ফরিদ মুন্সির শখ ছিল লেখালেখি করা। বড় লেখক হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল প্রবল। মাত্র তেরো বছর বয়সে তার লেখা প্রকাশ হয়ে গেলো। সেই লেখা নিয়ে তুমুল হৈচৈ।
আব্বা মুগ্ধচোখে পুত্রের মুখে তাকিয়ে রইলেন। এরপর চিৎকার করে বললেন, ফরিদের মা! সবচে বড় মোরগটা জবাই করো। তোমার ঘরে আল্লাহ-তাল্লাহ লেখকপুত্র পাঠিয়েছেন! রান্নাঘর থেকে মায়ের গলা ভেসে এলো, সন্ধ্যাবেলা পালের পশুপাখি জবাই করা যাবে না। তাছাড়া আমার রান্না-বান্না শেষ।
নূর মোহাম্মদ ক্ষুণ্ণ গলায় বললেন, তোমার পুত্রের আজ লেখক হিসেবে অভিষেক। মা বললেন, স্কুল ম্যাগাজিনে একটা কবিতা ছাপলেই কেউ লেখক হয়ে যায় না। পুত্রের মুখে তাকালেন বাবা, তোর জননীর আজ মেজাজ ঠিক নেই। ব্যাপার হয়েছে কী—হাট থেকে কাঁচা মরিচ আনতে ভুলে গেছি। ঠিক ভুলে গেছি তাও না। মরিচ কেনার আগেই পয়সা ফুরিয়ে গেলো। চলো বাজারে যাই। তোকে মিষ্টিমুখ করিয়ে আনি।
নিখিল ময়রার দোকানে ফরিদ রসগোল্লা খাচ্ছে। পরম তৃপ্তি নিয়ে পুত্রের মিষ্টি খাওয়া দেখছেন নূর মোহাম্মদ। দু’টি রসগোল্লা শেষ হলে নূর মোহাম্মদ বললেন, আর দু’টি নে। মিষ্টি ফরিদের খুব প্রিয় জিনিস। আরও দশ-বারোটা সাবার করা কোনো ব্যাপারই না। তবু ফরিদ বলল, আব্বা, আর পারবো না।
ফরিদের মুখে নিখুঁত বাবা ভুলানো হাসি।
নূর মোহাম্মদ বললেন, আর দুটি নে। এই নিখিল দা, আর দুটি দাও। ঝোল দিও বেশি করে। অ্যাঁ রে, তুই আবার টাকার কথা ভেবে কম খাচ্ছিস না তো? তুই তো আবার মাতৃ-স্বভাব পেয়েছিস।
ফরিদ উত্তর না-দিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো।
নূর মোহাম্মদ বললেন, আরে অভাব কি সারা জীবন থাকবে নাকি? কয়ে-বলে স্কুলটা সরকারি হলে দেখবি আর কোনো অভাব নেই।
ফরিদের পিরিচ আবারও শূন্য হয়ে গেছে।
নূর মোহাম্মদ বললেন, আর তিনটে নে। যতক্ষণ পারবি খাবি। তার আগে উঠবি না, পিতৃ-আজ্ঞা। পিতৃ-আজ্ঞা ভাঙলে কী হয়, জানিস তো? জীবনে কখনো উন্নতি হয় না। ও নিখিল দা, আর চার-পাঁচটা দাও তো।
ফরিদ একে একে চৌদ্দটা রসগোল্লা খেয়ে বলল, আব্বা, সত্যি সত্যি আর পারবো না।
নূর মোহাম্মদ সপ্রশংস দৃষ্টিতে পুত্রের মুখে তাকিয়ে বললেন, তুই তো আমার বাপকে ছাড়িয়ে গেলি রে!
নিখিল ময়রা তার হলুদ দাঁত বের করে বললো, মাস্টারের পুলা তো ‘রেকর্ড’ বানায় ফেললো! নিখিল ময়রার চৌদ্দটা রসগোল্লা এক বসায় জীবনে কেউ খেয়েছে?
বাড়ির জন্য এক হাড়ি রসগোল্লা নিয়ে নূর মোহাম্মদ বলল, নিখিল দা, টাকা সামনে মাসে বেতন পেলে নিও। নিখিল ময়রা জিব কেটে বললো, লজ্জা দেন ক্যান মাস্টার সাব? টাকা পয়সাই কি সব? সে আপনার যখন ইচ্ছা দেবেন।
বাড়ি ফেরার পথে এশার আযান হয়ে গেলো।
তখনো গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নূর মোহাম্মদের বাম হাতে মিষ্টির হাড়ি। ডান হাতে পুত্রের হাত। বাবার হাত ধরে অন্ধকার পথে চলতে চলতে ফরিদ জিজ্ঞেস করলো, আব্বা, সরকারি স্কুলে যে-বই পড়ায় তোমার স্কুলেও সেই বই। তাহলে তোমাদের বেতন কম কেন?
