সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য, কোর্স-ডিসকোর্স, মিল-অমিল, হীত-বিপরীত। একটা সাদা কাগজে আমি প্রায় এইসব অহেতুক শব্দ একের পর এক লিখতে থাকি। মনে হয়, আমার যেন একটু একটু আরাম লাগলো। মনে হয় শরীরটা পালকের মতো হালকা হয়ে উঠেছে। কিন্তু আপাতত আর কোনো অর্থহীন শব্দ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। কী হতে পারে, এই কথা ভাবতে ভাবতেই অপারগতার ব্যর্থতায় প্রচণ্ড রাগ লাগছে। যেন নিজের মস্তিষ্ককেই হুমকি দিচ্ছি, কী হতে পারে বলো, নইলে খুন করবো।
মস্তিস্কও আমাকে যেন উল্টো কথা শোনায়। বলে, আসলে তুমি কিছু লিখছ না। এই সাত সকালে মেস বাড়িটার মেঝেতে বসে আপন মনে সেদ্ধ আলুর খোসা ছাড়াচ্ছ। কাঁচামরিচ আর পেঁয়াজ কাটা আছে, একটু পরে আলুভর্তা হবে। লেখার খাতা ভেবে তুমি এটাই বলতে চাইছো, আলু যদি হয় কোর্স, তাহলে কাঁচামরিচ আর পেঁয়াজ কেনো ডিসকোর্স হতে পারে না। কী এসব বাকোয়াজ কথাবার্তা। আমি এই মেসে থাকি ঠিকই, কিন্তু এখন আলুভর্তা বানাচ্ছি না বরং সত্যিই লিখছিলাম। এই মুহূর্তে ঘরে কেউ নেই। আমার পাশে দুটি সিটের সবাই যার যার কাজে গেছে। আমার তো কোনো কাজ নেই, তাই বসেছি লিখতে। না কি ভুল ভাবছি, আসলে ভর্তা করতেই বসেছিলাম। গত রাতের ঠাণ্ডা ভাতের সঙ্গে আলু ভর্তা দিয়ে নাস্তা হবে। অথচ আলু চটকানো বাদ দিয়ে এখন লেখার চিন্তা করছি। অহেতুক শব্দ, অহেতুক ভাবনা। দেখে অজান্তেই আমি খাতায় বিরাট করে লিখেছি, মানুষ কেন খুন করে? আইনি আর ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা, সাংস্কৃতিক হস্তক্ষেপ, প্রতিশোধের ঝুঁকি এবং খাঁচাতে জীবন কাটানোর হুমকি সত্ত্বেও প্রতিদিন পৃথিবীতে না জানি কত শত মানুষ খুন হয়। অথচ মানুষ হত্যার অপরাধের মতো এই জাগতিক সমাজে বড় কোনো অপরাধ নেই। তবু, প্রতিটি সংস্কৃতির মানুষ কখনো না কখনো অন্যকে হত্যার আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে। আমি যেমন করেছি আমার যমজ বোনটিকে। হঠাৎ আমার মনে হচ্ছে সুগন্ধাকে খুন করলে কেমন হয়।
ও থাকে নাখালপাড়ায় একটা ছাত্রী হেস্টেলে। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর চমৎকার এক মেয়ে। ইদানিং মনে হয় প্রেম-ট্রেমও করছে। আমার সঙ্গে দেখা হতে না হতেই কেমন যাই যাই ভাব করে। তখন ওর চোখে কেমন একটা চোর চোর ভঙ্গি ফুটে ওঠে। দেখতে বেশ মজাই লাগে। আমরা যমজ হলেও আমাদের মধ্যে চেহারার মিল সামান্য। তবু লোকে কিভাবে যেন ধরে ফেলে আমরা যমজ। সেদিন নাখালপাড়া থেকে ওকে নিয়ে খেতে গেছি ফার্মগেটে। খাওয়া বাদ দিয়ে সুগন্ধা আমাকে বললো, দাদা চল তোকে একটা জিনিস দেখাই। আমরা গেলাম ওভার ব্রিজটাতে। এই দুপুরবেলাতেও ব্রিজটাতে কতরকম যে মানুষের ভিড়। কত রকম হকার কতকিছু বিক্রি করছে। লাল-নীল জাঙ্গিয়া থেকে শুরু করে মানিব্যাগ, লেবু, প্লাস্টিকের বোতল, মোবাইল সিম, আল্ট্রা কমফোর্ট উইংসের স্যানিটারি প্যাড পর্যন্ত। তবু ভিড় ঠেলে আমরা খানিকটা রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। সুগন্ধা আমাকে নিচে দেখালো। দাদা ওই দেখ, রাস্তার দুই পাশে কেমন সারিবদ্ধভাবে বাস, গাড়ি চলছে। মনে হয় চমৎকার একটা সিরিজ, না?
