গ্রামের একমাত্র বড় রাস্তাটি পথশ্রান্ত বৃদ্ধের মতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছাল ওঠা সদর রাস্তায় গিয়ে মিলেছে। বড় রাস্তা বলতে বিস্তীর্ণ মাঠের বুক চিরে কয়েক হাত চওড়া সর্পতনু ভঙ্গিমায় পড়ে থাকা মাটির রাস্তা। গ্রীষ্মে ধুলোর নদী আর বর্ষায় কাদার সাগর। তবু তো একটা রাস্তা আছে! সেটাই গাঁয়ের লোকের গর্বের। কারও গাছ রোপণের খায়েস হলে রাস্তার পাশেই খায়েস মেটায়। সেজন্য রাস্তার ধার বেয়ে নানা জাতের ফলের গাছ থেকে শুরু করে অপ্রয়োজনীয় গাছেরও ভিড় দেখা যায়। তেমনই হয়তো খায়েস মেটাতে কেউ আম গাছটি লাগিয়েছিল। এখন সেটি বেশ ডালপালা ছড়িয়েছে। সেটারই একটা অনুচ্চ ডাল দখলে নিয়ে বসে আছে দুই বন্ধু। নন্দীকে অদূরেই চরে খেতে দেখা যাচ্ছে। বিকেলের প্রলম্বিত রোদে তেমন আঁচ নেই, আছে কেবল চারদিক সুনসান আলোর প্লাবন। নিজেদের দুনিয়ার কত রকমের আলাদা আলাদা আলাপ জমে আছে দুই বন্ধুর। একে একে তা বেরিয়ে আসছে দুজনেরই প্রগলভতায়। আলোর প্লাবনে লম্বা দুটি ছায়াকে পরস্পরের সঙ্গে আলাপে মত্ত দেখা যায়।
-তা তুই ছড়া বানালি? চোখ গোল গোল করে প্রশ্ন করে অতুল।
মুখে দুষ্টুমীর হাসি ভাসিয়ে মাথা নেড়ে হ্যাঁ-সূচক জবাব দেয় নূর আলম। বলে, কী করব, সবাই মিলে ধইল্লো। না বানায়ে পারা গেলো না।
-তারপর কী হলো? উৎসাহে চক চক করে ওঠে অতুলের চোখ।
নির্বিকার কণ্ঠে জবাব দেয় নূর আলম, ছড়া লিখে আটা দিয়ে উজুখানার দ্যালে লাগায় দিলাম রাত্তিরি। সকালে তাই নিয়ে বিচার বইসলো। কিডা লিকেচে তাকে গরু খুজা করা হলো। সবাইকে বেত মারার হুমকিও দেলে মেজে হুজুর। তারপরও কেউ স্বীকার করিনি। সবাই কলো রাত্তিরি ঘুমোয় ছিলাম হুজুর, কিডা করেচে জানিনে। হুজুর আর কী করবে? পরে এ নিয়ে নিজিগির মদ্যি হাসাহাসি হলো খুব। ছড়া লিখার পর মেজে হুজুরের ছুকছুকানি একটু কুমলো। কিন্তু রাগ বেড়ে গেলো হেবি।
-তা কী ছড়া লিখিলি, মনে আচে? হ্যাঁ-সূচক জবাবের প্রত্যাশায় নূর আলমের মুখের দিকে চেয়ে থাকে অতুল। চঞ্চল চোখের তারায় আলোর স্ফুরণ। দুর্নিবার আগ্রহের আতিশয্যে একটা মাঝারি সাইজের ঢোক গেলে সে। কণ্ঠার হাড় একবার নিচে নেমে আবার ওপরে উঠে আসে। রহস্যময় হাসি দেয় নূর আলম।
বল না দোস্ত, কী ছড়া লিখিলি! নূর আলমের বাহু চেপে ধরে ঝাঁকি দিতে দিতে বলে অতুল। মুখের হাসি ধরে রেখে অনায়াস সাবলিলতায় আবৃত্তি করে যেতে থাকে নূর আলম:
হুজুর আমার বিরাট চিকন কিছুই খান না,
ভাত-মাছ আর গোশ-পরাটা কিছুই পান না।
না খেয়ে খেয়ে ভূড়িটা তার ফুলে ওঠার কী মানে?