নূর মোহাম্মদ বললেন, বাবারে, এটাই জগতের নিয়ম।
ফরিদ বলল, এটা আবার কেমন নিয়ম?
অনিয়মের নিয়ম। একজন লেখকের দায়িত্ব এইসব অনিয়ম দূর করা।
নূর মোহাম্মদ আরও যেন কী বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সেই মুহূর্তেই ঘটে গেলো ব্যাপারটা। একটা প্রকাণ্ড দাঁড়াশ সাপ নূর মোহাম্মদের পাড়া খেয়ে পা’ পেঁচিয়ে ধরেছে। সমুদ্রের গর্জনের মতো ফোঁস ফোঁস করে একের পর এক ছোবল। আতঙ্কে চিৎকার করছেন নূর মোহাম্মদ। তার হাত থেকে পুত্রের হাত খসে গেছে। মিষ্টির হাঁড়িটা পড়েছে দাঁড়াশের গায়।
ফরিদ কী করবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। হতবিহ্বলের মতো ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে আছে অন্ধকারে। তিনজন হাটুরে বাড়ি ফিরছিল। তাদের হাতে হারিকেন। নূর মোহাম্মদের চিৎকার শুনে তারা যতক্ষণে কাছে এলো আজরাইল ততক্ষণে টুঁটি টিপে ধরেছে। বাজারে শান্তি ডাক্তারের ঘরের বারান্দায় পৌঁছাতেই সাঙ্গ হলো ভবলীলা।
কবর হয়ে গেলে হায়দার মাওলানা বললেন, সাপের কামড়ে মৃত্যু বড় সৈভাগ্যের বিষয়। চিন্তার কিছু নাই ফরিদ। তোমার পিতাজি সরাসরি জান্নাতে দাখিল হবেন। মাওলানা সাহেব চিন্তার কিছু নাই বললেও দেখা গেলো অনেক বড় চিন্তা কাঁধে চেপে বসেছে। পিতার অবর্তমানে ছোট বোন আর মায়ের দায়িত্ব এখন ফরিদের। মাত্র তেরো বছর বয়সে তাকে রোজগারের ধান্দায় নামতে হলো।
সপ্তায় তিন দিন সে ক্লাস করে।
বাকি চার দিন ভাড়া ভ্যান চালায় কিংবা কারও ক্ষেতে কাজ করে। পরের বছর সে নিচের ক্লাসের ছেলে-মেয়েদের প্রায়ভেট পড়ানো শুরু করলো। সেই যে শুরু তারপর সংসারের ঘানি টেনে কেটে গেছে কুড়িটি বছর।
ঘরে তো কোনো কুপি নেই। রান্নাঘরে গেছ আমাকে ডাকোনি কেন? টুকটুকির বাপ! টুকটুকির বাপ কোনো কথা বললো না।
এতদিনে এইচএসসি পাস করেছে ছোট বোন। ফরিদ বিএ পাস করে একটা এনজিও’তে ঢুকেছে। ছোট বোনের বিয়ে দিয়ে সে নিজেও বিয়ে করে এখন সংসারী। সংসারে মা ও বউ ছাড়া আছে পাঁচ বছরের মেয়ে টুকটুকি। সব মিলিয়ে সে একজন সফল সুখী মানুষ। তবু বুকের ভেতর ইদানিং কেন যেন চিনচিনে ব্যথা হয়। মনে হয় কী একটা কাজ যেন করা হয়নি। অথচ কাজটা খুব জরুরি। খুব প্রয়োজন। কিন্তু কাজটা কী?
দুই.
