এখানে ইন্ডিয়ান গ্রোসারিতে মাঝে মাঝে লাউ পাওয়া যায়। তবে রান্ধুনী নামের মৌরি মসলা পাওয়া যায় না। রান্ধুনী ছাড়া লাউয়ের আসল স্বাদ আসে না। এটা নিয়ে আমার ক্ষোভ থাকলেও আমার স্ত্রীর ক্ষোভ অন্যত্র। তার দরকার কচি লাউ পাতা। লাউ পাতায় কই মাছ ভাতে সিদ্ধ করে খাবে। এটা শিখেছে আমার মায়ের কাছ থেকে। এর তুল্য সুস্বাদু খাবার এ জগতে নেই।
ফ্রজেন কই মাছ দেশ থেকে গ্রোসারিতে আসে। কিন্তু কচি লাউ পাতা পাওয়া যায় না।
আমার প্রতিবেশী উল্লাহ সাহেব করিতকর্মা লোক। তিনি বললেন, চিন্তা করবেন না। যোগাড় হয়ে যাবে।
তখন ফেব্রুয়ারি মাস। মাঝে মাঝে তুষার ঝরে। এরকম একদিন উল্লাহ সাহেব এলেন। বললেন, কচি লাউ পাতা যোগাড় হয়েছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছি।
এই তুষারপাতের মধ্যে লাউ পাতা পাওয়ার কথা নয়। মনে হলো মস্করা করছেন। হাসি মুখে তিনি জানালেন, মোটেই মস্করা নয়। ফ্লোরিডা থেকে এনেছেন। সেখানকার আবহাওয়া বাংলাদেশের মতো। শুধু লাউ নয় পান সুপারিও জন্মে।
কথা সত্যি। কিন্তু উল্লাহ ভাইয়ের হাত খালি। কোনো ব্যাগ নেই। লাউ পাতাও নেই। আমাকে অবাক হতে দেখে তিনি পকেট থেকে ছোট একটা প্যাকেট বের করলেন। সেখানে কচি লাউ পাতা থাকার কথা নয়। থাকলে থাকতে পারে শুকনো লাউ পাতার গুড়ো। লাউ পাতার গুঁড়ো কেউ খেয়েছে বলে কোনোকালে শুনিনি।
উল্লাহ ভাই আবারও শব্দ করে হাসলেন। প্যাকেটটা খুললেন। তার ভেতর থেকে বের হলো লাউ পাতার গুড়ো নয়—কয়েকটা বিচি লাউয়ের বিচি।
—বিচি দিয়ে কী করব?
—বিচি মাটিতে লাগিয়ে দিন। গাছ হবে। তিনি জবাব দিলেন।
অ্যাপার্টমেন্টে লাউ গাছ লাগানোর কোনো সুযোগ নেই। টবে মরিচ গাছ করা যায়। স্বল্পমূলী ফুলগাছও হয়। আমার দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে উল্লাহ সাহেব লাউ বিচি নিয়ে পার্কিং লটে চলে গেলেন।
আমাদের পার্কিং লটের পুরোটাই কংক্রিটের পাকা করা। বেড়া ঘেঁষে কিছুটা মাটি আছে। কিছু বুনো লতাপাতা হয়। সেখানে উল্লাহ সাহেব লাউ বীজগুলো পুতে দিলেন।
তখন মার্চ মাস শেষ হতে চলেছে। দ্রুত ঘাস গজাতে শুরু করেছে। একদিন উল্লাহ সাহেব ডেকে নিয়ে দেখলেন, ঘাসের মধ্যে লাউ চারা গজিয়েছে। বললেন, একটু যত্নআত্তি করুন। শুধু পাতা নয়, লাউও পাবেন।
গোটা তিনেক চারা। গোড়ার ঘাস পরিষ্কার করে দিলাম। বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটি গার্ডকে অনুরোধ করা হলো, যেন কেউ চারা তিনটিকে তুলে না ফেলে।
সিকিউরিটির নাম বেনি। স্প্যানিস। বুড়ো হয়েছে। মাঝে মাঝে টলে। জিজ্ঞেস করল, এ গাছে কি ফুল ধরে?
