পেছনের গল্প
প্রতিদিন জীবিকার জন্য ঢাকা থেকে বলা ভালো কল্যাণপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ থেকে কল্যাণপুর যেতে আসতে হয়। ফলে চব্বিশ ঘণ্টার বড় একটা সময় আমাকে কাটাতে হয় এই সব লোকাল বাসে। কত মানুষ দেখি। কাউকে হয়তো দ্বিতীয়বার দেখিও না। এই একবার দেখা মানুষগুলোরই আমি মুখ পড়ার চেষ্টা করি। প্রতিটি মানুষ একেকটি গল্প।
আমি গল্পগুলো বোঝার চেষ্টা করি। বোঝার চেষ্টা করি তাদের মনস্তত্ত্ব। যেহেতু ক্ষণিক সময় তাদের দেখা পাই, তাই একদিন মনে হলো তারাও আমার ছোটগল্পের বিষয় হতে পারে। কিন্তু গল্প আর লেখা হয়ে ওঠে না। আমি আসা যাওয়ার পথে এসব ঘটনা দেখতেই থাকি। একটি বিষয় সবসময় বড় বিব্রত করে, লোকালবাসগুলোতে মেয়ে বা নারীদের খুব বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। পুরুষদের সঙ্গে ঠাসাঠাসি করে চলতে হয় তাদের। এই সুযোগ অনেক সময় কিছু বিকৃত মানসিকতার পুরুষ গ্রহণ করে। এছাড়া, ছিনতাই, পকেটমার, প্রতারণা তো লেগেই থাকে। আছে সিটিং সার্ভিসের নামে চিটিং সার্ভিস। একদিনের ঘটনা। খুব ক্লান্ত আমি। বাসে করে বাসায় ফিরছি। বসে আছি। মহিলা সিটে। আসাদ গেট বা কলেজগেট থেকে এক মেয়ে এসে দাঁড়ালো আমার সামনে।
খুব ক্লান্ত, তাই তাকে সিট ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছিল না। তাছাড়া বিষয়টি গা-সওয়া হয়ে গেছে ততদিনে। তাছাড় ব্যাপারটা ফিটেস্ট দ্য সারভাইব গোছের হয়ে গেছে। কিন্তু সেদিন হঠাৎ মনে হল আচ্ছা, এ মেয়েটি যদি আমার বোন হতো কিংবা মা হতো, এভাবে কি বসে থাকতে পারতাম। এমন সময় এক লোক নেমে যাওয়ার সময় তাকে সিটতে বসতে বলে, সে ঘটনাটুকুই এ গল্পের আঁতুড়ঘর। গল্পটি যখন মাথায় এলো, তখন ভাবতে লাগলাম, গল্পটি আমি কিভাবে উপস্থাপন করবো, এর ন্যারেশন কেমন হবে? এসব। এভাবে মাথায় গল্পটি লেখা হতে থাকে, কাটিকুটি চলতে থাকে। মোটামুটি মাথার মধ্যে যখন চূড়ান্ত আকার লাভ করে, তখন একদিন লিখতে বসলাম।
তবে, এই গল্প লেখার সময় খুবই দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে আমার জীবনে। ভেবেছিলাম, সেটি বলবো। কেননা, এই গল্পটি আমার সেই দুঃখজনক ঘটনার স্মৃতিগন্ধে ভারাতুর। তারপর মনে হলো, অনেক বেদনার মতো এই কষ্টটুকুও না হয় অনুক্ত থাক।
চোখ ॥ রাকিবুল রকি
সিটে বসতেই ফস করে শব্দ হল। মামুন মুখ দিয়ে অস্পষ্ট শব্দ করল, ‘আহ!’
