কলিংবেলের সুইচে চাপ দিতে যাব, তখনই দরোজাটা ফাঁক হয়ে গেলো একটু। আমি সামান্য হকচকিয়ে গেলাম। দরোজার ফাঁকে তিলোত্তমার কাজলটানা মায়াবি চোখ। সেই চোখ দুটো প্রথমে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। তারপর বড় হতে থাকলো। তারপর বড় বড় করে পলক ফেলতে লাগলো। বুঝতে পারলাম তিলোত্তমা আমাকে বোকা বানানোয় অতিশয় আনন্দ পেয়েছে। তারই বহিঃপ্রকাশ এই চোখ পিটপিট।
দরোজাটা বন্ধ করে দিলো তিলোত্তমা।
আমি বাহিরেই রয়ে গেলাম এই ‘স্বর্গসিঁড়ি’র তিনতলায়। আমার সামনে তিলোত্তমার ফ্ল্যাটের দরোজা। আর একটু আগে হারিয়ে যাওয়া মায়াবি দুটি চোখ।
কী করব বুঝতে পারছি না। এ রকম রহস্যের কারণ কী? আমার আসার কথা ছিল এ সময়। সেই-ই তো আসতে বলেছে। কিন্তু আমি তার দরোজার সামনে চলে এসেছি, এটা সে জানল কিভাবে? বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল? কিন্তু আমার তা চোখে পড়লো না কেন? মূল রাস্তা থেকে তার বেলকনি দেখা যায়। মাঝখানে ছোট্ট একটি পুকুর। পুকুরের পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তার প্রথম লেফট-টার্নিং দিয়ে তার স্বর্গসিঁড়ি’র বিল্ডিং-এ যেতে হয়। আমি রিকশা থেকে নেমেই বেলকনির দিকে তাকিয়েছি। কেউ নেই সেখানে কয়েকটি ঝুলন্ত টব ছাড়া। শুধু শেষ বিকেলের নরম রোদ ছড়িয়ে আছে। খুব ছায়া ছায়া। কারণ পশ্চিম পাশে নারিকেল গাছের ঝিরিঝিরি ডাল। সে ডালের ছায়া তো টবের ছোট্ট ছায়াকে ঢেকে দেওয়ারই কথা। সেখানে কেউ ছিল না। রিকশা থেকে নেমে যখন পুকুরের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম, তখনো আমি বেলকনির দিকে তাকিয়েছি। পাইনি তাকে।
মফস্বল শহর হলেও এ বিল্ডিং-এর সিকিউরিটি সিস্টেম খুব শক্তিশালী। আগে যতবার এসেছি, ততবারই রেজিস্ট্রারে এন্ট্রি দিতে হয়েছে। তারপর ইন্টারকমে কথা বলার পরই ভেতরে ঢোকার অনুমতি মিলেছে।
আজ অবশ্য কিছুই করতে হয়নি। এও এক আশ্চর্য বিষয়। সিকিউরিটি সালাম দিয়ে শুদ্ধ উচ্চারণে বললো, ‘স্যার যেতে পারেন। এন্ট্রি করতে হবে না।’
আমি যখন ওপরে উঠছি তখন কি দারোয়ান ইন্টারকমে ম্যাডামকে বলে দিয়েছে আমার আসার কথা? কি জানি!
আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না। তিলোত্তমার ফ্ল্যাটের দরোজার ওপরে তাকালাম। ‘জুয়োতলা’। ভাড়া বাসায় ফ্ল্যাটের আলাদা আলাদা নামকরণের কথা আমি কখনো শুনিনি। তিলোত্তমার বিষয়গুলো ব্যতিক্রম।
প্রথম যেদিন বলল, ‘তুমি আসবে আমার জুয়োতলায়?’ আমি ধন্দে পড়ে গিয়েছিলাম। জুয়োতলা আবার কী? তিলোত্তমা বুঝতে পেরেছিল আমি হাবুডুবু খাচ্ছি। কুলকিনারা করতে পারছি না তার কথার। তখন সে-ই খোলাসা করেছিল বিষয়টি। বলেছিল, ‘আমার বাসার নাম জুয়োতলা।’
আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। বলেছিলাম, ‘বাসার নাম কখনো জুয়োতলা হতে পারে!’
তিলোত্তমা রিনিঝিনি হাসির ছন্দ তুলে বলেছিল, ‘কেন হতে পারে না। পৃথিবীতে আরও কত কিছু হয়!’
‘তাহলে তুমি বলো কেন হতে পারে এ রকম একটি নাম। আরও বলো পৃথিবীতে আর কী কী হয়?’
তিলোত্তমার হাসির ঢেউ তখন সারাদেহে ছড়িয়ে পড়েছিল। হালকা গড়নের তিলোত্তমাকে তখন মনে হচ্ছিল এক টুকরো সমুদ্র। সাদা কামিজের ওপর নীল ওড়না ছিল নিছক বাহুল্য হয়ে। তুমুল বেয়াড়া সেই ওড়নাকে একটুও সামলানোর চেষ্টা করেনি তিলোত্তমা। তার টানটান ভারি বুকের ঢেউ যখন আমার চোখের নীলে বিম্ব তৈরি করছিল, তখন মনে হয়েছিল তিলোত্তমার ভেতরে বয়ে যাচ্ছে এক নিরুপম সুনামি। সেই সুনামির ঢেউ যেকোনো মুহূর্তে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
বলব অন্য সময়।
কোন সময়?
কোনো এক সন্ধ্যায়।
আমি চোখ কপালে তুলে বলেছিলাম, কোনো এক সন্ধ্যায় কেন!
তিলোত্তমার হাসির ঢেউ তখন আরও আছড়ে পড়তে শুরু করেছিল। সেই ঢেউ আমার খুব বিপজ্জনক নিকটে এসে বলেছিল, কোনো এক গভীর রাতে তোমাকে ফোন করে জুয়োতলায় যেতে বলব। পরের দিনে তুমি ঠিক মাঝ বিকেলে আমার কাছে যাবে। কেউ থাকবে না বাসায়। সে-দিন আমি শোনাব জুয়োতলার গল্প। তুমি শোনাবে তোমার ঘড়ির গল্প।
আবার ঘড়ির গল্প! ঘড়ির আবার গল্প কী? আমার ঘড়ির কোনো গল্প নেই। আমার ঘড়ি একটি সাধারণ ঘড়ি।
তিলোত্তমা চলে যাচ্ছিল। কিছু দূর গিয়ে ফিরে এসেছিল। ফিরে আসতে আসতে এতটাই কাছে এসেছিল যে আমি তার নিঃশ্বাসের গন্ধটাও পাচ্ছিলাম। আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল। তিলোত্তমা কি তার অধর দিয়ে আমার অধর ছুঁয়ে দেবে আজ!
না। তিলোত্তমা তা করল না ঠিক। কিন্তু তর্জনিটা আমার অধরে ছুঁয়ে দিলো। মুখটা আরও কাছে এনে ফিসফিস করে বললো, তার আগে এটা নিয়ে আর কোনো কথা নয়।
কথাটি শেষ করে ফেরার সময় এতটাই কাছে এলো যে তার ভারী বুকের শীর্ষতম অংশ আমার বুকের সঙ্গে চকিত ছুঁয়ে গেল। এমন গভীর কোমলতার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না কখনো। এমন সুবাসের সঙ্গেও। এই কোমলতা এবং ঘ্রাণে আমি সবকিছু ভুলে গেলাম।
দুই.
হাত ঘড়িটার দিকে তাকালাম। অর্থহীন এ তাকানো। আমি তো জানিই ঘড়িটা বন্ধ হয়ে আছে বহুদিন। তবু আমি ঘড়িটা পরি। সময় দেখার কাজটা তো মোবাইল ফোনই করে দিচ্ছে। মোবাইল ফোন এসে তো হাতঘড়ির উপযোগিতা কমিয়ে দিয়েছে মারাত্মকভাবে। অল্প কিছু সৌখিন মানুষ এখন এটা ব্যবহার করে। আমি সে-ধরনের মানুষ নই।
তবু কেন যে ঘড়িটার দিকে তাকালাম! সময় দেখার ইচ্ছেও আমার নেই। তিলোত্তমার কাছে এলে আমার সকল সময়কে আমি ছুটি দিয়েই আসি।
আরেকবার আমার বন্ধ হয়ে যাওয়া হাতঘড়িটার দিকে তাকাতেই দরোজাটা খুলে গেলো আগের মতো করে। ওপারে তিলোত্তমার কাজলপরা মায়াবি চোখ। সেখানে আনন্দের ঝিলিক। আমার বিব্রতকর মুখ।
না, তিলোত্তমা আমাকে আর বিব্রত করল না। দরোজাটা আরেকটু ফাঁক করে বললো, ভেতরে এসো। তখন লক্ষ করলাম কড়া লাল লিপস্টিক (ওষ্ঠ রঞ্জনী)র ভেতরে হারিয়ে গেছে তার গোলাপি কমলালেবু। এই হারানোর ভেতর থেকে এমন কিছু জেগে উঠেছে যা আবিষ্ঠ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ। যা মাতাল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ।
ভেতরে ঢোকার অনুমতি পেয়ে আমি দরোজার হাতলে হাত রেখেছি যাওয়ার রাস্তাটি আরও প্রশস্ত করব বলে। তিলোত্তমা ভেতরে থেকে আগের মতোই বলল, না, না, আর ফাঁক করা যাবে না। এটুকুর ভেতর দিয়েই ঢুকতে হবে।
আমি আরও বিব্রত বোধ করলাম। ভেতরে ভেতরে রেগেও যাচ্ছি বোধ হয়। কিন্তু তিলোত্তমা আমাকে এমনভাবে আবিষ্ট করেছে যে এখান থেকে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছেশক্তিও আমার নেই। এমন মাতাল করা ঠোঁট থেকে ভেতরে যাওয়ার আহ্বান আর পাগল করা চোখ থেকে ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারা! তার ওপর ‘জুয়োতলা’ নামের গোপন গল্প উন্মোচনের এই ক্ষণকে কিভাবে আমি উপেক্ষা করি!
অগত্যা ওই অপর্যাপ্ত জায়গার ভেতর দিয়েই আমি ভেতরে ঢোকার জন্য উদ্যত হলাম। অন্য কোনো চেষ্টা না করেই। জায়গাটা অপর্যাপ্ত মনে হলেও ঢুকতে কোনো অসুবিধা হলো না আমার।
তিলোত্তমা দরোজা আটকে দিলো। এবার আমি তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকালাম। তার দীর্ঘ আঁখি পল্লবের নিচে পৃথিবীর সবচেয়ে গোপন নিরাপদ ছায়া। সেখানে আমারই প্রতিবিম্ব খেলা করছে। যখন পলক ফেলছে তখন একটা হালকা তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে। ওই তরঙ্গ পাড়ে এসে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আরেক পলক। এ তরঙ্গের খেলা তো শেষ হওয়ার নয়। তিলোত্তমা আজ জিনস পরেছে। সঙ্গে ভেরি মাচ শর্ট অ্যান্ড লো কাট লাল টি শার্ট। তিলোত্তমাকে আগে কখনো এই গেটআপে দেখিনি। অফিসে কিংবা বাইরে তাকে সালোয়ার কামিজ বা বড়জোর শাড়িতে দেখেছি। তাতেই তাকে অপ্সরীর মতো লেগেছিল। এখন এমন শর্ট ড্রেসে তাকে দেখব ভাবিনি। এমনকি সে ওড়না পর্যন্ত পরেনি। তার সুঢৌল বুকের অর্ধেক উচ্চতার অনাবৃত অংশ দেখা যাচ্ছে অনায়াসেই। তার পীনোন্নত বুকের দিকে মুহূর্তে তাকিয়ে যেই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি, তখনই তার লাল ঠোঁট দু’টি নড়ে উঠল, তুমি তো ভেবেছিলে এই দরোজার ফাঁকটুকু পর্যাপ্ত নয়। তাই না? কিন্তু দেখো জায়গাটা পর্যাপ্তই ছিল। ঢুকতে তোমার একটুও সমস্যা হলো না। তাই না?
ঠিক ধরেছো। আমি এটাই ভেবেছিলাম।
আমার কথা শেষই হয়নি। তিলোত্তমা এবার লক্ষ কোটি কাঁচের টুকরো ভেঙে পড়ার মতো শব্দ করে হাসতে লাগলো। কোনো মানুষের ঠোঁটটুকুই হাসতে পারে। কারও কারও চোখও হাসে, কারও কারও গালও হাসে। আজ আমি দেখলাম তিলোত্তমার সারা শরীরই হাসতে জানে। সেই হাসির ঢেউ সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই মনোহর, গর্জন মুখর, শব্দ-প্লাবি। সেই হাসির ঢেউ গভীরে লীন করে দেওয়ার নোনা-আহ্বান। আমি আবারও অনুভব করলাম তিলোত্তমার ভেতরে রয়েছে এক নিরুপম সুনামি। ওই সুনামির প্রভাব বড়ই মনোহর। আমি সেই সৌভাগ্যবান ওই মনোরোম মনোহর সুনামির সঙ্গে একাত্ম হতে পারছি।
তবে আজকের ঢেউ সে-দিনের মতো নীল-ঢেউ নয়। রক্তপ্লাবি লাল লাল। লাল লাল ঢেউয়ের ওপরে যমজ চাঁদের জোসনা।
কিন্তু তিলোত্তমা এভাবে হাসছে কেন, তা ভেবে পাচ্ছি না।
তিলোত্তমার মুখের হাসি থামলো একটু। চোখের হাসি তখনো থামেনি। তুমি এত বোকা কেন? বলো তো! ওই জায়গা তো ভেতরে ঢোকার জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। আমিই জায়গা করে দিলাম। তুমি তা টেরই পেলে না? মন কোথায় থাকে গো!
আমি বিস্মিত। বলে কি মেয়ে! তিলোত্তমা বলল, তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না তাই আমি একটা কাজ করেছি। আমি দরোজায় হাত দিয়ে রেখেছিলাম। আঙুলে ছিল ওষ্ঠ রঞ্জনী। দরোজা আরেকটু ফাঁক করার সময় সেই দাগ লেগে গেল তোমার টি শার্টে।
আমি টি শার্টে ওষ্ঠ রঞ্জনীর দাগ খুঁজতে ব্যাকুল হয়ে উঠলাম। তিলোত্তমা আঙুল দিয়ে লাল দাগটি দেখালো। তাই তো! আমার টি শার্টের ডান পাঁজরে হলুদ স্ট্রাইপের ওপর সে-দাগ জ্বলজ্বল করছে।
তিলোত্তমা বোধ হয় বুঝতে পারল আমি শুরু থেকে এক ধরনের অন্যরকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বিব্রত হচ্ছি। বোকা বনে যাচ্ছি। তিলোত্তমা এবার ডানদিকে ঘাড় কাত করল একটু। তার চোখের হাসি নিভে যেতে থাকলো। ঘাড় ডানদিকে আরেকটু কাত করে অনুচ্চ কণ্ঠে বললো, স্যরি।
আমি জানি এভাবে সে তিনবার স্যরি বলবে। প্রতিবার স্যরি বলার সময় কণ্ঠস্বর অপেক্ষাকৃত অনুচ্চ হতে থাকবে। সেই অনুচ্চ স্যরির ভেতরে এক ধরনের মিনতি থাকবে। ওই মিনতি খুব করুণ। তৃতীয়বারের মতো স্যরি বলার পর থাকবে কিছুক্ষণ নীরবতা।
ওই নীরবতাকে খুব ভয় করি আমি। খুব ভয়ঙ্কর লাগে আমার কাছে ওই নীরবতা। তার আগেই সব অভিমান জল হয়ে যায়। তখন আমাকে কিছু একটা বলতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমি কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে কবিতার দু’এক চরণ বলি। আজ বললাম, ‘কারো জন্য কোনো কিছু নয়/ তোমার জন্য সব/ তোমার জন্য রেখে গেলাম/ পাখির কলরব’
এটুকু কথাই যথেষ্ঠ। তিলোত্তমা এবার তিলোত্তমার ভেতরে ফিরে এলো। তার দুষ্টুমি উধাও। তার করুণ চাহনি উধাও। আমাকে হাত ধরে সোফায় বসিয়ে দিলো। বললো, তুমি একটু বোসো। আমি আসছি।
তিলোত্তমা চলে গেলো ভেতরে। মুগ্ধ হয়ে আমি তার চলে যাওয়া দেখি। মানুষের হাঁটাও এত সুন্দর হয়। এত ছন্দ থাকে! এত কলাময় হয়! আজকের হাঁটাটাও আমার কাছে নতুন মনে হলো। কারণ জিনস পরে হাঁটলে কেমন লাগে তিলোত্তমাকে, আগে তা কখনো দেখা হয়নি। আজ হলো। লম্বা কাঠির মতো পা। মানানসই উরু। সুষম নিতম্ব। সেখানে মাংসের মসৃণ পলি বুঝা যাচ্ছে। বাহুল্য মেদ নেই। আমি তার চলে যাওয়া দেখি অনেকক্ষণ ধরে। কারণ এ তো হাঁটা নয়। এক মুগ্ধকর ছন্দের ঢেউ।
বিশাল ড্রইং রুম। একদিকে দামি পর্দা ঝোলানো। এটাই অন্দর-বাইরের বিভাজক হিসেবে কাজ করছে। তিলোত্তমা যখন গেলো বিভাজক পর্দা সরিয়ে ডোরবেলের টুংটাং শব্দ ভেসে এলো। এই সুবাসিত নীরবতার ভেতরে ওই শব্দগুলো গানের কলির মতো মনে হলো আমার কাছে। বিশাল টিভি। টিভির পাশে তিলোত্তমার বিশাল আবক্ষ ছবি। দেয়ালে আরেকটা বাঁধাই করা ছবি। সমুদ্র স্নান-এর পোশাক পরা তিলোত্তমা গভীর সমুদ্রের দিকে দৌড়াতে উদ্যত। তার সামনে বিলীয়মান ঢেউ। রুম কর্নারে বিচিত্র সব শো পিস। যতই দেখি ততই চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
বাতাসে ছন্দ-সুবাসের ঢেউ তুলে তিলোত্তমা ছুটে এলো। বিভাজক পর্দাগুলো তখনো দুলছে, ডোরবেলের শব্দগুলো তখনো বেজে চলছে টুংটাং। সোফার ওপর তিলোত্তমা ধপাস করে বসে পড়লো। পৃথিবীটাই যেন দুলে উঠলো আমার চোখের সামনে। আমি কিছু বলার আগেই তিলোত্তমা বলল, স্যরি, তোমাকে বসিয়ে রেখে আমাকে যেতে হলো। বেবিকে ফিড করালাম একটু। এখন ঘুমিয়ে। তুমি আরেকটু বসো আমি আসছি। স্যরি এগেইন।
তিলোত্তমা টিভির রিমোটে হাত রাখলো। তুমি টিভি দেখো, বলে রিমোটের একটা বাটনে চাপ দিয়ে আমার হাতে দিয়ে উঠে পড়লো সে। রিমোটটা হাতে নিয়ে আমি টিভি নয় তিলোত্তমার চলে যাওয়া দেখি। তার টি শার্ট কোমর থেকে উঠে গেছে বেশ ওপরে। নদীর এমন বাঁক আমি কোনোদিন দেখিনি। এমন বাঁকে পৃথিবীর সব জল খরস্রোতা হয়ে ঘূর্ণি খেতে পারে। তিলোত্তমার হাঁটার ছন্দ ওই জলগুলোকে ছলকে ছলকে দিচ্ছে যেন।
বিভাজক পর্দার সামনে গিয়ে তিলোত্তমা হঠাৎ থেমে পেছনে আমার দিকে তাকালো। সে বোধ হয় জানতো আমি টিভি নয় তার চলে যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে থাকবো। তিলোত্তমা একটা স্মিত হাসি দিয়ে ভেতরে হারিয়ে গেল। আমি আলো আঁধারির এই খেলাময় পরিবেশে খানিকটা দূরত্বে থেকে সে-হাসির সামান্যটুকুই দেখতে পেলাম। এই দৃশ্যটা বারবার আমার চোখে ভাসতে লাগলো। আমি কল্পনা করতে থাকলাম তিলোত্তমা ওই স্মিত হাসির একটু নয় পুরোটায় আমার জন্য ঢেলে দিয়েছে। ওই স্মিত হাসি আমাকে বলে দিচ্ছে ইঙ্গিতময় অনেক কিছু।
কিন্তু তিলোত্তমা তো ওখানে নেই। চলে গেছে বিভাজক পর্দার ওপারে। বাধ্য হয়ে আমি টিভির স্ক্রিনে চোখ রাখি। ভারতিয় একটা মিউজিক চ্যানেল চলছে। কাজল ও আমির খানের গান। স্ক্রলে ভেসে উঠল সিনেমা: ফানাহ। কাজল বৃষ্টিতে ভিজছে। আমির খান খুব ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। আমার চোখে কোনো কিছুই লাগছে না। আমার মনটা তিলোত্তমার দিকে। একটু আগে তিলোত্তমা বললো ও বেবিকে ফিড করালো। কী ফিড করালো? ন্যাচারাল ফিড? না-কি আর্টিফিশিয়াল?
আমার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। উফ! একটা টেক্সট। নেট বিষয়ক। যত্তসব।
আবার টুংটাং শব্দ। আমি ফিরে তাকাই বিভাজক পর্দার দিকে। তিলোত্তমা আসছে। তার দুটি হাত ট্রলির হাতলে। একটু ঝুঁকে খাবারের ট্রলিটা ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসছে সে।
সোফায় বসে ট্রেগুলো নামালো তিলোত্তমা। রূপচাঁদা মাছের আকৃতির একটি বেশ বড় ট্রে। কমলালেবুর কোষগুলো এলোমেলো করে সাজানো সেখানে। দ্বিতীয় ট্রেটা বেশ অদ্ভুত। একটি ঘোড়ার দুটি পাখার ওপর গোলাকৃতি প্লেট। প্লেটের পরিধি জুড়ে অসংখ্য ছোট ছোট ঘোড়ার মূর্তি। আমি অবাক হয়ে গেলাম এই ট্রেতে মাত্র দুটি আইটেম। একটা সামুচা আর একটা রোল। ঘোড়ার গায়ে হেলান দিয়ে আছে সামুচা। তার গোড়া বরাবর শুয়ে আছে রোল।
তিলোত্তমা বেশ আয়েশ করে বসলো। টিভিতে এখন গুনাহ সিনেমার গান চলছে। বিপাশা বসুর লিপ নড়ছে। আমি কিছু শুনছি না। রিমোট নিয়ে টিভিটা অফ করে দিলাম। তিলোত্তমা ঘাড় একটু কাত করে আমার চোখে গভীরভাবে চোখ রেখে বললো, আমি যা অন করি, তুমি তা অফ করো?
আমি বললাম, না, তুমি যা অন করো, আমি তা আরও অন করি।
তিলোত্তমা কমলালেবুর দিকে আঙুল দিয়ে খাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করে। আমি একটি কোয়া হাত দিয়ে তুলতে যাব, তখনই তিলোত্তমা উঠে এসে আমার হাত ধরে থামিয়ে দিলো।
বোকা ছেলে। কিচ্ছু বোঝে না। তুমি এটা কী করছ?
আমি বোধহয় আরও বোকা হয়ে তার দিকে তাকালাম। তিলোত্তমা বললো, আগে ভালো করে দেখো এটা কী?
আমি ভালো করে দেখলাম। আরে এটা তো কোনো রমণীর মুখ। তিলোত্তমা কমলালেবুর কোয়া দিয়ে রমনীর মুখ বানিয়েছে আর আমি কি-না ভেবেছিলাম এলোমেলো। আমি তিলোত্তমার মুখের দিকে তাকালাম। তিলোত্তমা বুঝে ফেললো যে আমি বুঝেছি। এই মুখটা কার বলতে পারবে?
আমি বললাম, তোমার।
তিলোত্তমার মুখটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তাহলে শুরু করো।
আমি তিলোত্তমার চোখের দিকে তাকিয়ে কমলালেবুর কোয়া দিয়ে বানানো রমণীর নিচের ঠোটটি আঙুলে তুলে নিলাম। তিলোত্তমা আমার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সেখানে গেল। তারপর ওপরের ঠোঁটটি তর্জনি এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে হাতে নিলো। আমরা এখন আমাদের চোখের দিকে তাকালাম। তাকিয়েই থাকলাম। তারপর নিঃশব্দে কারও কোনো নির্দেশনা ছাড়াই মুখের ভেতরে চালান করে দিলাম।
তিলোত্তমা আমার পাশ থেকে উঠে বিপরীত দিকে বসলো। আমি রোলটা তুলে নিতে যাব তখনই আবার বাঁধা দিলো তিলোত্তমা। না, এটা তোমার নয়। এটা আমার। তোমার জন্য সামুচা।
আমি সামুচা তুলে নিলাম। তিলোত্তমা রোল তুলে নিলো। বলল, সামুচা খেতে হয় আস্তে আস্তে। আশ্চর্য চকোলেটের মতো। নিমিষেই গলাধকরণ মানায় না।
আমি নিশ্চুপ। তিলোত্তমা রোলের মাথায় কামড় দিলো না। কিছু অংশ একেবারে মুখের ভেতরে নিয়ে নিলো। এবং বের করে ফেলল। তারপর আবার রিনিঝিনি শব্দ করে ঢেউ তুলে হাসতে লাগলো। হাসি একটু থামিয়ে রোলটি আবার মুখের ভেতর নিয়ে আইসক্রিমের মতো করে চুষতে লাগলো। একটু পরপর একটু করে কামড় দিয়ে খেতে লাগলো।
আমার ফোনটা বেজে উঠল। সেটা হাতে নিলাম। আসলে চার্জ শেষ। অফ হয়ে যাচ্ছে। তিলোত্তমা সেটা বুঝতে পারল। বললো, মোবাইল বন্ধ হয়ে গেল? সময় দেখবে কী করে এখন?
আমি বললাম, সময় দেখব না।
কেন?
আমি সময় দেখি না।
এ জন্য কি বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘড়ি পরো তুমি? আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না। তুমি বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘড়িতে কী দেখো? তুমি যখন দরোজার ওপারে ছিলে তখন দুই বার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়েছো। কেন? ওই ঘড়িতো ক’বছর ধরেই বন্ধ। তুমিই বলেছিলে।
এমনি তাকাই।
তিলোত্তমা একটু গম্ভীর হয়ে গেলো বোধহয়। আমার পাশে এসে চোখ স্থির করে থুতনিতে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, আজ তুমি এটা বলবে। অবশ্যই বলবে। বলতেই হবে।
তিলোত্তমা সম্বিত ফিরে পাওয়ার মতো করে সচেতন হলো। বেবি জাগা পেয়েছে। এসো আমার বেবিকে দেখবে।
আমি তিলোত্তমার পেছনে পেছনে যাই। তিলোত্তমার জিনস্ আরও নিম্নমুখী হয়েছে। হালকা ঢেউয়ের মতো একটা বালিয়াড়ি দেখা যাচ্ছে। বিভাজক পর্দা ঠেলে আমরা ঢুকে পড়ি তিলোত্তমার অন্দরে। নীলান্ত নীল বিছানার চাদরে তিন-সাড়ে তিন বছরের এক ফুটফুটে কন্যাশিশু ঘুমুচ্ছে। মুখের ওপর এক অপার্থিব আলো এসে পড়েছে। যেন দেবশিশু। আমার বুকের ভেতরটা খুব হাহাকার করে উঠল। ইশ! এরকম একটা মেয়ে যদি আমার থাকতো। কিংবা এ মেয়েটাই যদি আমার হতো!
তিলোত্তমা বিছানায় আস্তে করে বসল। আমাকেও বসার জন্য ইশারা করলো। তখনই আমার নজরে এলো মা-মেয়ের একই রকম ড্রেস। তিলোত্তমার লাল টি-শার্টের দিকে তাকিয়েছিলাম। হঠাৎ চোখ চলে গিয়েছিল তার সু-উচ্চ বাম বুকের নীলাভ তিলের ওপর।
তিলোত্তমা স্মিত একটা হাসি দিলো। যার অর্থ অনেক কিছু। বললো, অরু খুব জেদ করত। একদিন আবিষ্কার করলাম ওর ড্রেস এবং আমার ড্রেস একই কালার হলে ও জেদ করে না। সেই থেকে আমরা একই ড্রেস পরি। বিশেষ করে ঘুম থেকে উঠে যদি দেখে আমার অন্য ড্রেস তাহলে তো কথাই নেই। আমার বাবা বলে অরু তো আসলে অরু নয়। অরু হচ্ছে তুইই। তোর ছোট্টবেলা।
অরুর ঠোঁট বেঁকে উঠলো এবার। মনে হয় জেগে যাবে। তিলোত্তমা তড়িঘড়ি শুয়ে পড়ে টি-শার্ট আলগা করতে লাগলো। ব্রেস্ট ফিডিং প্রিপারেশন। আমি বের হতে উদ্যত হলাম। এ রকম পরিস্থিতিতে কি থাকা যায়? তিলোত্তমা ধমক দিয়ে বললো, তুমি কোথায় যাচ্ছ। তুমি কোথাও যাবে না। এখানে বসো।
আমি উল্টো দিকে মুখ করে বসে থাকলাম। কয়েকবার চপ চপ শব্দ হলো। তারপর তিলোত্তমার নড়াচড়া বুঝতে পারলাম। এই অভ্যাসটা এখনো যায়নি অরুর। শি উইল রিমেইন স্লিপিং অনলি আফটার চিউয়িং সেভারেল টাইমস। তিলোত্তমা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমিও দাঁড়ালাম। হাঁটু ভেঙে অরু ঘুমাচ্ছে। তিলোত্তমা বললো, এ মেয়েটা তোমার হতে পারতো না!
আমি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। তিলোত্তমা বলতেই থাকলো, কেন আমাদের আগে দেখা হলো না। কেন ভুল মানুষের সঙ্গে মানুষের দেখা হয়ে যায়! বলতে পারো? কেন মানুষের পাঁচ বছর আগে বিয়ে হয়, কেন দশ বছর আগে দেখা হয় কোনো ভুল মানুষের সঙ্গে? তুমি কোথায় ছিলে তখন?
তিলোত্তমা এবার চিৎকার দেয়, তুমি কোথায় থাকো তখন?
অরু কান্নাসহ জেগে যায় এই চিৎকারে। তিলোত্তমা এবার অরুকে কোলে তুলে নেয়। আমার সামনেই অরুকে আর্টিফিসিয়াল ব্রেস্ট ফিডিং করায়। ধরা গলায় বলে, তুমি একচুলও নড়বে না এখান থেকে।
আমি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকি। অরু ঘুমিয়ে পড়ে আবার। বিছানায় রেখে আমার পাশে এসে দাঁড়ায় তিলোত্তমা। আমার কাঁধে মাথা রাখে। আমার দেখা সমুদ্র কিভাবে নিমিষেই শান্ত স্রোতহীন নদী হয়ে যায়! আমি ভাবতে পারি না। তিলোত্তমা কয়েকবার কেঁপে ওঠে। তারপর বলে, স্যরি। তুমি কি এখনই চলে যাবে? আমার জুয়োতলার গল্প শুনবে না?
আমি বলি, বালক মেঘেরা বালিকাকে পেলে/ কখনো ফেরে না তারা বিকেলে বিকেলে।
তাহলে কখন ফেরে তারা।
তারা কখনো ফেরে না। এই বালক ফিরতে চায় না।
বালক কি সত্যি সত্যি পূর্ণাঙ্গ বালক? না কি না-বালক? তিলোত্তমার চোখে দুষ্টুমির ইঙ্গিত।
এরকম কথায় কোন পুরুষের পৌরুষত্বে আঘাত করে না! আমারও করল। ইচ্ছে করল এখুনি প্রমাণ করে দেই সবকিছু। কিনতু এ পদ্ধতি তো পৌরুষত্ব প্রমাণের কৌশল নয়। এটা আত্মবিশ্বাসহীন মানুষের সর্বশেষ আয়ুধ। আর আমি তো পরস্পর সম্মতিতে বিশ্বাসী। আমি আমার ব্যক্তিত্বের বিশাল পর্দার পাশাপাশি তার সম্মতির জন্য প্রতীক্ষা করছি। তার সম্মতিটুকুই আমার সবচেয়ে বড় অনুমোদন। এই অনুমোদন ধর্মীয় কিংবা সামাজিক যেকোনো অনুমোদনের চেয়েও বড়।
আমি খুব গাঢ় করে তার চোখের দিকে স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। তিলোত্তমা মনে হয় এই দৃষ্টির মানে ঠিকই বুঝতে পারল। সে চোখ নামিয়ে নিলো। তার ফর্সা ত্বকে রক্তাভ আভা ছিল। চোখ নামানোর পর থেকে সে-আভা মিলিয়ে যেতে থাকলো। তিলোত্তমা আমার পাশ ঘেষে হেঁটে চলে গেল এই ঘরের ওয়ালে সেট করা শো কেছের দিকে। সেখানে কোথায় যেন চাপ দিলো। অমনি একটা ড্রয়ার খুলে গেলো। সঙ্গে হালকা মিউজিক বেজে উঠল। শান্ত। মনোরম। মনোহর। ছন্দময়।
তিলোত্তমা আমার দিকে তাকালো আবার। আবার কোথায় যেন চাপ দিলো। ড্রয়ারটা বন্ধ হয়ে গেলো।
আমি খুব কৌতূহলী চোখ নিয়ে তাকিয়েছিলাম তার দিকে। কিছু একটা মনে পড়েছে। এরকম একটি ভঙ্গি করে সে চলে এলো আমার কাছে। এসে আমার পাশে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো। আমি ইতস্তত বোধ করতে করতে তিলোত্তমার ঘুমন্ত কন্যার দিকে তাকালাম।
তিলোত্তমা বলল, ও আর জাগা পাবে না। ডন্ট ফিল হেজিটেট।
তিলোত্তমা আমার কাঁধে মাথা রাখলো। সাতাশ বছর বয়সী এই আমি এই প্রথম কোনো নারীর এত কাছাকাছি। তিলোত্তমা আমার চেয়ে কমপক্ষে তিন বছরের ছোট। নারীর চুলের এরকম ঘ্রাণ হয়! আমি জানতাম না। নারীর কোমলতা এরকম হয়! আমি জানতাম না। নারীর নিঃশ্বাস এরকম হয়! আমি জানতাম না।
তিলোত্তমা আমার ঘাড়ে মাথা রেখেই বলল, এখন তোমার ঘড়ির গল্প বলো।
আমি বলি, আমার ঘড়ির কোনো গল্প নেই।
তিলোত্তমা আমার ঘাড় থেকে তার মাথা তুলে বললো, তাহলে তুমি এই বন্ধ ঘড়ি পরো কেন? কেন তুমি বার বার এই বন্ধ ঘড়ির দিকে তাকাও?
এমনি। অভ্যাস। হাতটা খালি খালি লাগে। তাই পরি।
মিথ্যে কথা। আমি দেখেছি তুমি এই ঘড়ির সঙ্গে কথা বলো। একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘড়ির সঙ্গে কী কথা তোমার? তুমি কি এই ঘড়ি নিজেই কিনেছিলে?