কার বাক্সে কী খাবার ক্যামনে হুজুর সেসব জানে!
নাকটা তার হেব্বি জিনিস সব কিছুর গন্ধ পায়,
বদ হজম কাকে বলে কোনো দিনই জানা নাই।
বারো হাত খেজুর আর চল্লিশ হাত কলা,
বেহেস্তের ফল খেতে শুকিয়ে থাকে গলা।
হাসির হুল্লোড় সমান্তরাল বাতাসে যেন হালকা ঢেউ তুলে কাঁপিয়ে দিয়ে গেলো। হেসে একে অন্যের গায়ে লুটিয়ে পড়ে দুই বন্ধু। নূর আলমদের মাদ্রাসায় মেঝ হুজুর নামে পরিচিত যে শিক্ষক, তিনি কিঞ্চিৎ ভোজনরসিক। এ কারণে স্বাস্থ্যও বেশ নাদুস নুদুস। ছুটি থেকে ফেরার সময় ছেলেদের সবারই বাড়ি থেকে কিছু না কিছু খাবার সঙ্গে দিয়ে দেয়। রসিকতার ছলে সবার বাক্স শুঁকে মেঝ হুজুর খাবারের নাম বলে দেন। মাঝে মাঝে দুয়েকটা লেগেও যায়। তখন নিজের নাকের প্রশংসা করেন তিনি। সঠিক বা ভুল যাই হোক, একবার এই কাণ্ড করার পর তাকে ভাগ না দিয়ে ছেলেরা কিভাবে সে খাবার খাবে? চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা কথা আছে!
খাবার খেতে খেতে নানা রকমের কথা বলেন মেঝ হুজুর। তার মধ্যে যে খাবার যখন তিনি খেতে থাকেন তার স্বাদ, যে খাওয়াচ্ছে তার প্রশংসা, বেহেস্তের খাবারের নানা মুখরোচক বর্ণনা ও সবশেষে শিক্ষককে খাবার খাওয়ানোর ব্যাপারে হাদিসে কী আছে, তার বিশদ ব্যাখ্যা। দীর্ঘদিন ধরে ছাত্ররা মেঝ হুজুরের এই ছ্যাবলামি দেখে দেখে বিরক্ত হয়ে গেছে। এখন সময় পেলে তারা নিজেদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে গুজগুজ ফিসফাস করে। তারই চূড়ান্ত ফলাফল নূর আলমের ছড়াবাজি। সে যে ছড়া লিখতে পারে তা অনেকেরই জানা আছে কিন্তু কেউ কখনো প্রকাশ করেনি। করলে হুজুরের হাতের মার ও ছড়ার খাতাটি হারাতে হবে তাকে। সেটা তারা চায় না। বরং নানা বিষয় নিয়ে ছড়ার মাধ্যমে নূর আলমের মজার বিশ্লেষণ তাদের একঘেয়ে জীবনে একটু আনন্দের খোরাক জোগায়। শেষমেষ ছড়ার মাধ্যমে মেঝো হুজুরকে খানিকটা জব্দ করা গেছে এতেই নিজেদের মধ্যে চাপা খুশিতে আত্মহারা ছেলেগুলো।
কথাগুলো বলে অতুলকে অনুসরণ করে নূর আলম। অতুলের বিমাতাসূলভ আচরণে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে একগাল বকতে থাকে জয়নাল ব্যাপারি।
এসব বিষয় অতুলের কাছে সবৈর্ব বর্ণনা করে নূর আলম। চোখের সামনে যেন একটা আলাদা জগতের দৃশ্য ভেসে ওঠে অতুল। মাদ্রাসায় পড়ার গোপন একটু ক্ষীণ ইচ্ছা তার মনের বাগানে বেড়িয়ে বেড়ায়। অতুলের কাছেও স্কুলের নানা কর্মকাণ্ড শুনে নূর আলমের মনে একই অনুভূতি মাথা ফুঁড়ে মুখ তোলে। কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক কারণে যা সম্ভব নয়, তা নিয়ে আকাশ কুসুমকল্পনা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না দুই কিশোরের। তারা যখন হেসে লুটিয়ে পড়ছিল একে অন্যের গায়ে, তখন এক লোক রাস্তার ওপর থেকে নন্দীকে জহুরের চোখ নিয়ে এক নাগাড়ে মেপে চলছিল। নাকের ডগা থেকে লেজের আগা পর্যন্ত কয়েকদফা মেপে নিয়ে তারপর সেদিকে পা বাড়ায় লোকটি। ছাতার মাথাটি তার বগলের ভেতর দিয়ে সামনের দিকে মৌনাক চূড়ার মতো বেরিয়ে আছে। পেছন দিকে হলুদ রঙের কাঠের বাট।
লোকটি যখন দূর থেকে নন্দীকে চোখের ফিতায় মাপছিল, তখন অতুল আর নূর আলমের আলাপের মোড় অন্য দিকে ঘুরে যায়। কথা প্রসঙ্গে নতুন জামার কথা উঠে আসে। অতুল জানে নতুন একটা রঙিন জামার প্রতি নূর আলমের প্রবল আগ্রহের কথা। নূর আলমকে জিজ্ঞেস করে, জামা কি কিনা হচ্চে তালি?
