আস্তে আস্তে যখন দানেশ চোখ খুলল, তখন বাইরে আধাফোটা পদ্মকলি ভোর। গুটিশুটি মেরে সে আরও কিছুক্ষণ পড়ে থাকে। ভোরটা ধীরে ধীরে ফুটছে। গরম কালের ভোর ফোটা শেষ হলেই বারুদের মতো দপ করে জ্বলে উঠে ঝরে পড়ে। গুদাম ঘরটা তখনো আদিমকালের অন্ধকার গুহার মতো হয়ে আছে, আঁধারগুলো কালো রক্ত খাওয়া জোঁকের মতো সেঁটে থাকে গুদামঘরের কাঠগন্ধী আঁশটে বাতাসে। ভোর হয়ে গেছে এটা দানেশ বুঝতে পারে না, ভাবে আরও কিছুক্ষণ রাত আছে। কিন্তু যখন দেখল, কাঁচা সোনা রাঙা সাপ শরীরী একটা রেখা গুদামের ঘুলঘুলি দিয়ে ঢুকে, ধূসর দেয়ালের ওপর জীবন্ত মোটা পেইন্টের মতো লেগে আছে তখন বুঝতে বাকি থাকে না ভোরতো হয়েছেই, দিনও শুরু হয়ে গেছে। কাঠখড়ির মাঝে থেকে দানেশ তার দেহটাকে টেনে বের করে আনে। যেন একটা সরীসৃপ তার গর্ত থেকে বের হয়ে আসছে। দানেশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। কাঠের মাপ জোক শুরু হয়ে গেছে। রসাল কাঁচা কাঠের ওপর অসংখ্য নীল মাছি ভ্যান্ ভ্যান্ করছে। কাঁচা প্রাণবন্ত গাছের এই অঙ্গগুলো দেখে দানেশের মায়া লাগে। ঘন আঠাগুলো দেখে মনে, হয় এগুলো রক্ত, এগুলো চোখের পানি। গাছের চোখের পানি।
পায়ের ফোঁড়াটা টন টন করছে ব্যথায়। বাইরে এসে দেখল ফোঁড়াটা পেকে পূব দিকের সূর্যটার মতো লাল হয়ে আছে, মুখটা চকচেকে রূপালী। ‘কিরে কেমন নিন্দ হইলো’— বিশ্বাসজীর মুখটা সব সময় হাসিতে ভরে থাকে। যেকোনো সময় যার সঙ্গেই কথা বলুক প্রথমেই হাসির পিচকিরিটা ছুড়ে দেবে, তারপর যতক্ষণ কথা বলবে হাসি হাসি মুখে থাকবে। কোনো সময়ই বিশ্বাসজীর মুখটা গোমড়া দেখেনি দানেশ, সবসময়ই লিপস্টিকের মতো ঠোঁটের সঙ্গে হাসি লেগে থাকে। দাঁতগুলো কালো পাথরের মতো, কথা বলার সময় মুখ হতে সুগন্ধী জর্দার গন্ধ ছুটে। হাসির গমকে মুখ-মণ্ডলের সব থলথলে মাংসনদীতে ডুবে চোখ দুটো হাঁসফাস করে জলে পড়া মানুষের মতো। হাসি থামলেই যেন বাঁচে। শুকনো মুখে দানেশ হাসে বিশ্বাসজীকে দেখে। হাসির সময় তার চিমটে গালের চামড়া বালির উপর পড়া টেউয়ের মতো দেখায় এখানে কোনো রস নাই যেন। কিন্তু চোখ দেখলে বোঝা যায় এ চোখ কত উজ্জ্বল আনন্দময়। দানেশ বলল, ‘মাশাল্লা বিশ্বাসজী জমাটি নিন্দ হেছে একেবারে গেটলক, থামাথামি নাই।’
