বাসটা উল্টে খাদে পড়ার পর গেদু করাতির নাম সবার মুখে মুখে ফিরছে। এলাকার মানুষ এতকাল পরেও বিশ্বাস করে, গেদু করাতির আত্মা এখনো জাগ্রত। করাতি ব্রিজ পাহারা দেয়। কোনো অপকর্ম করে কেউ ব্রিজ পার হতে গেলে গেদু কাউকে ক্ষমা করে না। বাসে একা পেয়ে ড্রাইভার, হেল্পার, কন্ডাক্টর তিন জনে মিলেই মেয়েটার ওপর চড়াও হয়েছিল। তাই দেখে করাতি ব্রিজের কাছে এসে মেয়েটাকে বাস থেকে ফেলে দিয়ে বাস নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় ব্রিজের মুখে এসে বাসটা উল্টে খাদে পড়ে। সেই থেকে সবার ধারণা, কোনো অপকর্ম করে বাস নিয়ে পালানোর সময় এমন দুর্ঘটনা হবেই। অন্য কোথাও হলে বলা হতো, তারা মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল, ড্রাইভারের পরিবর্তে হেল্পার চালাচ্ছিল, গাড়ির গতি বেশি। কিন্তু এখানে কেউ কোনো কারণ শুনতে রাজি নয়। সবার এককথা, কাজটা গেদু করাতির। তাদের কথা তো আর শুধু কথার কথা না। যুক্তিও আছে। বাসের মাথাটা খালের কাদার ভিতর পুঁতে গেছে। তিন জনই বাসের বাইরে মাথা কাদায় পোঁতা, পা ওপরের দিকে। এ রকম শাস্তি গেদু করাতি ছাড়া কারও কম্ম নয়। মেয়েটার তখন জ্ঞান ছিল না, নইলে সে বলতে পারতো কিভাবে দুর্ঘটনাটা ঘটলো। এছাড়া রাতের বেলায় এমন ফাঁকা মাঠের ভেতর আর কারও সে দৃশ্য দেখার তো প্রশ্নই ওঠে না।
গেদু করাতির পৈত্রিক পেশা ছিল করাতি। গাছ কেটে কাঠ চেরাই করা। গেদু ছোটবেলায় বাপের সঙ্গে জোগালি দিতে দিতে কাজ শিখেছিল। কিভাবে দড়ির প্যাঁচ দিয়ে গাছের গুঁড়ি মাচানে তুলতে হয়, কিভাবে গোঁজ দিয়ে কাঠের মাঝে করাত চালাতে হয়, কিভাবে কালি মাখানো সুতা ফেলে কাঠের সাইজ ঠিক করতে হয়। এসবই তার বাপের কাছে শেখা। বাপ মারা যাওয়ার পর নিজে তার দল নিয়ে করাতির কাজ করতেহা। একবার মল্লিক বাড়ির দরগার পেছনে একটা শেওড়া গাছ কাটতে গিয়ে তার কী যেন এক ঘটনা ঘটেছিল, তারপর সে করাতি পেশাই ছেড়ে দিলো। এত দিন আগের ঘটনা যে, কী ঘটেছিল, তা ঠিক করে জানা যায় না। কেউ বলে গেদু করাতি রাতের বেলায় স্বপ্ন দেখেছিল, কেউ বলে সে যখন গাছ কাটতে যায়, তখন গাছ তার সঙ্গে মানুষের মতো কথা বলে ওঠে। গাছ তাকে বলেছিল, ‘তুই আর গাছ কাটবি না। বরং যত গাছ কেটেছিস, তত গাছ লাগাবি। তাতে তোর মঙ্গল হবে। তুই যদি আমাকে কাটিস, তবে তোর অনেক ক্ষতি হবে।’
গাছ তার সঙ্গে মানুষের মতো কথা বলেছে। সে কথা কেউ বিশ্বাস করে, কেউ করে না। তবে পেশা ছেড়ে দেওয়ার পর সে যখন রাস্তার ধারে গাছ লাগানো শুরু করলো, তখন সে গাছেদের সঙ্গে কথা বলতো। বুদ্ধি-পরামর্শ করতো। গাছেরা নাকি তাকে ভবিষৎ বলে দিতো। সে সব কথা বিশ্বাসীদের কাছে সত্যি হতো, অবিশ্বাসীদের কাছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মনে হতো, গেদু করাতির মনগড়া কথা। তবে মাঝে মাঝে তারাও অবাক হয়ে লক্ষ করতো গেদুর কথা সত্যি। যেমন মুক্তিযুদ্ধের সময় সবাই যখন দ্বিধাধন্দ্বে, গ্রামে পাকবাহিনী আসবে কি না, তা নিয়ে; তখন গেদু ঘোষণা দিলো, গ্রামে পাকবাহিনী ঢুকবে আশ্বিন মাসে। গাছেরা নাকি তাকে এ কথা বলেছে। গেদু করাতির সেই কথা কেউ বিশ্বাস করেছে, কেউ করেনি। কিন্তু ঘটনা সত্যি হয়েছিল। গেদু করাতি গাছেদের সঙ্গে কথা বলতো আর সব নতুন নতুন তথ্য দিতো। মাঝে মাঝে সে নিজেই বুঝে উঠতে পারতো না গাছেরা তাকে কী বলছে। তখন সে সব কথা নিয়ে গ্রামের জ্ঞানী-গুণীদের সঙ্গে আলাপ করতো। গাছেরা নাকি তাকে বলেছিল, ছাইবাড়ির ব্রিজ পাহারা দিতে। ওই ব্রিজ দিয়ে যাওয়ার সময় পাক বাহিনী নাকি তার হাতে মারা পড়বে। কিন্তু আসার সময় কেন মারা পড়বে না, তা গাছেরা তাকে কিছু বলেনি। গাছেরা বলেছে, গ্রামের অনেক ক্ষতি হবে। গেদু করাতি বলতো, তিনারা নিজের থেকে না বললে তো বারবার জিজ্ঞাসা করা যায় না। তাতে তিনারা খুব রাগ করেন। গাছেদের রাগ নাকি মানুষের রাগের চেয়েও খারাপ।
যখন গ্রামে আর্মি ঢুকে বাড়ি-ঘরে আগুন দেওয়া শুরু করেছে, তখনো গেদু করাতি ছাইবাড়ি ব্রিজের ওপরে-নিচে ছোটাছুটি করছিল। সে দৃশ্য গ্রাম থেকে যারা ব্রিজের ওপর দিয়ে পালাচ্ছিল, তারা অনেকেই দেখেছে।
গেদুর গাছ ফাড়াই করা করাতির দেহ। হাত-পা নাড়ালে দেহের পেশীগুলো সব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেহে অনেক শক্তি কিন্তু তা দিয়ে না হয় দু’চার জন নিরস্ত্র পাক আর্মির মোকাবিলা সম্ভব, তাই বলে তিন ট্রাক সশস্ত্র আর্মিকে তো আর থামানো যাবে না। গেদু নাকি স্বপ্নে দেখেছে তিন ট্রাক আর্মি আসবে। সেদিন গ্রামে কী ধরনের ক্ষতি হবে, তাও নাকি সে স্বপ্নে দেখেছে। তাই অনেকের বাড়িতে গিয়ে সে কান্নাকাটি করে। গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে অনুরোধ করে। কারও কারও হাত-পা ধরে মাফ চায়। বৈশাখ মাসের দিকে যুদ্ধের শুরুতে সে যখন এসব কথা বলা শুরু করে, তখন মানুষ বিশ্বাস করুক বা না করুক, মন দিয়ে খুব আগ্রহ ভরে তার কথা শুনতো। সময় যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে গেদু করাতির আচরণও কেমন যেন ক্ষ্যাপা পাগলের মতো হয়ে ওঠে। মানুষ আর তার কথার তেমন গুরুত্ব দিতো না। সবাই ভাবতো, আস্তে আস্তে সে পাগল হয়ে যাচ্ছে।
গেদু করাতি মুক্তি বাহিনীর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল। আশ্বিন মাসের দিকে যখন তাদের গ্রামে আর্মি আসবে, তখন যেন তারা প্রস্তুত থাকে গ্রামটাকে রক্ষা করার জন্য। বিশেষ করে ছাইবাড়ির ব্রিজের কাছে পাক বাহিনীকে কিভাবে মোকাবিলা করা যায়, যেন তারা গ্রামে ঢুকতেই না পারে। মুক্তিবাহিনীও তাকে আশ্বস্ত করেছিল সময়মতো খবর পেলে তারা অবশ্যই পাকবাহিনীর মোকাবিলা করবে।
