সেবার বেশ বন্যা হয়েছিল। আমার ভাড়া বাসার ছোট্ট আঙিনাটি জলে টইটুম্বুর। গিন্নীর যত্নে লাগানো বাগানবিলাস, হাসনেহেনা, নয়ন তারার টবগুলো দাঁড়িয়ে আছে গলা পানিতে। আসন্ন বিপদের শঙ্কায় সেগুলো নিয়ে আসা হচ্ছে বারান্দায়। এ কাজে গিন্নীর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন বাসার ক্ষুদে পাইক-পেয়াদাবৃন্দও। কিন্তু সেখানেও আশ্রয় নিয়েছে বেয়াড়া জলরাশি। সময় ভেদে কয়েক সেন্টিমিটার পর্যন্ত পুরুত্ব পায় জলের দখলদারিত্ব। বাতাসে ঢেউ ওঠে, দেয়ালে ধাক্কা খায়। প্রভাতী সূর্যের চিকচিকে আলোর সঙ্গে খেলা করে ঢেউগুলো, লাস্যময়ী খেলা। ঘরে বসে সৈকতের রূপ দর্শনের কী অপূর্ব সুযোগ! কর্মজীবী মানুষের অন্নযুদ্ধের চিন্তা মাথা থেকে বাদ দেওয়া গেলে সময়টা মন্দ নয়। কিন্তু সদ্য বদলি হওয়া কর্মস্থলে নয়টায় পৌঁছার লক্ষ্যে প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে উঠতে হয়, হাঁটুপানি ডিঙিয়ে সামিল হতে হয় সেই অন্নযুদ্ধে। মাঝে মাঝে দুই-একটি সর্প শাবক ভেল্কী দিয়ে যায়। ঢোঁড়া সাপের বিষ নেই তো কী হয়েছে, ভয় তো আছে। সাপের বিষ আগে রক্তে মেশে, তারপর যায় হৃদযন্ত্রে। আর ভয় তো সোজাসুজি হানা দেয় হৃদকুটিরের অন্দর মহলে, কয়েক কিলোমিটার বেগে। সারা বিশ্বে সাপের কামড়ে যে পরিমাণ মানুষ মরে তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সাপের বিষে মরে না, মরে ভয়ে স্ট্রোক করে। এ পরিসংখ্যান আমার নয়, সহকর্মী ওয়াইল্ড রিসার্চার রাসেল সাহেবের।
পাশের ডোবা সদৃশ পুকুরটাতে দীর্ঘদিন ধরে জীর্ণশীর্ণ হয়ে থাকা মাছগুলোও প্রাণ পেয়েছে এ বন্যায়। রবি বাবুর ভাষায়, ‘মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে /এখন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে।’ মাঝে মাঝে সেই জলক্রীড়া পৌঁছে যায় আমার বারান্দা অবধি। সদ্য মা হওয়া টাকি মাছটিও শ’তিনেক নবজাতক নিয়ে ঢুঁ মেরে যায় সেখানে। মনুষ্যসন্তানরাও সে আনন্দে শামিল হয়। বিস্কুট, মুড়ি, চিপস ছিটিয়ে ভিন জগতের অতিথিদের আপ্যায়নের চেষ্টা চালায় সাধ্যমতো। সে অতিথিশালায় গতকাল থেকে আরেক জনের আবির্ভাব হয়েছে। তিনি মিসেস ডগি। তাকে নিয়েই আজকের এই অহেতুক প্যাঁচাল।
রাত দু’টার দিকে প্রচণ্ড গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। দরজা খুলে দেখি সিঁড়ির পাশে পড়ে আছে একটি আহত কুকুর। দেহের অর্ধেকটা পানিতে, মাথা তুলে বারন্দায় ওঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু গেট বন্ধ, উঠবে কী করে? পেছনের পায়ে একটি বড় রকমের জখম, ঘেমে ঘেমে রক্ত পড়ছে সেই ঘা থেকে। এই অর্ধমৃত নোংরা প্রাণীটি যদি রাতের মধ্যে মরে যায়, তবে তার লাশ কোথায় সৎকার করব, সে ভয়ে গেট খুলতে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। গিন্নীর জোরাজোরিতে শেষে খুলে দিলাম। সে তার শখের টবগুলোও সরাতে রাজি হলো। মনে হলো পাঁচ বছর ধরে সাজানো বাগানটির চাইতে এই মুহূর্তে বেওয়ারিশ কুকুরটিই বেশি গুরুত্ব পেয়ে গেলো তার কাছে। সদ্য কেনা আসবাবপত্রের প্যাকেটগুলো নিচে দিয়ে তার ওপর দু’টি ছালা বিছিয়ে দেওয়া হলো। কুকুরটির বুঝতে অসুবিধে হলো না যে, এই আতিথেয়তা তার জন্য। নিজের অর্ধ-প্যারালাইজড দেহটা টেনেটেনে সেই বিছানাটায় স্থান করে নিলো। ইনফেকশনরোধী পাউডার ছিটিয়ে দেওয়া হলো ক্ষতস্থানে। ওষুধের জ্বালাপোড়া চোখ বুঝে সহ্য করলো কুকুরটা, কোনো আপত্তি করলো না। সম্ভবত বুঝে গেছে এ যন্ত্রণা তার কল্যাণের উদ্দেশ্যে, ক্ষতির উদ্দেশ্যে নয়। কিছু খাবার এনে দিতেই গোগ্রাসে খেয়ে নিলো এতসব ব্যথা-যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে। এই বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষ আছে বিপদে, কুকুর খাবার পাবে কোথায়? হয়তো ক্ষুধাতুর হয়ে মুখ দিয়েছে কারও খাবারে কিংবা আক্রমণ করেছে কারও হাঁস মুরগীর ওপর। তাই গৃহস্থের হামলায় তার এ অবস্থা। হয়তোবা এমনি এমনিও তাকে কেউ মারতে পারে। এ ধরনের বেওয়ারিশ প্রাণীকে খামাখা আঘাত করে কেউ কেউ আবার আনন্দ পায়, বিকৃত আনন্দ। রাস্তার পাশে একটি বিড়াল ছানাকে দেখলেও কারও হাত নিশপিশ করে। হাতের কাছে যাই পায়, তাই ছুড়ে মারে, বীরত্ব দেখায়। এ ধরনের মানুষ দেখে হয়তো এ চতুষ্পদ প্রাণীরাও দাঁত কেলিয়ে হাসে। বলে, হায়রে হতভাগা, তোরা মানুষ হবি কবে?
দুই-তিন দিন পর বন্যার পানি নেমে গেলো। কুকুরটিও সুস্থ হয়ে উঠলো অবিশ্বাস্য স্বল্প সময়ে। হয়ে গেলো আমাদের নিয়মিত দারোয়ান। বেতন নেই, বোনাস নেই, কেবল সামান্য ভাতের মাড়ের বিনিময়ে সারারাত জেগে বাড়ি পাহারা দেয়। বিনা নোটিশে প্রবেশাধিকার এখন এ বাড়িতে পুরোপুরি বন্ধ। জানালা খুলে ঘুমাই, কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত আগুন্তুকের ভয় হয় না। বাচ্চাদের সঙ্গেও তার বেশ ভাব জমে উঠেছে। আদর আপ্যায়ন চলে সকাল বিকাল।খাবার পেয়ে মাথা নিচু করে, লেজ নেড়ে কৃতজ্ঞতা জানায়। বাচ্চারা এর আদুরে নাম দিয়েছে ডগি। আহসান হাবীবের ‘ধন্যবাদ’-এর ডলির মতো ডগির বড়লোকি জন্মদিন পালন হয় না বটে, যেটুকু হয়, সেটুকু যে মধ্যবিত্ত ঘরের জন্য বাড়াবাড়ি নয়—এ কথাও বলি কী করে! তার ভাষাও রপ্ত করে চলছি দিনে দিনে। অঙ্গভঙ্গি দেখে এখন খুব সহজেই বুঝতে পারি, সে কখন, কী করতে চায়। বাজারের ব্যাগ নিয়ে আসতেই সামনে এসে দাঁড়ায়। লেজ নাড়ে, মাথা নিচু করে—জানতে চায় তার জন্য কী আনা হয়েছে। বাজারের লিস্টে নিয়মিত যোগ হয় একখণ্ড পাউরুটি। পাউরুটি পেয়ে আবেগে গদগদ, লম্পঝম্প করে, নেজ নেড়ে ধন্যবাদ দেয়।
মনিবের জন্য যে প্রাণ বাজি রাখতে জানে, সে দুই টুকরো পাউরুটির কাঙাল হয়ে বিক্রি হবে—এমন বিকৃত মানসিকতা তার নেই।
দিন যায়, মাস যায়, ডগি আরও ঘনিষ্ঠ হয়। ডগি আমাকে শেখাতে থাকে কেমন করে ভালোবাসতে হয়, মনিবকে ভক্তি করতে হয়, অধিকার আদায় করে নিতে হয়, আর উপকারের প্রতিদান দিতে হয় ক্ষণেক্ষণে। অন্য কোনো কুকুরের আর এ বাড়ি স্থান হয় না। হিংসা করে সে, ভীষণ হিংসা। বোঝাতে চায়, এ বাড়ির দায়িত্ব শুধুই তার, সব অধিকার তার, এক বাটি ভাতের মাড় তার, একখণ্ড পাউরুটিও তার। অনেক সাধনা করে সে এ অধিকার অর্জন করে নিয়েছে। তাই এ বাড়ির ত্রিসীমানায় কোনো কুকুর দেখলে ঘেউ ঘেউ করে তাড়িয়ে দেয়। মাঝে মাঝে ভাবি, যদি ডগির মতো মানুষও প্রভুভক্ত হতো, তবে নশ্বর জীবনের ক্ষুদ্র আয়ুটুকু নিয়ে হয়তো এত আক্ষেপ হতো না।
বেশ কিছুদিন ধরে আমার একটি ফাইল আটকা পড়ে আছে,কোনো সুরাহা হচ্ছে না। পিয়ন মারফত জমা দিয়েছিলাম ফাইলটি। শেষমেশ নিজেকেই যেতে হলো। চেয়ারে আয়েশি ভঙ্গিতে বসা ভদ্রলোক পান চিবাতে চিবাতে বললেন, কিছু খরচাপাতি দিতে হবে। আপত্তি করলাম, বাকবিতণ্ডা হলো। শেষে বোধোদয় হলো, জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ করা যায় না। ঘুষ দিলাম না, স্রেফ স্পিড মানি! ফাইল গতি পেলো। দশ মিনিটে পূর্ণ প্রক্রিয়াজাত হয়ে সোজা আমার সামনে। অতিথিপরায়ণ ভদ্রলোক চায়ের অর্ডার করলেন। স্বচ্ছ কাপে টকটকে লাল ধূমায়িত লোভনীয় চা। ভদ্রলোকের রুচি আছে বটে; কিন্তু আমার রুচি হলো না। যে অফিসে ‘খরচাপাতি’র ব্যাপার আছে সেখানের স্বচ্ছ কাপ আমায় টানে না। উচ্চশক্তি সম্পন্ন উত্তল লেন্সের ফাঁকে তীর্যক দৃষ্টি দিয়ে আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। বললাম, আপনার মতো প্রজাতন্ত্রের সেবক। এবার তাকে কিছুটা ইতস্তত দেখালো। এমন সময় অফিসে এক তরুণের আগমন। উসকোখুসকো চেহারা, এলোমেলো চুল, কাঁধে স্কুলব্যাগ। সালাম দিয়ে আমার পদস্পর্শ করতে চাইলো। বাধা দিলাম। এ কাজ আমি পছন্দ করি না, তাদের আবেগকে শ্রদ্ধা করি, পদ্ধতিকে নয়। ছেলেটি ইউনিভার্সিটি চান্স পেয়েছে, আমার ছাত্র। অফিসের এই ভদ্রলোক তার বাবা। ছেলেটির প্রস্থান শেষে ভদ্রলোক ভীষণ লজ্জিত হলেন, ক্ষমা চাইলেন। তার ছেলের কাছ থেকে শোনা আমার অনেক গল্প (বাড়িয়েও) শোনালেন। আমি ভীষণ বিব্রত। যত দ্রুত কেটে পড়তে পারি, ততই মঙ্গল। ভদ্রলোক সেই ‘খরচাপাতি’টাও জোর করে পকেটে গুঁজে দিলেন। তার ছেলে যেন এ ঘটনা কোনো দিন না জানে তার জন্য বারবার আকুতি জানাচ্ছিলেন। বললাম, সন্তানের কাছে বাবাকে ছোট করা শিক্ষকের কাজ নয়। ফেরার পথে তিনি সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে এসে আমায় সম্মান দেখালেন। কিন্তু আমি তো ছাত্রের পিতার কাছে শিক্ষকের সম্মান চাইনি, প্রজাতন্ত্রের একজন সেবকের কাছে নাগরিকের অধিকার টুকুন চেয়েছিলাম মাত্র।
বহু সাধনার ফাইলটি হাতে নিয়ে বাসায় ঢুকবো, অমনি ডগি এসে হাজির। সেও স্পিড মানি চায়, একটুকরো রুটি। নতুবা বাসায় ঢুকতে বিলম্ব হবে বৈকি। রুটি পেয়ে আহ্লাদে আটকানা। লেজ নাড়ে, মাথা নিচু করে কৃতজ্ঞতা জানায়। ডগি যে মনিবের চাকরি করে, কেবল তার নিকট চায়, অন্য কারও নিকট হাত পাতে না, একটুকরো রুটি না, স্পিড মানি না, খরচাপাতিও না। তাই তাকে লজ্জা পেতে হয় না, যেমনটা লজ্জা পেতে হয় ভদ্রলোকদের।
সেদিন এক শ্রদ্ধাভাজন এসেছিলেন আমার খোঁজে, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। আমি ঘুমাচ্ছিলাম ভেতরে। দেড়ঘণ্টা গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে তাকে। ডগি এন্ট্রান্স দিচ্ছে না। কুকুরবিদ্যা কিঞ্চিৎ রপ্ত ছিল ভদ্রলোকের। পাশের দোকান থেকে দুই টুকরো পাউরুটি এনে সে বিদ্যের চর্চা চালিয়েছেন বটে, লাভ হয়নি। কুড়ি বছরের অভিজ্ঞতা হার মেনেছে ডগির বিশ্বস্ততার কাছে। ডগি বুঝিয়ে দিয়েছে ঘুষ নেওয়া কুকুরের কাজ নয়, কতক মানুষের কাজ। মনিবের জন্য যে প্রাণ বাজি রাখতে জানে, সে দুই টুকরো পাউরুটির কাঙাল হয়ে বিক্রি হবে—এমন বিকৃত মানসিকতা তার নেই।
সারা সপ্তাহ জার্নির কারণে শুক্রবার সকালটা কাটিয়ে দিয়েছি স্রেফ আলসেমি করে। বিকেল বেলা যথারীতি বাজারের লম্বা ফর্দ। গেটে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছি। নর্দমার পাশে স্কুল ফেরত কয়েকজন উৎসুক বালক জটলা বেঁধে আছে, এগিয়ে গেলাম। একটি মৃতপ্রায় কুকুর নর্দমায় পড়ে আছে। মাথার একাংশ বিভৎস রকমে থেঁতলে গেছে। পুরো দেহে ছাপছাপ রক্ত। গলার হলুদ রঙের বেল্টটি দেখে নিশ্চিত হলাম এই আমাদের ডগি। আর বাজারে যাওয়া হলো না, বাসায় ফিরে গেলাম। বাসার সবাই ডগিকে দেখতে চাইলো। কিন্তু এ বীভৎস দৃশ্য তাদের দেখাব কী করে? জোরাজোরির কারণে তাদের নিয়ে যেতে বাধ্য হলাম। আট বছরের মেয়েটি আমার ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। সে কান্না যে বড়দের মাঝেও সংক্রামিত না হওয়ার কারণ নেই তা অনুমেয়। ডগি বলে ডাকতেই ডগি চোখ খুললো, তারপর কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে আবার বন্ধ করে ফেললো সে বিশ্বস্ত চোখজোড়া!