বললাম, নিশ্চয়ই ধরে। পুরুষ ফুল ধরে। আলাদা করে স্ত্রী ফুলও ধরে। এটা আমাদের দেশের বিখ্যাত লাউ গাছ।
বেনি শুনে খুব খুশি। বলল, তাহলে চিন্তা করো না। গাছগুলোর খুব যত্ন করব।
বেনি এই বিল্ডিংয়েই থাকে। তার কোনো স্ত্রী পরিবার নেই। উল্লাহ সাহেব তাকে চোখ টিপে বলল, শুধু ফুল না, বেনি, আনাজও পাবা। খাইতে খুব স্বাদ।
আনাজ শব্দটি বাংলায় বলায় তার মানে বেনি বুঝতে পারল না। সে নিয়ম করে গাছে জল দিতে লাগল। নতুন পাতা ছাড়লো। ডগা বের হলো। ডগডগিয়ে বেড়ে উঠল। নতুন গজানো আকশিগুলো হাওয়ায় দুলতে লাগল। তার জন্য মাঁচা চাই। বেড়ার সঙ্গে লাঠি গেড়ে সুন্দর মাঁচাও তৈরি হলো। বেনিই সব করল। নিয়ম করে গোড়ার মাটি খুঁচে দিল। হোম ডিপো থেকে সার মাটি দিতেও বাদ রাখল না। লাউ গাছের এরকম নধর কান্তি চেহারা দেখা যায় কেবলমাত্র বরিশালের গ্রাম—গাঁয়ে।
অ্যাপার্টম্যান্ট বিল্ডিংয়ে এলা বার্টন নামে এক বুড়ি থাকে। একা। তার বয়সের গাছ পাথর নেই। একজন সরকারি হোম এটেনডেন্ট তার দেখভাল করে। চোখে ভালো করে দেখতে পায় না।। কানে কম শোনে।
বুড়ি এলা বার্টন বলল, এ রকম আঙুরগাছ তার হানিমুনের সময়ে সাউথ ক্যালিফোর্নিয়ায় দেখেছে। তার তুল্য মিষ্টি আঙুর এ জীবনে আর দেখেনি।
শুনে বেনি এলাকে বলল, এটা আঙুরলতা নয়। এটা ইন্ডিয়ান ফুলের গাছ।
বুড়ি সেটা মানতে নারাজ। ঘর থেকে ছবির এলোবাম নিয়ে এলো। একটা ছবি বের করে দেখালো। এক গ্রাম্য চার্চের পাশে নবীন দম্পতি পাশাপাশি দাঁড়ানো। হাসি হাসি মুখ। পুরুষটির মাথায় কাউবয় টুপি। সাদা কালো ছবি। পুরনো বলে ছবিটির সব কিছু স্পষ্ট বোঝা যায় না। সেখানে আঙুরলতার চিহ্ন নেই। বুড়ি বলল, আঙুর লতা ঠিক ওদের পেছনেই আছে। সেদিন মেয়েটি একটি গানও গেয়েছিল। গানটি নাতালি উড দিস প্রপারটি ইজ কনডেমড মুভিতে ঠোঁট মিলিয়েছিল।
________________________________________________________________________________
বার্টনদের পরিবার ক্যালিফোর্নিয়ার প্রখ্যাত আঙুর-পরিবার। বেশ কয়েকটি নতুন জাতের আঙুরলতা তারা বের করেছিল। বেনি পরদিন হোমডিপো থেকে হাড়ের গুঁড়া ওরফে বোনমিল নিয়ে এলো। খুব ভালো করে গাছের গোড়ায় মিশিয়ে দিল।
________________________________________________________________________________
বেনির কাছে একটু ক্ষমা চেয়ে এলা বার্টন গানটির এক কলি গেয়েও উঠল— Wish me a rainbow.
