-বিন্দি, মন খারাপ করে বসে আছিস যে?
-চায়না, একটা ব্যাপার খুবই পীড়া দিচ্ছে।
-কোন ব্যাপার?
-সকালে বাজারে যাওয়ার সময় রাস্তায় রূপা নামের একজনের সাথে দেখা হয়। সে আমার বান্ধবী তিস্তার পরিচিত। তিস্তাই তার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় আমাদের দুজনেরই পরিচিত ছিল সে। তার কাছ থেকেই বান্ধবীর পরিবারের কথা জানতে পাই। তখন থেকেই মনটা খারাপ।
-কী শুনলি, যা মন খারাপ করে দিলো?
-অনেক কথা।
-শেয়ার করতে পারিস।
-শুনলে তোরও মন খারাপ হয়ে যাবে। থাক। না শোনাই ভালো।
-আরে বলে ফেল। কোনো অসুবিধা নাই।
-শোন, তিস্তার দাদু থাকে কলকাতায়। মাঝেমধ্যে সে দাদুকে চিঠি লেখে। অনলাইন আর ফোনেও কথা বলে। কয়দিন আগে একটা চিঠি লেখে।
প্রিয় দাদু,
বলো তো একজন মেয়ে যদি তার স্বপ্ন নিয়ে একা বাঁচতে চায়, তাহলে দোষের কী আছে? বুঝি না। সমাজ কেন তাকে নিয়ে এত মাথা ঘামাবে? সবাইকে কেন একই রাস্তায় হাঁটতে হবে? সবার পথ এক না-ও হতে পারে। এটা তার নিজস্ব ব্যাপার। প্রত্যেক দিন ভোরে সূর্যপ্রণাম করার সময় ভেতরটা কেমন হালকা হয়ে যায়। পচন আর ক্ষয়ের মধ্যে বাস করতে হচ্ছে। শুধু টিকে থাকার জন্য মেনে আর মানিয়ে নিতে হচ্ছে শত অন্যায়। মুখ খুলে কিছুই বলা যাচ্ছে না। বুকের মধ্যে এক দাবিয়ে রাখা গোঙানি, নাই তার ভাষা। কেই বা দিবে ভাষা? তবে যে শুনেছিলাম, পাপের ঘড়া ভরে উঠলে ঈশ্বর আবির্ভূত হন! তবে কি এখনো পূর্ণ হয় নাই সে ঘড়া? দাদু, যে দেশে জন্মেছি, সে দেশেই ভীষণ যন্ত্রণায় জ্বলছি।
ইতি
তোমার নাতনি
তিস্তা মুখার্জি
ঢাকা, বাংলাদেশ।
খ
তিস্তার এই চিঠি দাদু সুশীলের মনে অনেক কথাই উসকে দেয়। মনে করতে থাকে এদেশে কিভাবে এলো, সেই হিসাব। সে আসতে চায়নি; তাকে আসতে হয়েছে। কেউ কি চায় জন্মস্থান ছেড়ে অন্য, অচেনা মানুষ, অচেনা বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে? চায় না। সেও চায়নি। তাকে প্রত্যেকদিন শুনতে হয়েছে, তোমরা কি ইন্ডিয়া দেইখপার পান না? ইন্ডিয়া চলি যান। সুশীল অবাক হয়ে ভাবে, দেশ যেমন অন্য ধর্মের লোকদের, তেমনি সুশীলেরও। তারা থাকতে পারলে কেন সে থাকতে পাবে না? কেন তাকে হুমকি দিয়ে যাবে? তারা তো পাড়া-প্রতিবেশী। দিনের বেলা যদি কাজের জন্য একসঙ্গে না হতে পারে, তো সন্ধ্যায় একসঙ্গে বসে চা খায়। আলাপ হয়, তোর কেমন আলু হইলো? হইছে এত বস্তা। তোর কেমন আলু হইলো? অ্যাকনা কম হইছে। একপ্লেটেও খায়। অথচ তারাই বাজারে আগুন দেয়। বাড়িতে টিনের চালে ঢিল ছোড়ে। মারধর করে। বলে যায়, আমরা সেম্পল দিয়ে গেলাম। আরেকবার আসলে শ্মশান বানায়া দিবো। কেস করলে তোমাদের অস্তিত্বই রাখবো না। তারা ভোটও দিতে যেতে পারতো না। একদল বলে যায়, তোমরা ভোট দিতে যাবা না। আরেকদল বলে, যাবে। ভোট দিতে যেতে না পারলে। বিরুদ্ধ দল জিতলে বলদো, এই মালাউন ব্যাটারা ভোট দেয় নাই। ধরো। মারো। তাদের অধিকার নাই কিছু বলার। কিছু করার। ’৭১-এর যুদ্ধে অংশ নিয়ে তারাও দেশকে বিপদমুক্ত করেছে।