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো বাসের শেষ মাথা পর্যন্ত। পেছনে হয়তো দুয়েকটা সিট এখনো খালি। জানে, তবু মাথা উঁচু করে বাসের গায়ে সাঁটা স্টিকারটি আবার দেখে নিলো। ‘শিশু, মহিলা, প্রতিবন্ধীদের জন্য নয়টি আসন সংরক্ষিত’। অভ্যাসবশত প্রথম থেকে সিট গুনতে শুরু করলো। ড্রাইভারের বামে চারটা, পেছনে দুইটা। তার মানে সে যে সিটে বসেছে, সেটি সাত নম্বর সিট। মহিলাদের জন্য নির্ধারিত। মনে আবার খচখচানি শুরু হলো মামুনের। সিট পাওয়ার যে স্বস্তি, তা কেটে গিয়ে শুরু হলো অস্বস্তি। মামুন ডানপাশের সিটের দিকে তাকালো। কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা একলোক বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। মুখ কিছুটা হা হয়ে গেছে। আহ! কত শান্তি। সেও মহিলা সিটে বসেছে কিন্তু কোনো টেনশন নেই। আরামে ঘুম দিয়েছে। রাজ্যের যত খচখচানি, সবই যেন মামুনের মনে। অথচ বাসে ওঠার পর এক প্রকারে উড়ে এসেই বসেছে এই সিটে। বসবেই না কেন? যাবে যে অনেক দূর।
আমিনবাজার। পৃথিবী থেকে চাঁদের যাবার সময় ঠিকঠাক নির্ধারণ করা গেলেও গুলিস্তান থেকে আমিনবাজার যেতে কত সময় লাগবে, কেউ তা বলতে পারবে না। মামুন এই ব্যাপারে বাজি ধরতে রাজি। অবশ্য তার পকেটকে সবসময় গড়ের মাঠ না বলা গেলেও ছোটখাটো খেলার মাঠ বলা যেতে পারে। কখনোই ভরে না। মাস চলে হিসেবের টাকায়, গুনে গুনে। টিউশনির টাকা। তিনটে টিউশনি করে মামুন। অদ্ভুত ভাগ্য বলতে হবে মামুনের। তার টিউশনির সংখ্যা সবসময় তিনের কোটাতেই আটকে থাকে, বাড়েও না, কমেও না। বিগত চার বছর ধরেই এমন হচ্ছে। দেখা গেলো, একটি টিউশনি বেশি পেলো, তো আগের একটি টিউশনি চলে গেলো।
পুরোনো টিউশনি চলে গেলো, মাস না ঘুরতেই নতুন টিউশনি পেয়ে গেলো। টাকার অঙ্ক বাড়ে কমে কিন্তু টিউশনির পরিমাণ বাড়ে না। তবে, একটি জিনিস বাড়ছে মামুনের। বয়স। বোধহয় চল্লিশের কোঠা ছুঁয়েছে। হিসাব করতে ইচ্ছে করে না এখন আর। চাকরি একটি অবশ্য আছে মামুনের। অনার্স কলেজে। মুন্সীগঞ্জে। তবে সেটি কাজির গরুর মতো। কাগজে আছে। গোয়ালে নেই। মামুনের চাকরিও তেমনই। কলেজ অনার্স খোলার অনুমোদন পেতে হলে প্রতি বিষয়ে পাঁচজন করে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হয়। নইলে অনুমোদন পাওয়া যায় না। অগত্যা আর কী করার, কলেজ কর্তৃপক্ষ, অধ্যক্ষ পাঁচ জনকে নিয়োগ দেয় ঠিকই কিন্তু তাদের নিয়মিত করেন না। অর্থাৎ কাগজে তাদের নাম থাকলেও তারা কোনো ক্লাস নিতে পারেন না।
অনার্সের ক্লাসগুলো ইন্টারমেডিয়েট কিংবা ডিগ্রির শিক্ষক দিয়েই চালিয়ে নেন। যেহেতু ক্লাস নেন না, তাই মাইনেটাও নেই। মাঝেমধ্যে হয়তো কোনো কাজে ডাকেন। পরীক্ষার ডিউটি, খাতা দেখা কিংবা অডিট-টডিট হলে।
আজকেও কলেজে গিয়েছিল মামুন। কিছু পরীক্ষায় হল ডিউটি করেছিল, তারই বিল আনতে। বিল যা পেয়েছে, তা এ কদিনের যাতায়াত ভাতা বাদ দিলে থাকে মাত্র দেড়শ টাকা।
অফিসে ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে টাকা বুঝে নিয়ে ঢুকেছিল প্রিন্সিপালের কক্ষে।
কলেজে নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে নিজস্ব অর্থায়নে, তাই খুব ব্যস্ততা। মামুন বসে রইল প্রিন্সিপালের সামনে। প্রিন্সিপাল একের পর এক ফাইল দেখছেন আর স্বাক্ষর করছেন।
মামুন এক পর্যায়ে ডাকল, ‘স্যার।’
মামুন বারবার ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘড়ির সবচেয়ে বড় এবং মোটা কাঁটাটা বারোটার ঘরে গেলেই একটা বাজবে।
প্রিন্সিপাল মামুনের দিকে তাকালেন। চোখ দুটো মৃতমানুষের মতো। নির্লিপ্ত। বললেন, ‘কী ব্যাপার, মামুন সাব, হল ডিউটির বিল পেয়েছেন?’
মামুন বিগলিত হাসি হেসে বলল, ‘জি স্যার।’
প্রিন্সিপাল কলিংবেল বাজালেন। দরজার সামনে বসে থাকা আয়া হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো।
‘কী স্যার?’
‘মামুন সাহেবকে চা-বিস্কিট দাও।’ বলেই আবার কাজে ডুব দিলেন।
আয়া কিছুক্ষণের মধ্যেই চা-বিস্কিট দিয়ে গেলো মামুনের সামনে। লিকার চা। একটি কালো পিঁপড়ে ভাসছে তাতে। হয়তো চিনি থেকে এসেছে। সঙ্গে আলাদা করে পিরিচে দেওয়া তিনটি এনার্জি বিস্কিট।
মামুন ডান হাতের তর্জনী দিয়ে পিঁপড়েটি সরালো। চা বেশ গরম। বিস্কিট ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেলেন। চা পান করলো। সবটুকুই পান করলো। কোনো তলানি পড়ে রইলো না। তারপর খালি কাপ এমন ভাবে টেবিলে রাখল যেন কোনো শব্দ না হয়। প্রিন্সিপাল এক মনে কাজ করেই যাচ্ছেন। মামুন মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কক্ষটি আবার দেখলো। রুমের কোথায় কী আছে, মামুন জানে। তবু আবার মিলিয়ে নেয়। দেখে নেয়, আগের জিনিসগুলো ঠিকঠাক মতো আছে কি না?
মামুন প্রিন্সিপালের মাথার ওপর দেয়ালে লাগিয়ে রাখা বঙ্গবন্ধু এবং প্রধানমন্ত্রীর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে বেশ খানিকটা সময়। দুজনের চোখ কি আশ্চর্য মায়াময়। মামুনের মনে হয়, তারা মায়াভরে মামুনের দিকেই তাকিয়ে আছেন। চা-বিস্কিট খাওয়ার পর আরও আধঘণ্টা চলে গেছে। মামুন বারবার ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘড়ির সবচেয়ে বড় এবং মোটা কাঁটাটা বারোটার ঘরে গেলেই একটা বাজবে।
মামুন আবারও বললো, ‘স্যার।’
প্রিন্সিপাল বললো, ‘একটু।’
তারপর ফাইলের কাগজগুলোতে আর কয়েকটা স্বাক্ষর করে সামনের দিকে ঠেলে দিলেন। শরীর হেলিয়ে দিলেন পেছনে। দু’হাত টানটান করে মাথার ওপর করে একটু আড়মোড়া ভাঙলেন।
বললেন, ‘মামুন সাব, চা খেয়েছেন?’
মামুন মুখে আবার কৃতজ্ঞতার হাসি টেনে বললো, ‘জি স্যার, খেয়েছি।’ চোখদুটোও চকচক করে উঠলো মামুনের।
প্রিন্সিপাল জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু বলবেন?’
‘জি স্যার, একটু কথা ছিল।’ মামুন বললো। কোলে হাতের তালুদুটো একত্র করে ঘষতে লাগলো।
‘স্যার, আমাকে যদি একটু রেগুলার করে নিতেন, খুব উপকার হতো স্যার। দুই বছর তো হয়ে গেলো স্যার। একটু যদি দেখেন স্যার। খুবই উপকার হয় স্যার। খুব।’
বলতে বলতে চেয়ারে বসা অবস্থাতেও একটু বেঁকে যায় মামুন।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। অথচ অধিকাংশ শিক্ষককেই মেরুদণ্ড বাঁকা করে কথা বলতে হয়।
প্রিন্সিপাল এবার হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বসলেন। হাতদুটো রাখলেন কাচে ঢাকা টেবিলের ওপরে।
বললেন, ‘মামুন সাহেব, সবই বুঝি। আপনার মতো ট্যালেন্ট টিচারকে রেগুলার করতে পারলোে তো আমারই লাভ, স্টুডেন্টের লাভ। কিন্তু কী করবো বলুন? কলেজের ফান্ডে টাকা নেই। আপনাদের যে সম্মান করবো, সে উপায় নেই আমার।’ বলতে বলতে প্রিন্সিপালের চোখদুটো জানালার ফাঁকা দিয়ে নির্মাণাধীন বহুতল দালানের দিকে চলে যায়। মামুনও প্রিন্সিপালের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকায় দালানগুলোর দিকে। পুরোদমে কাজ চলছে। কলেজের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে এই ভবন। মামুন চেষ্টা করেও মুখের হাসি ধরে রাখতে পারে না। চোখদুটো জলে টলমল করে ওঠে। কত আশা নিয়ে প্রিন্সিপালের কাছে কথাটি তুলেছিল। অবশ্য এর আগেও বেশ কয়েকবার বলেছে। ফল ভাঁড়ে মা ভবানী।