বেলা দ্বিপ্রহর।
কিস্তি উঠিয়ে ফরিদ ভাটদী থেকে সাইকেলে ফিরছে। পিচঢালা সরু রাস্তার পাশে পাশে বয়ে চলেছে ক্ষীণাঙ্গ কুমার নদ। নদের স্বচ্ছ জলে তাকালে এই দুপুর রোদে বেশ শান্তি শান্তি লাগছে। মল্লিক বাড়ির মোড় পেড়িয়ে ফরিদ সাইকেল থামালো।
রাস্তার ধারে একটা প্রকাণ্ড বট গাছ। নিচে ক্ষীণাঙ্গ নদের জলে বটের ছায়া। মৃদু বাতাস বইছে। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ফরিদ গাছের ছায়ায় বসলো। স্বচ্ছ জলে তাকিয়ে থাকতে তার ভালো লাগছে। ঝিরিঝিরি বাতাসে শরীর জুড়িয়ে আসছে। কেমন ঘুম ঘুম ভাব তবু ঘুম আসছে না। শরীরজুড়ে একটা অলৌকিক আলস্য। চোখের পলক ফেলতেও ইচ্ছা করে না।
অপলক নদের জলে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফরিদ দেখলো খুব ধীরে একটা নৌকা ভেসে চলেছে। সাদা সেই নৌকার পাল সাদা। হাল ধরে কোনো মাঝি বসে নেই। কেবল পাটাতনে দাঁড়ানো এক শুভ্র সাধু। সাধুর শুভ্র কেশ, শুভ্র দাড়ি। পড়নে শুভ্র বসন। মুখখানা হাসি হাসি।
ফরিদের খুব ইচ্ছা করছে গলা ছেড়ে সাধুকে ডাকে, ও সাধু, কই থেকে এলে তুমি, গন্তব্য কোথায়?
এমন সময় সাধুর মোলায়েম কণ্ঠ ভেসে এলো, কি রে ব্যাটা ঘুম পায়? ঘুম পেলে তো হবে না। জীবন হচ্ছে একটা দ্বিচক্রযান। যাকে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়াতে হয়। থামলেই পতন নিশ্চিত।
ফরিদ জিজ্ঞেস করতে গেলো—আপনি কে? ঠিক তখন সে বুঝতে পেলো সাধুর চেহারা অবিকল তার আব্বার মতো! হ্যাঁ, আব্বাই তো! সাধুর মুখে কৌতুকের হাসি, এত দ্রুত ভুলে গেলি? ফরিদ বিড়বিড় করছে, না আব্বা, ভুলিনি তো! কক্ষনো ভুলিনি।
ভুলিসনি? তাহলে পরের টাকা পরকে ধার দিয়ে তুই ঘুরে মরিস কেন? তোর তো একাজ না।
সাধুর কথার আগামাথা না বুঝে ফরিদ ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে রইলো।
সাধু হাসছেন, কি রে বুঝলি না?
না আব্বা। বুঝিয়ে বলেন।
আমি তো কিস্তিওয়ালার বাপ হতে চাইনি। স্বপ্ন ছিল পুত্র বড় লেখক হবে। আমার গল্প কোথায় ফরিদ?
হাস্যমুখী সাধুর নৌকা মোড়ের আড়ালে হারিয়ে গেলো।
‘আব্বা! আব্বা’! ডাকতে ডাকতে ফরিদ সেদিকে ছুটতে গিয়ে বটের জটে পা বেঁধে হুমড়ি খেলো। মুখ তুলে দেখলো কোথাও কেউ নেই। কেবল বটের পাতায় বাতাসের শোঁ-শোঁ আওয়াজ।
তিন.
সব শুনে সেতু বললো, তুমি স্বপ্ন দেখেছ।
স্বপ্ন দেখেছে, তা ফরিদও জানে। তবু স্বপ্ন বলে বিশ্বাস হয় না। সেটা বড় ব্যাপার না। বড় ব্যাপার হচ্ছে দীর্ঘ বিশ বছর লেখালেখির কথা সে ভুলে থাকলো কিভাবে? অথচ তার পিতার সাধ ছিল ছেলে বড় লেখক হবে। ঝেঁটিয়ে দূর করবে সব অন্যায় অনিয়ম।
এই ভাবনা প্রতিমুহূর্তে ফরিদকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
ফরিদ নিয়ম করে প্রতি রাতে টেবিলে বসে কিন্তু কিছুই লিখতে পারছে না। গভীর রাত পর্যন্ত খাতায় আঁকিবুঁকি করে ঘুমাতে যায়। ঘুম ভাঙে দুপুরে। দুপুরের পর বটতলা বসে অপলক চেয়ে থাকে নদের দিকে। অফিস কামাই। কিস্তি উঠানো হয় না। অল্প বয়সী ম্যানেজার একদিন বাসায় এসে সব শুনলেন। তারপর মায়া মায়া চোখে বললেন, ফরিদ সাহেব, আপনি বরং কিছুদিন ছুটিতে থাকেন। আপনার এখন বিশ্রাম প্রয়োজন। ম্যানেজারের মুখে তাকিয়ে ফরিদ ম্লান হাসলো।
সে রাতে কুচকুচে আঁধার, ঘোর অমাবস্যা। টেবিলল্যাম্প জ্বেলে ফরিদ গভীর মনোযোগে খাতায় শাপলা আঁকছে। রাত তখন দু’টা। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলো। কার যেন পায়ের আওয়াজ! ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই কুপি হাতে নূর মোহাম্মদ এসে দাঁড়ালেন। আজ সে চব্বিশ-পঁচিশ বছরের সুদর্শন যুবক। মাথাভর্তি কুচকুচে কালো চুল। ক্লিন সেভড। গায়ে হাফহাতা নীল শার্ট, কালো প্যান্ট। মুখখানা হাসি হাসি।
নূর মোহাম্মদ বললেন, কিরে খুব বিপদে ফেলে দিয়েছি, না?
ফরিদ কী বলবে বুঝতে না পেরে মৃদু হাসলো।
নূর মোহাম্মদ বললেন, সমস্যা কি খুবই বড়?
ফরিদ হতাশ গলায় বললো, রাতের পর রাত টেবিলে বসে আছি। কিন্তু মাথায় লেখা আসছে না। নূর মোহাম্মদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে, লেখা মাথায় এলে লাভ কি রে বোকা? লেখা আসতে হবে বুকে। তা না হলে লেখা প্রাণ পাবে না।
ফরিদ মাথা ঝাঁকায়, আমি আসলে গল্প পাচ্ছি না।
নূর মোহাম্মদের হাসি আরেকটু বিস্তৃত হলো, গল্প না পাওয়ার কী আছে? চারিদিকে তো গল্পেরই ছড়াছড়ি। গল্প আছে তোর খুব কাছে, গল্প আছে খুব দূরে। গল্প আছে বাইরে, গল্প ঘরেই ঘোরে। হরেক রকম গল্প…হরেক রঙের গল্প…গল্প হরেক স্বাদের…। কয়টা কে তুই লিখবি? জীবন তো ফুরন্ত। গল্প অফুরন্ত। তাই ধরবি শুধু মানবিকতা, মহানুভবতা, প্রেম আর ভালোবাসার গল্পগুলো। যেন পাঠক আনন্দ পায়। মন বড় হয়। নীচতা যায় ধুয়ে-মুছে। নে এখন খপ করে একটা গল্প ধর আর টপ করে লিখতে শুরু কর। মনে থাকে যেন—পিতৃ আজ্ঞা। পিতৃ আজ্ঞা লঙ্ঘিলে নরক অনিবার্য।
নূর মোহাম্মদ টেবিলে কুপি রেখে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন।
সঙ্গে সঙ্গে সেতুর উদ্বিগ্ন গলা ভেসে এলো, এই কী হলো? টুকটুকির আব্বু কী হলো? লাইট অফ কেন? লাইট জ্বালো।
টুকটুকি হঠাৎ ঘুম ভেঙে কাঁদতে শুরু করলো। লাইট জ্বলে উঠলো, ফ্যান ঘুরছে।
সেতু চোখ বড় বড় করে বললো, কুপি পেলে কোথায়? ঘরে তো কোনো কুপি নেই। রান্নাঘরে গেছ আমাকে ডাকোনি কেন? টুকটুকির বাপ!
টুকটুকির বাপ কোনো কথা বললো না।
চার.
পরের দুই-তিন দিনেও গল্পের দেখা মিললো না। একে তো পিতৃ আজ্ঞা পালন হচ্ছে না, তার ওপর রাত জেগে জেগে ফরিদের মেজাজ খিটখিটে। টুকটুকি স্কুল থেকে ফিরে জুতা খুলে দিতে বললে সে বললো, খুলে নাও। বুড়ি ধাড়ি হয়েছ, এখনো জুতার ফিতা খুলতে পারো না? তোমার মা করেটা কী? সারাদিন বসে বসে খায় আর পড়ে পড়ে ঘুমায়?
টুকটুকি তবু ঘ্যানঘ্যান করে যাচ্ছে দেখে ফরিদ কষে থাপ্পড় মারলো।
পরের দিন মায়ের ওষুধ ফুরিয়ে গেলে ফরিদ আনতে ভুলে গেলো।
তার পরদিন সেতু বাজারের ব্যাগ এগিয়ে দিলে সে মুখের ওপর ব্যাগ ছুড়ে গৌতম বুদ্ধের মতো বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।
পাঁচ.