আমি চুপ করে থাকি এবার। কী বলব ভেবে পাই না।
তিলোত্তমা আমাকে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে। প্রথমে ডান হাত দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরে। তারপর বামহাতটাও প্রসারিত করে। দুই হাত দিয়ে আমার গলা পেঁচিয়ে ধরে বুকে মাথা রাখে। বসে থাকা আমি, এই আকস্মিকতায় শুয়ে পড়ি তার ঘুমন্ত কন্যার খাটের ওপর। আমার ওপর শুয়ে থাকে এক নিরুপম সুনামি। আমি টের পাচ্ছি এই সুনামি সবকিছু ভাসিয়ে দিতে পারে। শরীরতো প্রস্তুত। কিন্তু তিলোত্তমার চোখের নোনা ঢেউ আমার বুকটা ভিজিয়ে দিচ্ছে। ফলে মনটা আগাচ্ছে না। এই দুই বিপরীতমুখীর লব্ধিতে পড়ে আমার মনে হলো আমার ঘড়িটি বোধহয় সচল হয়ে উঠবে এবার। যদি সচল হয়েই ওঠে তাহলে তাকে শোনাতে পারি সেই স্বপ্নের কথা। যে স্বপ্নে আমি একজন রমণীকে দেখিছিলাম। তার হাতে ছিল অ্যাঞ্জেল উইংস-এর একটি ঘড়ি। যে ঘড়িতে কাঁটার পরিবর্তে ছিল মুক্ত প্রজাপতি। মিনিটের ঘুর্ণন শেষ হলেই সেই প্রজাপতি উড়ে এসে আমার ঘড়িতে বসছিল। অমনি বহুদিনের বন্ধ হয়ে থাকা ঘড়িটি সচল হয়ে উঠেছিল আমার।
স্বপ্নে সেই রমণীর খুব কাছে গিয়ে তার হাতঘড়িটির দিকে তাকিয়েছিলাম আমি। বলেছিলাম, আপনার অ্যাঞ্জেল খুব সুন্দর।
রমণী হেসেছিল রিনিঝিনি শব্দ তুলে। বলেছিল, আসুন, প্রজাপতি আসলে প্রজাপতি কি না, সেটা নিয়ে ভাবি আমরা।
সেই ভাবাটা ভাবা হয়নি। কারণ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আমার হাতঘড়িটাও বন্ধ হয়ে গেল কয়েকদিন পর। সেই স্বপ্নের কয়েক বছর পর এক রমণীর হাতে স্বপ্নে দেখা ওই ঘড়িটি দেখে চমকে উঠেছিলাম। কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলেছিলাম, আপনার ঘড়ির প্রজাপতিগুলো খুব সুন্দর।
রমণী আমার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিল। বিস্মিত হয়েছিল। কারণ ঘড়িটি চোখের সামনে না-ধরা পর্যন্ত প্রজাপতিগুলো দেখা যায় না। এ ঘড়িতে প্রজাপতি থাকে সেটা আমার জানারও কথা নয়। কারণ এ রকম ঘড়ি বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হয় না। পৃথিবীর সবচেয়ে সৌখিন লোকদের জন্য এটা তৈরি করা হয়। তৈরি করা হয় বড়জোর চার থেকে পাঁচটি। যার ক্রয়মূল্য মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
বলেছিল, এটা অ্যাঞ্জেল। প্রজাপতি নয়।
আমি খুব হেসেছিলাম। বলেছিলাম, আমি জানি কোনটা অ্যাঞ্জেল, কোনটা প্রজাপতি।
সেই রমণী আমার বন্ধ হয়ে যাওয়া কমদামি ঘড়িটির দিকে তাকিয়েছিল। বলেছিল, আমার নাম তিলোত্তমা।
আমি তাকে মনে মনে বলেছিলাম, আমি আপনাকে স্বপ্নে দেখিছি। আপনিই। একটুও ভুল না।
তিন.
তিলোত্তমা আমাকে ছেড়ে উঠে বসল। তারপর ওয়ালে ফিক্সড করা শোকেসের সেই বাটনে আঙুল রাখল। একটা ড্রয়ার খুলে গেল মিউজিকসহ। তিলোত্তমা তার ভেতরে হাত ঢুকে দিয়ে বের করে আনলো অনেকগুলো ঘড়ি।
ঘড়িগুলো আমার সামনে রাখলো। তিলোত্তমা খানিকটা স্বাভাবিক। আমরা ঘড়িগুলো দেখতে লাগলাম। এখানে সিকো, টাইটান, কেলভিন ক্লেইন-এর ঘড়ি থেকে শুরু করে রোলেক্স, ওমেগা, টাইনেক্স, ট্যাগ হুয়ারের মতো দামি ঘড়িও রয়েছে। এমনকি বার্ড উইঙ্স, হার্ট শেপের মতো অতি মূল্যবান ঘড়িও তার সংগ্রহে রয়েছে। আমি বিস্মিত হলাম যখন একটা ঘড়ি আমার হাতে তুলে দিয়ে তিলোত্তমা বললো, এই ঘড়ির নাম কোপার্ড-২০১।
আমি জানি এই ঘড়ির দাম ২৫ মিলিয়ন ডলার। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ঘড়ি। কিন্তু এত দামি ঘড়ি তিলোত্তমার কাছে!
তিলোত্তমা জোরে হাসতে গিয়ে মুখে হাত দিলো। শব্দ করা যাবে না। তার কন্যা ঘুমাচ্ছে। বললো, তুমি যা ভেবেছ, তা নয়। এটা ডুপ্লিকেট। তবে ডুপ্লিকেট হলেও এর বেশ দাম। আমরা দাম দিয়ে ঘড়ি কিনি। দাম দিয়ে সময় কিনি না।
তিলোত্তমা একটু নীরব হয়ে গেলো। তারপর ফিসফিস করে বললো, এসো আমার জুয়াতলায়, আমি কিন্তু তোমার ঘড়ির কথা এখনো ভুলিনি, এখানে তুমি সে-কথা বলবে।
তিলোত্তমা আমাকে তার বেডরুমে নিয়ে গেল। এত সুন্দর বেডরুম আমি কখনো দেখিনি। এত সুন্দর খাট আমি কখনো দেখিনি। বিস্ময়ে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো। তিলোত্তমা আবার আমার ঘাড়ে মাথা রেখে বললো, জানো, তুমিই প্রথম পুরুষ যাকে আমি এখানে নিয়ে এলাম। আগে কেউ আসেনি।
কেন তোমার হাজবেন্ড?
তাকেও আমি এখানে আনিনি। আর আনবও না।
আমাকে আনলে কেন?
তিলোত্তমা ঘাড় থেকে মাথা তুলে বললো, কারণ আমি চাইনি। আমি চেয়েছি একজন পুরুষই এখানে ঢুকতে পারবে। আর কেউ না। তুমি এখন তোমার গড়ির গল্প বলো।
আমি নীরব। কী বলব তিলোত্তমাকে!
আমরা আরেকটু এগিয়ে গেলাম। তিলোত্তমার খাট এত কারুকার্যময়! চার পায়ে চারটি পরীর পাখার ওপর ভর দিয়ে আছ খাটটি। পুরো খাটে প্রজাপতি আর মৎস্যকন্যার খোদাই করা মূর্তি। মুগ্ধ হয়ে এগুলো দেখতে দেখতে চোখ চলে গেল আরেক বিস্ময়ের দিকে। খাট ঘেঁষে যে-দেয়াল, সেখানে একটা বিশাল ঘড়ি টাঙানো। কোনো মূল্যবান ধাতুর তৈরি দামি ঘড়ি বোঝা যাচ্ছে। এক রমণী চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে আছে পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরা এক পুরুষের বুকে। লাল টপসের ভেতর থেকে তার বুকের গোলাপি ঢেউ বোঝা যাচ্ছে। বুকের মাঝে যেখানে অন্ধগলির সমস্ত সুবাস নিবিড় হয়ে থাকে, সেখান থেকে উঠে এসেছে ঘড়ির কাঁটাগুলো। সবগুলো কাঁটা অচল।
তিলোত্তমা বললো, ঘড়িটা বন্ধ। ইচ্ছে করলেই এটা রান করানো যায়।
নীরবতা।
কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো সব কিছু করা যায় না। এই ঘড়িতে দু’টি নীল বাটন রয়েছে। একটা পুরুষ একটা রমণী। দুটো দেখতে একই রকম। কোনটা পুরুষ কোনটা রমনী, আমি জানি না। ভালোবেসে পুরুষ-রমণী তর্জনি দিয়ে দুইটা বাটনে চাপ দিতে হবে। পুরুষ বাটনে থাকতে হবে পুরুষের তর্জনি, রমণী বাটনে থাকতে হবে রমণীর তর্জনী। ঠিক সন্ধ্যায় ভালোবাসাবদ্ধ পুরুষ-রমণী এই বাটনে চাপ দিলেই কেবল সচল হয়ে উঠবে এই ঘড়ি। ঘড়ির কাঁটা যখন ঘুরতে থাকবে তখন এই ঘড়িটিকে ঘিরে উড়তে থাকবে কয়েকটি প্রজাপতি।
আবার নীরবতা।
তিলোত্তমা আমার ডান হাতটি চোখের নামনে তুলে ধরে। তার তর্জনী দিয়ে আমার তর্জনিতে হালকা করে টোকা দেয়। তারপর আস্তে আস্তে তার রক্তিম ঠোঁটের কাছে নিয়ে যায়। হালকা করে চুমু খেয়ে বলে, আমি ঘড়িটি সচল করতে চাই। তোমার এই তর্জনি কি সেই পুরুষের তর্জনী হয়ে উঠবে? যদি না হয়ে ওঠে তাহলে তোমার সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক শেষ। আমি তো জীবনে অনেক হিসাব কষেছি। কী হয়েছে তাতে? আজ যদি এ রকম একটি জুয়ার ভেতরে নিজেকে সমর্পণ করি তাতে কী আর হবে?
নীরবতা।
এখন বলো, তুমি রাজি এই খেলাতে!
আমি তার তর্জনি তুলে নিয়ে একটা ছোটর্ট চুমু খেলাম। তিলোত্তমা আনন্দে আমাকে আরেকবার জড়িয়ে ধরলো। বললো, তাহলে সন্ধ্যা হোক।
আমি বললাম, সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
সত্যি সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
তাহলে চলো সন্ধ্যা দেখে আসি।
তিলোত্তমা তার বেডরুম সংলগ্ন বেলকনির দরোজাটা খুললো। বিবর্ণ মুখে বললো, এখনো বিকেল।
আমি দরোজাটা আরেকটু খুলে তিলোত্তমাকে বুকের স্পর্শে রেখে বেলকনির দিকে তাকালাম। কয়েকটি ঝুলন্ত টব। কালোগোলাপ ফুটে আছে সেখানে। শেষ বিকেলের নরম রোদ ছড়িয়ে। খুব ছায়া ছায়া। কারণ পশ্চিম পাশে নারিকেল গাছের ঝিরিঝিরি ডাল। সে ডালের ছায়া তো টবের ছোট্ট ছায়াকে ঢেকে দেওয়ারই কথা।
আমি বললাম, এটা ভুল। এতক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার কথা।
তিলোত্তমা উদাস হয়ে বললো, এখানে সন্ধ্যা আসে না। এখানে ঘুম আসে না।
আমি বললাম, সন্ধ্যা হয়েছে। ঘড়ি দেখো।
আমার সব ঘড়ি বন্ধ। তোমার মোবাইল ফোনটাও বন্ধ হয়ে গেলো। এক সময়হীন বিকেল আমরা যাপন করছি।
আমি একটু বাইরে যাই? দেখে আসি সন্ধ্যা হলো কি না?
তিলোত্তমা বললো, যাও। আমার জন্য সন্ধ্যা নিয়ে এসো।
বের হওয়ার সময় তিলোত্তমা আমাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বললো, আমাকে সন্ধ্যা এনে দাও, আমি তোমাকে গভীরতম রজনী উপহার দেব।
আমি শুধু তার গালের কাছে মুখটা নিয়ে গেলাম। কিছু বললাম না।
তিলোত্তমা দরোজা খুলে দিলো। আমি জাস্ট বের হয়েছি। তখনই তিলোত্তমা বললো, অ্যাই আমার চকলেট কই। আজ কালো চকলেট আনোনি?
আমি বললাম, এনেছি তো।
কোথায়?
পকেটে।
তিলোত্তমা এক ঝটকায় আমাকে আবার ভেতরে নিয়ে এলো। দরোজাটা বিকট শব্দে বন্ধ করে দিলো। তারপর টেনে এনে সোফায় ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। আমার ওপরে শুয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটটা আমার ঠোঁটের খুব কাছে এনে বললো, আগে আমাকে কালো চকলেট দাও। তারপর সন্ধ্যা আনতে যাও।
তিলোত্তমার নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে যাচ্ছে। সুনামির পূর্বাভাস টের পাওয়া যাচ্ছে তার অস্থিরতা দেখে। তিলোত্তমা আমার উরুতে চাপ দিয়ে বলল, এখানে কী?
আমি বললাম, কালো চকলেট।
আমি এখন চকলেট খাবো। বলে যেই চকোলেট হাত দিয়েছে তখনই তিলোত্তমার তিন বছরের ঘুমন্ত কন্যার কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো।
তিলোত্তমা আমাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে বসলো। একটু সময় লাগলো তার ধাতস্থ হতে। তারপর একটু দ্রুত লয়ে চলে গেলে বিভাজক পর্দার ওপারে।
তখনো আমার বুকের ভেতরে বেড়ে চলেছে বিবিধ সঙ্গীতের ঝংকার। বাইরে বিভাজক ডোরবেলেরর সুমধুর টুংটাং।
আমি আমার কমদামি ঘড়িটির দিকে তাকালাম। দেখি, ঘড়িটি চলতে শুরু করেছে।