আসরের আজান হতেই ওজুর জন্য এক বদনা পানি দিয়ে গেলো টুনি। ফখরুল শুয়ে ঝিমুচ্ছিলেন। ঘুম-ঘুম একটা রেশ সবে ছুঁয়েছিল চোখ। টুনির ডাকে ধড়মড় বসলেন উঠে।
-কী রে? আজান দেচে?
-সেই কহন! তুমার য়ুঁশ কোনে গেচে আইজকাইল অ্যাঁ? আজান দিলিউ ঠিক পাও না?
-হ। তুমার তো যবর য়ুঁশ, গাচেত্তে লিচু চুরি অয়া যায়, তাও গোমই বাঙে না তুমার!
টুনি দৌড়ে পালায়। আজ দুপুরে বাড়ির উঠোনের গাছ থেকে পাকা লিচুগুলোর কয়েকটা ঝাপ চুরি গেছে তার নাকের ডগা দিয়ে। জৈষ্ঠ্যের গরমে অতিষ্ঠ সে যখন বারান্দায় পেতে রাখা চৌকিতে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল, ঠিক তখন কোনো এক ফাঁকে গাঁয়ের কোনো বজ্জাত চোর এসে পেড়ে নিয়ে গেছে লিচুগুলো। একে তো অমন পাকা লিচুগুলোর শোক, তার ওপর আবার সুযোগ পেলেই খচ্চর বুড়োটার খোঁচা! দুঃখে, লজ্জায় টুনি তাড়াতাড়ি সরে পড়ে দাদার সামনে থেকে। বুড়োটা বড্ড হারামি। টুনিকে খোঁচানোর ধান্দা খোঁজেন সারাদিন।
নামাজ সেরে কী করবেন, ভেবে পান না ফখরুল। স্বাভাবিক সময়ে তিনি বাড়ির লাগোয়া মসজিদে আসরের নামাজ সেরে বাজারে যান, চেনা-জানা লোকজনের সঙ্গে দু-চারটে কথাবার্তা বলেন, গাঁও-গেরামের খবর নেন, চা খান জমিয়ে, তরতরিয়ে সময় চলে যায়। ইদানীং সময় যেন কাটতেই চায় না আর। থম ধরে থাকে কেমন। বুকের ভেতরটাও।
এশার আজানের খানিক আগে আগে বাড়িতে ঢুকে টিভির সামনে বসেন, নিয়ম করে। ঢাকা থেকে চাকুরে ছেলে বিশ ইঞ্চি কালার টিভি কিনে দিয়ে গেছে, রিমোট হাতে সেই টিভির সামনে বসে ইচ্ছেমতো চ্যানেল পাল্টান ফখরুল। গর্বে তার বুড়ো বুকের ছাতি ফুলে ওঠে ঢেরখানিক। এ পাড়ায় বিশ ইঞ্চি কালার টিভি আর কারও ঘরে নেই। কদিন আগেও তার দরজায় টিভি দেখার লাইন পড়তো লম্বা। অনেকের সঙ্গে টিভি দেখার আলাদা একটা মজা আছে। দর্শকদের মনস্তত্ব নিয়ে খেলাটা ফখরুলের পছন্দ ছিল খুব। ছিল দারুণ উপভোগ্য। সবাই যখন কোনো একটা সিরিয়ালে মগ্ন, ফখরুল পট করে চ্যানেলটা পাল্টে দিতেন তখন। রাজ্যের বিরক্তি মুখে ফুটিয়ে, মেহেদি দেওয়া দাড়িতে হাত বুলিয়ে উদাসীন, গম্ভীরমুখে বলতেন, ধুত্তুর! কী যে সপ আলতু-ফালতু জিনিস দেহায় আইজকাইল! দ্যাশটা লষ্ট অয়া গেলো এহাবারে!
অনেক তো বাঁচা হলো! দেখা হলো জীবনের বহুবর্ণা রঙ, চেনা হলো নাট্যশালার বহু কুশীলব, নিংড়ে নেওয়া হলো তার রূপ-রস-গন্ধের মোহন মদিরাটুকু একে একে। আর তবে কিসের অপেক্ষা?
