বিএ পরীক্ষা দিয়েই ঢাকায় এসেছিল বাকের। আসার অবশ্য কারণও ছিল। আইএ পড়ার সময় প্রেমে পড়েছিল। জেরিনের মায়াবি জাদুতে পাগল হয়ে গিয়েছিল বাকের। পরে প্রেমের বিষয়টি জানাজানি হলে পরিবারের চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হয় বাকের। বিয়ের পর কিছু দিন সুখেই ছিল তারা। বিএ ভর্তির সময় থেকেই বাকেরের জীবনে নেমে আসে অস্থিরতা। বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। টিউশনি করে যে টাকা আয় হতো তা দিয়ে পড়াশোনার খরচ, হাতখরচ, জেরিনকে সামলানো-হিমশিম খেত বাকের। এই অবস্থা থেকে নিজেকে বদলাতে শুরু করে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখে জেরিন। অবশেষে বাকের কে ডিভোর্স দেয়। অভাব, বেকারত্ব, পারিবারিক সমস্যা, জেরিনের চলে যাওয়ায় বিমূর্ত হয়ে যায়। চোখে-মুখে শুধুই অন্ধকার দেখে বাকের। শেষে শোক সইতে না পেরে চলে আসে ঢাকায়।
ঢাকায় নতুন জীবন। নতুন পরিবেশ। শান্ত, প্রকৃতি আর মেঠোপথ গ্রাম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে নানা কৌশল করে বাকের। বিএ পরীক্ষার ফল বের হলো। বিএ-তে দ্বিতীয় বিভাগ পেয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করে। খুঁজতে শুরু করে চাকরির।
কিছুদিনের মধ্যেই পেয়েও যায় একটি পোশাক কারখানায় স্যাম্পল আনা-নেওয়ার কাজ। এভাবে একমাস পেরিয়ে গেলো। প্রথম মাসের বেতনের টাকা দিয়ে একটা চৌকি কিনরো। মিরপুরের রূপনগরে মেসে এতদিন মেঝেতে ঘুমিয়েছে। বুয়ার হাতের রান্না এই জীবনে আর কোনো দিন খাইনি বাকের। একদিন তরকারিতে লবণ বেশি তো আরেকদিন প্রচণ্ড ঝাল। সকালে বাথরুমের সিরিয়াল। রাত এগারোটা বাজতেই লাইট অফ করতে হয়। এ রকম পরিমিত বদ্ধ জীবন বাকেরকে কুরে কুরে খাচ্ছিল।
শীতের সকাল। ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। রোজ রোজ অফিস আর ভাল্লাগে না। কিন্তু অফিসে না গেলে যে বেতন কাটা যাবে-এ চিন্তায় কিছুক্ষণ শুয়ে বিছানা থেকে উঠলো। শীত হলেও আজকের সকালটায় একটু রোদ উঠেছে। বাইরে মৃদু বাতাস। সঙ্গে মিষ্টি রোদ। সকালের নাস্তা খেয়ে বের হলো অফিসের উদ্দেশে।
বিকেল ছয়টা। সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়ার অবস্থা। অফিস ছুটি হলো। কলিগরা সবাই বের হচ্ছে। বাকেরও সিঁড়ি দিয়ে নামছে। সিঁড়িতে নিচতলার কাছে আসতেই চোখে চোখ পড়লো এক তরুণীর। সিঁড়ি থেকে নেমে বাইরে বের হয়ে তরুণীকে বলল, এক্সিউজ মি। আপনি কোন সেকশনে আছেন?
-আমি সাত তলায় সেলাইয়ের কাজ করি। আপনি?
-আমি স্যাম্পল আনা-নেওয়ার কাজ করি। আপনি কতদিন আছেন এখানে?
-তিন বছর।
-থাকেন কোথায়?
