মাত্র আগে, ঘুমের ভেতর বিকট চিৎকার করেছিলাম। একজন মানুষের হৃদপিণ্ডে ছোরা বিদ্ধ করলে মানুষটি যে স্বরে এবং যে মাত্রার চিৎকার করতে পারে, আমার চিৎকারটি ছিল সে স্বর এবং সে মাত্রার। আমার চিৎকারটা দেয়ালে টক্কর লেগে ফিরে এসে আমার কানে ঢুকেছে। আমার চিৎকার আমাকে ধাক্কা দিয়েছে। ফলে বুকে অস্থির ধড়ফড়ানি নিয়ে জেগে উঠেছি আমি। ঘুমের ভেতর দেওয়া চিৎকারের প্রতিধ্বনির অনুরণন, জাগার পরেও শোনা গেছে কয়েক মুহূর্ত। এখনো বুক ধক ধক করছে। এতক্ষণে শব্দমাধ্যমে টিভির অস্তিত্ব আমার কানে ঢুকল। টিভি এখনো চালু আছে। লো ভলিউমে চলছে।
আমি ঘুম থেকে জেগেছি একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে এবং স্বপ্নের ভেতর বিকট চিৎকার করে। টিভিটার দিকে চোখ দুটো সম্ভবত তাকানোর ইচ্ছা করল এবং আমি টিভির দিকে তাকালাম। সিনেমা চলছে। খুব পরিচিত ইংরেজি সিনেমা। সিনেমাটি এর আগেও কয়েকবার দেখেছি। রাতে সিনেমাটি শুরু হওয়ার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যখন টিভি দেখছিলাম তখন সিনেমা চলছিল না, অন্য কোনো অনুষ্ঠান হচ্ছিল। দেখলাম, সিনেমাটির অনেকখানি এগিয়ে গেছে। এখন দেখাচ্ছে—সিনেমার প্রধান চরিত্র এবং পার্শ্বচরিত্রগুলো লাঠি, চাকু, বোমা, পিস্তল নিয়ে অজস্র সাপের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সাপগুলো হত্যা করা শেষ হতেই কয়েকটা বাঘ বেরিয়ে এলো। তাদের সঙ্গেও যুদ্ধ হলো। বাঘ কটা পরাস্ত হয়ে পড়ে রইল কাটা গাছপালার স্তূপিকৃত ডালপালার ভেতর। পরাস্ত পিঁপড়ারা মৃত পড়ে আছে তাদের ডিমের ওপর। মৃত খরগোশেরা বিনা যুদ্ধে পড়ে থাকল, বিনা যুদ্ধে হেরে যাওয়া কচ্ছপের পেছনে। মৃত হরিণেরা, নিরীহ-অনিরীহ সরীসৃপেরা, পোকামাকড়েরা পড়ে আছে প্রাণের বাইরে। টিভি বন্ধ করে দিলাম। সিনেমার পুরো কাহিনি আমার মুখস্ত। একটা রেলকোম্পানি বিশাল এক বনের ভেতর দিয়ে রেললাইন বসিয়েছিল, সেই রেললাইন বসানোর চ্যালেঞ্জিং দুবছরের দৃশ্যসংক্ষেপ এ সিনেমা। বনের ভেতর দিয়ে লাইন বসানো এবং ইস্টিশান বানানোর জন্য জঙ্গলের গাছ কাটতে গিয়ে বহুবিপদের মধ্যে পড়ে টিমটি। তারা সব বিপদ এক এক করে মোকাবিলা করে। রেললাইন বসে, রেল স্টেশন বসে জঙ্গল উচ্ছেদ করে। সিনেমার শেষ দৃশ্যে একটা চলন্ত ট্রেন দেখা যায়। ট্রেনটা চলে বেশ গতিমাখা শব্দ তুলে, অজস্র ধোঁয়া উদ্গীরণ করতে করতে। ধোঁয়া উড়ে মানবজাতির জাতীয় পতাকার মতো।
এরপর মনু কিশোর বানরের খাঁচার সামনে এসে দাঁড়ালো। বানরেরা খাঁচার ভেতর হুটোপুটি করছে। মানুষের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটছে। মানুষের ভেতর থেকে কেউ বাদাম দিচ্ছে, কেউ খোঁচা দিচ্ছে, কেউ কাগজ পাকিয়ে ঢিল দিচ্ছে।
ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছি আমি। স্বপ্নের ভেতরে খুব জোরে চিৎকার করেছিলাম। স্বপ্ন দেখার পরের অস্থিরতা এখনো কাটছে না। অস্থিরতাকে কেটে ফেলার জন্য একবার বড় শ্বাসের চাকু বের করি, একবার বের করি ছোট শ্বাসের চাকু। এভাবে শ্বাসের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-বেধ প্রভৃতি জ্যামিতি কম বেশি করে খুব বেশি লাভ হচ্ছে না। অস্থিরতা কমছে না। তবে বুকের ধড়ফড়ানি একটু কমেছে। পিপাসা পেয়েছে। পানি পান করে, বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে রইলাম চুপচাপ। ঘরের দুকোণে দুটি কয়েল জ্বলছে। এই সময়টাতে ঘরে প্রচুর মশা এসে হাজির হয়। আমবাগানের সব গাছে মুকুল দেখা দিয়েছে। বাগানে প্রচুর বিষ দেওয়া হয়েছে পোকা মারার জন্য। ফলে মশারা মানুষের বাসাতে বেশি করে ভীড় জমিয়েছে। একটা কয়েলে তেমন কিছু হয় না, দুটো জ্বালাতে হয়। রাত কটা বাজে দেখার জন্য বালিশের তলায় হাত দিয়ে ঘড়ি খুঁজে বের করলাম। ঘড়ি দেখলাম। মধ্যরাত এখন। বালিশের পাশে খোলা অবস্থায় একটা বই দেখা গেল। মনে পড়ল, রাতে টিভির বাজে টাইপ কোনো একটা অনুষ্ঠান দেখার ফাঁকে ফাঁকে বইটা পড়ছিলাম এবং পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এই ঘুমের ভেতরেই শুরু হয়েছিল আমার ওপর দুঃস্বপ্নের উল্লাস। স্বপ্নটা হয়ে উঠেছিল বুকের ভেতর নটরাজ, ভয়ঙ্কর ভৃগু।
মানুষের পা যেমনভাবে গভীর ঘন কাদার ভেতর আটকে যায়, যেমনভাবে এক পা তুলতে গেলে আর এক পা কাদার মধ্যে ঢুকে যায়, তেমনভাবে স্বপ্নটির পা আমার মাথার মগজকাদায় আঁটকে গেছে। স্বপ্নপোকাটিকে মাথা থেকে বের করতে পারছি না। থেকে থেকে বুকটা গুড়গুড় করে উঠছে। একটু আনমনা হওয়ার জন্য বইটা হাতে নিলাম। কিশোরতোষ বই। যে পাতাটা বের করা ছিল সেখান থেকে পড়া শুরু করলাম, লেখা আছে—…এরপর মনু কিশোর বানরের খাঁচার সামনে এসে দাঁড়ালো। বানরেরা খাঁচার ভেতর হুটোপুটি করছে। মানুষের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটছে। মানুষের ভেতর থেকে কেউ বাদাম দিচ্ছে, কেউ খোঁচা দিচ্ছে, কেউ কাগজ পাকিয়ে ঢিল দিচ্ছে। কোনো কোনো বানর বসে বসে ঢুলছে—এখানে এসে আমার পড়া থামল। মনে হলো, বইয়ের এ ঢুলন্ত বানর কি স্বপ্ন দেখছে কোনো? এখানে বন্দি হওয়ার দিনটিকে বা বনের ভেতর মুক্ত থাকার শেষ দিনটিকে? অথবা সে কি স্বপ্নে দেখছে, তার পরিচিত বানরদের, যাদের সঙ্গে বনের ভেতর খেলে বেড়িয়েছে? সে কি স্বপ্ন দেখছে সুন্দর সবুজ আবাস সেই বনভূমিকে, যেখানে সে ছিল? উদিত এ সব প্রশ্নের কারণে আমি অস্থিরতা অনুভব করছি। অস্থিরতা থেকে বের হওয়ার জন্য আবার বইয়ের ভেতর ঢুকলাম। মনু কিশোর এবার বাঘের খাঁচার সামনে এসে দাঁড়াল। বাঘটা ঝিমুচ্ছে, তার পাশে কয়েক টুকরো সাদা মাংস পড়ে আছে। নীলমাছিরা গানের আসর বসিয়েছে গরু বা খাসির সাদা মাংসের ওপর। মাছি বসে আছে বাঘের ভাগের মাংসে, ভোগের মাংসে। বইয়ের এ পর্যায়ে এসে আবার বইচ্যুত হলাম। যে মাছিগুলো বাঘটার পাশে পড়ে থাকা মাংসে বসে আছে আর ভনভন করছে, সে মাছিগুলো আমার চিন্তাকে এটাক্ করল—মাছিও তো জীব। কেউ কি চিড়িয়াখানাতে গিয়ে মাছি দেখে? অথবা মাছিগুলো কি বন্দি? মাছিগুলোকে কেউ যদি ঢিল দেয়, তবে বোঝা যাবে তারা খাঁচা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে কি না। আমি লোভীর মতো বইটির দিকে তাকালাম এই ভেবে যে, দেখি, মনুকিশোর মাছিগুলোকে ঢিল দিচ্ছে কি না, মাছির স্বাধীনতা পরীক্ষা করার জন্য। কিন্তু আমি হতাশ হই। মনুকিশোর ঢিল না দিয়ে এগিয়ে গেল পাখির খাঁচার দিকে। শত শত পাখি খাঁচার ভেতর কিচির মিচির করছে। কোনো কোনো পাখি খাঁচার দেয়ালে এসে ঠোকর মারছে। মনুকিশোর পাশের খাঁচায় একটা নিঃসঙ্গ শকুনকে দেখতে পেল। শকুনটি খাঁচার ভেতর বসে বসে ঢুলছে। মাঝে মাঝে চমকে উঠছে আর গলাটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে নিয়ে আবার ঢুলছে। আমার মনে হলো—শকুনটি কি কোনো স্বপ্ন দেখছে? সে কি ভয়ঙ্কর কোনো স্বপ্ন দেখছে আর চমকে উঠছে? ঢুলন্ত শকুনের কথা পড়ে, আমি ফের আমার দেখা স্বপ্নের ভেতর পড়ে গেলাম। আমি আমার ওপর চরম বিরক্ত, একটা স্বপ্ন এত প্রভাব ফেলছে বলে। বইটা আমার কাছে বিরক্তিকর এবং ভীতিকর হয়ে উঠল। আমি চিড়িয়াখানা ভ্রমণ সংক্রান্ত বইটি ছুঁড়ে ফেললাম ঘরের এক কোণে। শক্ত হওয়ার চেষ্টায় নিজেকে ভেতর থেকে একটা ধমক দিলাম—ঠিক আছে স্বপ্নটা খারাপ তাই বলে এটা নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কিন্তু এসব ধমকাধুমকিতে স্বপ্ন আর মনের যে ঘিঞ্জি প্যাঁচ লেগে গেছে তা ছুটছে না। আমি ঘুমাতে গেলাম আলো নিভিয়ে। ঘুম আসার রাস্তাতে ব্যারিকেডের মতো সন্দেহ তার দেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল—আবার যদি ওই স্বপ্নটা চলে আসে!
সুতরাং বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। বাকি রাত জেগে থাকব পাঠাগারে। আমার বাসার বাইরে একটু ফাঁকা জায়গা ছিল। সেখানে পাঠাগারটি কিছুদিন আগে তৈরি করে নিয়েছি। পাঠাগার মূল বাসার সঙ্গে সংশ্রবহীন। এখানে দুতিনটা আলমারিতে কিছু বই আছে। কয়েকটা পেপার রাখি। গ্রামের ছেলেমেয়েরা এসে যেন পড়তে পারে, তাই এই ব্যবস্থা করেছি। সবার জন্য উন্মুক্ত। পাঠঘরের মাঝখানে লম্বা টেবিল। একসঙ্গে আট দশজন বসে পড়তে পারবে। আমি পাঠাগারে ঢুকলাম। পাঠাগারে ঢুকে আলো জ্বালানো মাত্র পড়ার টেবিল থেকে কয়েকটা তেলাপোকা উড়ে গেল। তেলাপোকারা কি বই পড়ছিল অন্ধকারের ভেতর? পৃথিবী নিয়ে মানুষের আর কী কী নীলনক্সা আছে তারা তা বই পড়ে পড়ে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছিল কি? তারা কি ঘুমিয়ে নিচ্ছিল? তারা কি ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখছিল? এতক্ষণ ভুলে ছিলাম স্বপ্নের কথা। আবার মনে পড়ে গেল। গা টা ছম ছম করে উঠল। মনে হচ্ছে, এখনই আমি হত্যা হয়ে যাব। এই নির্জন পাঠরুম আমার রক্তে ভেসে যাচ্ছে—এমন দৃশ্যচিত্র আঁকছে আমার মন। আমি কি হত্যা হতে চলেছি? খুনি তো আমার সঙ্গেই আছে। এখনই কি আমাকে ধরে ফেলবে? আমি কাঁপতে শুরু করলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে, আমি এত বোকা কেন? কেন এত বিচলিত হচ্ছি একটা স্বপ্নকে কেন্দ্র করে? এ সময়, ফট্ করে একটা টিকটিকি পড়ল টেবিলের ওপর। কেন পড়ে গেল টিকটিকিটা? অদ্ভূত এই প্রাণীটা! সিলিং দিয়ে, দেয়াল দিয়ে কিভাবে দৌড়ে বেড়ায়, হেঁটে বেড়ায়, শিকার ধরে, বিশ্রাম করে কিন্তু পড়ে যায় না! তবে কি ঘুমিয়ে গেছিল টিকটিকিটা? সিলিংয়ে ঘুমিয়ে গেলে কি টিকটিকি পড়ে যায়? অথবা ঘুমিয়ে গেলে হয়তো পড়ে না কিন্তু ঘুমিয়ে গিয়ে স্বপ্ন দেখলে হয়তো পড়ে। এ টিকটিকিটা কি স্বপ্ন দেখছিল? কী স্বপ্ন দেখছিল?
পাঠাগারের দরজা অর্ধেক খোলা। জানালায় কে যেন টোকা দিল। আমি একটু সাহস পেলাম। হয়তো হত্যা হব না আমি। আমি জানালার দিকে তাকালাম। জানালাটা খোলা নেই, বন্ধ। জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম। জানালার পাল্লা খুলতেই বীভৎস একটা দৃশ্য আমার দিকে তাকাল। বীভৎস দৃশ্যটা কঁকিয়ে উঠল আমার ভেতর। সারা শরীরে বরফ প্রবাহিত হলো। জানালার খাঁজে একটা টিকটিকি চ্যাপ্টা হয়ে লেগে আছে। মৃত টিকটিকির একটা চোখ গলে গেছে আর একটা চোখ বিস্ফারিত। আমার পা কেঁপে উঠল। এই টিকটিকির হত্যাকারী কোনো এক পাঠক, যে জানালা বন্ধ করে সব শেষে বেরিয়ে গেছে। জানালার খাঁজে চিপে নির্মমভাবে একটা প্রাণ যে চলে গেছে, সেটা সে খেয়ালই করেনি। টিকটিকিটা কেন পালিয়ে যায়নি? মানুষের তাড়াহুড়োর কাছে সে পরাজিত হয়েছে? মানুষের অন্যমনস্কতার কাছে সে পরাজিত হয়েছে? যে টিকটিকিটা কিছুক্ষণ আগে সিলিং থেকে পড়ে গেল টেবিলে, সে কি এই মৃত টিকটিকির কেউ? মৃত টিকটিকিটা মৃত হওয়ার আগে, জানালার কপাটের খাঁজে, ঘুমের ভাঁজে কি কোনো স্বপ্ন দেখছিল? সে কি কোনো স্বপ্ন দেখছিল সে সময়টাতে, যখন জানালার খাঁজে তার দেহমন প্রেম নিয়ে চিপে যাচ্ছিল, চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছিল? একটা লাল পিঁপড়ার সারি পুরো রুমের মেঝেকে দ্বিখণ্ডিত করেছে। পিঁপড়াদের এ ভ্রমণ সে টিকটিকির শরীরের দিকে, যে টিকটিকির শ্বাস চ্যাপ্টা হয়ে গেছে জানালার কপাটের খাঁজে।
যদি তুমি পাপ করো, তবে ক্ষমা পাওয়ার জন্য একটা পশু বলি দিও। যদি তুমি পুণ্য করতে চাও, পশু বলি দাও। যদি তোমার ধন সম্পদ আর পশুর সংখ্যা বাড়াতে চাও তুমি পশু বলি দাও। বইটা বন্ধ করে উঠতে যাব এমন সময় টেবিলের ওপর থাকা একটা পেপার ওয়েটের দিকে চোখ গেল।
আমি টেবিলের কাছে ফিরে এলাম। দেখলাম, টেবিলে একটা বই খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। আমি মনে করতে পারছি না, যখন এই রুমে ঢুকি তখন এই বইটা খোলা ছিল কি না। হয়তো, বইটা কেউ একজন পড়ছিল, পড়ার সময় শেষ হলে খোলা রেখেই চলে গেছে। আমি মনে করার চেষ্টা করি, যখন পাঠাগারে ঢুকি তখন বইটি খোলা ছিল কি না। বই খোলা ছিল? বই খোলা ছিল না? বই খোলা ছিল? বই খোলা ছিল না? প্রশ্ন দুটি হাজার অভিঘাত দিতে থাকে আমার মগজে। কোনো সিদ্ধান্তে স্থির হতে পারছি না। পুনরায় স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেল। আমি মাথা ধরে বসে পড়লাম চেয়ারে। আমি কি হত্যা হতে চলেছি? জানালায় টোকা দিয়েছিল বলে যা মনে হয়েছিল, তা ভুল। কেউ টোকা দেয়নি। সুতরাং আমি খুন হব না—এ আশা চলে গেছে। আমার খুনি আমার সঙ্গেই আছে। আমি যখন মৃত টিকটিকি দেখছিলাম, তখন খুনিই কি বই খুলে পড়ছিল? ভীতিমাখা চোখ নিয়ে বইটি পড়তে শুরু করলাম। যে পৃষ্ঠা থেকে খোলা আছে সে পৃষ্ঠা থেকে পড়া শুরু করেছি। কিছুদূর মাত্র পড়ে রেখে দিলাম। এটা একটা ধর্মগ্রন্থ। আগেও পড়েছি। যে পরিচ্ছেদটা খোলা আছে তার মর্ম হলো—যদি তুমি পাপ করো, তবে ক্ষমা পাওয়ার জন্য একটা পশু বলি দিও। যদি তুমি পুণ্য করতে চাও, পশু বলি দাও। যদি তোমার ধন সম্পদ আর পশুর সংখ্যা বাড়াতে চাও তুমি পশু বলি দাও। বইটা বন্ধ করে উঠতে যাব এমন সময় টেবিলের ওপর থাকা একটা পেপার ওয়েটের দিকে চোখ গেল। হাতির দাঁতের তৈরি। বিদেশে থাকা এক বন্ধু উপহার দিয়েছিল আমাকে। আর দিয়েছিল একটা হরিণের মুণ্ড। হরিণের শিংসহ মুণ্ডটা পাঠাগারেই টাঙ্গানো আছে। চোখদুটির জায়গাতে ফুটো। নাকের কাছে ফুটো। আমি গুলিবিদ্ধ হরিণটাকে কল্পনায় দেখতে পেলাম—হরিণের একটা চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছে, আর একটা চোখে অশ্রু ঝরে পড়ছে। নাক দিয়ে শ্বাস আর রক্ত একসঙ্গে পড়ছে। বুলেট বিদ্ধ শরীর নিয়ে ছুটোছুটি করছে। হরিণটা কি মারা যাওয়ার সময় ঘাস খাচ্ছিল? বা বাচ্চাকে দুধ দিচ্ছিল? অথবা ঘুমিয়েছিল আর স্বপ্ন দেখছিল কোনো? কী স্বপ্ন দেখছিল? আমি আমার কাছেই খুব অসহায় হয়ে পড়ি। আবার নিজের ভয়ঙ্কর স্বপ্নের গর্তে পড়ে যাই। স্বপ্নে যে খুনিকে দেখেছি, সে খুনি আমার সঙ্গেই আছে এখন। আমি অসহায়ের মতো কেঁদে উঠি ফুঁপরে। আমার ফোঁপরানো শুনে আমার খুনি হেসে উঠল। চাপা হাসি। ধীর বিষের মতো হাসি।
সকালে যখন আমার দ্বিতীয় দফার ঘুমের চোয়াল ভাঙলো তখন অনেক বেলা হয়ে গেছে। পাঠাগারের টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পাঠাগারের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই মনে পড়ল আজ ঈদের দিন। পাপ দূর করতে আর পুণ্য অর্জন করতে লোকজন কোরবানি করবে। কোরবানির পশুগুলোকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বধ্যভূমির দিকে। আমি পাঠাগারের বুকশেলফ থেকে একটা বই টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম ‘বিজ্ঞানের জয়’। বিজ্ঞানের জয় মানে কার জয়? আমি চিন্তা করলাম। আমার মনে হলো, বিজ্ঞানের জয় মানে, মানুষের জয়, আর কারও নয়। মানুষ ছাড়া সকলেরই পরাজয়। পরাজয় বৃক্ষের, নদীর, পাহাড়ের, বনের আর বনবাসীদের। মানুষ ছাড়া আর কারও এ পৃথিবী নয়? আমি চিন্তা করলাম। আমার স্বপ্নের কথা মনে পড়ল, এই ভোরবেলাতেও। আমি বেঁচে আছি। স্বপ্নের খুনির হাতে মরিনি বলে ভালো লাগছে। আমার ঠোঁটের কোণ দিয়ে একটু হাসি গড়িয়ে পড়ল বিজ্ঞানের, ধর্মের, ইতিহাসের, অর্থনীতির, রাষ্ট্রনীতির বইয়ের ওপর।
গতরাতে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম
ঘুমের ভেতর স্বপ্নে দেখছিলাম যে—কাজ শেষ করে ঘুমাতে যাচ্ছি কিন্তু যতই বিছানার দিকে যাচ্ছি ততই বিছানাটা দূরে সরে যাচ্ছে। এক সময় বিছানাটাকে ধরতে পারি আর শুয়েও পড়ি। ঘুমানোর চেষ্টা করছি, ঘুম আসছে না। চোখ বন্ধ করে এপাশ-ওপাশ করছি। রাত গভীর হয়ে গেছে। চারদিকে বোবা নিঃস্তব্ধতা। এমন সময় আমার মাথায় কে যেন টোকা দিল। চমকে উঠলাম আর চোখ খুলে তাকাতেই কালো মুখোশে মুখ ঢাকা একজনকে দেখতে পেলাম। শরীরের ভেতর দিয়ে বরফনদী বয়ে গেল। হৃদপিণ্ডটা ধড়াস ধড়াস করে উঠানামা করছে। লোকটা একটা বিশাল ছুরি আমার বুকে ঢুকাতে এলো। আমি চট করে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। লোকটা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। আমি দরজা খুঁজে পাচ্ছি না। যেখানেই হাত দিই, নির্মম দেয়াল। যে দেয়ালে দরজা খুঁজছি সে দেয়ালে কি তবে দরজা নেই? ভুল জায়গাতে কি দরজা খুঁজছি আমি? একটা দারুণ সন্দেহের দেহে ঢুকে পড়ি। হাতড়ে হাতড়ে দরজা খুঁজেই চলেছি পাগল হয়ে। এদিকেই তো দরজা ছিল, এদিকেই তো দরজা থাকে প্রতিদিন, এদিকেই তো দরজা থাকার কথা। তাহলে আজ কী হলো? দরজা কি অন্য কোনো দেওয়ালে চলে গেছে? আমার দরজা আমার সঙ্গেই লুকোচুরি খেলছে! লোকটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। দরজা খুঁজতে খুঁজতেই তাকে প্রশ্ন করি — ‘আমাকে কেন হত্যা করতে চাইছ তুমি?’ লোকটা এ প্রশ্ন শুনে মুচকি হেসে উঠল মুখোশের ভেতর। হাসিটা সে তার চোখে ঝুলিয়ে রেখেছে। কোনো শব্দ না করে, কোনো কথা না বলে ছুরিটা বাগিয়ে রোবটের মতো এগিয়ে আসছে। তার এগিয়ে আসার গতি ধীর কিন্তু নির্দিষ্ট, একগুঁয়েমিপূর্ণ। খুনি কাছাকাছি আসতেই অন্য একটা দেয়ালের দিকে পালিয়ে গেলাম। দরজা খুঁজতে শুরু করি এ দেয়ালে। এ দেয়ালেও দরজা পাই না। খুব তাড়াহুড়ো করি দরজা খুঁজে পাওয়ার জন্য। পাই না। সারা গা ঘামে ভিজে গেছে। লোকটা তার গতিমুখ চেঞ্জ করে আবার আমার দিকে গতিমুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
আমি বেঁচে থাকতে চাই। আমিতো কোনো অন্যায় করিনি। আমি খুব নিরীহ। কেন আমাকে হত্যা করছ? না! তোমার পায়ে পড়ি, তুমি আমাকে মেরো না!
এই দ্বিতীয় দেয়ালে দরজা খুঁজি আঁতিপাতি করে আর তাকে চিৎকার করে প্রশ্ন করি— ‘কে তুমি?’ লোকটা কোনো কথা বলে না। এ প্রশ্ন শুনে তার চোখ দিয়ে আগুন ঝরতে শুরু করেছে। সে রাগান্বিত চোখ আর রাগান্বিত ধারালো ছুরি নিয়ে আমার দিকে তেড়ে এলো। আমি তাকে বার বার অনুরোধ করি— ‘আমাকে হত্যা করো না।’ তার পা ধরে ক্ষমা চাই, আমার না জানা অপরাধের। তারপরেও ছুরি চালায় খুনি আমার শরীরে, ছুরিটা আমার বুকে না ঢুকে পেটে ঢুকে যায়। আমি বসে পড়ি, লোকটা এবার আমার মাথাতেই ছুরি চালাতে উদ্যত হয়। আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরে যায়। বের হয়ে যাওয়ার জন্য অন্য একটা দেয়ালের দিকে যায়। তৃতীয় দেয়ালটিতে দরজা খুঁজি, বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। বেরিয়ে যেতে পারলে বাঁচা যাবে এখনো। এ দেয়ালেও কোনো দরজা নেই। দরজা খুঁজে পাচ্ছি না। কেন দরজা খুঁজে পাচ্ছি না তা বুঝতে পারছি না। হতাশায় আর প্রাণ ভয়ে কেঁপে উঠি, কেঁদে উঠি। আমি আবার হাতজোড় করে লোকটার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাই— ‘আমি বেঁচে থাকতে চাই। আমিতো কোনো অন্যায় করিনি। আমি খুব নিরীহ। কেন আমাকে হত্যা করছ? না! তোমার পায়ে পড়ি, তুমি আমাকে মেরো না!’ কিন্তু লোকটা কোনো কথা শোনে না, কোনো কথা বলে না। আবার ছুরি মারল। ছুরি ঢুকল আমার বুকের ডানদিকে। আঘাতটা তেমন মারাত্মক নয়। তাকে আবার ধাক্কা দিয়ে সরে যাই। বুকটা চেপে ধরে দরজা খুঁজি অন্য দেয়ালে। এই দেয়ালই শেষ দেয়াল। এ দেয়াল চতুর্থ দেয়াল। এই দেয়ালেও যদি দরজা খুঁজে না পাই তবে আর কোনো সম্ভাবনা নেই গোঁয়ার লোকটার হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার। ঘরের মেঝে সিমেন্টে ঢালাই করা, ছাদও নিদারুণ হয়ে ধরা পড়ল আমার চোখে। জানালা আর ঘুলঘুলিগুলোও যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে, দেয়াল হয়ে গেছে। লোকটা যেভাবে এগিয়ে আসছে আমার দিকে তাতে বুঝতে এতটুকুও সন্দেহ নেই, এক্ষুনি আমাকে আজ হত্যা করবেই এবং এও বুঝতে পারছি, এখন যে দেয়ালে আমি দরজা খুঁজছি সেখানেও দরজা নেই, থাকলে লোকটা দ্রুত এসে আমার পথ রোধ করার চেষ্টা করত।
সে এগিয়ে আসছে, আমি দরজা খুঁজে পাচ্ছি না। সে এসে আবার আঘাত করার জন্য ছুরি বাগিয়ে ধরল। আমি দরজা খোঁজা বাদ দিয়ে ইট সিমেন্টের প্রাচীরে দরজা খোঁড়ার চেষ্টা শুরু করি। নখ ক্ষয়ে, আঙুল ক্ষয়ে রক্ত বেরিয়ে গেলেও ইট, সিমেন্ট, লোহার দেয়ালে এতটুকু আঁচড় বসাতে পারি না। ক্লান্ত হয়ে পড়ি, ব্যর্থ হয়ে পড়ি। আর কোনোদিকে পালানোর চেষ্টা করলাম না। তার দিকে তাকিয়ে বললাম— ‘আমি কি হত্যা হওয়ার আগে আমার হত্যাকারীর মুখটা একবার দেখতে পারি?’ লোকটা আমার হৃদপিণ্ডের ভেতর ছোরাটা বসিয়ে দেওয়ার পর একটানে তার মুখ থেকে মুখোশটা সরিয়ে নিল। ছোরার আঘাতে নয়, লোকটার মুখোশহীন মুখ দেখে প্রাণের সর্বোচ্চমাত্রার শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠি। মুখোশটা সরানো মাত্র দেখি—খুনির মুখ আমারই মুখ!