অনেক অনেক দিন আগের কথা নয় এটা। আমাদের ছোট্ট বর্ধিষ্ণু শহরটায় এক প্রিন্সেসের রূপের খ্যাতি ছড়ালো। তার একটা নাম হয়তো ছিল, কিন্তু সেটা চাপা পড়ে গেছে। সে দেখতে সত্যি-সত্যিই রাজকুমারীর মতো, মানে বই-পুস্তকে রাজকুমারীদের যে রকম বর্ণনা পাওয়া যায়, সেই বিবেচনায়। দুধের মতো ধবধবে শাদা তার গায়ের রং, তেমনি দেখতে সুন্দর তার লম্বাটে মুখশ্রী। সচ্ছল বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আদরে-যত্নে মানুষ। কিন্তু ডাইনির আছর পড়ল এই সুখী সংসারে, একের পর এক যাকে বলে পট-পট করে মারা গেল প্রিন্সেসের বাপ-মা। মামারা বলল, চল মা আমাদের বাড়ি, এখানে একা-একা কী করে থাকবি? কিন্তু বেঁকে বসল কিশোরী মেয়েটি—আমি এখান থেকে কোত্থাও যাব না। দিনে দিনে জানা গেল, মেয়েটি বলছে সে নাকি রূপকথার তুষারকন্যা। লোকেরা বলল, তা বটে, তুষারকন্যাই তো। এদেশে তুষার পড়ে না সত্যি, কিন্তু তুষার সম্পর্কে ধারণা আছে যাদের, তাদের নির্দ্বিধায় স্বীকার করতেই হবে যে, প্রিন্সেসের গায়ের রং যে-রকম ধবধবে শাদা, তাতে তার তুষারকন্যা হতে অসুবিধে নেই। সুতরাং লোকে তাকে তুষারকন্যা বলে ডাকতে লাগলো।
তো তুষারকন্যার নজর কাড়ার জন্য সত্যি-নকল কত শত রাজকুমারের আনাগোনা যে শুরু হলো। কিন্তু কেউ তার নজর কাড়তে পারে না। সে বলে, আগে তো আমার সাত বামুন ভাই আসুক, তারপরে আসবে রাজপুত্র।
সে ভোর থেকে রাত অব্দি উঁচু জানালার পাটাতনে বসে থাকে, উন্মুখ হয়ে চেয়ে থাকে পথের দিকে—কখন আসবে তার সাত বামুন ভাই। সে খোদার কাছে প্রার্থনা করে—আমার সাত বামুন ভাইকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। প্রত্যেকটা দিন যায়, তেমনি করে যায় রাত, কিন্তু সাত বামুনের দেখা মেলে না। তাই বলে সে আশা ছাড়ে না। তার বিশ্বাস একদিন তারা আসবেই আসবে।
আশপাশের গাঁও-গ্রাম আর শহর-নগর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল তুষারকন্যার কাহিনি। প্রত্যেকদিন আধুনিক এবং উত্তরাধুনিক রাজপুত্ররা এসে ভিড় জমাতে লাগলো তার দরোজায়। একজন আসে তো আরেকজন যায়, একজন যায় তো আরেকজন আসে। কিন্তু তুষারকন্যা অটল। সে সাত বামুনের প্রতীক্ষার প্রহর গোণে। রাজপুত্ররা তার পাণিপ্রার্থীই হয় না কেবল, কেউ কেউ প্রস্তাব নিয়ে আসে বিশাল রাজত্বের, বিপুল সম্পদের, সোনা-দানা, শাড়ি-গাড়ি-বাড়ি কী চাই, সব, সব দিতে রাজি তারা। কিন্তু সম্মত নয় তুষারকন্যা। পীড়াপীড়ি করলে সে বিরক্ত হয়। তাকে বিরক্ত করতে মন সায় দেয় না কারও।
তার ওই এক কথা—আগে তো আসুক আমার সাত ভাই বামুন, তারা আমাকে আশ্রয় দেবে, আমি তাদের সাথে বাস করব তাদের ছোট্ট কুঁড়েঘরে। সেখানে আমি তাদের উঠোন ঝাঁট দেব, মেঝে লেপব, হাড়ি-পাতিল পরিষ্কার করব, কাপড়-চোপড় কেচে দেব, রান্না-বান্না করব, তারা সারাদিন কাজ করে বাড়ি ফিরলে আমি তাদের সামনে খাবার বেড়ে দেব, এইভাবে সুখে জীবন-যাপন করব। আমার সুখ সইতে না পেরে একদিন আমার ডাইনি সৎমা আসবে, আমাকে বিষাক্ত আপেল খাওয়াবে, কিংবা বন্দী করে নিয়ে যাবে, তখন আসবে আমার রাজকুমার, আমাকে সে উদ্ধার করবে।