উপস্থিত দর্শকেরা হা-হা করে উঠতো ফখরুলের এই হঠাৎজাগা দার্শনিকতায়। চরম বিরক্তি নিয়ে উঠে যেতো কেউ কেউ। কেউবা আবার করুণমুখে ফখরুলকে আগের চ্যানেলে দেওয়ার অনুরোধ-উপরোধে ব্যস্ত হতো। শেষোক্ত দর্শকদের ভীষণ পছন্দ ছিল ফখরুলের। মনে মনে এ সময়টুকুর জন্যই সাগ্রহে অপেক্ষা করতেন তিনি। নিজেকে কেমন রাজা-বাদশা মনে হতো এ সময়টাতে। উপস্থিত দর্শকদের মনে হতো তার অনুগ্রহপ্রত্যাশী প্রজা। তাদের সানুনয় অনুরোধে, সযত্নলালিত দাড়ির গোছায় হাত বোলাতে বোলাতে আগের চ্যানেলে ফিরে যাওয়ার যে সুখ, তেমন আর কিছুতে নেই। দশটার দিকে সবাইকে বিদায় দিয়ে, নামাজ সেরে, রাতের খাবার খেতেন ফখরুল। তারপর, জি বাংলা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়তেন নিশ্চিন্তে। পাশে নোলকবানু তখন ঘুমে কাদা। তার পান খাওয়া, সময়ের কোপে শুকিয়ে আমসি মেরে যাওয়া লাল ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে অতীত জীবনটার কথা ভাবতে ভাবতে কেমন অনিত্য মনে হতো সব। নোলকবানুর সেই উদ্দাম যৌবনের কথা ভাবতে ভাবতে অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস পড়তো ফখরুলের। জীবন কত ছোট আর অকিঞ্চিতকর, অতৃপ্তি ছাড়া তাতে মেলে না কিছুই, এমনসব দার্শনিক দীর্ঘশ্বাসে ঘুমিয়ে পড়তেন অল্পক্ষণেই। সারা জীবন পরিশ্রম করা, কঠোর নিয়ম মানা শরীর তার। অসুখ-বিসুখ পাত্তা পায়নি কখনো তার নব্বই ছুঁইছুঁই শরীরে। ফলে অনিদ্রা শব্দটা এতদিন প্রায় অচেনাই ছিল তার।
কিন্তু চিরচেনা জীবনটা হঠাৎই পাল্টে গেল যেন। হুট করেই। অনিদ্রা শব্দটার সঙ্গেও সখ্য হলো শেষমেষ। ফখরুলের কেমন উল্টাপাল্টা লাগে সব। ঘোর ঘোর লাগে। মাঝে মাঝে চিমটি দিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে, আসলেই কী ঘটছে এসব, নাকি স্বপ্ন দেখছেন!
মাস তিনেক আগে ঢাকার চাকুরে ছেলেটা ফোন দিলো তাকে রোজকার মতোই। কিন্তু কথা বলল অচেনা ভাষায়। ফখরুলের প্রথমে সন্দেহ হলো, ছেলে হয়তো অন্য কাউকে ফোন দিতে গিয়ে ভুল করে তাকে দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু না! ছেলে তো দিব্যি আব্বা আব্বা বলে ডাকছে খানিক পর পরই! একবার ইচ্ছে হলো, জিগ্যেস করেন তাকে, এই ছাওয়াল, বাপ কয়ডা রে তোর? আর কোন বাপেক ডাহিস তুই আব্বা আব্বা কয়া রে, ইঁ?
কিন্তু প্রশ্নটা করা গেলো না। একে তো লায়েক ছেলে, ঢাকায় মোটা টাকার চাকুরে, তার ওপর বিপদে-আপদে এই ছেলেই তার হাতের লাঠি বলতে গেলে। এ ছেলেকে চটানো চলে না। কিন্তু কথাও তো কিছুই বোঝেন না তিনি ছেলের! প্রায় নব্বই বছরের এই পোড় খাওয়া জীবনে তিনি এমন সৃষ্টিছাড়া শব্দ তো কই শোনেননি কখনো আগে! এ কোন ভাষায় কথা কয় তার ছেলে! এ কোন ঘোর কলিকাল! কেয়ামত কি তাহলে ঘনিয়ে আসছে এবার!
চুপসে যাওয়া, ভাঙা স্বরে ছেলেকে থামান তিনি। বলেন, কী কইস বাজান? তোর কতা তো বুজিনে কিচু আগামাতা। বাজারে যাব না ক্যা? আর বাইত-ই বা কাউক আইসপের মানা করব আমি কেবা করে? কেউ বাইত আলি তাক কেবা নিষেদ করব, ক দিনি বাজান? সারাজীবন চললাম জন-মানুষ নিয়ে, আর এহন এই শ্যাষ বয়াসে আইসে আমাক তুই একগোরে অয়া থাইকপের কইস? তাইচ্চে দো আমার মইরে যাওয়া বালো!
ছেলের বাকি কথা চুপচাপ শোনেন ফখরুল। গুম হয়ে থাকেন। ছেলের বলা কথাগুলো মাথার ভেতর তালগোল পাকিয়ে যায়। বনবন ঘোরে। ভাইরাস, করোনা, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন আরো নানান সব অচেনা শব্দ মাথার ভেতর কেমন ঝিঁঝি সুরে ডাকে। দমবন্ধ লাগে। বাইরে তখন বসন্তের হাওয়া দিচ্ছে দারুণ, উঠোনকোণের হাসনাহেনা, মাধবীলতা আর গন্ধরাজের গন্ধে পুরো বাড়ি তখন বুঁদ। অন্যদিন অমন সময়টায় এশার নামায সেরে টিভি দেখতে বসেন তিনি। সেদিন আর মন বসে না কিছুতেই। টিভি দেখতে এসে সবাই হতাশ ফিরে যায়। ফখরুল ছেলের কথাগুলোই প্রায় রেকর্ড শুনিয়ে দেন তাদের। তারপর বিষণ্ন, চিন্তিত মনে টিভিতে নিউজ চ্যানেল চালিয়ে টিভির সামনে বসেন। সচরাচর নিউজ চ্যানেল দেখা হয় না তার। রেডিওতে বিবিসি বাংলা, ভয়েস অব আমেরিকা, ডয়েচেভেলে, এসব শোনার অভ্যেস ছিল বহুকাল আগে। এখন টিভির যুগ, ওসব শোনা হয় না আর। মাঝে মাঝে খবরের হেডলাইনগুলো দেখা হয় বড়জোর টিভিতে। তাতেই হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি। লুটপাট, খুন, ধর্ষণ, অনিয়ম, দুর্নীতি, এসব ছাড়া আর কোনো নিউজ চোখে পড়ে না বলে নিউজ চ্যানেলে ইচ্ছে করেই যান না তিনি আজকাল আর। কিন্তু ছেলের কথায় তো বসে থাকা যায় না চুপচাপ! অগত্যা নিউজ চ্যানেলের দ্বারস্থ হন ফখরুল। চমকে ওঠেন।
ছেলের কথার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চান খবরগুলো। কাঙালের মতো মনে মনে অপেক্ষা করেন, ছেলের কথায় কোনো ভুল আছে, ধরা পড়বে সেটা। কোথাও একটা প্রবল তৃষ্ণা জেগে থাকে, মিথ্যে প্রমাণিত হবে ছেলে। কিন্তু না। প্রবল বিস্ময় নিয়ে তিনি দেখেন, ইউরোপ, আমেরিকায় লাশের স্তূপ, চীনের উহান থেকে এক অচেনা ঘাতক ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বময়, বসিয়ে দিচ্ছে তার ভয়াল থাবা, আর ফখরুলের মতো বয়স্করা তাতে ঝরে পড়ছে, শীতশেষে ঝরাপাতার করুণ মর্মরে। বুকের ভেতর কেমন একটা ভয় খামচে ধরে। দমবন্ধ হয়ে আসতে চায়। চোখ বন্ধ করে ভাবেন ফখরুল। কী আছে জীবনে! অনেক তো বাঁচা হলো! দেখা হলো জীবনের বহুবর্ণা রঙ, চেনা হলো নাট্যশালার বহু কুশীলব, নিংড়ে নেওয়া হলো তার রূপ-রস-গন্ধের মোহন মদিরাটুকু একে একে। আর তবে কিসের অপেক্ষা? এবার বিদায় নিলেই হয়। ফিরে গেলেই হয় নির্ধারিত গন্তব্যে।
নোলকবানু চমকান। নোলকবানু আকাশ থেকে পড়েন। কী কতা কও এসপ? বুড়ো বয়াসে আইসে মাতাডা কি খারাপ অয়া গেলো নাহি তুমার? প্রশ্ন নয়, আর্তনাদ করে ওঠেন নোলকবানু।
কিন্তু না! মন তো কই কয় না সে কথা! সে তখনো গেয়ে চলে জীবনের গীত, তখনো কুলকুল বয়ে চলে সুরের ঝর্ণাধারায়! বুকের কোণে সে তো ঠিকই জিইয়ে রাখে জীবনের অনন্ত পিপাসা, অসীম তৃষ্ণা। ছুঁয়ে-ছেনে দেখতে চায় জীবনের আরও আরও অনাবিষ্কৃত পিঠ। তবে কি অতৃপ্তিই জীবনের একমাত্র প্রাপ্তি? শূন্যতাই তার শেষ কথা? ভেবে কূল-কিনারা পান না ফখরুল। আজকাল রাত কাটে তার নির্ঘুম প্রায়, দিন যায় ঝিমিয়ে। ছন্দময়, গতিময় তার নিরুপদ্রব, প্রায় নির্ঝঞ্ঝাট জীবনটাতে ছেদ পড়ে হঠাৎ। থমকে যায় তার প্রিয়তম জীবন। ছেলে-মেয়েদের অনুরোধে বাজারে যান না আর, পারতপক্ষে বেরই হন না বাড়ি থেকে, মসজিদে নামাজ না পড়ে বাড়িতেই পড়েন আজকাল, টিভি দেখতেও লোকজন কেউ আসে না এখন। নিষেধ করে দিয়েছেন তিনি নিজেই। নাতি-নাতনীদের সঙ্গে খুনসুটিতে দিন কাটে না আর। নোলকবানুর মুখে জমা হওয়া সময়ের ভাঁজগুলো গুনতে গুনতে বিরক্ত হয়ে ওঠেন তিনি। নিজের মুখে জমা হওয়া ততধিক ভাঁজগুলোয় হাত রেখে মনে মনে বলেন, এবার বরং মায়ার ঘুড়ি গুটোও হে! সুতো কেটে উড়াল দাও ভোকাট্টা!
অবশেষে নোলকবানুকে ভাবনাটা বলেই ফেলেন ফখরুল। মাগরিবের পরের এ সময়টা ভারী দীর্ঘ লাগে তার। কাটতেই চায় না মোটে। জৈষ্ঠ্যের গরমে, মশার কামড়ে অতিষ্ঠ ফখরুলের দমবন্ধ হয়ে আসতে চায়। তবু ঘরে গিয়ে টিভির সামনে গিয়ে বসতে ইচ্ছে করে না। ভয় লাগে তার। টিভি খুললেই মৃত্যু। টিভি খুললেই আতঙ্ক। দিন শুরু হয় মৃত্যুর খবর দিয়ে, শেষও হয় সেই একই ভয়াল খবর শুনে। প্রথমে ভেবেছিলেন, চীন থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় গেছে যে ভাইরাস, তা আর এ তল্লাতে ঢুঁ দিতে আসবে না। কিন্তু সবিস্ময়ে দেখলেন, ভুল ছিলেন তিনি। ভারতবর্ষেও ঢুকে পড়লো সেই নালায়েক ভাইরাস, একেবারে বাংলাদেশের বুকের ভেতর গেড়ে বসল তার থাবা। তার মতো বয়স্করা নয় শুধু, আক্রান্ত হচ্ছে যেকোনো বয়সী নারী, পুরুষ, এমনকী শিশুরাও। যদিও নারী আর শিশুদের আক্রান্ত ও মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে কম। ফখরুল বোঝার চেষ্টা করেন ব্যাপারটা। তার নব্বই বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে হিসাব মেলাতে চেষ্টা করেন। না, তার মতো জীবনের পোড়খাওয়া, প্রান্তিক জনগণ আক্রান্ত হচ্ছে কম বরং, মৃত্যুও হাতে গোনা। আরাম-আয়েশে জীবন কাটিয়ে দেওয়া, মাথার ওপর ছড়ি ঘুরানো ওপরতলার লোকগুলো বরং আক্রান্ত হচ্ছে বেশি, মারাও যাচ্ছে তারাই অধিকাংশ। আর মধ্যবিত্তরা সবসময়ই বলির পাঁঠা। এবারও তাই। কর্তাব্যক্তিরা সম্ভবত ব্যাপারটাকে পাত্তা দেয়নি প্রথমে। কিংবা তাদের ঘিরে থাকা অপদার্থ চামচাগুলো প্রকৃত অবস্থা আড়াল করেছে, অথবা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে ভুল পরামর্শ দিয়েছে। হয়তো তারা ভেবেছিলেন, ওপরতলার মানুষ তারা, তারা থাকবে সুরক্ষিত, আক্রান্ত হবে প্রান্তিক মানুষ, মরলে মরবে গরিব জনগণ! তা মরুক! আঠারো কোটির এ গিজগিজ করা মানুষ থেকে দুয়েক কোটি সাফা হলে কী আর এমন ক্ষতি! হাহাহা। শব্দ করে হাসেন ফখরুল। তার ফোকলা দাঁতে হাসির শব্দটা হাঁসের কণ্ঠের মতো ফ্যাসফেসে শোনায়। গবুচন্দ্রদের ভাবনাটা এখন বুমেরাং হয়ে ফিরে যাচ্ছে তাদের দিকেই। বেচারা হবুচন্দ্রের মাথায় হাত। মধ্যবিত্তেরা বিপাকে। নিম্নবিত্তেরা মরিয়া। তাদের কাছে পেটের চেয়ে বড় সত্যি আর কিছু নেই, নেই ক্ষুধার চেয়ে আর কোনো বড় ঈশ্বর। তারা দেখছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভাইরাসে মরছে তাদের আজন্ম রক্ত চুষে খাওয়া জোঁকেরা, তাহলে তারা কেন ঘরে বন্দী থেকে মরবে না খেয়ে? মর শালারা! আমাদের মারার ফন্দি এঁটেছিলি, এবার নিজেরাই মর!
মনে মনে এমন কত ভাবনা আসে। আবার নিজেই মাথা নাড়েন ফখরুল। না। মৃত্যু কাম্য নয়। কারও মৃত্যুই কাম্য নয়। কত কত নিরীহ জীবন ঝরে যাচ্ছে। কত অসংখ্য পরিবার ছন্নছাড়া, এলামেলো হয়ে যাচ্ছে। চার লক্ষাধিক জীবন ঝরে গেছে। চার লক্ষাধিক পরিবারে নেমে এসেছে মৃত্যুর শীতল শূন্যতা, অতল হাহাকার। আহা! দয়া করো! দয়া করো মাবুদ!
বিড়বিড় করেন তিনি। ঢাকার অবস্থা করুণ। প্রতিদিন মরছে মানুষ। ঢাকায় থাকা সন্তান, নাতি-নাতনিদের চিন্তায়, ভয়ে সিঁটিয়ে থাকেন তিনি। ফোন বাজলেই বুক কাঁপে, এই বুঝি কোনো দুঃসংবাদ এলো। খবর দেখে চমকে ওঠেন মাঝে মাঝে। আক্রান্ত বাবাকে রাস্তায় ফেলে যাচ্ছে সন্তান, মাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলছে ছেলে, স্বামীকে ত্যাগ করছে স্ত্রী, স্ত্রীকে ত্যাগ করছে স্বামী। প্রতিবেশী, এমনকি আপনার জন পর্যন্ত তালা দিয়ে ফেলে রাখছে আক্রান্ত ব্যক্তিকে, কখনো কখনো গোটা পরিবারটাকে। খাবার না পেয়ে, বিনা পথ্যে, ধুঁকে ধুঁকে, অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মানুষগুলো মারা যাচ্ছে প্রিয়জনদের চোখের সামনে। রাস্তায় শেয়াল কুকুরের মতো পড়ে থাকছে মৃতদেহ, পড়ে থাকছে অসুস্থ মানুষ। ফিরেও দেখছে না কেউ। স্বজনেরা সৎকার পর্যন্ত করছে না প্রিয়জনের মৃতদেহ, গ্রামবাসী দাফনে পর্যন্ত বাধা দিচ্ছে তাদের এতদিনের পরিচিত প্রতিবেশীর লাশ। এ যেন মানুষ নয় শুধু, মানবতারও মৃত্যু, মানুষের ভেতর লুকিয়ে থাকা পশুত্বের বিজয়োল্লাস। দেখে বুকের ভেতর কেমন একটা ভয়, কেমন একটা শঙ্কা মুখ বাড়িয়ে দেয় হঠাৎ হঠাৎ। শিউরে ওঠেন ফখরুল। বয়স হয়েছে। আক্রান্ত হওয়ার ভয় বেশি। যদি তেমন হয়? যদি আক্রান্ত হন তিনি কিংবা নোলকবানু? এই গাঁ-গঞ্জে চিকিৎসার আশা দুরাশা, যেখানে বড় বড় শহরগুলোতেই প্রায় বিনা চিকিৎসায় মরছে রথী-মহারথীগণ পর্যন্ত। বুক ধড়ফড় করে ফখরুলের। মাথা ঘোরে বনবন। গতকাল নিউজে দেখেছেন, কোনো এক অভাগা মা দশমাসের সুস্থ সন্তান পেটে মারা গেছেন আইসিইউ-এর অভাবে। এমন অসংখ্য মৃত্যু ঘটছে প্রতিদিন! কে দায়ী? কে নেবে দায়ভার? চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করে ফখরুল। কেমন ছিল সেই মায়ের মৃত্যুযন্ত্রণা? কতটা কষ্ট পেয়ে মারা গেছে তার অনাগত সন্তানটা? ভাবতে পারেন না আর। অসুস্থ লাগে। বন্ধ হয়ে আসতে চায় দম। পরিজনদের অমঙ্গল শঙ্কায় কুঁকড়ে ওঠেন তিনি।
তারপর নোলকবানুকে বলেই ফেলেন একফাঁকে। নোলকবানু চমকান। নোলকবানু আকাশ থেকে পড়েন। কী কতা কও এসপ? বুড়ো বয়াসে আইসে মাতাডা কি খারাপ অয়া গেলো নাহি তুমার? প্রশ্ন নয়, আর্তনাদ করে ওঠেন নোলকবানু।
মুগ্ধ চোখে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। এরচে সুন্দর, পবিত্রতম দৃশ্য কোনোদিন তিনি দেখেননি আর। চোখ মুছতে ভুলে যান ফখরুল। দুগণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল।