আর আজ তাদের দেশ ছাড়ার কথা বলে যায়। ঘরে আগুন দেয়, তার মাকে মারে। মায়ের কান্নার আওয়াজ এখনো কানে বাজে, চারজন মানুষ আসি মোক কইছে কানের সোনা খুলি দ্যাও। ছিঁড়িছুটি খুলি দিছি। ইটা নাগছে পিটিত। কোনো পাকে যাবার পাং নাই। ঘরোত আছনু। মুই যদি মরি গেনু হয় তাইলে ভালো আছিল। কয়টা দিন থাকি কান্দি কান্দি আছং। ভল ভল করি আগুন উঠি ঘর পোড়াইছে। বেরবার পাং না বায়ো। পাওত ঘা। কোমরত বিষ। ডাক্তার নাই। পাইসা নাই। খাবার পাং না। বা, ও বায়ো, ও মায়ো কী করে থাকমো মায়ো। তিস্তার দাদু নিজের শোক কমাতে ঢেপা নদীতে যায়। গিয়ে দেখে নদীরও মনে অনেক শোক জমা। নদীতে কোনো পানি নাই। চর জেগেছে। মানুষ কোদালের আঘাতে তার বুক চিঁড়ছে। ট্রাক ভর্তি করে বালু তুলছে। পাঠাচ্ছে শহরে। কামাচ্ছে টাকা। তার মতো নদীরও করবার বা বলবার কিছু নাই। কেবল তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। কবে বৃষ্টি হবে। তার শুকনা বুক পানিতে ভরবে। সে বীভৎস স্মৃতি নিয়ে রুমে হাঁটাহাঁটি করে।
বান্ধবী অফিস থেকে ফিরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার আকাশে চোখ রাখে। দেখতে দেখতে ভরা জ্যোৎস্না মেঘে ঢেকে যায়। সেও রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে টুলে এক পা, আরেক পা মেঝেতে রেখে গুনতে বসে শৈশব-কৈশোরের জীবন। বাড়ি থেকে স্কুল দূর হওয়ায় যাতায়াতের অন্য ব্যবস্থা না থাকলে তাকে সাইকেল চালিয়ে যেতে হতো। ভালোভাবে যে আসতে পেতো, তা না। সাইকেল ঘিরে ধরতো কিছু পোলা। বলতো, কী রে তোদের দেবীরা শরীর দেখায়া বেড়ায় বলে তুইও তাই করছিস। (১ম জন)
-না রে শোন, ওরা যত শরীর দেখাবে তত বাড়বে। (২য় জন)
-হাঁচা কইছোস, আমি কই জানি শুনছি এই কথা। (৩য় জন)
-পথ ছাড়, ক্লাস শুরু হয়া যাইবো।
-একটু যত্ন নিয়া বল, এমন ফালপাড়স ক্যান? (সবাই মিলে, একসঙ্গে)
-যত্ন? তগরে জুতামু, যাইতে দে।
-আহা রে মাইয়ার ভাব কত! তেজ কত! এত লাফাস ক্যান? আয়, একটু আদর করবি। (সবাই মিলে, একসঙ্গে)
-তগোর সাহস তো কম না, মুখে যা আইতাছে তাই কইতাছস।
-তো কী হইছে? তগোর তো দুধ দিয়া গোসল করায়া পূজা দিলেই পবিত্র হয়া যাস। (সবাই মিলে, একসঙ্গে)
সেদিন বাজার থেকে তিস্তার পরিচিত কয়েকজন ফিরছিল বলে অল্প সময়ের জন্য হলেও রেহাই পায় তাদের হাত থেকে। যদিও এই রেহাই পুরাপুরি হয়নি। ক্লাস শেষে ফেরার পথে দেখে তার সাইকেলের চাকায় ‘হাওয়া’ নেই। ওই ছেলেরা ছেড়ে দিয়েছে। পুকুরে গোসল করতে যেতে পারতো না। কিছু পোলা চেয়ে থাকতো। দেখতো তাকে। একজন তো গোসল শেষ করে ঘরে যেতেই ঢুকে। বলে, তরে তো হেব্বি লাগছে।
-তুই আমার ঘরে ক্যান?
