ পেরিয়ে হরিৎপুরের দিকে হাঁটা দেন।
প্রথম সহকারী: ম্যাডাম, এদিকে কোথাও যাবেন নাকি?
নিলু: হ্যাঁ, একটু হরিৎপুর যাব ভাবছি।
দ্বিতীয় সহকারী: গাড়িটা আনতে বলি, ম্যাডাম?
নিলু: না না, গাড়ি আনতে হবে না। আমি হেঁটেই যাব।
সজল আশফাক: ম্যাডাম, আপনি বোধহয় জানেন না, হরিৎপুর পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে না।
নিলু: কেন?
সজল আশফাক: একে তো রাস্তার বেহাল দশা। জায়গায় জায়গায় ভাঙা। শুকনোর দিনেই খুব কষ্ট করে হেঁটে মানুষজন যাতায়াত করে। আপনি তো আর এতটা দূরত্ব হেঁটে যেতে পারবেন না!
নিলু মুচকি হাসেন। ভাবছেন, ওরা কি জানে স্কুল শেষে বাবার সঙ্গে সে প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে হরিৎপুর গেছে? বাবাও তো প্রতিদিন এ পথেই যাতায়াত করলেন সারাটা জীবন।
নিলু: আশফাক সাহেব, আমাকে একটা উপকার করবেন?
সজল আশফাক: জি জি, বলুন ম্যাডাম।
নিলু: আমাকে একটা কালো ছাতা আর একটা তিন বাটির টিফিন ক্যারিয়ার দিতে পারবেন দয়া করে?
হঠাৎ এরকম আব্দারে সজল আশফাকসহ পুরো গ্রুপটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে নিলুর দিকে। অশ্রু ঢাকতে নিলু রোদচশমাটা চোখে তোলেন। সহকারীরা বলে, চলুন হাঁটি।