তারপর গ্রামে-গ্রামে শহরে-নগরে কত দিন কেটে গেলো। পতিতাপল্লী থেকে পীরের দরগা কত স্থানে ঘোরা হলো। তবু গল্প মিললো না।
এখন ফরিদের বেশবাস পথের ফকিরের মতো।
গায়ের চামড়া ধূলায় ঢাকা। পড়নের কাপড় নোংরা। চুল-দাড়ি রুক্ষ আর মাথাভর্তি উকুন। আধপেটা খেয়ে না-খেয়ে শরীর শুকিয়ে অস্থিচর্মসার।
সেতুর মুখে হাসি। বিছানায় উঠে বসেছেন মা। টুকটুকিকে জড়িয়ে ধরে ফরিদের মনে হলো, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গল্পটা সে পেয়ে গেছে!
দু’মাস কেটে গেছে।
এদিকে চিন্তায় চিন্তায় শরীর ভেঙে গেছে সেতুর। ফরিদের মা শয্যাশায়ী। টুকটুকি আর আগের মতো চঞ্চল নেই। বড় বড় চোখে সে আব্বুর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে আর মাঝে মাঝে জানতে চায়—আম্মু, আব্বু কবে আসবে?
সেতু তখন চোখের পানি গোপন করে বলে, আসবে মা, এই তো চলে আসবে।
টুকটুকি জানতে চায়, কবে? ঈদে?
সেতু মাথা নাড়ে, হু, মা।
এবার সেতু আর অশ্রু লুকাতে পারে না। তার চোখ থেকে টপটপিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
ছয়.
ফরিদ রাজবাড়ি রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে কুটুস কুটুস করে উকুন মারছে। উদ্দেশ্য কুষ্টিয়া যাবে লালন শাহ’র মাজারে। এবার নিশ্চয় একটা গল্প জুটে যাবে। ট্রেন আসতে বিলম্ব হচ্ছে। অতএব বসে বসে উকুন মারাই উত্তম কর্ম।
ফরিদের হঠাৎ খেয়াল হলো স্টেশনে বড্ড ভিড়।
কারণ কী? কোনো ঝামেলা-টামেলা না তো?
এইসময় হুইসেল বাজাতে বাজাতে একটা ট্রেন এসে থামলো। ফরিদ অবাক হয়ে দেখলো জানালার ওপাশে তার আব্বা বসা। সেই নৌকায় বসা সাধুবেশ। শুভ্র কেশ, শুভ্র দাড়ি। পরনে শুভ্র বসন। মুখখানা হাসি হাসি।
আব্বা বললেন, এই ফরিদ, এই! তুই এখানে কী করিস? আগামীকাল ঈদ। সবাই বাড়ি যাচ্ছে আর তুই বসে বসে উকুন মারছিস!
ঝম-ঝমা-ঝম শব্দ তুলে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। নূর মোহাম্মদের কথা আর শোনা যাচ্ছে না। আজ বহুদিন পর ঝম-ঝমা-ঝম ছন্দে টুকটুকি, মা আর সেতুর মুখখানা হঠাৎ ফরিদের চোখে ভেসে উঠলো। ঠিক তখনই একটা অপরাধবোধ আর মধুর আনন্দে ছেয়ে গেলো বুক।
সাত.
ফরিদ বাড়ি পৌঁছালো ঈদের দিন বিকালে।
বারান্দায় ম্লান মুখে বসে ছিল সেতু। তার পাশে পাটিতে মা শোয়া। দাদির পাশে গম্ভীর মুখে বসে আছে টুকটুকি। তার হাতে আব্বুর একখানা ‘ফোর আর’ সাইজ বাঁধানো ছবি।
ফরিদকে দেখেই কচি গলায় চেঁচিয়ে উঠলো টুকটুকি, আম্মু, আব্বু এসেছে! আব্বু এসেছে!
ফরিদের মনে হচ্ছে একহাজার পাখি একসঙ্গে গাইলেও এমন মিষ্টি সুর হবে না! টুকটুকি ছুটে এসে আব্বুকে জড়িয়ে ধরেছে। সেতুর মুখে হাসি। বিছানায় উঠে বসেছেন মা। টুকটুকিকে জড়িয়ে ধরে ফরিদের মনে হলো, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গল্পটা সে পেয়ে গেছে!
আরও পড়ুন: নির্বাচিত নবীনের কবিতা