খিলগাঁও তিলপাপাড়ার সরু একটি পাকা রাস্তায় হাঁটছি আমরা।
পড়ন্ত বিকেলের তেজহীন আলো। গলির মোড়ে-মোড়ে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের আড্ডা। শিশুদের হইচই। রাস্তার ওপর ক্রিকেট খেলার আয়োজন। কারও জানালার কাচে টুং করে আওয়াজ। ঝনঝন করে ঝরে পড়লো কাচের টুকরোগুলো। পাশেই চায়ের দোকানে হাসির ঠমক—পোলাপাইনগুলা কী যে পাইল? ক্রিকেট ক্রিকেট কইরা পাড়াডা মাতায়া রাখলো। বাড়ির মালিকের জানালার কাচ বদলাইতে বদলাইতে জান শ্যাষ। বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে রিকশা চালকের অলস বিশ্রাম। এসব দেখতে দেখতে এগিয়ে চলছি আমরা।
আমাদের একসঙ্গে দুটি কাজ। হেঁটে হেঁটে অবসর সময় কাটানো। আর বাসায় যেহেতু সিগারেট খাওয়া যায় না; তা-ই বাইরে এলেই একটু টান-টুন আর কি! তবে বিশেষ কাজটি হলো-একটি বাসা খুঁজে বের করা—রথ দেখা আর কলা বেচা!
বাসাটা অবশ্য খুঁজতে হচ্ছে বর্তমান রুমমেট খন্দকার মাহমুদুল হক মিলন ভাইয়ের জন্য। আমি আর মহসিন উদ্দিন তার সফরসঙ্গী। হেঁটে-হেঁটে খুঁজে-খুঁজে যখন আমরা ক্লান্ত, তখন বসলাম একটা চা’য়ের দোকানে। যন্ত্রণার শেষ নেই। ঢাকা শহরে ব্যাচেলর হলে যে কী ঝামেলা, তা কেবল ব্যাচেলররাই জানে। বাড়িঅলা একেকজন এমনভাবে তাকান, মনে হয় আমরা উদ্বাস্তু। অথচ গ্রামে এরকম দু’চারটা বাড়ি আমাদেরও আছে।
চা খেতে খেতে ভাবছি—তবে কি ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাব? মিলন ভাইকে বললাম, বাসার নম্বর ঠিক আছে তো? চায়ের কাপটা মুখ থেকে নামিয়ে পকেট থেকে কাগজটা বের করে ভালোভাবে দেখলেন। নিশ্চিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, নম্বরটা তো ঠিকই আছে। মহসিন বললো, ভাই, আরেকবার চলুননা। শেষবারের মতো একটু চেষ্টা করে দেখি।
রাস্তার পাশে ছাপড়ার মতো বানানো চায়ের দোকান থেকে বের হয়ে দেয়ালে আঁটা নম্বর প্লেট দেখে দেখে খুঁজছি। এমনিতেই অপরিচিত এলাকা। শাহজাহানপুর থাকলেও তিলপাপাড়া কখনো আসিনি। অথচ রাস্তার এপার-ওপার। একইপথে একাধিকবার ঘুরতে দেখে উঠতি বয়সের স্থানীয় কয়েকজন আমাদের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। আমরা এবার মিথি কনফেকশনারির সামনে দাঁড়ালাম। দোকানদারকে কাঙ্ক্ষিত বাসার ঠিকানাটা দিলাম। সে একটা চাঁপা-গিঞ্জি পথ দেখিয়ে বলল, এই পথে সোজাসুজি যান। তারপর একটু বামে যাইয়েন। থ্যাঙ্কস—বলে আমরা এগোতে থাকলাম। তার কথামত আমরা সোজা গিয়ে একটু বামে গেলাম। বামে গিয়ে পেয়ে গেলাম একটা সরু পথ।
সরু পথ দিয়ে সামনে এগোতেই সম্ভবত আশি বছরের এক বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হলো আমাদের। তিনি অনুন্নত কিংবা ঘুণে খাওয়া একটা লাঠিতে ভর দিয়ে ঠুকতে ঠুকতে পথ হাঁটছেন। আমরা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। তিনজন তাঁর সামনে দাঁড়ানোর ফলে এই সরু পথে তাঁর এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হলো। তিনি বাধ্য হয়ে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে অনুচ্চস্বরে সালামের জবাব দিলেন।
এরপর ঝুলে থাকা চশমাটা নাকের ডগা থেকে টেনে ভালোভাবে নাকের গোড়ায় বসিয়ে বললেন, কী চাও বাবারা?
জবাবটা মিলন ভাইই দিলেন—আমরা আসলে তিন শ’ সাতাশি নম্বর বাসাটা খুঁজছি। আঙ্কেল, বলতে পারেন বাসাটা কোন দিকে?
তিনি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলেন। হয়তো তাঁর প্রাচীন স্মৃতির ম্যাপে বাসাটার অস্তিত্ব খুঁজছেন। এবার তর্জনি উঁচিয়ে একটা বাসা দেখিয়ে বললেন, ওই যে হলুদ রঙের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, সম্ভবত ওটাই।
বৃদ্ধ একটু থামলেন। আমরা কেবল ঘুরে দাঁড়িয়েছি। ওই বাসার দিকে পা বাড়াবো।
এবার তিনি বললেন, শোনো বাবারা, তোমরা আমাকে আঙ্কেল বললে কেন? চাচা বলতে পারতে না? চাচা ডাকটা কত যে মধুর লাগে, জানো?
আমরা হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলাম। আসলেই তো। চাচা ডাকলেই হতো। আমি ভাবতে ভাবতেই মহসিন বলে উঠলো, স্যরি, ভুল হয়ে গেছে।
বৃদ্ধ এবার বললেন, আবার সরি বলো কেন? বলো, দুঃখিত। কী মনে থাকবে তো?
মিলন ভাই এবার বললেন, থ্যাঙ্কস চাচা, মনে থাকবে।
বৃদ্ধ এবার রাগ করলেন না। আমরা ভেবেছিলাম তিনি রাগ করবেন। কিন্তু না, তিনি এবার না হেসে পারলেন না। মুচকি হাসলেন। বললেন, আবার থ্যাঙ্কস কেন? বলো, ধন্যবাদ।
আমরা লজ্জা পেয়েও সবাই হেসে ফেললাম। বৃদ্ধও ফোকলা দাঁতে হাসলেন। কিন্তু এবার মলিন সে হাসি। বিবর্ণ এক আভাস। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন, তোমাদের আর দোষ দিয়ে কী লাভ? দোষ তো আমাদের। ইংলিশ মিডিয়াম আমাদের কচি কচি বাচ্চাদের গিলে খাচ্ছে। এফএম রেডিওর নামে শুরু হয়েছে ভাষা বিকৃতকরণের প্রতিযোগিতা।
আমাদের মাথা এখন নিচের দিকে। অবনত মস্তকেই আমরা বললাম, জ্বি, আপনি ঠিকই বলেছেন।
আমরা এখনও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা ভুলে গেছি বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন। রফিক, শফিক, সালাম, বরকতের আত্মত্যাগ—এক নাগাড়ে কথাগুলো বলতে বলতে বৃদ্ধ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। এরপর বিড়বিড় করতে করতে এগিয়ে গেলেন কিছুদূর। আমরা তাকিয়ে রইলাম তার প্রতিটি পদক্ষেপের দিকে। কিছুদূর গিয়ে চশমাটা খুলে চোখ দু’টো মুছে একবার তাকালেন। তারপর মন্থর গতিতে এগিয়ে চললেন সামনের দিকে। ততক্ষণে দিনের আলোকিত পৃথিবীকে গ্রাস করেছে সন্ধ্যার প্রায়ান্ধকার। আর সে প্রায়ান্ধকারে ক্রমশই মিলিয়ে যাচ্ছেন একজন আলোকিত মানুষ।
মন্তব্য