বিনা মেঘে বজ্রপাত কেবল প্রবাদেই হয় না, বাস্তবেও হয়।
খোদার দুনিয়ায় সময়-অসময়ে মেঘমুক্ত মহাশূন্য থেকেও বজ্রপাত হয়। তাতে কারও কপাল পোড়ে, কারও হয় প্রাণহানি। নইলে সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত হই-হুল্লোড়ে মেতে থাকা নুপুর কামালের লাশ কেন শেষরাতে মিলবে শান্তিনগর মোড়ে! তাও ডাস্টবিনের পাশে, রোয়া ওঠা কুকুরের সামনে?
সকাল বেলা ক্রাইম রিপোর্টার কবীর হাসান অফিসে ঢুকতেই সামনে পড়েন দৈনিক নিরপেক্ষ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রকিব উদ্দিন। ভোরের দিকেই ভাতিজি নুপুরের লাশের খবর পেয়েছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। সেই থেকে যেন নির্বাক পাথরের মূর্তি। কবীরকে দেখে সচকিত হয়ে ওঠেন। তাকান তার দিকে। সারারাতের সিটি রাউন্ডে কবীর তখন বিধ্বস্ত, ক্লান্ত, উদ্ভ্রান্ত। চোখ ঘোলাটে। সেই ঘোলাটে চোখ রকিব উদ্দিনকেও যেন বিপর্যস্ত করে তোলে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে।
রকিব উদ্দিন সহকর্মীদের চোখে লৌহমানব। তাকে কেউ কখনো ভেঙে পড়তে দেখেনি। কবীরের মনে পড়ে, কদিন আগে এই শান্তিনগরেই এক এসআইয়ের বাসা থেকে কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ পাওয়া গিয়েছিল। পুরো শরীর পুড়ে গিয়েছিল তার। পত্রিকাগুলো নিউজ করেছিল, শান্তিনগরে বাসা থেকে গৃহকর্মীর লাশ উদ্ধার। গৃহকর্তার নাম-ধাম কিছুই প্রকাশ করেনি। এছাড়া, ওই ঘটনায় কোনো হত্যামামলা পর্যন্ত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে কবীর হাসান অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সেই নিউজ ছাপতে দেননি। বলেছিলেন, কবীর, সবাই যখন চুপচাপ, আমরা কেন শুধু শুধু পুলিশের সঙ্গে লড়াই করতে যাবো? গৃহকর্মী কি এর আগে মারা যায়নি? আমরা কয়টা ঘটনা জানি? শুনুন, সময় চিনুন। ওই পুলিশ কর্মকর্তা অনেক প্রভাবশালী। সব মিডিয়ার ক্রাইম রিপোর্টারকে ধরতে গেলে সে কিনে ফেলেছে। তার বিরুদ্ধে কেউ নিউজ করবে না। তাহলে আপনি কেন ঝুঁকি নেবেন? সম্পাদকের কথায় যুক্তি আছে কিন্তু স্বস্তি নেই। তাই সে অনুসন্ধান চালিয়ে যায়।
দৈনিক নিরপেক্ষ পত্রিকার দক্ষিণ পাশের পরিত্যক্ত গ্যারেজটিকে মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোনো গুহা। সেই গুহায় কখনো সূর্যের আলো পড়ে না। সবসময়ই ঘুটঘুটে অন্ধকারের চাদর মুড়েই থাকে গ্যারেজটি। আর দিনের শেষে সূর্য বিদায় নেওয়ার পরপরপই সেখানে কালো চিতার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে রাত। তবে, কমতে থাকে লাজহীন-লজ্জাহীন গ্রীষ্মের তাপদাহ। সেই গ্যারেজে বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল কবে, সেই কথা আজ আর কেউ মনেও করতে পারে না। গ্যারেজটি পরিত্যক্ত হওয়ার সুযোগ নিয়েছে গাঁজাবিক্রেতা নসিমন। সূর্য তার পাট চুকিয়ে বিদায় নিলেই সেই গ্যারেজে জ¦লে ওঠে নসিমনের ভাঙা হারিকেন। সেদিনও হারিকেনটা অশীতিপর বৃদ্ধার কোটরাগত চোখের মতো পিট-পিট করছে। এটুকু আলো বাতাসের দাপটে এতটাই কম্পমান যে, ঘরের অন্ধকার দূর করার মতো শক্তি তার দেহে নেই। তাই সে পুরোপুরি আলো দূর করতে পারে না। কেবল নিজের অস্তিত্বটুকুর জানান দেয়। তাতে তার ক্ষীণশিখা বাতাসে কাঁপে। দূর থেকে মনে হয় তৃতীয়া তিথির বাঁকা চাঁদ মেঘের সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে পৃথিবীতে নেমে এসেছে। এখানে ভীরু সেই চাঁদের হাসিতে ভেসে যাওয়া পুরনো খাটের ওপর পসরা সাজিয়ে বসে আছে নসিমন। তার গাঁজার ক্রেতার মধ্যে শহরের বখাটে যেমন আছে, তেমনি আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, দিনমজুর যেমন আছে, তেমনি আছে, পুলিশের কনস্টেবল, এসআই থেকে শুরু করে সাংবাদিকরাও। পলিটিক্যাল বিটের রিপোর্টার শাকিলকে খুঁজতে খুঁজতে কবীর এসে হাজির হয় গ্যারেজে। দেখে সেখানে শাকিল ছাড়াও পলিটিক্যাল বিটের আরেক রিপোর্টার সাজ্জাদ, টিভি রিপোর্টার কামালসহ হাফডজন সাংবাদিক গাঁজার নেশায় বুঁদ আছে।
কিন্তু কী থেকে কী হলো, সকালে পত্রিকা খুলেই দেখে, তার নিউজটি হাওয়া। নিউজ এডিটরকে জিজ্ঞাসা করতেই জানালেন, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের নির্দেশ।
কবীরকে দেখে কারও মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। শাকিল গাঁজায় লম্বা একটা টান দিয়েই কবীরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, নেন বড় ভাই, একটান দিয়ে দেখেন। কবীর হাত তুলে, না ভাই আমার পোষাবে না। কামাল খেঁকিয়ে ওঠে—পোষাবে না তো এলেন ক্যান? আরে আমার গুডবয়, সম্পাদকের গুডবুকে থাকতে থাকতে কেমন ভদ্দর নোক ভদ্দর নোক ভাব ধরলেন ভাইয়ে! হা-হা-হা-হা। তার সেই হাসিতে কিশোরী রাত যেন ঠা-ঠা করে উঠলো। শাকিলের দিকে তাকালো কবীর, আপনার সঙ্গে জরুরি আলাপ আছে। শাকিল নেশাধরা চোখে তাকায়, বলেন। আরে বাল এখানেই বলেন তো। সমস্যা কী? গুরুতর কিছু? প্রেম? পারিবারিক সমস্যা? একনাগাড়ে প্রশ্ন করে শাকিল। কবীর চেয়ে থাকে শাকিলের চোখের দিকে, ওই চোখ দুটি লাল হয়ে উঠেছে। ধোঁয়ায় সেই লালকে পুরোপুরি লাল মনে হয় না, ভৌতিক-ভৌতিক মনে হয়। গাঁজার গন্ধে কবীরের মাথা ঘোরে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। শাকিলের হাত ধরে টান দেয়, চলুন তো। বাইরে চলুন। গ্যারেজ থেকে বের হয়ে সামনের খালি জায়গায় পুরোনো টায়ার, লোহালক্কড়ের ওপর তিন জন মুখোমুখি বসে। কিশোরী গৃহকর্মীর মৃত্যু হত্যাকাণ্ড না দুর্ঘটনা, এই বিষয়ে আলোচনা করতে চায় কবীর। বলে, পুলিশ তো দাবি করছে মেয়েটি দুর্ঘটনায় পুড়েছে। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে, তাকে হত্যা করা হয়েছে। কামাল কথা কেড়ে নিয়ে বলে, পুলিশ যা বলছে, তার বাইরে আপনার কাছে কোনো নতুন তথ্য আছে? যা দিয়ে বলবেন হত্যা করা হয়েছে। আছে? কবীর যে আগ্রহ নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছে, তার সেই আগ্রহে যেন জল ঢেলে দিলো কামাল। তবু সে দমে যায় না। বলে, মেয়েটি মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে বলেছে, তাকে এসআইয়ের বউ নির্যাতন করেছে। তাহলে? কথা শেষ করে সহকর্মীদের মুখের দিকে তাকায় কবীর। দেখে তারা দুজনেই ফ্যাকাশে মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে। তারা কি তারা গুনছে? এই নাগরিক রাতের বয়স যতই বাড়ে, ততই আকাশ অস্পষ্ট হতে থাকে। বিজলিবাতির ঝলকে কোনো তারাই তাদের চোখে পড়ে না। সহকর্মীরা কোনো জবাব দেয় না। মুহূর্তের জন্য সেখানে কবরের মতো সুনসান নীরবতা নেমে আসে।
হঠাৎ রাজনৈতিক নেতার মতো ভাষণ দেয় শাকিল, শোনেন কবীর ভাই। কামাল-কবীর দুজনই তার দিকে ঘাড় ফেরায়। শাকিলের হাত উত্তোলিত, মুষ্ঠিবদ্ধ। চোখ জ্বলজ্বল করছে। আধো আলো-আধো অন্ধকারে চিতার চোখ বলেই ভ্রম হয়। দুই সহকর্মী তার দিকে তাকালে একটু থেমে এবার বলে, এই যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, এই যে শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন এসব কেন হচ্ছে জানেন? কারও উত্তরের অপেক্ষা না করেই সর্বজ্ঞের মতো নিজেই জবাব দেয়, দেশে বিরোধী দল নেই বলে। শাকিলের কথা শুনে কামাল আপত্তি জানায়, বিরোধী দল থাকা-না থাকার সঙ্গে এসব খুন খারাবির কী সম্পর্ক শাকিল? প্রশ্ন শুনে ঈষৎ হাসে শাকিল, সেই হাসি জানিয়ে দেয়, রাজনীতির পাঠ না থাকলে এমন বোকার মতো প্রশ্ন করা যায়। এরপর যেখানে থেমেছিল, সেখান থেকে শুরু করে, সম্পর্ক তো আছে। দেশের শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎসহ নিত্যপণ্যের দাম এভাবে হু-হু করে বাড়তে পারতো না। দাম বাড়ালেই বিরোধী দলগুলো আন্দোলনে নামতো। হরতাল-অবরোধ দিতো। দেশে এসব আছে এখন? এই ২০২৩ সালে এসে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি কী করছে? দলটি আছে সত্য, কিন্তু দলটির কাজ কী? সরকার-আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা ছাড়া আর কিছু আছে? নাই।
কামাল একটু বিরক্তই হলো। কবীর কী নিয়ে কথা বলতে চাইলো, আর কামাল কিসের গীত ধরলো? কথাটা মনে মনে ভাবে, কিন্তু মুখে আনে না। কারণ শাকিল তখন এতটাই উত্তেজিত যে, তাকে দেখলে আওয়ামী লীগবিরোধীই মনে হবে, বাস্তবে তা নয়। সে নিজেই যুবলীগের সক্রিয় কর্মী তো বটেই, তার ছোট ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বড় নেতাও। তার মতে, দেশে শক্তিশালী-গ্রহণযোগ্য সরকারের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দলও দরকার। জামায়াতঘেঁষা বিএনপি আর হরিণের মতো কানপাতলা ভীরু বাম দল দিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করা যাবে না। এসব দলের কোনো কর্মসূচিই গণমুখী নয়। সবই নিজ নিজ নেতাদের স্বার্থকেন্দ্রিক। কোন নেতার বাড়ি গেলো, কোন নেতা মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার আসামি, তাদের মুক্তির জন্য প্রেসরিলিজেই সীমাবদ্ধ থাকে এসব দলের কর্মসূচি। জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে যেমন এসব দলের কোনো কর্মসূচি থাকে না, তেমনি সরকারের কোনো ভালো কাজেরও প্রশংসা তারা করে না। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার থেকে শুরু করে পদ্মাসেতুর মতো কর্মযজ্ঞেও দলগুলো সরকার কিংবা রাষ্ট্রের কোনো সাফল্যের কথাও স্বীকার করে না। শাকিল মনে করে, এসব কারণে এসব দলের কর্মসূচিগুলোতে জনগণের কোনো আগ্রহ নেই। তাই বিরোধী দলগুলো যে নানা বাড়ির মতো নির্বাচনকালীন সরকারের আবদার করে তাতে সরকারের টনক নড়ানো যাবে না।
শাকিলের লম্বা ভাষণ শুনতে শুনতে কবীর ভুলে যায়, সে কী বলতে এসেছিল। কামাল তাকে ধাক্কা দেয়, কবীর ভাই, আপনি যেন কী বলতে এসেছেন? কবীর কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় কামালই বলে, আরে শাকিল ভাই আপনি কী শুরু করেছেন? অপরাধের সঙ্গে পুলিশের জড়িয়ে পড়ার সঙ্গে শক্তিশালী-দুর্বল বিরোধী দলের কী সম্পর্ক? এবার হা-হা-হা করে বাতাস প্রকম্পিত করে হাসে শাকিল। বলে, কী সম্পর্ক জানেন না? বিরোধী দলগুলো শক্তিশালী হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ বাড়তো। এসব বাহিনীর সদস্যরা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতো। আর রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং-হামলা-মামলা হলে তখন ধরপাকড়ের ব্যস্ত থাকতো। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা তখন চাকরি বাঁচানোর জন্য উদয়াস্ত কাজ করতো। এখন তো তাদের কাজ নেই, তাই খই ভাজে। গৃহকর্মী নির্যাতন করে, বিচারপ্রার্থী নারীকে ধর্ষণ করে। হত্যাও করে। কিন্তু কোনো প্রমাণ রাখে না। তদন্ত রিপোর্ট তাদের পক্ষে যায়, পোস্টমর্টেম রিপোর্টও পুলিশের পক্ষে যায়। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। বুঝলেন?
এই উত্তপ্ত রাজনৈতিক আলোচনার ভেতর এসে পড়ে পত্রিকার জুনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার সেলিম। কবীরের কানের কাছে ফিস ফিস করে বলে, সিরিয়াস খবর আছে। জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকাতেই বলে, যে এসআইয়ের বিরুদ্ধে নিউজ করবেন, তার বাসায় আজ সিনিয়র সব ক্রাইম রিপোর্টার গেছে। আজ তার জন্মদিন। কবীরের চোখে রাজ্যের বিস্ময়, সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টাররা কি জানে না, ওই এসআই এখন অভিযুক্ত? তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তারা কিভাবে গেলো? কবীরের চোখে বিস্ময়ের ঘোর দেখে সেলিম হাসে। বলে, আরও মজার কাহিনি আছে, শুনবেন? প্রশ্ন শুনে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ায় কবীর। সেলিম বলে, ওই অনুষ্ঠানে আমাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, তার ভাই, ভাতিজি, প্রকাশক, প্রকাশকের ছেলেও গেছে। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কেন কিশোরী গৃহকর্মী হত্যার ঘটনা নিয়ে নিউজ করতে নিষেধ করেছেন, এবার দুইয়ে দুইয়ে চার মেলায় কবীর। তার মনে পড়ে, এর আগেও মিরপুরের শিশু জিহাদ হত্যাকাণ্ড নিয়ে ইনভেস্টিগেটিভ নিউজ করতে চেয়েছিল সে। ওই তদন্তে মানবপাচারকারী রাজ্জাক হায়দারসহ অনেক রাঘববোয়ালের নাম বেরিয়ে এসেছিল। নিউজটি যেদিন লিড হওয়ার কথা, সেদিনই প্রকাশকের ফোন, রাজ্জাক হায়দার আমাদের বিজনেস পার্টনার। তার সম্মানহানি হয় এমন নিউজ আমাদের পত্রিকায় যেন না যায়। ফোনের কথা কবীর জানতো না। ফাইনাল প্রুফ দিয়ে ফ্রন্ট পেজে যখন নিউজ এডিটর নিউজটি বসানোর কথা বলছেন গ্রাফিক্সম্যানকে, তখন নিউজরুমে কবীরও দাঁড়ানো ছিল। সে নিশ্চিত নিউজটি লিড হয়েছে। পরদিনই তোলপাড় শুরু হবে। প্রশাসনের ওপর মহলেরও টনক নড়বে। অপরাধীরা ধরা না পড়ে পারবেই না। কিন্তু কী থেকে কী হলো, সকালে পত্রিকা খুলেই দেখে, তার নিউজটি হাওয়া। নিউজ এডিটরকে জিজ্ঞাসা করতেই জানালেন, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের নির্দেশ।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের রুমে ঢুকতেই একগাল হেঁসে বললেন, আরে কবীর সাহেব যে! আসুন। আসুন। আজ কোনো গরম খবর আছে নাকি? ভদ্রলোকের মেকি আচরণের কবীর রাগ করবে, না ঘৃণা করবে, না করুণা করবে, বুঝে উঠতে পারে না। রাগ-ঘৃণা-করুণা সব গুলিয়ে তার মস্তিষ্কের ভেতর কে যেন হাতুড়ি পেটালো। সে চোখ তুলে তাকালো ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দিকে। দেখলো, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের চোখে ক্রুর হাসি। প্রশ্ন করে সন্তোষজনক উত্তর পাবে না জেনেও জিজ্ঞাসা করে, ভাই আমার নিউজ দেখলাম লিড হলো। ফাইনালি পাতায় বসানো পর্যন্ত ছিলাম। দেখেও গেলাম। কিন্তু সকালে দেখি নিউজটাই হাওয়া! নিউজ কি স্টাবলিশড হয়নি? ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কাস্তের মতো বাঁকা ঠোঁটের হাসির ঝিলিক দিয়ে বলেন, নিউজ স্টাবলিশড হলেই কি ছাপানো যায়? মালিকপক্ষ, সরকার, এনজিও, বিজনেস পার্টনারের স্বার্থও তো দেখতে হয়। সম্পাদকের যুক্তিগুলো পুরনো। তাই কবীর বলে, এসব তো বহুবার বলেছেন, কিন্তু এই নিউজে কী সমস্যা তা তো জানলাম না। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এবার যেন একটু রাগ হলেন। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে না। রাজ্জাক সাহেব প্রকাশকের বিজনেস পার্টনার। ব্যস। আপনি আসতে পারেন।
আগের অনুসন্ধানী নিউজগুলো কিল করার জন্য আপনাকে স্যরি বলে নিতে চাই। দেশে মানুষের নিরাপত্তা যে নাই, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি যে নাই, আমার ভাতিজির জীবন দিয়ে তার প্রমাণ পেলাম।
কবীর সেদিন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের রুম থেকে বের হয়ে পরিত্যক্ত গ্যারেজের সামনে বসেছিল। খবর পেয়ে শাকিল এসে বলেছিল, দেখুন ভাই, আমরা গরিব। যতটা সাংবাদিকতা করি, তারও বেশি চাকরি করি। আমাদের মনে রাখতে হবে, অর্থ যার ইচ্ছা তার। অর্থ দিচ্ছেন প্রকাশক, তার ইচ্ছার মূল্য আপনাকে দিতেই হবে। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া ঠিক হবে না। আপনাকে বাতাস বুঝে পাল তুলতে হবে। উল্টো পাল তুললে নৌকা তো ডুববে, সঙ্গে আপনিও ডুববেন। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রুমে ডেকে বলেছিলেন, বয়স কম, তাই আবেগ-রাগ বেশি। এগুলো কন্ট্রোল করতে হবে। দেখবেন, আপনার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের কথা শুনে একটি গ্রাফিতির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। ‘সাংবাদিকরা দালালি ছাড়ো/ দালালরা সাংবাদিকতা ছাড়ো’। কবীর ভাবে, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কোন শ্রেণীতে পড়েন। সে কী করবে—অনেক ভেবে দেখলো, এই হাউজ ছেড়ে আরেক হাউজে যাবে? সেখানেও যে এমন পরিস্থিতি হবে না, তার গ্যারান্টি কী? সেল্ফ সেন্সরশিপই এখন গণমাধ্যমের প্রধান বৈশিষ্ট্য। না সরকারি বিধিনিষেধের ভয়ে নয়, সরকারের সমালোচনা বরং বেশিই করে পত্রিকাগুলো। কিন্তু এনজিও বলো, কোনো ঠিকাদার কোম্পানি বলো, পুলিশ বলো, বিশেষ কমিউনিটি বলো, তাদের স্বার্থে ঘা লাগলে আর রক্ষে নেই। মানহানির মামলা তো আছে, আছে ক্ষতিপূরণের মামলা। সঙ্গে যোগ হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টও। পত্রিকাঅলারাই বা কী করবে? তাদের ওপর সরকার ক্ষেপলে তবু কথা চলে। বিরোধী দল, আদালত, আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে হলেও সরকার পত্রিকার ওপর থেকে খড়্গ তুলে নেয়। কিন্তু মালিকপক্ষের বিজনেস পার্টনার, বহুজাতিক কোম্পানি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, আবাসন ব্যবসায়ী, আদম ব্যাপারি, চোরাচালানি চক্রের বিরুদ্ধে নিউজ করা এখন আর সহজ নয়। এসব বিষয়ে সাংবাদিকদের সেল্ফ সেন্সর করা ছাড়া গতি নেই। সাতপাঁচ ভেবে ভেবে কবীর আর হাউজ বদলায়নি। রয়ে গেছে এখানেই। তাতে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকও খুশি হয়েছিলেন। অবশ্যই তার খুশি-অখুশিতে কবীরের কিছু আসে-যায় না। সে জেনে গেছে, এখানে সবাই স্বার্থের দাস। এখানে সবাই ক্ষমতা ও বিত্তের কাছে নতজানু হতে হয়। আর এই নতজানু হওয়ার জন্য কে কার আগে নিজের মেরুদণ্ড খুলে কেঁচো হয়ে যাবে, সেই প্রতিযোগিতা নিত্য চলে।
গৃহকর্মী সুমী হত্যাকাণ্ডের নিউজটা হাওয়া হয়ে যাওয়ায় তার মনটা ভীষণ খারাপ। এরই মধ্যে চিফ রিপোর্টার বললেন, কবীর মন খারাপ করবেন না। আজ সিটি রাউন্ড আপনার। গুরুত্বপূর্ণ কিছু পেলে অনলাইনে ধরিয়ে দেবেন। এসাইনমেন্ট পেয়ে ভালো লাগলো, না খারাপ লাগলো, বিষয়টি বুঝতে পারে না কবীর। তবে, রাত এগারোটার পর অফিস থেকে বের হয়ে পড়ে। মোটরসাইকেল নিয়ে ধানমন্ডি, শংকর, জিগাতলা, নিউ মার্কেট, চানখাঁরপুল, সদরঘাট, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, কমলাপুর, নয়াপল্টন, কাকরাইল হয়ে ভোর ৫টায় এসে থামলো শান্তিনগর ফ্লাইওভারের নিচে। যেখানে বিশাল ডাস্টবিনে নগরীর বর্জ্য এনে ফেলে যান পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। ডাস্টবিন থেকে সামান্য দক্ষিণেই টং চা দোকান। কবীর বিড়ালপায়ে এগোয়। দোকানিকে বলে, এককাপ চা দাও। চিনি ছাড়া। দোকানি চা দিতে দিতে ফিস ফিস করে বলে, সাংবাদিক ভাই, শুনছেননি ঘটনা? কবীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। দোকানি বলে, ডাস্টবিনের উত্তরপাশে দেখছেননি কতগুলি পুলিশ। ওইখানে একটা মাইয়ার লাশ পাওয়া গেছে। তাই নাকি—বলেই কবীর চায়ের কাপ হাতে নিয়ে এগোয় ঘটনাস্থলের দিকে। দেখে, কয়েকজন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে আছে। তার পরিচিত এসআই মিজানও আছে। কবীরকে দেখে হাত তোলে, কী সাংবাদিক সাব। গন্ধ পেয়েই হাজির? কবীর ঠাট্টার জবাব দেয় না। মৃদু হাসে। সারারাতের নির্ঘুম চোখ। ঢুলু ঢুলু। পুলিশকে বিশ্বাস নেই, তাকে গাঁজাখোর বানিয়ে চালান করে দিতে কতক্ষণ!
কবীর লাশটা দেখে। উপস্থিত পথচারী কিংবা পুলিশের কেউ লাশের পরিচয় জানাতে পারে না। ফলে কবীরও অনলাইন সেকশনে ফোন করে। বলে, একটা নিউজ আছে। হেডিং দিন, ‘শান্তিনগরে তরুণীর লাশ উদ্ধার’। এরপর ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়। অন্যপ্রান্ত থেকে প্রশ্ন আসে। তার জবাবে কবীর বলে, ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন এসআই মিজান। আপাতত এটুকু দিয়ে নিউজ আপ করে দিন। সকালে বিস্তারিত জানা যাবে। আপাতত বাসায় যাওয়া দরকার।
কবীর ঘুমাচ্ছিল। যেদিন সিটি রাউন্ড থাকে, সেদিন ভোরের দিকে এসে বাসায় ঘুমায়। বিকালের দিকে অফিসে ঢোকে। আজও বাসায় ঢুকেই সটান শুয়ে পড়ে। দেখে মেঘভরা ঘুমন্ত আকাশের তলে অসংখ্যা তারা মিটমিট করে জ্বলছে। এরইমধ্যে একটি তারা খসে পড়ে, নেমে আসে কবীরের দিকে। নামতে নামতে তার আলো কমতে থাকে। একসময় সে ডানাঅলা পরীতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। তারা কিভাবে পরীতে রূপান্তরিত হয়ে যায়, কবীর বুঝতে পারে না। তার চোখে ঘোর লাগে। সেই ঘোরগ্রস্ত চোখে পরীর দিকে তাকায়। বলে, তুমি কে? তুমি তো তারা ছিলে, পরী হলে কিভাবে? কবীরের প্রশ্নের জবাবে সে বলে, আমি তারা নই। পরীও নই। আমি সুমী। এসআই মিজানের গৃহকর্মী ছিলাম। মিজানের বউ যখন বাপের বাড়ি যেতো, মিজান তখন আমার সাথে বউ বউ খেলতো। আমার পেটে মিজানের বাচ্চা। মিজানকে বলেছিলাম, আপনার বাচ্চা আমার পেটে। সে পাত্তা দেয় নাই। কিন্তু বিবিসাব বুঝতে পেরেছিলেন। তাই বিবিসাব রাগ করেছেন। গ্যাসের চুলার গ্যাস আগে থেকে ছেড়ে দিয়ে রেখেছিলেন। আমি রান্না করতে ঢুকলে বাইরে থেকে কিচেনের দরোজা আটকে দেন। আমি চুলা জ্বালাতে গেলেই সারাশরীলে আগুন ধরে যায়। চিৎকার শুনে বিবিসাব দরোজা খুলে দেন। নিজেই ঝাপটে ধরেন আমাকে। তখন আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। বিবিসাব খুব চালাক। আমাকে কোলে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যান। ডাক্তার যখন বলেন, সুমী মরে গেছে, তখন বিবিসাব আর মিজান সাবের মুখে সে কী তৃপ্তি হাসি। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে সুমী থামে।
কবীরের গলা শুকিয়ে যায়। ঘামতে থাকে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। সুমী বলে, স্যার পানি খাবেন? আমার সাথে আসুন। কই? আসুন। সুমীর পেছন পেছনে হাঁটতে থাকে কবীর। হাঁটতে হাঁটতে একটি পুরনো পুকুর ঘাটে এসে থামে। দেখে সুমী পুকুরে নেমে যাচ্ছে। কবীরকে ডাকছে। সে ঘাট ধরে নিচে নামতে যাবে, অমনি পা পিছলে পড়ে গেলো। হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। হাঁটুতে হাত রাখতে টের পায়, সে স্বপ্ন দেখছিল। পুকুর ঘাটে পড়েনি। ঘরের দেয়ালের সঙ্গে হাঁটুর ধাক্কা লেগেছে। তাতেই তীব্র ব্যথা। মোবাইলফোন হাতে নিয়ে দেখে ৫টা মিসড কল। সবই ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের।
গোসল না করেই বেরিয়ে পড়ে। অফিসে ঢুকতেই ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক তাকে রুমে ডেকেই দরোজা বন্ধ করে দেন। চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ান। হাত রাখেন কবীরের কাঁধে। জাঁদরেল ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের এই অসহায় চেহারা কবীরকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। সে কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, বস, ফোন দিয়েছিলেন কয়েকবার। আমি তো সিটি রাউন্ড শেষে ভোরে ঘুমোতে গেছি। কবীরের ডিউটির কথা ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক যে জানেন, কথা বলতে ভোলেন না। শেষে যোগ করেন, আপনাকে একটা সিরিয়াস এসাইনমেন্ট দেওয়ার জন্য বারবার কল দিয়েছি—বলেই কবীরের দিকে ছলছল তাকান। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের এই ভেঙে পড়ার কারণ বুঝতে পারে না কবীর। তাই প্রশ্ন করে, কী হয়েছে বস? কী জরুরি এসাইনমেন্ট? আপনি দিলে আমি করবো না, এমনটা কখনো কি হয়েছে? ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে, না, কবীর বিষয় তা নয়। বিষয়টি পারিবারিক। আপনি ভোরের দিকে যে লাশ উদ্ধারের নিউজ দিয়েছেন, ওই লাশ আমার ভাতিজির। কবীরের শরীরে কে যেন পঁচিশ হাজার ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক শক দিলো। যে আঁতকে ওঠে, তার কণ্ঠস্বরে প্রায় কান্না উথলে ওঠে, কী বলেন বস। এখন কী করবো? থানায় মামলা করেছেন? ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাথা নাড়েন। এই মাথা নাড়ানোয় কবীর ‘হ্যাঁ’ যেমন বোঝে না, তেমনি ‘না’-ও না। তাই সে চোখের কোণে মস্তবড় প্রশ্নবোধক চিহ্নটা এঁকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দিকে তাকায়। এবার জাঁদরেল ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সচকিত হন। বলেন, আগের অনুসন্ধানী নিউজগুলো কিল করার জন্য আপনাকে স্যরি বলে নিতে চাই। দেশে মানুষের নিরাপত্তা যে নাই, স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি যে নাই, আমার ভাতিজির জীবন দিয়ে তার প্রমাণ পেলাম।
জিজ্ঞাসা আর করতে হয় না, শাকিলই বলে, নুপুরের বাবাকে তো পাওয়া যাচ্ছে না। জানেন তো? কবীর স্বীকার করে, সেও এই খবর পেয়েছে।
কবীরের মনে পড়ে, আগের সন্ধ্যায় কামালের কাছে শুনেছিল রাতে এসআই মিজানের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। তাই সে বলে, কাল আপনারা না এসআই মিজানের বাসায় গেলেন? আপনার ভাতিজিও তো সেই অনুষ্ঠানে ছিল। তাই না? কবীরের প্রশ্নে রকিব দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, অনুষ্ঠানে তো সবাই একসঙ্গে গিয়েছিলাম। বের হওয়ার সময় আমরা চলে এলাম। নুপুর বললো সে পরে আসবে। পরে খবর নিতে পারিনি। প্লিজ এখন আপনার দায়িত্ব, কিভাবে কী হলো, ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে রিপোর্ট করুন। কবীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককে আশ্বস্ত করে—বস আপনি ভেঙে পড়বেন না। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
কবীর ছোটে শান্তিনগর মোড়ে। এসআই মিজানের প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে। কাল রাতে কোনো অস্বাভাবিক কিছু সন্দেহ করেছিল কি না, তারা। পাশের বাসার ভদ্রলোক, চাকরি করে ব্যাংকে। নিজের নাম প্রকাশ করতে রাজি হন না। তবে বলেন, প্রায় রাতেই সুমীর কান্নার আওয়াজ শুনতেন তারা। কিন্তু পুলিশের বাসা। কী বলতে গিয়ে কোন বিপদে পড়েন, তাই তারা চুপ থাকতেন। আর গতরাত বিশাল পার্টি ছিল। ব্যাংক কর্মকর্তা ফিস ফিস করে বলেন, এসআই মিজানের শালা নাকি ব্যবসায়ী। আদম ব্যাপারী। বয়স কম। অ্যাক্কেরে লুচ্চা। কোনো সুন্দরী মাইয়া মানুষ চোখে পড়লে তার আর রক্ষা নাই। কাল রাতে তো হেয় ব্যাডাও নাকি মিজান সাহেবের বাসায় ছিল। মাঝরাতে নাকি মদ খেয়ে অনেক মাতলামি করেছে সে। আপনি আবার কাউরে কইয়েন না, আমার ওয়াইফ কইলো দুপুর রাইতে নাকি মাইয়া মানুষের চিৎকার শোনা গেছিল। আল্লাহ জানে কী হয়েছে।
ব্যাংক কর্মকর্তার কথা শুনে ভাবতে থাকে কবীর। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারে না—আসলে নুপুরই চিৎকার করেছিল কি না। এছাড়া নুপুর যদি এখানে চিৎকার করবে, তখন বাসায় এসআই মিজান, তার স্ত্রী কিংবা আর কেউ ছিল না? নুপুরই বা কেন এই বাসায় থেকে গেলো? কবীরের ধাঁধা লাগে। সে সারাদিন ঘুরে ঘুরে এসআই মিজানের প্রতিবেশী, বাড়ির সিকিউরিটি, বাসার সামনের চা-দোকানি ও কাজের লোকটির সঙ্গেও কথা বলে। কিন্তু কারও কাছ থেকে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য পায় না। ভাবে, নুপুরের বাবাকে কল দেবে। তার আগে জানতে হবে, তাদের বাসা কোথায়। রকিব উদ্দিনকে কল দিয়ে তার ভাই সফিক উদ্দিনের ফোন নম্বর নেয় কবীর। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সফিক উদ্দিনকে কল দেয় না। ভাবে মেয়ের মৃত্যুর পর থানা-হাসপাতাল করে করে ঘূর্ণিবায়ুর মতো লোকটার মাথা এখন ঘুরছে। সন্ধ্যার দিকেই কল দিলেই চলবে। সে ভাবে, মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই। অথচ এই মানুষই নিজেকে আশরাফুল মাখলুকাত দাবি করে। অথচ নিজেরা নিজেদের খুন করে। কোনো পশুপাখি নিজেদের আশরাফুল মাখলুকাতও দাবি করে না, এক সিংহও আরেক সিংহের রক্তে কেশররঞ্জিত করে না। কিন্তু মানুষ বড় ধূর্ত, সে স্বজনকেও হত্যা করে। মুখ লুকাতে না পারলে আত্মহত্যাও করে। এই মানুষকে বিশ্বাস নেই। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রকিব উদ্দিনকেই বা কী করে বিশ্বাস করে সে? এই রকিব উদ্দিন তো কত কত রিপোর্টকে আলোর মুখ দেখতে দেয়নি। ভ্রূণহত্যার মতো সাব এডিটরদের হাতে পড়ার আগেই কত কত হত্যাকাণ্ডের নিউজ এই ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কি-বোর্ডের বাটন টিপেই হাপিস করে দিয়েছেন। আর আজ? নিজের ভাতিজির লাশ দেখে তার রক্তে প্রতিবাদের নেশা জেগেছে। অথচ সুমীর বেলা নিউজই করতে দিলেন না।
সন্ধ্যা নামতে এখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। সূর্যটা বোধ হয় আজ বেশি রকমের চটেছে, তাই দুনিয়াতে গ্যালন গ্যালন আগ্নেয়গিরির লাভা ঢেলে দিচ্ছে। তাতে রাস্তা এতটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে যে, রিকশার চাকা আটকে যাচ্ছে গলিত পিচের সঙ্গে। যাত্রাবাড়ির মোড়ে পুলিশবক্সের সামনে নামতেই রিকশাচালকের কাতরকণ্ঠ—মামা দশটাকা বাড়াইয়া দ্যান। বেজায় কষ্ট অইছে। অন্যদিন হলে কবীর হয়তো কষে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতো রিকশাঅলার গালে। আজ কিছু বলে না, নিঃশব্দে আরও দশটা বাড়িয়ে ধরে। দুই কদম হেঁটেই হাতের ডান পাশের বিল্ডিংয়ের দোতলায় উঠেই কলিং বেলে চাপ দেয়। মধ্যবয়সী যে লোকটি দরোজা খুলে দেন, তার সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রকিব উদ্দিনের চেহারার হুবহু মিল। কবীরের বুঝতে অসুবিধা হয় না, ইনিই সফিক উদ্দিন। নিজের পরিচয় দিতেই সফিক বলেন, রকিব আপনার কথা আমাকে বলেছে। আসুন। ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই চোখে পড়ে—দুজন কনস্টেবলকে নিয়ে এসআই মিজান সোফায় বসে আছে। এসআইয়ের নেমপ্লেট দেখে কবীর বুঝে নেই এই সেই মিজান। সে দেখে সফিক উদ্দিনের মুখ থমথমে। কবীর যত প্রশ্নই করে সফিক ঠিকঠাক কোনো জবাব দেয় না।
অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে সফিককে বারান্দায় ডাকে কবীর। সফিক বারান্দার দিকে পা বাড়াতেই মিজান বলে ভাই কী করছেন, আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। কিছু বলার থাকলে আমাদের বলুন। কবীর বলে, না সফিক সাহেবের সঙ্গে আমার কথা আছে। আমাকে কথা বলতে দিন। এবার মিজান ক্ষেপে ওঠে—আপনি কিন্তু তদন্তকাজে বাধা দিচ্ছেন? কবীর রাগে কেঁপে ওঠে—কী? আমি আপনার তদন্তকাজে বাধা দিচ্ছি? ঘটনা আপনার বাসায় ঘটলো, লাশ মিললো আপনার বাসার পাশেই, তদন্ত হচ্ছে যাত্রাবাড়ী! এটা কী ধরনের তদন্ত? উভয়পক্ষের তর্কের মাঝখানে হাত তুলে দাঁড়ান সফিক উদ্দিন, ভাই আমরা এমনিতেই শ্যাষ। আপনারা দয়া করে ঝগড়া করবেন না। আমার ওয়াইফ বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। তাকে হাসপাতালে নেবো। আপনারা দয়া করে আসুন। কবীর কী করবে বুঝতে পারে না, বিমূঢ়-নিশ্চল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তাই দেখে রাগে গায়ে জ্বালা ধরে যায় এসআই মিজানের— কী ব্যাপার যাচ্ছেন না কেন? কবীর আর দাঁড়াতে পারে না। অপমানে-ক্ষোভে বাসা থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়ায়। ভাবে, কেমন ভয়ে সংস্কৃতি চালু হলো? কোথায় বাস করছে মানুষ? এতে দেখি মহাভারতের জতুগৃহ। চারদিকে ঘি আর লাক্ষায় তৈরি দেয়াল। ঘুমিয়ে পড়লে সর্বনাশ। আগুনে পুড়ে ভস্ম হতে হবে। এই রকিব উদ্দিন-সফিক উদ্দিন আর কবীর নিজেই পাণ্ডবদলের সদস্য, আর এই পুলিশ-ধর্ষক-খুনিরা একেকজন দুর্যোধন-দুঃশাসন। তাদের ভয়ে কেউ কথা বলতে পারবে না? হায় ঋষিব্যস তুমি কি আরেকবার আসবে মর্ত্যলোকে? লিখবে আরেকটা মহাভারত? মোটরসাইকেলের হর্নে তার ভাবনায় ছেদ ঘটে। কী ব্যাপার কবীর ভাই, আপনি রাস্তার মাঝখানে এভাবে দাঁড়িয়ে কেন? প্রশ্ন করতে করতে হাত ধরে টেনে ফুটপাতে এনে দাঁড় করায় শাকিল। সম্বিত ফিরে পেয়ে কবীর বলে, নুপুরের বাবার কাছে এসেছিলাম। কিন্তু কোনো তথ্য পাইনি, শালা এসআই মিজান এখানেও এসে বসে আছে। আমাকে কোনো কথা বলতেই দিলো না। এক প্রকার অপমান করেই বের করে দিলো। কথাগুলো বলে থামে। শাকিল বলে, এখন কী করবেন? কবীরের বুক ঠেলে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে—কী আর করবো, অফিসে যাবো, যা তথ্য পেয়েছি, তাতেই চলবে। চলুন, অফিসে যাই আগে।
সকাল বেলা পত্রিকার সেকেন্ড লিড ‘নুপুর হত্যা: রহস্যের জট খুলছে, সন্দেহের তীর এসআই মিজানের দিকে’ দেখেই কবীরের নিজেকে অনেকটাই ভারমুক্ত লাগে। এরইমধ্যে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ফোন করে স্পেশাল থ্যান্কস জানালেন। বিকালের দিকে সেগুনবাগিচায় ডিআরইউতে বসেই খবরটা শুনে ভড়কে যায় কবীর। নুপুরের বাবা সফিক উদ্দিনকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোনও বন্ধ। ঘটনা কী ঘটতে পারে, কবীর অনুমান করতে পারে না। দূর থেকে শাকিলকে দেখে হাত তোলে। শাকিলের কণ্ঠে উচ্ছ্বাস-উদ্বেগ একসঙ্গে—কবীর ভাই একদম ফাটায়ে দিলেন। ফাটাফাটি নিউজ করলেন। কিন্তু সাবধানে থাকবেন। এসব প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে নিউজ করার ঝামেলা অনেক। জানেন তো? বিষয়টার ভেতর আমি যেন সাগর-রুমি সিমটম দেখতে পাচ্ছি। কথাগুলোয় যুক্তি খুঁজে পায় কবীর। কিন্তু কিছু বলে না। তার মাথায় সফিক সাহেবের নিখোঁজের বিষয়টি ঘুরছে। শাকিলের সঙ্গে শেয়ার করবে? সে কি আর জানে না? নিশ্চয় জানে। জিজ্ঞাসা আর করতে হয় না, শাকিলই বলে, নুপুরের বাবাকে তো পাওয়া যাচ্ছে না। জানেন তো? কবীর স্বীকার করে, সেও এই খবর পেয়েছে।
নির্লজ্জ গরমের অত্যাচারে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ডিআরইউ থেকে বের হয় দুজনেই। অফিসে ঢুকে কবীর প্রথমে যায় রকিবের রুমে। দেখে রকিবের চেহারায় বিষণ্নতার কালো মেঘে ভর করেছে। কবীরকে নিউজের দ্বিতীয় কিস্তি লেখার অনুরোধ করেই অফিস থেকে বের হয়ে যান ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। কোথায় গেলেন, তা বললেন না।
নুপুরের বাবাকেও কি এভাবেই নিয়ে গিয়েছিল? হঠাৎ তার মনে হলো মাইক্রোবাসটি স্বাভাবিক গতির চেয়ে বেশি দ্রুত ছুটছে। সে কিছু একটা বলতে যাবে, এমন মাথায় ভারী কিছুর আঘাত পড়লো।
পরদিন যাত্রাবাড়ির ফ্লাইওভারের নিচে অচেতন অবস্থায় সফিক উদ্দিনকে পাওয়া যায়। প্রতিবেশীরা তাকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়। সংজ্ঞা ফিরে আসার পরও সফিক উদ্দিন কোনো কথা বলেন না। যে দিকেই তাকান, তার চোখ ভয়ার্ত। যেন তার সামনে সাক্ষাৎ যমদূত দাঁড়িয়ে আছে। কথা বললেই প্রাণটা কেড়ে নেবে। কবীর অনেক চেষ্টা করেও সফিক উদ্দিনের মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে পারলো না। মেডিক্যাল থেকে বের হয়ে টিএসসি পর্যন্ত এসেছে মাত্র, মোবাইলফোনে রিং বেজে উঠলো। কার ফোন হতে পারে? ফোন হাতে নিয়ে দেখে অচেনা নম্বর। রিসিভ করতেই, গম্ভীর কণ্ঠ, নুপুর হত্যার ঘটনা নিয়ে অনেক করেছেন। ভালো চান তো, এখানেই থেমে যান। নইলে কিন্তু… বাকি কথা কবীরের মাথায় ঢোকে না। সামনে সারি সারি রিকশা। সে ডাক দেয়—এই রিকশা মৌচাক যাবি?
পরিত্যক্ত গ্যারেজের সামনে গেলে সেখানে পেয়ে যায় শাকিল, কামাল, সেলিমকে। পুরো ঘটনা নিয়ে তাদে সঙ্গে আলোচনা করে। শাকিলের সেই এককথা, সাগর-রুনি সিমটম। কবীর আপনি থেমে যান। কী দরকার আগুন নিয়ে খেলার? তাদের আলোচনার মাঝখানে এসে হাজির হয় চিফ রিপোর্টার আবুল খায়ের। বলে, সবাই এখানেই? একটা সুখবর আছে। ব্যাকপেজে পুরোপাতার বিজ্ঞাপন পাওয়া গেছে। দুই লাখ টাকা। কথা কেড়ে নিয়ে শাকিল বলে, এটা সুখবরের কী হলো? বিজ্ঞাপন তো পাওয়া যাবেই। আবুল খায়ের এবার বলে, অর্ধেক শুনে ক্ষেপলে হবে ব্রো? বিজ্ঞাপনটা কে দিয়েছে শুনবেন না? সবাই জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকালে আবুল খায়ের বলে, প্রকাশকের বিজনেস পার্ট সাদেক খান। তিনি আবার এসআই মিজানের শালা। কথাটা শোনা মাত্রই চোখে অন্ধকার দেখে কবীর। বলে, কী বললেন? ওদের বিজ্ঞাপন আমাদের পত্রিকায়? তাও এ সময়? নুপুর হত্যাকাণ্ডের নিউজের কী হবে? খায়ের বাঁকার ঠোঁটের হাসি হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে বলে, ব্যবসা আগে? না নিউজ আগে?
খায়েরের কথায় বিরক্ত হয় কবীর। কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। এমনকি তার কথার জবাব দিতেও ইচ্ছা হয় না। ভাবে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের সঙ্গেই বরং কথা বলা যাক। গ্যারেজের সামনের আড্ডা থেকে উঠতে যাবে, এমন সময় খায়ের বলে, আসল সুখবর তো শুনলেন না মিয়া। খালি ছটফট করেন। কবীর তাকায় সেদিকে, বলেন খায়ের ভাই। আসল সুখবর কী? খায়ের এগিয়ে আসে। হাত রাখে কবীরের কাঁধে। বলে, চাকরিটাই করে যান। বেশি সাংবাদিকতা করবেন না। এটা অনুরোধ। আর সুখবরটা হলো রকিব ভাই এবার ভারমুক্ত হচ্ছেন।
শাকিল-কামাল-সেলিম একযোগে প্রশ্ন ছোড়ে—মানে? জুনিয়র সহকর্মীদের প্রশ্নে হাসি পায় খায়েরের। ভাবে এই পুচকে ছেলেগুলো সাংবাদিকতা করবে? ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ভারমুক্ত হলে কী হয়, তাও জানে না। নিজের জানার পরিধিটা কতটা বিস্তৃত তার কিঞ্চিৎ হিসাব কষে বেশ আহ্লাদিত হয়। বলে, আরে বোকারা এই জ্ঞান নিয়ে রিপোর্টিং করেন? রকিব ভাই কাল থেকে পূর্ণ সম্পাদক। কালকের পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে তার নাম বসবে। সবাই অফিসে চলুন। সম্পাদক মিষ্টি খাওয়াবেন সবাইকে।
কবীর অফিসে ঢুকে দেখে, সম্পাদককে বরণ করার জন্য সহকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার অন্ত নেই। কনফারেন্স রুমে সম্পাদকের পাশের চেয়ারে প্রকাশক বসে। তারই পাশে এসআই মিজানের শালা শিল্পপতি সাদেক খান। এই দৃশ্য দেখে কবীরের চোখ দিয়ে যেন উত্তপ্ত ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে স্থির থাকতে পারে না। দরোজা খুলে বেরিয়ে পড়বে, বাধা দেয় চিফ রিপোর্টার, অনুষ্ঠান ছেড়ে কই যান? কিন্তু কবীর বসে না। কনফারেন্স রুম থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। কোন দিকে যাবে? বাসায়? শাহবাগে? ভাবতে ভাবতে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে রমনার পাশ ঘুরে মৎস্য ভবনের পাশ দিয়ে মোড় নেয় শাহবাগের দিকে। তখন প্রায় নিঃশব্দে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। সড়ক বাতিগুলো জ্বলে ওঠে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে পৌঁছে আর সামনে এগোতে পারে না। কালো রঙের একটি মাইক্রোবাস সামনে এসে ব্রেক কষে। সঙ্গে সঙ্গে দুজন লোক নেমেই কবীরকে টেনে-হিঁচড়ে মাইক্রোবাসে তোলে। যেন বহুকাল ধরে ক্ষুধার্ত কোনো সিংহ হরিণের ঘাড়ে ধারালো নখর বসিয়ে আহারের আয়োজন করছে। ঘটনার আকস্মিকতায় কবীর স্তম্ভিত হয়ে যায়। কিছু বোঝে ওঠার আগে তার চোখ বেঁধে ফেলে আক্রমণকারীরা। সে বোঝার চেষ্টা করে তাকে এখন কোথায় নিয়ে যাবে? নুপুরের বাবাকেও কি এভাবেই নিয়ে গিয়েছিল? হঠাৎ তার মনে হলো মাইক্রোবাসটি স্বাভাবিক গতির চেয়ে বেশি দ্রুত ছুটছে। মনে হলো মাইক্রোবাস নয়, কোনো রকেট ছুটছে নগরীর কালো ধোঁয়া-সিসায় মোড়ানো বাতাস চিরে চিরে। কবীর কিছু একটা বলতে যাবে, ঠিক তখনই ভারী কিছুর আঘাত পড়ে মাথায়। নাকে কেমন লবণাক্ত স্বাদ টের পায়। আর কিছুই বুঝতে পারে না সে।