মিনাজদ্দি চাকলাদার গরিব মানুষ।
গরিব বলতে আসলেই গরিব। গরিব হতে যা যা বৈশিষ্ট্য দরকার, সবই তার আছে। চারিদিকে ফুলে-ফেঁপে ওঠার এই সময়েও গরিব তাহলে আছে। আছে বলেই তো সে এখনো টিকে আছে।
মিনাজদ্দি তেমনই গরিব। হাতে একটা মোবাইল ফোন নেই। এমনকি ঘরেও নেই। কথা বলার মতোও গুরুত্বপূর্ণ কেউ নেই। পায়ে জুতা-স্যান্ডেল নেই। খালি পায়ে সারাদিন চলে। ঘুমানোর আগেও পা ধোয়ার বালাই নেই। তার বক্তব্য, মাসে একবার কাথা ধুয়ে দিলেই চলে। ঘরে সুগন্ধি সাবান নেই। গোসলের সময় কচা নদীতে দুটা ডুব দিলেই চলে। মাথায় দেওয়ার মতো শ্যাম্পুও নেই। নদীর পাড়ে গিয়ে একটু এঁটেল মাটি চুলে দিলেই চুল ঝরঝরে হয়ে যায়।
সবচেয়ে বড় কথা, তার কোনো ছেলে নেই। মাত্র দুটি মেয়ে। বড় মেয়ে টিয়ার বিয়ে দিয়েছে এক ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে। উপজেলা শহরে একটি খুপড়ি ঘরে ভাড়া থাকে। জামাই সারা মাস এদিক-ওদিক খ্যাপ দিয়ে বেড়ায়। বছরে একবার শ্বশুরবাড়ি আসে। কোনো দাবি-দাওয়া নেই। ছোট মেয়ে হিয়া অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। গ্রামের উঠতি ছেলেগুলো পেছনে লাইন লাগিয়েছে। চেহারা-ছবি ভালো বলে। মিনাজদ্দি তাতে গর্বিতও বটে।
এই যে আগেই বললাম, ছেলে নেই। এই ছেলে না থাকার কারণে সে গরিব। গরিব রয়ে গেছে। ছেলে থাকলে হয়তো বিদেশ যেত। অনেক টাকা কামাতো। প্রতিবেশীদের মতো বাড়িতে বিল্ডিং করতো। পাকা মসজিদ হতো। নামাজ না পড়লেও মসজিদ কমিটির সভাপতি হতে পারতো। পাড়ায় ওয়াজ-মাহফিল হলে পোস্টারে মোটা করে তার নাম লেখা থাকতো। নামের আগে বিশিষ্ট সমাজসেবক লেখা থাকতো। ছেলেটা তার বড় বোনকে পড়ালেখা করাতো। বড় অফিসারের সঙ্গে বিয়ে দিত। ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি থাকতো। ছোট বোনটাকেও ঢাকায় রেখে ভার্সিটিতে পড়াতো। একসময় বিসিএস ক্যাডার হতো।
কোনো আশাই পূরণ হয়নি মিনাজদ্দির। এক জীবনে মিনাজদ্দির কাজের কাজ কিছুই হয়নি। হতাশ মিনাজদ্দি একটা ছেলে না থাকার আক্ষেপে মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরেও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তখন পাশ থেকে স্ত্রী জরিনা বানু বলে ওঠে, ‘অকি, আপনে এহনো ঘুমান নাই?’
গলায় হালকা কাশির আওয়াজ তুলে মিনাজদ্দি জবাব দেয়, ‘তুমি ঘুমাও নাই ক্যান?’