বাবলার তীক্ষ্ম কাঁটা এনে ফোঁড়া গালতে বসে দানেশ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে। প্যাচপ্যাচ করে গাঢ় পুঁজ বেরিয়ে আসছে, রংটা বাসি মাড়ের মতো। ভারী পঁচা গন্ধ নাকে ঢুকে, দানেশের খারাপ লাগে না। নাকটা বেশি করে উঁচিয়ে, আরও গভীরভাবে গন্ধটা ভেতরে টানে। পুঁজ বের হওয়া শেষ হয়েছে, তারপরেও টিপে চলে দানেশ। পাতলা পানের পিকের মতো রক্ত বের হয়ে আসছে ফোঁড়ার ছোটমুখ দিয়ে। তীক্ষ্ম টনটনে ব্যথাটা আর নেই। আরাম লাগে। আরামটা নেশার মতো মনে হয়। মনে হয়—বারবার ফোঁড়াটা পুঁজে ভরে পটকা মাছের মতো ফুলে উঠুক, প্রচণ্ড টনটনে ব্যথা হোক আর টিপে টিপে পুঁজ বের করার মজাটা পাওয়া যাক। পুঁজ বের হওয়া ফোঁড়াটাকে দেখে চুপসানো বেলুনের মতো লাগে, সেখানে এখন মৃদু ভোঁতা একটা ব্যথা আছে। তারপরেও শরীরটা হালকা লাগে, কোথা হতে বিশাল একটা পাহাড় যেন নেমে গেছে। পায়ের বুড়া আঙুল দিয়ে ছোট গর্ত করে কাঁটাটা সেখানে ফেলে দেয়, মাটি চাপা দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
মুখটা ধুয়ে দানেশ কালামের দোকানে আসে। কালাম দানেশকে দেখে প্রতিদিন ফ্যাস করে হেসে দেয়? সবাইকে দেখেই হাসে। আজো হাসল। দানেশ ভাবে—পৃথিবীর সবকিছুতেই ভ্যাজাল ঢুকে গেছে, খাঁটি কিছু আর নাই। আগে অন্তত কান্না-হাসি ব্যাপারটা নির্ভেজাল ছিল। কালামের সঙ্গে সে তেমন কথা বলে না। লোকটা হাড়ে হাড়ে শয়তান। মাগীখোর । মাঝে মধ্যেই স্টেশন থেকে বেশ্যা এনে, নামোকুঠির মাঠের দিকে যায়। বাড়িতে বউ ছেলে মেয়ে না খেয়ে থাকে। বউটাকে মারধর করে। মেয়েটা বাপ মায়ের বাড়ি গিয়ে যেন বাঁচে। কিন্তু বিবাহিত একটা মেয়েকে কতদিন পুষবে বাপ-ভায়েরা, ঠিকই একদিন রেখে যায় কালামের কাছে। কালাম যেতেও যেমন বাধা দেয় না আসাতেও তাই। বাজারের লোকজন এমন একটা মানুষকে আসলভাবে চিনতে পারে না, হাসিটা ফেরেশতা চিহ্নের মতো কাজ করে। দানেশ গাঁয়ের পথে পথে দিন কাটায়। এ অঞ্চলের সব গাঁয়ের সবার কথায়, ঘটনায় সে সুতা কাঁথার মতো জড়িয়ে আছে। দিনে গাঁ শেষ করে রাতে এসে বিশ্বাসজীর কাঠের গুদামে শুয়ে থাকে। আকাশ ভাবে, পাতাল ভাবে, তারা ভাবে, ঘাস ভাবে। সব ভাবে ঘুম ভাবে।
কালামের হাসিটা তার ভালো লাগে না কোনোদিন, আজও লাগল না, তার পরেও কিছু কিনলে সে এ দোকান হতেই কিনে। যে লাভটা হবে তার এককণাও যদি তার বউয়ের জন্য খরচ হয় এই চিন্তুা করে। একটা পাউরুটি, চিনি গোলা পানিতে গুলে খেতে থাকে আরাম করে আর হিসেব করে, কোনদিক দিয়ে কোথায় যাবে। আজ বুধবার। চকটোলা যেতে হবে। এক গাঁয়ে সপ্তাহে একদিন বা দুই দিনের বেশি গেলে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়— হাঁজি তুমিতো দু’তিন দিন আগ্ই একবার ভিখ লিয়্যা গেল্যা। অবশ্য এ প্রশ্নের মুখে তেমন পড়তে হয় না, তবুও দানেশ সর্তক থাকে, বারগুলো মনে রাখে— আজ চকটোলাবার, কাল নসিপুরবার, পরশু পালশাবার…
গুদামের মধ্য হতে ঝোলাটা বের করে আনে দানেশ। বিশ্বাসজীকেই প্রথমে ধরে প্রতিদিন—‘বিশ্বাসজী দেন, আপনি সাইত করলে সারাদিনটা ভাল চলে।’ বিশ্বাসজী ধবধবে সাদা পাঞ্জাবির পকেটে হাত ভরে যতগুলো খুচরো পয়সা থাকে সবগুলোয় হাসতে হাসতে বের করে দেয়। পাঞ্জাবির মতোই লোকটার দিল ফর্সা। ফর্সা মানুষ, ফর্সা পাঞ্জাবি, ফর্সা লুঙ্গি, পাঞ্জাবির বোতামগুলো শুধু একটু কালচে ধরনের। লোকটাকে দানেশের বেশ ভালই লাগে, গরিব মানুষকে খুব দেখে কিন্তু বিশ্বাসজী পঞ্চাশ টাকা দরের লাকড়ীর সঙ্গে যে বিশ-পঁচিশটাকা দরের লাকড়ি মিশেল দেয়ে এটা দানেশের পছন্দ হয় না। আজো চার-পাঁচটা টাকা ধরিয়ে দিয়ে দানেশের হাতে। দানেশ কালচে বোতাম কয়টা থেকে চোখ টেনে চলে আসে।
দানেশ ঝুলি কাঁধে করে হাঁটে। বাজার আর গ্রামের গন্ধের পার্থক্যটা দানেশ স্পষ্ট বুঝতে পারে। আওয়ালের দোকানের কাছে আসতেই বাজার বাজার গন্ধটা পাতলা হয়ে আসে। বাজার এবং গ্রামের গন্ধের পার্থক্য সবাই বুঝতে পারে, কিন্তু কিছু কিছু গন্ধ সবাই বুঝতে পারে না, যেমন— মানুষের গন্ধ, কথার গন্ধ, হাসির গন্ধ। এগুলো দানেশ মোটামুটি বুঝতে পারে। দানেশের বাপ গন্ধের ব্যাপারে আরও বেশি পারদর্শী ছিল। পরিচিত যে সব দোকানে সে প্রায়ই যেত সেসব দোকানের গন্ধ বুঝতে পারত। দোকানের জিনিসের মধ্যে কিছু না থাকলে বলে দিতে পারত গন্ধ শুঁকে, কোন জিনিস নতুন আনা হলেও বুঝতে পারত অবশ্য নতুন জিনিসটা যে কি তা বুঝতে পারত না। কোনো পাড়ায় ঢুকেই গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারত এ পাড়াতে কতটা লোক বাইরে থেকে এসেছে। এগুলো অবশ্য শোনা কথা, দানেশ ওর বাপকে তেমন মনে করতে পারে না।
বাজারের পূর্বদিকের শেষ প্রান্তের দোকান লতিবের। তার দোকান পার হয়ে দানেশ। গ্রামের পাতলা ফিনফিনে গন্ধটা নাকে এসে লাগে। এ গন্ধটা ভালোই লাগে কিন্তু আজকে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নাই। দানেশ অল্প দ্রুত পায়ে হাঁটছে সে। দিনটা আজ একটু বেশি মেতে উঠেছে। চনচনে রোদ চারদিকে তাঁ তাঁ করছে। দূরে কাশফুলের সাদা যেন সাদা মেঘগুলো জমির বুকে নেমে এসে নদীর পা ছুঁয়ে বাতাসের সঙ্গে খেলায় মেতেছে। এই বারঘরিয়া বাজার, ফিল্ডের হাট, ঘোড়ার স্ট্যান্ড সংলগ্ন গ্রামগুলো পুরোপুরি গ্রাম নয়, শহরের ছোঁয়া আছে। শহরে গ্রাম। হাঁটতে হাঁটতে দানেশ ফিল্ডের হাটের কাছে এসে থামে। তেমাথা মোড়। ডানের সরু রাস্তাটা দিয়ে মহারাজপুর। ও গাঁয়ে কোনোদিন ঢোকে না দানেশ, কারণ ওখানেই মেলা ফকিরের বাস। অথচ বারঘরিয়া বাজার, ঘোড়া স্ট্যান্ড, রানীহাটি অঞ্চলের মধ্যে সব ধনি মানুষের বাস মহারাজপুরে। যেখানে বড়লোক বেশি সেখানে গরিব বেশি কথাটার উদাহরণ—মহারাজপুর। সোজা হাঁটে দানেশ।
পৃথিবীর আদি ঘড়ির দিকে তাকাল দানেশ। ১১টা বাজবে হয়তো। সূর্যটা সরু তীক্ষ্ম আলোর সুতায় পৃথিবীর সবকিছুকে বাঁধতে ব্যস্ত। মানুষ, পশু, গাছ, বাড়ি সবকিছু হাঁসফাঁস করে ঘেমে উঠছে। অস্থির অস্থির ভাব। পৃথিবীটাকে মানুষ বদলে দিচ্ছে। দেদারসে কাটছে গাছ, পশু, মানুষ। মানুষের প্রতি মানুষের বৈরি ভাবটা সবচাইতে কাঁদায় দানেশ ফকিরকে। প্রতিটা মানুষের আকাঙ্ক্ষা একটা সুন্দর মৃত্যু। এই আশাটাও পূর্ণ হয় না মানুষের। দানেশ ভাবে, যারা রক্ত পান করে— শ্বাপদ—যারা রক্ত ঝরায় তাদের চেয়ে অনেক ভালো। মানুষ বৈরি, পৃথিবীও বৈরি। ঘাতক আকাশের দিকে চেয়ে চাতকটা আবার কেঁদে উঠল। কিছুদূর যেতেই দানেশ দেখতে পেল ভ্যানে শুয়ে একটা লোক আসছে। কাতরাচ্ছে লোকটা মরণ যন্ত্রনায়। দানেশ ফকির চিনতে পারে। আশরাফ চেয়ারম্যান এটা। চকলামপুরের চেয়ারম্যান। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কালো পিচের রাস্তায় পানের পিকের মতো রক্তের ছোপ পড়ছে। দানেশ কিছুই বুঝতে পারে না, হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটাকে মোটেও পছন্দ করে না দানেশ, আশরাফ চেয়ারম্যান একটা পয়সাও কোনোদিন ভিক্ষা দেয়নি তাকে। সে নাকি কাউকেই ভিক্ষা দেয় না। ভিক্ষা চাইতে গেলে তেড়ে উঠে—আবে তোরাকে তো আল্লায় দেখতে পারে না, হামি ক্যান কউর্যা দেখব, ভাগ শালা। না জানার কারণে দানেশও একদিন এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে। কিন্তু সে কথা এখন বাদ, লোকটার এ অবস্থা করলো কে। ভিড়ের দঙ্গল ছেড়ে ভ্যানটা দ্রুত সামনে যাওয়ার চেষ্টায় মত্ত। লোকটার জন্য মায়া হয়। দানেশ ভাবে, বুকের মধ্যে মাঝারি সাইজের একটা গাঢ় সবুজ রঙের কচু পাতা আছে, এ পাতার উপর টলটলে বড় এক ফোটা পানি আছে যেটা নিজের ইচ্ছে মতো নাড়া-চড়া করে কষ্ট বা আনন্দ দেয়। কচুপাতা মালিকের এতে হাত নেই। অন্তত আশরাফ চেয়ারম্যানের ব্যাপারে কষ্ট পাওয়াতে এটা মনে হচ্ছে। দানেশ এই ওই লোককে প্রশ্ন করে জানতে পারল— মহসিন চেয়ারম্যানের লোকেরা ইচ্ছে মতো দায়ের কোপ বসিয়েছে তার পায়ে। মহসিন গতবার চেয়ারম্যান ছিল। এই ইউনিয়নে সবসময় ফিলিস্তিন আর ইজরায়েলের মতো যুদ্ধ লেগেই থাকে। নবাবগঞ্জ জেলার সবচাইতে বিপজ্জনক এলাকা হচ্ছে চকলামপুর। সারাবছর ভুটভাট, ফুটফাট করে বোমা ছুড়ে এক পার্টি আর এক পার্টির উপর। মানুষ মানুষের ওপর। কখনো কখনো নিজপার্টির লোককে খুন করে অন্য পার্টির ওপর কেস করে। শোনা কথা—আশরাফ চেয়ারম্যান এক বার নিজের বুড়া বাপকে মারার জন্য পরিকল্পনা করেছিল। পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ায় বুড়া পালিয়ে বেঁচে ছিল। দানেশের মনে হয়, মানুষ কখন কী করে তার কোনো চিত্র নেই, সবই বিচিত্র।
দানেশ ঘোড়াস্ট্যান্ডে বসে চা খায়। ঘোড়াস্ট্যান্ড গাঁজা, মদ, বিশেষ করে ফেন্সিডিলের জন্য বিখ্যাত। নেশার জন্য অত্র অঞ্চলের রাজধানী বলা যেতে পারে। সোজা রাস্তা ছেড়ে বামের পথ ধরে দানেশ। মসৃণ ধুলায় ভরা রাস্তা, ধুলাগুলো বাদাম ভাজা বালি যেন। পা পুড়ে যাচ্ছে। কিছুদূর যেতেই আলমাসের সঙ্গে দেখা। ও ও ভিক্ষুক। দানেশকে দেখেই চালাক চালাক হাসি দিল একটা—দানেশ ভাই এ গাঁয়ে আইজ ঢুকিও না, লাভ হব্যে না। কেনেরে?— দানেশ হাসিটা ফিরিয়ে দিল না। করিম মইর্যা গেছে— দাঁত মেল করে হাসে আলমাস, কাঁধের ঝোলাটা বামদিক থেকে ডান কাঁধে চড়ায়। দানেশ বোকার মতো তাকিয়ে থাকে আলমাসের দিকে। আলমাস আবার বুদ্ধিদীপ্ত হাসি হাসে—বুসতে পাইরল্যানা দানেশ ভাই, হামরাকে তো ভিক্ দ্যায় বেটি বহুরা, মরা বাড়ি আর বিহ্যা বাড়ি পাইলে তো অরঘে ঈদ লাইগ্যা যায়, তাইহ্লে কে ভিক দিবে কহ। অরাতো সব মরা বাড়িতি থাকবে। আলমাস হাসতে হাসতে চালাক চালাক ধাপে হাঁটতে থাকে। দাঁড়িয়ে থাকে দানেশ, মনটা খারাপ হয়ে যায়, আহারে লোকটা মইর্যা গ্যালো। বউটা কি সুন্দর। কানের কাছে ঘোমটা গুঁজে দানেশ কে ভিক্ষা দিতে আসত— ভাইজান একটু দুয়া করিও, উ যেনে ভালো হে যায়। করিম অনেকদিন হতেই অসুখে ভুগছিল। কী যে অসুখ একেবারে বিছানার সঙ্গে সাটপাট, ও বেঁচে থেকে যেমন ছিল মরে গিয়েও তেমন, তারপরেও বউটার জন্য কষ্ট হয়। ছুঁড়িটা কাঁচা চুলে আঁড়ি হলো। কিংবা করিমের বয়সইবা কত। দানেশ ভাবে— শরীরে পোশাক যদি কুটকুটায় তো খুলে ফেললে ভালো হয়ে যায় কিন্তু শরীরের ভেতর রক্ত, দম যদি কুটকুটায় তো জীবন বাঁচে না। করিমের শরীর রক্ত, দমই ওর সঙ্গে বেঈমানি করল। কত বাঁচার চেষ্টা করল বাঁচতে পারল না। মানুষ যত বাঁচার দিকে ছুটে যায় মৃত্যু তত বেশি কাছে আসে, চুমা খায়, হাত ধরে নাচে। দানেশ করিমের বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।
দানেশ শূন্য ভাবলেশহীন চোখে চেয়ে আছে করিমের দিকে। প্রতিটা মানুষের মৃত্যুর পর মুখে একটা বিশেষ ছাপ থাকে, বিরক্তির ছাপ, কান্নার ছাপ, সুখের তৃপ্তির, স্বস্তির। এ ছাপ সবাই পড়তে পারে না। দানেশ পারে। করিমের মুখে স্বস্তির ছাপ। দানেশ ভিতর ভিতর রেগে যায় করিমের ওপর— কিসের স্বস্তি? বউটা লয়্যা দুলে আড়ি হলো তার চিন্তা নাই এ্যাঁ? বেরিয়ে আসে দানেশ।
দানেশ ঠিক করল আজ আর ভিক্ষা করবে না। এলোপাতাড়ি সে হাঁটতে লাগল। সূর্যটা মাথার ওপর চড়ে গেছে। রাস্তার ধুলোগুলো খইয়ের মতো ফুটছে। ছাগল-গরুরা গাছের ছায়ায় বসে অলসভাবে জাবর কাটছে চোখ বুঁজে। দানেশের শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে, তবুও হাঁটছে। দানেশের মনে হয় এ হাঁটার শেষ নাই। খুব ধীরে তপ্ত ধুলোর মধ্যে দিয়ে হাঁটছে। রজব হেঁটে আসছে দৃঢ় পায়ে, চোখ-মুখ দিয়ে খুসি চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। দানেশের সঙ্গে দেখা হতেই দাঁত বের করে হাসে রজব—দানেশ ভাই একটা সুখবর হাঁর ব্যাটা হেছে। খাওয়ার দাওয়ান দিছি, তুমি দুটা খায়্যা হাঁর ব্যাটার লাইগ্যা দুয়া করিও। যেভাবে হাঁটছিল সেভাবেই হেঁটে চলে গেল রজব। গভীর গাঢ় একটা দীর্ঘশ্বাস ছুটে দানেশের— যোগ বিয়োগের খেলা খেলছে ওপরের বুড়া। আর কত খেলবি। খবরটা রজবের জন্য সুখবর, দানেশের জন্যও কিন্তু দানেশের কাছে তখন সুখবরের চেয়ে সুখাবারেরই গুরুত্ব বেশি। কারণ পেটের ভিতরটা এই দুপুরের মতোই জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। তবুও দানেশ আর সেদিকে এগুলো না। করিমের বউয়ের জন্যই মনটা খারাপ আছে। ঘোড়াস্ট্যান্ডে গিয়ে সামান্য কিছু খেয়ে কোনো গাছের নিচে শুয়ে থাকবে দানেশ। আজ ছুটি, সারাদিন ছুটি। গাছের মতো, সবুজ গাছের মতো নরম ছুটি।
দানেশের যখন ঘুম ভাঙল তখন সূর্যটা ডুবে গেছে। পশ্চিমের আকাশের বুকে লাল কাঁচুলী বাঁধা। পৃথিবীর এই রাতটা লজ্জামুখী মনে হচ্ছে কিন্তু গরমের চাপে ভাবটা বেশিক্ষণ থাকে না। একটুও বাতাস বইছে না। পৃথিবীর প্রতি কোনো অনুভূতি নাই এমনভাবে উঠে বসল দানেশ। বসেই থাকে কিছুক্ষণ। ক্ষুধাটা আবার চাড়া দিয়ে ওঠে। পুটলিটা কাঁধে চড়িয়ে হাঁটতে থাকে দানেশ। পায়ের ফোঁড়াটা আবার ফুলে উঠেছে। বিচিটা বের করে না ফেললে ভালো হবে না। টন টন করে উঠছে মাঝে মধ্যেই। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করে না। দানেশ হাঁটে। মনের প্রতি কোণায় কোণায়, কণায় কণায় অবসাদ পূর্ণ। তবুও হাঁটে। এসব ব্যথা নিজের জন্য নয়, পৃথিবীর সব মানুষ, সব গাছ, সব পশুর জন্য। পৃথিবীর মানুষগুলো নিজকে নিয়েই ব্যস্ত আছে। পৃথিবীর মানুষেরা আরও একটু ভালো হলে কী এমন ক্ষতি হতো? বুকের ব্যথা বাড়ে পায়ের ব্যথার কথা মনে থাকে তার।
বারঘরিয়া পৌঁছে দানেশ দেখল— প্রায় সব দোকান বন্ধ। কাঠের গুদামটা বন্ধ করে দিয়েছে যেখানে সে রাত্রে শুয়ে থাকে। দানেশের চোখ জ্বালা করছে, বুকটা ভাঙছে— তারা একবারও ভাবেনি দানেশ কোথায় ঘুমুবে। দিলেশের চালের দোকানটা খোলা আছে, এখুনি লাগিয়ে দেবে। টাকা গুনছে দিলেশ খুব আয়েশ করে। টাকার জন্য মানুষ কত কিই না করে। এই দিলেশও ভাল চাল, খারাপ চাল মিশেল করে। পাথর মেশাতে দ্বিধা করে না।
দানেশ মনিমুলের দোকানের বারান্দায় এসে বসে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর পুটলিটা মাথার তলে দিয়ে শুয়ে পড়ে। খিদেটা মোচড় দেয়, ঘুম আসে না। মশা মশায়েরা কানের কাছে এসে গান শোনায়, দানেশ মাথা এপাশ ওপাশ করে, হুল ফোটালে নিজের ওপরই চড় থাপড় মারে। একটা মশা মারা পড়লে মনে শান্তি লাগে, কেমন একটা আনন্দের ঢেউ খেলে যায় বুকের মধ্যে। চোখ বন্ধ করে ঘুমুতে চেষ্টা করে দানেশ। ঘুম আসে না। সারা দিনটা, সারা দিনের ঘটনা, সারাদিনে দেখা মানুষের চেহারা মনে আসে। চামেলির কথা মনে পড়ছে। ও গাঁয়ে ভিক্ষা করে না। ব্রিজের ফুটপাতে বসে থেকে চায়। হাঁটু পর্যন্ত পা নেই একটা। দানেশের সঙ্গে একটু ভাব আছে। একদিন চামেলীকে দানেশ বিয়ের কথা বলেছিল। চামেলির মুখটা বিষণ্ন হয়ে যায়, পূর্ব স্বামীর কথা মনে হতে হতে ঘৃণা ঝরে। দানেশ এই ভাব দেখে চমকে ওঠে। চামেলি এবার হাসি হাসি মুখ করে বলে— বিহ্যার কথা আর কই্হোনা হামাকে দানেশ ভাই। ঘিন্ন্যা হয়। তোমার যুতি দরকার হয় মাঝে সাঝে রাইত্যে চলাইসব্য বুঢ়ি মা কিছু বুসতে পারবে না। দানেশ আশ্চর্য হয়ে যায় ঘৃণায় মুখটা কুঁচকে ফেলে—বেশরা কাম করব! কুনুদিনই লয়। তুই কী ব্যব্সা পাইত্যাছিস? এই কথা শুনে চামেলি স্তম্ভিত হয়ে যায়—ছিঃ দানেশ ভাই তুমি এট্যা কইহতে পাইরল্যা! তাইহ্লে তুই হাঁকে ডাকলি কেনে? দাঁত কিড়মিড় করে দানেশ। চামেলি ঠোঁটের সঙ্গে লেগে থাকা হাসি হাসে—দানেশ ভাই, তুমি লোকটা খুব ভাল তোমাকে হামি পসন করি। আর ভালোবাসার মানুষে মাঝে মধ্যে রাইতে আসলে কী আর হব্যে? দানেশ রাগ করে চলে আসে। মনটা খারাপ হয়ে থাকে। আজ চামেলির জন্য কষ্ট হচ্ছে। স্বামীটা ছেড়ে চলে গেছে। বুড়ি মাকে নিয়ে একলা থাকে। রাস্তায় ভিক্ষা করে। আহারে কার ভাগ্যের কোথায় গন্তব্য! দানেশের মাথাটা ঝিম ঝিম করে ওঠে। মাথার মধ্যে চিন্তার চাপ আর সহ্য করতে পারে না।
সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে চামেলির শরীর চিন্তা করতে লাগল। নাক, চোখ, চুল, বুক, পেট, নাভী, নাভীর নিচ, নাভীর নিচের নিচ, পুরো শরীরটা নিয়ে সে নাড়া চাড়া করতে লাগল। ভিতর ভিতর উত্তেজিত হয়ে উঠছে। যৌনিক উত্তেজনা। শরীর কাঁপছে। ক্ষিধের জন্য পেটের মধ্যে যে মোচড় দিচ্ছিল তা আর নেই। দানেশ ফকীর ভাবে— যৌন ক্ষুধা এলে কি পেটের ক্ষিধা মিটে যায়? তবে উত্তেজনা টুকু থাক, চামেলীর কাছে গিয়ে উত্তেজান টুকু নষ্ট করা যাবে না। কিন্তু দানেশ উঠে হাঁটতে লাগল। এ রাস্তা দিয়ে অনেক জায়গাতেই যাওয়া যায়, মসজিদ, চামেলির বাড়ি, নদী, নামো কুঠির মাঠ, গোরস্থান…