-শুনছি, তোর নাকি বিয়া হইয়া যাইবো। চইলা যাইবি আরেক দ্যাশে। তরে এতদিন ধইরা চোখ চোখ কইরা রাখলাম। আর এখন উড়াল দিবি।
ঘর থাইকা বাইর হ।
-যাইয়াম তো, একটু কাছে আয়, দেহি কতটা পাকছোস।
বার বুঝি থেমে যাবো। এমন কিছু পরিস্থিতির ভিতর পড়ে যাই সত্যিই বুঝি না কী করবো।
তিস্তার বড় দাদা কাজ শেষে বাড়িতে ফিরলে দৌড়ে পালায় কামরুল। রাতে বিচার বসে। বিচার হয়। ছেলে আসে না। মেম্বার, চেয়ারম্যান ছেলের বাপের হাতে। আগেই তাদের ম্যানেজ করেছে। চেয়ারম্যান লোক দেখানো বিচারে কামরুলের বাপকে বলে, ভাতিজা, তোমরা বিশ হাজার ট্যাকা ছাড়ো।
-হামার ছাওয়া তো লাগায় নাই ওমার মাইয়াক, তাইলে ট্যাকা দেইম ক্যা?
-আরে তোমার ছাওয়া তো ঢুকছিল ওমার ঘরত। ভিনজাতির ঘরত। দ্যাও ট্যাকা মিটি যাক। হামরায় হামরায় তো।
চেয়ারম্যানের চাপাচাপিতে সে টাকা দিতে রাজি হয়, কিন্তু পরে আর দেয় না। সম্মান বিক্রি হয় বিশ হাজার টাকায়। তিস্তা অপমানবোধ করে। কলেজজীবন শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এখানেও সে শান্তি পায় না। লোকনাথের ছবি দেয়ালে টাঙাতে পারে না। টেবিলেও রাখতে পারে না। বের করে। পূজা শেষে আবার ট্রাংকে রাখতে হয়। দেয়ালে রাখলে রুমমেটের নামাজ পড়তে অসুবিধা। ফেরেস্তা আসে না ঘরে। তাই খাটের নিচেই রাখতে হয়। তার গানের গলা ছিল বেশ। গাইতো। রেওয়াজ করা দরকার ছিল। রেওয়াজে বসলে পাশের রুম থেকে তার বান্ধবী বলতো, তোমার সময় জ্ঞান নাই গান গাওয়ার। এখন সন্ধ্যার নামাজের সময়। আর তুমি ঢং শুরু করছো। না, তার আর গাওয়া হয় না গান। সেই যে গান ছেড়েছে। আর ফেরা হয়নি।
দাদুর ফোনে সে ফেরে বর্তমানে।
-হ্যালো,
-দিদি ভাই, মন খারাপ? স্বর অমন ভেজা ভেজা লাগছে ক্যানো?
-একটু। বলো কেমন আছ?
