সৌন্দর্য আর রহস্য, দুটো শব্দ সত্যি খুব বিচিত্র তাই না? কে কখন কোথায় কিভাবে কিসের মধ্যে রহস্যময় সৌন্দর্য খুঁজে পাবে, তা কেউ বলতে পারে না। আবার কবে কেন কখন কোনকালে কে সৌন্দর্যময় কোনো রহস্যের মধ্যে হাবুডুবু খাবে, তাও বলা যায় না। তবে কুক্ষণের সঙ্গে হয়তো দুটো শব্দেরই যোগ আছে। কে জানে, অথবা গুণ ভাগেরও সম্পর্ক! তবে বিয়োগ যে নেই, তাতে আমি নিশ্চিত। বিয়োগ থাকলে কি আর সেই শুরুতে কুক্ষণের কুমন্ত্রণায় রহস্যময় গন্ধমযোগ ঘটতো। অথবা ধরা যাক নার্সিসাসময় জলে কোনো আলোড়ন। যে আলোড়ন দেখে অদ্ভূত কোনো সৌন্দর্যে একদৃষ্টে অদৃষ্টবাদী হওয়া যায়। এই যেমন আজকের আধো চাঁদনি রাতের রহস্যময় সৌন্দর্য দেখতে শহরের আনাচে-কানাচে ঘুমন্ত কাদামাটির মানুষগুলোর মধ্যেও ইতিউতি উঁকিঝুকি মারছে কিছু জীবন্ত মুখ।
চৌরাস্তার ধারের ফুটপাতে এই অসময়েও দোকান খুলে বসে আছে এক চা খাওয়ানেওয়ালা। তবে খানেওয়ালা না থাকায় সে অবশ্য খানিকটা বিরক্ত। একটু দূরে পাশের গলিটার একেবারে মুখে কারা যেন সারাদিনের ক্লেদ, দুঃখ, হতাশাভরা প্লাস্টিকের ব্যাগ, নোংরামি আর রক্তচুপচুপে খবরের কাগজ, জীবন যাপনের এঁটোকাঁটা, যৌনতাময় মালমশলা, ভোগবাদের ভাগাড় জড়ো করে আগুন ধরিয়েছে। এই নিস্তব্ধ রাতে সেসবের নিভু নিভু ধোঁয়া আলাদিনের জিনের মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে হা হা করে উঠে যাচ্ছে আকাশে। কোথাও হয়তো মরা পোড়ানোর গন্ধ পেয়েছে কয়েকটা কুকুর। রাস্তার নিয়ন আলোয় নাক উঁচিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে তারা। একটু পরপর অকারণে ঘেউ ঘেউ করে উঠছে কেউ কেউ। যেন অদৃশ্য কোনো অশরীরিকে বলছে-সাবধান রহস্য ভাঙতে আরেক রহস্য নিয়ে এসো না। গুমগুম শব্দে রাস্তা দিয়ে একটা ট্রাক চলে গেল। যাক, তাওতো শব্দ আছে, শব্দেরও নৈশব্দ বর্তমান। কিন্তু এখানে এই বেটগাছটার নিচে কোনো শব্দ নেই, সঙ্গে নৈশব্দও। যেন কেবল অন্ধকারে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা এক কালো অবয়ব। না কি কোনো রহস্য আছে? থাকলেও থাকতে পারে। আপাতত গাছের সৌন্দর্যেই হোক আর চাঁদনি রাতের রহস্যময়তাতেই হোক বটগাছটার নিচে হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়িয়েছে এক যুবক। একেবারে ঘন কোকরা তার চুল। মুখটা পাথরের মতো নিরেট। আবার হতেও পারে পাথরের ভেতরে কোনো ফল্গুধারা বইছে। আসলে আধো অন্ধকারে ভালোভাবে ওর মুখ দেখতে পাচ্ছি না। ছেলেটাকে আগে কখনো এখানে দেখিনি। এত রাতে এখানে ও কী করছে, ভয়ডর নেই নাকি? আবার কে জানে, আজকাল হয়তো আর মাঘী পুর্নিমা লাগে না, যুবক সিদ্ধার্থরা অদৃশ্য নেশার টানে এমনিতেই গৃহত্যাগ করে।
