এক.
শামসুল আলমের ডান পা বেয়ে কিছু একটা হাঁটু পর্যন্ত উঠে গেছে। কী উঠছে তা তিনি বুঝতে পারছেন না। কিন্তু যখন কামড়াতে আরম্ভ করলো, তখন তার বুঝতে বাকি রইলো না যে, এটা বিষপিঁপড়ার কামড়। বাম পা বেয়েও কয়েকটা বিষপিঁপড়া সুড়সুড় করে উঠছে। ততক্ষণে হাঁটুতে আরও দুটো পিঁপড়া কামড় বসিয়ে দিয়েছে। বাম পায়ের হাঁটুর ওপর ও নিচে কয়েকটি বিষপিঁপড়া অনবরত কামড়ে যাচ্ছে, কয়েকটি পিঁপড়া উঠে গেছে আরও ওপরে। তারাও কুটকুট করে কামড়ে সাড়া পায়ে বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। শামসুল আলম এবার উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে সমবেত জনতা একে অন্যের দিকে বিস্ময়ে ইতিউতি তাকাচ্ছে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে শামসুল আলম নিচু হয়ে দুই হাতে নিজের প্যান্ট গুটাতে শুরু করলেন। সহকারী সুলতান এগিয়ে এসে তার কানে কানে বললেন, কী হইছে স্যার?
এটুকু সময়ের মধ্যে শামসুল আলমের দুই পায়ের হাঁটুতে ও উরুতে অসংখ্য পিঁপড়া মিলে কামড়ে যাচ্ছে। শামসুল আলম জনতার মাঝখানে বসে চোখে শর্ষেফুল দেখছেন। দুই হাতে প্যান্ট গুটিয়ে ওপরে তুলতে গিয়ে দেখেন আরও আট-দশটা লালপিঁপড়া তার কুচকুচে কালো পায়ের আঙুল কামড়ে ধরে আছে। ডান হাতে সেগুলো পিশে ফেলতে গিয়ে দেখেন তার চারপাশে অসংখ্য লাল পিঁপড়ার জমায়েত। তার অণ্ডকোষে বিষ ছড়িয়ে যাওয়া টের পেয়ে তিনি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে প্যান্টের ওপর দিয়ে বাঁ হাতে অণ্ডকোষ ঘষতে লাগলেন। সমবেত জনতা তাদের ন্যায়বিচারের আশায় এখানে আসার কারণ ভুলে গিয়ে নিজেরা ফিসফিস করে কথা বলা শুরু করে। শামসুল আলম এই ফিসফিসানির গুঞ্জন শুনে আন্দাজ করতে পারলেন, সবাই তাকে নিয়েই কথা বলছে। কী লজ্জার ব্যাপার!
