মোবাইলফোনটা দক্ষিণপাড়ার মুন্সীবাড়ির মুন্সীর নাতি সজলের কাছ থেকে নগদ পাঁচশত টাকা দিয়ে কিনেছে মিরাজ। সন্ধ্যার মুখে মিরাজ যখন পাড়ার দোকানে টুয়েনটি নাইন খেলছিল, তখন কোথা থেকে সজল হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো, মিরাজ আমার মোবাইলটা বেচে দেব। খুব টেকার দরকার। তুই যদি পাঁচশ টাকা দিতি পারিস।
মিরাজের পকেটে যে সবসময় পাঁচশত টাকা থাকে, তেমন নয়। তবে সেদিন ছিল। সেদিন বিকালেই ওর ভাবি ওকে টাকাটা দিয়েছিল বাসায় মেহমানদের জন্য ভালোমন্দ বাজার করার জন্য। বাজারের কথা ভুলে গেলেও টাকাটার কথা সে ভোলেনি। সেই টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিল মোবাইলটা। মোবাইলের সঙ্গে একটা হেডফোনও ফ্রি পেয়েছিল সে। সেই হেডফোনটা দুই কানে গুঁজে গান শুনতে শুনতে সে যখন মসজিদের সামনে দিয়ে হাঁটছিল, তখন ফিরোজার বাপও ওই পথেই যাচ্ছিল। কোনোদিকে খেয়াল না করলে যা হয়, তাই হলো। দুনিয়া রাষ্ট্র হয়ে গেল তার কুকীর্তির কথা—মিরাজ মুরুব্বিদের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়। সালাম দেয় না। আল্লাহ-খোদার ভয় নেই মিরাজের, দুনিয়া আখেরাতের ডর নেই তার বুকে। থাকলে কি আর এমন ব্যবহার করে! বাসায় যেতেই মিরাজের মা বলে—তোর জন্যি কি পাড়ায় থাকা যাবি না!
অথচ মিরাজের কানেই ঢুকলো না কথাগুলো। কারণ তার কানে তখন ফিরোজার কথাগুলোই বাজছিল।
ফিরোজা তাকে আজ জিগ্যেস করেছে তার শরীর ভালো কি না। কতদিন পর ফিরোজা তার সঙ্গে কথা বললো। ভাত খেতে গিয়ে যখন বিষম খেলো, তখন মায়ের এগিয়ে দেওয়া পানির গ্লাসটায় চুমুক দিতে দিতে মায়ের কথাগুলো কানে গেলো তার।
তোর জন্যি মাইয়া ঠিক করিছি। সমনের মাসে তোর বিয়া।
ফিরোজার পোলাটার জন্য মনডা কেমন করে মা, ফিরোজার লগে বিয়া দেওন যায় না?
মিরাজের মা কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলে—
তোর কাছে ফিরোজারে ওর বাপ দেবে না। এককথা তোরে কতবার কওয়া লাগবি? তোর কি কোনো লজ্জা শরম নাই?
শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো মিরাজের। সে কি এত মন্দ ছেলে—তার কাছে বিয়াইত্তা ফিরোজারে দেওয়া যায় না! ফিরোজার পোলাটা সেদিন তাকে দেখেই মামা বলে ডাকা শুরু করেছে। ওরই বা কী দোষ! মাসুম বাচ্চা। ফিরোজার স্বামী যখন নিরুদ্দেশ হলো, পোলাটা তখন ফিরোজার পেটে। স্বামীর জন্য দিন মাস বছর গুনে গুনে ফিরোজার কী দিন গেছে! এখন সব সয়ে নিয়েছে সে। তার বাপ এখন তার বিয়ে দিতে চায়, ফিরোজাও নাকি রাজি। এসব জেনে আজ বিকালে রঙচটা জিন্সের প্যান্ট আর হলুদ গেঞ্জিটা পরে মিরাজ গিয়েছিল ফিরোজাদের বাসায়, ফিরোজাকে তার মনের কথাগুলো বলতে। ফিরোজা তখন উঠানের লতানো শিমগাছ থেকে শিম তুলে প্লাস্টিকের লাল বালতিতে রাখছিল। মিরাজকে দেখে এগিয়ে আসে, জানতে চায় মিরাজের দিনকালের খবর। মিরাজ জানায় সে ভালো আছে, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলো তাই ফিরোজার পোলাটার খবর নিতে এসেছে। মিরাজের কথা আর আগায়নি। ফিরে গেছে শ্মশানঘাটের মাঠটায়। এই মাঠে একা একা বসে মোবাইলফোনটা হাতে নেয়। ফোনটায় অনেক ছবি আছে, সিনেমার অনেক নায়িকার রঙিন ছবিও। মিরাজ একটার পর একটা ছবি দেখে। এদের চেয়ে ফিরোজাকেই বেশি মোহনীয় লাগে তার। ফিরোজা যেভাবে লতানো শিমগাছ থেকে শিম তুলে আঁচলে ভরে, জংলিছাপা শাড়ি পরা শরীর বাঁকা করে কী ভঙ্গিমায় আঁচল থেকে শিমগুলো নিচে নামিয়ে রাখে, তার কি কোনো তুলনা হয়!
আজ তাস খেলায় না গিয়ে মসজিদে গিয়ে মাগরিবের নামাজ পড়ে সে। মোনাজাতে বসে সে আল্লাকে কিছুই বলতে পারলো না। নিজেকে স্বার্থপর মনে হচ্ছিল তার। কখনো তো আল্লাহর ঘরে আসে না সে, আল্লাহকে ডাকে না। আজ যখন আশ্রয়ের প্রয়োজন হলো তখন ঠিকই আসলো এখানে। অসহায় মিরাজ অঝোরে কাঁদলো আজ। সে নিজেও জানতো না তার চোখে এত জল এমন জমাট বেঁধে ছিল।
সকালে আজানের সুরে ঘুম ভাঙতেই মিরাজ ধড়ফড়িয়ে উঠে বাড়ির দিকে যখন হাঁটছে, তখন তার চোখ গেলো রাস্তায় একটা লুঙ্গি পরে শুয়ে থাকা লোকের দিকে। লোকটার গায়ে আর কোনো কাপড় নেই।
কাছে গিয়ে দেখলো লোকটার একটা হাত নেই। অন্য হাতটি সরু, ফিনফিনে। দুই পা ভাঁজ করে শুয়ে পড়ে আছে। দুটি চোখই বন্ধ। মিরাজ হেঁটে চলে যাচ্ছিল, তক্ষুনি হিরণ ঋষি লোকটাকে দেখে থেমে বললো, কী রে মিরাজ, লোকটা কিডা। মরা নাকি?
বুজতে তো পারছি না। কে এ, দেহেন তো কাকা চিনতে পারেন নাকি?
হিরণ ঋষি এগিয়ে যায় লোকটার দিকে। নিজের ডান হাতের আঙুল এগিয়ে দেয় লোকটার নাকের কাছে। হ্যাঁ, নিঃশ্বাস নিচ্ছে। দাঁত বের করে হেসে বলে হিরণ।
এমন সময় পুবপাড়ার জব্বাইরা তার বাঁ হাতে লুঙ্গি ধরে হেলে দুলে হেঁটে আসছিল স্কুলঘরটা পার হয়ে। ওদের দেখে জানতে চায় শুয়ে থাকা এই অথর্ব লোকটা কে। হিরণ ঋষিই জবাব দেয়—সে একে চেনে না, জব্বারই দেখে বলুক চিনতে পারে কি না।
জব্বার একটু এগিয়ে দেখে চিনতে না পেরে ঠোঁট দুটোতে আফসোস ফুটিয়ে তোলে, তাড়া আছে বলে হন হন করে হেঁটে চলে গেলো কাঁচাবাজারের পথে।
কিছুক্ষণের মধ্যে জটলাটা বড়ো হয়ে গেলো। লোকজনের কথায় শুয়ে থাকা লোকটার ঘুম ভেঙে গেলে সে চোখ তুলে তাকায়। শেষমেষ ফিরোজার বাপই তাকে চিনতে পারে। এ তো ফিরোজার নিখোঁজ জামাই মিন্টু মিয়া। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে এর! এমন দেখে তো সে তার মাইয়ারে মিন্টুমিয়ার কাছে দেয় নাই। হাতটারই বা কী হয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর জটলার মানুষের জানা নাই, আধমরা মিন্টু মিয়াও এসবের উত্তর দেওয়ায় এখন সমর্থ নয়। রাগ ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলে ফিরোজাও মিন্টুমিয়াকে ঘরে জায়গা দেয়। সেবাশুশ্রূষা করে। অসুস্থ মিন্টুমিয়া একটু একটু করে তার দেশান্তরি হওয়ার করুণ কাহিনী শোনায়। ফিরোজাকে রেখে পালিয়ে সে গিয়েছিল ঢাকায় রিকশা চালাতে। সেখানে সে দেখা পায় এক চাঁদাবাজ লোকের, যে তাকে তার নির্দেশে কাজ করতে বলেছিল। মিন্টুমিয়া রাজি না হওয়ায় একদিন সকালে লোকটা তাকে কী যে এক ওষুধ খাওয়ায়, সে বলতে পারবে না। যখন হুঁশ আসলো তখন দেখলো তার ডান হাতটা নাই। কাটা ক্ষতটায় ব্যথা-বেদনার ঘরবসতি। আর অন্য হাতটার পুরোটা জুড়ে লোহার পাত