বুড়ি আরও জানালো, গানটির পুরোটাই তার মনে আছে। এই গাছে যখন আঙুর ধরবে তখন গানটি গেয়ে শোনাবে।
আঙুর ধরার কথা শুনে বেনির মেজাজ বিগড়ে গেল। বুড়িকে আঘাত দিতে চায় না বলে বিড়বিড় করে জানালো, এ গাছে কোনো আঙুর ধরুক সেটা সে চায় না। গ্রোসারিতে কি আঙুর পাওয়া যায় না? লাগলে সে কিনে আনতে পারে।
বেনির কথা শুনতে পায়নি বুড়ি। ঘরে ফিরে যাওয়ার আগে বলল,এই ছবিতে নবদম্পতিটি হলো সে আর তার স্বামী রিচার্ড বার্টন। ছবিটা সত্তর বছর আগে তোলা। একটু লজ্জা মিশ্রিত গলায় আস্তে করে বলল, রিচার্ডের চোখ ছিল ধূসর রঙের। স্বপ্নময়। এত ভালো চোখ পৃথিবীতে আর কোনো পুরুষের নেই।
দিন দিন গাছটি পল্লবিত হয়ে ওঠে। হাওয়ায় পাতা দোলে। আমার স্ত্রী কই মাছ কিনে আনে। জিরে বাটার জন্য এক ভারতীয় পরিবারের কাছ থেকে শিলপাটাও খুঁজে আনল। তাতে মরিচ বাটবে। জোগাড় করল খাঁটি সরিষার তেল। ষাইটা ধানের চাল পাওয়া গেল না। বাঁশমতি চাল কিনে আনা হলো। তবে লাউ পাতা তুলে আনতে গেলে বেনি একটু কেশে বলল, নো ম্যাম, এখনো কুঁড়ি আসেনি। কুঁড়ি আসুক। তারপর ফুল আসবে। সে পর্যন্ত তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে।
বুড়ি এলা বার্টন টুকটুক করে নেমে এসে বলল, সাউথ ক্যালিফোর্নিয়ায় হানিমুনের সময় আঙুর বাগানে হাড়ের গুঁড়ো দিতে দেখেছিল। তার স্বামী বার্টন বলেছিল, হাড়ের গুঁড়ায় ফসফরাস আছে। ফসফরাস গাছে ফুল ফোটাতে সাহায্য করে।
বার্টনদের পরিবার ক্যালিফোর্নিয়ার প্রখ্যাত আঙুর-পরিবার। বেশ কয়েকটি নতুন জাতের আঙুরলতা তারা বের করেছিল।
বেনি পরদিন হোমডিপো থেকে হাড়ের গুঁড়া ওরফে বোনমিল নিয়ে এলো। খুব ভালো করে গাছের গোড়ায় মিশিয়ে দিল।
বুড়ি খুব খুশি হয়ে বলল, শুধু সার দিলেই হবে না। আঙুরলতাকে গান শোনাতো বার্টনরা। বুড়ি একটা রেকর্ড প্লেয়ার নিয়ে এলো। সেখানে সং অব সলোমনের একটি গান আছে। বুড়ি বাজিয়ে শোনালো—
O my dove, in the clefts of the rock, In the secret place of the steep pathway,
Let me see your form, Let me hear your voice;
অয়ি মম কপোতি! তুমি শৈলের ফাটলে, ভূধরের গুপ্ত স্থানে তুমি রহিয়াছ,
আমাকে তোমার রূপ দেখিতে দেও, তোমার স্বর শুনিতে দেও,
কেননা তোমার স্বর মিষ্ট ও তোমার রূপ মনোহর।
এই গানের কম্পোজিশন করেছে পল বিন হেইম। গেয়েছে মেরি ক্লেরে হেরমন। বুড়ি বলল, এই গানটিতে আঙুরলতার কথাও আছে। এই গানের লং প্লে রেকর্ড আনার জন্য তার স্বামী বার্টন অর্ডার দিয়েছিল মিউনিকের বিখ্যাত মিউজিক স্টোরে। তার ধারণা ছিল, নিয়মিত এই গানটি আঙুর বাগানে বাজালে আঙুর ফুল থেকে বিরাটকায় আঙুর ফল জায়ান্ট গ্রেপ ধরবে। এর তুল্য আঙুর পৃথিবীতে কখনো ধরেনি। তাদের পরিবারের পূর্বপুরুষের ধারণা—কেউ না কেউ জায়েন্ট গ্রেপ জাত জন্মাতে পারবে। এ বিষয়ে অষ্টম পরদাদা মি. আলেক্সান্ডার বার্টনের একটি আগাম অভিনন্দনবার্তাও রৌপ্যফলকে লিখিত আছে। তিনি লিখেছেন—ধন্য সেই বার্টন যাহাতে পবিত্র গ্রেপ ফল মহিমান্বিত হইবে। সালটি লেখা আছে ১৭০২ খ্রিস্টাব্দ।
এলা আরও যোগ করল, রিচার্ডের কী করে যেন ধারণা হয়েছিল, সে-ই জায়েন্ট গ্রেপ উদ্ভাবন করতে পারবে। সে না পারলে অন্য কোনো বার্টন পারবে না। এটা নিয়ে তার এক ধরনের খ্যাপামিও ছিল। এটা ছাড়া আর কিছু চিন্তা করত না। তাকেও মোটেই সময় দিত না। সারাক্ষণ আঙুর বাগানে পড়ে থাকত। এলা বার্টন বলল, আঙুর গাছকে তার সহ্য হত না। তার প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য কোনো নারী মনে হত যে তার স্বামীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেছে।
এ সব শুনতে বেনির কোনো আগ্রহ নেই। সুযোগ পেলেই মেয়েমানুষরা বেশি বেশি কথা বলে। এ কারণে সে কোনো মেয়েমানুষের ছায়াও মাড়ায়নি সারাজীবনে। প্রসঙ্গ ঘোরাতে বেনি একটু উচ্চস্বরে বুড়িকে জিজ্ঞেস করল, তাইলে কি গাছের ফুলের আকারও কি বড় হবে?
