এক.
দত্তপুকুর লোকাল ট্রেন, প্রতিদিন ছুটে চলে শিয়ালদাহ থেকে বনগাঁ জংশন। ১৫/১৬টা বগি নিয়ে অজগর সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে। চিরচেনা পথের বুক ছুঁয়ে, গন্ধ মেখে। যেন কোনো প্রেমিকার বুকে মুখ গুঁজে ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে দিয়ে যায় কোনো প্রেমিক। প্রতিদিন, নিয়ম করে। পুরনো হয় না সেই ভালোবাসা। বুড়িয়ে যায় না, কখনো ক্লান্ত হয় না ভালোবেসে। ছেঁড়া যায় না কথা দিয়ে। কখনো সময়ের একটু পরে পৌঁছালে প্রেমিক-প্রেমিকার মতোই গাল ফুলিয়ে থাকে প্ল্যাটফর্মগুলো। এদের ভালোবাসায়, মিলনে প্রতিদিন জন্ম হয় হাজারো সংসারের গল্প। দুঃখ-হাসি-কান্না-আনন্দ-বেদনা-প্রেম-ব্যর্থতা-অভিমানের রঙ বদলাতে থাকে প্ল্যাটফর্মে-প্ল্যাটফর্মে। বদলাতে থাকে সুন্দর-অসুন্দর, আনন্দ-বেদনার জীবনের গল্প।
কারও কারও জীবনের গল্পে নিজের কোনো হাত থাকে না। থাকে না কোনো প্রত্যাশাও। স্বপ্ন দেখার বীজ অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যায় কারও। কেউ কেউ ভালোবাসা শিখতে শিখতেই কাটিয়ে দেয় একটা সম্পূর্ণ জীবন, জানতেই পারে না জীবনের কত রঙ, কতভাবে জীবনকে সাজানো যায়, ভরিয়ে তোলা যায়! কোনো কোনো জীবনগল্পের স্ক্রিপ্ট অলক্ষ্যে বসে রচনা করে কেউ। অলক্ষ্যে বসেই ভয়ঙ্কর কাঁটাময় অধ্যায়ের একের পর এক পর্দা উন্মোচন করে যায় সযত্নে। এ যেন মেলায় দেখা কোনো জীবন্ত পুতুলনাচ। এখানে পুতুলের কোনো ক্ষমতা নেই কিছু করার। জীবনসুতার অন্যপাশ ধরে বসে রয়েছে যে রচয়িতা, তার ইচ্ছাই শেষ কথা। কোথাও যাওয়ার ক্ষমতা নেই সে সুতো ছিঁড়ে। এরই মাঝে কেউ কেউ সাহস করে সুতো ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে। জীবন নাটকের বাকি অধ্যায়টুকু নিজেই রচনা করতে প্রতীজ্ঞ হয়—সাহস আর প্রাণপ্রাচুর্যকে পুঁজি করে। ঠিক হোক বা ভুল, রচয়িতা সে নিজেই; এই যা সান্ত্বনা।
দুই.
শিয়ালদহ প্ল্যাটফর্মে ট্রেন আজ টাইমের কুড়ি মিনিট পরে এসে দাঁড়িয়েছে। হুড়মুড় করে য়াত্রীরা সব ঢুকে যাচ্ছে বগিগুলোর পেটের ভেতর। যে যার জায়গা করে নিতে ব্যস্ত। লেডিস কামরায় গল্পের জোয়ার এসেছে ট্রেন ছাড়তে না ছাড়তেই। সন্ধ্যা ৭ টা ৫০ মিনিট। শিয়ালদহ, কোলকাতায় যারা কাজ করে, কাজ শেষে দত্তপুকুর ট্রেনটা ধরতে মহাব্যস্ত হয়ে পড়ে। পরের ট্রেন রাত ১১ টায়। এটা মিস করলে ভোগান্তির আর শেষ থাকবে না। তাই স্রোতের মতো সবাই ছুটে যায় দত্তপুকুর লোকাল ট্রেনের দিকে।
এ ট্রেনের প্রায় সবাই, বিশেষ করে লেডিস কামরার যাত্রীরা আত্মীয়ের মতো হয়ে গেছে। বেশিরভাগ যাত্রীই একে-অন্যের মুখ চেনে। গল্প করতে করতে বাড়ি পৌঁছয় সবাই।
লেডিস কামরার একদিকে ঘোষগিন্নী বামনগাছির আইনজীবী লতার ছেলেমেয়ের খোঁজ নিচ্ছে হাসিমুখে। পারমিতা কলকাতার একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করে, স্মার্ট সুন্দরী। নবনীতাকে তার নতুন ফোন সম্পর্কে তথ্য দিতে ব্যস্ত। দাসপাড়ার হরিদাসের বউটা অফিসের সমস্যার কথার জোরে জোরে বিরক্তিমাখা মুখ নিয়ে দূরে বসা শান্তি বৌদিকে শুনিয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন গরম লেগেছে বলে ফ্যানের সুইচ অন করতেই পাশ থেকে ফ্যান বন্ধ করার আকুতি করে ওঠে আরেকজন। জানালা খুলে বাইরে দেখতে চাইতেই জানালা বন্ধ করে দেয় কেউ। এভাবে লেডিস কামরা মুখর হতে থাকে। একটু একটু করে দত্তপুকুর লোকাল ট্রেন শিয়ালদহ ছেড়ে বিধান নগর, দমদম প্ল্যাটফর্ম পার হয়ে বারাসাত জংশনের দিকে এগিয়ে চলে।
তিন.
বারাসাত জংশন প্ল্যাটফর্ম। শান্তিপ্রিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো প্ল্যাটফর্মে। প্ল্যাটফর্ম-২-এ ঢুকবে দত্তপুকুর লোকাল। কোমরের কাপড়ের ভাঁজে গুঁজে রাখা ৮০০ টাকা দামের মোবাইলটা বের করে শান্তিপ্রিয়া। রাত ৯টা ৩০মিনিট। নিয়ম অনুযায়ী ৫ মিনিটের মধ্যে ট্রেনটির প্ল্যাটফর্মে ঢোকার কথা। কিন্তু প্ল্যাটফর্ম থেকে ঘোষণা এলো ট্রেন কুড়ি মিনিট লেটে পৌঁছবে। প্ল্যাটফর্মের এককোণে তালি দেওয়া চটিজোড়া পেতে বসে পড়ে শান্তিপ্রিয়া। হাতে তার নানা আকৃতির পলিথিন। পলিথিনগুলোর রঙও বিভিন্ন। এর কোনোটায় রয়েছে আঁশছাড়ানো কচুর লতি, কোনোটায় সজনে পাতা, আছে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ কুচি করা, নারকেল কোরানো, খেঁজুর গুড়ের মোওয়াও। সব ব্যাগ নামিয়ে এক এক করে হাতের মধ্যে সাজিয়ে নিচ্ছে শান্তি। প্রথমদিকে যা আনতো, তার সব বিক্রি হতো না। ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হতো, নষ্ট হয়ে যেতো অনেক। এখন যা অর্ডার পায়, তাই শুধু আনে। খুব ভালো লাগে এ কাজ তার। কেউ বলে, শান্তি তোমার দাদা পিঠা খেতে চেয়েছে, কাল একটু চালের গুঁড়া করে এনো তো। কেউ বলে, শান্তি, রবিবারের আগে মেহেদী বেঁটে দিও, সাথে মেথি মিশিয়ে এনো। মটরশুঁটি শাক খাওয়ার আবদারও করে কেউ কেউ।
খুব আনন্দ পায় শান্তি, যখন দেখে তার ওপর নির্ভর করছে ওরা। সবাইকে একটা পরিবারের মতোই মনে হয় তার। কত সংসারের চাওয়া পূরণ করতে পারে শান্তি! কী ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের জীবন ছিল একদিন শান্তিপ্রিয়ার! বুদ্ধি হওয়ার পরপরেই দেখেছে তার চারপাশে শুধু নারী। আর সব নারীই নিজেকে সুন্দর করে অন্যের সামনে উপস্থাপন করতে ব্যস্ত থাকতো সবসময়। অন্য কোনো কাজ করতে দেখেনি কাউকে কখনো।
চার.
ভাইজ্যাক রেলওয়ে স্টেশন থেকে ডানদিকে এগুলেই শান্তিপ্রিয়াদের এ আনন্দমহল। মাত্র ১০ বছর বয়স থেকেই শান্তিকে একই কাজ শুরু করতে হয়েছিল। কাজটা করতে একদমই ভালো লাগেনি তার। গা গুলিয়ে বমি হয়েছিল সেদিন। টানা ১০ দিন জ্বরের ঘোরে অচেতন ছিল। পরে জানতে পেরেছিল ওইদিন সবচেয়ে বেশি টাকা পেয়েছিল মাসি শান্তির জন্য। সুস্থ হয়ে করতে চায়নি এ কাজ। স্কুলে যাওয়ার বায়না ধরেছিল মায়ের কাছে। পারেনি। আনন্দমহল থেকে বাইরে কাউকে যেতে দেখেনি শান্তি কখনো। যা প্রয়োজন, সব চলে আসতো এ মহলে। শাড়ি, গয়না, ভালো খাবার; কোনোটারই কমতি ছিল না এখানে। তবু শান্তির ভালো লাগতো না সেখানে। খোলা আকাশে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করতো। দম বন্ধ হয়ে আসতো। প্রতিদিন দুই/একজন দৈত্যের হাতে নিজেকে সমর্পণ করতে হতো অনিচ্ছায়, ঘৃণায়। দৈত্যগুলো ভয়ঙ্কর ধারালো দাঁত বসাতো শরীরে, সর্বোচ্চ শাস্তিটুকু দিয়ে পৈশাচিক আনন্দ নিয়ে বের হয়ে যেতো ঘর থেকে। মৃত্যু কামনা করতো প্রতিরাতে সে।
একদিন দৈত্যগুলোর পরিবর্তে অন্যরকম একজন মানুষ এসেছিল শান্তির ঘরে। দামি আতরের পরিবর্তে কাঁচা ফুল দিয়ে শান্তিকে ভরিয়ে রাখতো। শান্তিকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে সে ফুলের ঘ্রাণ নিতো সারারাত। জানালা খুলে মুখোমুখি বসে পার করেছে কত রাত! কখনো কখনো চাঁদের আলোয় শান্তিকে আলিঙ্গন করে রাখতো সে। দু’জনে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল সংসারের। শান্তিও আনন্দমহল থেকে মুক্তির নেশায় বুঁদ হয়েছিল। সংসারকে ঘিরে রঙিন স্বপ্নে বিভোর ছিল তার মন। একদিন জানাজানি হয়ে সেই স্বপ্নের কথা। অন্যরকম মানুষটার সঙ্গে যে কী করেছিল ওরা, আজও জানতে পারেনি সে। প্রতিদিন অপেক্ষা করে বসে থাকলেও আর আসেনি সেই মানুষটা। হঠাৎ আসা লোকটা হারিয়ে গেলো হঠাৎই। শুধু বদলে গেল শান্তির অনুভূতি, ভাবনা। দৈত্যগুলোর আবার আসা শুরু হলো একের পর এক। শান্তির জীবন এবার আরও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। কাঁচা ফুলের ঘ্রাণে ডুবে থাকা শান্তি দামি ঝাঁঝালো আতরে আর ফিরে যেতে পারে না। যখন শান্তি জানতে পারে কাঁচা ফুলের সৌরভ বেড়ে উঠছে তার ভেতরে একটু একটু করে, প্রচণ্ড শক্তি আর সাহস ভর করে কোথা থেকে যেন! ভেতরের সৌরভ কিছুতেই অপবিত্র করতে দেবে না ও। এক রাতে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার নাম করে সে পালিয়ে যায়। ভাইজ্যাক রেল স্টেশন থেকে হাওড়ার ট্রেন চেপে বসে। সুতা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে ও, রচনা করে নিজের জীবনের পরবর্তী অধ্যায়। সে কথা মনে পড়লেও আঁতকে ওঠে আজ। অনেক কষ্টেও শান্তি হাসে প্রাণ খুলে। নিজের শরীরে বেড়ে ওঠা সৌরভকে সে বাঁচাতে পেরেছে আনন্দমহলের বিষনিঃশ্বাস থেকে। মেয়ের নাম রেখেছে ফুল। স্কুলে পড়ে। বারাসাত জংশনের পাশেই ছোট একটা বাসায় ভাড়া থাকে। দত্তপুকুর লোকালের লেডিস কামরায় উঠে সবার চাহিদা অনুযায়ী খাবার বিক্রি করে। বারাসাত থেকে ট্রেনে উঠে বামনগাছি, দত্তপুকুর, অশোকনগর হয়ে হাবড়া নেমে যায়। ফিরতি ট্রেন ধরে ফিরে আসে বারাসাতে। ঘরে ফিরে মেয়ে ফুলের সৌরভে ভরিয়ে রাখে নিজেকে।
পাঁচ
লেডিস কামরায় সবার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চাহিদা অনুযায়ী দেওয়া হলে শান্তি এগিয়ে যায় কামরাটির পশ্চিমদিকের শেষ দরজার কাছে। সেখানে অন্ধকারে দাড়িয়ে থাকে পল্লবী। পেশায় উকিল। সবাই পল্লবী সিনহা নামে চেনে। সারা পথ এই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যায় পল্লবী। শীত বা গরম, নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয় নার। চলন্ত ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে তার। সারা দিন রাতে এই সময়টুকুই যেন ওর নিজের। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা লাগে সারা শরীরে। জুড়িয়ে যায় দেহমন।
ছিপছিপে গড়ন পল্লবীর। গায়ের রঙ শ্যামলা। তবে ভারি মিষ্টি দেখতে মুখখানা। বড় বড় টানা চোখ। গভীর আর মায়াবি সেই চোখের চাহনি। শাড়ি পরে পল্লবী সবসময়। চুলটা একটু উঁচু করে খোঁপা করে রাখে। বাম হাতে খয়েরি ফিতার ঘড়ি আর ডান হাতে শাড়ির রঙের চারটি কাচের চুড়ি পরে। চুলের সিথির কোনো এক জায়াগায় খুব হালকা করে সিঁদুর পরে। মনোযোগ দিয়ে না দেখলে সিঁদুর কারও চোখেই পড়ে না। আইন পেশায় খুব অল্প বয়সেই নাম করেছে। আলাদা একটা ব্যক্তিত্ব ওর চারপাশ থেকে আড়াল করে রাখে। হয়তো তার ব্যক্তিত্বের কারণেই লেডিস কামরার গল্পে যোগ দিতে পারে না সে।
দরজায় দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে থাকে। অন্ধকারের একটা সৌন্দর্য থাকে। থাকে নিজস্ব আলো। সেই গাঢ় অন্ধকারের গূঢ় আলোয় নিজেকে দেখতে চায় এই নারী। জীবনের হিসাব-নিকাশ মেলাতে মেলাতে উত্তর খুঁজে ফেরে। পায় না। তাই সে বার বার হিসাব মেলানোর চেষ্টায় অন্ধকারেই হাতড়ে ফেরে।
এই পল্লবীর সঙ্গে শান্তির দেখা দত্তপুকুর লোকালেই। বছর খানেক আগে শীতের সময়। শান্তিপ্রিয়া বারাসাত জংশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিল দত্তপুকুর লোকালে উঠবে বলে। যেই উঠতে যাবে, অমনি ভিড় ঠেলে একজন পুরুষ তাকে মারতে মারতে লেডিস কামরা থেকে নামিয়ে আনে। তার ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে। চুলগুলো এলোমেলো। চোখের কোণে আঘাতের চিহ্ন। কালো ছোপ ছোপ দাগ। পুরুষটার কোনো খেয়ালই নেই সে দিকে। পল্লবীরও লোকটার হাত থেকে বাঁচার কোনো চেষ্টা নেই। শান্তি এগিয়ে যেতেই পল্লবীর চোখে চোখ পড়ে। সে চোখে কোনো দুঃখ নেই, কষ্ট বা রাগের কোনো চিহ্নও নেই। শান্তির মনে হচ্ছিল পাথরের কোনো মূর্তির চোখ। সে চোখে যেন নিষ্প্রাণ। সেই বিভ্রান্ত-নিষ্প্রাণ চোখের দিকে তাকিয়ে সেদিন আটকে গিয়েছিল শান্তি। যেতে পারেনি ট্রেনে। ট্রেন ছাড়তেই লোকটি পল্লবীকে প্ল্যাটফর্মে ফেলে রেখে দ্রুত উঠে যায় ট্রেনে। শান্তি এগিয়ে যায় তার দিকে, এগিয়ে দেয় পানির বোতল।
যে লোকটি তাকে মেরেছিল, সে পল্লবীর স্বামী পাথর ব্যবসায়ী অরুনেশ। ভালোবেসে তারা বিয়ে করেছিল। বিয়ের পর অরুনেশ চাইতো না, পল্লবী ল’ পড়ুক। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকতো। প্রথম প্রথম রাগারাগি করতো অরুনেশ। ধীরে ধীরে গায়ে হাত তোলা শুরু। মদ খেয়ে ফিরতে শুরু করে প্রতিরাতে। ব্যবসায়ে একের পর ধস নামতে শুরু করে। তখনই ঘরে এসে পল্লবী গায়ের ওপর দিয়ে সে রাগ তুলতে থাকে। পল্লবীর পেশায় সফলতা অরুনেশের রাগকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ।
পল্লবী-অরুনেশের সংসারে ঝামেলা লেগেই ছিল। এই ঝামেলার চূড়ান্ত হয়েছিল বারাসাত প্ল্যাটফর্মে। এরপর থেকে হঠাৎ করেই থেমে গেছে সেই ঝামেলা। অরুনেশ কাজ থেকে মাতাল হয়ে ফিরে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। পল্লবী একমাত্র সন্তানকে নিয়ে আলাদা ঘরে ঘুমায়। একই ছাদের নিচে যেন দুজন আলাদা-অচেনা মানুষ।
যে ভালোবাসার টানে বাবা-মাকে ছেড়ে একদিন বেরিয়ে পড়েছিল পল্লবী, আজ আর সেই ভালোবাসা সে কোথাও খুঁজে পায় না। তাই এ ট্রেনের অন্ধকার কামরায় স্মৃতি হাতড়াতে থাকে সে। মেলাতে থাকে জীবনের হিসাব-নিকাশ।
ছয়.
শান্তি গভীর চিন্তায় ডুবে যায। পল্লবীও এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হিসাব কষছিল। আর তখনই হুইসেল বাজে দত্তপুকুর লোকালের। বাঁশি শুনেই ধ্যান ভাঙে শান্তি ও পল্লবীর। ত্রস্ত হয়ে ওঠে প্ল্যাটফর্মের অন্য যাত্রীরা। ট্রেনটি থামতেই সবাই ছোটে সেদিকে। লেডিস কামরার দিকে ছুটতে থাকে শান্তি, পল্লবীও। ভিড় ঠেলে উঠে পড়ে তারা। শান্তি-পল্লবীর মতো জীবনের নানা সমস্যাকে বয়ে চলা, কিংবা সংকটকজয়ী আরও আরও নারী-পুরুষকে পেটের ভেতর নিয়ে বাঁশি বাঁজিয়ে বারাসাত জংশন ছাড়ে দত্তপুকুর লোকাল ট্রেন। পেছনে পড়ে থাকে হৃদয়পুর, মধ্যমনগর, ব্যারাকপুর, দমদম আর শিয়ালদহ প্ল্যাটফর্মের হাসি কান্নার গল্প।