দিয়ে আটকানো, ব্যথায় টনটন করছে। একমাস আটকা পড়ে ছিল স্যাঁতস্যাঁতে খুপরি ঘরটায়। তখন তার বুকের ভেতর স্বয়ং মৃত্যু এসে বাসা বেঁধেছিল। সেই খুপরি থেকে যখন বের হলো, তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করল রাস্তায় দাঁড়ানো পথচারীর কাছে হাত পাতা অবস্থায়। তার ফিনফিনে হাতের সঙ্গে বেমানান হৃষ্টপুষ্ট আঙুলে পথচারীরা পরম করুণায় খুচরা টাকা গুঁজে দেয়। এভাবে হাত পেতে আনা টাকা দিনশেষে ওর হাতেই থাকতো এমন নয়। একেকদিন একেকজন তার হাত থেকে সেগুলো কেড়ে নিতো। হ্যাঁ তিন বেলা খাবার তার জুটতো ঠিকই। বলতে বলতে হাঁপিয়ে ওঠে মিন্টুমিয়া। ফিরোজা পানিভরা স্টিলের গ্লাসটা এগিয়ে দেয় তার দিকে। পানি খেয়ে সে আজকের মতো শুয়ে পড়ে। সারাদিনের ক্লান্তিতে ফিরোজার চোখেও ঘুম নামে।
পরদিন ফজরের আজান শুনেই সকালে ঘুম ভাঙে ফিরোজার। ক্লিশে হাতটা গুটিয়ে ঘুমিয়ে থাকা মিন্টুমিয়াকে না জাগিয়ে আলগোছে নেমে যায় চৌকি থেকে। কলতলায় হাতমুখ ধোয়। এ কোন মিন্টুমিয়া ফিরে এলো তার কাছে। এ তো অন্য মানুষ! নিজের কান্নার দমক নিজেই সামলে নেয় ফিরোজা। তবু তো তার পোলার বাপ এতদিন পরে ফিরে এসেছে। কতকিছু ভেবেছে সে এতদিন! কত গালাগালি করেছে সে মিন্টুমিয়ার নাম ধরে। নিরুদ্দেশ স্বামীর অভাব তার যতটুকু ছিল মিন্টুমিয়ার প্রতি তার অভিসম্পাতও ছিল ততই কর্কশ।
এরইমধ্যে মিন্টুমিয়ার ফিরে আসার খবর পাঁচকান হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে। দুপুর গড়ালেও ফিরোজাদের বাড়িতে মানুষের ভিড় কমছে না। মিরাজও আছে সেখানে। মিন্টুমিয়াকে খুঁজে পাওয়ার ঘটনাটা সে যে কতজনকে কতবার বর্ণনা করেছে তার হিসাব নেই। কী বা করার আছে তার! সবাই এসে মিরাজের খোঁজে। আর তার কাছেই সবাই ঘটনাটা শুনতে চায়। সেই তো মিন্টুমিয়াকে কোলে করে ফিরোজার বাসায় নিয়ে এসেছে। ফিরোজার বাপও ওকে আজ খাতির করেছে। বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে ওর পা দুটো ভেঙে আসে। মরিচটালের ভেতর দিয়ে হাঁটাপথে যেতে যেতে পরিচিত মানুষের চোখে চোখ পড়লে চোখ সরিয়ে নেয়।
চেনাজানা এই পথ ও পথের চেনা মানুষের চোখের আড়ালে যাওয়ার পথ খোঁজে মনে মনে। নিজের বাড়িতেও মন টানে না আজ। হাঁটতে হাঁটতে বুড়া বরইগাছটা পার হয়ে পুরোনো মন্দিরের সামনে চলে এসেছে কখন মিরাজ নিজেও জানে না। পায়ের নিচের ঘাসগুলো ভেজা ভেজা, পায়ের জুতা জোড়া সে কোথায় ফেলে এসেছে মনে করতেও চায়নি সে।
সন্ধ্যা নামলে সে যখন বাড়ি ফিরলো, তখন বাড়ির পাশের দেবদারু গাছে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। তখন ওর মা-ই ওকে জানালো খবরটা। মিন্টুমিয়া সকালে যে ঘুমিয়েছিল আর নাকি জাগেনি। শুনেই দৌড়ে বের হয় মিরাজ।