সে যাই হোক এত রাতে ওর ঘর থেকে বের হওয়া মোটেও উচিত হয়নি। শহরে ছোটখাটো চোর ডাকাত তো অবশ্যই, বড় বড় সাঁজোয়া যানে আসা ডাকুদেরও উৎপাত কম নয়। কিন্তু ওর ভাবভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে না ঘরে ফেরার তাড়া আছে। অনেকটা আয়েশ করেই ও বটগাছটার বাঁধানো বেদীটাতে বসলো। বেদীর ওপাশে ময়লা লুঙ্গিটা পেঁচিয়ে ঢোলবালিশ হয়ে শুয়ে থাকা ভিক্ষুক কিংবা নেশাখোরটা অবশ্য বিরক্ত চোখে ওকে একবার দেখেছে, তারপর আবার ঘুমিয়ে গেছে নিজ নিয়মে। ছেলেটা এবার পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে তুললো। তারপর যখন ফস করে ম্যাচের আগুনটা দুই সেকেন্ডের জন্য জ্বললো তখন আমি ভালো করে ওর মুখ দেখতে পেলাম। ঠিক তখনই গলির মুখের কুকুরগুলো একটা দীর্ঘ আওয়াজ দিলো। হ্যাঁ ছেলেটাকে এবার খানিকটা চেনা চেনা লাগছে। তবে পুরোপুরি মনে পড়ছে না। সিগারেট টানতে টানতে পা দোলাচ্ছে ও। অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে যেন গান গাইছে। কথা বুঝতে পারছি না, তবে সুরের বিড়বিড় শুনছি। আশ্চর্যতো! রাতের রাস্তার নিয়ন আর চান্দ্র আলোর শংকর বন্যা ডিঙ্গিয়ে অস্তিত্ব ঘোষণা করতে করতে আরেকটা গাড়ি চলে গেল।
একি, ওই দূরে কাকে যেন দেখা যায়। ওর শরীর বোঝা যায় না, কেবল একটা ছায়া রাস্তার মধ্যে যেন একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। কে ও, কী চায়, কোথা থেকে আসছে? ছায়ার মানুষ কে, কেমন, কোথা থেকে আসছে এসব জানার একটা অপ্রতিরোধ্য কৌতূহল যেন রাতের পরিবেশটা আরেকটু উস্কে দিলো। সিগারেট টানা ভুলে গিয়ে কোঁকড়াচুলো ছেলেটাও বোধ হয় দেখছে ওকে। তবে কি এ মানুষ দুজন পূর্বপরিচিত! না কি রাতের নিঃসঙ্গতা ছিঁড়েফুঁড়ে কে আসে তা জানার কৌতুহল। হ্যাঁ, এবার যেন ছায়াটার অবয়ব একটু একটু করে বোঝা যাচ্ছে। একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ। গায়ে আবছায়া রঙের হাওয়া খেলানো শার্ট আর লুঙ্গি। হবে, হয়তো কোনো মানুষ, জন্মের পর থেকে যে দারিদ্র্যের দোষে যাযাবর হয়ে নিজের পরিচয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। আজ রাতে এখানে এসেছে বটগাছটার বাঁধানো বেদিতে শুয়ে থাকবে বলে।
লোকটা আসলেই বটগাছটার সামনে এসে আড়মোড়া ভাঙে। কোঁকড়াচুলো ছেলেটা যেন ওর কাণ্ডকারখানায় মজা পাচ্ছে। আবার ওর চোখের দৃষ্টিও সতর্ক। সত্যিইতো আজকাল আর কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। এমনকি নিজেকেও না। মধ্যবয়সী লোকটাও কোঁকড়াচুলোর দিকে নজর রাখে। সে বেদীতে বসে আরাম করে। এই মধ্যরাতে দুজন রহস্যময় মানুষ চুপচাপ বসে আছে বটগাছটার নিচে, দৃশ্যটা আমার কেমন যেন অপাকৃত মনে হয়। যেন ওদের অস্তিত্ব আসলে বাস্তবে নেই। কোনো খেয়ালি লেখকের কলমে বা শিল্পীর তুলিতে জন্ম ওদের। আর দৃশ্যটা অস্বাভাবিক হতে বাধ্যও। এইতো কিছুদিন আগে এই বটগাছটার নিচেই এক পাগলির লাশ মিললো। এমনিতে অবশ্য সারাদিন ওর এখানে আসা যাওয়া বা ধুলোখেলা নিয়ে কারো নজর থাকে না। আর তো থাক রাতের অন্ধকার। ওর অসুখই ওকে মানুষের সভ্যতা থেকে গায়েব করে দেয় ভোজবাজির মতো। কেবল বেলা বেড়ে যেতে যেতে যখন রোদ বাড়তে লাগলো, তখন একজনের চোখে পড়লো, আরে পাগলটা তো মরে দাঁত কেলিয়ে আছে। নেহায়েৎ শরীরটা ছিল মানুষের, পঁচলে দুর্গন্ধ বেশি বেরোবে তাই লোকজন ধরাধরি করে লাশটাকে কোথায় যেন সরিয়ে ফেললো। আবার বটগাছটার এই বাঁধানো বেদী, নীরবে সাক্ষী হয়ে থাকে বারো বেশ্যা, ঠকবাজ আর নেশাখোরদেরও। এমন একটা জায়গায় রাতের বেলাটা সত্যিই নিরাপদ নয়। অন্ধকারও যেন এখানে কখনো কখনো রাতের কাছ থেকে ছিনতাই হয়ে যায়।
হাওয়া খেলানো শার্টের লোকটা এখন গুনগুন করে গান ধরেছে-চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙ্গেছে। আশ্চর্য, রবীন্দ্রনাথের গান! এই পোশাকে এই নির্জন রাতে লোকটার গলায় ঠিক রবীন্দ্রনাথের গান যেন মানাচ্ছে না। বরং নিস্তব্ধ এই গুঞ্জনে যেন অপার্থিব কোনো গান হলে বেশি জমতো। যাক, লোকটা তাহলে কোনো গায়ক। হয়তো অন্ধকারে ওকে ভূতে পাওয়া কোনো রোগীর মতো রবিঠাকুর পেয়ে বসেছে। কোকড়াচুলো ছেলেটা ওকে দেখতে থাকে। ওর হাতের সিগারেটটা এখনো শেষ হয়নি। দূর সমুদ্র থেকে দেখা বাতিঘরের আলোর মতো সিগারেটের আগুনটা জ্বলছে। মুখের মতো মানুষের মনের কথাও যদি পড়া যেতো, তাহলে নিশ্চই অনেক আগেই হানাহানি লেগে যেতো।
কে জানে এখন এই দুজনের মনে আসলে কী চলছে! হয়তো তারা মনে মনে কোনো শুভ-অশুভ ছক কষছে। কেউ হয়তো কোমরে গুঁজে রেখেছে ছুরি। একটু সুযোগ করে আড়াল বুঝে পঠে আমূল বসিয়ে দেবে ওটা। রক্তে যখন ভসে যাবে আহতের শরীর, তখন ভেজা হাতটা বুকের কাছে মুছে লুটে নেবে সব। আমি ধারণা করার চেষ্টা করি, আসলে কার মনে বা কোমরে আছে সেই লুকানো খঞ্জর। লুঙ্গি পরিহিত লোকটা গুনগুন করতে করতেই কোমরে হাত দেয়। আমি দমবন্ধ করে অপেক্ষা করি কোনো একটা কিছু ঘটার। মনে হয় যেন হঠাৎই হৃদপিণ্ড নামক হরিণ শাবকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চলেছে মুহূর্তের ডোরাকাটা বাঘ। না, বাঘটা ধরা দেয় না। যেন আড়ালে আড়ালে চলতে চলতে নজর রাখে শিকারের ওপর। লোকটা কোমরের খুট থেকে বের করলো সিগারেট। এ কি কোকড়া চুলো ছেলেটার কাছ থেকে আগুনের জন্য অপেক্ষা করছে সে। আর ওই ছেলেটাই বা লোকটাকে এভাবে দেখছে কেন। সেও কি আগুন ভাগে আগ্রহী! ওহ, এ তো এক উত্তেজনাপূর্ণ খেলা। অন্ধকার রাতের আড়ালে অচেনা রহস্যময় রুলেত। অথচ খলোয়াড়রা হয়তো জানেই না, কী মজা লুটছে দর্শক। আমি নিজের সঙ্গে একটা বাজি ধরার চেষ্টা করি-ছেলেটা হয়তো ওকে আগুন ধার দেবে। যদি দেয় তাহলে পাতায় পাতায় ছলাৎ ছলাৎ উল্লাস। আর যদি না দেয়—তাহলে..তাহলে আসলে কী হওয়া উচিত! নাহ এই দমবন্ধ খেলার শেষ কোথায়। ছেলেটা একমনে এখন সিগারেট টেনেই যাচ্ছে, আর লোকটা নাকের কাছে সিগারেটটা নিয়ে গন্ধ শুঁকছে। আমি এবার সত্যিই বুঝতে চেষ্টা করি আসলে ওদের উদ্দেশ্যটা কী। কেনো এই রাতে অচেনা দুই পারস্পরিক এভাবে রহস্যের পসরা পেতেছে। ঠিক কতক্ষণ ওরা এভাবে কাটায় আমি গুণে উঠতে পারি না। সময় আর রাতও যেন ওদের সঙ্গে আঁতাত সেরেছে। তারপর হঠাৎ দূরে আবার কুকুর ডাকে, একটা নিশাচর পাখি ডানা ঝাপটায়। মৃদু একটা বাতাসে পথের আলগা ধুলো গড়াগড়ি সেরে নেয়। ভোর হতে আর হয়তো তেমন বাকি নেই। ছেলেটা আর লুঙ্গি পড়া লোকটা যেন একসঙ্গেই উঠে একে অন্যের মুখোমুখি দাঁড়ায়। ওরা তাহলে পরস্পরকে চেনে, আর আমি এতক্ষণ কত কী ভেবে নিয়েছি। কিন্তু ভাবনার পরও যে আরও ভাবনার অবশিষ্টাংশ থাকে তা ভাবতে পারিনি।
ব্যাপারটা সত্যিই ঘটলো কী না জানি না। তারপরও দেখলাম-হাত বাড়িয়ে ছেলেটার ছায়া লোকটার ছায়া ছুঁলো। তারপর ছায়াদুটো মিশে যেতে থাকলো ছায়ার মধ্যে।যেন এতক্ষণের রাত গল্পে আর কোনও চরিত্র নেই, কখনো ছিলও না। কেবল ছায়াই মুখ্য চরিত্র হয়ে খেলেছে রাতের সঙ্গে। ওদের সম্মিলিত ছায়াটা যেন এখন মাটিতে বিছিয়ে থাকে। যেন নিকষ কোন রস ধীরে ধীরে ঢুকে যাচ্ছে মাটির গভীরে। যেমন মাটির বুকের মাঝে বন্দি যে জল মিলিয়ে থাকে। এখন দৃশ্যপটে আর কেউ নেই। শুধু নিঃসঙ্গ বটগাছটার কিছু পাতা মৃদু বাতাসে এলোমেলো দোলে। মনে হয় রাতের সেই চিরকালীন রহস্যময়তা আর সৌন্দর্যকে স্বীকার করে ক্রমাগত কুর্নিশ করে চলেছে প্রকৃতি। আশ্চর্য অথচ ছেলে আর লোকটা একটু আগেও কেমন এখানে ছিল। না কি তারা কখনোই ছিল না! আবার হয়তো এসেছিল ঠিক, কিন্তু চলে গেছে কোনও এক ফাঁকে। অবশ্য তারা ছায়া হতেও দোষ নেই। দিনের কোনও এক মুহূর্তে কায়া হয়ে এসেছিল এখানে। শুধু চলে যাওয়ার সময় ফেলে গেছে ছায়াটা। মৃদু বাতাসে আমারও পাতা দোলে, শাখা নড়ে। বটগাছটা আর আমি অন্য রাতগুলোর মতোই অধীর অপেক্ষায় কিসের জন্য যেন চেয়ে থাকি। শুনশান আলো আঁধারিতে রাস্তাটা চাঁদের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেয়। এই রাতের ভেতরও একটা রাত আছে। ঠিক যেমন শহরের ভেতর আছে আরেকটা শহর। গহীনের ভেতর অতলান্তিক গহীন। রাত হলেই রহস্যময় সৌন্দর্যের ঘোরে কায়াসর্বস্বরা এখানে ছায়াতে পরিণত হয়। তারাই তখন নতুন রাতের রঙ্গমঞ্চ সাঁজায়।
গৃহত্যাগী জোছনায় ঘরছাড়ার সময় রাহুলের মুখ মনে করে কাঁদে। সেসব অবোধ্য কথা, অকারণ প্রলাপ কেউ মনে রাখে না। শুধু গাছ আর রাস্তার নিশ্চল কুঠুরিতে জমা থাকে সেসব। তারপর হঠাৎ কোনোদিন বাউরি বাতাস বয়ে গেলে এখানে, ছায়ারা সব জিকির ধরে:
আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো
খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার
পুরোনো পেঁচার ঘ্রাণ; অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ, মাঠে-মাঠে ডানা ভাসাবার
গভীর আহ্লাদে ভরা; অশথের ডালে-ডালে ডাকিয়াছে বক
আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক