প্রতিরাতে টেমি নেভানোর পরপরই ক্যানক্যান করে বায়না ধরে ঝড়ি বিবি।দুপুরচন্দ্র ফুল তার লাগবেই লাগবে।পাড়ার মহিলারা তাকে দেখলেই আঁচলে মুখ ঢেকে বলে,হায় হায়! সকাল সকাল হাটকুড়ো মাগীর মুক দ্যাকলাম!কপালে আজ মুড়ো ঝেটার বাড়ি খাতি হবানে। এসব কথা শুনলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ঝড়ি বিবির।বুকটাতে কেউ যেন ঢেঁকি দিয়ে জোরে জোরে পিষে মারতে চায়। চাঁদ-তারা-সূর্যকে সাক্ষী করে দিন রাত কাঁদে সে। কাঁদতে কাঁদতে একদিন এক অন্ধ ফকিরের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ঝড়ি বিবির।
দুনিয়াতে যার দুই চক্ষু নাই,তার মতো দুঃখিত নাই।কণ্ঠের সমস্ত আবেগ মিশিয়ে উঠোনের একমাথায় দাঁড়িয়ে অন্ধ ফকিরটা একটানা জিকির তোলে। হাতের লাঠির একধার ধরে এক মহিলা সাগরেদ তার সঙ্গে থেকে সুর মেলায়। টাকার বিনিময়ে সারাদিন ভাড়া খাটে মহিলাটি।অন্ধ ফকিরের কথা আল্লাহ শোনে—এই বিশ্বাসে ঝড়ি বিবি বলে ফেলে তার ভেতরের সইতে না পারা কথাগুলো। গ্রামে সে হাটকুড়ো মাগী বলে পরিচিত। সকাল বেলা তার বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে চায় না গ্রামের কেউ-ই। তার মুখ দেখলেই নাকি দিনটা খারাপ যাবে সবার। এমনটি ভেবে ওই পথ মাড়ায় না লোকজন। সব কথা শুনে অন্ধ ফকির তাকে পরামর্শ দেয়, যদি দুপুরচন্দ্র ফুল বিট লবণ দিয়ে বেটে খেতে পারে তাহলে গর্ভবতী হবে সে। একথা শোনার পর থেকেই স্বামী ইছহাক ঢালীকে দুপুরচন্দ্র ফুল আনতে বলে ঝড়ি বিবি। প্রথম প্রথম ঝড়ি বিবির কথায় কোনো কান দেয় না ইছহাক। ভাবে, ঝড়ি বিবি বোধ হয় তার সঙ্গে ইয়ারকি মারে। কিন্তু তার এই ভুল ভাঙে শিগগিরই। মাঝরাতে ঝড়ি বিবি আবারও ফুঁপিয়ে কান্নাকাটি করে আর বলে, দুপুরচন্দ্র ফুল কবে এনে দিবা?
এমন আবদারে নীরব থাকে ইছহাক। ঘ্যানরঘ্যানর বেড়ে যায় ঝড়ি বিবির। প্রতিদিন ইছহাক জানায়, কাল দিবানি। এমন করতে করতে মাঠ থেকে খালি হাতে ফেরে পর পর সাত দিন। মাথায় রক্ত চড়ে যায় ঝড়ির। গজগজ করতে থাকে সারাদিন। আট দিনের দিন স্বামী তার কথা দিয়েছে আজ সে দুপুরচন্দ্র ফুল আনবেই আনবে। এই শপথে মাঠে গেলেও দুপুর বেলা ফিরতে দেরি হয় স্বামী ইছহাক ঢালীর। কেন দেরি হচ্ছে বুঝতে পারে না ঝড়ি। মনে মনে চিন্তা করে সে, এতক্ষণ তো দুপুরচন্দ্র ফুল ফোটার কথা! এক পা দুই পা করে খলসেমারী বিলের দিকে হাঁটতে থাকে ঝড়ি। দুপুরের রোদে খলসেমারীর বুকে আগুন ধরে টগবগ ফুটছে বিলের পানি। নিঃসঙ্গ হয়ে মাঠের মধ্যে গম্ভীর হয়ে ঝিমুচ্ছে বরকতের শ্যালো মেশিন। শাড়িটা কোমরে পেঁচিয়ে তলপেটে শক্ত করে গুঁজে নেয় সে। আইলের ওপর হনহনিয়ে পা ফেলে সামনে এগোতে থাকে।
২.
বড় ব্যারেল দিয়ে ঢাকা শ্যালো মেশিন। তারই কোলঘেঁষে মুখ থুবড়ে পড়ে সিটকে কাঠ হয়ে আছে ইছহাক ঢালী। নাকের ভেতর অনেকগুলো সাপপিঁপড়া সারিসারি ঢোকে আবার বের হয়। পড়িমরি করে হুমড়ি খেয়ে গায়ের ওপর পড়ল ঝড়ি বিবি। তার আত্মচিৎকারে মাঠের মধ্যে দুই-একজন কৃষক কাজ ফেলে দিয়ে সেদিকে ছুটে এলো। কাছেই বাগদী পাড়া। সেখান থেকে ছুটে এলো আদাড়ে আর রেণু। গ্রামে কোনো খবর ছড়াতে বেশি সময় লাগে না। একে একে পুরো সোনামুখী গ্রাম জেনে যায়। সবাই খলসেমারীর দিকে দৌড়াতে থাকে। লোকে লোকারণ্য খলসেমারীর মাঠ। সবাই কানাঘুষা করতে লাগে ইছহাক ঢালীর মৃত্যু নিয়ে। অনেক গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করে অবশেষে সবাই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, তাকে গোদানে ঠেসে মেরেছে। হায় হায় করে একে একে বাড়ির দিকে চলে যায় সব্বাই। কেউ কেউ বলে—আহারে! এখন পর্যন্ত কোনো সন্তানের মুখ না দেখেই বেচারি মরে গেল!
৩.
তুমুল বৃষ্টিপাতের মধ্যে সোনামুখীর মানুষেরা ভিজে জবজবে হয়েও দলে দলে দেখতে আসে ইছহাক ঢালীকে। কবর দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয় কেউ কেউ। লুঙ্গি কাচা মেরে পশ্চিম পাড়া থেকে বাঁশ কেটে আনে বিল্লাল ঢালী। কবর খোঁড়ার জন্য কাচামেরে নেমে পড়ে বজলু। ফ্যালফ্যাল করে দূরে তাকিয়ে রয়েছে ঝড়ি বিবি। অনেকক্ষণ কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত সে এখন। শুধু মাঝে মাঝে পরিচিত কাউকে পেলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠছে। ইছহাক ঢালীর যেখানে যা আত্মীয় আছে একে একে প্রায় সবাইকে খবর দেওয়া হলো। যারা পারলো তারা ওইদিনই চলে এলো। গ্রামের মোড়ল-মাতব্বররা সিদ্ধান্ত নিলো গোদানে ঠেসে মরা লাশ বেশিক্ষণ বাইরে রাখলে জিনের আক্রোশ বেড়ে যাবে পুরো গ্রামের ওপর। এই ভয়ে তাড়াতাড়ি লাশকে কবরে নামাতে ব্যস্ত সোনামুখীর মানুষেরা। কোদাল নিয়ে নেমে পড়লো বজলুর সঙ্গে আতিয়ার ও কেলে রাজ্জাক। মুহূর্তের মধ্যে কবর খোঁড়া শেষ।যথাযথভাবে কবরে শোয়ানোর পর ওপরে কাচা বাঁশের মাচা ও তার ওপর মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল ইছহাক ঢালীকে। শেষ বারের মতো কবরের কাছে গিয়ে আছড়ে পড়ে ঝড়ি বিবি। পূবপাড়ার নবিছন ও সায়রা টেনে ধরে উঠিয়ে ঘরের দিকে নিয়ে যায় তাকে। বৃষ্টি থামলে ধীরে ধীরে যে যার বাড়ির দিকে কানাঘুষা করতে করতে রওনা দেয়। গোদানে ঠেসাকে কেউ কেউ বিশ্বাসে নিতে পারে না। তবু হাজার বছরের কুসংস্কারের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণে মুখ থুবড়ে-কুলুপ এঁটে থাকে সোনামুখীর সোনামুখগুলো।
৪.
বৃষ্টি শেষ। তবে থেকে থেকে বিজলী চমকাচ্ছে তখনো। দুই পা ভাঁজ করে একদৃষ্টিতে দূরে তাকিয়ে আছে ঝড়ি বিবি। চুলগুলো এলোমেলো। দুপুর থেকে পেটে কোনো দানাপানি পড়েনি। সন্ধ্যাবাতি জ্বালানো হয়নি এখনো। অন্ধকারে গা ছমছম করে ঝড়ি বিবির। ঘরের দরজা খুলতে ভয় করে তার। দরজায় কান পাতলে ঘরের ভেতর থেকে হু হু শব্দ শোনা যায়। যে ঘরটা আগলে রাখতো, এখন সে তো আর নেই। ভাবে ঝড়ি, এখন এখানে আর কেউ আসবে না। মৃত্যুকে টিকিয়ে রাখা মানুষের অসাধ্য। নবিছন একটা টেমি ধরিয়ে এনে ছেচের কাছে এসে ডাক দেয় ঝড়ি বিবিকে। কোনো সাড়া নেই। গায়ে ধাক্কা দেওয়াতে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে। নবিছনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। বু এ আমার কী হলো? এত লোক থাকতি আল্লা আমার কপাল ভাঙলো! জীবনে কোনো নামাজ কাজা করিনি।ক্ষতিও করিনি কারও কখনো।
কাঁদিস না বু। যা হওয়ার তাই তো হবে। আল্লা তোর কপালে লিকে রেকেচে। তোর আর কী করার আচে বল? খুঁটিতে মাথা জোরে জোরে আঘাত করতে থাকে ঝড়ি বিবি। অনেক কষ্টে নবিছন থামায় তাকে।টেমিটা তার সামনে দিয়ে আঁচলে নিচু থেকে এক গামলা ভাত সামনে দেয় নবিছন। নে বু খেয়ে নে। কেন্দে আর কী হবে? উনি যা ভালো মনে করেছেন তাই-ই করেছেন। জীবন যেমন আসে মিত্যুও তো তেমন আসবে। এটা তো আর ঠেকানো যাবে না।
গামলার ওপর থেকে প্লেট সরিয়ে ভাত খেতে সাধে নবিছন। ভাতের ওপর কলমিশাক ও ছোট মাছ চচ্চড়ি কেমন জানি মিইয়ে আছে। সেদিকেই পলকহীনভাবে তাকিয়ে ঝড়ি। অনেক কষ্টে দুই-এক নলা ভাত মুখে তোলে। চোখের জল নাক বেয়ে ভাতের ওপর পড়ে। ভাত আর গিলতে পারে না সে। গলা ঠেলে বমি চলে আসে। নবিছন আবার সাধে, জোরাজুরি করে, কিন্তু কোনো কাজ হয় না। হাল ছেড়ে নবিছন চলে যেতে উদ্যত হয়। ঝড়ি বিবি তাকে যেতে দিতে চায় না। বলে, বু আমি একলা থাকতি পারব না।
ঠিক আছে, আমি ভ্যাজোকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
এমনটি বলে তাকে আশ্বস্ত করে নবিছন বিদায় নেয়। কিছুক্ষণ পর ল্যামপো হাতে ভ্যাজো এসে হাজির। ঝড়ি তখনো বসে আছে পা ছড়িয়ে। ভ্যাজোকে দেখে আবারও ঢুকরে কেঁদে ওঠে। গায়ে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয় ভ্যাজো। ঘরে ঢুকে বিছানা ঠিকঠাক করে ঝড়িকে ডাকে।
বু, আয়। অনেক রাত হয়ে গেচে শুতি হবি না?
নারে বু, এ মরার চোকে ঘুম আসপে না। আমি যে এখন ভাতারখেকো মাগী হয়ে গিলাম।
ভ্যাজো এসে জড়িয়ে ধরে ঝড়িকে।দুজন মিলে কান্দে। তাদের কান্না থামলে চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে যায়।নিস্তব্ধ ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে সোনামুখীর মানুষেরা যেন আহারে আহারে করে করে যে যার ঘরের দিকে রওনা দেয়।
৫.
ইছহাক ঢালী মারা যাওয়ার এগারো দিন পর অন্ধ ফকিরকে আবার দেখা যায় সোনামুখী গ্রামে। ফকিরের সঙ্গে আজ কোনো মহিলা সাগরেদ নেই। অন্ধ ফকিরের আপদমস্তক কাপড়ে ঢাকা। তার সেই চেনা সুর আর নেই কণ্ঠে। ঝড়ি বিবির শুকনো শরীর আরও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। দিনের অধিকাংশ সময় কাটে তার খুঁটিতে মাথা রেখে। সারাক্ষণ একদৃষ্টিতে খলসেমারীর দিকে মুখ করে চেয়ে থাকে সে। অন্ধ ফকিরের আওয়াজ পেয়ে বুক ধড়ফড় করে ওঠে ঝড়ি বিবির। তবুও জমাটবাঁধা পাথরের মতো থির হয়ে বসে থাকে ঝড়ি। অন্ধ ফকির তার অনেক কাছে এসে বসে। হাতে তার শক্ত একটা বাবলা গাছের ডাল। ঝড়ি বিবির কোলঘেষে কাঁধ ঝুঁকিয়ে নরম সুরে বলে, কিরাম আছো?
অন্ধ ফকিরের নিঃশ্বাস ঝড়ি বিবির শরীরে লাগতেই শিরশির করে ওঠে। কেমন জানি এলোমেলো লাগে। ছড়ানো পা দুটো এক জায়গায় গুটিয়ে নিয়ে আঁচলের খুঁটটা টেনে একটু দূরে সরে বসে সে। চুপ থাকে কিছুক্ষণ। ফকির আবার বলে ওঠে, কী হলো, কতা কচ্চো না যে?
হাতের ডালটা পাশে রেখে আরেকটু কাছে যায় ফকির। তার ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়া দেখে ঝড়ি বিবি আত্মসংবরণ করে গুছিয়ে নেয় নিজেকে। গ্রামের এককোণে বাড়ি তার। দুই-একটা ঘর। প্রতিবেশী তেমন নেই। দুপুরের রোদে খা খা করছে পুরো উঠোন। তিন-চারটা ভাতশালিক রান্নাঘরের পাশে জটলা করে ফেলে দেওয়া পান্তা ভাত কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে। ঝড়ি বিবি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সেদিকেই। বারান্দার খুঁটি ধরে উঠতে গিয়ে ফকির বাধা দেয়:আরে বসো, কনে যাচ্চো?
একটু ভয় পায় ঝড়ি। ততক্ষণে আঁচলের এককোণ ধরে টান মেরে তাকিয়ে পান খাওয়া দাঁতগুলো বের করে বিচিত্রভাবে হাসে অন্ধ ফকির। অসহ্য লাগে সেই হাসি। শালিকগুলো উড়ে পালায় একটা নেড়িকুত্তাকে দেখে। ছেই ছেই করে কুকুরটাকে তাড়াতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে ঝড়ি বিবি। ওদিকে আঁচলটা আবারও ধরতে উদ্যত হয় অন্ধ ফকির। অপ্রস্তুত হয়ে একটু রেগে গিয়ে ঝড়ি বলে, আমার কাজ আছে,আপনি যান।
থাকতি আসিনি, চলে তো যাবো। তো যাওয়ার আগে কিছু খবর দেই তোমার। নতুন করে কী খবর দেবেন, আমার তো সব শেষ! আপনার জন্যিই আমার কপালডা পুড়লো!
কী কও এসব তুমি। আমি তোমার কী কল্লাম?
আপনি যদি দুপুরচন্দ্র ফুল আনতি না বলতেন,তাইলে কি আমার স্বামীকে গোদানে ঠেসে মারত? তোমার স্বামীকে গোদানে ঠেসে মারেনি। এসব আপনি কী বলেন? তাহলে আমার স্বামীকে কিডা মারলো? সেডা জানানোর জন্যিই তো এতপথ একলাই আইলাম। উৎসুক হয়ে ঝড়ি জানতে চায়, তা আপনি জানলেন কিভাবে? তার উৎসাহে আরও একটু ঘি ঢেলে দিল অন্ধ ফকির। বালুণ্ডা গ্রামে ভিক্কে করতি গিইলাম, সেকানের হুজুর আমাকে ইঙ্গিত দিয়েছেন।আমি জিজ্ঞেস করতিই উনি বললেন, তোমার সঙ্গে কবে। সব জানতি হলি আমার সঙ্গে একন তোমার যাতি হবে। কনে? বালুণ্ডায়, কবিরাজ বাড়ি। আয়নাভরণ দিয়ে বের করতি হবে।
ঝড়ি বিবি এরপর বেশ ব্যাকুল হয়ে পড়ে। ভেতরে খচখচ করতে লাগল। গলা দিয়ে কান্না দলা পাকিয়ে ওপরে উঠতে চায় খালি। কোনোরকম নিজেকে এই বলে প্রমোদ দিল যে, অন্ততপক্ষে স্বামীর হত্যাকারীর নাম জেনে প্রতিশোধ নিলেও কিছুটা দুঃখ লাঘব হবে।একটু ভেবে অন্ধ ফকিরকে বলল, আমি একনি গুছিয়ে নিচ্চি,আপনার সঙ্গে যাব। দুপুরের ভাত রান্না বাদ দিয়ে রাতে রাখা পান্তাভাত খেয়ে অন্ধ ফকির ও ঝড়ি বিবি ক্ষুধা নিবারণের কাজ সেরে রওনা দিল। সোজা রাস্তা না ধরে খলসেমারীর মাঠ ধরে তারা হনহন করে হেঁটে চলল।মাঠের শক্ত মাটির খটখট আওয়াজে পুরো খলসেমারী থরথর করে কেঁপে উঠল। পুবপাড়ার নাজিমের মেয়েরা ঝড়ি দাদি, ঝড়ি দাদি, কনে যাচ্চো—বললেও কোনো লাভ হয় না, ততক্ষণে তারা ছোট ব্রিজ পার। সন্ধ্যা না হতেই এ খবর পুরো সোনামুখীর মানুষ জেনে যায়।
৬.
বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি। ঝড়ি দাদি কাঁথায় সূচ ঠেসে ধরে আমার দিকে তাকায়। আমি অসহায় ও উৎসুক হয়ে বলি, দাদি, সোনামুখীর মানুষেরা গল্পের এই পর্যায়ে এসেই থেমে যায়। তুমি তো এই গল্পের নায়িকা। বলো না, এরপর আসলে কী ঘটেছিল? ঝড়ি দাদি পায়ের ওপর থেকে কাঁথা সরিয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে শুরু করে,তালি শোন্, আমি আর অন্ধ ফকির শার্শা কামার বাড়ির মোড় যকন ক্রচ করব, তকন শুরু হল বিষ্টি। দৌড়ে একটা বাবলা গাছের নিচে এসে দাঁড়ালাম। ওমা! সঙ্গে সঙ্গে সেকি ঝড়-তুফান। বাবলা গাছটা যেন মাজা ভেঙে পড়ে যাবে। বাতাসে বাবলা গাছের একটা ডাল বারবার মুখের কাছ দিয়ে পাশের গাছের ওপর পড়ে হাচড়-পাচড় করছে। আমি আর অন্ধ ফকির একেবারে কুক্ড়ো ভেজা হয়ে গিলাম। শাড়ির আঁচলের ভেতর বাতাস ঢুকে ফত্ফত্ করে শব্দ হতি লাগলো। ফকির বাবা বারবার ইয়া নফসি, ইয়া নফসি করে। আমি তো ভয়ে কুঁকড়ে আছি। ফকির বাবাকে বললাম, একন কিরাম করে যাব বালুণ্ডো? এরপর বৃষ্টির বেগ আরও বেড়ে যায়। বাতাস কুমলো কিছুক্ষণ পর। ফকির বাবা আমাকে বলল, চলো এবার যাই গা। তারপর দুজন রওনা দিলাম।
পায়ে হেঁটে যাতি হবে সারাপথ। একনকার মতো সময় ছিল না তকন। গাড়ি বলতি শুধু গরুর গাড়ি। অন্য যানবাহন ছ্যালো না তেমন। তোদের তো একন কত সুক। সুকের ঠেলায় মাটিতে পা পড়ে না তোদের। নসিমন, করিমন, আলম সাধু আরও কত কি দ্যাকলাম এই কলি যুগে। তা শোন্। তারপর শুরু করলাম হাঁটা। দাঁড়া, পায়ে ঝিঝি লেগে গেছে একটু ঠিক করে নিই।
এই বলে ঝড়ি দাদি পাটা কয়েকবার ঝাকা মারলো। তারপর বুড়ো আঙুলটা ধরে গোলাকৃতিভাবে ঘোরাতে লাগল। ৩০ সেকেন্ড পর হালকা হাফ ছেড়ে বলল, হা, শোন্ বাপু, একন শার্শা কামার বাড়ি মোড় দিয়ে ডানে সোজা বেনাপোলের দিকে গিয়ে কাগজ পুকুর মোড় হয়ে বামে চোরের রাস্তায় ঢুকতে হবে। মাঝখানে দাদিকে থামিয়ে আমি বললাম, দাঁড়াও, দাঁড়াও,চোরের রাস্তা মানে?
ওহো এটাও জানিস না। তোরা শিক্ষিত পোলা! ইতিহাস-টিতিহাস সম্পর্কে কোনো খোঁজ খবর রাখিস না দেখছি।
আমি যদ্দুর জানি, মেলা আগে হীরানটী-রামচন্দ্র খাঁ-হোসেন শাহের আমল সেডা, তখন জেল থেকে আসামি মানে চোর-ডাকাত ধরে এনে এই রাস্তা বানানো হয়। সেই থেকে এর নাম হয়েছে চোরের রাস্তা। এই রাস্তার একটা ক্যারাবাজি হলো, এটা একদম সোজা, বাঁকাচোরার কোনো বালাই নেই। অবশ্য আমরা ছোটবেলায় রাস্তাডা দেখে বেশ অবাক হতাম। একন তো ভুঁইচোর বেড়ে গেছে, তাই যার জমির পাশে রাস্তা, সেই রাস্তা কেটে নিজের জমি বাড়িয়েছে। দেক দেক ধান ভানতি গিয়ে কেমন শীবের গীত গেয়ে ফেললাম। খেই হারিয়ে ফেলব, তাই হীরানটি ও রামচন্দ্র খাঁর গল্পটা একন বললাম না। পরে একদিন বলবানি, হ্যাঁ সোনা। তো তকনো টিপটিপ করে বিষ্টি পড়ছে। রাস্তায় ছোট ছোট গাছের ডাল টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে নেতিয়ে আছে। পা টিপে টিপে আমি ও ফকির বাবা হেঁটে যাচ্ছি কাগজ পুকুরের দিকে। লাঠি নিয়ে একা একা হাঁটতে ফকির বাবার কষ্ট হচ্ছে। খপ করে লাঠির এক মাথা ধরে হাঁটতে শুরু করি। এবার হাঁটার জোর বাড়লো। শার্শা বাজার পার হতে গিয়ে দেখি দুই চারজন ন্যাংটা ছেলে আমাকে দেখে মুচকি মেরে হাসছে। তারা হয়ত ভেবেছে ফকিরের নতুন সঙ্গী। গায়ের ভেতর কেমনজানি উত্তেজনাবোধ হতে লাগল আমার। মুখ ফুটে ফকির বাবার সেই সুর যেন কোথা থেকে ভেসে আসছে। ফকির বাবাকে একবার অনুরোধ করলাম সায়েরটা ধরার জন্যে। সে জানালো আজ তার মুড নাই। কী আর করা আমিই শুরু করলাম, দুনিয়াতে যার দুই চক্ষু নাই, তার মতোন দুঃখিত নাই।
বললাম ঠিকই তবে আমার বলার ভেতর তেমন কোনো সুর নাই। ফকির বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন। রাগে মাথায় আগুন ধরে গেল। কিন্তু কিছুই বললাম না তাকে। আবোলতাবোল চিন্তায় মাথাটা ভরে গেছে তখন আমার। সব হজম করে সামনের দিকে এগোতে থাকি। অবশেষে কাগজ পুকুর গিয়ে পৌঁছলাম। এবার চোরের রাস্তা ধরে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে হবে। মনে পড়ল, মুরুব্বিরা বলে দক্ষিণ দিকে না যাওয়া মঙ্গল। তবু কোনো উপায় নেই। যেতে আমাকে হবেই। হনহন করে হাঁটা ধরলাম লাঠির এককোণ ধরে। রাস্তা ফাঁকা, শো শো করে তখনো বাতাস বইছে। হামারখামার করে দুজনে হাঁটতে লাগলাম। ফকির বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, আর কতক্ষণ লাগবে বাবা? তিনি জবাব দিলেন, এই ধরো পায়ে হাঁটা পথ তো, ঘণ্টা দেড়েক মতো লাগবে। মনে মনে বললাম, তা লাগুক। সত্য আমাকে জানতিই হবে। সবকিছু সত্য জানার ভেতর একটা সুখ আছে, তাই না আমার প্রেমিকবর? আমি একটু কুঁকড়ে গেলাম! দাদি আজ ফুল টালে আছে। কী বলতে গিয়ে কী যে বলে ফেলে বোঝা বড় মুশকিল। তাই আজ তাকে কোনো আবোলতাবোল প্রশ্ন করছি না। তার মুখ থেকেই পুরোটা শুনতে হবে। অন্ততপক্ষে আমাকে জানতে হবে ঘটনার পুরোটা। কারণ গল্পখরায় ভুগছি বেশ কিছুদিন। তো আবার আমি দাদির কথায় কান পাতি। দাদি একটা বড় হাই তুলে বলল, হ্যাঁ কোথায় যেন ছিলাম। আমি জানায়, ওই যে, সত্য তোমাকে জানতেই হবে। হুম, তারপর শনশন বাতাস তার সঙ্গে নির্জনতা দুইটা মিলে খা খা করছে বুক। সত্যি বলতি কি একটু ভয় ভয়ও লাগছিল। তখন সন্ধ্যা। আশপাশ থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। হুজুরের বাড়ি পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে ভাবতেই বুকটা ভারী হয়ে গেল। ফকির বাবা আমার গা ঘেষে দাঁড়ালেন। ঘিনঘিন করে উঠল গা’টা। তবু তাকে কিছু বললাম না। তার পান খাওয়া দাঁত বের করে আমাকে বললেন, একটা কতা কই? তার বলার মধ্যে কেমনজানি রহস্যের গন্ধ পেলাম। বললাম, বলেন। দাঁত কেলিয়ে তিনি আমাকে বললেন, আমি তোকে ভালোবাসি, তোকে বিয়ে করতি চাই, সেই জন্যি তোর ভাতারকে খুন করিচি।
তুই বল, এ কথা শুনলে মাথা কারও ঠিক থাকে? আমারও থাকেনি। মাথার মদ্দি চড়চ্চড় করে উঠল। হাতের লাঠি দিয়ে দমাদম পিটাতে লাগলাম তাকে। প্রথম বাড়ি দিলাম মাথা বরাবর। চিৎপটাং হয়ে কাচা রাস্তার ওপর পড়ে গেল সে। ভেতরের যত রাগ সব ঝাড়লাম তার ওপর। মাথা ফেটে রক্তে জবজব হয়ে মাটি ভিজে গেল। পাগলিনীর মতো বাড়ির ওপর বাড়ি। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেল তার শরীর। আমিও ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। ও হ্যাঁ, তোকে আর একটা কথা বলি, ওই হারামজাদা ফকিরের বাচ্চা একটা চোখে ঝাপসা ঝাপসা দেখতো। লজ্জার কথা! তবু তোকে বলি,তুই এখন সেয়ানা হয়েছিস, তাই বলাই যায়। ঝড়ের মধ্যে পড়ে বাবলা গাছের নিচে আমরা যখন ছিলাম, ওই হারামির বাচ্চা তখন সুযোগ বুঝে আমার ডান পাশের দুধটা চেপে ধরে আবেগে বলেছিল যে, তার বাম চোখ দিয়ে সে নাকি একটু একটু দেখতে পায়। আরও বলেছিল যে, কলকাতা গিয়ে তার চোখ অপারেশন করবে। তারপর নতুন বিয়ে করে ঘর বাঁধবে। তাহলে বোঝ, হারামজাদার খায়েশ কত? দাদির কোমলমতি চোখ মুহূর্তেই লাল টকটকে হয়ে গেল। আমি এ এক অন্য দাদিকে দেখছি। আমি একটু নড়েচড়ে বসে দাদিকে জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর কী করলে দাদি?
কী আর করব, লাশটার ওপরে কয়েকবার থুথু ফেলে উল্টো পথ ধরলাম। সোজা বাড়ি। তারপর ১৫ দিন পর তোর বাবা এলো পেটে। আমি বললাম, আচ্ছা দাদি বাবা পেটে আসাতে গ্রামে অনেকে তোমার চরিত্র নিয়ে কী সব আজে-বাজে কথা বলে আমার শুনতে একটুও ভালো লাগে না। দাদি আমার পিঠের ওপর হাত রেখে যা বলল, তা শুনে রীতিমতন আমি আশ্বস্ত হলাম।
আরে শোন, স্বামী মরা মহিলাদের নামে এরকম রটে। বিধবা মহিলাদের দেখলে জিব লকলক করে অনেকেরই। ঘরের বউ রেখে উঁকিঝুঁকি মারে বেড়ার ফাঁক দিয়ে বিধবাদের ঘরে। আমিও আর বাদ থাকব কেন? শুরু হলো অত্যাচার। সকাল সন্ধ্যা পুরুষগুলোরে তাড়িয়ে পারিনে। ফুচকি দিতেই থাকে প্রতিদিন। কখনো রান্নাঘরে, কখনো শোবার ঘরে, কখনো বা কলপাড়ে। কিছুতেই শান্তি পাই নে। শোন তোকে একটা মজার ঘটনা বলি, আমি একদিন বসে মাছ কুটছি। ঠিক দুপুর বেলা। পশ্চিম পাড়ার মুন্সী এসে বসলো। আর ইনিয়ে বিনিয়ে রাজ্যের কত কথা। আমার কোনো সাহায্য লাগবে কি না। একা থাকতি ভয় করে কি না। রাতে ঘুমের মদ্দি কষ্ট হয় কিনা, এ রকম নানা আজগবি সব গল্প করতে লাগলো আমার সঙ্গে। এভাবে বলতে বলতে ওমা বলা নেই, কওয়া নেই, ফচাং করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমিও হাতের কাছে বটি পেয়ে দিলাম ওর পাছার ওপরে একটা কোপ বসিয়ে। ও মাগো, ও বাবাগো বলে সেকি দৌড়। বিশ্বাস না হয়, ওর পাছার লুঙ্গি উঁচু করে দেখিস একবার। ভাব খারাপ দেখে পরের দিনই মাকে নিয়ে আসলাম এই বাড়িতে। এরপরও যে মানুষজন আমাকে ডিস্টার্ব করেনি তা নয়। তবে সত্যি কথা বলতি কী জোয়ান চ্যাঙড়াদের থেকে মরার বুড়োরাই বেশি ঘুরঘুর করত। কত বুড়োর খেদানোর জন্য যে হেশো চেলে মেরেছি তা তুই হিসাব করতি পারবিনে।
৭.
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে দাদি বড় একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল। তার দীর্ঘনিঃশ্বাস আমাদের উঠোন পেরিয়ে কোণার বাবলা গাছের ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়ল পুরো সোনামুখী গ্রামময়। কোলের ওপর পড়ে থাকা নকশিকাঁথাটা এক সাইডে সরিয়ে একটা হাই তুলল আমার দাদি ঝড়ি বিবি। বেশ ঝরঝরা লাগছে তাকে এখন। এবার আমার মরেও শান্তি—বলেই দাদি আমাকে ধমকের সুরে বলল, যা এবার শুতি যা, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।