নদীর পাড়ে বসে আছে দুই বন্ধু। সাবান দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকাচ্ছে শার্টটি। কিন্তু ঝোলের দাগ পুরোপুরি যায়নি। পেটের কাছ থেকে নিচের দিকে বড়সড় একটা এলাকা জুড়ে লালচে দাগ স্পষ্ট হয়ে ফুটে রয়েছে। অনেকবার সাবান দিয়ে ধোয়ার পরেও এই অবস্থা। মাথায় নতুন কোনো বুদ্ধি না আসায় জামাটি শুকাতে দিয়ে বসে আছে দুই বন্ধু। কী হতে কী হলো সেই ভাবনাটাই বুঝি তাদের মনের মধ্যে ঝড়ের মতো বয়ে চলেছে। পরস্পরের দিকে সরাসরি তাকাতে পারছে না দুজনের কেউই। অবশেষে নীরবতা ভাঙে অতুল। বলে, ‘কী কল্লাম দোস্ত এইডা! তোর সমস্ত আনন্দ মাটি করে দিলাম।’ চুপ করে থাকে নূর আলম। তার মুখ দেখে কিছুই বোঝা যায় না। ‘একন আমার হাত দুডো কেটে ফেলাতি মনে চাচ্চে, ধূউউউর!’ নিজের ওপর বিরক্তিতে ছেয়ে গেছে তার অন্তর। বন্ধুর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তার কাঁধে হাত রাখে নূর আলম। বলে, ‘শোন নিজিকে খামোখা কষ্ট দিচ্চিস। এইডা একটা দুর্ঘটনা। আমার হাতে লেগে কড়ার ঢাকনি পড়ে না গিলি তো আর এইডা ঘটতো না। সবই আল্লার ইচ্চা। তুই শুদু শুদু মন খারাপ করিসনে।’ মুখে হাসি ফুটে ওঠে নূর আলমের।
মনের ওপর কতটা শক্তি খাটিয়ে এই হাসিটুকু মুখে ফোটাতে হয়েছে, তা সে ছাড়া আর কেউ জানে না। বন্ধুকে কোনোভাবেই সে দোষ দিতে চায় না। আবার ঘটনার বাস্তবতাও মেনে নিতে কষ্ট হয় তার। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে অবশেষে খানিকটা হাসি সে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে। তার সেই হাসি দেখে ভরসা পায় অতুল। ধীরে ধীরে চিন্তাশক্তিও ফিরে আসতে থাকে তার। ভূতে পাওয়া মানুষের মতো হঠাৎ লাফিয়ে উঠে ‘অনীল ধুপা’ বলে চিৎকার করে ওঠে অতুল, অনীল ধুপার কথা ভুলেই গিচিলাম। চল চল শিগগির চল তার কাচে। কথাগুলো হড়বড়িয়ে বলা শেষ করে নন্দীর দড়ি ধরে এক প্রকার টেনে নিয়ে চলে অতুল। পেছনে আধ শুকনো জামাটি হাতে নিয়ে তাকে অনুসরণ করে নূর আলম। দুপুরে বাবার সঙ্গে হংস ভোজনের কথা ভুলে গেছে সে। অতুলের মাথা থেকেও দাওয়াতের কথা একেবারেই মুছে গেছে। অনাহূত সমস্যা সমাধানের আরাধ্য আবেশে ছুটে চলেছে দুই কিশোর।
গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে অনীল ধোপার বাড়ি। আশপাশের দুচার গ্রামের মধ্যে সেই একমাত্র। সেজন্য ভাবের আর শেষ নেই তার। নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করে সে। কেউ চাপ দিয়ে তার কাছ থেকে কাজ বের করতে পেরেছে বলে আজ পর্যন্ত রেকর্ড নেই। অনুরোধ উপরোধেও কাজ হয় না। সম্পূর্ণ নিজের মেজাজ মর্জিতে চলে। তার বাবার পিতামহ নাকি একবার কোনো এক মন্ত্রীর কাপড় ধুয়ে দিয়েছিল। সেই গর্বে আজও মাটিতে পা পড়ে না তার। কথায় কথায় সেটা সবাইকে শোনাতেও পিছপা হয় না সে। পারিবারিক বিরল ইতিহাসটি সবাইকে খুব গর্বের সঙ্গেই বলে বেড়ায় সে। মুড না থাকলে কোনো কোনো দিন কাজ থেকেও বিরত থাকে সে। আজকে তেমনই একটা মুড অফ দিবস তার। কাজ ফেলে আয়েশি কায়দায় বাড়ির পেছনে গাছের ছায়ায় চেয়ার পেতে বসেছে সে। পায়ের কাছে একটা অনুচ্চ টুল। তাতে পা দু’টি তুলে দিয়ে পরনের ধুতিতে ছিদ্র অন্বেষণ করছে। খুঁজে পেতে সাদা সুতো দিয়ে নিপুণ হাতে রিপু কর্ম করে যাচ্ছিল সে। পৃথিবীর মধ্যে এটাই বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভারটি পড়েছে তার কাঁধে। অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে তাই সেই দায়িত্ব পালন করে চলেছে অনীল ধোপা।
শরীরের মারাত্মক স্পর্শকাতর এলাকায় অবস্থান করা ধুতিগাত্রে একটা ছিদ্র পাওয়া গেছে। খুশি হয়ে ওঠে সে। মুখে সামান্য হাসির আভা সেই ভাব প্রকাশ করছে। সুতোর মাথায় গিঁট লাগিয়ে সূচটি কেবল ফোঁটাতে যাবে, এমন সময় চিল চিৎকারে গলায়, অনীল দা, ও অনীল দা, বাড়ি আচো? ডাক দিয়ে ওঠে কে যেন। ডাকের জবাবে ‘উক্’ করে বিজাতীয় একটি দুর্বোধ্য শব্দ বেরিয়ে আসে তার গলা দিয়ে। চোখ দু’টি গোল গোল হয়ে ওঠে। অবোধ সূচটি জায়গা না চিনে বোধ হয় বেকায়দা কোনো স্থানে খোঁচা দিয়ে ফেলেছে। দোষ সূচের না কি নিজের, সেটা বিবেচ্য নয়।
ওই মুহূর্তে সব দোষ গিয়ে পড়ে ডাক যে দিয়েছে, তার ওপরে। নিশিন্দার তিতা পান করা গলায় হেঁকে ওঠে সে, ‘এই কিডারে? বেরো, বেরো আমার বাড়িত্তে!’ গিলোটিনের মতো ঝপ করে দুর্ব্যাবহারের খড়গ কেনো নেমে এলো বুঝতে পারে না কিশোর ছেলে দু’টি। নিজেদের দোষ বুঝতে না পেরে বাক হারা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তারা। কারও বাড়িতে গিয়ে তাকে খোঁজ করতে হলে একটু হাঁক ডাক তো করতেই হয়। তা না হলে লোকটি জানবে কী করে যে তাকে খোঁজা হচ্ছে? কিন্তু ডাকের জবাবে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবার হুকুম কেউ দিতে পারে, তা বোধহয় কিশোর দুটোর কল্পনায়ও ছিল না। তাদের বদলে এবার নন্দী ডেকে ওঠে একবার।
তা না হলি দাওয়াত মিস হই যেবেনে। হাঁসের গোস্ত বলে কথা। কথা শুনে সত্যিই দ্রুত পা চালায় নন্দী। তাই দেখে হেসে ওঠে দুই বন্ধু।
নন্দীর ডাক শুনেই কিনা, কে জানে অনীল ধোপা সূচবিদ্ধ বিশেষ স্থানটি ডলতে ডলতে বেরিয়ে আসে। তাদের সামনে দাঁড়িয়েও আনমনে ডলতে থাকে। তারপর হঠাৎ সম্বিত ফিরে পাওয়ার চটকে চমকে উঠে চট করে হাতটি সরিয়ে নেয়। তার এই কাণ্ড দেখে শত দুঃখের মধ্যেও একটু হাসি পেয়ে যায় দুই বন্ধুর। মুখ টিপে হেসে নেয় তারা। ছেরে দুটির হাসি দেখে পিত্তি জ্বলে যায় অনীলের। তিতা মিশ্রিত গলায় জানতে চায়, ‘কী হইছে, অত চেঁচামেচি কচ্চাও কিসিজজন্যি? মাইনষির বাড়ি এসে অমন অভদ্রভাবে কেউ চিল্লায়? এ বাড়ির ইতিহাস জানা আচে? আরে মন্ত্রীর জামা ধুয়া লোক আমরা। উহ…’ নিজের অজান্তেই বিশেষ জায়গায় হাত চলে যায় তার। মুখ বিকৃত হয়ে ওঠে। জায়গাটা টাটিয়ে ওঠায় আচমকা এই প্রতিক্রিয়া হয় অনীলের। কতটুকু ক্ষতি হয়েছে চোখে না দেখা পর্যন্ত শান্তি নেই তার। কিন্তু ছেলেদুটো সামনে থাকায় সে কাজটিও করে উঠতে পারছে না বলে আরও মেজাজ খিচড়ে যায় তার। ততক্ষণে অনীলের অন্য হাতে সাদা সুতা পরানো সূচটি চোখে পড়ে অতুল-নূর আলমের। মনে মনে কিছু একটা দুয়ে দুয়ে চার মেলায় তারা।
‘ডাকচিলে কিসির জন্যি?’ তাদের হাবভাব খেয়াল করে আরো তিরিক্ষে হয়ে ওঠে অনীলের মেজাজ। হুশ ফিরে পেতে জামাটি বাড়িয়ে ধরে নূর আলম। তার হাত থেকে জামাটি নিজের হাতে নিয়ে অতুল ঝোলের দাগটি দেখিয়ে বলে, ‘দাদা এইডা ওর ঈদির জামা। কাল রাতি কিনা হইচে। কিন্তু ভুল করে ঝোল লেগে এই সব্বনাশ হইচে। একন তুমি এর এট্টা সমাধান দেও দাদা। তুমি ফিরোয় দিলি ওর ঈদ হবে না।’
—কাল বাদে পরশু দিন ঈদ, আর আজকে তুমরা আইচাও ইয়ার্কি মাত্তি। একন নতুন কাজ নিতি পারব না, যাও যাও অন্য দিকি দেকো গে। মুখের ওপরে কাটা কাটা জবাব দিয়ে দেয় অনীল। সে ভালো করেই জানে সে ছাড়া আশপাশে আর কোনো ধোপা নেই। তার ওপরে এই ছেলে দুটোর জন্য তার সর্বনাশ হয়ে গেছে। কতটুকু হয়েছে সেটাও এদের কারণেই জানতে পারছে না। সেজন্য মেজাজ সহজে বশ মানছে না। তা না হলে এই দাগ তার কাছে কিছুই না। মন্ত্রীর জামা ধোয়া ধোপা পরিবারে জন্ম বলে কথা। সামান্য এই ঝোল ফোল তার কাছে নস্যি।
—দাদা একটু দেকো না…করুণ মিনতি বেরিয়ে আসে অতুলের গলা বেয়ে।
—একনো দাঁড়ায় রইচাও কী মনে করে তুমরা? যাতি বললাম না! কথাগুলোয় ঝাঁজ তেমন না থাকলেও অপমানজনক বটে। কিন্তু সেটা গায়ে মাখে না অতুল। আগ বেড়ে তোয়াজ মাখানো গলায় বলে, এই সামান্য দাগ তুমার কাচে কোনো ব্যাপারই না দাদা। মন্ত্রীর জামা ধুইচো না! এই গরিবির দাগ তো তুমার বাম হাতের এক তুড়িতিই গায়েব হই যাবে। একটু দেখো না দাদা।
এই কথার ওপরে আর ফেরানো চলে না। তাই অনিচ্ছার ভাব নিয়ে জামাটি হাতে নেয় অনীল ধোপা। নেড়েচেড়ে দেখে বলে, ঈদির আগে দিতি পারব না। পরে নিতি হবে। জামাটি হাতে নেওয়ার পর হাসি ফুটে উঠেছিল অতুলের মুখে। তার হাসি দেখে কেবল ভরসার আলো টিমটিম করে জ্বলে উঠেছে নূর আলমের মনে। অনীলের কথায় অতুলের হাসি ও নূর আলমের ভরসা দুটোই দুপ্ করে নিভে গেলো। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ঢোক গেলে তারা। এবার সাহস করে কথা বলে নূর আলম। বলে, দাদা, এট্টু চিষ্টা করে দেকো না। জামাডা না পালি আরো অনেক সমস্যা হবে। শুদু ঈদ সেজন্যি না, বাড়িতি মেলা ঝামেলা হই যাবে। দেকো না দাদা। এই মিনতি ঠেলতে পারে না অনীল। বলে, ঠিকাছে দেকি কী করা যায়। কাল বিকেলের দিকি এসো।
দুই বন্ধুর হাসি নিঃশব্দ প্লাবনের মতো বুকের মাঝখান থেকে ঠেলে মুখে উঠে আসে। আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করতে গিয়ে অতুল নন্দীর কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলে, দেকিচিস দাদা কিরাম ভালো? প্রশংসা শুনে ভাব মিশ্রিত একটা গর্ব চোখেমুখে খেলা করে যায় অনীলের। দ্রুত স্থান ত্যাগ করে সে। নন্দীকে নিয়ে ফিরতি পথ ধরে ছেলে দু’টি। পথে যেতে যেতে অতুল তাড়া লাগিয়ে নন্দীকে বলে, চ নন্দী তাতাড়ি পা চালা। তা না হলি দাওয়াত মিস হই যেবেনে। হাঁসের গোস্ত বলে কথা। কথা শুনে সত্যিই দ্রুত পা চালায় নন্দী। তাই দেখে হেসে ওঠে দুই বন্ধু।
চলবে…