রাজপুত্র আর মন্ত্রীপুত্রদের তাই খালি হাতে ফিরে যেতে হলো। তুষারকন্যার সৎ-মা ছিল না, কিন্তু সৎ-মায়ের মতো এক চাচী ছিল। সে মানে-মানে আপদ বিদেয় করতে চাচ্ছিল, তুষারকন্যা চলে গেলে বাড়িটা সে তার মেয়ে-জামাইয়ের জন্যে দখল করতে পারে। কিন্তু তুষারকন্যার গোঁ ছোটাতে পারে না। রাজপুত্র তবু পাওয়া যায়, বামুন যে মেলে না।
অপেক্ষায় অপেক্ষায় সবাই কান্ত ও শ্রান্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু তুষারকন্যা সাত বামুনের প্রতীক্ষায় কখনো কান্তি অনুভব করে না। সে প্রত্যেকদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে জানালার পাটাতনে গিয়ে বসে। ফলবিক্রেতা ডাইনি মেয়েরা তার জানালার নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। তখন সে তার চাচীর দেওয়া যাদুর আয়নার সামনে গিয়ে বলে, ওগো যাদুর আয়না, আমি তোমার পায়ে পড়ি, আমার সৎ-মাকে গিয়ে বলো সে আমাকে বনে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে পাঠাক, চাকরদের দয়া হবে আমার ওপর, তারা আমাকে না মেরে খরগোশ মারবে, আর তার রক্তে আমার ওড়না ভিজিয়ে নিয়ে যাবে আমার সৎ-মায়ের কাছে। তারপর সাত বামুন ভাই আমাকে কুড়িয়ে পাবে বনের মধ্যে, তারা আমাকে তাদের কুটিরে নিয়ে যাবে।
দিনের পর দিন চলে যায়, কিন্তু এসবের কিছুই ঘটে না। যতই দিন যায় তুষারকন্যার আকাঙ্ক্ষা ততই তীব্রতর হয়, প্রত্যাশা গভীরতর হয়, তার মনের মধ্যে তার সকল কল্পনা ও আশা গভীর দাগ কেটে বসে যায়। কিন্তু সংকট সৃষ্টি করে সময়। সময় কেবল বয়েই চলে না সবকিছুকে পেছনে ফেলে, সে তার নির্দয় কামড় বসিয়ে যায় সবখানে। আমাদের তুষারকন্যার বয়স বাড়তে থাকে, তার যৌবন ফিকে হতে শুরু করে। সাত বামুন তো আসেই না, রাজপুত্ররাও আর এ পথ মাড়ায় না।
এইভাবে, আমাদের তুষারকন্যাটির রূপকথার নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন অবাস্তবায়িতই থেকে যায়। তার স্বপ্ন কাহিনি হয়ে ওঠে না। তার নিজের কোনো গল্প রচিত হতে পারে না। একদিন সে চাচীর দেওয়া যাদুর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার মধ্যে এক শাদাচুলো চিমসে বুড়িকে আবিষ্কার করে। সে তার নিজের কুৎসিত চেহারা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ভয়, দ্বিধা আর সন্দেহ তার স্বপ্নের টুটি চেপে ধরে। কিন্তু সে তার স্বপ্নকে মরে যেতে দিতে চায় না। গল্পে তার নিজের অবস্থান করে নিতে সে তার স্বপ্ন ও ভূমিকার পুনর্বিন্যাস করে নেয়। সে আপেলের ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। এক গাঁ থেকে আরেক গাঁ, এক মহল্লা থেকে আরেক মহল্লা, এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি, এ রকম করতে করতে গ্রামদেশেও ফেরি নিয়ে চলে। তার