সবাই মনে করেছিল পাকবাহিনী গ্রামে এলে ছাইবাড়ির ব্রিজ পার হয়েই গ্রামে আসবে। অন্য কোনো দিক থেকে আসার কথা নয়। শহর থেকে গ্রামে ঢোকার এটাই একমাত্র পাকা রাস্তা। অথচ আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি, সঠিকভাবে বললে ১৭ আশ্বিন গ্রামে আর্মি ঢুকল উল্টো দিক থেকে মাটির কাঁচা রাস্তা দিয়ে।
গেদু করাতি আশ্বিনের শুরু থেকেই ছাইবাড়ি ব্রিজের নিচে কাঁথা-বালিশ নিয়ে স্থায়ী পাহারা বসিয়েছে। পাগলের মতো একা-একা প্রলাপ বকে। গাছেদের সঙ্গে কথা বলে। গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা আক্ষেপ করে, ‘গেদু ছেলেটা শেষ পর্যন্ত পাগলই হয়ে গেলো। ঘর-সংসার ছেড়ে একেবারে রাস্তার ছুটাপাগল হয়ে গেলো।’ যখন গ্রামে আর্মি ঢুকে বাড়ি-ঘরে আগুন দেওয়া শুরু করেছে, তখনো গেদু করাতি ছাইবাড়ি ব্রিজের ওপরে-নিচে ছোটাছুটি করছিল। সে দৃশ্য গ্রাম থেকে যারা ব্রিজের ওপর দিয়ে পালাচ্ছিল, তারা অনেকেই দেখেছে। অনেকে তাকে পালানোর জন্যও বলেছে। গেদু করাতি উল্টা তাদেরই দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া দিয়েছে।
পাক-আর্মিরা সেদিন গ্রামের সব বাড়ি-ঘরে আগুন দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে যাদের সামনে পেয়েছে, তাদেরই গুলি করে মেরেছে। গ্রাম থেকে নয় জন মেয়েকে তাদের ট্রাকে তুলে নিয়ে পাকা রাস্তা ধরে শহরের দিকে রওনা হয়েছিল।
এলাকার মানুষ এখন বিশ্বাস করে যে, সারাদেশে এমন হাজারও গেদু করাতি আছে। তাদের যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি।
ট্রাক তিনটি যখন একে একে ব্রিজের ওপরে ওঠে, তখনই একটা বিকট শব্দ হয়। ব্রিজসহ তিনটি ট্রাকই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আর্মিদের লাশগুলো টুকরা টুকরা হয়ে মাঠের মধ্যে ছিটিয়ে পড়ে। আশেপাশের গ্রাম থেকে মানুষ দেখেছে, শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর্মির ট্রাকগুলো কাগজের টুকরার মতো আকাশে উঠে গেছে। তারপর টুকরা টুকরা হয়ে চারিদিকে শিলাবৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে। দু’চার জন আর্মি, যারা তখনো বেঁচে ছিল, গ্রামের লোকজন তাদের পিটিয়ে মেরেছে। এই ঘটনার পর গেদু করাতির আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমনকি তার লাশও খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। তবে, সবাই নিশ্চিতভাবে মনে করে যে, গেদু করাতি ওই ঘটনায় মারা গেছে। ঘটনাটা কিভাবে ঘটেছে, তা ঠিক করে কেউ না জানলেও দু’রকম বিশ্বাস প্রচলিত আছে। বেশিরভাগ মানুষ মনে করে, গেদু করাতি মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে ডিনামাইট জাতীয় কোনো কিছু সংগ্রহ করে ব্রিজের নিচে পুঁতে রেখেছিল। অন্যদের মত, গেদু করাতি অলৌকিক কিছু শক্তি লাভ করেছিল, যা দিয়ে সে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। যুক্তি হিসেবে তারা বলে, অলৌকিক শক্তি না থাকলে ছয় মাস আগেই সে এসব ঘটনা জানলো কিভাবে। সে যে ঘটনা যেভাবে বলেছিল, ঘটনার দিন ঠিক সেভাবেই সব কিছু ঘটেছে। সে বলেছিল, আশ্বিনের মাঝামাঝি তিন ট্রাক আর্মি আসবে, গ্রামের অনেক মানুষ মারা যাবে, ঘটনা ঘটিয়ে ফেরার পথে ছাইবাড়ি ব্রিজে পাক আর্মিরা সবাই মারা যাবে। এই সব কথাই যখন অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে, তখন এটা বলাই যায় যে, সে তার অলৌকিক ক্ষমতা বলেই এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে ঘটনা যেভাবেই ঘটে থাকুক, রাতারাতি ছাইবাড়ি ব্রিজের নাম হয়ে গেল করাতি ব্রিজ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ওখানে যখন নতুন ব্রিজ তৈরি করা হলো, তখন এলাকার লোকের চাপে ব্রিজের সরকারি নাম দেওয়া হলো, শহীদ গেদু করাতি ব্রিজ।
স্বাধীনতার বছর দেড়েক পরের ঘটনা। তখন অনেকের হাতেই অস্ত্র, আইনশৃঙ্খলা অবস্থা বেশ নাজুক। মাঝে-মধ্যেই গ্রামের ধনী বাড়িতে রাতে ডাকাতি হয়। এমনি এক ডাকাতি শেষে বাড়ির এক নতুন বউকে চার জন ডাকাত মিলে ধর্ষণ করে। পরদিন সকালে চার ডাকাতেরই লাশ পাওয়া গেলো করাতি ব্রিজের নিচে। চার জনেরই মাথা কাদার ভেতরে, পা আকাশের দিকে। এলাকার মানুষের দৃঢ়বিশ্বাস, এই কাজ গেদু করাতির। সে মারা গেলেও তার আত্মা এই এলাকাতেই বিচরণ করে। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে এখনো সে সক্রিয়।
এরপর অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে করাতি ব্রিজে। অনেকেই রাতের বেলা নাকি তাকে দেখেছে ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, কেউ কেউ দেখেছে গাছের সঙ্গে কথা বলতে। কোনো অপকর্ম করে মানুষ করাতি ব্রিজ পার হতে ভয় পায়। একবার এক থানার দারোগা এলাকার এক নারীকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলে। চারদিকে জানাজানি হওয়ার পর দারোগা ওই নারীকে খুন করে রাতে ব্রিজের ওপর দিয়ে ফিরছিল। পরদিন সকালে ব্রিজের মুখে গাছের ডালে তার ঝুলন্ত লাশ মিললো।
একবার এক নির্বাচনের পর জয়ী দলের কয়েকজন কর্মী পরাজিত দলের এক সমর্থকের বাড়িতে হামলা চালায়। বাড়ির নারীদের ওপর চড়াও হয়। জয়ী দলের সমর্থক হওয়াই তাদের এই অপকর্মের কোনো বিচার হয় না কিন্তু গেদু করাতি তাদের বিচার করেছিল গাছে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।
বিশেষ করে, নারীদের ওপর কোনো অত্যাচার হলে গেদু করাতির হাত থেকে তার রক্ষা নেই। গেদু করাতি মুক্তিযুদ্ধের কোনো ট্রেনিং নেয়নি, মুক্তিযুদ্ধেও যায়নি। বেঁচে থাকলে হয়তো মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেটও পেতো না। এলাকার মানুষ এখন বিশ্বাস করে যে, সারাদেশে এমন হাজারও গেদু করাতি আছে। তাদের যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি।