রাত্রিটা বড্ড দীর্ঘ, আর বৃষ্টিও যেন একটু ধরে এলো। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে একঘেয়ে, একভাবে। তার বাতাসে জানালায় লাগানো ময়লা পর্দাটা উঠছে-নামছে, যেন সমুদ্রের ঢেউ। লেখকের মনে হয়, চাইলেই তিনি ঝাঁপ দিতে পারবেন ওই জলে। তারপর শুরু হবে ডুবসাঁতার—গভীর থেকে গভীরে, আরো গভীরে। তিনি ক্লান্ত চোখ বুজে হাতড়ে বেড়াতে থাকেন সমুদ্রের জল। ঠিক যেন চাইলেই ছোঁয়া যায় ঠোঁট চকচকে মাছ, শ্যাওলা আর স্মৃতির মতো বহুপদী চিংড়িকে। লেখকের মনে পড়ে তার ছোট্ট বেলার কথা। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি নাকি পড়ে গিয়েছিলেন সুগন্ধার জলে। দুই পায়ের ফাঁকে লুঙ্গিতে কাছা মারা দুলাল কাকা হইহই করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন জলে। অবশেষে খাবি খেতে খেতে কাকার কোলে চড়েই আবার ডাঙ্গা। আচ্ছা, সেদিন তো মরেও যেতে পারতেন! তাহলে আর আজকের রাত থাকতো না। মাথার ওপর ঘুরে চলা ফ্যান, চেয়ার, টেবিল, চৌকি কিংবা বাতাসে উড়তে থাকা পর্দার মাঝে সমুদ্র দর্শন থাকতো না কিছুই। বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেন তিনি। শিরদাঁড়ার ভোঁতা ব্যথাটা হঠাৎ যেন চাপিয়ে এলো। কতক্ষণ যন্ত্রণায় চোখ বুজে থেকে কী ভেবে আবার উঠে পড়লেন। জানালাটা এখনো খোলা। বাইরে অন্ধকার আর ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। ঘুম আসছে না কিছুতেই। সেলফে রাখা নানান রুচির বই ইদানিং কেন যেন টানছে না আর। থাক, ওকথা ভাবা যাবে না। এই মধ্যরাতের নাটকটিতে চরিত্র কেবল একটাই থাক। তাহলে কি একটা ব্যথার ওষুধ খেয়ে দেখবেন। শিরদাঁড়ার ব্যথাটা প্রচণ্ড ভোগাচ্ছে তাকে। মঞ্জুলিকে একটা ফোন করা যায় না? না, এখন সে ঘুমঘোরে আচ্ছন্ন। আলো নেই, আবেগ নেই, আর মঞ্জুলি! নেই, না থাক। অথচ কখনো কখনো তিনি এমন উদ্বেল হয়ে ওঠেন, মনে হয় এক দৌড়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। কারো সঙ্গে শুধু একটু কথা বলার জন্য যেন দিয়ে দিতে রাজি থাকেন ইটের মতো থরে থরে সাঁজানো অভিজ্ঞতার স্থাবর-অস্থাবর সব। চৌকির পাশের টেবিলের ড্রয়ারে ব্যথানাশক আর ঘুমের কয়েকটা ওষুধ রাখা ছিল। তিনি ড্রয়ার খুলে ওষুধটা খুঁজতে গিয়ে আবার চোখ আটকে গেল পুরনো খবরের কাগজগুলোর দিকে। আবছা আলোয় ছাপার অক্ষরে দেখা যাচ্ছে তার নাম। তিনি যেন সব ভুলে গেলেন। সেই কবেকার লেখা, মনে আছে, একদিন চলতে চলতেই হঠাৎ তার মাথায় গল্পটা এসেছিল। সেকি উত্তেজনা সেদিন! মঞ্জুলি কেমন করে যেন সব টের পেয়ে যেত। গল্পটার নাম রাখা হোক ‘যাপিত জনান্তিক’। অবশ্য মঞ্জুলির তাতে ঘোর আপত্তি। বড্ড দাঁতভাঙা হয়ে যাবে নামটা। বরং আরো সহজ আরো সুন্দর কিছু ভাবো। অবশেষে খবরের কাগজে ওটা ‘ভুল সরোবর’ নামে ছাপা হয়েছিল। যত্ন করে গুছিয়ে রাখা আরেকটি খবরের কাগজ উ্ল্টাতেই আবার তার নাম। এক ঘোর শীতের রাতে লেখা গল্প-সমুদ্রের জন্মকথন। না, না, এসব আবার কেন বের করছেন তিনি! হঠাৎ লেখাগুলো ফেলে যেন মার খাওয়া কুকুরের মতো ছিটকে আসেন তিনি। দেখতে চাই না, আর দেখতে চাই না। শান্তিতে থাকতে দাও আমায়। কেমন আধো রহস্যের রাতে নিজের চৌকিতে বসে শ্বাস টানেন কয়েক মিনিট। টেবিলের ওপর এলামেলো পড়ে থাকা খবরের কাগজগুলো যেন অদৃশ্য একটা আকর্ষণে বলছে, আয় আয়। তিনি দেখতে চান না, তবু চোখ চলে যায়। থাবা মেরে টেবিল থেকে ফেলে দেন সব। তিনি এখন মৃত ঘোড়া। লেখাগুলোও সব নষ্ট হয়ে গেছে। হাজার চেষ্টা করেও আর একটা কিছু লিখতে পারেননি তিনি। একসময়ের কলম স্বপ্ন এখন পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে। কলমটাকে এখন তিনি ভয় পান। আসলে হয়তো ভেতরটা মরে গেলে বাইরেও তার আলোড়ন ওঠে। মঞ্জুলি বলে গেছে, তিনি নাকি ফুরিয়ে গেছেন। নষ্ট হয়ে গেছে জাদুকরের সব জারিজুরি। তার সুবর্ন সময় এখন অতীত। তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন। যেন বন্ধ চোখে এক সমুদ্রের জন্ম দেখা যায়। লেখক যন্ত্রণায় কাঁতরাতে থাকেন। কথা সমুদ্র যেন ফিসফিস করছে মৌমাছির মতো। মধ্যরাতের নাটকে মাথার ভেতর গুনগুন করতে থাকে আরো সব চরিত্র। তিনি কাঁদেন আর খামচে ধরেন মাথার চুল। হঠাৎ চারপাশটা কেমন নিঝুম লাগে। বাতাসে উড়তে থাকে জানালার পর্দা, বাইরে বৃষ্টি থামা নীরবতা। তিনি চৌকি থেকে উঠে, বহুদিন পর আজ সাদা কাগজ হাতে নেন। বের করেন রেখে দেওয়া কলম। কথা সমুদ্র যেন দ্বিতীয় জন্ম লাভ করে তার মগজে।
একটি মেঠোপথ ধুলিধূসর। একটি ভ্যানগাড়ি, জৈষ্ঠের গরমেও পাতলা একটা চাদর দিয়ে শরীর ঢাকা একজন অসুস্থ মানুষ আর দুজন নর-নারী। মহাজনের শ্বাস উঠছে থেকে থেকে। মনে হচ্ছে জৈষ্ঠের রোদ প্রবল আক্রোশে পৃথিবী থেকে চুষে নিয়েছে বাতাস। শ্বাসের সঙ্গে মহাজনের উঁচু হয়ে ওঠা ভুড়িটা উঠছে আর নামছে। মেয়েটির নাম ধরা যাক মঞ্জুলি। না, মঞ্জুলি নয়, ওর নাম আলেয়া। মহাজনের দ্বিতীয় বউ। আর কালো গ্রন্থিল পেশীর ভ্যান চালকটির নাম দিদার। সে আলেয়ার প্রথম স্বামী। জৈষ্ঠের পড়ন্ত বিকেলের আকাশরঙা গরম পথ ধরে এগিয়ে চলেছে ওদের ভ্যান। তারপর, তারপর কী? লেখক উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকলেন সাদা দেয়ালের দিকে। ওখানে একটা টিকটিকি পা টিপে টিপে এগিয়ে আসছে গপ করে গিলে খেতে কোনো পোকাকে। কই মনে পড়ে না, মহাজন, আলেয়া, দিদার। উফ ঈশ্বর, কেন কেন এত যন্ত্রণা! তিনি কলমটাকে খাতার ওপর আছড়ে ফেলেন। খানিকটা কালি ছড়িয়ে যায় চারদিক। মঞ্জুলি তোমাকে বলেছিলাম না পারব না। আর কোনোদিন লেখা হবে না আমাকে দিয়ে। পরক্ষণেই হঠাৎ কথার সমুদ্র যেন আবার কেঁপে ওঠে। কেমন দ্বিতীয় জন্ম কাহিনীর। জৈষ্ঠের পরৎ পরৎ ধুলা ভেঙে ওরা যাবে আরো আট মাইল। সেখান থেকে আদিত্য নদ পেরিয়ে গঞ্জের হাসপাতালে। দিদার ধীর লয়ে প্যাডেলে চাপ দেয়। আলেয়া চোখের কোণে জলের শুকনো দাগ মোছে। মহাজনকে ভ্যানে তুলে নিয়েছে সে অনেকক্ষণ হলো। এতক্ষণ কেবল মহাজন মৃত মানুষের মতো ভীতিকর দৃষ্টিতে হুপহুপ শব্দে শ্বাস টানলেও আলেয়া একটি কথাও বলেনি। কে জানে, হয়তো লজ্জা কিংবা অপরাধবোধ। দিদারের সঙ্গে আবার এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবেনি সে। সময়টা ছিল আজ থেকে চার বছর আগে। শক্তসমর্থ টেরি গোফওয়ালা দিদারকে স্বামী হিসেবে পেয়ে খানিকটা গর্বই হয়েছিল আলেয়ার। দিদারের সুন্দর হাসি আর চিকন গোফ দেখে লোকে ওকে সিনেমার নায়কের সঙ্গে তুলনা করতো। তখন এলাকার সবচেয়ে বড় বরফ মিলে শ্রমিক হিসেবে খাটে সে। দিন গেলে রোজ আয়ের কড়কড়ে নোট আর লুঙ্গির খোঁটে স্বপন বিড়ি ও হাতে এটা সেটা নিয়ে প্রতিদিনই বাড়ি ফিরতো সে। সুখে, দুঃখে, হাসি কান্নায় কাটে ওদের দাম্পত্য। একদিন গর্ভবতী হয় আলেয়া। বছর ঘুরতেই কোল আলো করে আসে এক শিশু। স্বামী-স্ত্রী মিলে ওর নাম রাখে নবীজির মায়ের নামে—আমেনা। তারপর কী হলো? কেমন করে কাটছে ওদের দিন! তিনি নিজের কপালটা টিপে ধরে পড়ে থাকেন। না, মনে আসছে না। কী হবে ওদের? মঞ্জুলি তুমি কি দেখতে পাচ্ছো ওদের? সংসার, নিভৃত গ্রামে ওদের তিন জনের সংসার। আহ, আর পারছি না, কেন পারছি না? তিনি এক গ্লাস জল খান। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। শিরদাঁড়ার ব্যথাটা যেন একটু পরপর ঢেউ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো শরীরে। এত অস্থির লাগছে কেন! চুলোয় যাক আলেয়ার সংসার। নিভৃত কোনো গ্রামে পড়ে থাক নিকোনো উঠোন। এভাবে আর পারা যায় না, হয় না। মঞ্জুলি, তুমি কি ফুরিয়ে যাওয়ার মানে বোঝো? শূন্যতা আর রিক্ততার রঙ কী হয় জানো তুমি? মাঝে মাঝে মনে হয় আমি জানি। আবার কখনো মনে হয়, কী হবে জেনে, থাক না যে যার মতো। নিভৃত গ্রামটা থাক, মেঠোপথ, তিনজন মানুষ, সংসার সব থাক। ওদের কাছে আমার কোনো দায় নেই, সংশ্রবও নেই। লেখক আবার বসে পড়েন কাগজ কলম নিয়ে। যেন তিনি কিছুর সঙ্গেই নেই আবার সব কিছুর সঙ্গেই আছেন। আলেয়া, দিদার আর আমিনার ঘর যেন চলতে থাকে চলমান।
