গল্পের কথা
পেশাগত কাজের সূত্রে তৃণমূল মানুষের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। তাদের মধ্যে জেলে সম্প্রদায়ও একটি। ২০০৪ সাল থেকে লম্বা একটা সময় কেটেছে এই সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর সঙ্গে, তাদের শিশুদের সাংস্কৃতিক চর্চায় যুক্ত করতে। তাদের প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না দেখেছি অনেক কাছ থেকে।
অনেক স্মৃতি এখনো মনকে স্পর্শ করে, আন্দোলিত করে অজান্তেই। নদী আর সাগরের টানে জলময় পাড়ে যখনই একান্ত সময় কাটাতে গেছি, তখনো এমন জলজ শ্রেণীর মানুষের দেখা পেয়েছি। তাদের জীবন যুদ্ধের করুণ চিত্র ভাবিয়েছে খুব। বিভিন্ন সময়ে দেখা সে সব মানুষগুলো আমার লেখায় আসতে পারে সচেতনভাবে সেটা ভাবিনি কখনো। সম্প্রতি এক শিশুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল কক্সবাজারে। সে বাংলাদেশের কোনো একটি জেলে পল্লী থেকে পাচার হয়ে এসে পড়েছে এখানে। পরিবারের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, পিতার উপার্জনহীন সময়, পরিবারের মানুষগুলোর মুখে খাবার তুলে দিতে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার নিদারুণ বাস্তবতা দেখে থমকে গেছি।
তথাকথিত শোষক শ্রেণীর শোষণের ঠুনকো হাতিয়ার হয়ে কী নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হয়, এসব পরিবারের মানুষগুলোকে, স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি সেটা খুব কাছ থেকে। সেই শিশুর মুখটা এখনো চোখে ভাসে। চোখে ভাসে তার মায়ের কাছে ফেরার আর্তি। সেই শিশুটিই আমাকে ‘জলজগাথা’র মতো একটি ছোটগল্প লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে অগোচরে। এই গল্পের অনেকটাই সত্যি। কিছুটা কল্পনার আশ্রয় নিলেও সেটা নিঃসন্দেহেই যেকোনো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রামের এক খণ্ডচিত্র।
জলজগাথা ॥ প্রদীপ আচার্য
দুপুর গড়িয়ে যেতেই কুমারছড়া বাজারে কানাঘুষা শুরু হয়। লক্ষ্মীন্দর গায়ে একটা পুরোনো হালকা ধূসর চাদর জড়িয়ে বাজারে, সিকদারের চায়ের দোকানে এসে বসে। পাঁচ টাকার ড্রাই কেকের প্যাকেটে ছোট দুটো ড্রাই কেক আর এককাপ দুধ চা দিয়ে বৈকালিক নাশতা সারে। চা, ড্রাই কেক খেতে খেতে বোঝার চেষ্টা করে কাহিনি। সিকদারের দোকানেই বিষয়টা নিয়ে কথা হয়। ভোর রাতে নদীর পাড়ে সীমান্ত রক্ষীরা নাকি বেশ কিছু মাদক জব্দ করেছে। সীমান্তরক্ষীদের আসার খবর পেয়ে কারা যেন মাদক ফেলে পালিয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে কাল থেকে নদীতে মাছ ধরা নিষেধ। নদীতে যদি মাছ ধরা বন্ধ কইরা দেয়, তয় আমাগো কি দশা হইবো!
