ডাক্তার শ্রেণীটাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে অর্ক। যদিও তাদের অনেকের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত পরিচয় আছে। তবে কেউ-কেউ কামাল মোস্তফা। যারা সত্যিকারের ডাক্তার। আন্তরিক ব্যবহার। অনেকের মতো রুগী পেলেই মনে মনে আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন না। বরং সহানুভূতিশীল হন। মধ্যবয়স্ক নিউরোলজিস্ট। ডাক্তার হিসেবে মোটামুটি নাম ডাক আছে। এছাড়া গল্প-উপন্যাস লেখেন। ইতোমধ্যে খ্যাতিও পেয়েছেন বেশ। একসময় তিনি বলেন— দেখুন মিস্টার অর্ক, আপনি এতক্ষণ যে প্রবলেমগুলোর কথা বললেন, তা সাধারণত লেখক বা শিল্পীদের, আই মিন ক্রিয়েটিভ পারসনদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়। আপনি কি সে রকম কোনো কাজের সঙ্গে ইনভল্বড?
—না। কেন? রোগেরও আবার পারসন বেসড ডেফিনেশান আছে না কি?
—হা, তা কিছুটা আছে। এখানে সেনসিটিভিটির প্রশ্ন। সাধারণত ওদের সেনসিটিভিটি অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি থাকে তো, তাই?
—জেনারেল পিপলরা বুঝি এই প্রবলেম ফেইস করতে পারেন না?
—পারেন, তবে এই কেইসে তা খুব রেয়ার। আচ্ছা, আপনি নিশ্চয়ই আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বা ভিনসেন্ট ভ্যানগগের নাম শুনেছেন?
দৃঢ়কণ্ঠে অর্ক উত্তর দেয়—না শুনিনি (মিথ্যা।এই দুজন সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানা আছে অর্কের)।
—ও আচ্ছা। আপনার বুঝি বই-টই খুব বেশি একটা পড়া হয় না?
—একদমই না। বলতে গেলে ভালো লাগে না। দু’একটা সস্তা প্রেমের উপন্যাস পড়েছি। এই যা! (আবারও মিথ্যা, পাঠক হিসেবে সে সর্বভুক)
—ওকে! একটা সিটিস্ক্যান করাতে হবে। আপাতত কিছু ওষুধ দিচ্ছি। আচ্ছা, এই প্রবলেমটা কত দিন ধরে চলছে?
— খুব বেশি দিন না। হঠাৎ হঠাৎ হয়। অর্কের উত্তর।
ডাক্তার কামাল জিজ্ঞাসা করেন—কখন, কখন?
—এই ধরুন খুব ইমোশনাল কিছু ঘটলে। যেমন, কোনো পেইনফুল কথা…
—হা, বলুন, বলুন…
— দেখুন, এটা আমার খুব সামান্য সময়ের ব্যাপার মাত্র।
প্রসঙ্গটা হাল্কা করতে চায় অর্ক। তারপর আবার ভালোও হয়ে যায়। ডাক্তার কামাল মাথা নাড়ান। বলেন— নিউরোসিসের ভাষায় এটাকে বলে…
কথা থামিয়ে অর্ক বলে—রোগের নাম শুনে কী হবে? বরং প্রবলেমটা কী, সেটা বলাই বেটার!
মোস্তফা কামাল লজ্জা পান। বলেন—হা, তা ঠিক। তো বর্তমানে কী অবস্থা?
—বুঝিনি।
—মানে, নিজের ভেতর কোনো চেইঞ্জ দেখতে পারছেন?
—কিছুটা। আগে আমার মেমোরি খুব সার্প ছিল। বাট্ ইদানিং কিছুই মনে রাখতে পারছি না। ঘনিষ্ঠ কারও নাম পর্যন্ত না। বেসিক্যালি এ জন্যই আসা।
—আর কিছু?
—মাঝে মাঝেই আউট অব কন্ট্রোল হয়ে পড়ি। তখন ব্রেন টেম্পারমেন্ট খুব হাই হয়ে যায়। ঠুনকো ব্যাপারেও খুব রেগে যাই। কিছুক্ষণ পর রাগ নেমে গেলে খুব ক্লান্তি লাগে। তখন আর কিছু ভালো লাগে না…
—দেখুন মিস্টার অর্ক, আমার ধারণা কোনো একটা ঘটনার পারপাসে আপনি দীর্ঘদিন ধরে হাইলি ডিপ্রেশানে ভুগছেন। সো…. ব্রেনের একটা সাইট ইফেক্টেড হয়ে পড়েছে। বাট্ আই হোপ নট্ সিরিয়াস। রিপোর্ট দেখলেই বুঝতে পারব। আচ্ছা, অনেস্টলি বলেন তো, মন খারাপ থাকলে আপনি কী করেন?
—একটার পর একটা সিগারেট খাই। মাঝে মাঝে গান শুনি। এই তো…
—ওকে। বাট্ সিগারেট ছাড়তে হবে। লান্সের অবস্থা ভালো ঠেকেনি। আই থিংক ইউ মাস্ট বি কিওর অ্যাজ আরলি অ্যাজ পোসিবল। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঠোঁটের এক কোণে আঁড় হাসি রেখে অর্ক টেনে টেনে বলে— তাই? সসস-ব ঠিক হয়ে যাবে?
এই হাসিতে স্পষ্টই বোঝা যায় সিগারেট সে ছাড়তে চায় না।
২.
আজ অর্কের মন ভালো নেই। কারণ মা ভালো নেই। বিছানায় পড়ে আছেন অনেক দিন। তাকে ছাড়া মায়ের কিংবা মাকে ছাড়া তার আর কেই-বা আছে? মায়ের এই ভগ্ন দশা দেখতে ভালো লাগে না তার। ঘর থেকে বের হয়ে যায়। মোবাইলটা হাতে নেয়। ডায়াল করে সুতপার নম্বরে। স্পষ্ট বিরক্তি নিয়ে সুতপা অন্য পাশ থেকে বলে—হ্যালো, হা, কী ব্যাপার?
অর্ক চুপচাপ শুনে যায়। হ্যালো শুনেই বুঝতে পারে মুড। এই মুড গত ছয় মাস ধরে চলছে।
সুতপা আবার বলে—হা, কিছু বলার আছে?
এক শব্দে অর্ক উত্তর দেয়—নাহ্।
—ওকে। ফোন রাখব। এই কথা বলেই ফোন রেখে দেয় সুতপা।
হ্যাংলার মতো আবার ফোন করে অর্ক। এবার ভেসে আসে চিৎকার—কী? কী হইছে? বলছি না কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছে না। ফাজিল কোথাকার!
এই হলো অর্কের প্রতি সুতপার বর্তমান শ্রদ্ধাবোধ। অথচ একসময় তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তার এতটুকু অপমান সুতপা কোনোদিনই হতে দেবে না। বাট্ টু-ডে ইজ নট্ লাইক বিফোর।
৩.
রিপোর্ট হাতে নিয়ে ডাক্তার কামাল বলেন—যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই। দ্যাটস্ নট্ অ্যা ভাইটাল কেইস। জাস্ট একটু কোয়াপোরেশান লাগবে।
—ক্যামন? ভ্রূ কুঁচকে অর্ক প্রশ্ন করে।
—আরও কিছু ওষুধ দিচ্ছি। নিয়মিত খাবেন। সিগারেট মাস্ট ছাড়তে হবে। নো টেনশান, ওটাকে ঝেড়ে ফেলুন। একটু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতে হবে। আর সবচেয়ে ইম্পোর্টেন্ট হচ্ছে, চিয়ার্স! আই মিন অল টাইম হাসিখুশি থাকা। নেভার মাইন্ড, একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?
শঙ্কিত কণ্ঠে অর্ক জানতে চায়—কী?
—আপনার কোনো ভালো বন্ধু আছে? আই মিন, অ্যানি ওয়ান স্পেশাল?
অর্ক মাথা দুলিয়ে না জানায়। ঠোঁট কামড়ে ধরে।
—ও… তাহলে পরিবারের কাউকে লাগবে যার সঙ্গে আপনি সব কিছু শেয়ার করেন।
— মা আছেন। বাট্…
—ওকে ফাইন। ওনাকেই নিয়ে আসবেন।
— দেখুন ডাক্তার, এ ব্যাপারে আসলে আমি কাউকেই জড়াতে চাচ্ছি না।
—মানে? কী বলছেন? আরে আপনার এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি। জাস্ট প্রিলিমিনারি স্টেজ। অল উইল বি ওকে। দেখুন মিস্টার অর্ক, লাইফ ইজ কালারফুল। এছাড়া…
কথাগুলো তার খুব বিরক্তি লাগে। বলে—তাছাড়া কী?
—এছাড়া বাঁচতে তো হবে, তাই না?
শরীরটা একটু ঝাঁকিয়ে নাক দিয়ে একটা ‘হু’ শব্দ করে অর্ক। বলে—কে বলল আমি বাঁচতে চাই?
—মানে! কপাল কুঁচকে তাকায় ডাক্তার কামাল।
—ভয় নেই। সুইসাইড করার মতো দুঃসাহস আমার নেই। (মনে মনে ভাবে, আহ্! যদি হেমিংওয়ে বা ভ্যানগগের মতো সাহস থাকতো…)
এটুকুই কথা। অর্ক বেরিয়ে আসে ডাক্তারের চেম্বার থেকে। হাতে ধরা রিপোর্টগুলো ছিঁড়ে ফেলে দেয় রাস্তার পাশের ড্রেনে। একটা সিগারেট ধরায়। শরীর খুব ক্লান্ত লাগে। অনেক কিছু করার বাকি। সময় খুব কম। পা চালাতে হবে। দ্রুত চালাতে হবে। ক্লান্ত শরীর নিয়েই ছুটতে চায় অর্ক। খুব দ্রুত ছুটতে চায়। হাঁটতে থাকে। গতি বাড়ে। শ্বাস বাড়ে। আরও দ্রুত। আরও-আরও…।
হঠাৎ আছড়ে পড়ে রাস্তার ওপর। বাম পায়ে চোট খায়। মাংস থেতলে যায়। পা বেয়ে রক্ত ঝরে। উঠে দাঁড়াতে চায়, পারে না। তীব্র যন্ত্রণায় চোখ-মুখ কুঁকড়ে যায়। হাত দিয়ে চেপে ধরে ক্ষত পা। কেউ নয়, সে সময় কেউ নয়; কেন জানি শুধু আর্তনাদের ভেতর দিয়ে অভাবী বিধবা মায়ের মুখখানি মনে পড়ে যায় তার।