গুঞ্জর মোল্লার কথা তোমার মনে আছে কিনা জানি না।
মুহূর্তে গ্রামগঞ্জের কতোজনের মুখ তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে উঠতে মিলিয়ে যায়। না, মাহমুদ সেরকম কাউকে মনে করতে পারে না। তবে নামটা তার একেবারে অপরিচিতও ঠেকে না। কবে কোথায়, কার কাছে যেন সে নামটা শুনেছে, গুঞ্জর মোল্লা। হয়তো বা দেখেছেও তাকে। কিন্তু কে সে? কোথায় থাকে? কী করে? বয়স কতো? এ মুহূর্তে কিছুই তার মনে পড়ছে না। বড় ভাই আলমের মুখের দিকে সে উদাসদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আলম তাকে বলে, সেই যে পদ্মার ধাওয়া খাইয়া বুড়ির চর থেক্যা নওয়াবগঞ্জ চরে আমরা ঘর তুলছিলাম, তুমি তহন ম্যালা ছোড। বড় জোর চাইর পাঁচ বছরে পা দিছিলা। হেই সময় আমরা নওয়াবগঞ্জের চরে আহি।
বুড়ির চরের কথা মাহমুদের মনে পড়ে। তবে ঝাপসা ঝাপসা। বিশাল কাশবন। কোদাল দিয়ে কাশের ছোবা আমূল তুলে মাঝে মাঝে ধান, কাউন, গম, তিল, তিসি আর বাদামের চাষ। বাড়ি থেকে সরু রাস্তা ধরে প্রায় মাইলখানে এগিয়ে গেলে পদ্মা। সারাক্ষণই স্রোতের শো শো। একটু বাতাস উঠলেই বিশাল বিশাল ঢেউ, তর্জায় গর্জায়। তার ওপর দিয়ে দিনরাত চলে পারাপারের নাও। জেলে নাও। মহাজনী নাও, গয়না, ছান্দি কত যে নাম এক একটার। সব নাম মাহমুদের আজ মনেও পড়ে না। তবে চোখের সামনে আজো ভেসে ওঠে সেই সব দৃশ্য, গুন টেনে টেনে, গান গাইতে গাইতে মাঝিদের উজিয়ে যাওয়া। কিংবা স্রোতের টানে দূরদূরান্তে ভেসে যাওয়া।
মাঝে মাঝে লঞ্চ আর বড় বড় স্টিমারের যাওয়াআসা। খাড়া পাড়ে দাঁড়িয়ে উলঙ্গ, অর্ধ উলঙ্গ মাহমুদরা এক একটা লঞ্চ কিংবা স্টিমারের দেখা পেলেই হৈ হৈ করে উঠতো। তা দেখে যাত্রীরাও আনন্দ পেতো। হাসাহাসি করতো। কেউ কেউ কথাও বলতো। কিন্তু কী বলতো, ইঞ্জিনের একটানা গো গো গম গম ফটফট ফটরফটর আওয়াজে মাহমুদরা তা কিছুই বুঝতে পারতো না। শুধু বোকার মতো তাকিয়ে তাকিয়ে হাসতো। না হয় হৈ চৈ, নাচানাচি করতো।
মাঝে মাঝে দল বেঁধে নেমে যেতো নিচে, জলে। হয়তো গোসল, না হয় পাড় ধরে উজান কিংবা ভাটির দিকে হেঁটে যেতো, মাছরাঙাদের বাসা খোঁজার জন্য। খাড়া পাড়ে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে গর্ত করে বাসা বানাতো মাছরাঙারা। মাহমুদরা নির্ভয়ে সেই এক একটা গর্তের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বাসা থেকে বের করে আনতো ডিম, না হয় বাচ্চা। ওখানে সাপখোপ থাকতে পারে, তা তাদের মাথায়ই আসতো না। তবে একবার এক বাসা থেকে একটা জাতি সাপ (গোখরো) বেরিয়ে আসতে দেখেছিল তারা। সেটির তাড়া খেয়ে বাড়ির দিকে ভো দৌড়। ওদিকে আর পা বাড়াতো না তারা। তারপর তো ভেঙেই গেল বুড়ির চর। মাহমুদের সেই উলঙ্গ, অর্ধ উলঙ্গ বন্ধুরা কে কোথায় চলে গেল, হারিয়ে গেল, তা সে স্মরণ করতে পারে না। এমনকী কারো নাম, কিংবা চেহারাও আজ আর স্পষ্ট হয়ে ওঠে না তার মনের পর্দায়।