স্বপ্নের এই পর্যায়ে শামসুল আলমের ঘুম ভেঙে গেলে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলেন। লোডশেডিং এর অন্ধকারে স্ত্রী ফরিদা বানু স্বামীর দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘খারাপ স্বপ্ন দেখসুইন? বইন এইনো, বাতাস করি।’ বলেই হাতপাখা এনে বাতাস করতে লাগলেন। শামসুল আলম এক নিশ্বাসে পানিটুকুন শেষ করে দম মেরে বসে রইলেন। হাতপাখায় বাতাস করতে করতে ফরিদা বানু একসময় ঘুমিয়ে পড়লেন। বাকি রাতে চেষ্টা করেও আর দুই চোখের পাতা এক করতে পারলেন না শামসুল আলম। বারান্দায় পায়চারী করলেন। বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসে রইলেন। স্বপ্নের গ্লানিটুকু কিছুতেই মুছে যাচ্ছে না। বরং আরও গাঢ় হয়ে মনের মধ্যে জেকে বসেছে। একটু পর পর শামসুল আলম আঁতকে আঁতকে উঠছেন।
সকালের নাস্তা সেরে শামসুল আলম যখন পুবপাড়ায় নিজের জমি-জিরাত নিয়ে কাইজাফ্যাসাদ মিটাতে গেলেন তখন তাকে দেখে কেউ বুঝবে না যে গতরাতটা তার ভালো কাটেনি। তার দুই একর জমির কোনায় এক টুকরো জমিতে বাস করে যে মজিদ তার প্রতি শামসুল আলমের রাগটা অনেক দিনের। বরাবরের মতোই মজিদকে দেখামাত্র তার ঠোঁটে রাগমিশ্রিত অনুকম্পার হাসি ফুটে উঠলো। বছরখানেক আগে সুলতান তার দলবল নিয়ে মজিদের বউটাকে দিনের আলোতেও এলাকা থেকে উধাও করে দিয়েছিলো। দুইদিন পর মজিদের উঠানেই ফেলে রেখে গেছে বউটাকে। কিন্তু কী আশ্চর্য! সেই বউকে নিয়ে দিব্যি সুখের সংসার করছে মজিদ। ওকে নিঃশেষ করতে না পারলে মনে শান্তি পাবে না শামসুল আলম। তার মনের গতিবিধি বুঝতে পেরে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সুলতান এগিয়ে আসে তার কাছে। তাকে চোখের ইশারায় অর্থবহ ইঙ্গিত দিয়ে শামসুল আলম যখন চোখ সরিয়ে নিচ্ছেন তখন তার চোখ পড়লো সুলতানের কনুই বেয়ে হেঁটে যাওয়া লালপিঁপড়ার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি লজ্জায় কুকড়ে গিয়েও নিজে নিজেই সামলে নিলেন।
দুই.
সন্ধ্যার মুখে ফরিদা বানু যখন উঠোনে মেলে রাখা কাপড়গুলো নিয়ে ঘরে ফিরছিলেন তখনই হন্তদন্ত হয়ে শামসুল আলমকে বাইরে যেতে দেখা গেলো। তার পেছনে সুলতানসহ আরও কয়েকজন। বাজারে চালের আড়তে বসে যে তোফায়েল, তার হাত দুটো পেছনে নিয়ে বাঁধা—সে তার শরীরের সব শক্তি দিয়ে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। দুই পাশ থেকে দুইজনে তাকে জাপটে ধরে রেখেছে। খুব পাপ করেছে সে। আড়তের হিসাবে দুইশ টাকার গরমিল। যেই হাতে সে চুরি করেছে শামসুল আলম তার সেই হাত থেঁতলে দেওয়ার হুকুম দিয়েছেন। হুকুম পেয়ে সুলতান কোত্থেকে একটা হামানদিস্তা নিয়ে এসেছে। হামানদিস্তাটা দেখে তোফায়েল চিৎকার করা করেছে। তার চেঁচামেচি শুনে ফরিদা বানু বাইর উঠানে এসে দেখে এরইমধ্যে তোফায়েলের ডানহাতের দুইটা আঙুল থেঁতলে ফেলা হয়েছে। থেঁতলে যাওয়া আঙুলের দিকে তাকিয়ে তোফায়েল কাঁদছে। এসব দেখে ফরিদা বানু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সন্ধ্যার আবছা আলোয় শামসুল আলম স্ত্রীকে দেখে বিরক্ত বোধ করলেন। এসব জায়গায় মহিলাদের আসা তার পছন্দ নয়। মহিলারা থাকবে ভেতর বাড়িতে। বাইরে কেন আসবে? শামসুল আলম গলা চড়িয়ে বললেন ‘ফাল্গুনির মা, তুমি বাড়ির ভিতরে যাও’। ততক্ষণে কাঁপন শুরু হওয়া শরীর নিয়ে ফরিদা বানু ধীরে ধীরে নিজের ঘরে চলে এলেন। তার কী বা করার আছে! যদি সামান্য ক্ষমতা থাকতো তাহলে অনেক আগেই মেয়েকে নিয়ে এই সংসার ছেড়ে চলে যেতেন। বাপ মরে গেছে সেই কবে। একটা ভাই। তারই দিন চলে না। মেয়েকে নিয়ে সে যদি তার কাছে চলে যায় ভাইটা কখনোই বিরক্ত হবে না ঠিকই কিন্তু তার সংসারে অশান্তি নেমে আসবে। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর থেকে মাঝে মাঝেই এ বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন কী ভাববে? এসব ভেবেই মাটি কামড়ে এই সংসারে পড়ে আছেন।
মনে ও শরীরে ঘিনঘিনে অবসাদ নিয়ে তিনি রাতে কিছু খেতে পারলেন না। খাওয়ার টেবিলে শামসুল আলম মুখে গ্রাস তুলতে তুলতে বললেন—‘বউ, তোমার কাজ ঘরের ভেতরে। বাইরে যাওয়ার তো তোমার দরকার নাই। কথাটা মনে রাখবা।’ ফরিদা বেগম মাথা নেড়ে স্বামীর কথায় সায় দেন। মুখে কিছু বলেন না।
রাতে ঘুমাতে গিয়েও ফরিদা বেগমের চোখে ঘুম আসে না। পাশে শুয়ে শামসুল আলম নানান কথা বলেন। পুবপাড়ার জমিটা কিছুদিনের মধ্যে ঝামেলামুক্ত হয়ে যাবে। মজিদকে কতভাবেই তো তিনি বোঝাতে চেয়েছেন ব্যাপারটা। না বুঝলে তার কী বা করার আছে। ফরিদা বেগম এসব কথার কিছু শোনেন, কিছু শোনেন না। পাশ ফিরে শুয়ে থাকেন। শামসুল আলম গদগদ হয়ে পেছন দিক থেকে বউকে জড়িয়ে ধরেন। ফরিদা বেগম তার মনের ইচ্ছা বুঝতে পেরে আঁতকে ওঠেন। সারাজীবন তার ওপর কম জবরদস্তি করেননি শামসুল আলম। এখন তার বয়স হয়েছে। এখন আর এসব জবরদস্তি তার শরীর সইতে পারে না। তবু তিনি সয়ে যাচ্ছেন। নইলে যে ললিতাকে ঘরে তুলে আনবেন শামসুল আলম সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ফরিদা বানুর। লোকে বলাবলি করে, দিনের বেলা সাহাপাড়ার যুবতী ললিতা রানীর বাড়িতে গিয়ে পড়ে থাকেন শামসুল আলম। কেউ কেউ বলে ললিতাকে বিয়ে করেছেন তিনি। যদিও এটা ঠিক কি না, তা কেউ আজ পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পারেনি। এ ব্যাপারে স্বামীকে কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারেননি। প্রায় রাতেই ললিতার নাম ধরে তাকে ডাকেন শামসুল আলম। প্রথম যেদিন শুনেছেন, সেদিনও খুব অবাক লাগেনি তার। এরইমধ্যে এক কান দুই কান হয়ে ললিতার রটনা ফরিদা বানুর কানে পৌঁছে গেছে। পাশ ফিরে এসব কথা ভেবে ভেবে ফরিদা বেগমের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তার শরীরে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করতে করতে ফরিদা বেগম অন্ধকার বিছানায় নিজেকে অসহায় অবস্থায় আবিষ্কার করেন। অল্প কিছুক্ষণ পর শামসুল আলম তার পাশে শুয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই ঘুমিয়ে পড়েন।
তিন.