বুড়ি মাথা হেলিয়ে বলল, নিশ্চয়ই বড় হবে। ফুল বড় না হলে ফল বড় হয় কী প্রকারে?
পরদিন বেনি সং অব সলোমনের গানের সিডি কিনে আনল ম্যানহাটন থেকে। কুঁড়ি মেলার আগে থেকে প্রতি ভোরে আকাশ ফর্সা হতে শুরু করলে সিডিটি বাজানো শুরু করল। অদ্ভুত কাঁপা কাঁপা গলার সঙ্গে পিয়ানো বাজাচ্ছে বিখ্যাত পিয়ানো বাদক হেউটা বেট আরি। এলা বুড়ি জানালা খুলে একবার দেখল। তারপর পার্কিং লটে আঙুল মাঁচার কাছে এসে কুঁড়ি থেকে ফুল দেখার চেষ্টা করল। ভোরের হাল্কা হাওয়ায় গাছের সবুজ পাতা অল্প অল্প নড়ছে। বলল, যে সময়ে তার স্বামী বার্টন গানটির রেকর্ডের অর্ডার দিয়েছিল সে সময়টাতে মিউনিক থেকে কোনো অর্ডার সাউথ ক্যালিফোর্নিয়াতে পাঠানো সম্ভব নয় বলে ডাক—বিভাগ জানালো।
—তাহলে? বুড়িকে জিজ্ঞেস করলাম।
বুড়ি ক্লান্তি বোধ করছিল। কোনো উত্তর না দিয়ে ধীরে ধীরে ঘরে চলে গেল। তার জানালাটির একপাল্লা খুলে মুখ বের করল। এক ক্লান্তিকর স্বরে বলল,বার্টন কাউবয় টুপিটা পরে মিউনিকে চলে গেল। রেকর্ডটা তার আনা চাই। জায়ান্ট গ্রেপ ধরানো চাইই।
মিউনিকে যাওয়ার সময় বলে গেল, গানটি নিয়ে এলে গাছে জায়ান্ট গ্রেপ ধরবেই। তারপর তার কাজ শেষ। এলাকে নিয়ে সারাজীবন হানিমুন করে কাটাবে।
সাদা সাদা লাউ ফুল ফুটল কয়েকদিনের মধ্যেই। বুড়ি ফুলের আকার দেখে মুগ্ধ। বলল, দেখছো না, সং অব সোলেমানের গুণ। বার্টন ঠিক ধরেছিল। বড় বড় ফুল থেকেই বড় জাতের আঙুর ধরবে।
আমার স্ত্রীর তর সইছিল না। সে লাউ পাতা তুলতে এসেছিল। বুড়ির উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলল, এগুলো পুরুষ ফুল। পুরুষ ফুল থেকে ফল ধরবে না।
বুড়ি শুনে মন খারাপ করল। জিজ্ঞেস করল, ও মেয়ে, স্ত্রী ফুল ধরবে তো?
—অবশ্যই ধরবে। চিন্তা করো না।
—কিন্তু চিনব কী করে?
—স্ত্রী ফুলের পাঁপড়িমণ্ডলের নিচে কুঁড়ি ফলও থাকবে। এই কুঁড়িফল দেখেই চিনতে পারবে।
এবার বুড়ির মনটা ভালো হয়ে গেল। তার ধারণা—ভারতীয়রা কখনো মিছে কথা বলে না। বলল, তাহলে তুমি আজ পাতা তুলো না। আগে স্ত্রীফুল আসুক।
____________________________________________________________________________________
বুড়ি এলা বার্টনের কাছ থেকে জানা গেল, মি. বার্টন ফিরে না আসায় এলাকে তার বাবা—মা আবার বিয়ে করতে পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু এলা সে কথা শোনেনি। একা থেকেছে। সজ্ঞানে কোনো পাপ করেনি। বিশ্বাস করেছে, জায়ান্ট গ্রেপ কোনও এদিন ফলবে। বার্টনের বাসনা পূর্ণ হবে।
____________________________________________________________________________________
স্ত্রীফুলও এসে গেল। প্রথমে খুব ছোট। কয়েকদিনের মধ্যেই গোড়ায় বর্তুলাকার লাউ কুড়ি দেখা দিল। বুড়ি খুব কষ্ট করে দেখে বলল, কুঁড়িগুলো দেখতে সাধারণ আঙুরের চেয়ে বড়। পরিণত হলে জায়ান্ট গ্রেপ হবে।
বুড়ি এলা বার্টন এই দিনগুলোয় ভোর হওয়ার অনেক আগে থাকতেই নিজের ঘরে উচ্চ ভলিউমে সং অব সলোমন রেকর্ডটা বাজাতে শুরু করে। বেনি তার আগেই উঠে যায়। গাছের চারিদিকে ঝাড়পোচ দিয়ে একটি পবিত্র ভাব ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু সমস্যা হলো, কুড়িগুলো সামান্য বেড়েই পঁচে যায়। বুড়ির হতাশা বাড়ে। তার মনে হয় কোনো পাপের ফলে ফলগুলো পচে যাচ্ছে। কুড়ি ফল পচে গেলে জায়েন্ট আঙুর হবে কী প্রকারে?
জানালার কাছে বসে প্রার্থনা করে। বুড়ির গাল বেয়ে জল পড়ে।
আমার স্ত্রীর হাত ধরে বুড়ি শোনালো, মিউনিক থেকে সং অব সলোমন রেকর্ডটা এলেও রিচার্ড বার্টন ফিরে আসেনি। তার সন্ধানই পাওয়া যায়নি। জাহাজটির যেদিন ডকইয়ার্ড ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল, সেদিনটিতে কোনো জাহাজ ছাড়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। শোনা যায় হিটলারের বাহিনী জাহাজ থেকে সব মানুষকে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছিল কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে। বুড়ি চোখ মুছতে মুছতে বলল, পরে বার্টনের জামা—কাপড়, কাউবয় টুপিটা আর সং অব সলোমনের রেকর্ডটি ডাকে আসে।
বুড়ি এলা বার্টনের কাছ থেকে জানা গেল, মি. বার্টন ফিরে না আসায় এলাকে তার বাবা—মা আবার বিয়ে করতে পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু এলা সে কথা শোনেনি। একা থেকেছে। সজ্ঞানে কোনো পাপ করেনি। বিশ্বাস করেছে, জায়ান্ট গ্রেপ কোনও এদিন ফলবে। বার্টনের বাসনা পূর্ণ হবে।
সেটা শুনে বললাম, কোনো পাপে নয়, ডেকাস সিলিয়েটাসের আক্রমণে ফল নষ্ট হচ্ছে।
শুনে বেনি খুব খেপে গেল। ডেকাস সিলিয়েটাসকে মারতে বন্দুক আনতে ছুটল।
তাকে ফিরিয়ে এনে বললাম, ডেকাস সিলিয়েটাস কোনো জন্তু জানোয়ার নয়। এটা এক ধরনের বোলতা পোকা। তারা কচি ফলে নরম ত্বকে ডিম পেড়ে যাচ্ছে। সেজন্য ফলগুলো পচে নষ্ট হচ্ছে। বেনি জিজ্ঞেস করল, তাহলে কী হবে?
কুঁড়িফল ছোট পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিলাম। কয়েকদিনের মধ্যে ফলগুলো বাড়তে শুরু করল। আমার স্ত্রী কই মাছের পাশাপাশি কুচো চিংড়ি দিয়ে লাউ রাধার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল।
মাচায় বেশ কয়েকটা লাউ ধরেছে। আর ফুলও ফুটে আছে বেশ কিছু। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই একটা টেনিশ বলের আকার ধরল। তখনই বুড়ি প্রেসকে খবর দিতে চাইল। তাকে বোঝালাম, ফলের আকার আরও অনেক বড় হবে।
শুনে বুড়ি বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ল। বলতে লাগল, বার্টনের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে।
এর মধ্যে বুড়ি অসুস্থ হয়ে গেল। লং আইল্যান্ড জুইস হাসপাতালে তাকে নেওয়া হলো। তার বাঁচামরা নিয়ে সংশয় দেখা দিল। তার বুকে নতুন করে পেস লাগানো হলো। এ যাত্রায় বুড়ি সেরেও উঠল। সপ্তাহ দুই পরে জানা গেল বুড়ি রবিবার বাড়ি আসবে। এ উপলক্ষে বিল্ডিয়ের ভাড়াটেরা একটি উৎসবের আয়োজন করল। সে অনুসারে পার্কিং লটে বারবিকিউ হবে। কচি লাউপাতা দিয়ে কইমাছ। আর চিংড়ি দিয়ে লাউয়ের কারি রান্না হবে। এটা করবে আমার স্ত্রী। গাছে ঝুলন্ত লাউয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বুড়ি এলা বার্টন বিস্ময়কর বড় জাতের আঙুরের ছবি তুলবে।
এ উপলক্ষে পার্কিং লটকে খুব সুন্দর করে সাজানো হলো। নানা রংয়ের মরিচ বাতি বসানো হলো। ভাড়া করে আনা হলো কয়েকটি বারবিকিউ কয়লার চুলা। আর লাউ রান্নার জন্য গ্যাসের চুলা। উৎসবের পোশাক কিনতে মেয়েরা ছুটলো মেসি স্টোরে। শুধু বেনিকে দেখা গেল, নিশ্চুপ। একটু গম্ভীর। চোখ লাল। একটু বেশি পান করে ফেলেছে।
এলা বার্টন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবে বিকাল চারটায়। তাছাড়া ছুটির দিন বলে বিল্ডিংয়েরর সবাই আয়েশ করে বেশ বেলা অব্দি ঘুমালো। কেউ উঠল দশটায়। কেউ বারোটায়। কেউ বা উঠল একটায়। আমার স্ত্রীর ভোর ভোরই ওঠার অভ্যাস । উঠে একটু হাঁটাহাঁটি করে। আজ হাঁটাহাঁটি বাদ দিয়ে পড়িমড়ি করে ছুটে এলো। একটি দুঃসংবাদ শোনাল। বলল, বুড়ো বেনি নেই।
আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, মারা গেছে?
—না। চলে গেছে।
চলে গেছে। মরে যায়নি। আতঙ্কটা কেটে গেল। বেনি বুড়ো হয়েছে। অনেক আগেই অবসর নেওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল। নেওয়াই দরকার। তবু মনটা একটু খচখচ করে উঠল। আজ না গেলেই পারত। আমাদের লাউ উৎসব করে যেতে পারত। বুড়ি এলা বার্টন খুশি হতো।
তবে বেনি একটি চিঠি রেখে গেছে। লিখেছে, পার্কিং লটের ওই জায়গাটিতে ডিয়েন্ড্রা হাজ মরে পড়েছিল। তার শিরা থেকে ওই মাটিতে সব রক্ত ঝরে পড়েছিল। ওইখানে যে ফুল গাছ হয়েছে তা ডিয়েন্ড্রারই রক্ত-মাংস-আত্মা। ফুলগুলো তার অনুপম ভালোবাসা। ফুলগুলো দেখে আমার নতুন করে ভালোবাসার ইচ্ছে জেগেছিল। কিন্তু গাছটির পাতা এবং লাউ নামের ফল রেঁধে খাওয়ার অর্থ ডিয়েন্ড্রাকে খেয়ে ফেলারই উৎসব। এটা এই বয়সে অসহনীয়। তাই লাউ গাছটি তুলে নিয়ে চলে গেলাম। ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
পার্কিং লটে গিয়ে দেখা গেল, লাউগাছের জায়গাটি সাফসুতেরো। মাচাসুদ্ধ কোনো লাউগাছ এখানে ছিল তার কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই। আমার স্ত্রী একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। পাতা দিয়ে কইমাছ আর চিংড়ি রাধার সুযোগ আর থাকল না বুঝে বড় শোক পেল।
বিল্ডিংয়ের সুপারভাইজার একটু হেসে বলল, বেনি একটা পাগল। ডিয়েন্ড্রা হাজ নামে কেউ এই বিল্ডিএ কখনো ছিল না। কেউ হাতের শিরা কেটে এখানে মারাও যায়নি। বুড়ো বেনি মাতাল হয়ে গালগল্প বানিয়েছে। চিন্তা করো না। সব কিছু ঠিকঠাক মতো হবে।
বিকেল চারটার মধ্যেই পার্কিং লটে বিল্ডিংয়ের লোকজন নানা রঙের পোষাক পরে এলো। সঙ্গে নিয়ে এলো সুস্বাদু সব খাবার। একটা সঙ্গীত দলও এসেছে। তারা মৃদুমন্দ হাওয়ায় বাদন শুরু করল।
বুড়ি এলা বার্টনের গাড়িটা এলো সাড়ে পাঁচটায়। হাসি হাসি মুখ করে বের হলো। বেশ শীর্ণকায় হয়ে পড়েছে।
যেখানে লাউগাছটি ছিল সেখানে তাকাল। খুব কষ্ট করে গাছটি দেখার দেখার চেষ্টা করল। দেখতে না পেয়ে তার মুখ শুকিয়ে গেল। সুপারভাইজার বুঝতে পেরে তার কানের কাছে মুখ রেখে বলল, দুষ্টু শিয়ালগুলো গাছটিকে ছিঁড়ে ফেলেছে।
বুড়ি চমকে জিজ্ঞেস করল, কোন শেয়ালগুলো?
—সং অব সলোমনের শেয়ালগুলো। বলে সুপারভাইজার বাইবেল থেকে সং অব সলোমনের দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে পড়ে শোনালো,
Catch the foxes for us, The little foxes that are ruining the vineyards,
While our vineyards are in blossom.(তোমরা আমাদের নিমিত্ত সেই শৃগালদিগকে, ক্ষুদ্র শৃগালদিগকে ধরো,
যাহারা দ্রাক্ষার উদ্যান সকল নষ্ট করে;
কারণ আমাদের দ্রাক্ষার উদ্যান সকল মুকুলিত হইয়াছে।)
বাইবেলকে অবিশ্বাস করার আর উপায় নেই। বুড়ি শুধু জিজ্ঞেস করল, তাহলে গাছের সেই জায়ান্ট গ্রেপগুলো?
সুপারভাইজার টুপিটা কাত করে বললেন, আছে।
—কোথায়?
এর উত্তর দেওয়ার দরকার হলো না। বিল্ডিংয়ের সব ছোট ছোট ছেলেমেয়ে একটি ট্রলি টেবিল ঠেলে নিয়ে এলো। তার ওপরে একটা বড়সড় লাউ। লাউয়ের গায়ে পেস্ট্রি দিয়ে লেখা ‘হ্যাপি সেভেন্টিথ হানিমুন’।
বুড়ি দেখল কি দেখল না বোঝা গেল না। শুধু চোখ বুজল। বিড়বিড় করে বলল, স্বর্গে গিয়ে সে মিস্টার রিচার্ড বার্টনকে তার এই জায়ান্ট গ্রেপ জন্মানোর খবরটি দিতে পারবে। আর তাকে ফাকি দিতে পারবে না। শুধু তাকেই সময় দেবে।
আমার স্ত্রী লাউ পাতার শোক ভুলে গেল। যন্ত্রীরা জোরে জোরে বাদন করতে শুরু করল। সবাই গলা ছেড়ে গাইতে লাগল—
Wish me a rainbow and wish me the stars
All this you can give me
Wherever you areAnd dreams for my pillow
And stars for my eyes
And a masquerade ball
Where our love wins first prize।
গানের মধ্যে দিয়েই জায়ান্ট গ্রেপ কাটা হলো। সবাই স্বীকার করল, এতো সুস্বাদু কেক তারা আগে কখনো খায়নি।