মামুন বলল, ‘একটু স্যার দেখবেন চেষ্টা করে। যদি হয়…’
‘আমার মাথায় আছে মামুন সাব। চিন্তা করবেন না। আপনার চেয়ে আপনাদের নিয়ে আমার চিন্তা বেশি, বুঝলেন।’
মামুনের কথা শেষ করতে না দিয়েই প্রিন্সিপাল বললেন। তারপর আরেকটি ফাইল টেনে নিলেন কাছে। মামুন দাঁড়িয়ে বললো, ‘স্যার, আজ তবে আসি। দোয়া করবেন। আসসালামু আলাইকুম।’
প্রিন্সিপাল ঠিকমতো মামুনের দিকে না তাকিয়েই এক হাত আশীর্বাদের ভঙ্গিতে তুলে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভালো থাকবেন। ওয়ালাইকুম সালাম।’
মামুন হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে বাসট্যান্ডে। আরেক কাপ চা বিস্কিট খেয়ে চেপে বসলো ঢাকার বাসে। ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে মামুন যখন গুলিস্তান নামলো, দেখলো, বিশ গজ দূরেই সাভারের বাস। কোথায় রইলো ক্লান্তি? কোথায় রইলো মনখারাপ? বয়স ভুলে মামুন দিলো এক দৌড়। অবশ্য দৌড় না বলে একে হাঁটা এবং দৌড়ের মাঝামাঝিকে বলা যায়।
এত কষ্টের পর মামুনের মনে এখন একটাই দোলাচল কোনো মহিলা না এসে উঠে বাসে। মামুনের মনের কথা বোধহয় পেছনের যাত্রী বুঝতে পারলো। ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে বলল, ‘ওই ড্রাইভার সাব, গাড়ি ছাড়েন না কেন?’
গণপরিবহনে একটি সুবিধা আছে। কেউ কিছু বললে সঙ্গে সঙ্গেই গণমত তৈরি হয়ে যায়। লোকটির সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই হৈহৈ করে উঠলো। ‘গাড়ি ছাড়েন, গাড়ি ছাড়েন।’
ড্রাইভার সিটে বসে পান চাবাতে চাবাতে ব্যাক মিররে গাড়ির অবস্থা দেখলো। কিছু বললো না।
ড্রাইভারের পক্ষ থেকে হেলপার বললো, ‘ভাই, আর দুই জন অইলেই যামু গা। রাস্তার তে আর লোক নিমু না।’
মামুনের পাশের যাত্রীর ঘুম ভেঙে গেছে। বললো, ‘হ, ভাড়া লইয়াই আবার প্যাসেঞ্জার তোলবা, জানি এসব চালাকি!’
মামুন কিছু বলে না। চুপ করে শুধু আশে-পাশের ঘটনা দেখে। শোনে। ইতোমধ্যে একজন যাত্রী আরেকজন যাত্রীর সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে বিশাল তর্ক জুড়ে দিয়েছে। একটি কথা ছিটকে এলো মামুনের কানে। লোকটি বলছে, এতই যদি ভালো হবে, তাহলে ছিয়ানব্বইর ভোটের সময় স্লোগান দিলো কেন, ভুল ত্রুটি ক্ষমা চাই? বলেন।
মামুনের ঘুম ভেঙে গেল। দ্বিতীয় স্বপ্নটি সে আগেও দেখছে। আসলে স্বপ্ন নয়, বাস্তব ঘটনা বারবার দুঃস্বপ্ন হয়ে তার কাছে ফিরে আসে।
গাড়ি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ছেড়ে দিলো। কচ্ছপ গতিতে জিরো পয়েন্ট আসতেই পড়লো সিগন্যালে। ভাগ্য ভালো সিগন্যালে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হলো না। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রেসক্লাব পেরুলো বাস। হেলপার ভাড়া তুলতে শুরু করছে। মামুনের সামনে আসতেই মামুন পকেট থেকে ত্রিশ টাকা বের করে দিলো।
‘কই যাইবেন?’
‘আমিনবাজার।’ মামুন বললো।
হেলপার মামুনের পাশের যাত্রীর থেকে ভাড়া তুলে চলে গেলো। হেলপারের সঙ্গে ক্যাঁচাল লাগলো মামুনের ঠিক এক সিট পিছনের যাত্রীর সঙ্গেই। সেও আমিন বাজার যাবে। ভাড়া দেবে পঁচিশ টাকা। হেলপার কিছুতেই ত্রিশ টাকা ছাড়া নেবে না। অবশেষে হেলপার মামুনকে দেখিয়ে বললো, ‘ওই ভাইরে জিগান। হেয়ও আমিনবাজার যাইব। জিগান ভাড়া কত দিছে।’
মামুন খুব বিব্রত হয়ে পড়ে। পেছনে তাকানোর সাহস পায় না। কী না কী বলে বসে ওই লোক।
মৎস্যভবন পেরিয়ে এসে ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটের সামনে জ্যামে পড়লো বাস।
প্রথমে এক পানি বিক্রেতা উঠলো। পনেরো টাকা দামের হাফ লিটার পানির দাম চাচ্ছে বিশ টাকা। এরপর বাসে উঠলো এক বৃদ্ধলোক। ভিক্ষুক বা সাহায্যপ্রার্থী। বয়সের ভারে ন্যূব্জ। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। পরনে সাদা ময়লা পাঞ্জাবি। মাথায় ময়লা টুপি। হাতে পাঁচ টাকা, দশ টাকার নোট দুমড়ানো মোচড়ানো করে হাতে ধরা।
খুবই করুণ গলায় জানালো, টাকার অভাবে ওষুধ খেতে না পারার কথা। লোকটি কাকুতি-মিনতি ভরা কণ্ঠে বলতে বলতে পেছনে যেতে লাগলো। ঠিকমতো হাঁটতেও পারছে না। মনে হচ্ছে, এখনই পড়ে যাবে। মামুনের মনে আবার দোলাচল শুরু হয়। লোকটিকে কিছু টাকা দেবে, না কি দেবে না? কত দেবে? পকেটে আছে অতিরিক্ত দেড়শ টাকা। ভেবেছিল আজ রাতে একশ টাকায় গ্রিল নান খাবে। পঞ্চাশ টাকায় করবে আগামীকাল সকালের নাস্তা।
লোকটি পেছন থেকে সামনে আসতে আসতেই মামুন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। সে যখন মামুনকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল, মামুন আলগোছে ডান হাত বাড়িয়ে দিলো লোকটি সামনে। একশ টাকা। লোকটি টাকা নিয়েই পাঞ্জাবির পকেটে ভরে ফেললো। কে জানে, হাতে একশ টাকার নোট কেন রাখলো না? লোকটি আস্তে আস্তে বাসের গেইটের দিকে এগিয়ে গেলো। মামুন পেছন থেকে তাকিয়ে দেখে। বাস থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই যেন জাদুবলে সব বদলে গেলো। নুয়ে থাকা লোকটি সঙ্গে সঙ্গেই সোজা হয়ে গেলো। বীরবিক্রমে হেঁটে গেলো আরেকটি বাসে। মামুন বুঝতে পারলো, একশ টাকাই জলে পড়ছে। মনে মনে হেসে উঠলো। অথচ লোকটির চোখের দিকে যখন সে তাকিয়ে ছিল, সেখানে ছিল নিদারুণ অসহায়ত্ব। মানুষ বলে, চোখ মিথ্যে বলে না। আসলে ভুল বলে। পাকা অভিনেতারা চোখ দিয়েও অভিনয় করতে পারে। ভিক্ষুকটি সেই তুখোড় অভিনেতাদের দলেই।
মামুনের তাদের মহল্লার ইব্রাহিম হুজুরের কথা মনে পড়লো। একসময় খুব ভালো সম্পর্ক ছিল তার সঙ্গে। একবার মামুন এক লোককে ভিক্ষা দিলে ইব্রাহিম হুজুর বলেছিল, ‘বুঝলেন মামুন ভাই, নবিজির শিক্ষা, করো না ভিক্ষা। নবিজি কিন্তু ভিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করে গেছেন। জানেন নিশ্চয়ই, একবার নবি হজরত মুহাম্মদ (স.) তার সাহাবিদের নিয়ে বসে আছেন। এমন সময় এক লোক এসে নবির কাছে ভিক্ষা চাইলো। নবি কিন্তু তাকে ভিক্ষা দিলেন না। তাকে একটি কুড়াল কিনে দিলেন। বললেন, ‘এ কুড়াল দিয়ে বন থেকে কাঠ কেটে বাজারে নিয়ে বিক্রি করবে।’ লোকটি তার কথা মতো কাজ করে সাবলম্বী হয়ে উঠেছিল। নবি চাইলেই তাকে কিছু ভিক্ষা দিয়ে বিদায় করে দিতে পারতেন। যদি ভিক্ষা দিয়ে বিদায় করতেন, তাহলে তাকে আবার কারো কাছে হাত পাততে হতো। সবচেয়ে বড় কথা তার মধ্যে যে ব্যক্তিত্ববোধ, তা একেবারেই নষ্ট হয়ে যেতো। মনে রাখবেন মামুন ভাই, কাউকে ভিক্ষা দিয়ে উপকার করা যায় না। যদিও আমরা এক মগ খিচুড়ি দিয়ে, দুটো টাকা দিয়ে, কিছু চাল দিয়ে মনে করি মানুষের অনেক বড় উপকার করে ফেললাম। আসলে তা না। যে কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের আত্মমর্যাদা নষ্ট হয়ে যায়, সে কাজে কোনো মতেই মানুষের উপকার হয় না।’
মনে হচ্ছে, ইব্রাহিম হুজুরের কথাই ঠিক। ইব্রাহিম হুজুরের আরেকটি কথা খুবই মনে পড়ে মামুনের। ইব্রাহিম হুজুর বলতেন, ‘বুঝলেন মামুন ভাই, নবিজি বারবার বলতেন, ‘তোমরা চোখ ও কানের গোনাহ থেকে বেঁচে থাকো।’
অবিবাহিত পুরুষদের চোখের গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা কি যে কঠিন, তা ভুক্তভোগী মাত্র জানেন।
মামুন এক সময় বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ পড়েছিল। মনে করতে চেষ্টা করল, অন্য কোনো ধর্মে চোখ নিয়ে কিছু বলা হয়েছে কি না? মনে করতে পারলো না।
বাস এতক্ষণে শাহবাগের মোড় ঘুরে বাংলামোটরের দিকে যাবার রাস্তায় এসে ব্রেক কষলো। এ ব্রেক চাপা ইচ্ছাকৃত নয় কিন্তু কাক্সিক্ষত। সামনে অনেক গাড়ি থেমে আছে। না চাইলেও ব্রেক চাপতেই হতো। কিন্তু কাক্সিক্ষত বলার কারণ, গেইট দিয়ে হু হু করে যাত্রী উঠে বাস ভরে গেল। কয়েকজন মহিলাও উঠেছে। এক মহিলা মামুনের উপরে এসে পড়তে গিয়েও পড়ল না।
মামুন তাকালো মহিলার বুকের দিকে। ভীষণ বড় দুটো মাংসপিণ্ড। এমনভাবে জামা পরেছে, বুকের খাঁজ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। মামুন এক মুহূর্তের জন্য ঘোরগ্রস্ত ভাবে তাকায় সেদিকে। ইব্রাহিম হুজুরের বলা হাদিসের কথা মনে পড়ে। ‘তোমরা চোখ ও কানের গোনাহ থেকে বেঁচে থাকো।’
মামুন ইচ্ছায় অনিচ্ছায় জানালার দিকে চোখ ফেরায়। একবার ইচ্ছে হয় নরম মাংসের গম্বুজে কাঁধ ডুবিয়ে দিতে। সে-ইচ্ছেকেও দমন করে। মহিলাটি মানুষের স্রোতে পেছনে চলে যায়। কয়েক সেকেন্ড মাত্র দাঁড়িয়ে ছিল সে মামুনের সামনে। এই কয়েক সেকেন্ডেই তার মনে এতসব কাহিনি ঘটে গেছে। যাত্রীতে ভরে গেছে বাস। দুইসারি লোক দাঁড়িয়ে আছে। পিন প্রবেশ করানোর জায়গা নেই। বসে থাকা যাত্রীরা তো বলছেই, দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরাও হেলপারকে শাপশাপান্ত করে বলছে, আর যাত্রী না তোলার জন্য। দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের দেয়াল ভেদ করে হেলপাল গালি আর ভাড়া তুলতে লাগলো।
বাস অজগরের মতো এগুতে থাকে। মামুনের মনে আবার ঢিপঢিপ শুরু হয়েছে। কতগুলো মহিলা দাঁড়িয়ে আছে, অথচ সে নির্বিকারভাবে বসে আছে সংরক্ষতি আসনে। নিজেকে প্রতিরক্ষা করার জন্যেই মামুন মাথাটি পেছনে হেলিয়ে দিয়ে ঘুমের ভান ধরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তন্দ্রা নেমে আসে দুচোখে। অদ্ভুত দুটো স্বপ্ন দেখে সে।
দেবরাজ ইন্দ্র গৌতম মুনির বেশ ধারণ করে তার আশ্রমে হাজির হয়েছে। ইন্দ্র আগেই খবর নিয়ে জেনেছে, গৌতম মুনি আশ্রমে নেই। গৌতম মুনির ছদ্মবেশে ইন্দ্র গৌতম মুনির স্ত্রী অহল্যার সতিত্ব নাশ করল। গৌতম মুনি ফিরে এসে দুজনকেই অভিশাপ দিলেন। অভিশাপের কারণে অহল্যা পাথরে পরিণত হলো। ইন্দ্রের শরীরে দেখা দিল সহস্র যোনি-চিহ্ন।
ইন্দ্র এবার নিজের ভুল বুঝতে পারলো। অনেক অনুনয়-বিনয় করলো। ইন্দ্রের কাকুতি মিনতিতে মন গলল গৌতম মুনির।
বলল, অভিশাপ ফিরিয়ে নেবার কোনো উপায় নেই। তবে আমি বর দিচ্ছি, আপনার শরীরের সহস্র যোনি-চিহ্ন যেন সহস্র চোখে পরিণত হয়। আপনি যদি আর কখনো অন্য কোনো নারীর প্রতি কামাতুর হয়ে তার সতিত্ব হরণ করতে যান, তাহলে যেন নিজের চোখে নিজেকে দেখতে পেয়ে লজ্জিত হন।
গৌতম মুনির কথায় ইন্দ্রের শরীরের হাজার যোনি-চিহ্ন হাজার চোখের রূপান্তরিত হলো। ইন্দ্রের সেই চোখগুলো দেখতে দেখতে দুটো চোখে পরিণত হল। বদলে গেল স্বপ্ন। চোখ দুটো তার সাত বছরের ছোট বোনের। পুল থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে, অদ্ভুত ভয় মাখানো চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মামুনের ঘুম ভেঙে গেল। দ্বিতীয় স্বপ্নটি সে আগেও দেখছে। আসলে স্বপ্ন নয়, বাস্তব ঘটনা বারবার দুঃস্বপ্ন হয়ে তার কাছে ফিরে আসে।
হাঁটতে হাঁটতে এবার দৌড়াতে শুরু করলো মামুন। যেভাবেই হোক চোখের আড়ালে তাকে যেতেই হবে।
মামুনদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া একটি নদী, ওরা বলতো গাঙ, গাঙের থেকে বেরিয়ে আসা খাল চলে গিয়ে মিশেছিল শীতলক্ষ্যা নদীতে। বর্ষা খালে সেই খালে থাকতো তীব্র স্রোত। একবার মামুন তার ছোট বোন মোমেনাকে বর্ষার নদীর পানি দেখাতে নিয়ে যায় বাড়ির কাছেই একটি পুলের ওপর। কী ভেবে মামুন মোমেনাকে পুলের রেলিঙে বসিয়ে দেয়।
এমন সময় মামুন দেখে রঙিন পাল তোলা এক নৌকা পাট নিয়ে যাচ্ছে।
মামুন মোমেনাকে বললো, ‘মোমেনা, দেখ দেখ।’
মোমেনা ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায়। তখনই হারিয়ে ফেলে শরীরের ভারসাম্য। সাথে সাথে নিচে পড়ে যায়। পানিতে পড়ার সময় মোমেনার মুখটি ছিল মামুনের দিকে ফেরানো। মোমেনার চোখে অদ্ভুত এক দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিটি এখনো ঘুমের মধ্যে ফিরে ফিরে আসে।
পানিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মোমেনা তীব্র স্রোতে ভেসে গিয়েছিল। অনেকটা দূরেই পাওয়া যায় তার লাশ। মোমেনার লাশ যখন বাড়ির উঠানে এনে রাখা হয় মানুষজনের ঢল নামে মোমেনাকে দেখার জন্য। মামুনের মা ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। যারাই মোমেনাকে দেখতে এসেছিল, সবাই মোমেনাকে দেখে তাকিয়ে থাকত মামুনের দিকে। অদ্ভুত সে দৃষ্টি। মনে হচ্ছিল অক্টোপাসের মতো গিলে খাবে মামুনকে। সেই থেকে মামুন এখনো ঠিক মতো অন্যের চোখের দিকে তাকাতে পারে না। কখনো কখনো অসহায় হয়ে পড়ে অনেকগুলো চোখের সামনে।
গাড়ি ফার্মগেট চলে এসেছে।
হেলপার চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘ফারোম গেইট নামেন, ফারোম গেইট, আয় ফারোম গেইট।’
লোকজনও হুড়হুড় করে নামতে লাগলো।
এরমধ্যে আরেক হল্লা শুরু হলো বাসে।
বাস থেকে নামার সময় এক যাত্রী হড়হড় করে বমি করে দিয়েছে বসে থাকা আরেক যাত্রীর গায়ে। ‘ দেখি, দেখি’ করতে করতে আরও দুইজন যাত্রী এগিয়ে এলো বমি দিয়ে মাখামাখি হওয়া যাত্রীর কাছে। পরম যত্নে তারা শরীর থেকে বমি মুছে দিল। যে বমি করেছে, তাকে মৃদু বকাঝকা করল। বকতে বকতেই নেমে গেল বাস থেকে। ফার্মগেট থেকে মানুষের স্রোত আবার যখন বাসে উঠছে, এমন সময় যার গায়ে বমি করা হয়েছিল, সে খেয়াল করল, প্যান্টের পকেট কাটা। পকেটে দশ হাজার টাকা ছিল। হাপিশ। পুরোটাই নিয়ে গেছে। লোকটি দৌড়ে এসে বাস থেকে নামল। কিন্তু যারা এ কাজ করেছে, তারা কোথাও নেই। বাতাসের সাথে মিশে গেছে। বাসের যাত্রীরা বলতে লাগল, ‘ভাই, উঠে আসেন। আর পাবেন না।’
লোকটি উঠে এল বাসে।
আবারও লোকজনে ঠাসা হয়ে গেছে বাস। এবার ষোল সতেরো বছরের এক মেয়ে এসে দাঁড়াল মামুনের সামনে।
মামুনের মনে হল মেয়েটিকে সিট ছেড়ে দেয়। পরক্ষণেই মনে হল আমিনবাজার এখনও অনেক দূর। তাছাড়া বাসে ইতোমধ্যে চার ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। ফলে শরীরের সঙ্গে মন মিলে দাঁড়ানোর পক্ষে মতামত দিচ্ছিল না। সিদ্ধান্তহীনতার শিংমাছ অনবরত তার মনে বিষাক্ত গাঁই দিয়েই যাচ্ছিল।
বাস মানিকমিয়া এভিনিয়্যুর মোড় পেরুতেই গতি ফিরে পেল। সামনে আর জ্যাম নেই। রাস্তা ফাঁকা। গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগলো মামুনের মনের অস্থিরতা। অস্বস্তি।
একবার মনে হচ্ছে, বসেই থাকি। আবার মনে হচ্ছে, যদি আমার ছোট বোন হতো, আমি কি বসে থাকতে পারতাম? তাছাড়া এটি মহিলা সিট। আবাব মনে হচ্ছে, আরও তো আটটি মহিলা সিট আছে, সেখানে বসে থাকা সবাই পুরুষ, তাছাড়া তুমি অনেক দূর থেকে এসেছো, যাবো অনেক দূর। আবার মনে হচ্ছে, তোমার ছোট বোন হলে কী করতে? নিজে বসে থেকে বোনকে দাঁড় করিয়ে রাখতে? বসে বসে দেখতে, লোকজন তোমার বোনকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় এক স্টপেজ আসতেই কিছু লোক নেমে গেল। লোকজনদের যেতে দেবার জন্য মেয়েটি একটু সামনে ঝুঁকে আসে। আর তখনই মেয়ের বুক এসে স্পর্শ করে মামুনের কাঁধ। খুবই সামান্য স্পর্শ। কিন্তু মামুনের শরীরের বিদ্যুৎ খেলে গেল। অন্যসময় হলে হয়তো কোনো এক আদিম পুলক অনুভব করত। কিন্তু এখন এক রাশ লজ্জা ঘিরে ধরেছে তাকে। কুলকুল করে ঘামতে থাকে সে।
ইতোমধ্যে গাড়ি আরেক স্টপেজে এসে থেমেছে। এক বয়স্ক ভদ্রলোক সিট থেকে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে ডাকল। বলল, ‘আমি নামব। আপনি এখানে এসে বসুন।’
মেয়েটি খালি সিটের দিকে এগিয়ে গেল। ভদ্রলোকটি মামুনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একবার তাকালো তার দিকে। মামুনের মনে হল সে চোখে শুধু ঘৃণা, ধিক্কার তার জন্যে। মামুন মাথা নিচু করে ফেললো। মনে হল, মেয়েটি তার বোন। সে বোনকে ধরে রাখতে পারেনি। রক্ষা করতে পারেনি। এ গ্লানি, লজ্জা তাকে অস্থির করে ফেললো। মনে হলো, বাসের সব লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই দেখছে তাকে। ধিক্কার দিচ্ছে। চোখগুলো বদলে মোমেনার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের চোখে পরিণত হতে লাগলো। মামুন আর সহ্য করতে পারছে না।
বাস এক স্টপেজে থামতেই মামুন ছিটকে বেরিয়ে এলো। দেখলোও না সে কোথায় নামলো, তার গন্তব্য আর কতদূর। বাস থেকে নেমেও রেহাল পেলো না। মনে হলো রাস্তার লোকজনও তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আছে। দেখছে। মামুন হাঁটতে লাগলো। জোরে জোরে হাঁটতে লাগলো। চোখ তবু বাড়তেই লাগলো। এখন দোকানকে মনে হচ্ছে চোখ, ভ্যানগাড়িকে মনে হচ্ছে চোখ, মানুষ নেই যেন চোখ হাঁটছে। ল্যাম্প পোস্ট এক জোড়া চোখ, ব্যাংকের বুথ চোখ, পথের পাশে ভাঙা দেয়ালও একজোড়া চোখ। তাকিয়ে আছে তার দিকে। যতই এগিয়ে যাচ্ছে, ততই চোখের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছেই। বড় ভয়ঙ্কর সে চোখের দৃষ্টি। অসহ্য। হাঁটতে হাঁটতে এবার দৌড়াতে শুরু করলো মামুন। যেভাবেই হোক চোখের আড়ালে তাকে যেতেই হবে।