-মিরপুর মাজারের ওখানে। আচ্চা আসি, বাস চলে যাচ্ছে।
-ওকে…বাই।
রাতে বুয়া আসেনি। রান্নাও হয়নি। রুমের অন্য সদস্যরা বাইরে হোটেলে খেয়ে এসেছে। সারাদিন অফিস করে রাতে ক্ষুধায় ক্লান্ত বাকের। পকেটে বেশি টাকা নেই। হোটেলে খেতে গেলে কমপক্ষে পঞ্চাশ টাকা লাগবে। বেতন হবে বারো তারিখে। কী আর করা! চৌকির নিচে রাখা বয়ামটা বের করে চাল ভাজা খেতে শুরু করলো। খেতে খেতেই ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় চলে গেছে। পানিও আর খেতে ইচ্ছে হলো না। ঢুলে পড়লো ঘুমে।
ফুসকাওয়ালা বললো, ভাই পানি খান, ঠিক হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হলো বাকের। একটু একটু রাতও বাড়ছে। ওরা চলে গেলো দুজনের বাসায়।
শীতের উষ্ণ রোদের অলস দুপুর। অফিসে দুপুরের খাবার খেয়ে দশ মিনিট সময় হাতে আছে। অফিসের গেটের উলটো দিকটায় একটা চায়ের দোকান। কয়েকদিন ধরে বাকের এখানে দুপুরের খাবারের পর এক কাপ চা খেয়ে আবার অফিসে কাজ শুরু করে। আজ অফিসে কাজ করতে যেতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ গতকাল কথা হয়েছিল; ওই তরুণীর কথা মনে পড়ে গেলো। কিন্তু কথা বলবে কিভাবে। চেহারা ছাড়া কিছুই জানে না তার সম্পর্কে। অফিসে এসে দ্রুত কাজ শেষ করে ফেললো। আজ দেখা করতে হবে ওই তরুণীর সঙ্গে। মাথায় আজ তরুণী ভাবনায় বিভোর বাকের। অনেকদিন মনটাকে রঙিন পৃথিবীর আভায় রাঙাতে পারেনি। কষ্ট কষ্ট জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। হঠাৎ বসের ডাক পেলো। বস বললেন, বাইরে কাজ আছে, তাড়াতাড়ি বের হচ্ছি, তুমি কাজ শেষ করে যেও। বাকের বলে, ওকে স্যার।
অফিস শেষ করে গতকালের মতো সিঁড়ি দিয়ে নামছে। আজ ওই তরুণীই প্রথম দেখলো বাকেরকে। দেখেই জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছেন?
-ভালো, আপনি?
-এই তো কেটে যাচ্ছে।
-আপনার হাতে সময় আছে, এক্ষুণি বাসায় যাবেন? চলেন চা খাই।
-আধাঘণ্টা পরে গেলেও চলবে। চলেন।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে মিরপুর-৬-এর পাশ দিয়ে স্টেডিয়ামের সামনে আসল। পাশে কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ ফুসকা ও চায়ের দোকান। ওরা ফুসকা খাচ্ছে। বাকের জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, আপনার নামটাই জানা হলো না।
-আমি কিন্তু আপনার নাম জানি।
-কীভাবে জানেন?
