পাত্রপক্ষ চলে যেতেই বাসায় আনন্দের ঢেউ উঠলো। বাবার আটত্রিশ শত টাকা দামের মোবাইলফোন দিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের ফোন করতে লাগলো মা—আমরা তো বুঝিইনি, প্রথমবারেই পছন্দ করে ফেলবে। ছেলে তো অফিস থেকে গাড়ি পায়। বিয়ে সামনের মাসের দশ তারিখ।
ফারিয়া নিজের ঘরে বসে হাতের আংটিটা দেখছিল। শুধু মুক্তাই নয়, সঙ্গে রুবি, ফিরোজা আর ছোট্ট গোলাপি একটা পাথরও আছে। আংটিটা সুন্দর কিন্তু ফারিয়ার ভালো লাগছে না।
এটা সত্যি যে ফারিয়াদের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। বড্ড টানাটানির সংসার। একটাকা বাড়তি খরচ করার উপায় নেই। তার মধ্যে দরিদ্র আত্মীয়-স্বজনকে সহযোগিতা, দান খয়রাতে বাবার জুড়ি নেই। আবার মা এসব বিষয়ে বাবার রাশ টেনে ধরেন বটে কিন্ত তিনিও দয়ালু হিসেবে কম যান না। এই তো ফারিয়াদের দুই বাসা পরেই মিষ্টিদের বাসা। মিষ্টির বাবা অসুস্থ, শয্যাশায়ী। অল্পশিক্ষিত মিষ্টির মা তাহেরা আন্টি দোকানে দোকানে সেলাই করা ব্যাগ সাপ্লাই দিয়ে কোনোমতে সংসার চালান। সবাই মিলে একটা ঘরে কোনোমতে থাকেন। শহরে-গ্রামে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাহেরা আন্টি দুবছর আগে মাকে এসব বলছিলেন কাঁদতে কাঁদতে। তারপর থেকে ফারিয়া খেয়াল করেছে ওদের নিজেদের এই অভাবের সংসারেও মা কিভাবে যেন মিষ্টিদের জড়িয়ে নিয়েছে। প্রায়ই রান্না করা এটা-ওটা পাঠায়। ঈদে-পরবে মিষ্টিদের দুই বোনের পোশাক কেনা ফারিয়াদের জন্য পোশাক কেনার মতোই যেন বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে তার!
যদিও ফারিয়ারা কেউ-ই কোনো এক অদৃশ্য কারণে বাবা-মায়ের কাছে খুব একটা আব্দার করে না। ফারিয়া ভাবে, চাকরি পেয়ে ও প্রতি মাসে বাবা-মাকে নতুন কাপড় কিনে দেবে।
এই টানাটানির সংসারে ফারিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে সে বড়৷ তারপর মারিয়া এবার এইচএসসি দেবে। আর একমাত্র ভাই তালাত নাইনে। ফারিয়া বোঝে, ওর বিয়ে হয়ে গেলে মারিয়া আর তালাতের পড়াশোনার জন্য বাবা আরেকটু বেশি খরচ করতে পারবে। অবশ্য ফারিয়ার জন্য যে খুব খরচ হচ্ছে, তা নয়। তবু একটা মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করলে কিছু খরচ তো লাগেই। একটু ভালো জামা, দুয়েকটা ভালো লিপস্টিক। একটু ফেস পাউডার, দুই-চারটে গহনা—হোক ইমিটিশনের; তবু লাগে তো! সঙ্গের মেয়েদের সঙ্গে কম্পিটিশন নয়, চলাফেরা করতে আজকাল এসব দরকার। মা বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়লেও এসব জানে। বাবাকে বলে ফারিয়াকে হাতখরচের একশ টাকা বেশি দেয়। মা যে কোথা থেকে টাকাটা ম্যানেজ করে, ফারিয়া ভেবে কূল পায় না।
ফারিয়ার এখন বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই। ও সবসময় স্বপ্ন দেখেছে পড়াশোনা শেষ করে একটা করপোরেট জব করবে। দেশ-বিদেশে যাবে, গাড়ি থাকবে একটা। আর ধানমন্ডি কিংবা বনানীতে একটা ফ্ল্যাটে থাকবে মা-বাবাকে নিয়ে। ঘরে পরা শাড়িগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার পরও মা দীর্ঘদিন রিফু করে পরে। ফারিয়া একদিন রাগ করে বলেছিল, এত সেলাই কেন? ঘরে পরার জন্য একটা শাড়ি কিনে নিলে কী হয়? মা হেসে বলেছিল, দেখিস না, বেরোবার সময়ই তো করতে পারি না। ফারিয়া জানে, মায়ের কথাটা মিথ্যে। টাকা বাঁচানোর কৌশল। এ কৌশলটা বাবাও করে। দুটো শার্ট দিয়ে বছর চালিয়ে দেয়। অথচ ছেলে-মেয়েদের চাহিদার কোনোটা অপূর্ণ রাখে না। যদিও ফারিয়ারা কেউ-ই কোনো এক অদৃশ্য কারণে বাবা-মায়ের কাছে খুব একটা আব্দার করে না। ফারিয়া ভাবে, চাকরি পেয়ে ও প্রতি মাসে বাবা-মাকে নতুন কাপড় কিনে দেবে।
কিন্তু এখন কি ফারিয়ার কোনো স্বপ্নই আর পূরণ হবে?
