একটা অচেনা গন্ধ সমস্ত গা গুলিয়ে দিচ্ছে চতুর আলীর। সারাদিন হাঁটাহাঁটির পর এরকম গন্ধ সত্যিই অসহনীয়। গন্ধটার উৎস অনুসন্ধানে কোনো তৎপরতা না দেখিয়ে ডান পাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে চতুর। আরও তীব্র হয় গন্ধটা। এভাবে কয়েকবার ডান-বাম করে করে যখন কোনো সুরাহা হলো না, তখন সে চিৎ হয়ে খোলা আকাশে চোখ রাখে। আকাশে আজ অনেক তারার মিলন। চতুরের শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়। তার শুকনো ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা। মনের অজান্তেই বলতে থাকে একটা তারা, দুইটা তারা, ওই তারাডার বোও মরা।
-হোইনি। অ্যাকটা তারা, দুইটা তারা, ওই তারাডার স্বামী মরা।
-কিডা? কিডা আপনি?
জোছনার আলোয় খিলখিল করে হেসে উঠলো একটা মেয়ে। তার হাসির ঝলকানিতে বাতাসও কিছুটা কেঁপে ওঠে।
-মরার বিটা! বলে কী! আমি নাকি ‘আপনি’? আরে তুই বল্, তুই। রাস্তার বিটিদের আপনি বোল্লি গুনা হয়।
-অ্যাইটা আপনি কীরাম কতা বলচেন? আপনাকে চিনিনে, জানিনে।
-বুছচি, তোকে হালুয়া খায়াতি হবে।
চতুর ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বিপরীত দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কয়টা বাজে দেখার উদ্দেশ্যে হাতের দিকে তাকাতেই বুকটা টনটন ব্যথায় কুঁকড়ে ওঠে। আজ সন্ধ্যায় ঘড়িটা খোয়া গেছে। সঙ্গে যৎসামান্য যে অর্থ ছিল, তাও নিয়ে গেছে ছিনতাইকারীরা। তাদের সঙ্গে টানাহ্যাঁচড়া করতে করতে শার্টটার একটা অংশ ছিঁড়ে গেছে। এখন তাকে কমপ্লিট একজন পথের মানুষের মতো লাগছে। এরকম হাল হওয়ায় অবশ্য একটা লাভও হয়েছে। কারওয়ান বাজারের ফুটপাতের মাঝ বরাবর একটি স্থান দখল পেয়েছে সে। এটা না পেলে তাকে এতক্ষণ হয়তো চোর-ডাকাত উপাধি পেয়ে খাঁচায় বন্দি থাকতে হতো। তারচেয়ে এই খোলা আকাশের নিচে অনেক ভালো আছে চতুর আলী।
গন্ধটা আবারও আসছে। নাহ। এভাবে আর শুয়ে থাকা যাবে না। গন্ধটার একটা দফারফা করে তবেই ছাড়বে সে। মনস্থির করে উঠে বসে। পাশ ফিরে তাকাতেই চোখ দুটি ছানাবড়া। চাঁদের ক্ষীণ আলোয় ধবধবে সাদা এক নারীর দেহের কিয়দংশ চিকচিক করছে। চতুরের মাথার ভেতর চিনচিন ব্যথা অনুভূত হয়। একটা ঘোরঘোর ভাব তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এক অপূর্ব মাদকতায় শরীরটা টলছে। মেয়েটির দিকে একটু এগিয়ে যায় সে। গন্ধটার ভেতর এখন মাদকতার ভাব পষ্ট। হঠাৎ চতুরের মগজে দুইটা সহজ হিসাব ধরা পড়ে। হিসাব এক; গন্ধটার ভেতর এক ধরনের কাছে টানার তুমুল আকর্ষণ আছে। হিসাব দুই; গন্ধটা কোনো এক নারী শরীরের।