-আরে বাবা নাম জানা কোনো ব্যাপার হলো? বাকের আপনার নাম।
কিছুটা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে বাকের বলে, আপনারটা? তরুণী জানালো, জেরিন। অমনি বাকেরের হাত থেকে ফুসকার প্লেটটা পড়ে গেলো। শরীরটা কাঁপছে। হালকা বিষম খেলো। এ সময় জেরিনও ভয় পেলো। নাম জানার পরই বাকের বেহুঁশ! মাত্র দুই দিনের সাক্ষাৎ। যদি কিছু হয়ে যায়? নানা ভাবনা কাজ করছে জেরিনের মনে। ফুসকাওয়ালা বললো, ভাই পানি খান, ঠিক হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক হলো বাকের। একটু একটু রাতও বাড়ছে। ওরা চলে গেলো দুজনের বাসায়।
বাসায় এসেই শুয়ে পড়লো। শরীর-মন কোনোটাই স্বাভাবিক নেই। একটু শান্তি খুঁজে পেতে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসা। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাতের মতো আবারও ঝড়। কে এই জেরিন? জেরিন তো চলে গেছে! না ওহ কিছুতেই হতে পারে না। মাথায় যেন সুনানি শুরু হয়ে গেছে বাকেরের। চোখ দুটো বন্ধ করে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে। শীতের রাত। বাইরে তখন কুয়াশায় নিথর সময়।
রাত একটা পঁচিশ। চারদিকে সুনসান নীরবতা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো জেরিনের। মাথায় চক্কর দিচ্ছে বাকেরের ওই ঘটনার ভাবনা। কী হলো ওর, ও এখন কেমন আছে, বাসায় ঠিকমতো গিয়েছে তো! নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ থেকে ছয় বছর আগের ঘটনা। এরকম এক ঘটনায় স্ট্রোক করে মারা গিয়েছিল পরান। পরানের মৃত্যুর পর জেরিন ছয় মাস প্রায় পাগল ছিল। পাগল হওয়ারই কথা। জেরিনের বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ বেঁচে নেই। পরানকে ভালোবেসে বিয়ে করে পৃথিবীতে সুন্দরভাবে থাকতে চেয়েছিল। হঠাৎ পরানের মৃত্যু জেরিনকে আবারও বিধবা এতিম বানিয়ে দিয়েছে। বর্তমান সময়ে সমাজের যে অবস্থা, তাতে একা একা বাস করা বড় কঠিন। নির্মম সত্য। জেরিন বাকেরকে ফোন দিলো। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করতেই জেরিন বললো, কী খবর বাকের, কেমন আছ, শরীরের কী অবস্থা? জানো, রাতে আমার ঘুম আসছে না। হঠাৎ কী হলো তোমার? বাকের কিছুটা বিমর্ষ।
হালকা মৃদু কণ্ঠে জবাব দিলো, একটু ভালো। তো আপনি আমার সেল নম্বর কিভাবে পেলেন? আরে ওসব পরে কথা হবে। আগে তুমি সুস্থ হও। শরীর ভালো হলে কাল অফিসে এসো। দেখা কইরো। ফোনটা কেটে গেলো। মনে হয় ব্যালেন্স শেষ।
শীত হলেও আজ সকালটা একটু অন্যরকম লাগছে। বাইরে রোদ। খুব একটা শীত লাগছে না। বুয়া সকালে এসে খিচুড়ি রান্না করেছে। খিচুড়িটা খেয়ে বের হলো অফিসের উদ্দেশে। অফিসে গিয়ে সব কাজ একঘণ্টা আগেই শেষ করে নিচে চায়ের দোকানে গেলো বাকের। এ সময় ফোন। রিসিভ করতেই জেরিন বললো, তুমি কোথায়?
-চায়ের দোকানে।
-ওকে আমি আসছি। তুমি থাকো।
দুজনের আবার দেখা। দোকানের পাশ দিয়ে খালি রিকশা যাচ্ছিল। জেরিন ডাক দিলো। রিকশায় চললো মিরপুর এক নম্বরে। ওখানে প্রিন্স বাজারের পাশে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো।
এরপর জেরিন কথা শুরু করে। বলে, কেন কাল এমন হলো? তোমার কোনো দুঃখ আছে?
বাকের অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। গ্রামের সহজ সরল অভ্যাসটা বদলাতে পারেনি সে। মায়াবি স্বভাবটা আজও চাঙা হলো। জেরিনের কাজে তাকে খুব আপন মনে হচ্ছে। কতদিন চলে গেছে, কেউ তো এমন করে কোনো কিছু জানতে চায়নি। জেরিনের কাছে কেনজানি নির্ভরতা খুঁজে পাচ্ছে।
বাকের একে একে অতীতের সব তুলে ধরে। বাকেরের হাতটা ধরলো জেরিন। বললো, তুমি আমার জীবনের সবকিছু জেনেছ, আমিও তোমার। তাই তোমাকে সরাসরি বলছি, এ জীবনে বাঁচতে হলে সঙ্গী প্রয়োজন। আর তা তোমাকেই করতে চাই। বাকের কিছু বলে না। কী করবে ভেবে পায় না। বুয়ার হাতের রান্নার কথা মনে পড়ে গেলো। কখনো তরকারিতে লবণ বেশি, কখনো ঝাল। আহা! কী যে যন্ত্রণা!
সাতদিন পর। মাঝখানের দিনগুলো ওরা ফোনে শেয়ার করে। শুক্রবার। কারোই অফিস নেই। বাকেরকে নিয়ে জেরিন ঘুরতে গেলো আশুলিয়ায়। ঠিক সন্ধ্যার সময় ওরা আব্দুল্লাহপুর যখন, তখন রাস্তার পাশেই একটা কাজি অফিস দেখতে পেলো। বাকের নিয়ে জেরিন ঢুকে গেলো সেখানে। কাজি সাহেবকে বিয়ের আয়োজন করতে বলে জেরিন।
এ সময় কমলাপুর থেকে চট্টলা এক্সপ্রেস এসে থামে। ট্রেনের খাবারের রুমে উঠে দাঁড়ালো বাকের। একমিনিট পরেই ট্রেনটি বিমানবন্দর ছেড়ে চললো চট্টলার উদ্দেশে
জেরিন থাকতো মিরপুর। টিনশেট এক বাসায় একরুমে একাই থাকে। পাশে কেউ থাকে না। ওরা আব্দুল্লাহপুর থেকে সরাসরি জেরিনের বাসায়। বাইরে থেকে বিরিয়ানি খেয়ে এসেছে। জেরিন মিষ্টি নিয়ে এসেছে। জেরিনের ছোট্ট একটা খাট। পরিপাটি বিছানা। কতদিন এই বিছানায় একা কাটিয়েছে। বাকেরকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় গেলো। চুমোয় চুমোয় বাকেরকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিচ্ছে। এভাবে কেটে গেলো বাকেরের দ্বিতীয় বিয়ের প্রথম রাত।
সপ্তাহখানেক পর জেরিনের একটা কথায় বাকেরের মাথাটা আবারও চক্কর দিলো। কেনই বা জেরিন বললো, ধূর তুমি একটা ছাগল, তোমার সাথে বিয়েটাই ভুল। বাকের সহজ সরল হলেও কথাটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। এদিকে অফিসে বসের একটা কাজ ভুল করে। বসও তুমুল বকাবকি করে। চাকরি চলে যাওয়ার অবস্থা। মাস শেষে জানতে পারলো, চাকরিটা আর নেই। কী হবে এখন, কেমনে সংসার চলবে? কেনই বা আবারও বিয়ে করলো, নানা চিন্তায় বাকের বাসা থেকে বের হয় না। প্রতিদিন বাসায় বসে থাকতে থাকতে শরীরটাও খারাপ হয়ে গেছে। জেরিনেরও আর সহ্য হচ্ছে না এভাবে বাকেরকে পালতে। অল্প বেতন। বাসা ভাড়া, সঙ্গে বাকেরের খরচ। বিরক্ত জেরিন। একদিন এ নিয়ে দুজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া। অবশেষে জেরিন রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। বাকের অনেক ফোন করেও তাকে ফেরাতে পারলো না।
যাকে বিশ্বাস করে ঘরে এনেছিল, সে কেন এভাবে কষ্ট দেবে? আর কোনো কষ্ট পেতে চায় না জেরিন। তাই সিদ্ধান্ত নিলো ডিভোর্স। একা থাকবে জেরিন। একা। সারাজীবন একা।
পাগলের মতো বাকের সবকিছু হারিয়ে এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনে চলে আসে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। কে তাকে খাওয়াবে। না কিছুই বুঝতে পারছে না। এ সময় কমলাপুর থেকে চট্টলা এক্সপ্রেস এসে থামে। ট্রেনের খাবারের রুমে উঠে দাঁড়ালো বাকের। একমিনিট পরেই ট্রেনটি বিমানবন্দর ছেড়ে চললো চট্টলার উদ্দেশে। বাকেরও যাচ্ছে। কিন্তু কোথা যাচ্ছে, জানে না। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।