কিশোর শামসুল আলম তার দাদার যে পুরোনো খাটে ঘুমাতেন, আজ এতদিন পর সেই খাটে শুয়ে আছেন তিনি। তার গায়ে কোনো কাপড় চোপড় নেই। তার হাত পা খাটের সঙ্গে আষ্টেপিষ্টে বাঁধা। তার সারা গায়ে শত শত শুঁয়োপোকা হাঁটাহাঁটি করছে। শুঁয়োপোকার শরীরময় থাকা কাঁটা বিঁধছে তার সারা গায়ে। অবশ হয়ে আসা দেহে ছড়িয়ে পড়া বিষের প্রকোপ তিনি স্পষ্ট টের পাচ্ছেন। আশেপাশে কোথাও কেউ নেই। তিনি চিৎকার করে ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে গেছেন। গলাও গেছে ভেঙে। ভাঙা গলায় এখন চিঁ চিঁ শব্দে ফরিদা বানুকে ডাকছেন। গলায় এত অল্প আওয়াজ হচ্ছে যে শামসুল আলম নিজেই ঠিকমতো শুনতে পাচ্ছেন না। প্রাণপণ চেষ্টা করেও তিনি উঁচু গলায় কাউকে ডাকতে পারছেন না। এদিকে শত শত শুঁয়োপোকার বিষাক্ত কাঁটা প্রতি সেকেন্ডে বিঁধছে তার গায়ে। মেঝে বেয়ে বেয়ে আরও শত শত শুঁয়োপোকা ধীরে ধীরে তার হাত পা বেয়ে তার নগ্ন গায়ে উঠে কিলবিল করছে। দুই কানে দুটি শুঁয়োপোকা অনায়াসে ঢুকে যাচ্ছে। অথচ তার মাথাটা বিছানায় এমনভাবে আটকে আছে যে তিনি মাথা নাড়তে পারছেন না। শরীরের সব শক্তি দিয়ে চেষ্টা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না।
এমন সময় দুঃস্বপ্ন কেটে ঘুম ভেঙে গেলে শামসুল আলম উঠে বসলেন। ঘামে ভিজে সারা গা চুপচুপে হয়ে গেছে। তিনি ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছেন। ডান হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে স্ত্রীর ঘুম ভাঙালেন। কাঁচা ঘুম ভাঙা চোখে ফরিদা বানু বললেন, কী হইছে?
পানি কই? শামসুল আলম মিনমিন করে বললেন।
ফরিদা বানু গ্লাস ভরে পানি খেতে দিলেন স্বামীকে। বিছানা থেকে নেমে সিলিংফ্যানের গতি বাড়িয়ে দিলেন। গামছা ভিজিয়ে স্বামীর গা মুছে দিলেন।
শামসুল আলমের বাকি রাতটুকু নির্ঘুম কাটাতে হলো। বারান্দায় পাতা চেয়ারে বসে দিব্যি জেগে রইলেন। সকাল হতে হতে তার শরীরমনে অবসাদ ঘিরে ধরেছে। গোসল করার পর শরীরটা কিছুটা ঝরঝরে লাগলে বাজারে গেলেও দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসেন বাড়িতে। খাওয়া দাওয়া সেরে গত দুই রাতের বকেয়া ঘুম চোখে নিয়ে বিছানায় গেলেন। মিনিট দশেক যেতে না যেতেই ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠে একা একাই বসে রইলেন বিছানায়। আবারও তিনি দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। জেগে উঠেও স্বপ্নে দেখা ঘটনাটা তার চোখে ছায়াছবির মতো ভাসছে।