ফুরফুরে বাতাসে চতুরের বুকের লোমগুলো খাড়া হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে মেয়েটির উন্মুক্ত নাভিমূল শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে ওঠানামায় ব্যস্ত। এরকম এক ভয়ঙ্কর রাতের কাছে চতুর নিঃস্ব, সম্বলহীন, অসহায়। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় তার। নানা রকম প্রশ্ন তাকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। যেমন, সেকি খোদার কোনো পাপি বান্দা? নাকি তার নাম পাপিদের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে? নাহ। সে আর ভাবতে পারছে না। এক অসম পাথর বুকটাকে চেপে ধরেছে। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলিয়ে আবার স্বস্থানে ফিরে আসে চতুর। সৃষ্টিকর্তাকে ডাকার উদ্দেশ্যে আকাশের দিকে তাকায়।
সেখানে এক পাশে এক বিদ্যুতের খুঁটির নিচে বসে পড়ে চতুর। তারপর শুধু দূরে চেয়ে বেনুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। একঘণ্টা, দুইঘণ্টা এভাবে সময় পার হয় কিন্তু বেনু আর আসে না।
আবারও কিছু ভাবনা তাকে এলোমেলো করে ফেলে। আচ্ছা, আল্লাহ কি আকাশের ওপর থাকে? পরক্ষণে ভাবে, হবে হয়তো, তা না হলে আল্লাহর নাম করলে সবাই আকাশের দিকে তাকায় কেন? এসব কিছু ভাবার কাজ জ্ঞানীগুণীদের, তার ভেবে কী লাভ? খোদা আকাশে থাক, আর পাতালে থাক, অথবা নাইবা থাক, এ নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকারটা কী? বরং বিষয়টা বাদ দেওয়া ভালো। তর্কে তর্কে কোনো সমাধান হয় না বরং সমস্যা বাড়ে। এইসব ভেবে ভেবে চতুর চুপ করে থাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়, আজ সারারাত ধরে সে আকাশের তারা গুনবে।
ভাবনার সঙ্গে সঙ্গেই কাজ শুরু করলো।
-অ্যাকটা তারা, দুইটা তারা, তিনটা তারা…
এভাবে নিরানব্বই পর্যন্ত গোনার পর হঠাৎ কানের কাছে ফিসফিস শব্দ।
-হোইনি। অষ্টানব্বই বাদ পড়েছে।
চতুর প্রচণ্ড ভয় পেয়ে বিদ্যুৎ গতিতে দূরে সরে যায়। কিন্তু খুব বেশি দূর এগোতে পারে না সে। পাশে গাদাগাদি করে অনেক মানুষ শুয়ে আছে। এত মানুষ ডিঙিয়ে যাওয়া অসম্ভব।
-আমাকে অত ভয় পাবার কী আছে? আমি বাঘ, না ভাল্লুক যে তোকে খেয়ে ফ্যালবো।
চতুর কোনো কথার উত্তর না দিয়ে ভাবে, এ কোন্ নরকে এসে উপস্থিত হলাম? মেয়েটা চতুরের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রাগে গজগজ করে ওঠে।
-কিরে, তোর খিদে পায়নি? অ্যামন এক জলজ্যান্ত রসুগোল্লা দেকেও তোর লোব হয় না? কিরাম ব্যাটারে তুই?
মেয়েটির কথায় কোনোরকম ভ্রূক্ষেপ না করে একটু নড়েচড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে চতুর। ঠিক সেই সময়ে আরও কিছু আপত্তিকর শব্দ তার কানকে ফালাফালা করে দেয়।
-শালা হিজলে নাকি? কত মালদার পারটি পকেট খসিয়ে এই বেনুবালার পায়ের নিচে পড়তে চায়, সেডা কি তুই জানিস? আর তোর ফিরিফিরি খায়াতি চাইছি, তাও খাবি না।
মেয়েটির লাজলজ্জা বলে কিছুই নেই। তবে এটা ঠিক, তার প্রতিটি কথার ভেতর কেমন জানি কাছে টানার একটা তীব্র আকর্ষণ আছে। কথাগুলো শুনতে চতুরের যে খুব বেশি খারাপ লাগছে তাও বলা মুশকিল। এমন জোছনাধোয়া রাতে কামুক এক রমনীর পাশে ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করা সত্যিই বোকামির সামিল। চতুর ঘুমানোর ভান করে চোখ বন্ধ করে। ব্যস, এই সুযোগে মেয়েটা তার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লো। এই মধ্যরাতে প্রচণ্ড বিরক্তির মাঝেও ভালোলাগার একটা আবেশ কী আশ্চর্যভাবে ছড়িয়ে পড়ছে দেহের সমস্ত মাংসপিণ্ডে। মেয়েটার কোমল-নরম হাত চতুরের লোমশ বুকের মাঝখানে। তার দেহের সব শিরা-উপশিরা সজাগ। স্পর্শ কাতরতায় দমদম করে শব্দ হচ্ছে বুকের ভেতর। চতুর অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও মেয়েটার হাত সরাতে পারে না। স্বপ্নের মধ্যে কেউ ধাওয়া করলে যেমন পথ ফুরাতে চায় না, আবার শত্রুপক্ষও ধরতে পারে না। ঠিক তেমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি চতুর আলী।
মেয়েটির গরম নিঃশ্বাস চতুরের শরীরকে পুড়িয়ে ফেলছে। তবু চতুরের কাছে আসার কোনো উদ্যোগ নেই। আচানক চতুরকে জড়িয়ে ধরে পাগলিনীর মতো হাসফাস করতে করতে চুমো খেতে থাকে মেয়েটা। এই লুটোপুটির খেলায় চতুর নিজেকে মেলে ধরে। বেনু চতুরের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফাস করে বলে,
-ঠোঁট দুডো অ্যাকটু ফাঁক করনা। তোকে অ্যাকটা ফিরান্স কিস্ দিই। কালকে এক বিশাল বড়োলোক আমাকে এই ফিরান্স কিস্ দিয়া শিকিয়েচে।
চতুর কিছুই বলে না। শুধু ঠোঁট দুটো আলতোভাবে মেলে ধরে। চতুরকে আরও পাগল করে তোলে বেনুবালা। আজ এই জোছনা রাতে দুটি শরীর পরস্পরকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। তাদের এই মহামিলনে চাঁদমামা একটু লজ্জা পায়। তাই সে নিজেকে এই মুহূর্তে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে ফেলে। পুনরায় যখন ফিরে আসে, সব খেলা সাঙ্গ হয়ে গেছে তখন।
চতুরের বুকের ওপর নেতিয়ে পড়ে আছে বেনুর নগ্ন দেহটা। ভোরের ক্ষীণ আলোয় ফোটাফোটা ঘাম চিকচিক করছে বুকে, পিঠে, নিতম্বে। কারওয়ান বাজারের বড় মসজিদ থেকে আজানের সুর ভেসে আসছে। আজানের ধ্বনি কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে বেনু তার দেহটা সরিয়ে নেয় চতুরের দেহের ওপর থেকে। শাড়িটা কোনো রকম শরীরে পেঁচিয়ে উঠে পড়ে সে। চতুরও ততক্ষণে উঠে পড়েছে। বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে বেনুর ঘামে ভেজা মুখের দিকে। কপাল থেকে আঁচল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বেনু বলল,
-এবার বলেন, আপনি কন থেকে অ্যাসেচেন্? আর অ্যাকন কনে যাবেন?