-কণ্ঠে উত্তেজনা, অনিশ্চয়তা আর হতাশা মিশিয়ে কথাগুলো বলে হরিনাথ। কুমারছড়া বাজারের সঙ্গে লাগানো জেলে পাড়া। একসময় এই জেলে পাড়ার নাম ছিল শান্তিপদের বাড়ি। কাল পরিক্রমায় এখন এই পাড়ার নাম এসে ঠেকেছে জ্যাইল্লা পাড়ায়। আনুমানিক ষাটটি জেলে পরিবারের বাস এই পাড়ায়। অধিকাংশেরই জীবিকা সুখখালী নদীতে মাছ ধরা। লক্ষ্মীন্দর চাদরের ভেতর হাত ঢুকিয়ে শার্টের পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট বের করে দেয় দোকানিকে। বাড়িতেই বিষয়টা কানে এসেছিল, বাজারে এসে তার সত্যতা টের পায় সে। দোকানের এমন সরব আলোচনায় তেমন অংশ নেয় না নিয়ে ভাবতে থাকে নীরবে। এ কোনো নতুন অনিশ্চয়তা ভর করতে যাচ্ছে জেলে পাড়ার পরিবারগুলোতে! চুপচাপ বাজার থেকে বেরিয়ে সে নদীর দিকে হাঁটে।
শীতটা বেশ পড়তে শুরু করেছে এবার। রাত বাড়তে বাড়তে টিনের চালের ওপর কুয়াশার ফোঁটা বৃষ্টির মতো ঝরে। মোটা কাঁথা বিছিয়ে বিউটিকে নিয়ে নিচে শোয় রাজরানী। খাটে লক্ষ্মীন্দর আর বিশ্বজিত। শীতের প্রকোপ, সঙ্গে সামনের অনিশ্চিত সময়ের কথা ভেবে ঘুমহীন রাত কাটে রাজরানীর। আজ দশ দিন চলে গেলো নদীতে মাছ ধরা বন্ধ। যত দিন যায় সময় কঠিন হয়ে আসে আরও। ঘরে সামান্য যা চাল-ডাল ছিল, তাও শেষ হয়েছে সেই কবে, মুদি দোকানি সাফ জানিয়েছে আর বাকি দেবে না। এসব চিন্তায় রাজরানীর ঘুমহীন রাতের প্রহর কখন ভোরের দিকে উঁকি দেয় টের পায় না সে নিজেই। হঠাৎ মুখে শীতল হাতের স্পর্শ পায় রাজরানী। লক্ষ্মীন্দর খাট থেকে নেমে জড়োসড়ো হয়ে ঢুকে পড়ে রাজরানীর লেপের ভেতর। কী কর, পোলা মাইয়া জাইগা উঠবো! ফিসফিসিয়ে বলে রাজরানী।
তুই চুপ কর, পোলা মাইয়ার আর খাইয়া দাইয়া কাম নাই, মায়ে বাপে কী করে, তা দেখার লাইগা জাইগা থাকবো রাইতভর! রাজরানীর কানের কাছে কথাগুলো বলে তার কানের লতিতে আলতো করে দাঁত কাটে লক্ষ্মীন্দর। মাথায় জমে থাকা দুশ্চিন্তা ক্ষণিকের জন্য দু’জনের শরীর বেয়ে শূন্যে মেলায় দ্রুত।
আচমকা রাজরানী রুম থেকে বের হতে চাইলে বতাকে টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে নেয় আবার বাবু। বলে, আমার কথা মাইন্যা নাও। নইলে সোয়ামিরে আর জেল থেইক্যা ছাড়াইতে পারবা না।
আজকাল নদীতে যাওয়ার তাড়া নেই। বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে লক্ষ্মীন্দর। রাজরানী এককাপ লাল চা আর ঠাণ্ডা পরোটা দেয় খেতে। পাড়ার চায়ের দোকানি পরোটা বাকি দিতে চায় না। রাজরানী বলে-কয়ে কয়েকটা বাসি পরোটা নিয়ে আসে। চা খেতে খেতে সে লক্ষ্মীন্দরকে জিজ্ঞ্যেস করে, শুকলাল যে তোমাকে খুঁইজতে আইছিল, তার লগে কথা হইছে?
হ। হইছে, হে একডা কামের কথা কইতেছিল। উত্তর দেয় লক্ষ্মীন্দর।
কী কাম? প্রশ্ন করে রাজরানী।
কী একটা জিনিস নাকি একজনরে পৌঁছাইয়া দেওন লাগবো, ঠিক বুঝতাছি না, হের লাইগ্যা নাকি ভালা টাকাও পামু!
দেইখো আবার কোনো ঝামেলা না তো? রাজরানীর কণ্ঠে শঙ্কা ঝরে।
হ, তাই ভাবতাছি। দেখি কী করন যায়। আরেকটু বেলা বাড়লে ঘাটের দিকে যামু। শুকলাল ঘাটে থাকব কইছে। তুই অত কিছু ভাবিস না। কিছু একটা করুম আমি। কথাগুলো বলতে বলতে রুমের দিকে উঁকি দেয় লক্ষ্মীন্দর। বিউটি খাটে উঠে গেছে, ভাইয়ের পাশে, জড়োসড়ো। দুজন তখনো ঘুমে।
নদীতে বাতাস নেই, কনকনে ঠাণ্ডা। স্রোতও স্থির। জেলেপাড়ার ছোট নৌকাগুলো ঘাটে ঝিমুচ্ছে। ঘন কুয়াশা জলের ওপর ধোঁয়া হয়ে ভাসছে। অদূরেই মোহনা। নদীর ওপর গাঙচিল উড়ছে, মওকা বুঝে ছোঁ মারবে শান্ত জলের বুকে। পাড়ের কোথাও আবার হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে আছে দু’একটা গাঙচিল। ঘন কুয়াশায় চেনা যাচ্ছে না সুখখালী নদীকে। মনে হচ্ছে এ নদীর ওপার বলতে কিছু নেই। বেলা বাড়লে নদীর ঘাটে আর প্রতিদিনকার মতো ব্যস্ততা নেই। স্পিড বোটে যাত্রীরা ওঠা-নামা করছে। নদীর মোহনা হয়ে সাগরের বুকে ভেসে দ্রুত পৌঁছে যাওয়ার তাড়া যে যার গন্তবে। আবার কবে নদীতে মাছ ধরার অনুমতি মিলবে কেউই বলতে পারছে না। লক্ষ্মীন্দর ঘাটে আসে। খেয়াল করে তার শরীর মনে কোনো চাঞ্চল্য নেই। ভেতরে জমে থাকা হতাশা দীর্ঘশ্বাস হয়ে গড়ায়। গত দুই-দিন ধরে মোবাইল বন্ধ, মোবাইলে টাকা নেই। শুকলালকে খুঁজতে থাকে সে। হঠাৎ পেছন থেকে পরিচিত কণ্ঠ কানে আসে।
দাদা, আমারে খুঁজতাছ? এই তো আমি।
লক্ষ্মীন্দর ঘুরে তাকায়। শুকলাল। লক্ষ্মীন্দরের ছোট ভাই। সে কখনো জেলে পেশায় আসেনি। লক্ষ্মীন্দরই পৈত্রিক পেশাটাকে ধরে রেখেছে লালিত কষ্টে। দুবছর হলো শুকলাল জেলে পাড়ায় থাকে না আর। ঘাটের কাছের গ্রামটাতে জায়গা কিনে ঘর বানিয়ে পরিবার নিয়ে সেখানেই থাকে। শুকলাল ঘাটের জটলা থেকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় লক্ষ্মীন্দরকে। হাতে ছোট প্যাকেটের মতো কিছু একটা ধরিয়ে দেয়। চাদরের ভেতরে সেটা ঢুকিয়ে নেয় লক্ষ্মীন্দর। আর একটা ছোট কাগজ পুরে নেয় শার্টের পকেটে। মুহূর্তের মধ্যে পুরো ঘটনা ঘটে। যাওয়ার আগে লক্ষ্মীন্দর বলে, ভাই, কোনো অসুবিধা হইব না তো?
শুকলাল উত্তর দেয়, এত ভাইবো না তো, এভাবে কাম ছাড়া তুমি বইয়া থাকলে তো না খাইয়া মরবা। কোনো অসুবিধা হইব না, ঠাকুর সহায়! জিনিসটা ঠিকঠাক মতো পৌঁছাইয়া দাও, তিন হাজার টাকা পাইবা। হে টাকা দিয়া তো কিছু দিন চলতে পারবা, পরেরটা পরে দেখা যাইবো। এখন তুমি যাও। এয়ানে বেশিক্ষণ আর থাইক না।
দুভাই দুদিকে হাঁটা দেয় মুহূর্তেই। গন্তব্য ভিন্ন তাদের।
দুপুর বারোটার দিকে জেলে পাড়ায় হঠাৎ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খবর রটে যায় লক্ষ্মীন্দর ইয়াবাসহ ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে গেছে এবং জেলে পাড়ায় এসে নাকি বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করবে। কেউ কেউ বলাবলি করছিল, লক্ষ্মীন্দরের পরিবারের সবাইকে হয়তো ধরেও নিয়ে যাবে। খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে রাজরানীর। দৌড়ে ছুটে যায় পাড়ার সর্দার বিষ্ণুপদের কাছে।
আপাতত পোলা মাইয়া লইয়া আশে পাশে কোথাও লুকাইয়া থাক। বাকিটা আমি দেখতাছি। কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে যায় বিষ্ণুপদ।
মা লক্ষ্মী বেজার হইছে। আইজ বেস্পতিবার। লক্ষ্মী পূজাটা আর দিতে পারুম না আইজ। বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে বলতে বেড়ার দরজায় ছোট তালা লাগিয়ে বিউটিকে সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে বিশ্বজিতকে খুঁজতে থাকে রাজরানী। কোথায় যাবে জানে না নিজেও।
পাড়ায় পুলিশ এসে কয়েকটি বাড়ি তল্লাশি করে যায়। বিষ্ণুপদ সর্দার যতটা পারে পুলিশকে শান্ত করার চেষ্টা করে, অনুরোধ করে লক্ষ্মীন্দরের পরিবারকে যেন হেনস্তা না করা হয়। পুলিশ চলে গেলে বিষ্ণুপদ গোপনে খবর পাঠায় রাজরানীর কাছে। বিকেলের মধ্যে যেন লক্ষ্মীন্দরের পরিবারকে থানায় গিয়ে দেখা করতে হবে নতুবা তারা তল্লাশির জন্য আবার জেলে পাড়ায় আসবে। লক্ষ্মীন্দরকে পরের দিন সকালে জেলে চালান করা হবে। রাজরানী দৌড়ে আসে বিষ্ণুপদের কাছে। হুনো, পুলিশের অত্যাচার বন্ধ করতে হইলে তাগো কিছু টাকা দেওনই লাগব। আর লক্ষ্মীন্দররে ছাড়ানোর কথা পরে ভাবন যাইবো। বলে বিষ্ণুপদ। তার কথাগুলো রাজরানীর কাছে বড় অপরিচিত শোনায়। শুকলালের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তার ফোন বন্ধ।
লক্ষ্মীন্দর ধরা পড়ায় সে গা ঢাকা দিয়েছে। কী করবে, বুঝতে পারে না রাজরানী। তার নিদারুণ অসহায়ত্ব মাপার জন্য বিষ্ণুপদের আর তার মুখের দিকে তাকাতে হয় না। জাল আর জলের জীবনে পুরোটা সময় কাটিয়ে দিয়ে সময়ের সাক্ষী হয়ে আজ তাকেই বয়ান করতে হয় জেলে জীবনের বিপর্যয় কথকতা, পিতা হওয়ার ভারত্ব যে আজীবন উপলব্ধি করেছে শরীরে মাছের গন্ধ শুঁকে। বিষ্ণুপদ বলে, এক কাম করো, তুমি গফুর মাঝির কাছে যাও। এ সময়ে হেয় একমাত্র জন, যে টাকা ধার দিতে পারবো। বিষ্ণুপদ গফুর মাঝিকে ফোনে সব বলে। গফুর মাঝির সাগরে মাছ ধরার বেশ কয়েকটা ট্রলার আছে। দ্বীপে শুটকি শুকানোর মাঠও আছে। আছে আরও নানান ব্যবসা।
জেলে পাড়ার অনেকে তার ট্রলারে দিনমজুর খাটে। জেলে পাড়ার লোকেরা তাকে ডাকে গফুর বাবু। এক সপ্তা’র মধ্যে টাকা ফেরত দেয়ার শর্তে বাবু রাজরানীকে তিন হাজার টাকা ধার দেয়। জেলে পাড়ায় পুলিশের হয়রানি আপাতত বন্ধ হয়। রাজরানী ছেলে-মেয়ে নিয়ে ফিরে আসে বাড়িতে।
চারদিন পর সর্দার কাকা আর রাজরানী জেল গেটে দেখা করতে যায় লক্ষ্মীন্দরের সঙ্গে। এই কদিনে লক্ষ্মীন্দরের চেহারা এমন হয়েছে যে তাকে চেনা যায় না প্রায়। সে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্নের কথা বলে রাজরানীকে। বলে, আমারে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করো। তার চোখে মুখে কেমন এক শঙ্কা কাঁপে।
রাজরানী কান্না লুকায় তার আটপৌরে শাড়ির আঁচলে। তুমি অত ভাইবো না। খুব তাড়াতাড়ি তোমারে এইখান থেইক্যা ছাড়ানোর ব্যবস্থা চলতাছে। আমি আর কাকা এখান থেইক্যা উকিলের কাছে যামু।
-অভয় দেয় রাজরানী। চলে যাওয়ার সময় লক্ষ্মীন্দর রাজরানীকে ডাকে, হুইন্না যাও।
রাজরানী মুখ ঘুরিয়ে বলে, কিছু কইতাছ?
হ। আর কয়দিন পরেই না আমাগো বিউটির জন্মদিন?
হ, পৌষের ছাব্বিশ তারিখ। উত্তর দেয় রাজরানী।
কয় বছরে পড়বো আমার মাইয়াডা?
আট বছরে।
ডাঙ্গোর হইয়া যাইতাছে মাইয়াডা! বিড়বিড় করে লক্ষ্মীন্দর। বলে, হোনো, হের জন্মদিনের দিন যদি পারো তো তারে খানিকটা গুড়ের পায়েস বানাইয়া দিও।
হ, দিমু। আর ভগবানকে ডাকো তার আগে যেন তোমারে ছাড়াই লইতে পারি। ধরা গলায় বলে রাজরানী। অশ্রু আর শাড়ির আঁচলের আড়াল মানে না তার। লক্ষ্মীন্দরের দৃষ্টি এড়িয়ে চোখ মুছে দ্রুত চলে যায় রাজরানী। লক্ষীন্দর অপলক তাকিয়ে দেখে তার চলে যাওয়া।
সপ্তাহ পেরিয়ে যেতেই বাবুর লোক আসে জেলে পাড়ায়। রাজরানীকে দেখা করতে বলে বাবুর সঙ্গে। এদিকে খবর আসে নদীতে আবার মাছ ধরার অনুমতি মিলেছে। পাড়ার লোকেদের মুখে হাসি ফেরে আবার। রাজরানী প্রতিদিন সর্দার কাকার বাড়ি যায়। যদি কোনো উপায় বের হয়! গফুর বাবু সর্দারের কাছে ফোন করে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য। সর্দার রাজরানীকে বলে গফুর বাবুর সঙ্গে তার মাছের আড়তে দেখা করতে। দুপুরের দিকে ব্যস্ততা কমে এলে রাজরানী ছেলে-মেয়েকে বাড়িতে রেখে বটের টেকের দিকে যায় বাবুর আড়তে। ভোর থেকে ব্যস্ততম এ জায়গায় দুপুর হতে না হতেই নেমে আসে নীরবতা।
আড়তের পেছনে বাবুর বিশ্রামের জায়গা। বাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে একজন বাবুর বিশ্রামের জায়গায় নিয়ে যায় রাজরানীকে। বাবু তখন মোবাইলে ফেসবুকিংয়ে ব্যস্ত। রাজরানীসহ লোকটি রুমে ঢুকতেই বাবুর ইশারায় সে রাজরানীকে রেখে তৎক্ষণাৎ বাইরে বেরিয়ে যায়, আলতো করে দরজা বাইরে থেকে টেনে দিয়ে যায়। রুমের ভেতরে বাবু আর রাজরানীর হালকা কথা-বার্তা শোনা যায় বাইরে থেকে। আচমকা রাজরানী রুম থেকে বের হতে চাইলে বতাকে টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে নেয় আবার বাবু। বলে, আমার কথা মাইন্যা নাও। নইলে সোয়ামিরে আর জেল থেইক্যা ছাড়াইতে পারবা না।
ভেতর থেকে দরজা বন্ধের তীব্র শব্দে রাজরানীর কণ্ঠের হাহাকার ক্ষীণ হয়ে আসে। নীরবতা নামে সহসা। নির্বিঘ্ন হয় বাবুর যৌনসম্ভোগ।
বাবুর দিক থেকে আপাতত টাকা পরিশোধের চাপ কমে আসে। তবে সে শর্ত দেয়, রাজরানীর ছেলে বিশ্বজিতকে টেকের দ্বীপে তার আড়তে কাজে দিতে হবে। যতদিন না রাজরানী টাকা ফেরত দিতে পারবে ততদিন বিশ্বজিত এখানে পেটে ভাতে কাজ করবে আর তার দৈনিক মজুরির বিনিময়ে টাকা পরিশোধ হলে তাকে ফেরত দেবে।
বিশ্বজিত! বাবা আমার! মার আর্তনাদ কানে আসে বিশ্বজিতের। মা-ছেলের মিলনের করুণ আর্তিতে সাড়া দেয় সমুদ্রও। অবারিত জলের ফেনিল আঁচল বিছিয়ে সে মুহূর্তেই বিশ্বজিতকে লুফে নেয় তার জলজ বুকে।
রাস্তার মাথায় বিশ্বজিতকে নিয়ে যাবার জন্য অপেক্ষা করে বাবুর চেলারা। রাজরানী বিশ্বজিতকে নিয়ে সেদিকে যায়। বিশ্বজিত তাদের সঙ্গে চলে গেলে রাজরানী পেছন থেকে সন্তানের চলে যাওয়া দেখে অঝোরে কাঁদে। রাস্তার পাশের কৃষ্ণচূড়ার ছায়া, গাছের কচি পাতা আর প্রথম ফুলের লাল কলিও তার ক্রন্দনরত মাতৃহৃদয়কে শান্ত করতে পারে না। জন্মের পর থেকে বারো বছরে এই প্রথম মায়ের বুক থেকে বেরিয়ে বিশ্বজিতের চলা শুরু হয় অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে। কিছুই করার নেই রাজরানীর। তার কানে ভাসে চলে যাবার আগে মাকে জড়িয়ে ধরে বিশ্বজিতের আর্তনাদ, মা! আমি তোমারে ছাড়া থাকতে পারুম না।
ছোট দ্বীপ, টেকের দ্বীপ। সে দ্বীপে গফুর মাঝির শুটকি শুকানোর কাজ। সেটি ঘিরে শ্রমিকদের থাকার ছোট ছোট ঘর এখানে-সেখানে। দ্বীপে নতুন কেউ পা রাখলে প্রথম দিকে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কীটনাশক মেশানো পানি দিয়ে কাঁচা মাছ শুকানো হয়। কোথাও তৈরি আছে মাচান আবার কোথাও বাঁশে ঝোলানো হয় মাছ। বাঁশের ডগায় বসা মাছখেকো পাখিগুলোর আগ্রহ নেই শুকাতে দেয়া এসব মাছে। এখানে আসার পর বিশ্বজিতের চোখ জ্বলতে থাকে, মাথা ঝিমঝিম করে, দুয়েকদিন পর আস্তে আস্তে সয়েও যায়। এই আড়তে বিশ্বজিতের বয়সী অনেকেই কাজ করে। শুটকির ঘরেই দুপুরে খেতে বসে সকলে। টমেটো দেওয়া ডালের সঙ্গে শুটকির তরকারি। মা আর বোনের জন্য নীরবে কাঁদে বিশ্বজিত। স্কুলের কথা ভুলেই যায় প্রায়। এখানে তবু দুবেলা খাবার পাচ্ছে সে। এটুকুই বা কম কী! প্রতিদিন সে হিসাব করতে থাকে বাবুর কাছ থেকে ধার নেওয়া টাকা পরিশোধে কত টাকা শোধ হলো। প্রতিদিনের এ হিসাব কখন যে তার স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয় খেয়ালই করে না বিশ্বজিত।
দুপুরের পর বাড়ির উঠোনে রাজরানী লক্ষ্মীন্দরের ছেঁড়া জালটা সেলাই করতে বসে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তো নদীতেই নামতে হবে মাছ ধরতে, আরও কত ভাবনা, স্মৃতি হানা দেয় তার মাথায়। জালের এ জীবন তার কাছে অভিশাপের মতো লাগে। এ যেন জাল নয়, ছেঁড়া আর ফুটো জীবন সেলাই করে সে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেদিন পড়ন্ত বেলায় নীরব দুপুরে গফুর মাঝির বিশ্রামের সময়টুকু তার শরীর থেকে ধুয়ে মুছে গেলেও মন থেকে সরাতে পারে না কিছুতেই। এর মধ্যে একদিন বিউটিকে সঙ্গে নিয়ে গফুর মাঝির আড়তে যায় সে। গিয়ে দেখে পুলিশের সঙ্গে গফুর মাঝির আলাপ। দেখে বোঝা যায় বেশ ভালো সম্পর্ক তার পুলিশের সঙ্গে। গফুর মাঝির কাছে অনেক অনুনয় করে রাজরানী, কান্না চেপে রাখতে পারে না আর। গফুর মাঝি তাকে আশ্বস্ত করে, লক্ষ্মীন্দরকে ছাড়ানোর চেষ্টা করবে সে। কিন্তু শর্ত দেয়, আগামীকাল বিউটিকে নিয়ে যেতে হবে গফুর মাঝির কাছে।
নিজের রক্ষাকবচ হিসেবে বিউটিকে নিয়ে গিয়ে এ কোন নতুন আতঙ্ক তৈরি করলো, ভেবে দিশেহারা বোধ করে রাজরানী। কাল ছাব্বিশ পৌষ। বিউটির জন্মদিন। কালই নিয়ে যেতেই হবে বিউটিকে! গফুর মাঝি কয়েকদিন এলাকায় থাকবে না। তবে লক্ষ্মীন্দরকে ছাড়িয়ে আনার সব ব্যবস্থা করবে সে, কথা দেয়। গফুর মাঝি ধূর্ত লোক। কাঁচা কাজ করে না। রাজরানীকে বুঝায়, লক্ষ্মীন্দরকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার এই মোক্ষম সুযোগ। সময় এবং সুযোগ সব সময় ধরা দেয় না। শেয়ালটার কথা ভাবতে ভাবতে রাজরানী বিউটির দিকে তাকায়। বাড়ির উঠোন-কোণে সে বান্ধবীদের সঙ্গে গুটি খেলছে। বান্ধবীদেরও জানিয়েছে কাল তার জন্মদিন। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনের ভেতর দ্বিধার হুল টের পায় রাজরানী। কী করবে সে! গফুরের কথা মতো কি বিউটিকে নিয়ে যাবে তার কাছে, নাকি স্বামীকে জেল থেকে মুক্ত না করে অনিশ্চিত সময়ের পথে হাঁটবে! সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আর বেশি নেই, হাতে মাত্র একটা রাত। শকুনের থাবায় এগিয়ে দেবে মেয়েকে? ফিসফিসিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করে সে। বিশ্বজিত কেমন আছে জানে না সে। এতসব ভাবনায় শক্ত হয় রাজরানীর চোয়াল।
সে রাতে টেকের দ্বীপে সবাই ঘুমিয়ে। রাত প্রায় দশটা। হঠাৎ ফিসফিসানি শুরু হয়ে তা বাড়তে বাড়তে শব্দ জোরালো হয়ে আসে। পালা, পুলিশ আইছে। পুলিশ হানা দিছে দ্বীপে। গফুর মাঝির আড়তে ইয়াবা লুকানো আছে!
শ্রমিকরা যেদিকে পারে পালায়। ঘুম ভাঙে বিশ্বজিতের! কী করবে সে। কে যেন বলে ওঠে, এখনো বইসা আছস, যেদিকে পারস পালা, নয়তো আমার লগে আয়।
বিশ্বজিত ছুটতে থাকে দিকবিদিক, দৌড়াতে দৌড়াতে সাগরের তীরে গিয়ে দাঁড়ায়। কন্ঠ শুকিয়ে আসে তার। সামনে সমুদ্রের অবারিত জল। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয় তার ব্যাকুল কণ্ঠ, মা!
বিশ্বজিত! বাবা আমার! মার আর্তনাদ কানে আসে বিশ্বজিতের। মা-ছেলের মিলনের করুণ আর্তিতে সাড়া দেয় সমুদ্রও। অবারিত জলের ফেনিল আঁচল বিছিয়ে সে মুহূর্তেই বিশ্বজিতকে লুফে নেয় তার জলজ বুকে।