জরিনা অনুযোগের সুরে বলে, ‘ঘুম তো আহে না।’
তার ওপর বাড়তি দু’জন। বাড়তি খরচ। করোনার দাপটে গত দু’বছরে আয়-রোজগারও ভালো নয়। সবার মনেই চিন্তা আর হতাশার চিত্র।
মিনাজদ্দি এ সুর বোঝে। তবুও রেগে যায়, ‘ঘুমাও। রাইত জাগলে শরীল আরও খারাপ অইবো। তোমারে দিয়া তো আর ভরসা নাই। যে কয়দিন বাঁইচা থাকো, আমাগো এট্টু শান্তিতে থাকতে দাও।’ বলেই পাশ ফিরে শোয়। চোখের কোণে জমা হয় বিষাদের জল।
এদিকে অভিমানে ঠোঁট ফুলে ওঠে জরিনা বানুর। কাঁদতে পারে না শব্দ করে। ফোঁস ফোঁস শব্দ শোনা যায় কেবল। ছোট মেয়ে হিয়ার জন্মের পর পরই সমস্যাটা টের পায় জরিনা বানু। তখন অতটা আমলে নেয়নি। গায়ে-গতরে জোর আছে। থোরাই কেয়ার। তা ছাড়া গরিব মানুষ। আমলে নিতেও তো অনেক টাকা-পয়সা লাগে। ডাক্তার মানেই তো কসাই। হাসপাতাল মানেই দোজখ। তাদের অত টাকা কই? গরিব হলেও একপ্রকারে সুখেই ছিল। কোনো অভিযোগ ছিল না। শুধু স্বামীর একটু খামখেয়ালিপনা ছিল। তা-ও মানিয়ে নিয়েছিল।
দেখতে দেখতে জরিনা বানুর সমস্যা যখন গভীরে; তখন গেল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার বলল, জরায়ুতে ক্যান্সার ধরা পড়েছে জরিনা বানুর। সময় বেশি নেই হাতে। যতদিন আছে, চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। তবে জরায়ুটা কেটে ফেলতে হবে।
একটা ছেলের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল মিনাজদ্দির। এবার হতাশা যেন স্থায়ী হয়ে গেল।
এটা নিয়ে বউকে কখনো কটু কথা বলেনি। নিজের কষ্টটা নিজের বুকেই আগলে রেখেছে। তবে জরিনা বানুও কম কষ্ট পায়নি। সেটাও সে বোঝে। হিয়া যখন পেটে আসে; মিনাজদ্দি হেসে হেসে বলেছিল, ‘টিয়ার পর এবার একটা পোলা অইলে কেমন অয় জরি?’ সেই থেকে জরিনাও জানে, একটা ছেলের জন্য কেমন হাহাকার করছে মিনাজদ্দির বুকটা। অসুস্থতার পর একদিন স্বামীকে বলেছিল, ‘আমি মইরা গেলে তুমি আরেকটা বিয়া কইরো।’
জরিনা বানুর কথা শুনে মিনাজদ্দি কিছুক্ষণ হাসে। হেসেই যেন কথাটি উড়িয়ে দেয়। অন্যমনস্ক হয়ে বলে, ‘আইচ্ছা, পরেরটা পরে দেখা যাইবো।’
স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে যেটুকু গরিব হওয়া বাকি ছিল, তা-ও হয়ে গেল মিনাজদ্দি। ভিটা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। একমাত্র জামাইয়ের কাছে হাত পাতা যায় না। সমাজে সম্মান ক্ষুণ্ন হয়। গরিব হলেও কিছুটা সম্মান তো তার অবশিষ্ট আছে।
তা ছাড়া শীতের এই সময়ে গায়ে জড়ানোর একটা চাদর তো আছে। সেটা ভাঁজ করে কাঁধে চাপায়। জমিদারি একটা ভাব চলে আসে। খালি পায়ের জমিদার মনে হয় নিজেকে। মিনাজদ্দি ভাবে, পায়ের তলায় মাটিই তো নেই। জুতা থেকে আর কী হবে?
রাতে জরিনা বানুর পাশে শুয়ে কাথা টানাটানি করে মিনাজদ্দি। কাথাটা বহরে ছোট। টিয়ার জন্মের পর জরিনা বানুর মা সেলাই করে দিয়েছিল। আদরের নাতনির যেন শীত না লাগে। একজনের কাথায় কি দুজনের হয়? তাই জরিনার কথামতো দুজনে বুকে বুক লাগিয়ে শোয়। যেন পিঠ বের না হতে পারে।
জরিনা বানুকে বুকে জড়িয়ে মিনাজদ্দি বলে, ‘জরি, কাইল তো তোমারে নিয়া ঢাকা যাইতে অইবো।’
‘ঢাকা যাইয়া এহোন আর কাম কী? খালি খালি কতগুলা টাহা নষ্ট। বাড়িতেই থাহি না এই কয়টা দিন।’ নিষ্প্রভ কণ্ঠে জবাব দেয় জরিনা বানু।
‘ক্যান? তাড়াতাড়ি চইলা যাইতে চাও? আমারে একলা ফালায়া যাইতে পারলেই বাঁইচা যাও? কষ্ট পাইতাছো জানি। পয়সা থাকলে বড় ডাক্তার দেহাইতাম। বড় হাসপাতালে ভর্তি করতাম। আমার তো কিছুই নাই জরি।’
‘মনে কষ্ট নিয়ো না টিয়ার বাপ। কপালে যা লেখা থাকে, তা কি এড়ানো যায়?’ মিনাজদ্দির চুলে আঙুল চালাতে চালাতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাটা বলে জরিনা বানু।
‘সবই বুঝি, তয় মনডা যে মানে না টিয়ার মা।’ আক্ষেপের সুরে বলে মিনাজদ্দি।
সারাদিন সব জোগাড়-যন্তর করে ঢাকা যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে থাকে মিনাজদ্দি আর জরিনা বানু। হিয়া থাকবে বাড়িতে। না হলে বাড়ি যে খালি পড়ে থাকবে। হিয়াকে নিয়েও দুশ্চিন্তা হয় মিনাজদ্দির। বাড়ন্ত কিশোরীর প্রতি লোলুপ দৃষ্টি অনেকেরই। আধুনিক মজনুরাও ঘুরঘুর করে আশেপাশে। গরিবের বউ সবার ভাবির মতো গরিবের সুন্দরী মেয়ে সবার প্রেমিকা। তাই ছোট ভাইয়ের বউ হালিমাকে বলেছে খোঁজ-খবর নিতে। পাশের বাড়ির কুলসুম এসে রাতে ঘুমাবে হিয়ার সঙ্গে।
ঘরের বেড়া জায়গায় জায়গায় ভাঙা। পলিথিন, ভাঙা টিন আর পাটের বস্তা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে মিনাজদ্দি। শীতের রাতে বাইরের ঠান্ডা ঢুকে যায় হু-হু করে। তার চেয়ে বড় শঙ্কা বিশেষ শ্রেণির শেয়াল-কুকুরের। মানুষরূপী এসব শেয়াল-কুকুর থেকে রক্ষা পাওয়া দুষ্কর। তবুও মেয়েকে একা রেখে যেতে হয়। একজনের যাতায়াত ভাড়াও কম কথা নয়। সবশেষে ‘আল্লাহ ভরসা’ বলে হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে মিনাজদ্দি ও জরিনা বানু। হিয়াও আসে তাদের সঙ্গে ঘাট পর্যন্ত।
লঞ্চ ঘাটে বসে থেকে কতসব রাজ্যের চিন্তা করতে থাকে মিনাজদ্দি। যাত্রী ছাউনির বেঞ্চে বিছানার চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে জরিনা বানু। দূর থেকে লঞ্চের ভেপু শোনা যাচ্ছে। ল²ণদী ঘাটে ভিড়তে আর পনেরো মিনিটি সময় লাগবে। জরিনা বানুর মাথার কাছে বসে আছে হিয়া। চোখ তুলে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জরিনা বানু বলল, ‘সাবধানে থাহিস মা। যদি ফিইরা না আহি, আমারে মাপ কইরা দিস। তোরে তেমন আদর-সোহাগ দিতে পারি নাই। মরার অসুখে পইড়া তোরে কত অবহেলা করছি। ঠিকমতো কোলেও নিতে পারি নাই।’
জরিনা বানুর চোখে পানি। হিয়াও চোখ মোছে গোপনে। মাকে কপট ধমক দেয়। রাগতস্বরে বলে, ‘আজেবাজে কতা কইবা না মা। তোমার লগে আবার দেখা অইবো। দেইখো।’
‘মনডা যে সায় দেয় না মা।’ চরম হতাশা নিয়ে কথাটি বলে জরিনা বানু।
মিনাজদ্দি এসে তাড়া দেয়। লঞ্চ একেবারে ঘাটে ভিড়ে গেছে। দুজনের কাঁধে ভর করে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে লঞ্চে ওঠে জরিনা বানু। হিয়া আর ভেতরে যায় না। চোখ মুছতে মুছতে আবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে।
ঢাকা এসেও মনটা ছটফট করে জরিনা বানুর। মন পড়ে থাকে বাড়িতে।
দুরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠে তারা। আত্মীয়রা ঠিক সহজভাবে নিয়েছে কি না বুঝতে পারে না। ছোট বাসা, মানুষ বেশি। তার ওপর বাড়তি দু’জন। বাড়তি খরচ। করোনার দাপটে গত দু’বছরে আয়-রোজগারও ভালো নয়। সবার মনেই চিন্তা আর হতাশার চিত্র।
বাড্ডা থেকে মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখায়। ডাক্তার ভরসা দেয় না। শুষ্ক মুখে তাকায় মিনাজদ্দির দিকে। তার চোখে হতাশার ছায়া। ছোট্ট করে বলে, ‘বাড়ি নিয়ে যান। ছেলে-মেয়ে দূরে থাকলে খবর দেন।’
তারা শেষ আলিঙ্গনে খুঁজে পায় পৃথিবীর সব সুখ। ভুলে যায় যত অপূর্ণতা। কী আছে, কী নেই? নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মনে হয় জরিনা বানুর। নিজেকে সার্থক স্বামী মনে হয় মিনাজদ্দির।
বাড়ি ফেরার জন্য সদরঘাট যায়। বরগুনাগামী লঞ্চে ওঠে। লঞ্চের ডেকে বিছানা পেতেছে। এই শীতে কেবিনে যাতায়াত করলে ভালো হতো। কিন্তু কেবিনে যাওয়ার মতো টাকা-পয়সা কই মিনাজদ্দির? ডেকে হোগলার ওপর বিছানো হয়েছে চাদর। গায়ে দেওয়ার জন্য মোটা কাথাটাও এনেছিল। আত্মীয়ের বাসা থেকে এক বাটি ভাত, এক বাটি তরকারি আর এক বাটি ডাল দিয়েছে। কারণ লঞ্চে কিনে খেতে পারবে না তারা। পরে কি না সারারাত না খেয়ে থাকে।
সন্ধ্যায় সদরঘাট থেকে কয়েকশ যাত্রী নিয়ে রওনা হয় এমভি অভিমান। চাঁদপুর, বরিশাল ও দপদপিয়া ঘাট পেরিয়ে লঞ্চটি যায় বেতাগী, শেষ গন্তব্য বরগুনা; শীতের রাতে যাত্রীদের অধিকাংশই ঘুমে আচ্ছন্ন। জরিনা বানুকে জড়িয়ে কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে মিনাজদ্দি।
লঞ্চের দোতলায় হঠাৎ বিস্ফোরণ হয়। ঘুমের ঘোরে টের পায় না তারা। কেবিনে আর লঞ্চের পেছনের বিভিন্ন অংশে আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। উপরের দিকে উঠতে থাকে আগুন। জরিনা বানু ও মিনাজদ্দি নিচ তলায়। ধোঁয়ার গন্ধে ঘুম ভাঙে তাদের। ততক্ষণে তৃতীয় তলার কেবিন ও নিচ তলায় ছড়িয়ে পড়ে আগুন।
অনুমান করে, রাত প্রায় ৩টা। চারদিকে অন্ধকার। ধোঁয়ার রাজত্ব। গরম হয়ে উঠছে ডেকের লোহাও। ত্রিপল বেয়ে ধেয়ে আসছে আগুন। লঞ্চ থামছে না কোথাও। এগিয়ে যেতে থাকে অভিমান। মানুষের চিৎকার-হাহাকার লঞ্চজুড়ে। একপর্যায়ে পুরো লঞ্চ পরিণত হয় নরককুণ্ডে। রাতের কুয়াশা কাটিয়ে সুনন্দা নদী আলোকিত করে তোলে সেই আগুন। প্রাণ বাঁচাতে অনেকেই নদীর শীতল জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আগুন দেখে ছুটে আসে আশপাশের গ্রামের মানুষ। প্রাণ বাজি রেখে ঝাঁপ দেওয়া অনেকেই কূল খুঁজে পায়। এগিয়ে গিয়ে তাদের তুলে নেয় স্থানীয়রা।
মিনাজদ্দি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। একা একা ঝাঁপ দিতে চায় না। জরিনা বানুকে সঙ্গে নিতে চায়। জরিনা বানু রাজি হয় না। দিশেহারা হয়ে বলে, ‘তুমি পরানডা লইয়া লাফায়া পড়। আমার আশা বাদ দেও। আমি আর কয়দিনই বা বাঁচুম?’
মিনাজদ্দি বউকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে, ‘না রে জরি, তোরে ফালায়া আমি কই যামু? গরিব অইলেও এতটা নিমকহারাম আমি না।’
‘পাগলামি কইরো না টিয়ার বাপ। বাড়িতে ছোড মাইয়াডা একলা। তুমি অরে দেইখা রাইখো।’ জোর মিনতি করে জরিনা বানু।
মিনাজদ্দি নাছোড়বান্দা। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জরিনাকে। এদিক-ওদিক তাকায়। পালানোর পথ নেই। নিজেদের অজান্তেই আগুনের বেড়াজালে আটকা পড়ে গেছে। আগুনের লেলিহান শিখা ঘিরে ধরে তাদের। মানুষের ছোটাছুটি। দগ্ধ মানুষ ছুটছে পানিতে ঝাঁপ দিতে। লঞ্চের ডেকে দাঁড়ানো যায় না। পা পুড়ে যাচ্ছে। তাই আগুনে পুড়ে মরার চেয়ে জলে ডুবে মরাও শান্তির-আরামের।
জোর গলায় মিনাজদ্দি বলে, ‘আমি তোমারে ফালায়া যামু না জরি।’
জরিনা বানু কাতর কণ্ঠে বলে, ‘আমি আর কয়দিন বাঁচুম। আমার আশা বাদ দেও।’
‘না। মরলে দুই জনই মরুম।’ বলে জরিনা বানুকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিনাজদ্দি। চতুর্দিক থেকে ধোয়া আর আগুনের কুণ্ডুল আসতে থাকে। জরিনা-মিনাজদ্দি চোখ বন্ধ করে ফেলে। তাদের বন্ধন যেন আরও মজবুত হয়। চিরদিনের জন্য। তারা শেষ আলিঙ্গনে খুঁজে পায় পৃথিবীর সব সুখ। ভুলে যায় যত অপূর্ণতা। কী আছে, কী নেই? নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মনে হয় জরিনা বানুর। নিজেকে সার্থক স্বামী মনে হয় মিনাজদ্দির।