চতুর তো অবাক! সে মেয়েটির উপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব এনে ফেলেছে। বেনুবালা তাকে আপনি সম্বোধনে অত্যন্ত বিনয়ীভাবে কথা বলছে। অথচ গতরাতেও সে তাকে পাত্তা দেয়নি। বেনুর ভরাট মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন জানি মায়া হলো চতুর আলীর। সে ঝটপট যেসব কথা বললো, তার সারমর্ম এই যে, তার বাড়ি যশোর জেলায়। বাড়ি থেকে সে রাগারাগি করে ঢাকায় এসেছে একটা চাকরির সন্ধানে। লেখাপড়া কোনো রকম আন্ডার ম্যাট্রিক।
বেনুরও চতুরের প্রতি মায়া হয়। চতুর এই প্রথম আবিষ্কার করলো, দেহ দিয়ে ভালোবাসারও অন্যরকম টান থাকে, কাছে পাওয়ার টান, কাছে থাকার টান। বেনু তার আঁচলের গিঁট থেকে একশ টাকার ভাঁজ করা একটা নোট চতুরকে দেয়। গতরাতে চতুরের কাছে যে লোকটির কথা বলেছিল তার ঠিকানাটাও বলে। লোকটি বেনুকে শরীরের জন্যই হোক, আর অন্য কোনো কারণেই হোক, খুব পছন্দ করেছে মাত্র একদিনের সঙ্গমেই। এমনকি বেনুর কোনো দরকার পড়লে তার কাছে যেতেও বলেছে। বেনুর বিশ্বাস লোকটার কাছে গেলে তিনিই একটা ব্যবস্থা করে দেবেন চতুরের।
কথায় কথায় চারদিকে রোদ ঝলমল করে উঠলো। রাত্তি আবার দেখা হবে এই জায়গায়। বলেই বেনু হনহন করে হাঁটতে শুরু করে। কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসে। চতুর তখনো বেনুর পথের দিকে তাকিয়ে আছে। বেনু এসেই বললো,
-চলেন আমার সাতে।
-কন্ জায়গায়?
-ফার্মগেট
কারওয়ান বাজার থেকে হাঁটতে হাঁটতে ফার্মগেটে পৌঁছায় চতুর ও বেনু। শাড়ির গিঁট খুলে বেনু আরও দুশো টাকা চতুরের হাতের মধ্যে গুঁজে দেয়।
-সামনের দুকান থেকে একটা জামা কিনবেন। জামাটা গায়ে পরার পর ৬ নম্বর গাড়ি ধরে সোজা বনানী নামবেন। তারপর আমার দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী চলে যাবেন।
কথাগুলো অ্যারোপ্লেনের গতিতে বলেই চম্পট দেয় বেনুবালা। চতুর দোকানে ঢুকে একশ আশি টাকা দিয়ে একটা জামা কেনে। নতুন জামাটা গায়ে পরে ছেঁড়াটা খুলে দিয়ে দেয় এক ফকিরকে। এরপর অনেক ঠেলাঠেলির পর বনানী রুটের ৬ নম্বর বাসে ওঠে চতুর। বাস থেকে নির্দিষ্ট স্থানে নেমে কিছুদূর হাঁটার পর চতুর লোকটির বাসা খুঁজে পেলো। ঢাকা শহরে কারও বাসা খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু চতুরের কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি এলাকার প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের ছেলে হওয়ায় একটু সহজ হয়েছে আর কি। লোকটির বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় চতুর। সেখানে অনেক লোকের ভিড়। এত লোকের সমাগম দেখে তার বুক ধড়ফড় করছে। সবাই জটলা পাকিয়ে কী যেন কানাকানি করছে। উপস্থিত সবার মুখের ওপর বিষণ্নতার ছাপ। চতুর আলী আরও কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বাড়ির ভেতর উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। অগত্যা একজনের হাত টেনে ধরে জিজ্ঞাসা করে,
-বাড়ির মদ্দে কী হয়েচে ভাই?