-নাহ জামা আর কিনা হবে না।
-কেন? সংক্ষীপ্ত প্রশ্ন অতুলের।
-এবারও জোব্বা বানাতি দে এইচে আব্বা। বাড়ির অবস্তা তো জানিস, জোব্বা আর জামা একসাতে কিনা হবে না। তাছাড়া আমাকে জামা পত্তি দেকলি গিরামের লোকও খারাপ কবে। ঝাঁঝের সঙ্গে উত্তর দেয় অতুল।
-আরে গিরামের লোকের কতা থো দিনি। উরা সবসুমায় ওরামই করে। যারা আমার ভৃঙ্গিডারে খেই ফেলাতি পারে, তাদের খারাপ বলাই কী আসে যায়? তোর এট্টা জামা আসলেই কিনা খুব দরকার। আমার নতুন জামা থাকলি কবে দে দিতাম! কিন্তু তার জন্যি তো সেই দুর্গা পূজা পোযযোন্ত অপেক্ষা করা লাগবে।
-আরে বাদ দে, লাগবে না জামা! অতুলের মহৎত্ব তাকে খানিকটা লজ্জায় ফেলে দেয়। এমন সময় বগলের মাঝখানে চাপা খাওয়া ছাতাটি নন্দীর নিকটবর্তী হয়।
ছাতার মালিক নন্দীর পিঠের মাঝখানে বিশেষ যায়গায় বিঘৎ মাপা আঙ্গুলে চেপে ধরে উঁচু করে। কিন্তু চাপ খেয়ে লাফিয়ে উঠে সরে যায় নন্দী। সেই সঙ্গে একটা আতঙ্কিত ডাক ছাড়ে। নন্দীর ওপরে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো নেমে আসা আচমকা উৎপেতে লোকটির দিকে মহারোষে তেড়েফুঁড়ে যায় অতুল। সঙ্গে সঙ্গে তড়িৎ বেগে লাফিয়ে উঠে অতুলের সঙ্গ যোগায় নূর আলম। লোকটির সামনে দাঁড়িয়ে দুটি শীর্ণকায় শরীর পর্বত দৃঢ়তায় প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। নন্দীর দিকে আর এক পাও এগুনোর উপায় থাকে না লোকটির। হকচকিয়ে যাওয়া চেহারা নিয়ে ওদের দুজনকে পালাক্রমে অনুসরণ করে লোকটির অস্থির চোখজোড়া। দুটি কিশোর চেহারায় অনাত্মীয় সুলভ বৈরিতা দেখে থমকায়। লোকটির পরনে নীল রঙের ছিট কাপড়ের তৈরি খাটো পাঞ্জাবি। লাল সুতোয় সেলাই করা একটা বোতাম সহজেই দৃষ্টি কাড়ে। ডান পকেটের গোড়ায় একই রঙের সুতো দিয়ে করা রিপুটিও যথেষ্ট মনোযোগ আকর্ষণ করে। পরনে ছন্দভঙ্গ কায়দায় পরা লুঙ্গি। পায়ে ক্ষয়ে যাওয়া স্যান্ডেল। এই বেশভূষায় তাকে ঠিক চোর বলে মনে না হলেও তার আচরণে যথেষ্ট সন্দেহজনক ব্যাপার রয়েছে।
কণ্ঠে দৃঢ়তা নিয়ে প্রশ্ন করে অতুল, কী ব্যাপার? ছাগলের সাথে এ কিরাম আচরণ আপনার?
-না মানে, আমি হলাম গে ইয়ে। মানে আশপাশের দু’দশটা গিরামে এই ইয়ে মানে, ছাগল-গরু দেখে বেড়াই। বুঝলে না, মানে ইয়ে আরকি। ছ্যাবলামো কিসিমের একটা হাসি মুখে ঝুলিয়ে কৈফিয়তের সুরে বলে লোকটি। -ইয়ে মানে কী? ঘটক? গরু-ছাগলের বে দে বেড়ান আপনি? আক্রমণাত্মক কিন্তু বিদ্রূপের স্বরে অতুলের এই কথায় ফিক করে হেসে ফেলে নূর আলম। লোকটিও অপ্রভিত হয়ে পড়ে। কিন্তু হাল না ছেড়ে পাল্টা প্রশ্ন করে।
-তুমার বাপের নাম কী? কোন পাড়ায় বাড়ি?
-বাবার নাম মনোরঞ্জন। হিন্দু পাড়ায় বাড়ি। কেনো? কাটা-কাটা জবাব দিয়ে আবার পাল্টা প্রশ্ন ছোড়ে অতুল।
বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে এবার চওড়া একটা হাসি দেয় লোকটি। বলে, তুমার বাপ আমারে ভালো করেই ইয়ে, মানে চেনে আরকি। জয়নাল ব্যাপারি বললি এক নামেই ইয়ে, মানে চেনবে বুইঝলে? সামনে তো ইয়ে, মানে বকরা ঈদ। তা তুমাগের ওই ছাগলডা ইয়ে, মানে বেচপা?
-ইয়ে মানে না, আরকি। বেচপো না। আপনি এখন ইয়ে, মানে যাতি পারেন। অতুলের ঠোঁট কাটা জবাবের পরেও দাঁড়িয়ে থাকে লোকটি।
গরুর লেজের আঁটুলির মতো হাল না ছেড়ে লেগে থাকা কণ্ঠে জয়নাল ব্যাপারী বলে, বেচতি চালি আমারে কবা। ভালো ইয়ে, মানে দাম দুবানে। বাড়ি আমার ইয়ে, মানে শালাইপুর। ওই যে, বেশি দূর না। এক নামে সবাই ইয়ে, মানে চেনে আরকি। বেচলি ভালোই ইয়ে পাবা কিন্তুক। কথাগুলো বলার সময় অতুল-নূর আলমের তোলা মানব প্রাচীরের মধ্য দিয়ে ছাগলটির দিকে লোভাতুর চোখে তাকিয়ে থাকে জয়নাল ব্যাপারি। তার ব্যাপারি চোখের বিচারে ঈদের বাজারে ছাগলটির ভালো মূল্য পাওয়া যাবে বলেই বিশ্বাস।
-বেচপো না কাকা। কথাগুলো ক্ষুধার্ত কুকুরের সামনে রুটি ছুড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেই ছাগলটি নিয়ে সোজা মাঠের দিকে হাঁটা দেয় অতুল।
ব্যাপারির উদ্দেশে নূর আলম বলে, ছাগলডা বেচপে না কাকা। ওডা ওর বিরাট প্রিয় ছাগল। ছোট বেলাত্তে মানুষ কচ্চে তো। তাই আপনার কথা শুনে একটু রেগে গেচে, কিচু মনে করবেন না। কথাগুলো বলে অতুলকে অনুসরণ করে নূর আলম। অতুলের বিমাতাসূলভ আচরণে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে একগাল বকতে থাকে জয়নাল ব্যাপারি।
-ভারী ইয়ে তো ছেলেডা! ছাগলডা বেচতি পাল্লি বেশ একটা ইয়ে হতো। ক’দিন পর ঈদ, বেশ ইয়ে ছিল গো ছাগলডা…। জয়নাল ব্যাপারির শেষের কথাগুলোতে আপসোস ঝরে পড়ে।
চলছে…
জামা-২ ॥ ইবনুল কাইয়ুম