যেকোনো উচ্চতা নিয়ে আমার তীব্র ভীতি আছে। পাহাড়, টিলা, ব্রিজ, সাঁকো থেকে শুরু করে দোতলা বাসে পর্যন্ত আমি উঠতে পারি না। আমার অস্থির লাগে, দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয় এখনই খুব খারাপ কিছু ঘটবে এবং এরপর আমি অন্ধকার কোনো জগতে নিমজ্জিত হব। শুধু তাই নয়, যেকোনো ধরনের নতুন সম্পর্ক, সম্পর্কের দায়িত্ব আমাকে আতঙ্কিত করে ফেলে। আমার জগৎ খুব ছোট। সেখানে আমার বাবা-মা বাদে নতুন কোনো সম্পর্ক নিয়ে আমি ভাবি না। আমার তেমন কোনো বন্ধুও নেই। সঙ্গ প্রয়োজন হলে আমি রাতে সিনেমা ছেড়ে ঘুমাই। সিনেমার শব্দ, কথোপকথন আমার জন্য ‘সফট নয়েজ’-এর মতো কাজ করে। ঘুম ভালো হয়। কোথাও যাওয়ার পথে আমি কানে ইয়ারফোন গুঁজে দেই, গান শুনি। ট্রেনে অধিকাংশসময় বই পড়ি। ঘরে একা থাকার সময় গিয়ার ভিয়ারে থ্রিডি সিনেমা দেখি। আমার প্রতিটি মুহূর্তকে ব্যস্ত রাখতে আমি প্রযুক্তি অথবা বইয়ের কোনো না কোনো সাহায্য নেই। আমি একটা বিদেশি ফার্মে কাজ করি, সেখানেও খুব প্রয়োজন না পড়লে আমাকে কেউ ঘাঁটায় না। শুধু নিজের কাজ নিয়ে আমি অত্যন্ত সচেতন বলে আমি এই সুবিধাটুকু অর্জন করতে পেরেছি। এছাড়া, আমি সবার আগে অফিসে পৌঁছে যাই এবং বেশিরভাগ সময়ই সবার পরে অফিস থেকে বের হই। হয়তো পরোক্ষভাবে সেটাও একটি কারণ।
আজ আমার জন্য গতানুগতিকতার বাইরের একটি দিন। যদিও আমি এমন দিনের অভিজ্ঞতা আগে বেশ কয়েকবারই পেয়েছি। তবু প্রতিবারই আমার মনে হয়েছে, একই দিনে কেউ আমাকে পাহাড়, ব্রিজ, বহুতল ভবন থেকে শুরু করে সমস্ত উচ্চতা থেকে ফেলে দেওয়ার জন্য ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এমন দিনগুলোতে আমি অদ্ভুত এক আঁধারে ঢেকে যাই। আমার মধ্যে পৃথিবীর শেষ স্টেশন এর সর্বশেষ গাড়িটা ধরার মতো তাড়া কাজ করতে থাকে। মাথার ভেতরে ভোঁতা একটা যন্ত্রণা দানা বাঁধে। আমি মনে মনে পাবলো নেরুদার সনেটের দুই-এক লাইন আউড়ে ফেলি। অবশ্য একটা ভুল তথ্য দিয়ে ফেলেছি। সব সম্পর্ক আসলে আমাকে অন্য উচ্চতাভীতিতে নিয়ে যায় না। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গান ও সিনেমা আমার আবেগকে স্পর্শ করতে পারে। সেখানের আবেগ দেখতে বা অনুভব করতে আমি পুলক বোধ করি।
—কী হলো চল? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। ভেতরের ঘর থেকে উচ্চস্বরে বলে ওঠে আমার মা। তার কণ্ঠ শুনে চশমার কাচ মুছতে মুছতে বাইরের ঘরে এসে হাজির হয় আমার বাবা। আমি আমার দুঃখময়তা হাতে করে নিয়ে নিঃশব্দে তাদের পিছু নেই। আমার নিজেকে কাকতাড়ুয়ার মতো লাগে। নিজেকে দীনহীন এক কবির মতোও লাগে, যার হয়তো অন্য কোনো নক্ষত্রে জন্ম নেওয়ার কথা ছিল।
উবারে উঠে আমি চালকের পাশের সিটে বসি। আমার মনে হয় আজ যেন আমার স্কুলের প্রথম দিন। নিয়ম বেঁধে আমাকে পোশাক পরিয়ে, ব্যাগ চরিয়ে স্কুলে পাঠানো হচ্ছে। আমি চাই কিংবা না চাই আজ আমাকে যেতেই হবে। উবারের ভেতরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাতাসে আমার কেমন যেন দম বন্ধ বন্ধ লাগে। এক্রোফোবিয়া, এনথ্রোপোফোবিয়ার সঙ্গে সঙ্গে কি তবে আমার ক্লাসট্রোফোবিয়াও সঙ্গী হয়ে গেল? নিজের জন্য আমার নিজেরই কেমন যেন দুঃখ বোধ হয়। আমার আবার স্কুলে যাওয়ার কথা মনে হয় সেই সঙ্গে মনে পড়ে ওরহান পামুকের স্কুলজীবন নিয়ে লেখা একটা গ্রন্থের কথা। সেখানে একটা ‘আমি’ চরিত্র থাকে। যে স্কুলে যেতে চায় না। চায় না কারণ, তার খুব ঘুম পায়, সে ভয় পায়, অন্য শিশুরা তার পথ আটকায়। সে আকাশ দেখে। মেঘ দেখে। গাছের ছবি আঁকে, পাতাহীন গাছের ছবি। তার খুব একলা লাগে। তার গাল বেয়ে কান্না নেমে আসে। একসময় সে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি বাইরের কোনো একটি মেঘ হতে চাই। ইরেজার, নোটখাতা আর কলম, এগুলো সব মুরগিকে খাইয়ে দাও।
খুব হাস্যকর কথা। খুব। অথচ আমি জানি এই লেখা পড়ে আমি নিজেকে কতবার খুঁজে পেয়েছি। কতবার ক্ষণিক জোনাকির মতো জেগে উঠে দপ করে নিভে গিয়েছি। আজ কেমন দিন? আজ কি আমার জ্বলে ওঠার দিন না কি নিভে যাওয়ার? আমি জানি না। আমি কিচ্ছু জানি না।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর আমরা গন্তব্যে পৌঁছাই। যেখানে এসেছি সেটা বেশ পুরানো লাল ইটের দোতলা বাড়ি। ঝুল বারান্দা আর বাইরের দরজা অজস্র মানিপ্ল্যান্ট গাছে ছেয়ে আছে। গাড়ি থেকে নেমে মা আমার কাছে এসে আলতো স্বরে বলেন, এবারের মেয়েটিকে অন্তত ভালো মতো দেখিস। নিজ থেকে কিছু কথা বলিস। প্রতিবারের মতো আর বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে চাই না।
আমি মায়ের কথার উত্তর দেই না। ঘাড় তুলে ছাদের হালকা সবুজ রঙের রেলিং-এর দিকে তাকিয়ে থাকি। ব্যাপারটা এমন, যে মানুষ যা পছন্দ করে না, তা যদি তার সঙ্গে বারবার হতেই থাকে, একসময় সে খুব ভাবলেশহীন হয়ে যায়। যেমন আমি একটা সিনেমায় দেখেছিলাম, এক দম্পতি একে অন্যকে ঝগড়ার সময় প্রতিবারই ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলতো। এবং প্রতিবারই এই কথা বলার জন্য তারা দুঃখ পেয়ে কাঁদতো এবং পরস্পরের কাছে ক্ষমা চাইতো। এভাবে চলতে চলতে এক সময় সত্যি তাদের মাঝে বিচ্ছেদ চলে এলো। সেদিন তারা কেউ কাঁদলো না, কেউ ক্ষমা চাইলো না। জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার এই প্রচলিত কৃত্রিম নিয়ম আমার অপছন্দের শীর্ষে। এখন আর আমার কিছুই যায় আসে না। শুধুই বাধ্যগত ভৃত্যের মতো বাবা মায়ের সঙ্গে আসা ছাড়া। আমি লাল দেয়ালে সবুজ মানিপ্ল্যান্টে ছেয়ে থাকা কিছুটা মলিন বাসার দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে যাই।
আমরা বসার ঘরে শান্ত হয়ে বসে থাকি। আমি একমনে নিজের হাতের রেখাগুলো দেখতে থাকি। মনে মনে নিজের সঙ্গে নিজেকে অদৃশ্যভাবে জড়িয়ে রাখতে চাই। মিনিট কয়েক পর মাঝবয়সী ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলার সঙ্গে সে আসে। আমি একটু মুখ তুলি। গতানুগতিক রীতি অনুযায়ী শাড়ি নয়, বরং ঘরোয়া সালোয়ার কামিজ পরনে। শান্ত অথচ গম্ভীর মুখশ্রী। কিছুটা লম্বাটে ধাঁচ। এটুকু দেখেই আমি চোখ সরিয়ে