-চলে যাচ্ছে। মন খারাপ করে না। বিপদ আসপে জেনে আরও শক্ত হও।
-শক্ত হতে হতে অঙ্গার হবার দশা।
-দিদিভাই, তোমাকে আমার জীবনের একটা গল্প বলি। তখন তুমি অনেক ছোট। তোমার পিসিরে বিয়া দিব যেইদিন, সেইদিন চিঠি আসলো যে আমার একটা ক্ষেত অর্পিত সম্পত্তি নামে আরেকজন দখলে নিছে। সেইদিনই আমি দৌড়ায়া যাই উকিলের কাছে, বিষয়টা বুঝি। বুঝি আরো অনেকের কাছে। একদিকে বিয়ার আয়োজন, আরেকদিকে এই যন্ত্রণা। বিয়া পার হয়, আমার কাজও হাসিল হয়। আমারে, পুরা পরিবারটারে টেনশনে রাখপে এটাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। তাই করেছে। বুড়া মানুষটারে কোর্ট-কাচারির পথে রাখছে। দৌড়াইছি। তারা দেখছে, শান্তি পাইছে। তাদের হয়া বাকিরা শান্তি আরও বাড়ায়। আমার বাড়ির তিনপাশে আছিল অন্য ধর্মের মানুষ। তারা প্রত্যেক বছর কয়েক ইঞ্চি কইরা সীমানা বাড়াইতো। এমন করতে করতে দেখি তিনদিক থাইকা তিনফুট কইরা জমি নাই। তারা আমার জমিনে খাড়া করছে সীমানা প্রাচীর। একটা বাড়িতে দশজন মানুষের ঘরে দুইটা কইরা সন্তান আসে। হয় বিশজন। তাদের থাকার জায়গা দিতে গিয়া আমার বাড়ির সীমানা কমায়। আমার বাড়িতে গরুর মাংস খায়া হাড় ঢেল দিতো।
-দাদু, আমাদের দেশে আমরা নিরাপদ না। তুমি শঙ্কায় ছিলা যে, পরের প্রজন্ম কেমন থাকবে তার জন্মভূমিতে? দেখো তোমার জীবনকালেই দেখো, আমরা কত সুখে আছি। শরৎ আসছে। আকাশে তুলার মতো সাদা মেঘ। স্বচ্ছ নীল আকাশ। কাশফুল। শিউলি। জ্যোৎস্না। এসবের কারণেই এই ঋতু আমার ভালো লাগে। সারা বছর অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু এই শরৎ এবার আমার কাছে ধুলিধূসর। শুধুই ধূসর।
-দেখো, চাকরিটা টিকায়া রাইখা, কষ্ট সহ্য কইরা কইরা থাকতে পারো কি না।
-দাদু, চাকরিতে যাবার পথে বাসে, সিএনজিতে শুনতে পাই, একবার খালি ক্ষমতায় আইসপার পাই, তোমাগরে টুকায়া টুকায়া মারবো। বাইরে চলাও এখন রিস্ক। শাখা-সিঁদুর দেখলে তো কথাই নাই। কী নাতে কী বলবো, হুশ থাকে না।
লাইন কেটে গেলে তিস্তা নিজেই নিজের মাঝে বিড় বিড় করতে থাকে, ‘এই শহরে আমার কতজন আপন আছে? চেনা আছে কতজন? আমার খারাপ খবর জেনে কে কে আসবে? আমি ভালো নেই শুনলে কে কে মন খারাপ করবে? আমার একটা রুমের দরকার। যিনি আমাকে থাকতে দেবেন তিনি যখন আমার লোকাল অভিভাবকের নাম ঠিকানা দিতে বললেন। আমি একটু চিন্তা করে দেখলাম কার নাম দিবো? কতগুলো আপন মুখ আমার চোখের সামনে এসে গেলো। যে আমার থেকে দুই কদম দূরে সে কাছের? না, যে অনেক অনেক দূরে, আমার কথা দিনান্তে একবার ভাবে সে কাছের (আমার অফিস কলিগ ছাড়া)? আমরা যারা একলা চলি। একলা থাকি। আমাদের কি আসলেই কোনো লোকাল অভিভাবক আছে? বা দরকার পড়ে? উনি ভালো মানুষ, ভদ্র মানুষ তাই বলেনি কেন এতদিনে বিয়ে করোনি? কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে কি না? অনেক অনেক বাধা পেরিয়ে আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু মাঝে মধ্যেই মনে হয় আর পারবো না। এবার বুঝি থেমে যাবো। এমন কিছু পরিস্থিতির ভিতর পড়ে যাই সত্যিই বুঝি না কী করবো।’ কিছু শব্দে সুর দিয়ে টেনে টেনে পড়তে থাকে,