মাহমুদের চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। সেই কথা মনে পড়ে আজো তার চোখের পাতা ভিজে ওঠার উপক্রম হয়। তখন বড় ভাইর কথা তার মগজে টোকা মারে, হেই হাসানের বাপই তো গুঞ্জর মোল্লা।
অবশ্য নবাবগঞ্জ চরের কথা ভিন্ন। এখানে যারা তার বন্ধু হয়েছিল তাদের কথা সে আজো ভুলে যায়নি। খুরশেদ, জালাল, কুদ্দুস এমন কতোজনের কথাই তো তার মনে পড়ে। চেহারা, নামধামও ভুলে যায়নি। সারাদিন একসাথে তারা গরু চরাতো। কোনো কোনোদিন মাঠে বাদাম লাগাতো। কিংবা কাশবনের ভেতরে ঢুকে বালিহাঁস, কানি বক আরো কতোরকম পাখির বাসা যে তারা খুঁজে বেড়াতো, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। চরটাও ছিল বিশাল। কাছেধারে নদী ছিল না। বাড়ির কাছে বিরাট একটা খাল। সারাবছরই পানি থাকতো। সেখানেই তারা ঝাপাঝাপি করতো। জাল ফেললেই উঠে আসতো কতোজাতের মাছ। বর্ষায় আবার সেই খালের কোনো অস্তিত্ব থাকতো না। সারা চরটাই তখন জলে থৈ থৈ। বাড়িঘরগুলো ডুবো ডুবো। পদ্মার বড় বড় ঢেউগুলো বনবাদাড় ঠেলে ঠেলে এসে ঘরবাড়ি দুলিয়ে যেতো। একটু বড়গোছের নৌকাই ছিল তখন হাটবাজারে যাওয়ার একমাত্র ভরসা। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি কিংবা এদিক ওদিক যাওয়ার জন্য কলাগাছের ভেলা আর ডিঙি নাও। গরুর জন্য তারা মাঠ থেকে ঘাসটাস তুলে আনতো। বড়শি ফেলে মাছ ধরতো। ধানগাছ কিংবা কাশের ছোবার নিচে ডুবিয়ে আসতো দোয়াড়। সকালবিকাল জলের ওপর তুলে ধরলেই চালিতে খচমচ করতো ডিমঅলা ছাডা ইছা, বাইন, টেংরা, টাকি, শিং, মাগুর, পুটি, বাইলা, রিটা কতোরকম মাছ! বাড়িতে তখন দিনরাত মাছ ভাজা হতো। রান্না হতো। এতো মাছ খেতেও ইচ্ছে করতো না মাহমুদের।
সারি সারি ঘরবাড়ি উঠে, এক একটা গ্রাম গড়ে উঠেছিল। তাদের বাড়ির উত্তরে ছিল লাল মিয়া চাচার বাড়ি। তার উত্তরে পচা নমুদের ঘরবাড়ি। দক্ষিণে শামসুদ্দিন চাচা, ইছাক দাদারা ছিল। তারপর বাদশাহ ভাইয়েরা। তারপর… কারা ছিল মাহমুদ মনে করতে পারে না। অথচ বড় ভাইয়ের মেমোরি কী শার্প! সে বলে, আমাগো বাড়ি থেকে দক্ষিণে বারোহান বাড়ির পরই ছিল গুঞ্জর মোল্লার বাড়ি। তোমার মনে নাই? ওই যে তার ছোড পোলা হাসান মিয়ার হাথে তোমার ছিল গলায় গলায় বাব। একজনরে ছাড়া আরেকজন থাকবার পারতা না। রাইতের বেলা বাদশাহর দাদির কাছে গপ্পো হুনতে যাইতা। মনে পড়ে? আরে ওই যে…
হ্যাঁ, এইবার হাসান মিয়ার চেহারা মাহমুদের কাছে আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে থাকে। গোলগাল চেহারা। মাহমুদের চেয়ে লম্বাচওড়া আর শক্তপোক্ত দেহ। গায়ের রঙটাও কুচকুচে কালো। বেশি কালো ছিল বলেই হয়তো ওর সাথে অনেকে খেলতে চাইতো না। তাছাড়া ওকে খুব ভয় পেতো সবাই। কারণ ওর মেজাজ ছিল খুব চড়া। কারো সাথে একটু কথা কাটাকাটি হলেই ও দুমদাম দুচার ঘা তার গায় বসিয়ে দিতো। একবার দক্ষিণপাড়ার এক ছেলের সাথে মাহমুদের ঝগড়া বেঁধে গিয়েছিল। ঝগড়ার তেমন কোনো বিষয়ও ছিল না। হাঁটতে গিয়ে ছেলেটার পায়ে একটু পাড়া লেগেছিল মাহমুদের। তাতেই ছেলেটা খেপে উঠেছিল, এই শালা তুই আমার পায় পাড়া দিলি ক্যা। মাহমুদ বলেছিল, আমি দেহি নাই। কিন্তু তা কি শোনে সেই পোলা! হঠাৎ ঠাস করে তার গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। চড় খেয়ে মাহমুদ তো একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা। পাশেই ছিল হাসান। সাথে সাথে ওকে জিজ্ঞেস করলো, এই হুমুন্দির পুত তুই ওরে মারলি ক্যা? তারপর এক ঘুষিতে ওই ছেলের নাক ফাটিয়ে রক্ত বের করে দিয়েছিল সে। এতো ঘনিষ্ঠ একজন বন্ধু, অথচ তার নামটাই কিনা সে ভুলে গিয়েছিল!
মাহমুদের মনে পড়ে, একসাথে তারা গরু চরাতো। মাঠে কাজকর্ম করতো। খেলতো। সারাক্ষণই গলায় গলায়। কোনো কোনো রাতে ঘুমাতোও একসাথে, গল্পের লোভে বাদশার দাদির কাছে চলে যেতো। দাদি ফোঁকলা দাঁতে পান চিবাতো আর গল্প বলতো। সারারাত বললেও তার গল্প ফুরাতো না। রহিম বাদশা, রূপবানের গল্প, হাতেম তাইয়ের গল্প, জ্বিনপরী, দেওদানবের গল্প… কী যে ভালো লাগতো এক একটা গল্প। রাত ফুরিয়ে আসতো, তারপরও তার চোখে ঘুম আসতো না, গল্পের শেষ কী হলো, তা জানার জন্য মনটা ছটফট করতো। হাসান অবশ্য অনেক আগেই ঘুমে একেবারে কাদা হয়ে যেতো। পরদিন খেয়েদেয়ে গরু নিয়ে আবার মাঠে। না হয় ক্ষেতের কোনো কাজকর্মে ডুবে যেতো।
মাহমুদ যেদিন থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করে, সেদিন থেকেই হাসানের সাথে তার দূরত্ব বাড়তে থাকে। কয়েকদিন সে হাসানকে বলেওছিল, চল ইশকুলে যাই। কিন্তু ও মোটেও রাজি হয়নি, না রে লেহাপড়া করতে আমার বালো লাগে না। আমার জন্যি ক্ষেতের কামকাইজই বালো। ক্ষেতখামারের কাজেই মগ্ন হয়ে গিয়েছিল ও। মাহমুদ ক্লাশের পর ক্লাশ ডিঙিয়ে যতোই সামনে এগিয়ে গেছে, হাসান ততোই পেছনে পড়ে রয়েছে। তারপর একদিন তো হারিয়েই গেল। ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে জাতি সাপের কামড় খেয়েছিল। নামকরা ওঝা বছির মিয়ার তন্ত্রমন্ত্র আর ঝাড়ফুঁকেও কাম হলো না। মুখে গ্যাজলা ওঠে মারা গেল হাসান। শরীর নীল হয়ে গিয়েছিল! ওর মা মাহমুদকে জড়িয়ে ধরে, অ হাসান, হাসান কই গেলি বাপ। কোন আজরাঈল তোরে…আলুথালু হয়ে খুব জোরে জোরে চিৎকার করছিল সে। মাহমুদের চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। সেই কথা মনে পড়ে আজো তার চোখের পাতা ভিজে ওঠার উপক্রম হয়। তখন বড় ভাইর কথা তার মগজে টোকা মারে, হেই হাসানের বাপই তো গুঞ্জর মোল্লা।
মাহমুদের দিকে চোখ তুলে তাকায় আলম। দেখে, দূরে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে মাহমুদ। সেই ছোট্ট মাহমুদ। আলম বলে, একবার কি ওদিকে যাইতে পারবা, বাই? সুময় অইবো তোমার?