তিনি বাসে চড়ে ঢাকায় যাচ্ছেন। হঠাৎ খেয়াল করলেন তার দুইপায়ের আশেপাশে অসংখ্য কালো পিঁপড়া জড়ো হয়ে গেছে। অনুভব করলেন কয়েকটা পিঁপড়া তার গলা বেয়ে মুখ ছেয়ে ফেলেছে। হাত দিয়ে মুখের পিঁপড়াদের মারতে গিয়ে দেখলেন দুই হাতজুড়ে পিঁপড়াদের রঙে কালো হয়ে গেছে। ততক্ষণে তার সারা গায়ে কালো পিঁপড়াগুলো কামড়াতে শুরু করেছে। দলবেঁধে ওরা শামসুল আলমের দুই কানে ও নাকের ফুটোয় ঢুকে পড়েছে। তিনি সাহয্যের জন্য চিৎকার করে যাচ্ছেন। কিন্তু কোনো যাত্রী তার চিৎকার শুনতে পারছেন না। এরইমধ্যে তার মুখেও একদল পিঁপড়া ঢুকে পড়েছে। তিনি রাগের বশে কচকচ শব্দে মুখভর্তি কালো পিঁপড়া কামড়ে খাচ্ছেন।
এ পর্যন্ত মনে করে তিনি ডান হাতের আঙুল বাঁ কানে ঢুকিয়ে পরখ করলেন। না, এমন কিছু বাস্তবে হবে না কখনও। এটা শুধুই দুঃস্বপ্ন। বিছানায় বসেই উবু হয়ে মেঝেতে তাকালেন। না, পিঁপড়ার নামগন্ধও তো নেই।
সন্ধ্যা পর্যন্ত তার শরীরটা মেজমেজ করলেও সন্ধ্যার পরই সব অবসাদ দূর হয়ে যায়। খবরটা তাকে দিয়েছে সুলতানের সহচর বরকত। মজিদের লাশটা ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে পড়ে থাকতে দেখে কয়েকজন ধরাধরি করে মজিদের বাড়িতে নিয়ে গেছে। বরকতের মুখে এই খবর শুনে তিনি আগ্রহ করে আরও একটা খবর জানতে চায়—মজিদের বউটার এখন কী হবে?
বরকতের খুব পছন্দ হয় শামসুল আলমের প্রশ্নটা। সুলতানের পিশাচের মতো হাসি সেখানে উপস্থিত সবাইকে এ প্রশ্নের জবাব মিলিয়ে দেয়। সময় নষ্ট না করে তখনই সুলতান চলে যায় মজিদের বাড়িতে। এলাকাবাসীকে একত্রিত করে অল্প সময়ের মধ্যে দাফন করে মজিদের লাশ। সব শেষ হয়ে গেলে সবাই যখন চলে যায় তখন দুই একর ফসলি জমির এক কোণায় গড়ে তোলা দোচালা ঘরে মজিদের বউটা ভয়ে জড়সড় হয়ে মানবজন্মকে ঘৃণা করতে শিখে যায়।
মরাবাড়িতে রাত বাড়ার সাথে সাথে শোকের সাথে পাল্লা দিয়ে মজিদের বউটার আতংক বাড়তে থাকে। শামসুল আলম যখন সুলতান ও তার সহচরকে নিয়ে এ বাড়িতে আসে তখন রাত গভীর। যতটা উন্মাদনা ও পাশবিক সুখ নিজের মনে অনুভব করতে করতে শামসুল আলম এসেছিলেন এখানে, কোথায় যেন সেসব উবে গেলো হঠাৎ। কাঁদতে কাঁদতে কাজল লেপ্টে যাওয়া চোখে মজিদের বউ ভয়ে ভয়ে তাকায় শামসুল আলমের দিকে। এলোমেলো শাড়ি দুই হাতে ঠিক করে নেয়। মহাজনকে ঘরের ভেতরে রেখে সুলতান ও তার সহচর এরইমধ্যে বাইরে চলে গেছে। সুনসান এই ঘরে আর কেউ নেই। তবু শামসুল আলম তার শরীরে কেমন অস্বস্থি বোধ করেন। তার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে, ঘুমে দুই চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায়। তার এক্ষুনি বাড়ি যাওয়া দরকার। ঘুমানো দরকার। কতদিন তিনি শান্তিতে ঘুমান না। ঢুলুঢুলু চোখে মহাজনকে বেরিয়ে আসতে দেখে ওরা এগিয়ে আসতেই তিনি বলেন, বাড়িত চল্।
মনের অনিচ্ছায় ওরাও চলে যায় শামসুল আলমের সাথে।
চার.