সেবার বর্ষাকাল। মেঘের অভিমানে বের হওয়া যায় না ঘর থেকে। ঘরে দিদার নেই। তবু ঘুমন্ত শিশু আমিনাকে ঘরে রেখে কেরোসিনের ছোট্ট বোতলটা হাতে নিয়ে আলেয়া চলে যায় দোকানে। ছোট্ট আমিনা চৌকিতে ঘুমায় নিশ্চিন্তে। কখনো কখনো যেন অদেখা ভূবনের দেখা ইশারায় মিষ্টি হাসি হাসে দেবদূতের মতো। খালটার পাশ ঘেঁষে পাট ক্ষেত। বৃষ্টিতে ভিজে মাটি কাদা হয়ে লেগে যায় পায়ের সঙ্গে। সেদিনই আলেয়ার সঙ্গে প্রথম দেখা মহাজনের। মোটাসোটা লোকটা একটা ছাতা মাথায় যাচ্ছিল ওই পথ ধরে। কয়েক সেকেন্ডের জন্যই আলেয়ার মুখ ধরা পড়েছিল সেদিন তার চোখে। তারপর কেটে যায় অনেকদিন। আমিনা আধো থইথই পায়ে ঘরের খুঁটি ধরে দাঁড়াতে শেখে। দিাদার তার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। আর আলেয়া ওদের দেখে সুখ পুষে রাখে গোপনে। মহাজনের সঙ্গে আবার তার দেখা বাড়ৈইতলির মেলায়। তার দোকান আছে মনিহারি। দিদারই প্রথম পরিচয় করিয়ে দেয় আলেয়াকে মহাজনের সঙ্গে। আমার বউ, মহাজনেরে সালাম দেও। ঘোমটার ফাঁকে আলেয়া অস্ফুট স্বরে সালাম দেয় আর দেখে লোকটা কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে। আলেয়ার ভালো লাগে না এই দৃষ্টি। দিদার মহাজনের দোকান থেকে রঙ দিয়ে কাজ করা মাটির কলসি কেনে, আমিনার জন্য প্লাস্টিকের পুতুল, চিরুনি। যাওয়ার সময় লোকটা আগ বাড়িয়েই আমিনার হাতে পাঁচটা টাকা গুঁজে দেয়। রিকশায় সেদিন ঘরে ফিরতে ফিরতে আলেয়া বলে, একদম ভালা না লোকটা। কেমন কইরা তাকাইতেছিল! দিদার হাসে আর হাসে। সুন্দরী বউ যার ঘরে তারে দেখে লোকের তো হিংসা হবেই।
কিন্তু কেন হিংসা হবে? কোন পরিণতির দিকে তিনি তিলেতিলে ঠেলে দিচ্ছেন ওদের। না না এ অন্যায়। মঞ্জুলি এটা হয় না। অন্যের সুখের সংসার দেখে কেন হিংসে হবে বলো? না, এভাবে আর লিখব না আমি। যদি কোনোদিন পারি তবে অন্য একটা লেখা লিখব। অকারণে তার নিজের ওপর কেন যেন ভয়ঙ্কর রাগ হতে থাকে। তিনি জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নেন। তার মনে হয়, তিনি যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন—একটা ভ্যান গাড়ি, তার ওপর ময়লা একটা চাদর দিয়ে শরীর ঢাকা মহাজন কেমন যেন আকুতি মেশানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার অস্বস্তি হয়, মনে হয় মহাজন যেন একজন নয়। হঠাৎ করে মহাজনের চোখের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে প্রথমে হাজার তারপর লাখ,তারপর কোটিতে পৌঁছে যায়। কেমন স্মৃতি খাওয়া মৃতবৎ লক্ষ-কোটি মহাজন নীরবে ডাকতে থাকে কথার সমুদ্রে। হঠাৎ সেটা আবার হয়ে যায় আলেয়ার মুখ, দিদারের মুখ। তিনি জানালার বাইরে কেমন যেন কপট বিতৃষ্ণায় একদলা থুথু ফেলে কাকে যেন উদ্দেশ করে বলেন, ছয় আঙুলের জীবন কত যন্ত্রণার, কুত্তাটা যদি জানতো, তাহলে কি আর আমাকে কাটতো! তখন হয়তো কোনো মানুষকেই…।
তারপর আরো কয়েকবার দেখা হয়েছে আলেয়ার সঙ্গে মহাজনের। মাঠে শাক কুড়োনোর সময়, পহেলা বৈশাখে হর-গৌরির ভিক্ষা মাগার দৃশ্য ঘোমটার ফাঁক দিয়ে দেখার সময় দূরে লোকটাকে দাঁড়িয়ে পান খেতে দেখেছিল। পাশের বাড়ির মেয়েটাও মহাজনকে দেখিয়ে বলেছিল—লোকটার নজর ভালো না। কিন্তু কই লোকটার সঙ্গে এতবার দেখা হলো, তাকে তো কোনোদিন কোনো কথা বলেনি! কেবল কেমন যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো সবসময়। যেন ঘোলাটে চোখের ক্ষুধার্ত বাঘ। দিন চলে যায়, দিদারের বরফ কলের চাকরিটাও চলে যায় একদিন। আদিত্য নদের জল জোয়ার ভাটায় উছলায় নীরবে। দিদার ধার-কর্য করে ভ্যান কিনে ফেলে একটা। সে নাকি এখন থেকে ভ্যান চালাবে। উজানতলির ব্রিজ থেকে বাড়ইপাড়া বাজার পর্যন্ত ভালোই খ্যাপ মারা যায়। হঠাৎ একদিন দিদারের ভ্যানে চড়ে মহাজন আসে তাদের বাসায়। ঘরের উঠানে পান বিড়ি খেয়ে চলেও যায়। অথচ আশ্চর্য আলেয়ার সঙ্গে কথা হয় না একটুও। মানুষের মনের ভেতর কোনো গোপন কুঠিুরিতে হয়তো এমন একটা সাপ আছে, যে শীত নিদ্রায় শুয়ে থাকে নিস্তেজ। শুধু রোমাঞ্চপ্রিয় কেউ যদি হঠাৎ অন্ধকারে জাগিয়ে দেয় তাকে তবে তেড়েফুড়ে বিষদাঁত ফুটায় মগজে। একদিন কৌতূহলের বশেই হঠাৎ দেখা হওয়া মহাজনের সঙ্গে কথা বলে আলেয়া। হয়তো কোনো ধরনের নিষিদ্ধ কৌতূহল তাকে জড়িয়ে ধরেছিল আষ্ঠেপৃষ্ঠে! শুরু হয় দিদারের চোখ ফাঁকি দিয়ে মহাজনের সঙ্গে দেখা করা। একদিন হঠাৎ খপ করে তার হাত ধরে মহাজন বলেছিল—যাবি আমার সাথে, চল পালিয়ে যাই। কিন্তু আমার সংসার, আমিনা! সব হবে, আবার সব হবে। মহাজন কেমন ঘোরলাগা চাহনিতে সম্মোহিত করেছিল আলেয়াকে। লোকটার প্রতি তার কেমন যেন মায়া হয়, উছলে ওঠে নিষিদ্ধ ভালোবাসার ঢেউ। তারপর সত্যিই একদিন রাতে দিদার যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, তখন চোখের জলে ভাসতে ভাসতে আমিনার কপালে ছোট্ট চুমু এঁকে মহাজনের হাত ধরে ঘর ছাড়ে আলেয়া। মহাজন তাকে নিয়ে চলে দূর থেকে দূরের এক গ্রামে। এখানে দিদারের ভ্যান চলে না, থেকে থেকে কান্নাও শোনা যায় না আমিনার। আবার আলেয়ার নতুন সংসার। মহাজন অবশ্য তার কথা রেখেছিল। আলেয়ার ঘটনা নিয়ে পুরো গ্রামে ছিঃ ছিঃ পড়ে যাওয়ার পর সেও আর ফিরে যায়নি প্রথম বউয়ের কাছে। সেই থেকে ভালোই চলছিল ওদের ঘর পালানো সংসার।
__________________________________________________________________________________
দিদার ওর হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে বলে, আমিনারে দেখতে মন চায় না তোর?
__________________________________________________________________________________
তারপর কী হলো ওদের মঞ্জুলি? কী লিখব, আলেয়ার কথা? কেমন করে সাজিয়েছিল নতুন সংসার, কিংবা কখনো কি একবারের জন্যও মনে পড়তো না পেছনে ফেলে আসা দিদার শিশুকন্যা আমিনাকে! তুমিই বলো না কি লেখা যায়? না কি মহাজনের কথা লিখব? যে ভালোবাসা ঠিক কি জিনিস না বুঝে ঠিকই ভালোবেসে ফেলেছিল আলেয়াকে। যে পুরুষ আর ফিরে যায়নি তার প্রথম সংসারে। অথচ দেখো আজ ভ্যানে শুয়ে মৃত্যুর ছায়া দেখতে দেখতে লোকটা কেমন হাহাকার করছে বাতাসের জন্য। নাকি দিদারের কথা লিখব! বলো না মঞ্জুলি, তুমিই বলে দাও। তিনি খানিকক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন। তার মনে হয় যেন কানের সামনে মঞ্জুলি ফিসফিস করে কখনো দিদার, কখনো আলেয়া, কখনো বা মহাজনের নাম জপছে।
সেদিন ঘরে ফিরে মহাজন ভালোই ছিলেন। আলেয়ার রান্না করা পুঁটি মাছের ঝোল আর কলমি শাক দিয়ে ভাত খেয়ে আসন্ন বর্ষায় ব্যবসার ভবিষ্যৎচিন্তা করতে করতেই বুকের ব্যথাটা শুরু হলো। দুপুর যখন একটু ধরে এলো তখন তিনি বাতাসের অভাবে খাবি খাচ্ছেন মাছের মতো। চোখ হয়ে উঠেছে টকটকে লাল। বিড়বিড় করে আলেয়াকে বলেন, আমি মনে হয় আর বাঁচমু না। তোর কী হবেরে আলেয়া? আলেয়া উদ্ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করে এর কাছে ওর কাছে। কে আছো-মহাজনেরে বাঁচাও, আমার স্বামীরে বাঁচাও, হাসপাতালে নিয়া চলো। উদ্ভ্রান্ত আলেয়ার কান্না অবাক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে গ্রামবাসী। অথচ কী আশ্চর্য, কই কেউতো এগিয়ে এলো না। তবে কী মরে যাবে লোকটা, মহাজন মরে যাবে বেঘোরে! কোথা থেকে যেন দৌড়ে এলো এক চ্যাংড়া যুবক। সে কাঁধে করে নিতে চায় মহাজনকে। কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব, না কি ধরাধরি করবে কয়েকজন? এভাবে না, বরং একজন দৌড়ায় উজানতলির ব্রিজের কাছে। সেখানে ভ্যান পাওয়া যায়। ধরে নিয়ে আসতে হবে একটাকে। সেখান থেকেই একজন ভ্যানসহ ধরে আনে দিদারকে। আলেয়া যখন তাকে দেখলো তখন তার মনে হয়েছিল যেন—এ ঠিক তার আগের জীবন। কিছুই যেন মনে নেই তার, দিদার যেন ঠিক তার আগের অধিকার। যখন তখন তার কাছে যে কোনো আবদার চলে। তাইতো আলেয়া দৌড়ে এসে দিদারের পায়ে পড়ে। মরে যাচ্ছে, মহাজন মরে যাচ্ছে, আল্লাহর দোহাই লাগে হাসপাতালে নিয়া চলো। কিন্তু দিদার চোয়াল শক্ত করে। ও যেন ওকে এখানে ধরে এনে অপমান করার অভিযোগে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাবে গোঁ ধরা ষাঁড়ের মতো। না কিছুতেই নেবে না সে এই খ্যাপ। দরকার হলে ভ্যান বন্ধ করে বসে রইবে ঘরে। যত্তসব নষ্ট মেয়েছেলে। আলেয়া কী এক ভূতে পাওয়া মানুষের মতো একবার দৌড়ে যায় মহাজনের কাছে, আবার কখনো ফিরে এসে আছড়ে পড়ে দিদারের পায়ে। গ্রামবাসী যখন আলেয়াকে দেখে অবাক চোখে ড্যাবড্যাব হয়ে তাকিয়ে দেখছিলো এই কাণ্ড, তখন মহাজন বেঁচে থাকার শেষ শক্তিটুকু আঁকড়ে ধরে অবচেতনায় কাঁতরায়। তরুণ যুবারা দিদারকে অনুরোধ করে, মারের ভয় দেখায়, তবু সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নিজের কাছে। কিছুতেই সে নেবে না এই খ্যাপ। দিদার ভ্যান নিয়ে চলে যায়। ফিরে যাওয়ার প্রতিটি প্যাডেলে কিসের যেন অসম্ভব ক্রোধ ওকে জৈষ্ঠের ভিষণ গরম ভুলিয়ে দেয়। দরদর করে ঘেমে চলা দিদারের চোখে কেন যেন সেই দৃশ্য ভাসে—আলেয়া কাঁদছে তার পায়ে পড়ে। দিদারের নিজের প্রতি রাগ হয়। সে কেন ওই নষ্ট মেয়ে মানুষটার কথা ভাববে? কেউ না ও, কেউ কখনো ছিলও না। তবু কখনো কখনো মানুষের এমন হয়। অলক্ষ্য অভিমান কখনো চিমনির মতো হৃদয় পোড়ায়। কিন্তু মগজের কোণে কোণে ভালোবাসার ঘুন কুটকুট করে কেটে চলে মন বাঁধের ইট। ছিদ্র হয়, ক্ষয়ে যায়, গলগল করে ঢুকে পড়ে প্লাবন। আবার সে ভেসে যায় পুরনো বন্যায়। দিদারের মনে হয় জৈষ্ঠের আগুন যেন তার অভিমান তীব্র থেকে তীব্র করে তোলে। অথচ কী আশ্চর্য, কোনো এক অদৃশ্য ইশারায় দিদার প্যাডেল ঘোরায় উল্টো দিকে। এই খ্যাপটা কি তার না নিলেও চলতো না! দিদার চলে যাওয়ার পর গ্রামের যুবকরা গেছে অন্য কাউকে যোগাড় করতে। আর প্রায় নিস্তেজ হয়ে আসা মহাজনের পাশে বসে আলেয়া একমনে কী যেন ভাবতে থাকে। এমন সময় ঘরের বাইরে টুং টুং বেলের আওয়াজ পাওয়া যায়। আলেয়া দৌড়ে এসে দেখে জবজবে ঘামে মাথা নিচু করে ভ্যানসহ দাঁড়িয়ে আছে দিদার। এতক্ষণ না কাঁদলেও এখন আর কেন যেন আলেয়ার চোখের বাঁধ মানে না। তারে একলা উঠাতে পারব না। কাউরে বলেন একটু ধরতে। আর বাইরে ভিষণ রোদ, ঢাকা দেওয়ার জন্য একটা পাতলা চাদর নিতে হবে।
আচ্ছা মঞ্জুলি, দিদার ফিরে এলো কেন? নাও তো ফিরতে পারতো, বরং ওর জন্য ফিরে যাওয়াটাই তো ভালো ছিল, তাই না? কই, তুমি তো ফিরে আসোনি। নাকি প্রবল মায়ার আচ্ছন্নতা কেটে গেলে আর কেউ ফিরে আসে না। আমার প্রতি তোমার কোনটা ছিল? মায়া না কি সহানুভূতি? না না, দিদার এভাবে ফিরতে পারে না। কেন ফিরবে সে, কোন আশায়? কথার সমুদ্রে ঢেউয়ের সঙ্গে লড়তে লড়তে আমি ক্লান্ত। আমি আর এই গল্পটা লিখব না। তুমি থাকলে নিশ্চই খুব রাগ করতে। কিন্তু কেন লিখব আমি, দিদারেরা কেন ফিরে ফিরে আসে? আমি এতদিন একটি শব্দও লিখিনি। একটি চরিত্রও প্রাণ পায়নি কলমের সৌন্দর্যে। কই আমি তো মরে যাইনি। হ্যাঁ, তুমি বলতে পারো—লেখাটাই আসলে আমার পৃথিবী, কলমে সৃষ্ট মানুষগুলোই আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু। বরং ওদের দূরে ঠেলে দিয়ে বিচ্ছিন্ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি কেবল। তবু লিখব না, আমার আর ভালো লাগে না মঞ্জুলি। তুমি বুঝবে না এই যন্ত্রণা।
ঘরটা ক্রমেই যেন গুমোট হয়ে উঠেছে। তিনি কাগজ কলম ফেলে শুয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। শিরদাঁড়ার ব্যথাটা জানান দেয় ক্ষণে ক্ষণে। চৌকির পাশের টেবিলটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাগজগুলো। সেগুলোতে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা তার নামগুলো যেন ভেংচি কাটছে বারে বারে। তিনি আবারও বললেন, না লিখব না। তারপর হঠাৎ কেন যেন উঠে লেখা শুরু করলেন। মঞ্জুলি, লোভ মানুষকে বারবার নিজের সামনে নিজেকে দাঁড় করায়। এই যেমন আমি এসে দাঁড়িয়েছি। সৃষ্টির লোভে, নতুন চরিত্র, নতুন উত্তেজনা, কথার সমুদ্রের নতুন নাচন দেখার লোভে।
জৈষ্ঠের গরমে গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলো যখন বিছিয়ে আছে পথটাতে। যখন ভয়ঙ্কর গরমে থেমে থেমে নিশ্বাস উঠছে মাটির। সে সময় দিদার শক্ত পায়ে প্যাডেল চেপে এগিয়ে চলেছে ভ্যান নিয়ে। ভ্যানের ওপরে শুয়ে থাকা মহাজন কিসের যেন যন্ত্রণায় অস্ফুটস্বরে গোঁ গোঁ করছে। আলেয়া সঙ্গে আনা একটি বোতল থেকে অল্প জল ঢেলে দেয় তার মুখে। দিদারের কেন যেন হিংসা হয়, রাগ হয়। সে ভ্যানের গতি কমিয়ে আনতে থাকে। চলার হঠাৎ এই পরিবর্তন আলেয়া কি টের পেলো? উনি কেমন যেন করতেছেন, একটু জোরে চালানো যায় না? দিদারের রাগ হয়, সে যে ভ্যান চালাচ্ছে এইতো বেশি। তাকে কী অনুরোধ করা হলো না কি নির্দেশ? নষ্ট মেয়ে মানুষটার এত সাহস হয় কী করে? এই মাঝ রাস্তায় যদি সে ওদের দুজনকে ফেলে রেখে যায় তার কী এতটুকু ক্ষতি হবে? আলেয়া আগের চেয়ে আরেকটু অনুরোধ মেশানো গলায় বলে—আরেকটু জোরে চালানো যায় না? দিদার একবার কেবল পেছন ফিরে তাকায়। তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে অবোধ্য রাগে। যদিও সে কিছু বলে না। ঠিক তেমনই তো আছে আলেয়া, আগের মতো। একটুও পাল্টায়নি। হয়তো মহাজনের সংসারে ভালো আছে অনেক। তার সংসারে কী খারাপ ছিল? কই, ভাত, কাপড়, ভালোবাসায় তো একটুও কমতি রাখেনি সে। তাহলে কেন চলে গেল? হয়তো চলে যাওয়াই সব মানুষের নিয়তি। কত মানুষ কাছে থেকেও সারাজীবন দূরে দূরে থাকে অলক্ষ্যে। আবার কেউ কেউ ফেরত আসে। বৃত্তের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ভোঁ চক্কর। চলে যাওয়া আর বার বার ফিরে আসা। এই যেমন আলেয়া ফিরে এসেছে। কিন্তু সত্যিই কী এসেছে? দিদার কেবল প্যাডেল চাপে। তার রোদে পোড়া পিঠ দিয়ে চিকন ধারায় ঘাম নামে। পেছনে মহাজনকে শাড়ির আঁচল দিয়ে বাতাস করার ফাঁকে সেই দিকে হঠাৎ চোখ আটকে যায় আলেয়ার। আহারে কী মানুষটা রোদে পুড়ে কী হয়ে গেছে। যতদূর চোখ যায় জৈষ্ঠের রোদে পোড়া ধুলোর পথ। শেষ বিকেলে সূর্যও যেন আগুন ঢালতে ঢালতে মহাজনের মতো অবসন্ন। আলেয়ার হঠাৎ ইচ্ছে করে শাড়িটা দিয়ে দিদারের কালো পিঠে বেয়ে চলা ঘামগুলো মুছে দেয়। অথচ বাম হাতটা যে প্রাণপণে ধরে রেখেছে মহাজন। যেন শেষ শ্বাস পড়ার আগ পর্যন্ত নিঃশব্দে তাকে বুঝিয়ে দিতে চায়—কোথাও যেতে দেবে না আলেয়াকে। কিছুক্ষণের জন্য শাড়ির আঁচল ধরা হাতটা থেমে ছিল তার। নিশ্বাসের ভয়ঙ্কর কষ্টে চোখ বোজা মহাজনের। মুখেও বরফ ভরা পানির গ্লাসের মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম। আলেয়ার হঠাৎ কান্না পায়। কোন ঘাম সত্য, কোন ভালোবাসা সত্য তার জীবনে? না, মহাজন আমি আছি, কোথাও যাব না। কেন যাব, যাওয়ার সব পথতো বন্ধ করে দিয়ে এসেছি আমি নিজেই। কেবল দেয়ালের ওপারের স্বর যতই ডাকুক মাথা কুটে মরা ছাড়া আর কোনো কিছু করার নেই। এভাবেই কেবল পথ চলে ওরা। ধুলোমাটির ওপরে পেছনে চাকার দাগ পড়ে থাকে। যেন পেছনের পথে ফেলে আসা স্মৃতি। সামনের গ্রীষ্মের গরমে মজে ওঠা শুকনো ডোবাটার পাড়ে হঠাৎ ভ্যান থামায় দিদার। কী হইলো, ভ্যান থামালেন ক্যান? দিদার কথা বলে না। আলেয়া একই কথা আবার জিজ্ঞেস করতেই দিদার খেঁকিয়ে ওঠে। এই রইদের মধ্যে আট মাইল রাস্তা ভ্যান চালায়ে আসো না, তাইলে বুঝবা ক্যান ভ্যান থামাইছি। আলেয়া কথা বলে না, কেবল নত মুখে বলে, ঘাট আর কতদূর? ভ্যানের ওপর তখন চোখ বন্ধ করে খাবি খাওয়া মাছের মতো মহাজনের দিকে একমনে তাকিয়ে ছিল দিদার। ডোবা থেইকা একটু পানি নিয়া মুখে ছিটা দিয়া দাও, নদীর ঘাট এখনো পাঁচ মাইল। কথাটা বলেই যেন দিদার চমকে উঠে আলেয়ার দিকে তাকায়। না না, তার কেন এতো মায়া হবে লোকটার প্রতি? ওই মহাজনের জন্যই তো ভেঙে গেছে ওর ঘরটা। মা হারা মেয়েটা হয়তো এখন বাসার এক কোণে খেলছে একা একা। আর যাই হোক এই নষ্ট মেয়েমানুষটা আর তার ভাতারের প্রতি আমার কোনো মায়া নাই। তারচেয়ে বরং মরুক, এইখানে খানিকটা জিরায়ে নেই। মরলে লাশসহ মেয়েমানুষটাকে নিয়ে রেখে আসবে হাসপাতালে। তার কেবল টাকা পাইলেই হলো।
আচ্ছা মহাজন যদি আজ মরে যায় তবে আলেয়া কি ফেরত আসবে দিদারের কাছে? তোমার কী মনে হয় মঞ্জুলি? যদি আসে, তবে কি আবার অন্য গল্প লিখব? অন্য এক সুখের কথা? না কি…মঞ্জুলি এ বড্ড বড়াবাড়ি আমার। এক জীবন কি সময় দ্বিতীয়বার ফেরত দেয়? আচ্ছা তুমিই বলো, তবু দিদারের কি একবার লোভ হতে পারে না বিগত জীবনের প্রতি! আর আলেয়া, তার কি এবার দেখতে ইচ্ছে করে না পুরনো আলিঙ্গন, সংসার, ছোট্ট মেয়েটাকে? মাঝখানে তবে কেবল ঝুলে রইলো মহাজন। আমি ইচ্ছে করলেই ওকে মেরে ফেলতে পারি। তুমি কাছে থাকলে হয়তো বলতে আমার স্বভাবটাই এমন। কেবলই উদ্ভট আর সৃষ্টিছাড়া অশুভ কঠিন ভাবনা। তবু জানো ওই এতটুকু পুরনোকে ফিরিয়ে দিতে, মহাজনকে শেষ করে দিতে এতটুকু হাত কাঁপবে না আমার। নিজের কলমে আমি নিজেই ঈশ্বর, ধূর্ত, নিচ আর পাষাণ। আর এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার।
অল্প জলের মজা ডোবাটায় পা ধোয় দিদার। তারপর আঁজলা করে পানি ছিটায় মুখে। যেন জৈষ্ঠের রোদে মুখটা পুড়ে গেছে ভীষণভাবে। হঠাৎ তাকিয়ে দেখে পাশে দাঁড়িয়ে আলেয়া। একটু তাড়াতাড়ি করেন, উনি জোরে জোরে শ্বাস টানতেছেন। দিদারের চোয়াল ফুলে ওঠে। শ্বাস টানলে আমি কী করমু, উইরা উইরা তো তারে হাসপাতাল নিতে পারুম না। আলেয়া এই অপ্রস্তুত উত্তরে ভীষণ কষ্ট পায়। চোখ ফেটে যেন জল আসতে চায়। তবে কি মানুষটা এভাবে মরে যাবে? এই দিদারকে তো সে চেনে না। এ যেন অন্য এক মানুষ। তবু সে দিদারের কাছে হাতজোড় করে, দয়া করেন, চলেন একটু তাড়াতাড়ি। কান্নারত আলেয়ার মুখে যেন অব্যক্ত যন্ত্রণার ছাপ পড়ে। হঠাৎ দিদারের কী যেন হয়। সে কাছে এগিয়ে এসে হাত রাখে আলেয়ার মাথায়। কই সেই আলেয়া তো আগের মতোই আছে। সেই যে বিয়ের রাতে বাপের বাড়ি ছেড়ে এসে মেয়ের কি হাপুস নয়নে কান্না! আজ ওকে তো সেই একই রকম লাগছে! যেন মাঝখানে কোনো বছর ছিল না, মহাজন ছিল না। দিদার চোখের জল মুছিয়ে দেয় ওর। অপ্রত্যাশিত এই স্পর্শে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়া আলেয়া অবাক চোখে কেবল তাকিয়ে থাকে। দিদার ওর হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে বলে, আমিনারে দেখতে মন চায় না তোর? সেই ঘর, তোর লাউ গাছ, গোয়াল, রান্নাঘর দেখতে মন চায় না? তুই যাবি আবার ফিইরা? হঠাৎ ভ্যানের ওপর থেকে মহাজনের আর্তনাদ শোনা যায়। আলেয়া দিদারের হাত এক ঝটকায় ফেলে দৌড়ে যায় সেদিকে।
মঞ্জুলি মহাজনের মরে যাওয়াই ভালো। আর একবার না হয় গল্প শুরু হোক নতুন করে। আর একবার না হয় আলেয়া ফিরে যাক দিদারের কাছে। বাইরের বাতাসে মাথার ওপর ফ্যানটা জোরে দুলে ওঠে। লেখকের ঘরের ভিতর যেন অস্বাভাবিক রকম অস্বস্তি ঘুরে ঘুরে ফিরছে। তিনি লেখা বন্ধ করে চোখ বুজে শুয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। শিরদাঁড়ার ব্যথাটা পাক খেয়ে ঢেউয়ের মতো পাক খেয়ে যেন উঠে আসছে ওপরে। তার খুব পিপাসা পায়। অথচ জগে হাত দিয়ে দেখেন তাতে পানি নেই। আবার কী লিখতে বসবেন? কাগজে আবার কী যেন লিখতে থাকেন তিনি, পরক্ষণেই আবার তা কাটাকুটি দিয়ে ভরে দেন। এভাবে দিদার-আলেয়া-মহাজনের শরীর যেন অকস্মাৎ ভরে ওঠে কালো রঙের অসংখ্য কাটাকুটি দাগে। তারপর কেন যেন ধৈর্য হারিয়ে কলমটাকে মাটিতে আছড়ে ফেলেন তিনি। আমি, আমি আসলে কী, তুমিই বলে দাও মঞ্জুলি? নিজের সৃষ্টির গড়া দাস, রক্ত-ঘামে গড়া একতাল মাংসপিণ্ড? না কি ভালো মানুষের ছাঁচে গড়া অর্ধেক বনমানুষ। নয়তো কোথায় আমি, কোথায় আমার নিজের আত্মা? তুমি বলো, নিজের সৃষ্টির গড়া মেকি দুঃখে কেন আমার চোখে জল আসে? কেন দিদার একমনে দাঁড়িয়ে থাকে অকস্মাৎ আশাভঙ্গের বেদনায়। কেন মহাজন মরে যায় না? কেন ভালোবাসার সমুদ্র তীরে দাঁড়িয়ে আলেয়া আবার ফিরে যায় আরেক সমুদ্রে? আমি কেন বার বার কাঁদব তাদের দুঃখে? কই তুমি যখন হাসতে হাসতে ছেড়ে গেছ আমায়, আমি তো কাঁদিনি। অব্যক্ত যন্ত্রণায়, কখনো নিকষ দুঃখে বার বার মরেও মরে যাইনি। তবে কেন মঞ্জুলি, জবাব দাও? লেখকের হঠাৎ মনে হয় ঘরটা যেন আরো অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে ধীরে-ধীরে। চারপাশের চারটে দেয়ালে যেন লাল ছোপ-ছোপ রক্ত। যেন বুক ভরে শ্বাস টানতে পারছেন না। তবু কোনোক্রমে উঠে গিয়ে টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে মঞ্জুলির সবেধন নীলমনি ছবিটা নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদেন। হারিয়ে ফেলা দুঃখ যেন নতুন করে ঢেউ তোলে সমুদ্রে। আজ এই নতুন যন্ত্রণায় তিনি নিজেই একজন দিদার, আলেয়া, মহাজন। তাহলে মঞ্জুলি কে, মঞ্জুলি তুমি কোথায়? আমি তোমাকে বলেছিলাম না আমি আর কখনো লিখতে পারব না। আমি ফুরিয়ে গেছি, তুমি সঙ্গে করে নিয়ে গেছ আমার শ্রেষ্ঠ সময়। এখন আর ঈশ্বর নই আমি। আমি সাধারণ লেখক হতে চাই। খাব- দাব-লিখব, পত্রিকায় লেখা ছাপা হবে, বই বের হবে, সেই বই দেখিয়ে বত্রিশ দাঁত বের করে তৃপ্তির হাসি হাসব। গর্ব করে অন্যকে বলা যাবে—দেখুন আমি কত বড় শিল্পী, শিল্প-সাহিত্যে, জ্ঞানে, রুচিতে আমি কতখানি এগিয়ে আপনাদের চেয়ে। এভাবেই তো চলে, এভাবেই তো চলছে। নয়তো কেন মহাজন মরে যেতে পারে না! বর্তমান আরেকবার ফিরে যাক চিরাচরিত অতীতে। না কি লেখক মানে প্রাকৃত বাক্যের বিকৃত পসরা, লেখক মানে পাঠকের মনোরঞ্জন, লেখক মানে বেশ্যা। যে তোমায় আজ পড়ছে, তার সঙ্গেই চাইলে শুয়ে পড়ো। তার মনের ভেতরেই ঢুকে যাও তার মতো হয়ে। অথচ মাথার গভীরে নিয়ত কেঁদে চলা দিদার, আলেয়া, মহাজনেরা নতুন নতুন জন্মের তাড়নায় ঠুকরে মরে। এই যে, এই গল্পটা শেষ হলে কে আর মনে রাখে তাকে? কেউ না—এর পেছনের যন্ত্রণা, তাড়না কেউ জানতে চায় না। তিনি সদ্য লেখা কাগজগুলো ছুড়ে ফেলেন ঘরময়। ফ্যানের বাতাসে সারি সারি বাক্য-সংবলিত কাগজগুলো উড়ে বেড়ায়। তিনি আজ অনেকদিন পর অঝরে কাঁদেন। দিদারের জন্য কাঁদেন, আলেয়া, মহাজন, মঞ্জুলির জন্য কাঁদেন। এভাবে কতক্ষণ চলে যায় খেয়াল নেই। হঠাৎ মনে হয় যেন মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা কাগজের মাঝে একটা সাদা কাগজ ডাকে তাকে। তিনি কলম আর কাগজটা আবার তুলে নেন। পাশ থেকে কানে কানে খুব চেনা কণ্ঠে মঞ্জুলি কথা বলে—লেখক মানে কারিগর, লেখক মানে শিল্পী, লেখক মানে এক মনে কাঠ ঠুকে বানিয়ে ফেলা অসম্ভব সুন্দর গল্পের ভাস্কর্য, লেখক মানে কুমার, নরম মাটি দিয়ে বানানো পুতুল। এসো আবার কলম ধরো, সপ্তম জন্ম হোক কথা সমুদ্রের। অলৌকিক আনন্দের ভার বিধাতা যাহারে দেন, তাহার বক্ষে যে বেদনা অপার।
শ্বাসকষ্টে ক্রমাগত খাবি খেতে খেতে মহাজনের চোখমুখ লাল হয়ে ওঠে। আলেয়া পাগলের মতো বাতাস করে আর কাঁদে। না না চোখ খোলা রাখেন, আপনে চোখ খোলা রাখেন, এই যে আমি। মহাজন অবচেতনই হোক আর সচেতনেই হোক আলেয়ার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে রাখে। আর দূরে দাঁড়িয়ে কিসের যেন অব্যক্ত দুঃখে একমনে ওদের দেখে দিদার। আপনে কী পাষাণ? মানুষটা মইরা যাইতেছে আল্লা, আপনের পায়ে পড়ি তারে হাসপাতাল নিয়া চলেন। আলেয়া বিলাপ করে কাঁদতে থাকে।
হঠাৎ যেন দিদারের সম্বিত ফেরে। মাথার ওপর সূর্য তখন প্রায় অস্তগামী। সে তার লুঙ্গিটা কাছা দিয়ে নেয়। তারপর ভ্যানে চড়ে বসে সর্বশক্তিতে পা চালায় প্যাডেলে। পেছনে আলেয়ার হাত মুঠোয় নিয়ে ছটফট করতে থাকে মহাজন। দিদার রুদ্ধশ্বাসে প্যাডেল চাপতে চাপতে পেছন ফিরে বলে, এই পৌঁছায়া যামু, টিকে থাকো মহাজন, টিকে থাকো।