মেয়ে তুমি খারাপ, প্রজন্মচতত্তরে যাও বলে
মেয়ে তুমি খারাপ ৫৭ ধারা চাওনা বলে
মেয়ে তুমি খারাপ যৌন-নির্যাতন নিয়ে প্রতিবাদ করো বলে
মেয়ে তুমি খারাপ একলা থাকো বলে
মেয়ে তুমি খারাপ তোমার চেতনা একটু আলাদা বলে
মেয়ে তুমি খারাপ সমকামিতা সমর্থন করো বলে
মেয়ে তুমি খারাপ বিয়ে করোনি বলে
মেয়ে তুমি খারাপ…।’
গ
তিস্তা সকালে অফিস যাবে, সিএনজির জন্য অপেক্ষা করছে। সিএনজি এলে, ওঠে। দেখে ভেতরে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধু। অনেকদিন পর দেখা। দুজনে কথা বলে। অনেক কথা হয়। তিস্তা বলে, দেখেছো দেশে কী হারে চাপাতির ব্যবহার বেড়েছে?
-আচ্ছা, তুমি চাপাতির ভয় করো কেন? কেন করো বলো তো?
-ভয় নয়, নরপশুদের কাজ-কাম দেখে অবাক হই। আমরা যাঁতাকলে আছি ওই নামটার কারণেই। তুমি দেখো হুমায়ুন আজাদের পর যারা আততায়ীর হাতে খুন হয়েছে, তাদের অধিকাংশই আমাদের ধর্মের। অভিজিৎ, অনন্ত, নিলয় এরা কোন ধর্মের জানো? অবশ্য তারা ধর্ম-টর্ম মানতো না। ওই যে নাম।
এই মাটিটুকু বদলের চক্রে ফেলে জানবে, মাটিটুকুই আমার দেশ। আমার সমাজ। আমার পরিবেশ। আমার আত্মীয়। আমার প্রতিবেশী। আমার শৈশব-কৈশোর-যৌবন আর শেষ বেলা।
-নাম, না উলট-পালট লিখেছে বলেই খুন হয়েছে? তারা ধর্ম মানে না সেকথা ঠিক আছে। কিন্তু ধর্ম নিয়ে খোঁচাখুঁচি করে কেন? দুনিয়ায় অনেক বিষয় আছে লেখার জন্য। কেবল নাবালকের মতো ওইসব নিয়েই জ্বলতে হবে, জ্বালাতে হবে। এটা কি লেখক অভিধানে লেখা আছে?
-ভারতে দেখো, পিকে মুভি দেখো, সেখানে সনাতন ধর্ম নিয়ে কিভাবে দেখিয়েছে? কই সেখানে তো পরিচালক খুন হলো না। চাপাতির ব্যবহার তো দেখতে পেলাম না?
-দেখো তারা ধর্ম নিয়ে চালু থাকা কুসংস্কার নিয়ে বলেছে। ইসলাম ধর্মেরও তো পীরপূজা আছে, মাজার প্রেম আছে এসব নিয়ে লিখতে পারো। তোমরা নবিকে নিয়ে বেহুদা বকো কেন?
-আমরা মূর্তিপূজা করি, কেন করি এই পূজা, সে নিয়ে প্রশ্ন তোলো কেন? জানো এটা আমাদের জন্য কত অপমানের? আমাদের দেশে আমরা নিজের ধর্ম পালন করবো, তোমরা কেন সেখানে বাধা দেবে? তোমরা গরু খাওনা। অথচ গরুর দুধ খাও! জন্মের সময় গোবর খাও। এসব বলো কেন? রক্ত ঝরানোটাই কি সমাধান? মানবিকতাটা কোথায় গেলো? তোমরাও লিখো। দেখাও। তা করবে না।
-আর এজন্যই কী তোমরা অন্য ধর্ম নিয়ে এটা-ওটা লিখবে?