মনে অফুরন্ত আশা—কোথাও না কোথাও গিয়ে তার এই যাত্রা শেষ হবে, সেই গন্তব্যে কোনো এক কুটিরের জানালায় বসে থাকবে তুষারকন্যা। সে ভাবে, ওই তুষারকন্যাকে সাত বামুন বা রাজপুত্রের কাছে পৌঁছার ব্যবস্থা করে দেবে সে। হয়তো হবে সেটা কোনো অন্ধকার গলি, প্রত্যন্ত কোনো জনপদের পরিত্যক্ত ছোট্ট একটি কুটির, যার জানালা দিয়ে বিচ্ছুরিত হয় না কোনো আলো, অথচ সেখানেই তার অপেক্ষায় প্রহর গোণে তুষারকন্যা। সে তাকে বিষাক্ত আপেল দিয়ে সাহায্য করতে বদ্ধপরিকর, যেন সে এইভাবে তার আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে। তার একটা সুখী ও শান্তিময় জীবন দরকার।
সে মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে চলে, ভোর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, খেয়ে, না-খেয়ে, আমের বাগান, ফসলের মাঠ, খাল-বিল-জঙ্গল পেরোতে থাকে, কোনো কিছুই তাকে নিরস্ত করতে পারে না। কিন্তু কোনো তুষারকন্যা মিষ্টিকণ্ঠে ডাকে না তাকে। প্রত্যেক পাড়া, প্রত্যেক বাড়ি থেকে তাকে খালি হাতে ফিরতে হয়। তার ঝুড়ির আপেল নিজের বিষেই জ্বলে-পুড়ে পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়ায়।
তার দাঁত পড়ে যায়। সে কুঁজো হয়ে হাঁটে। তার শুকনো চিমসে মুখে খাড়া সরু নাকটা সত্যিকারের ডাইনির রূপ পায়। তার দুর্বল পা দুটো স্থির খাড়া হয়ে থাকতে পারে না আর, কোমরে, গিঁটে-গিঁটে, সারা শরীরে ব্যথা টনটন করে। চোখে ঝাপসা দেখে, কানে ভালো শুনতে পায় না। তবু সে হেঁটে চলে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, পথ থেকে পথে, প্রত্যেকটা বাড়ির দরোজা ও জানালা ছুঁয়ে, মাঠ-ঘাট বন-জঙ্গল পেরিয়ে অনুসন্ধান করে চলে একজন তুষারকন্যার, যে তার কাছ থেকে একটা আপেল চেয়ে নিয়ে খাবে, সব আপেলেই এখন বিষ, একটা খেলেই হবে। সেই আপেল খেয়ে তুষারকন্যা অজ্ঞান হয়ে যাবে, যদি তা না হয় আজকাল, অন্তত ঘুমিয়ে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। তারপর এক রাজকুমার তাকে দেখতে পাবে, তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে হয়তো কোনো ক্লিনিকে বা হাসপাতালে। বুড়ির চিন্তা-ভাবনায় আজকাল নিজের, সমকালের, অভিজ্ঞতার ছাপ পড়ছে।
একসময় অভিজ্ঞতাই তার মধ্যে এই উপলব্ধি জাগ্রত করে যে সময়ের পরিক্রমায় সবকিছু বদলে গেছে, যেমনটা হয়েছে সে। সে নিজেই কেবল অসুখি হয়েছে তা-ই নয়, সে পরিত্যক্ত এবং জগত-সংসারের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছে। সে তার পোড়ো বাড়ির এক কোণে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তার হৃদয় ভেঙে গেছে, এবার ক্ষুধায়-জরায়, দারিদ্র ও দুর্ভোগে তার শরীরও ভেঙে পড়ে। সে নিজের চোখে নিজের দৈহিক অস্তিত্বের নয় কেবল, তার নৈতিক আদর্শেরও পতন প্রত্যক্ষ করে।
যে স্বপ্ন ও আদর্শের জন্য সে বিসর্জন দিয়েছে তার সর্বস্ব, তার সকল সাধ, যৌবন ও জীবন, তার প্রতি সম্মান দেখায় না কেউ। নোংরা ময়লা দুর্গন্ধময় বিছানায় মৃত্যুর প্রহর গুনতে-গুনতে সে আত্মসমালোচনা করে, আমি কি ভুল করেছি? ভাবে, আর নিজেই নিজেকে বলে, না, আমি ভুল করিনি, আমি যা চেয়েছি তা পাওয়ার জন্য প্রাণপাত করেছি, আমি ঠিকই করেছি।
যেদিন আমাদের তুষারকন্যার মৃত্যু হয় সেদিন তার বয়স নব্বইয়ের ঘর ছুঁইছুঁই করছিল।
তার নিজের ছোট্ট পোড়ো বাড়িতে সে মৃত্যুকেও আলিঙ্গন করেছিল সম্পূর্ণ একাকী।
তার মৃত্যুর খবর পাড়ার লোকরাই জানল প্রথম। ওই পাড়াতে ভাড়া থাকত ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার এক সাংবাদিক। সে অনেকদিন থেকেই ভাবছিল একটা ফিচার স্টোরি করবে তুষারকন্যাকে নিয়ে। কিন্তু ব্যস্ততার ভিড়ে তা হয়ে ওঠেনি এতদিন। এবার তাকে সময় করতেই হলো। ওই সাংবাদিকের কল্যাণে আমাদের তুষারকন্যার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে ইথারতরঙ্গের মতো। তারপর সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন সর্বত্র তার সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা, মনোবল ও আত্মত্যাগের মহিমা ও তার বিশদ বিশ্লেষণ প্রচারিত হতে থাকল। তার জানাজায় নয় বছর থেকে নব্বই বছর বয়সী হাজার হাজার মানুষ অশ্রু বিসর্জন করল তাদের প্রিন্সেসের জন্য। তার শব বহন করল সাতজন বামুন, সারাদেশ থেকে ছুটে আসা কয়েকশ বামুনের মধ্য থেকে তাদের বাছাই করে নেওয়া হয়েছে। দাফন শেষে এই বামুনেরা ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলো—হায় আল্লা, আমাদের তুষারকন্যাকে ছেড়ে আমরা কী করে বাঁচব!
রাজপুত্ররা, যারা আমাদের তুষারকন্যার স্পর্শধন্য হওয়ার জন্য একদা আকুল ছিল, তারা এখন কেউ মন্ত্রী, কেউ সচিব, কেউ জেনারেল, কেউ-কেউ সিআইপি-ভিআইপি, তারা কেউ তার জানাজা বা দাফন অনুষ্ঠানে শরিক হতে পারেনি; তারা কেউ ব্যস্ত ছিল জাতীয় দায়িত্ব পালনে, কেউ বা জরুরি পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজে। তবে শোকবার্তা পাঠাতে ভোলেনি। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করল। টিভি চ্যানেলগুলোয় তাকে নিয়ে আলোচনা হলো। সবখানে, সকলেই, প্রায় একই ভাষায় ও ভঙ্গিতে বলল প্রায় একই কথা—আমাদের প্রিন্সেস ওরফে তুষারকন্যা নিজের, একেবারে তার নিজস্ব ধরনের, একটা জীবন, একটা আখ্যান তৈরি করার জন্য একাকী বিরামহীন পরিশ্রম করেছেন। তিনি আমাদের স্বপ্ন দেখতে এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে অবিরাম, ক্লান্তিহীন লড়াই করতে শিখিয়েছেন। নিজের স্বপ্ন ও আদর্শ বাস্তবায়নে তিনি যে দৃঢ় অঙ্গীকার ও অধ্যবসায় প্রদর্শন করেছেন তা আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। আপাতঃব্যর্থতা সত্ত্বেও একজন অদম্য স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ হিসেবে সম্পূর্ণ সফল ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব আমাদের তুষারকন্যা।