হ্যাঁ, গুঞ্জর চাচা। এবার হাসানের মনে পড়ে তার মুখ। গোলগাল চেহারা। বড় বড় দুটো চোখ। লম্বাচওড়া গড়ন। মাথাভর্তি চুল। মুখে কালো কুচকুচে চাপদাড়ি। চুল আর দাড়ির সাথে গায়ের রঙ পার্থক্য করা যায় না। তবে তার মুখে ভারি রস ছিল। কথায় কথায় হাসাতে পারতো। আর সবসময় মুখে হাসি লেগেই থাকতো। একদিন তার বড় নৌকাটা খালে ডুবে গিয়েছিল, তখন বর্ষা শুরু হয়েছে, পদ্মার জল খালে পড়ে শো শো তীব্র স্রোতের সৃষ্টি করেছে, বেশি দেরি হলে নৌকাটা কোথায় হারিয়ে যাবে, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই, সেই সময়ও গুঞ্জর চাচাকে বিষণ্ন দেখা যায়নি। মানুষজন ডেকে নেমে গিয়েছিল সেই স্রোতের মধ্যে। প্রত্যেকে ডুব দিয়ে চলে যেতো জলের তলায়। অনেকক্ষণ পর শুষুকের মতো ভুঁস করে উঠে আসতো জলের ওপর। অনেকক্ষণ ডুবোডুবির পর নৌকার খোঁজ পেয়েছিল তারা। মোটা মোটা দড়ি বেঁধে উঠে এসেছিল পাড়ে।
ছেলেবুড়ো সবাই মিলে দড়ি ধরে টানাটানি। তাদের মধ্যে মাহমুদও ছিল। বড়দের একজন আগে আগে বলতো, হেইও…অন্যরাও বলতো, হেইও… জোরে টানো.. হেইও…, আরো জোরে.. হেইও…, এই, বল কি আছে?…, আছে…,আরো জোরে, হেইও…এসব বলে বলে দুপুরের মধ্যেই তুলে ফেলেছিল বড় নৌকাটা। গুঞ্জর চাচা বলেছিল, আইজ দুপুর আমার বাড়িত তোমাগো সবার ডাইলবাতের দাওয়াত। যাইবা কিন্তুক।
গোসলটোসল সেরে মাহমুদরা গিয়েছিল তার বাড়ি। গুঞ্জর চাচা বড় বড় দুটো মোরগ জবাই করেছিল। তরকারির ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। সাথে কাঁচা কুমড়োর ভাজি আর মশুরির ডাল। লাল লাল আউশচালের ভাত। পেটপুরে খেয়েছিল তারা। খেতে খেতে ধলা চাচির রান্নার তারিফ করেছিল সবাই। তবে মাহমুদের মনে হয়, মোরগের চেয়ে কুমড়াভাজি স্বাদ হয়েছিল বেশি। জীবনে অনেক কুমড়োভাজি সে খেয়েছে, কিন্তু সেরকম স্বাদ আর পায়নি। স্বাদটা যেন আজো তার জিহ্বায় লেগে আছে। তারিয়ে তারিয়ে সেই স্বাদ বেশিক্ষণ অনুভব করা হয়ে ওঠে না মাহমুদের। বড় ভাই বলে, হাসান মারা যাওনের পর গুঞ্জর চাচা খুউপ মনমরা অইয়া গেছিল, তোমারে দেখলেই কাছে টাইনা নিতো। তারপর ভারি একখান নিয়াস ফেলতো। না অয় হু হু কইরা উটতো। মনে পড়ে তোমার?
মাহমুদ মাথা ঝাঁকায়, হ্যাঁ, এখন সবই মনে পড়ছে তার। বড় ভাইকে সে জিজ্ঞেস করে, গুঞ্জর চাচা এখন কোথায় থাকে? কী করে?