ফখরুল মাথা গোঁজ করে থাকেন। কথা সরে না মুখে। কিন্তু মাথা থেকে ভাবনাটা সরে না। জীবনে কত মানুষের জানাজা পড়িয়েছেন, কত মানুষের রুহের মাগফেরাত কামনায় ঝরিয়েছে চোখের জল। মিনহা খালাম না কুম’ বলে কত মানুষকে তিনি শুইয়ে দিয়েছেন শেষ শয্যায়। সেই ফখরুল যদি সত্যিই আক্রান্ত হন, যদি মারা যায়, স্বজনেরা আসবে না তাকে দেখতে, তার মৃতদেহটাকে পরম শ্রদ্ধায় পূত-পবিত্র করে কেউ জানাজা দেবে না, অস্পৃশ্য, ঘৃণ্য ভেবে ফেলে রাখবে, এমনটা ভাবতেই হু হু করে ওঠে বুকের ভেতর। চোখ বেয়ে জল গড়ায় অজান্তে। না, এমন মৃত্যু চাননি তিন, চানও না। তারচে আত্মহত্যাই শ্রেয়। তাতে অন্তত জানাজাটা হবে। ভেবে মাথা দোলান তিনি। হ্যাঁ। সেই ভালো বরঞ্চ। কিন্তু নোলকবানুর কথাটাও ফেলে দেওয়ার নয়। নোলকবানু যে বলেন, আইত্মহত্যা করলি তো ঈমান নিয়ে মরণ হবিনে তুমার, দোজকে যাবা, ইহকাল, পরকাল সপ যাবি তুমার, সে য়ুঁশ নাইকো? কেবা কতা কও তুমি? ধৈর্য রাহ, ঠিক অয়া যাবি সপ। আল্লার ওপর ভরসা রাহ, বোচ্চ?
হতোদ্যম হন ফখরুল। কিন্তু আরও একটা কাঁটা মনের ভেতর ফোটে। নোলকবানু টের পান না। ফখরুল চোখ বন্ধ করে ভাবেন। তিনি বা নোলকবানু, কেউ একজন আক্রান্ত হয়েছেন, কেউ দেখতে আসছে না, আত্মীয় না, সন্তান না, পরিজন না, কোনো প্রতিবেশী পর্যন্ত না। তালাবন্ধ পড়ে আছেন, জল-খাবার ছাড়া, পথ্যহীন। কেউ খোঁজ নিচ্ছে না, শেষ সময়টুকুতে কোনো প্রিয়মুখ তাকে ঘিরে নেই পরম মমতায়, উদ্বেগে, ভাবতে ভাবতে ফখরুলের মনে হয়, করোনা নয়, বরং এই দুশ্চিন্তাই মৃত্যুর কারণ হবে তার। আবার ভাবেন, যদি এমন হয়, সে বা নোলকবানু আক্রান্ত হয়েছেন, ছেলে-মেয়েরা তাদের ফেলে এসেছে রাস্তায়, কুকুর-বেড়ালের মতো রাস্তায় পড়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন তারা, কেমন হবে তখন? কতই তো হচ্ছে এখন এমন! কতই তো নিউজ দেখছেন রোজ!
ভাবতে ভাবতে হাউমাউ কাঁদেন নব্বই ছুঁই ছুঁই ফখরুল। টুনি দৌড়ে আসে। দৌড়ে আসেন নোলকবানু, অন্যান্য স্বজন। কী অয়চে, অ দাদা? কাঁদো ক্যা? টুনির কণ্ঠে উদ্বেগ কাঁপে। নোলকবানু ফুঁপিয়ে ওঠেন। স্বজনেরা সাহস জোগান। ফখরুল সামলে ওঠেন। টিভির সামনে গিয়ে বসেন খানিকবাদে। হঠাৎ টিভির পর্দায় চোখ আটকে যায় তার। আনন্দে জল আসে চোখে। আছে। ভালোবাসার টলটলে জলে উপচে পড়ছে পৃথিবী। কোনো ভাইরাসের ক্ষমতা নেই তাকে সরিয়ে দেয়। শ্বাসকষ্টে মৃত্যুপথযাত্রী বাবাকে বুকে আগলে সারারাত হাসপাতালের বিছানায় বসে থাকা ছেলেটির মুখের ওপর থেকে চোখ সরে না ফখরুলের। মুগ্ধ চোখে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। এরচে সুন্দর, পবিত্রতম দৃশ্য কোনোদিন তিনি দেখেননি আর। চোখ মুছতে ভুলে যান ফখরুল। দুগণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল।