এক.
ঢাকায় একটা আর্ট গ্যালারিতে তরুণ চিত্রশিল্পীদের চিত্রকর্ম প্রদর্শনী হচ্ছে। শিল্পবোদ্ধাদের ভিড়, এদিকে বেশ জটলা। তার মধ্যে কেউ একজন আলো ছড়াচ্ছেন; সুশ্রী, সুনয়না। পরনে জলপাই রঙের শাড়ি, কপালে কালো টিপ, ওষ্ঠের ওপর এক বিন্দু তিল। তিনি দুটো ছবি এঁকেছেন, তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন চির সবুজ গ্রাম বাংলা। দুবার চোখাচোখি হতেই, কাছে গিয়ে বললাম, এর চেয়েও ভালো আঁকেন আপনি। এত নিপুণ করে এঁকেছিলেন, সেই ছবিটা!
কোন ছবিটা?
ওই যে…
বরুণার বুকে আতরের গন্ধ নেই, তবু দেহে আছে উত্তাপ।
মুখে ধেনো মদের গন্ধ, উন্মত্ত মাতাল বকে যায় প্রলাপ।
স্যরি। আমি এমন কিছু কখনোই আঁকিনি।
তাহলে ওই ছবিটা?
কোনটা?
ওই যে,
রক্তের ভেতরে ঢুকে গেলো মসৃণ এক ছুরি
বিষাদে কেঁদে উঠলো ক্ষত-বিক্ষত স্বপ্নগুলি।
স্যরি। এমন কিছুও আঁকিনি আমি। তাছাড়া আপনি যা বলছেন, তা আঁকা আদৌ সম্ভব কি না, জানা নেই আমার।
রঙ তুলি দিয়ে মানুষ আঁকতে পারে কেবল বাহ্যিকতা
কিন্তু যা বিমূর্ত, দেখা যায় না, তা তো মনের মধ্যে আঁকা।
স্যরি! আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না কিছুই।
রমণী তো চিরকালই না বোঝার অভিনয় করে!
কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন স্যুট পরিহিত এক ভদ্রলোক। এগিয়ে এসে বললেন, দেখুন, ইনি একজন শিল্পী।
তাই? আমি ভেবেছিলাম অভিনেত্রী।
আমার মনে হয়, সভ্য মানুষ হলে কিছু ভদ্রতাজ্ঞান থাকা উচিত।
হেসে বললাম,
আঁতুড় ঘরে আজকাল পশু জন্মায়
ধরার বুকে মানুষ নাকি বিলুপ্তপ্রায়?
ভদ্রলোক কী বলবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না, কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ আমার পেছনে এমদাদ ভাই এসে দাঁড়ালেন, এসব কী হচ্ছে অরণ্য? আমার হয়ে এমদাদ ভাই ক্ষমা চেয়ে নিলেন।
গ্যালারি থেকে বেরিয়ে এসে সিগারেট ধরিয়ে এমদাদ ভাইকে বললাম, কে যেন বলেছিল হুটহাট ক্ষমা চাওয়াটাও নাকি একালে স্মার্টনেস। এমদাদ ভাই হেসে বললেন, অরণ্য চৌধুরীর সমার্থক শব্দ বাঁদরামো, রমণীর কাছেও নাকি সেটা কখনো কখনো উপভোগ্য! কিন্তু বেচারা স্বামী উপস্থিত সেখানে, এসব মানবে কেন?
এরা দম্পতি?
তবে নয়তো কী?
একদম মানায়নি।
হু, তবে চিত্রশিল্পী দারুণ সব ছবি আঁকেন, নাম দীপ্তি।
আর তার সোয়ামি?
পয়সাওয়ালা, করপোরেটে বেশ নামডাক তার।
আচ্ছা। তা ব্যস্ত মানুষদের আর্ট গ্যালারিতে কী কাজ?
সুন্দরী বউকে পাহারা দেওয়া।
হা হা হাহ! আমারই কেবল চৌকিদারের চাকরিটা নেওয়া হলো না।
বেশ আছো ভায়া। তা হঠাৎ এদের পেছনে লাগতে গেলে কেন?
এত সুন্দর ফুল; তার কাঁটার বিষ না জানি কত না বেদনাবিধুর! ওই একটুখানি পরখ করার বাসনা হয়েছিল।
তা পরখ করে কী পেলে?
আগাছা আগলে রেখেছে, কাঁটার মুখ তাই লুকিয়ে আছে।
হাহাহা। অরণ্য বদলালে না তুমি।
এমদাদ ভাইয়ের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে শিল্পকলার মূল ফটকে, দুজনেই উঠে যাব। পেছন থেকে মলিন চেহারার অল্পবয়সী এক মেয়ে ডেকে বললো,
আপনি অরণ্য চৌধুরী?
জি।
একটা চিরকুট আমার হাতে গুঁজে দিয়েই মেয়েটি দ্রুত চলে গেলো। খুলে দেখি, এক টুকরো কাগজে একটা ফোন নাম্বার আর তাতে চিত্রশিল্পীকে ফোন দেওয়ার ছোট্ট আহ্বান। এমদাদ ভাই রেগে গিয়ে বললেন, সব কিছুতেই যেন তোমার রহস্য! এ ভারী অন্যায়! তোমাদের মধ্যে নিশ্চয় কোনো সম্পর্ক আছে! আমার প্রতি এমদাদ ভাইয়ের অভিযোগ শেষ হলে জোর করে একটুখানি হাসার বৃথা চেষ্টা করলাম মাত্র। এছাড়া আর কী-ই বা বলার আছে আমার! মনে পড়ে গেলো প্রথম যৌবনের তিক্ত মধুর দিনগুলো, ফেলে আসা জীবনের দুঃসহ সব স্মৃতি!
দুই.
তখন আমার সবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু। কিন্তু সেই শুরু ঠিক শুরুর মতো ছিল না। ভর্তি হয়েই কেমন যেন নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলাম সবকিছু থেকে, সারাদিন জীবনানন্দের কবিতায় বুঁদ হয়ে থাকি, অনিয়মতান্ত্রিক জীবনে কখন যেন রুদ্রকেও ভালোবেসে ফেলেছি। বন্ধু আমার তেমন নেই বললেই চলে, ইচ্ছে হলে ক্লাসে যাই, আবার হয়তো দেখা গেলো দুই চার সপ্তাহ ওদিকের পথই মাড়াই না। এভাবেই দেখতে দেখতে আমার স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষ শেষ হয়ে গেলো। ফাইনাল দেওয়ার পর আমার দুই সপ্তাহের ছুটি, একঘেয়েমি জীবন ভালো লাগছিল না তখন। ছুটে এলাম রাজশাহীতে, ছোট খালামণি তখন খালুর চাকরির সুবাদে এখানে একটা ভাড়া বাসায় থাকে। দোতলা বাসা, নিচের তলায় খালামণি ভাড়া থাকেন; ওপরের তলায় বাড়িওয়ালা।
সময়টা বৈশাখের মাঝামাঝি। সারাদিন প্রচণ্ড দাবদাহ, সন্ধ্যার পর ভ্যাপসা গরম। প্রথম দিনেই বিরক্তি এসে গিয়েছিল—কেন এলাম? সেদিন সন্ধ্যার পর আমি ছাদে এসেছি একা; খালামণিকে হাওয়া খাওয়ার অজুহাত দিয়ে। উদ্দেশ্য আরও ছিল, সুযোগ বুঝে একটা বিড়ি ফুঁকে নেওয়া। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সিগারেট ধরিয়ে আয়েশ করে কেবল দুটো টান দিয়েছি, ওমা! পাশেই দেখি এক নারীমূর্তি। অন্ধকারে অবয়ব বোঝা গেলেও, চেহারা দেখা যায় না। মুহূর্তেই সিগারেট ফেলে দিয়ে আমি সুবোধ ছেলে, শুষ্কমুখে জোর করে একটুখানি হাসলাম। আমার সে হাসি অন্ধকারে মেয়েটির চোখে গিয়ে যে পৌঁছবে না, এই বোধটুকু তখন নেই আমার। শুরু হয়ে গেলো জেরা।
কে আপনি?
অরণ্য।
আরে! এ তো লোকালয়। জঙ্গল কোথায় পেলেন?
জি, আমার নাম অরণ্য। নিচের তলায় খালা থাকেন, বেড়াতে এসেছি।
আর ছাদে এসেছেন বিড়ি ফুঁকতে?
কী করব? বদ অভ্যাস আছে।
তা ফেলে দিলেন কেন?
ভয় পেয়ে।
ভয়ের কিছু নেই। বাড়িওয়ালার একমাত্র মেয়ে, অনুমতি দিচ্ছি। আবার ধরান।
আর নেই আমার কাছে।
আহারে! তা কী করেন আপনি?
হাওয়া খাই।
আরে! কাজকাম?
কিছু নাই।
আপনাকে জঙ্গল বলেছি বলে কিছু মনে করেছেন? দুঃখিত। আমি দীপ্তি।
মিথ্যে কথা।
মানে?
চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাড়া আর তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
হাহাহা। যখন দেখবেন, তখন কিন্তু চোখ ঝলসে যাবে।
ভয় নেই, আমার দিনকানা রোগ আছে।
বাব্বাহ! নারীর দিকে চোখ মেলে না তাকানোর, এত অহঙ্কার?
এ তো একমাত্র অরণ্যকেই মানায়; সূর্যের দীপ্তিও যেখানে পৌছে যেতে বাধা পায়।
সকাল হলেই না আবার দীপ্তির দীপ্তিতে মিথ্যে সব অহঙ্কার ধুলোয় মিশে যায়!
সেই রাতে ঘুম এলো না চোখে। দীর্ঘদিন বন্ধুহীন থাকার দরুনই হোক কিংবা যৌবনের উচ্ছৃঙ্খলাকে প্রথম প্রশ্রয় দেওয়ার বাসনা থেকেই হোক, কেবল সকাল হওয়ার প্রতীক্ষা। মনের মধ্যে সেই মেয়েকে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষাও তৈরি হয়ে গেলো। কেমন সে মেয়ে? কতটা সুন্দর? আমাকে কি তার রূপে মোহিত হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলো কথার ছলে? আরও কত কী ভাবলাম! নির্ঘুম রাত শেষে শিথানের জানালা খুলে দিলাম, আলো রঙ সকাল এসে ছুঁয়ে গেলো আমায়। কিন্তু প্রেম এ যে যন্ত্রণারই আরেক নাম, এই উপলব্ধিটুকু আমার জীবনে কখনোই হতো না সে দিনটা না এলে। সেই সকালে আমি ছটফট করে মরলাম, কতবার বাসার ছাদে উঠলাম নামলাম, এদিক-ওদিক উঁকিঝুঁকি মারলাম। না কোথাও নেই সেই সুন্দরী! তখন তো আর জানতাম না এই আলালের ঘরে দুলালীর সকাল শুরু হয় দুপুর নাগাদ!
রাজ্যের হতাশা নিয়ে বেরিয়ে এলাম বাসা থেকে। দুপুর অবধি চষে বেড়ালাম পুরো শহর কিন্তু মন পড়েছিল বাসাতেই, ছাদে। তবু এক রকমের কষ্ট বুকের মধ্যে চেপে শেষ বিকেলে বাসায় ফিরে এলাম। রুদ্রের কবিতার এই লাইনই মনে পড়ছিল সেদিন সবচেয়ে বেশি, এত সহজেই ভালোবেসে ফেলি কেন!
খালামণির বকা খেয়ে কেবল রুমে এসে শরীর এলিয়ে দিয়েছি বিছানায়,দেখি টেবিলের ওপর রেপিং কাগজে মোড়ানো একটা প্যাকেট। আমার বছর সাতেকের পুঁচকে ভাই সায়রকে ডেকে বললাম, এটা কে দিয়ে গেছে রে? কাকে? ভাইটা আমার কানে কানে বলল, দীপ্তি আপু তোমাকে!ওর কথা শুনে হেসে ফেললাম! যেন ও আমার কথা আমাকেই গোপন করছে। রেপিং খুলে দেখি বেনসন অ্যান্ড হেজেস এক প্যাকেট! সঙ্গে ছোট্ট একটা চিরকুট। তাতে লেখা,
কাল ঘুম হয়নি আমার সারারাত
বুকের মধ্যে যে কি তোলপাড়
মনে হলো দুমড়ে গেছি ঝড়ে
এ আমি পড়েছি কার খপ্পরে?
সেই চিরকুট নিয়ে ছুটে এলাম ছাদে, একদৌড়ে। মাঝেমাঝে নিজের চোখকেও এত অবিশ্বাস হয়! আমার সামনে লাল শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে যে নারী, সে মানবীই নয়; ঠিক যেন লাল পরী। বললাম,
আপনিই দীপ্তি?
জি। আপনাকে কাল সকালেই দেখেছিলাম আমি, যখন বাসায় এলেন। আমি এখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর তারও আগে আপনার কত গল্প শুনেছি আন্টির মুখে। আর রাতেও পেয়ে গেলাম কায়দামতো।
আর এইটুকুতেই শুরু হলো পাগলামো? রাতের ঘুম হারিয়ে গেলো?
পাগলামো তো আপনি করবেন এখন থেকে, আমাকে পাওয়ার জন্য!
একটুও না। চোখ ঝলসাবে তো দূরের কথা, পছন্দই হয়নি।
তবে এক বিকেল খরচ আমি কেন সেজেছি?
তার আমি কী জানি!
ধ্যাত!
দীপ্তি ধ্যাচাং মেরে চলে গেলো। হেসে ফেললাম আমি! মনে পড়ে গেলো চণ্ডিদাসকে,
গোপন পিরীতি গোপনে রাখিবি
সাধিবি মনের কাজ।
সাপের মুখেতে ভেকেরে নাচাবি
তবে ত রসিক রাজ।।
তিন.
মাঝেমাঝে জীবন যেন গল্পের মতো। অল্প সময়ের মধ্যেই দীপ্তির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হলো। আর্ট কলেজে পড়ুয়া এই মেয়েকে তখন যতই দেখছি, ততই যেন ডুবে যাচ্ছি প্রেমে; বিভোর থাকছি দীপ্তির আবেশে। সেদিন দুপুরে বাসায় আমি একা, পুঁচকে ভাইটাকে নিয়ে খালামণি স্কুলে, খালু অফিসে। দীপ্তি চলে এলো আমার রুমে।
শরীরের চেয়ে বড় কোনো ভাষা নেই আর এই সহজ সত্যটা দীপ্তি কত সহজে সেদিন বুঝিয়ে গেলো আমাকে। এক জোড়া স্থির চোখ আমাকে দেখছে, ভেজা ঠোঁট কাপছে। কত কি যে আমাকে বোঝাতে চাচ্ছে মেয়েটি, কিছু না বলে। জানি না সেদিন কি হয়েছিল আমার, নিজের বুকেও উঠলো ঝড়। এ ঝড়ে নিমিষেই যেন সব তছনছ। বললাম, শোনো মেয়ে, নারীর প্রতি পুরুষের সহজাত দুর্বলতা আছে। তোমার ওষ্ঠের ওপর এক বিন্দু তিল, ছুঁয়ে দেখার সাধ কার না জাগে?
ছুঁয়ে দাও না তবে। তোমায় বাধা দিয়েছে কে?
মনে আগুন ছিল, সে আগুন ছড়িয়ে গেলো শরীরেও। আর এও তো অজানা নয় এই আগুন নেভাতে পারে কেবল আরেক শরীর। দুটো শরীরই তখন এক, অভিন্ন। দিশা হারিয়ে কখন ভুলে গেছি পাপপুণ্য!
যখন এই ঝড় থামলো দীপ্তির চোখে জল; এ জল ছুঁয়ে আমি শুদ্ধ করে নিলাম নিজেকে, প্রেমে!
সুখের সময় দ্রুত ফুরায়। দেখতে দেখতে আমার ছুটি শেষ হয়ে এলো, চলে এলাম রাজশাহী থেকে। দীপ্তিকে রেখে এলাম সজল চোখে, কিন্তু সত্যিই কি রেখে এলাম? ও যেন তখন সারাদিন আমার সকল কাজে আমার সঙ্গেই মিশে থাকে, আমার ভালোমন্দ দেখে। এত কম সময়ে এত বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওকে, যার প্রতিদান দিতে হলো শুধুই চোখের জলে।
আমাদের সম্পর্কের বয়স তখন দুই মাসের কাছাকাছি, এমন একটা সময়ে এসে দীপ্তি হঠাৎ যোগাযোগ ছেড়ে দিলো। ফোন বন্ধ। মেইল করলাম, রিপ্লাই নেই। মনের মধ্যে অস্থিরতা নিয়ে ছুটে গেলাম রাজশাহীতে। চমকে উঠলাম দীপ্তিকে দেখে। আমি যে দীপ্তিকে দেখছি, তাকে যেন আগে কখনো দেখিনি। কালবৈশাখী যেমন লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যায় লোকালয়, দীপ্তিও যেন ঠিক তেমনি। কিন্তু আমি তখনো জানি না ভূমিকম্পের চেয়ে বড় কোনো দুর্যোগ অপেক্ষা করছে আমার জন্য। জানতে চাইলাম,
কী হয়েছে তোমার দীপ্তি?
আমি দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা অরণ্য।
আমার যেন পায়ের তলায় মাটি সরে গেলো। বললাম, সব দোষ আমার। আমি দায়িত্ব নিতে রাজি আছি।
কিন্তু আমি তোমাকে দায়িত্ব নিতে বলছি না।
মানে?
অবিবাহিত একটা মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা। তুমি তার কী দায়িত্ব নেবে? বিয়ে করবে? বিয়ে করলেই সব অপবাদ ঘুচে যাবে? আমি আমার বাবা-মায়ের কাছে কী বলব? তুমিই বা কী জবাব দেবে? আর আমার বাবা-মা কেন আমাকে তোমার মতন চালচুলোহীন ছেলের কাছে বিয়ে দেবে?
তাহলে কী করতে চাও তুমি?
অ্যাবরশন।
অসম্ভব! আমি আমার সন্তান চাই দীপ্তি। এ আমারই অখণ্ড সত্তা, তুমি এটা কিছুতেই করতে পারো না।
দেখো এটা বাস্তবতা। এছাড়া আর কিছুই করার নেই।
আছে। তোমাকে নিয়ে যাব আমার সাথে।
এ হয় না অরণ্য। তোমাকে ভালোবেসেছি সত্য কিন্তু তাই বলে আমি আমার বাবা-মা ছেড়ে তোমার সাথে চলে যেতে পারি না ভবিষ্যৎ জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে। তোমার নিজেরই তো পড়াশোনা বাকি আছে, তুমি আমাকে কী করে চালাবে? তাছাড়া আমার বাবা-মাই তো আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।
আর আমি ভালোবাসি আমার অনাগত সন্তানকে।
তুমি পাগলামো করো না, বাধা দিও না আমাকে।
গর্ভপাত মানে ভ্রূণ হত্যা আর এটা খুনেরই নামান্তর দীপ্তি।
দেখো বিশ সপ্তাহের আগে গর্ভপাত বেআইনি নয়। এছাড়া একে আমিই ধারণ করেছি, গর্ভপাত মায়ের অধিকার।
পৃথিবীর কী অদ্ভুত নিয়ম! তুমি ধারণ করেছো বলেই সব অধিকার শুধুই তোমার? আমার দাবি নেই কোনো? এছাড়া মানবিকতা, মায়া, মমতার চেয়ে যেন আইনটাই বড়!
তুমি একে কী পরিচয় দিয়ে বড় করে তুলবে? বিবাহবহির্ভূত দৈহিক সম্পর্কের ফসল হিসেবে? মানুষজন কী বলবে?
এই সম্পর্ক তো হয়েছিল আমাদের কিন্তু তার জন্য একে কেন খেসারত দিতে হবে? আর বিয়ে? সামাজিক এই চুক্তিটা কি একটা জীবনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ?
অরণ্য জীবন কখনো কখনো যুক্তি দিয়ে চলে না, সামাজিক রীতিনীতি আমাদের মেনে চলতেই হয়।
কিন্তু সেই রীতিনীতি, প্রথা, সামাজিকতাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমরা যেন কখনো কখনো অমানুষ হয়ে উঠি, নিজেদের অপকর্ম আড়াল করতে আমরা যেন পশুর চেয়েও অধম হয়ে যাই। মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, শিল্প, সাহিত্য আমাদের মুখোশ বটে, আমরা ভেতরে ভেতরে এখনো রয়ে গেছি বর্বর, অসভ্যতার যুগে। সংস্কারের মুখোশে আমরা এখনো বাস করি অন্ধকার যুগে।
অরণ্য যুক্তিতে আমি পারব না, সে চেষ্টাও করব না। আমাকে ক্ষমা করো তুমি। তোমার কথা আমি রাখতে পারব না, ভেবে দেখেছি কোনোভাবেই সম্ভব না।এর পরে তুমি আমাকে গ্রহণ করবে কিনা, তোমার ওপরই নির্ভর করছে সেটা।
এই দুঃখের সময়ও তুমি হাসালে। সত্যিই সারাজীবন দেখেও আমাদের মানুষ চেনা হয় না। আর দু মাস দেখে তোমাকে চেনা? যে নিজের অখণ্ড সত্তাকেই ভালোবাসতে জানে না, তার কাছে ভালোবাসা চাওয়া? সবই ছিল শুভঙ্করের ফাঁকি, সব ফাঁকি।
তারপর?
দশ বছর পর আজ আবার দেখা দীপ্তির সঙ্গে। এই দশ বছরে ওর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। আমার হাতে নতুন এক চিরকুট;যে চিরকুট মনে করিয়ে দিচ্ছে আমাকে দেওয়া ওর দশ বছর আগের সেই চিরকুটের কথা। হঠাৎ কেঁপে উঠলাম ভয়ে, আর একটা চিরকুট মানেই কি আর একটা গর্ভপাত? আর একটা হত্যা?