দুই.
ছাদটা অনেক বড়। বিকেল ফুরিয়ে গেছে। তবে সন্ধ্যা নামেনি এখনো। একটা কোমল সাদা ফুরফুরে আলোয় চারিদিক ভাসছে। সকালের দিকে বৃষ্টি হওয়ায় আর একটা হালকা মেঘে সারাদিন সূর্যটা গা ঢাকা দিয়ে থাকায় বাতাসটাও বড্ড মিষ্টি হয়ে বইছে। সেই ফুরফুরে আলো আর ঝিরিঝিরি বাতাসে বুকের ভেতরটা কেমন হু-হু করে ফারিয়ার।
প্রিতমেরও চর্চিত চেহারা। তবে ছবি দেখে ফারিয়ার মনে প্রিতমের প্রতি কোনো ভালোলাগা জাগে না।
চার ইউনিটের ছয়তলা বাড়ির ছাদ। ছাদটা অনেক বড়। বড় বড় ড্রাম আর বালতিতে গাছ। ফারিয়া গাছগুলোর আড়ালে ছাদের রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। মনটা বিষণ্ন ওর। একটু আগে মারিয়ার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে।
মারিয়া একটা পিরিচে কতগুলো মিষ্টি নিয়ে ফারিয়ার সামনে রেখে বললো, আপু খা। অনেক টেস্টি। পড়ার টেবিলে মাথা রেখে চোখ বুঁজে ছিল ফারিয়া। মারিয়ার ডাকে চোখ মেলে। বলে, তুই খা।
—আমি তো খেয়েছি। তোর দেখাদেখির মিষ্টি তুই খাবি না? অনেক মজা একটা খা।
—আর কোনোদিন মিষ্টি খাসনি? ফারিয়ার কণ্ঠে বিরক্তি।
কিন্তু ফারিয়ার মন খারাপটা ধরতে পারে না মারিয়া। সে উল্টো রাগ করে বলে, ওহ, তোর জামাইবাড়ির আনা মিষ্টি খেয়েছি বলে কথা শোনাচ্ছিস? খাবো না, যা।
ফারিয়ার ইচ্ছে করে না মারিয়ার সঙ্গে কথা বলতে। ও ছাদে চলে এসেছে। মা বলেছে, প্রিতম ফোন করতে পারে। প্রিতমের বড় আপা এখান থেকে বেরিয়েই মায়ের কাছে ফোন করে ফারিয়ার ফোন নম্বর চেয়ে নিয়েছে।
প্রিতমের সঙ্গেই ফারিয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আজ প্রিতম আসেনি। সে নাকি ভার্সিটিতেই ফারিয়াকে দেখে এসেছে। প্রিতমের ছবি দেখেছে ফারিয়া। অধ্যাপক মা-বাবার আদরের ছেলে, চেহারায় লুতুপুতু ভাব আছে। ভালো কোম্পানিতে ভালো জব করে, পোশাক-আশাকে সেটা স্পষ্ট। চেহারা খুব ভালো নয়। তবে অর্থ থাকলে বাজে চেহারাও ভালো দেখায় চর্চায়। প্রিতমেরও চর্চিত চেহারা। তবে ছবি দেখে ফারিয়ার মনে প্রিতমের প্রতি কোনো ভালোলাগা জাগে না।
ফারিয়ার চোখে বর্ণের মুখটা ভাসে।
তিন.
ভার্সিটিতে ভর্তির এক সপ্তাহের মধ্যেই বর্ণের সঙ্গে পরিচয় ফারিয়ার। বইপাগল, এলোমেলো একশব্দের কালো ছেলেটাকে ভালো লাগে ফারিয়ার। বর্ণ একটু কথা বললেই কেন যেন ভালো লাগায় ভরে যায় ফারিয়ার মন। এটাই প্রেম কি না, জানে না ফারিয়া। তবে যদি হয়, তবে তা একতরফা। কারণ প্রথম প্রথম বর্ণ কোনো কোনোদিন এমন আচরণ করতো, যেন জীবনে সে ফারিয়াকে দেখেইনি। সেসব দিনগুলোতে খুব কষ্ট হতো ফারিয়ার। এখন অবশ্য ফারিয়ার খুব ভালো বন্ধু বর্ণ। হ্যাঁ বন্ধুই। ফারিয়া তো কোনোদিন বিয়ে করবে না। আর বর্ণেরও তেমনই সিদ্ধান্ত। সেও কোনোদিন বিয়ে করবে না। আজীবন শুধু পড়বে আর পড়বে আর তারপর একদিন বইয়ের মধ্যে মাথা রেখে মরে যাবে!
বর্ণ প্রশ্ন করে, জেনে নেয় হবু বরের প্রোফাইল। তারপর বিরক্ত স্বরে বলে, ধূরররর! তোরা মেয়েগুলো না! আমি ভেবেছিলাম আমার বইয়ের সাগরে তোকে নিয়ে ডুব দেবো! আর তুই বিয়ের পিঁড়িতে পা দিয়ে দিলি!
বর্ণের ভাবনাটা ভালো লাগে ফারিয়ার। তবে ও বইয়ে ডুবে মরতে চায় না। মা-বাবাকে অনেক সুখী করতে চায়।
ফারিয়া ভাবে, এখন বিয়ে করলে মা-বাবাকে সুখী করার জন্য ওর যে স্বপ্ন, তাও কোনো দিন আর পূরণ করতে পারবে না। ও যদি এখন বিয়ে না করে মা-বাবা কি অনেক কষ্ট পাবে? ওর জন্য কি মা-বাবার অনেক খরচ হচ্ছে? ও যদি দুটি টিউশনি করে তাহলে কি নিজের খরচ চালাতে পারবে না? তখন মা-বাবা রাজি হবে, ও বিয়ে না করুক! না কি প্রিতমের মতো এমন ভালো ছেলে মা-বাবা হাতছাড়া করতে চাইছে না? প্রিতম ফোন করলে ফারিয়া কি বিয়ে ভেঙে দিতে বলবে? তাহলে প্রিতম কারণ জানতে চাইবে, মা-বাবাও? ফারিয়ার চিন্তাকে কি কেউ বাস্তব বলে মেনে নেবে? মা-বাবা কি তাদের সুখের জন্য মেয়ের এখন বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত মেনে নেবে? অসংখ্য প্রশ্ন জাগে ফারিয়ার মনে।
চার.
হাতের মুঠোফোন বেজে ওঠে।
ওপাশে বর্ণ।
—কী ব্যাপার তোর? ভালো আছিস? তোকে যে বইটা দিয়েছিলাম পড়েছিস?
—না।
—কেন? ভার্সিটিও আসছিস না।
বর্ণকে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে সে কথা জানায় ফারিয়া। বর্ণ প্রশ্ন করে, জেনে নেয় হবু বরের প্রোফাইল। তারপর বিরক্ত স্বরে বলে, ধূরররর! তোরা মেয়েগুলো না! আমি ভেবেছিলাম আমার বইয়ের সাগরে তোকে নিয়ে ডুব দেবো! আর তুই বিয়ের পিঁড়িতে পা দিয়ে দিলি!
বর্ণের কথাগুলো ফারিয়ার হার্টবিট বাড়িয়ে দেয়! কী বললো বর্ণ! ফারিয়া কিছু বোঝার আগেই বর্ণ লাইন কেটে দেয়।