বড়ভাই বলে, বিলাসপুর বাড়ি করছে তারা। তাও মনে অয় চৌদ্দ পনের বছর অইলো। আমিও জানতাম না। একদিন তার ছোড পোলা কালামের হাথে দেহা। জয়পাড়া বাজারে। আমার মুহের দিকে অনেকক্ষণ চাইয়া থেক্যা কইলো, আপনি আলম বাই না? আমি কইলাম, হ। আপনি কেডা? অ কইলো, আমি কালাম, গুঞ্জর মোল্লার ছোড পোলা। ওই যে নওয়াবগঞ্জের চরে…তারপরই আমি চিনলাম ওকে। বুকে জড়ায়া দরলাম। তারপর হোডেলে বইয়া পুরিসিঙ্গারা খাইতে খাইতে কতো কতা। শেষে আর ছাড়লোই না, বাবারে দেইখ্যা যান। কত কয় আপনাগো কতা। হাত দইরা টাইনা নিয়া গেলো বাড়ি। মাহমুদ জিজ্ঞেস করে, গুঞ্জর চাচার কী অবস্থা। এখনো বেঁচে আছে তো?
বড়ভাই ভাই একটা নিয়াস ছেড়ে বলে, আছে। তবে না থাহনেরই দশা। পাহাড়ের লাহান সেই মানুষটা আর নাই। শুকাইতে শুকাইতে কাডের মতোন অইয়া গ্যাছে। শইলের হাড় কয়হান গুণ্যা দেওন যায়। অনেকদিন দইরা পইড়া আছে বিছানায়।
কী অসুখ?
জানি না। কেউ কিছু কইবার পারে না। মনে অয় ডাক্তার কইবরাজ ফেল। যাওনের সুময় অইয়া গ্যাছে গা। যে কুনো সুময়…
মানুষজন চিনতে পারে?
জানি না। তবে আমার নাম হুনার পর এক ধিয়ানে আমার দিকে চাইয়া রইলো। আমি কইলাম, চাচা, আমারো চিনবার পারো নাই অহনো? আমি আলম। তারপরই তার ঠোঁড কাঁইপা কাঁইপা উটলো। দুই চোখ অইতে টপটপ কইরা পানি পড়তে লাগলো। তারপর মাম..মাম…কইরা গোঙায়া উঠলো। কী কইলো বা কইবার চাইলো কিছুই বুঝলাম না। চাচি আর কালামের মুহের দিকে চাইয়া রইলাম। তারা কইলো, মামুদের কতা জিগায়। কেমুন আছে জানবার চায়। আমি কইলাম, আল্লার রহমতে মামুদ বালোই আছে। পড়ালেহা কইরা ম্যালা বিদ্বান অইছে। বড় চাকুরি করে। বউপোলাপান নিয়া ঢাহায় থাহে। চাচা আবারও মাম..মাম… কইরা কী জানি কইলো। চাচি কইলো মামুদরে একবার শ্যাষ দেহাডা দেকবার চায়। আমি কইলাম, মামুদ তো ম্যালা ব্যস্ত। বাড়িতে আইবারই সুময় পায় না। কবে আহে, না আহে তার কুনো ঠিক ঠিকানা নাই। আইলে কমুনে আপনার কতা। চাচার মুখখান কেমুন কালো অইয়া গ্যালো। মাম..মাম…কইরা আরেকবার গোঙায়া উইট্যা একেবারে চুপ অইয়া গ্যালো। দেহি তার চোখ থেক্যা আবারও গড়ায়া পড়ছে পানি। হেই পানি আঁচলে মুছতে মুছতে চাচি কইলো, ম্যালাদিন দইরা মামুদরে দেকবার চাইতাছে। মনে অয় তার জন্যিই জানডা অহনো পইড়া আছে উনার। বাপু, তুমি যদি একবার মামুদরে আইতে কইতা। বেশিক্ষণ না, একবার দেহা দিয়াই চইলা যাইতো…উনার মনের শ্যাষ আশাডা পূরণ অইতো…চাচিও আঁচলে মুখ চাপা দিয়া কানলো। আমি আর কী কমু, কী-ই বা কইতে পারি আমি, কইলাম, আচ্ছা, কমুনে।
মাহমুদের দিকে চোখ তুলে তাকায় আলম। দেখে, দূরে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে মাহমুদ। সেই ছোট্ট মাহমুদ। আলম বলে, একবার কি ওদিকে যাইতে পারবা, বাই? সুময় অইবো তোমার?
মাহমুদ মাথা ঝাঁকায় আস্তে।