-আমরা স্বাধীনভাবে কিছু লিখতে পারি না। ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাসও দিতে পারি না। আমি ঢাকায় বসে লিখছি, হয়তো আমার খুব বেশি ক্ষতি হবে না। কিন্তু এর প্রভাব পড়বে আমার পরিবারের ওপর। তারা ঘুমাতে পারবে না, কখন এর জন্য কাউকে হারাতে হয়। সেদিন কানাডা থেকে একজন আমায় ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। বন্ধু হয়। কেবল আমাকে এটা বলতে যে, তুমি এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করো না। আমি চাই না, আমার আরেকজন স্বজাতি হারাক। বুঝলে তো, এই দেশে অল্প কয়জন হিন্দু কত সংশয় আর সংকট নিয়ে বেঁচে আছে।
সেদিনের মতো তিস্তা বিদায় নেয় অফিসের কাছাকাছি এলে। অফিস থেকে ফিরে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করতে করতে স্মৃতি হাতড়ে আবার চলে যায় পেছনে। সে সময় একটু গল্ডগোল লাগলে আমি আর ছোট বোন চলে যেতাম দাদু বাড়ি। এখন দাদুও পরদেশে। আমি যাবো কোথায়? এই দেশে আমি মালাউন, সংখ্যালঘু। আর ওই দেশে গেলে আমাকে রিফুজি বলবে। তাহলে আমার দেশ কোনটা? তিস্তার দাদু সম্পত্তি কমানোর জন্য বিক্রি করবে। এর কাছে যায়। ওর কাছে যায়। এক ব্যবসায়ীকে বলে, সংসারে টান-টোন পড়েছে। জমি কিছু বিক্রি করতে চাই। কিনতে চাও?
-কাকা, কোনো অসুবিধা নাই। আমরা নিবো। বলেন কত কইরা দিতে হইবো?
-বাজার হিসাবে দিবা।
-ঠিক আছে, পাইবেন।
‘পাইবেন’, আর পাওয়ায় থাকে না। সংসার চালানোয় না, জমি বিক্রি করে দেশ ছাড়বে জানতে পেলে সে আর জমি কেনে না। অন্যকেও কিনতে দেয় না। এ অবস্থায় একদিন হাট থেকে ফেরার পথে তিস্তার দাদু শুনতে পায় তাদের আলাপ, শোনো, তোমরা কেউ জমি কিনবা না। খালি একটু প্রেসারে রাখবা। সে আজ হোক, কাল হোক, চইলা যাইবোই। তাইলে জমি তো আমাদেরই। জমি তাদেরই হয়। বিক্রি করতে না পেরে তার দাদু জমি রেখেই চলে যায় কলকাতায়। যেতে হয়। যাওয়ার সময় তিনি যে ঘরে থাকতেন, সেই ঘর থেকে এক মুঠু মাটি সঙ্গে নিয়ে যান। দেশ বদলে যাচ্ছে, সমাজ বদলে যাচ্ছে, পরিবেশ বদলে যাচ্ছে। এই মাটিটুকু বদলের চক্রে ফেলে জানবে, মাটিটুকুই আমার দেশ। আমার সমাজ। আমার পরিবেশ। আমার আত্মীয়। আমার প্রতিবেশী। আমার শৈশব-কৈশোর-যৌবন আর শেষ বেলা।
ঘ
-বিন্দি, সত্য সত্যই ঘটনাটা কষ্টের। মন খারাপের।
-একটা সময় দেখবি এদেশে হিন্দু-টিন্দু খুঁজেই পাওয়া যাবে না। হয় মরবে, না-হয় দেশ ছাড়বে।
-হুম।পরিস্থিতি তো একথাই বলে দিচ্ছে।