তোকে যদি এখান থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেই, এই যে এত এত মানুষ সবাই নিশ্চই চমকে যাবে। আহা, ধাক্কা দিচ্ছি বললেই তো আর করে ফেলছি না। সুতরাং চোখ-মুখ কালো করার কিছু নেই। শুধু কল্পনা কর, দেখবি মাথার মধ্যে অন্যরকম একটা রোমাঞ্চ খেলে যাবে। রাতে চোখ বন্ধ করলে আমি মাঝে মাঝেই এমন খেলা খেলি। মনে কর, তোকে আমি এখান থেকে ধাক্কা দিলাম। তোর শরীরটা একটা পালকের মতো ভাসতে ভাসতে নামছে নিচের দিকে। হয়তো এক সেকেন্ডেরও কম সময়, কিন্তু তুই এর মধ্যেই চিন্তা করে ফেলেছিস আমাদের ছোটবেলার কথা। সেই ছোঁয়াছুঁয়ি, বরফপানি আর চোর-পুলিশ। কিংবা ওই রাতের কথা, মা ঘুমাচ্ছে আর তুই আমি ভাবছি বালিশটা দিয়ে মার মুখ শক্ত করে চেপে ধরবো কি না। আরে নিজের মা তো না, সৎ মা। নিজেদের মা তো আমাদের জন্ম দিতে গিয়েই আজীবনের জন্য ফেরার হয়েছে। না বালিশ চাপা দিতে হয়নি, তারচেয়ে ঘরে যেই আগুনটা লেগেছিল বাপরে বাপ। মনে কর ভাসতে ভাসতে তুই চলেছিস নিচে। একসময় তোর মাথাটা গিয়ে পড়লো রাস্তার পিচের ওপর, এরপর শরীরটা। ঠিক তখন চলন্ত একটা বাস ব্রেক করতে পারছিল না। তার সামনের চাকা উঠে গেল তোর মাথার ওপর দিয়ে। ব্যস, থ্যাপ করে একটা শব্দ হলো, আর তোর ২৫ বছরের সব স্মৃতি কেবল একতাল মগজ হয়ে ছিটে গিয়ে পড়লো পাশের ড্রেনে। মেয়েটা মাঝে মাঝেই এমন সব উদ্ভট চিন্তা নিয়ে আমার কাছে হাজির হয়। আচ্ছা তুই কি এসব খাপছাড়া জিনিস ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা করতে পারিস না? খুব দ্রুত তোর পরীক্ষা শুরু হবে, তুই বরং পড়াশুনায় মন দে।
অনেকেই আমাকে বিকারগ্রস্থ বলতেই পারে, কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। আমার চেহারায় কি কোথাও খুনির ছাপ আছে?
সুগন্ধা হাসে, বলে, চাতক সাহেব, আমার এই বেখাপ্পা চিন্তার বীজ যে আপনিও অহর্নিশ নিজের মানসজমিনে বুনে চলেছেন, তা আমাকে না বললেও চলবে। আমরা কিন্তু যমজ। সুগন্ধার কথা শুনে আমার মাথা কেমন ঝিমঝিম করে। ব্রিজ থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি, রাস্তার দুই পাশের গাড়িগুলো যেন উল্টো চলছে। আবার ব্রিজে যাতায়াত করা মানুষগুলোও যেন সামনে চলছে না। ওরা সবাই হাঁটছে উল্টো দিকে, প্রত্যেকের মুখেই কেমন একটা রহস্যময় হাসি।
নাকি সুগন্ধা আমাকে এসব কিছুই বলেনি, এসব আমার নিছক কল্পনা। অহেতুক সুন্দর প্রাণচঞ্চল একটা মেয়েকে নিয়ে আমি মনে মনে বিভৎস গল্প ফেঁদেছি। হোক না আমার যমজ বোন, এসব শুনলে নিশ্চই ওর ভালো লাগবে না। যাই হোক, আমি কী যেন করছিলাম, লিখছিলাম অথবা খোসা ছাড়াচ্ছিলাম সেদ্ধ আলুর। আসলে কোনটা সত্যি, নিজেই বুঝতে পারছি না। গতরাতে খানিকটা মদ খেয়েছিলাম, ঘুমটাও তেমন ভালো হয়নি। এ তারই ফল হতে পারে। সেটা যাই হোক, কিছু করছি এটাই সত্য। রাত শেষে এখন দিন এসেছে, দিন শেষে আবার দুপুর হবে। আর দুপুরের পর আমাকে ছুটতে হবে অফিসে।
এসব বাদ দিয়ে আপাতত আরও কিছু অহেতুক শব্দ লেখা যাক। না না, মানুষ কেন খুন করে তেমন বাক্যও হতে পারে। আবার অপরাধবিজ্ঞানের জনক সিজার লেমব্রোসোর তত্ত্ব নিয়েও খানিকটা ভাবা যায়। দেখা যাবে হয়তো আমি আলুভর্তা করছি, কিন্তু মনে মনে লিখতে লিখতে ভাবছি মানুষ খুনের কথা। সেটা সুগন্ধা হতে পারে, আবার অন্য যে কেউ। এই তো সেদিন রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখি ফুটপাতে ছোট্ট একটা বিড়ালের বাচ্চা মিউ মিউ করছে। কী যে মায়া লাগলো আমার। ওটাকে কোলে করে বাসার সামনে নিয়ে এলাম। অন্য রুমমেটরা না থাকলে হয়তো ঘরেও নিয়ে যেতাম। বিড়ালটার জন্য দোকান থেকে খানিকটা দুধ কিনে নেই। কী সুন্দর চুকচুক করে বাচ্চা বিড়ালটা দুধ খেয়েছিল যে দেখতেই ভালো লাগে। এরপর বিড়ালটাকে কোলে নিতেই আমার মাথায় অন্যরকম এক ভাবনা খেলে যায়। মনে হয়, ওকে আজীবনের জন্য একেবারে ব্যক্তিগত করে রেখে দিলে কেমন হয়? ঠিক যেমন আমার পছন্দের মেয়েটিকে রেখেছিলাম। কেউ বুঝতে পারেনি, কেউ টের পায়নি আজ পর্যন্ত সেই মেয়েটির সঙ্গে কী হয়েছিল। গুগলে চাইলেই সার্চ করা যায়, হাউ টু কিল সামওয়ান এন ইউনিক ওয়ে। এই বিড়ালটির ভাগ্যেও তেমনটাই ঘটতে পারে। কারণ ওকে আমি পছন্দ করে ফেলেছিলাম। একটা বিড়াল মারা গেলে কার কী যায় আসে। কেউ ওর মৃত্যুর কারণ খোঁজ করতে যাবে না। আমার তৃপ্তিও হবে, সেইসঙ্গে একটা এক্সপেরিমেন্টও। মনে আছে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বাচ্চা বিড়ালটার ঘাড় মটকে দিয়েছিলাম। হত্যা হয়তো অনেকটা অর্গাজমের মতো। যার আগে দিয়ে তীব্র একটা অজানা উত্তেজনা কাজ করে। আর কাজটা শেষ হয়ে গেলে শরীর জুড়ে নেমে আসে কেমন ক্লান্ত প্রশান্তি।
একটা গান বা কিছু শুনতে ইচ্ছে করছে। অথবা কোন যন্ত্রও বাজানো যেতে পারে। কিন্তু একমাত্র মোবাইলটা ছাড়া অন্য কোন মিউজিক সেট যে আমার কাছে নেই। সমস্যা নেই চোখ বন্ধ করলেই সব চলে আসবে। আচ্ছা এমন একটা যন্ত্রসঙ্গীত কি বাজানো যায়, যার মধ্যে তীব্র বৈপরিত্ব আছে! এরকম একটা অর্কেস্ট্রা হতে পারে না? আমিই সবাইকে লিড দিলাম। চলো মোৎসার্ট ছেড়ে দেই। সিম্ফনি নং ফোর্টি, আহা! লেখা কিংবা আলুভর্তা দুটোই বাদ। আপাতত মোৎসার্টে মন মজাই। শুনতে ভালো লাগছে, ইচ্ছে করছে ঘর জুড়ে একটু নেচে নিতে। যদিও মনে হচ্ছে শুধু মোৎসার্ট নয় আরও কিছু হলে ভালো হতো। আচ্ছা, এর সঙ্গে যদি বেটোফেনের ফর এলিস ছেড়ে দেই। কিংবা মুনলাইট সোনাটা হতে পারে। এক কাজ করা যায়, একসঙ্গে চলুক মোৎসার্ট, বেটোফেন। চমৎকার এই বৈশাদৃশ্যিক কিছু তৈরি হোক। আর সেটা শুনতে শুনতে আমি ভাবি মানুষ খুনের কথা।
সুনামগঞ্জের পাঁচ বছরের শিশু তুহিন মিয়া। রাতে বাবার কোলে ঘুমিয়ে ছিল সে। কিন্তু সকালে দেখা গেল কদমগাছের ডালে ঝুলছে তার নিথর দেহ। দুই কান কাটা, পেটে ঢোকানো দুটি ছুরি। নির্মমতার এখানেই শেষ নয়। শিশুটির যৌনাঙ্গটিও কেটে নেওয়া হয়েছে। দেখা গেল জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে তুহিনকে খুন করেছে তার বাবা আর চাচা। আবার ক’দিন আগেই খিলগাঁয়ে পরকীয়া সম্পর্কের জেরে দুই সন্তানকে গলা কেটে খুন করেছে এক মা। আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় প্রেমিকাকে খুন করে তার মাংস খেয়ে ফেলেছে টমি জো ব্লান্টন নামে এক যুবক। জার্মানিতে রাজনৈতিক নেতা ভাল্টার লুবকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা। প্রতিদিন এমন আরো কত কত খবর যে আমার চোখে পড়ে। না কি আমিই এর শিকার, অন্যদের কাছে এই খবরগুলো চোখ এড়িয়ে যায়। মোৎসার্ট আর বেটোফেনের মিলিত সিম্ফনি তীব্র হয়ে উঠেছে। সেইসঙ্গে আমার মনে হয়, গতকালের পড়া এক ঝাঁক খবর মৌমাছি হয়ে পিনপিন শব্দে আমার চারদিকে ওড়াউড়ি করছে। ঘরে ঢুকে শিশুসন্তানসহ চার জনকে গলা কেটে হত্যা, ডোবায় দুই সন্তানসহ মায়ের লাশ, রাস্তায় দুই যুবককে কুপিয়ে খুন, গৃহবধূকে পুড়িয়ে হত্যা, পাওনা টাকা চাওয়ায় হত্যার পর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের লাশ বিকৃত কিংবা দুই ছেলে মিলে বাবাকে হত্যা, পাহারায় স্ত্রী! উফ চারেদিকে কেমন হত্যার উৎসব।
নাহ এই মিউজিকেও ঠিক পোশাচ্ছে না, তাহলে অন্যকিছু ভাবা যাক। ধরা যাক কোন রবীন্দ্র সঙ্গীতের সঙ্গে নজরুল, হাসন, লালন সব একসঙ্গে চালিয়ে দিলাম। রবীন্দ্রনাথের মেঘের পরে মেঘ জমেছের সঙ্গে মিশে গেল নজরুলের এ ঘোর শ্রাবণ নিশি কাটে কেমনে। সেইসঙ্গে হয়তো মিশিয়ে দিলাম হাসনের মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়ারে কিংবা শাহ আব্দুল করিমের এই দুনিয়া মায়াজালে বান্ধা। সুর, তাল, লয়ের এক বিপুল ভজঘট। এ হচ্ছে মহৎ সঙ্গীতকে হত্যা করার আনন্দ। হত্যা আর হত্যার রাজত্ব।
মাথার ভেতর গান, সুর আর তাল লয়ের এক বিচিত্র ক্যাকাফোনির মধ্যেই আমি যেন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারলাম। আমি সুগন্ধাকে খুন করছি। সুগন্ধা আমার যমজ বোন এবং আমি তাকে কোন নৃশংস উপায়ে খুন করবো। প্রশ্ন আসতে পারে যে, কেনো খুনটা করবো, ওতো কোন দোষ করেনি। নিজের এই প্রশ্নের উত্তর আমার নিজেকেই দিতে হবে। কারণটা হলো ছোট এই বোনটিকে আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালোবাসি। আর কখনো কখনো প্রত্যেকটা মানুষেরই ইচ্ছে করে, তার ভালোবাসার মানুষকে একেবারে মেরে ফেলে। অনেকেই আমাকে বিকারগ্রস্থ বলতেই পারে, কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। আমার চেহারায় কি কোথাও খুনির ছাপ আছে?
লোমব্রোসো বলেছিলেন, যারা অপরাধী বা হত্যাকারী তাদের কান সাধারণ মানুষের চেয়ে লম্বা হয়, নাক বোঁচা হতে পারে। এর অর্থ দাঁড়ায়, বড় কোনো অপরাধী বা হত্যাকারী হুট করে এমনটা হয়ে যায় না। জন্মগতভাবেই তারা হত্যাকারী। তাদের ভেতরে হয়তো এই প্রবৃত্তি সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কোনো কোনো ঘটনায় তা প্রকাশ পায়। আর তখনই ওই ব্যক্তি হত্যাকারী হয়ে ওঠে। আমার ভেতরেও কি সেই মানসিকতা আছে! আমিও কি জন্ম থেকেই হত্যাকারী। হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। লোমব্রোসোর তত্ত্বই সত্য বলে ধরে নিতে হবে কেনো। বরং এই তত্ত্বই মানুষকে হত্যাকারী হয়ে উঠতে প্ররোচণা দিতে পারে। সে রসদ এই তত্ত্বে আছে। সে যাকগে, এখন কথা হলো সুগন্ধাকে আমি কিভাবে খুন করবো। সেটা নিয়েই আলাদা গবেষণা হতে পারে। চাইলে এখন সুগন্ধাকে একটা ফোনও করা যায়।
বিকেলের সেই বিশেষ কথা না হয় বিকেলের জন্যই বিশেষ থাক। আপাতত এখন সকালের একটা কবিতা আওড়ানো যাক।
ওপাশ থেকে দুই একবার রিং হতেই সুগন্ধার পরিচিত কণ্ঠটা শোনা যায়। দাদা, তোকে বলেছি না সকাল সকাল ফোন করবি না। আমি একটু ঘুমাই। আমি ওর এসব কথার কখনোই উত্তর দেই না। বললাম, শোন তোর সঙ্গে একটু দেখা করা জরুরি। আজ কি একটু নীলক্ষেতের দিকে আসতে পারবি? সুগন্ধা বললো, কেনোরে? না কোন কারণ নেই, এমনি। বোন কি একটু সময় ভাইর সঙ্গে ঘুরতে পারে না, তার ওপর শত হলেও যমজ বোন। এবার সুগন্ধা হেসে ফেলে, পারবে না কেনো অবশ্যই পারবে। তার আগে তোকে একটা কথা বলি দাদা শোন। গত রাতে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম। দেখি, কারা যেন তোকে একটা নির্জন ঘরে বন্দি করে রেখেছে। তোর হাত-পা, মুখ বাঁধা। ঘরটায় কোনো আসবাবপত্র নেই। কিন্তু কোথা থেকে যেন বিদঘুটে মিউজিকের শব্দ আসছে। তুই ভয় পেয়েছিস, কোন একটা আতঙ্কে তোর চোখগুলো বড় বড় হয়ে উঠেছে। আতঙ্কটা হলো একটা চকচকে ছুরি। কেউ একজন ঠিক কণ্ঠনালী বরাবর ছুরিটা টান দিতেই ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো। ফোয়ারায় যেমন উপর দিকে জল ছিটে বের হয় অনেকটা তেমন। রক্তে তোর বুকের কাছটা ভিজে গেছে, অথচ চোখটা তখনো খোলা। আমি ওর কথার কোন উত্তর দেই না। শুধু বলি- ছুরিটা কে চালাল তুই? এবার সুগন্ধার কণ্ঠে বিরক্তি। আরে সেটাই তো বুঝতে পারছি না। একবার মনে হয় আমিই ছুরিটা চালিয়েছি, আবার মনে হয় না অন্য কেউ।
শোন আমি এখন ফোন রাখি। বিকেলে নীলক্ষেতে আসিস কিন্তু, তোকে একটা বিশেষ কথা বলবো। সুগন্ধা কেমন অদ্ভুতভাবে হাসে। বলে, দাদা, আমিও তোকে আজ একটা বিশেষ কথা বলবো। জরুরি, খুব জরুরি। আমি ফোন রেখে দেই। সুগন্ধাও তাহলে আজ আমাকে জরুরি কোন বিশেষ কথা বলবে। ভালো, বেশ ভালো। পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এখন আগের কাজে ফিরে যাওয়া যায়। একটা সাদা কাগজে অহেতুক শব্দ লেখা কিংবা ভর্তার জন্য আলু চটকানো। সুগন্ধা মাঝে মাঝেই বলে, দাদা তোর নাম চাতক রাখা একদম ঠিক হয়েছে। একবার এক মুমূর্ষু মা কিশোর ছেলের কাছে জল খেতে চাইলেন। কিন্তু ছেলে মায়ের আকুতি ভুলে খেলায় মেতে রইল। ইতিমধ্যে মা গেলেন মরে আর ছেলে পড়লো অনুশোচনায়। জল জল করে চেঁচিয়ে পাড়াময় ঘুরতে লাগল সে। এমনকী মাকে জল পৌঁছে দিতে ছেলেও বিধাতার কাছে আর্জি জানালো তাকে পরপাড়ে তুলে নেওয়ার। কিংবা সে যাতে উড়ে উড়ে মেঘের কাছে গিয়ে জল চাইতে পারে, সেজন্য তাকে যেন পাখি বানিয়ে দেওয়া হয়।
সৃষ্টিকর্তা ওর আবেদনটা মঞ্জুর করলেন। তাকে ঈশ্বর বানিয়ে দিলেন চাতক পাখি। যে এখনো উড়ে উড়ে মেঘের কাছে জল প্রার্থনা করছে। তুইও অহর্নিশি কিসের দুঃখে যেন মগ্ন থাকিস। কেন বলতো? সুগন্ধার এসব কথার উত্তর দেই না, সব কথার উত্তর দিতে নেই। যদিও ইচ্ছে করলে আমি ওকে পাল্টা প্রশ্ন করতাম, আমি, না হয় ছয় আঙ্গুলের ফেরার, কিন্তু তুই কেনো মৃত্যুর ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিস? জানি না ও উত্তর দিতো কিনা। কোন কোন মানুষ কোন প্রশ্নের উত্তর দেয় না।
যাই হোক খুনটা করার আগে বিকেলে ওকে কোন বিশেষ কথাটা বলা যায় তা এখন ভাবতে হবে। ইচ্ছে করলে খাতায় লিখেও ফেলা যায়। বিশেষ কথার যে আমার অভাব নেই। মৃত্যুর আগে বাবার অবাক দৃষ্টি কিংবা কিশোরী বেলায় ওর পছন্দের মানুষটির শেষ চিৎকার, কিংবা…। বিকেলের সেই বিশেষ কথা না হয় বিকেলের জন্যই বিশেষ থাক। আপাতত এখন সকালের একটা কবিতা আওড়ানো যাক।
গাছের ছায়ার তলে মদ লয়ে কোন ভাঁড় বেঁধেছিল ছড়া!
তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া।
ভুলে গিয়ে রাজ্য জয় সাম্রাজ্যের কথা
অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাকা ছিল
তুলে নেবো তার শীতলতা;
ডেকে নেবো আইবুড়ো পাড়াগাঁর মেয়েদের সব
মাঠের নিস্তেজ রোদে নাচ হবে
শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব।