রূপকথার মতো ‘অতঃপর তাহারা সুখে-শান্তিতে বাস করিতে লাগিলো, নটে গাছটি মুড়িয়ে যেমন গল্প ফুরিয়ে যায়’, তেমনি এ গল্পও ফুরোতে পারতো। কিন্তু ফুরোলো না। কেন, তা নিয়েই এই কথকতা। তার আগে বলি, গল্পটা আমাদের, আমার আর পলাশের। আমরা সহপাঠী ছিলাম। সেই স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি।
এইচএসসি পাসের পর মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম দুজনেই। আমি চান্স পেলাম, পলাশ পেলো না। তার পাংশু মুখের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে মুহূর্তমাত্র দেরি হয়নি সেদিন আমার। আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, কষ্ট পাস না, আমি মেডিক্যালে পড়বো না।
পলাশ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের হাসি হেসে বললো, আমাকে বোকা মনে হয় তোর?
আমি মরিয়া হয়ে বললাম, বিদ্যা বলছি! সত্যি পড়বো না। চল আমরা বিশ্বদ্যিালয়ের ভর্তি পরীক্ষাটা ঠিকঠাক দেই। দুজনের যেখানে চান্স হবে, সেখানেই ভর্তি হবো।
তোর ফ্যামিলির কেউ মানবে না। তাছাড়া আমার জন্য তুই কেন এত ভালো সুযোগ হাতছাড়া করবি?
আমার ফ্যামিলি নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। এছাড়া ওসব ডাক্তারি-ফাক্তারি পড়তে ভালো লাগবে না আমার। রক্ত দেখলে আমার মাথা ঘোরে। ডাক্তারি আমার জন্য নয়।
অলোক তবু হাসিমুখে শোনে পুরোটা। ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করে, আমার বলা শেষ হলে সে দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ওহ মাম্মি! ডোন্ট বি সো আপসেট! লাইফ ইজ ইয়োরস! এনজয় ইট! লোকটাকে ভালো না লাগলে বিদায় করে দাও! হোয়াটস দ্য হেল!
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মা-বাবাকে রাজি করিয়ে মেডিক্যালে ভর্তি হওয়া বাদ দিলাম। আবার ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলাম, দুজনেই। একই সাবজেক্টে না হলেও একই ফ্যাকাল্টিতে। আমি এতেই খুশি। যদিও পলাশ মেধাতালিকায় শেষের দিকে থাকায় নিচের দিকের সাবজেক্ট পেলো, সে নিয়েও মন খারাপ হতো তার, হীনম্মন্যতায় ভুগতো, টের পেতাম। পাত্তা দিতাম না, আমি ওকে সান্ত্বনা দিতাম। বলতাম, মন দিয়ে পড়লে যেকোনো সাবজেক্ট থেকেই ভালো করা সম্ভব। তুই মন দিয়ে পড়। দেখবি তোর সাবজেক্ট থেকেই অনেক ভালো রেজাল্ট করে বের হবি।
আমি সেটা বিশ্বাসও করতাম, এখনো করি। যদিও এখন এসবের আর কোনো মানে নেই। নটে গাছ মুড়িয়ে গেছে ঢের আগে। পলাশ আর আমার গল্পও ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু গল্প কী সত্যিই ফুরোয় আদতে? আমার আর পলাশের গল্প ফুরিয়েও তাহলে কেন জীবন ফুঁড়ে আবার জেগে ওঠে নতুন গল্প? কেন সে ডালপালা মেলে ঢেকে ফেলে পলাশের সবটুকু স্মৃতিচিহ্ন, আর হঠাৎ হঠাৎ কেনই বা আবার সেসবের আড়াল চিরে মাথা বের করে দেয় সদ্য অঙ্কুরিত বীজপত্রের মতো পলাশের সঙ্গে যাপিত যত গন্দম সময়!
মিহির অফিসে গেছে খানিক আগে। তার ছেড়ে যাওয়া কাপড়গুলো গুছিয়ে মারুফা টেবিলের পাশে চা রেখে গেছে কিছুক্ষণ হলো। হাত বাড়িয়ে ফোনে সময় দেখি, অলোক এতক্ষণে বের হয়ে গেছে সম্ভবত, মারুফাকে জিগ্যেস করলে জানা যায়, ইচ্ছে করে না। থাক। শরীরটা ভারী লাগে। চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে চুমুক দেই, পত্রিকার পাতায় চোখ রাখি আলস্যে। আজ আর অফিসে যাবো না। অফিসের কাজগুলো ফোনে যতটা পারি সেরে নেবো। মিহিরের সঙ্গে কাল রাতেও হয়ে গেছে একচোট। দিন দিন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে সে। আর বেশিদিন বোধহয় একসঙ্গে থাকা হবে না আমাদের। অলোকের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আজ কথা বলবো ভেবেছিলাম। কিন্তু এত সকালে এসব কথা শুনতে তার ভালো লাগবে না। তাছাড়া মা আর তার নতুন জোটা বরের নিত্যদিনের ক্যাচাল শুনতে কারই বা ভালো লাগে হররোজ! অলোক তবু হাসিমুখে শোনে পুরোটা। ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করে, আমার বলা শেষ হলে সে দুহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ওহ মাম্মি! ডোন্ট বি সো আপসেট! লাইফ ইজ ইয়োরস! এনজয় ইট! লোকটাকে ভালো না লাগলে বিদায় করে দাও! হোয়াটস দ্য হেল!
ছেলেটা একদম পলাশের মতো হয়নি। ভাগ্যিস হয়নি। আমাকে পুরোপুরি বোঝে। পলাশের এই একটা স্মৃতি আমার কাছে সযত্নে গচ্ছিত আছে। আগলে রেখেছি বুকে। পলাশ আর আমার ডিভোর্সের পর পলাশ চাইতো অলোককে তার কাছে নিয়ে রাখতে। আমি নিজেও দিয়েই দিতাম হয়তো। কিন্তু তার আগেই রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেলো পলাশ। অলোক তখন পাঁচ বছরের। বাবার আদর পায়নি ছেলেটা। মা বলতে তাই পাগল সে। যতটুকু সময় বাসায় থাকি, আমাকে সে আগলে রাখে বাবার মতো, যেন আমিই মেয়ে তার, ছোট্ট শিশুটি!
পলাশকে টেনে তুলেছিলাম আমি। পড়াশোনায় অতটা মন ছিল না তার, আমার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কোনোদিন জিততে না পেরে হীনম্মন্যতা তাকে কুঁকড়ে রাখতো আরও। মাস্টার্সের পর দুজনই বিসিএসে বসলাম। আমার পাশে সিট করার ব্যবস্থা করায় সে উৎরেও গেলো। কিন্তু আমি প্রশাসন ক্যাডার পেলেও সে পেলো নেহাত নিচের দিকের এলেবেলে এক ক্যাডার। তার হীনম্মন্যতা বাড়লো তাতে আরও। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়লো আমার আত্মবিশ্বাস। আর আমি, নিজেকে আবিষ্কার করলাম যেন নতুন করে, এতকাল পর। ততদিনে বিয়ে করেছি আমি আর পলাশ। রূপকথার সূত্র অনুসারে সুখে-শান্তিতে বাস করার যুগে প্রবেশ করেছি তখন। কিন্তু বাস্তবে তেমন হলো না। হয় না আসলে। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর নিজের দিকে ফিরে তাকানোর ফুরসত মিললো এতদিনে আমার। পড়াশোনা নিয়ে, ক্যারিয়ার নিয়ে, ব্যস্ততায় নিজের দিকে তাকানোর সময় মেলেনি এতকাল। যেটুকু সময় মিলতো সেটা বরাদ্দ ছিল পলাশের জন্য। তাকে গড়েপিটে নিজের মতো করে তোলার চেষ্টা ছিল আপ্রাণ। তাকে ভালোবাসতাম, চাইতাম সে আমার যোগ্য হয়ে উঠুক, পরিবার বা অন্য কেউ যেন তাকে অপমান করার সুযোগ না পায়। যেন বলতে না পারে, সে আমার যোগ্য নয়।
যতদিন অস্ট্রেলিয়ায় ছিলাম, সজল, এন্ডারসন, জন আর উইলিয়ামসের সঙ্গে দারুণ সময় কাটতো। সবাই বয়সে ছোট ছিল আমার চে, অন্তত বছর দশেকের। ততদিনে বুঝে নিয়েছিলাম কম বয়সী যুবকদের প্রতি আমার মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি।
পলাশ মূলত পুতুল ছিল আমার। তাকে মনের মতো করে গড়ার খেলায় পেয়ে বসেছিল আমাকে। দুজনেই চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর সে খেলা ফুরোলো আমার। ফিরে তাকালাম নিজের দিকে। আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক অন্য আমি। এই আমাকে এতকাল চিনিনি আমি। সে যে আমার ভেতরে ছিল এতকাল, সেটাই বুঝিনি একদম। প্রথমটায় আমি নিজেই হকচকিয়ে গেলাম। তারপর ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হলাম নতুন এই আমির সঙ্গে। সরকার থেকে দেই বছরের স্টাডি লিভ নিয়ে ফুল ফ্রি স্কলারশিপে উচ্চতর গবেষণার কাজে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেলাম। পলাশের নাখোশ মুখকে পাত্তা দেওয়ার প্রশ্নই ছিল না। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে প্রথম প্রথম একটু একা, নার্ভাস লাগতো। সেটুকু কাটিয়ে উঠতে আমাকে সাহায্য করলো সজল। সজল বয়সে ছোট আমার, অন্তত বছর দশেক। দারুণ উদ্যমী আর চটপটে, টগবগে এক যুবক তখন সে। বছর দুয়েক হলো স্টুডেন্ট ভিসায় অস্ট্রেলিয়া এসেছে, পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম জব করে নিজের খরচ চালায়, মাঝে মাঝে দেশেও মা-বাবার জন্য ডলার পাঠায়। সে আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রত্যেক উইকএন্ডে আশপাশের জায়গাগুলো চেনাতে থাকে, যে কোনো প্রয়োজনে না ডাকতেই সে হাজির হয়ে যায় মেঘ না চাইতেই জলের আদর্শ উদাহরণ হয়ে। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করি, সজল আমার প্রেমে পড়েছে। সেই সঙ্গে আমার ভেতরের অন্য আমিকেও আবিষ্কার করি আচমকা। প্রথমটায় কেমন চমকে গেলাম। নিজেকে এতকাল রক্ষণশীল হিসেবে জানতাম। জানতাম আত্মনিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলো সুচারুভাবে রপ্ত করতে পেরেছি আমি। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করতেই যেন আমার ভেতরের সেই অন্য আমিটা ভেংচি কাটলো, আবির্ভূত হলো স্বরূপে। সজলের সঙ্গে আমার প্রেম নয় বরং সম্পূর্ণ জৈবিক একটা সম্পর্ক তৈরি হলো, এবং আমি লক্ষ করলাম এ নিয়ে আমার ভেতর সামান্যও অনুতাপ বা অপরাধবোধ নেই। বরং এটা খুব সহজ আর স্বাভাবিক একটা ব্যাপার মনে হলো। সজলের দিক থেকে ব্যাপারটা প্রেমই ছিল। পরের দিকে সজল কাঁদতো, বলতো তুমি পলাশকে ডিভোর্স দাও, থেকে যাও এখানেই। চলো একসঙ্গে থাকি, সংসার করি।
আমি হেসে উড়িয়ে দিতাম তাকে। বোকা ছিল ছেলেটা। এত যে বোঝাতে চাইতাম তাকে, তার প্রতি মানসিক কোনো টান তৈরি হয়নি আমার ভেতর, তত সে অস্থির, অধীর হয়ে উঠতো, হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো আচরণ করতো। সে সময়েই ইউনিভার্সিটিতে এন্ডারসনের সঙ্গে আলাপ হলো আমার, সে এসেছিল নিউজিল্যান্ড থেকে, আমার চেয়ে সে-ও বেশ ক’বছরের ছোট ছিল। হাসিখুশি, মিশুক আর হৃদয়বান এক যুবক। আমাকে ডাকতো সুসি! সুস্মিতাকে ছোট করে সুসি ডাকতে ডাকতে সে যখন আমার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টটায় হাজির হতো, তখন অন্য সেই আমিটা যেন হাওয়ায় উড়তো। যতদিন অস্ট্রেলিয়ায় ছিলাম, সজল, এন্ডারসন, জন আর উইলিয়ামসের সঙ্গে দারুণ সময় কাটতো। সবাই বয়সে ছোট ছিল আমার চে, অন্তত বছর দশেকের। ততদিনে বুঝে নিয়েছিলাম কম বয়সী যুবকদের প্রতি আমার মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি।
ব্যাপারটাকে আমি উপভোগও করতাম, এখনো করি। তার আগ পর্যন্ত কেন এটা অনাবিষ্কৃত ছিল, সেটাই ভাবতে ভারি আশ্চর্য লাগে আমার, এই এখননো। দেশে ফেরার পর অলোককে কন্সিভ করলাম আমি। কিন্তু ততদিনে আমার মাত্রাতিরিক্ত পুরুষাসক্তি, মূলত কম বয়সী যুবকাসক্তি, পলাশের কাছেও অনাবিষ্কৃত নেই আর। আমিও ব্যাপারটা তার কাছে গোপন করার চেষ্টামাত্র করিনি। কারণ এতে গোপন করার কিছু আছে বলেই মনে হয়নি আমার। প্রথম প্রথম পলাশ কষ্ট পেতো খুব, আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করতো, কেমন অবিশ্বাস আর অচেনা একটা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে। আমি একফুঁয়ে উড়িয়ে দিতাম তাকে। পলাশকে বোঝাতাম, দেখো, তোমাকে ভালোবাসি আমি। সবটুকু দিয়েই বাসি। তাহলে তোমার আমাকে নিয়ে সমস্যাটা কোথায়? তোমার যদি বেশি খিদে পায় তুমি কী করবে? বেশি খাবে, তাই না? যদি প্রতিদিন এক খাবার ভালো না লাগে তাহলে রুচি ফেরাতে অন্য খাবার খাবে, সেটাই স্বাভাবিক। এ ব্যাপারটাও তেমন। তোমার তাহলে এত আপত্তি কিসের? এটা তো খুব ন্যাচারাল একটা ব্যাপার! তুমি কেন এমন রি-অ্যাক্ট করছো. সেটাই বুঝতে পারছি না! মানুষ জন্মগতভাবেই বহুগামী, এমনকি তুমিও। শুধু বুঝতে পারছো না, এই যা তফাৎ। তুমি চাইলে করতে পারো তোমার যা খুশি, আমি তোমার স্বাধীনতায় বাধা দিতে যাবো না। আশা করবো তুমিও এটা নিয়ে আর কোনো কথা বলবে না!
বিয়ের পর থেকে একে অন্যকে তুই থেকে তুমি বলতাম আমরা। আমার কথায় পলাশ যেন পাথর হয়ে গেলো। অনেকক্ষণ চোখ বড় বড় করে আমার দিকে যেন অদ্ভুত কোনো চিড়িয়া দেখছে ভাব করে তাকিয়ে থাকলো সে। ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য মুখে চুপচাপ অনেকক্ষণ দেখলো আমাকে। তারপর বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুম থেকে বের হতে হতে বিড়বিড় করে বললো, তুতুমি পাপাপাগল হয়ে গেছো। তো তোমার মানসিক চিকিৎসা দরকার।
পলাশের হীনম্মন্যতা বাড়তে থাকলো আরও, সেই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকলো পলাশের ভাষায়, আমারও ’স্বেচ্ছাচার’। কিন্তু তা বলে রুচিহীন তো নই আমি। ছিলাম না কখনো। আমার পছন্দ ছিল শিক্ষিত, কমবয়সী, সুদর্শন। অফিসের সবাই এটা জানতো, জানে। ফলে আমাকে সঙ্গী নির্বাচনে কাঠখড় পোড়াতে হতো না তেমন, এখনকার মতো। তারা নিজেরাই এসে হাজির হতো আমার কাছে। আমি সুশ্রী, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আর্থিক দৈন্য নেই, এসব সুবিধাজনক অবস্থার কারণে তারা আমার কাছে আসতো পতঙ্গের মতো। আমিও তাদের ব্যবহার করতাম আমার প্রয়োজনে। সাধ্যমতো নানাভাবে উপকারও করতাম তাদের চাহিদানুসারে। কিন্তু পলাশটটা এত বোকা। সে তার মান্ধাতা আমলের সংস্কার ছাড়তে পারলো না। তার মাথায় গেঁথে আছে বিয়ে মানে একে অন্যকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে পুরোপুরি দখল করে নেওয়া।
মনে হয় অলোক নয়, বরং পলাশের জন্যই অপেক্ষা করছি। গল্পটা তাই ফুরোয় না আর। নটে গাছটি মুড়িয়ে গেছে ঢের আগে, গল্প তবু চলছে অন্তহীন।
একজন পুরোপুরি অন্যজনের সম্পত্তিতে পরিণত হওয়া। কিন্তু ব্যাপারটা তো আদতে তা নয়! বিয়ে মানে একটা চুক্তি। আমরা বৈধভাবে একে অন্যের সঙ্গে থাকার চুক্তি করেছি, একে অন্যের সন্তানের মা বা বাবা হওয়ার অঙ্গীকার করেছি, কিন্তু তা বলে আমরা তো বিক্রি হয়ে যাইনি একে অন্যের কাছে যে, আমরা, আমাদের শরীরে বা মনে অন্য কাউকে ধারণ করতে পারবো না, নাকি বিক্রি হয়ে গেছি? পলাশ মনে করতো গেছি, বিক্রিই হয়ে গেছি আমরা একে অন্যের কাছে। কিন্তু আমি কারও কাছে বিক্রি হতে রাজি নই। না শরীরে, না মনে। কাজেই পলাশের এই অন্যায় আবদার আমার সহ্য হলো না আর। কিংবা পলাশের ভাষায়, আমার স্বেচ্ছাচারিতাই তার সহ্য হলো না আর। ফলে বিয়ে নামক চুক্তিটা বাতিল করলাম আমরা। অলোক তখন পাঁচ বছরের। অলোককে পলাশ নিয়ে যাবে বলতো, আমিও দিয়ে দিতে অরাজি ছিলাম না তেমন। মাঝখানে রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গেলো পলাশ। ডিভোর্সের সময় যতটা কষ্ট পেয়েছিলাম, তারচে অনেকগুণ বেশি কষ্ট হলো পলাশের মৃত্যুতে। পলাশ আমার প্রথম প্রেম ছিল। শেষও। আর কাউকে ভালোবাসিনি কোনোদিন, সে প্রয়োজনই পড়েনি আমার। কিন্তু পলাশ সেটা বুঝলো না। সে তার পুরনো আর অর্থহীন মূল্যবোধ আঁকড়ে বসে থাকলো।