শামসুল আলমের ঘুম যখন ভাঙে তখন রাত বেশি গড়ায়নি। একটু আগেই তো ঘুমিয়েছেন। তিনি দেয়ালঘড়ি দেখেন। পনেরো মিনিটের বেশি হয়নি। এরই মধ্যে দীর্ঘ একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নের ঘটনা তার ঠিক মনে নেই। কিন্তু মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া আতঙ্ক এখনো স্পষ্ট। বিছানা থেকে নেমে নিজেই পানি ঢালেন গ্লাসে। ঘরের ভেতরেই পায়চারি করেন। এত লম্বা রাত এক সময় ফুরিয়ে প্রতিদিনের মতোই সকাল হয়। তিনি সকাল সকাল খবর পাঠান গনি কবিরাজকে। সব শুনে গনি কবিরাজ শামসুল আলমের হাতের কব্জিতে একটা তাবিজ বেঁধে দেন। মাথায় ফু দিয়ে দেন। সারা বাড়িতে পানি ছিটিয়ে বাড়ির দোষ দূর করে দেন। শামসুল আলমের একনিষ্ঠ ভক্ত গনি কবিরাজ তার কাজ সেরে চলে গেলে শামসুল আলম যখন গোসল করলেন তখন তার শরীরটা ফুরফুরে। এটা কি তার হাতে পরা তাবিজের কেরামতি কিনা তা তিনি বুঝতে পারেন না।
মেয়ে ফাল্গুনী বাপের বাড়ি এসে মায়ের কাছে শুনল তার বাপ আজকাল ঘুমান না। সারারাত বারান্দায় বসে বসে কী যেন ভাবেন। দুই মা-মেয়ে মিলে কিছুতেই বুঝতে পারে না কী এতো ভাবেন শামসুল আলম। আজকাল শামসুল আলমের মেজাজটাও থাকে খটমটে। তাই সাহস করে জিগ্যেস করতে পারেনি ফরিদা বানু। ফাল্গুনীও বাপের মেজাজগতিক দেখে এ বিষয়ে আর কথা না বলে মায়ের সাথেই কথা বলতে থাকে।
শামসুল আলম গতদিনের মতো দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরেই নিজের ঘরে ঘুমিয়ে পড়লেন। বিকাল হতে হতে কাঁপুনি দিয়ে তার জ্বর আসে। ফরিদা বানু আর ফাল্গুনী তাকে কাঁথা দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে। রাতে কাঁপুনি কমলেও জ্বর কমে না। সারা রাত একটু পর পর বমি হয়।
শামসুল আলম টানা সাতদিন গায়ে জ্বর নিয়ে শুয়ে থাকলেন আর দিনে কয়েকবার করে বমি করলেন। সাতদিন পর শামসুল আলমকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করানো হলো। ডাক্তাররা নানা রকম পরিক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। চিকিৎসায় জ্বর আর বমি কমে গেলেও ঘুমের অষুধ খেয়েও ঘুম হচ্ছে না শুনে ডাক্তাররা প্রেসক্রিপশনে আরেকটি ঘুমের অষুধ লিখে দিলেন। স্বপ্নের ব্যাপারটা ডাক্তারকে বলতেই ডাক্তারটি মুচকি হেসে বললেন,‘কোনো কিছু নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করবেন না। তাহলেই আর এমন স্বপ্ন দেখবেন না।’
শামসুল আলম আর কিছু বলেন না। দিনের বেলা তার পাশে অনেকেই থাকে। তার সময় কেটেই যায়। কিন্তু এই হাসপাতালে খুব ক্লান্তিকর দীর্ঘ রাত নামে। নির্ঘুম শুয়ে থেকে সেসব রাত তার কাটতে চায় না।