নেই। তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয় না। সে কথা বলে আমার মায়ের সঙ্গে, বাবার সঙ্গে। তারপর আমি না তাকিয়েও বুঝতে পারি সে আমার দিকে তাকিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কেন যেন বিদ্যুৎ চমকের মতো কেঁপে উঠি এবং প্রচণ্ড বিচলিত বোধ করি। ভেতরে ভেতরে আমার শরীরের প্রতিটি কোষ থর থর করে কাঁপতে থাকে। আমার মনে হয়, আমি হা করে আছি আর কেউ চামচ ভরে ভরে বিষাদ ঢেলে দিচ্ছে আমার মধ্যে। ফোঁটা ফোঁটা কান্না আর হাসি বুনে দিচ্ছে কেউ মাথার ভেতর। অনেক উঁচু একটা গম্বুজ বিশাল বড় দেয়াল তুলে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। আমি জানি দেয়ালের ওপারে যেতে না চাইলেও আমাকে যেতে হবে। আমার কপালে, কানের পাশে, গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। কোথা থেকে যেন একটা অচেনা নির্যাস ছুটে আসে আমার দিকে আর আমি বুঝতে পারি এখন কী হবে!
আমি জেনে যাই মেয়েটির নাম প্রজ্ঞা। সে ইংরেজিতে সঠিকভাবে নিজের নাম লেখে Progma। যা নিয়ে প্রায়শই অনেকে হাসাহাসি করে। তার প্রিয় রঙ সবুজ। প্রিয় ফুল জারুল। অন্য অনেকের মতো সে বৃষ্টি দেখলে আবেগি হয়ে ওঠে না। তার ভালো লাগে ঝকঝকে রোদেলা দিন। আর তার সবচেয়ে পছন্দের বিষয় হলো ‘টর্ট ল’।
তার মা এসে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়, সে সপ্রতিভ ভঙ্গিতে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে ওঠে—‘হ্যালো।’
আমি কাঁপা কাঁপা শরীরে হাত বাড়িয়ে দেই। সঙ্গে সঙ্গেই সে আমাকে এক প্রচণ্ড টানে নিয়ে যায় তাদের সবুজ রেলিং ঘেরা ছাদে। সেই ছাদে আছে অজস্র স্পাইডার লিলি ফুল। সেই ফুল থেকে মৃদুমন্দ ঘ্রাণ ভেসে আসে। আমার হলুদ রঙের এক মধ্য দুপুর পেরিয়ে বিকেলের মেঘের অপেক্ষা করি। পাশের বাসার ছাদে রঙিন ঘুড়ির ভেসে যাওয়া দেখি। প্রজ্ঞা পিঠময় তার ঘন কোঁকড়া চুল ছড়িয়ে ছাদে খালি পায়ে হেঁটে বেড়ায়। আমি হাতে একটা গল্পের বই নিয়ে রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে থাকি।
—আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন। প্রজ্ঞার কথা শুনে আমি চকিত দৃষ্টি দেই। হঠাৎ আমার খুব শূন্য লাগে। চোখের তারায় আকাশের সব বিষণ্নতা এসে জমা হয়। সবকিছু খুব অস্পষ্ট লাগে। দূর বহু দূর থেকে কে যেন বলে ওঠে, তোমরা কথা বলো। আমরা পাশের ঘরে যাচ্ছি।
—আপনি কি খুব কম কথা বলেন?
আমি অস্বচ্ছ একটা ধারণা দেওয়ার মতো করে নিচু স্বরে বলি, ঠিক তা না।
—আপনার মা আপনাকে নিয়ে অনেক গল্প করেছেন ফোনে। এও বলেছেন আপনি বিয়ে করতে খুব একটা আগ্রহী নন। আমি আরও বিব্রত হই। তারপর অপেক্ষা করতে থাকি সে আর কী বলবে, তা শোনার জন্য।
—দেখুন, সরাসরিই বলি। আমি নিজেও আসলে এখন বিয়ে করতে চাই না। পারিবারিক চাপ আর আবেগীয় টানাপড়েনে পড়ে গিয়ে আজকে দেখা করার জন্য রাজি হয়েছি। বিয়ে নিয়ে যদি আপনার নিজের আগ্রহ না থাকে, তাহলে এর চেয়ে আনন্দের সংবাদ আপাতত আমার জন্য আর কিছু নেই। আপনি কি তাহলে বাড়ি গিয়ে আমার ব্যাপারে ‘না’ করে দিতে পারবেন?
কোথায় যেন চুরচুর করে অসংখ্য কাচ ভেঙে পড়তে থাকে। অথচ কোনো শব্দ হয় না। আমার খুব কষ্ট হয় এবং বুক ভেঙে যেতে থাকে। আমি আমার ডান হাতের দিকে তাকাই, সেই হাতে প্রজ্ঞার হাতের স্পর্শ লেগে আছে। আমি দেখতে পাই হাসপাতালে প্রজ্ঞা আমার বাবার হাত শক্ত করে ধরে আছে। আমি আর মা একটু দূরে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদছি। দেখতে পাই কোনো এক শীতের বিকেলে প্রজ্ঞা লন্ডনের টেমস নদীর পাশে গিয়ে আমাকে ফোন করছে। ওখানে খুব ঠাণ্ডা। বরফ পড়ছে। ওর মাথায় বেশ বড় একটা সাদা রঙের উলের টুপি।
—কী হলো? আপনি কি আমার কথায় খুব আহত হলেন না কি?
—ন…না। অস্ফুটভাবে বলি—আপনার ভিসা হয়ে গেছে?
প্রজ্ঞা চমকে যায় কিছুটা। তার লম্বাটে মুখ আরেকটু লম্বা হয়। মুখটা আরেকটু গাম্ভীর্যে আবৃত হয়। সে বলে ওঠে, কিভাবে জানলেন এই বিষয়ে? আমি তো এখনও অ্যামব্যাসি থেকে খবর পাইনি।
—আমি জানি।
—আপনি কি গ্রিক মিথলজির দৈবশক্তি প্রাপ্ত কোনো দেবতা? সূক্ষ্ণ খোঁচার স্পর্শ পাই আমি তার কথায়। এই খোঁচা আমার অনেক পরিচিত মনে হয়। আমি জানি প্রজ্ঞা বিরক্ত হলে তা সরাসরি প্রকাশ না করে সূক্ষ্ণভাবে বলে।
—আপনার…। একটু থামি আমি কথার মাঝে। তারপর আবার শুরু করি—আপনার মায়ের সঙ্গে বেশি মনোমালিন্যে যাবেন না। রাগ করে নিজের চুল কেটে ফেলবেন না।
প্রজ্ঞা আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর বলে, আপনি কি কোনো স্টকার? কী কী জানেন আর? বুঝতে পারি তার কণ্ঠস্বর অসম্ভব শীতল হয়ে উঠছে।
আমি নিজের চারপাশে একটা অদৃশ্য খোলস সৃষ্টি করতে চেষ্টা করতে থাকি। একসঙ্গে এত কথা আমি বহুদিন কারও সঙ্গে বলিনি। এমনকি নিজের সঙ্গেও নয়। যেন হাঁপিয়ে উঠি। আমি কিভাবে বলি, তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে আমার কাছে একহাজার এক রাত্রির গল্প আছে। কী উত্তর দেব তাকে আমি? বলতে কি পারব যে, গিয়ার ভিয়ারের থ্রিডি সিনেমার মতো করে সব দেখতে পাচ্ছি? বলতে পারব যে, আমি জেনে গিয়েছি, অসীম নামের বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত লোকটি ওকে খুব কষ্ট দেবে? তারপর তিন বছর বাদে দেশে ফিরে এসে সবকিছু অচেনা মনে হবে ওর? নাকি এটা বলব, আমাদের বিয়ের সুদীর্ঘ দশ বছরে সন্তানহীন থাকার কারণে তাকে একসময় নিয়মিত মানসিক থেরাপি নিতে হবে? আমি আত্মসমপর্ণ করব, না কি তার উপহাস নেব? আমার চারপাশে যেন ভারী বর্ষণ হতে শুরু করে। আমার মনে হয় আমার হৃৎপিণ্ডটা শরীরের ভেতর থেকে ছিটকে বের হয়ে সেই বর্ষণে ভিজতে শুরু করবে। আমি লম্বা শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকি।
—দেজা ভু, বিড়বিড় করি আমি। তারপর কিছুটা চঞ্চল হয়ে উঠে বলি, আমাকে ক্ষমা করো। আমি আজ বাড়ি ফিরে তোমার পরিবারকে না করে দেব কিন্তু তারপরেও আমাদের একসঙ্গেই থাকা হবে। আমি আর কিছু বলতে পারব না।
—মানে? কিছুটা জোরেই বলে ওঠে সে। এরপর আর কিছু না বলে অস্থিরভাবে নিজের চুলে হাত চালিয়ে হেঁটে হেঁটে সামনের সোফায় আমার মুখোমুখি বসে।
তারপর মৃদু ঘাড় কাত বলে—সিনেমাটিক! আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল, ঘরকুনো, আঁতেল ধরনের ছেলেরা খুব খুঁতখুঁতে হয়। যাই হোক, আমি জানি না আপনি এতকিছু কিভাবে জেনেছেন। কেন জেনেছেন। আর জানতেও চাইছি না। এই বিয়ের প্রস্তাব থেকে আমাকে মুক্ত করে দিলেই আমি খুশি হব। আমি আসলেই দেশের বাইরে চলে যেতে চাই, সেখানেই আমার থিতু হওয়ার ইচ্ছে। আপনি না করে দিলে অনেক ঝামেলামুক্ত হয়ে যাব। ‘না’ করা উপলক্ষে আগাম ধন্যবাদ রইল।
আমাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বিরক্তি ঢেকে ভদ্রতাসুলভ একটু হাসি দিয়ে সে একরাশ কোঁকড়া চুল ছড়িয়ে পাশের ঘরে চলে যায়। আমি ম্লান মুখে বিশাল বড় ঘরটায় একা বসে থাকি। কেন যেন মনে হয় সুখ আর দুঃখ কর্পূরের মতো আমার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেক উঁচু কোনো জায়গা থেকে আমি পা পিছলে পড়ে যাচ্ছি। আর আলগা হয়ে যাচ্ছে আমার হৃদয়। আমি দেখতে পাই বিয়ের প্রায় এগারো বছরের মাথায় পেছনের কোমরে একহাত রেখে বেশ অতিকায় একটা পেট নিয়ে প্রজ্ঞা খাবার ঘরের দিকে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। তারপর কী হবে? যেই আমি কয়েক ঘণ্টা আগেও ভিন্ন এক মানুষ ছিলাম, সেই আমিই কেমন যেন বদলে যাই। নিজের অনাগত সন্তানকে দেখার জন্য উৎসুক করতে থাকি। যেন আমি এক বসাতেই এক জীবনের সবটুকু পরিণতি দেখে নেওয়ার পণ করেছি। যেন সারা বছরের সিলেবাস এক লহমায় শিখে নিয়ে সব পরীক্ষা দিয়ে দেব। কিন্তু আমাকে হতাশ হতে হয়। আমি আর কিছু দেখতে পাই না। আর কোনো ভবিষ্যৎ ভেসে ওঠে না। আমার সামনে ধীরলয়ে প্রজ্ঞার খাবার ঘরে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য চলতে থাকে। আমি আমার অনুভবে সেই নতুন সত্ত্বার স্পর্শ পাওয়ার গভীর তৃষ্ণা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। আমার চোখ ভিজে আসতে থাকে। পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, সে অতীতে ফিরে যেতে চায় না কি ভবিষ্যৎ দেখতে চায়, বেশিরভাগ বোকা মানুষই ভবিষ্যৎ দেখতে চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অথচ এটা খুব খুব ভুল সিদ্ধান্ত। নিশ্চিত বা অনিশিচত কোনো ভবিষ্যৎকেই সময়ের আগে দেখে কোনো লাভ নেই। শুধুই দুঃখ। শুধুই কাছাকাছি বিষাদ ছুঁয়ে দেখা। আর কিছুই নয়। কেন যেন আমার আর কোনো কিছু বা কারও কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করে না। ভেতরের ঘর থেকে কিছু হাস্যোজ্জ্বল মানুষদের গল্পের টুকরো টুকরো শব্দ ভেসে আসে। আমি দোতলার বসার ঘর থেকে দ্রুত নেমে আসি। ভবিষ্যতের সাক্ষ্য নিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত আমার হাতে আর কিছুই নেই।
শুধু গেট দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় আমি বুঝতে পারি, আজ থেকে ঠিক তিন বছর পরের এক বিমর্ষ প্রজ্ঞা দাঁড়িয়ে আছে ছাদের কিনারে। আর আমি পেছনে না তাকিয়ে তার দিকে—‘আবার হবে দেখা’র মতো নিঝুম বিদায়ি হাত নেড়ে ফিরে যাওয়ার পথ ধরি।