পলাশের মৃত্যুর পর ছোট্ট অলোককে নিয়ে যুদ্ধটা কঠিন ছিল আমার। যদিও বিয়ে নামক শব্দটায় আর আস্থা ছিল না আমার। তবু বেশ কবার বিয়ে করেছিলাম। টেকেনি। বরং পলাশকে খুব বেশি মনে পড়তো আমার, প্রতিদিন। এখনো পড়ে। পলাশের না থাকাটা আরও বেশি করে থাকা হয়ে ওঠে এখন। যাকেই বিয়ে করি কিংবা যার সঙ্গেই লিভ টুগেটার করি, আমার অবচেতন মন পলাশের সঙ্গে তাকে তুলনা করে, তার সঙ্গে পলাশের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য মেলাই। আর পলাশের ভালো দিকগুলোকে তার বিপরীতে কিংবা তার মন্দদিকগুলোকে পলাশের বিপরীতে দাঁড় করাই। এই তুলনা আমাকে অস্থির করে তোলে। শেষে আমার খুঁতখুঁতানিতে সে বেচারা লেজ তুলে পালায়। মিহিরের সঙ্গে আছি প্রায় মাসছয়েক হলো। কিংবা মিহিরই আমার সঙ্গে আছে। সে বিয়ের প্রসঙ্গ বেশ কবার তুললেও নাকচ করে দিয়েছি। আঠারো শ স্কয়ার ফিটের এই ফ্ল্যাটটা আমার নিজের। অল্প কিছু দিন হলো বাবার দেওয়া ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়ে এটাতে উঠেছি। অলোক সামনের মাসে কানাডা চলে যাবে। মিহিরকে এর মধ্যেই বিদায় করতে হবে। রোকনের সঙ্গে ইদানীং সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে বেশ। অন্য সবার মতো তার সম্ভবত আমার কাছ থেকে টাকাপয়সা হাতিয়ে নিয়ে কেটে পড়ার ধান্দা নেই। ভাবছি অলোক চলে যাওয়ার আগে রোকনের সঙ্গে এবার বিয়ের পাটটা চুকিয়ে নেবো। আর বছর খানেক চাকরি আছে আমার। চাকরি শেষে রোকন চাইলে তাকে নিয়ে কানাডায়, অলোকের কাছে চলে যাবো। এ বয়সে একাকিত্বটা খুব পোড়ায়। পলাশ তখন স্মৃতিতে এসে হানা দেয় নির্দয়ভাবে। সেটা খুব যন্ত্রণার। রোকন নিশ্চই আপত্তি করবে না। অনেকবার বিয়ের কথা বলেছে সে, কান দেইনি আগে। কিন্তু এখন সময় হয়েছে। অলোক চলে গেলে সময়টা কঠিন হবে আমার জন্য। একাকিত্ব ছেঁকে ধরবে আরও।
মারুফা চায়ের কাপ নিতে ঘরে ঢোকে। বিছানা-বালিশ গোছায়।
অলোক কী করছে রে? উঠেছে ঘুম থেকে?
জি আপা। ভাইজান পেপার পড়ে আর চা খায়।
আমার ঘরে আসতে বলিস তো। বলবি জরুরি কথা আছে।
মারুফাকে বেডরুম গোছাতে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসি। অলোক আমাকে বোঝে। সে জানে তার মা নিজের জীবন নিজের মতো করে যাপন করে, অন্যের ছায়া হয়ে বাঁচার চেষ্টা করে না। মুখোশপরা মানুষদের মুখোশটা পছন্দ নয় তার। নিজের মুখ নিয়ে সে বাঁচতে চেয়েছে আজীবন, নিজেকে ভালোবেসে, অন্যকেও। বারান্দায় বসে অলোকের জন্য অপেক্ষা করি আমি। মনে হয় অলোক নয়, বরং পলাশের জন্যই অপেক্ষা করছি। গল্পটা তাই ফুরোয় না আর। নটে গাছটি মুড়িয়ে গেছে ঢের আগে, গল্প তবু চলছে অন্তহীন।