-আমগোর এমপি সাহেবের পোলা গাড়ি কইর্যা অফিস যাওনের পথে অ্যাক্সিডেন্ট কইর্যা মইর্যা গ্যাছে।
চতুরের মাথার মধ্যে বাজ পড়ার মতো শব্দ হয়। তার চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসছে। পা দুটি অবশ। কোনো রকম এক পা দুই পা করে পথ চলতে থাকে সে। এভাবে সারাদিন উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে হেঁটে সন্ধ্যাবেলায় সে কারওয়ান বাজারে পৌঁছায়। সেখানে এক পাশে এক বিদ্যুতের খুঁটির নিচে বসে পড়ে চতুর। তারপর শুধু দূরে চেয়ে বেনুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। একঘণ্টা, দুইঘণ্টা এভাবে সময় পার হয় কিন্তু বেনু আর আসে না।
কোনো রকম কোনো দিশা না পেয়ে আকাশের দিকে একপলকে তাকিয়ে আছে চতুর আলী। বিড়বিড় করে কী যেন বলছে? গল্পের সাবজেক্ট ভেবে আমি যখন তার খুব কাছে কান পাতি। তখন শুনতে পাই,
ওদিকে রাস্তার আইল্যান্ডের ওপর অনেকে শোয়ার জন্য জটলা পাকাচ্ছে। চতুর গতরাতের জায়গায় গিয়ে দেখে সিট দখল। শুধু তারটা নয়, বেনুরটাও। অনেক কষ্টে সে অন্য একটি স্থানে শুয়ে পড়ে। আর মাঝেমাঝে পাশ ফিরে তাকায় বেনুর জায়গাটার দিকে। কিন্তু বেনুর দেখা আর মেলে না। সারারাত তার চোখে ঘুম আসে না। ঘুমের মধ্যে বারবার বেনুর নাভিমূল চাঁদের আলোয় ওঠানামা করে। চতুর আগের রাতের মতো ছড়া কাটে, আকাশের তারা গোনে, কেউ তাকে আর বাধা দেয় না।
-ওট্ খানকির পো। মইর্যা গ্যাচস্ নাকি? এই ল পেপার পড়।
চতুর থতমত খেয়ে ঘুমঘুম চোখে উঠে পড়ে। উঠতেই তেরো চোদ্দ বছরের এক হকার ছেলে হাসতে হাসতে তার হাতে পেপার ধরিয়ে দেয়। চতুর পেপারটা উল্টে পাল্টে দেখতে থাকে।
-কিরে হালার পো, তুই পড়তে জানস্ নাকি? ত পড়। আর হ, ভালো কইর্যা নজর লাগাইয়া দ্যাক্ তো কুনো ধর্ষণের, মানে ইজ্জত মারামারির খবর আছে কি না? জলদি কইর্যা দ্যাক্।
কথাগুলো শেষ হতে না হতেই ছেলেটি জ্যামে আটকে থাকা বাসগুলোর দিকে ছুটে গিয়েই বলতে থাকে,
-এই পেপার, গরম খবর, টাটকা খবর, জননেত্রী গ্রেফতার। এই গরম খবর, টাটকা…
জ্যাম ছেড়ে দিলে ছেলেটি ফিরে আসে চতুরের কাছে।
-কিরে পাইছস্ কিছু?
চতুর ততক্ষণে ‘জননেত্রী গ্রেপ্তার’ শিরোনামের খবরটি খুব মনোযোগের সঙ্গে পড়ছিল। কিন্তু ছেলেটির পীড়াপীড়িতে অন্য পৃষ্ঠা উল্টাতে বাধ্য হয়। দুই পৃষ্ঠা উল্টিয়ে চতুর থামে। ছেলেটি খুব উৎসুক হয়ে বলে,
-কিরে পাইছস বুঝি? তইলে পড়, জলদি পড়, দম লাগাইয়া জোরে জোরে পড়।
‘‘অবশেষে এইডস্ রোগী বেনুবালার খোঁজ’
গত সাতদিন ধরে গোয়েন্দা বিভাগ অনেক খোঁজাখুঁজির পর, এইডস্ রোগী বেনুবালাকে মগবাজারের পূর্ণিমা হোটেলের সামনে থেকে গতকাল সন্ধ্যায় গ্রেফতার করেছে। গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান জনাব মোজাম্মেল হক জানান, বেনুবালার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের কালিয়াডাঙ্গা গ্রামে। তার শরীরে এইচআইভি ধরা পড়ার পর, সে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পালিয়ে ঢাকায় আত্মগোপন করেছিল। ওখানকার গোয়েন্দা সংস্থা আমাদের কাছে মেয়েটির ছবি পাঠায়। সেই মোতাবেক আমরা গত সন্ধ্যায় তাকে মগবাজার থেকে আটক করি। সে এখন আমাদের হেফাজতে আছে। ইতোমধ্যে আমরা ওপারে যোগাযোগ করেছি। এবং যতদ্রুত সম্ভব আমরা তাকে তাদের কাছে হস্তান্তর করবো।”
চতুরের হাত ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। চোখদুটো তার ভীষণ জ্বালা করছে। ওদিকে ছেলেটি গজগজ করে বলতে থাকে,
-আরে মাগীর পো, এইডা কুনু গরম খবর হইল? দে হালায়, আমার পেপার দে।
একপ্রকারের জোর করে পেপারটি ছিনিয়ে নিয়ে ছেলেটি দৌঁড়ে আবারও জ্যামে আটকে থাকা বাসগুলোর দিকে ছুটে গেলো।
-এই গরম খবর, টাটকা খবর জননেত্রী গ্রেফতার…
চতুরের শরীরটা একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে থেমে আছে। সে এখন কী করবে, কিছুই বুঝতে পাচ্ছে না। চোখ দিয়ে কয়েকফোটা পানি গড়িয়ে তার লোমশ বুক ভিজিয়ে দেয়। সে একবার ভাবে বেনুর সঙ্গে দেখা করে আসি! আবার ভাবে, না। সেখানে গেলে নতুন কোনো ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। তাহলে সে কি বাড়িতে চলে যাবে? এটাও ভাবে। কিন্তু গ্রামের কথা মনে আসতেই তার মায়ের মুখটি ভেসে আসে এবং সে শুনতে পায় তার মা যেন বলছে, ‘এত লোকের মরণ হয়, তোর মরণ হয় না।’ মা ভাবেন, এরকম এক নিষ্কর্মা ছেলেকে পেটে ধরে তিনি রীতিমত অন্যায় করেছেন। চতুরের অবস্থান পৃথিবীর কাছে এখন অসহ্য, অপ্রয়োজনীয়।
মাথার ভেতর ভাবনার জালগুলো ক্রমশ তাকে আটকে ফেলছে। জাল ছিঁড়ে সে কিছুতেই বের হতে পারে না। জালগুলো নীল কুণ্ডলী পাকিয়ে তাকে ঘিরে নৃত্য করছে। সে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। অনেক কষ্টে চতুর আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ ধবধবে পরিষ্কার। সেখানে আজ কোনো তারার অস্তিত্ব নেই। আর থাকবেই বা কী করে? এখন যে সকাল। তবে কি সে খোদাকে ডাকবে?
কিন্তু কী আশ্চর্য! তার চারপাশে খিলখিলিয়ে কে যেন হাসছে? চোখের পাতায় বারবার ভেসে উঠছে বেনুবালার উন্মুক্ত নাভিমূল। কোনো রকম কোনো দিশা না পেয়ে আকাশের দিকে একপলকে তাকিয়ে আছে চতুর আলী। বিড়বিড় করে কী যেন বলছে? গল্পের সাবজেক্ট ভেবে আমি যখন তার খুব কাছে কান পাতি। তখন শুনতে পাই,
অ্যাকটা তারা, দুইটা তারা, ওই তারাডা ভাতার মারা…
আরও পড়ুন: প্রথম গল্প