ময়ূরের পুচ্ছ দেখে কাক ছুঁয়েছি
কাক কি আর পোষার পাখি!
বাঁধন খোলা সে কাকের প্রাণে যে বেদনা রাখা আছে
সে তো এখন ওই কাকের মর্মহীন সমূহ বালি;
আমার গেল মুক্তাদানায় অমূল্য বর্ণ কিছু
অযথাই তার নকল পালক সাজিয়ে লেখা…
হারানো মুক্তা নাকি ওই কাকের জন্যই অহোরাত্র বিলাপ এখন;
কাক ও মুক্তা একা কেউ নয়, দুয়ে মিলে কথা কয় ভিন্ন সংযোজন।
কবিতাটির নাম ‘কাক’। অনুজ কবি বিদ্যুৎ বিহারিকে মেসেজ দিলাম—‘কাক’ নামে একটি কবিতা লিখে এইমাত্র পোস্ট করেছি। আমার টাইমলাইনে ঢুকে ওটা পড়। এরপর কেমন হলো জানা। ভালো লাগলে একটা কমেন্ট কর। একজন আমাকে ফেসবুকে হাত-পা ধরে তার প্রেমে ফেলেছিল। আর আমিও পড়ে যখন টালমাটাল করছি, মানে ভাবছি, মিষ্টি কথা চালাচালি করতে করতে শেষে না ধরা খাই। বয়সে ছোট যেহেতু, সেহেতু আমি যদি আগে মরি, তাই বিয়েটিয়ে করতে বাধ্য হলে, নির্ঘাত দু’দিনের সে সোয়ামী আমার সম্পত্তির একটা বড় অংশ বের করে নিয়ে চলে যাবে। মেয়েমানুষের কী এক জ্বালা! ছেলেমেয়ের সঙ্গে আমি জেনেশুনে এমন একজন সবল প্রতিপক্ষ এনে প্রতিষ্ঠিত করে যাব, এটা অসম্ভব!
বহুবছর আগে এরকম মিষ্টি কথা চালাচালি করতে করতে ফেঁসে গেছিলাম। শেষে তার জোর দাবির মুখে আমি তাকে বলেছিলাম, ঠিকা আছে, বিয়ে করতে রাজি, কলমা হবে। কিন্তু কাবিন হবে না…। আমার দিকে তাকিয়ে সেজন বলেছিল, কারণ কী? মহিলারাই তো মোটা অঙ্কের টাকার কাবিন করতে বলে। আমি বলেছিলাম, আমার তাতে দরকার নেই। কিন্তু আমার টুকুতে যেন অন্য কেউ নখ বসাতে না পারে!
কিন্তু এই নতুন প্রেমিকের সঙ্গে কথা সে পর্যন্ত গড়ায়নি। শুধু একটু টাল অবস্থার ভেতর পড়ে গেছিলাম। তবে পড়েছিলাম তো তাকে খুশি করতেই। সে আমার থেকে ‘তুমি’ সম্বোধন পেতে বুক ফেটে মরেই যাচ্ছিল। শেষে নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার মতোই শুরু করলাম ‘তুমি’ ‘তুমি’ লেখা। ক’দিন না যেতেই একদিন নতুন প্রেমিক আমাকে মেসেঞ্জারে লিখলো, তোমার একখানা ছবি পাঠাও।
আমি আশ্চর্য হয়ে লিখলাম, বরাবর আমি এত ছবি পোস্ট করছি, তুমি পাঁচ বছর ধরে আমার সঙ্গে অ্যাড আছ। এতদিনে দেখোনি যে, এখন আমি তোমাকে আলাদা করে ইনবক্সে ছবি পাঠাতে যাবো! তাহলে তুমি আমাকে ভালো করে খেয়াল না করেই আমার প্রেমে অমন গদগদ হয়েছিলে?
সে আমাকে বললো, ঠিকাছে, তুমি খালি বলো, তুমি কত সাইজ ইয়ে…পরো।
বিদ্যুৎকে লিখলাম, আমিও কি কম চালাক! আমি একেবারে দশ নাম্বার কমিয়ে লিখলাম! কিন্তু লিখলাম যে, সে তা বিশ্বাস করলো কিনা, তা বোঝার সময় না নিয়েই আমার হঠাৎ মেজাজ ঠা ঠা করে তেতে উঠতে লাগলো। আমি তাকে আবার লিখলাম, তুমি আমাকে ছবিতে ভালো করে পরখ না করেই আমার প্রেমে পড়লে কেন? গাধা কোথাকার! পড়েছ তো পড়েছ, আমাকেও পিছলা কাদার মতো টান মেরে ফেলেছ! ভালো করে জেনে রাখো, আমি দেখতে তামাটে। মুখে রোদের আঁচড়ের দাগ। কারণ আমার জীবনটা সুখকর নয়, একেবারে মাটি কাটা শ্রমিকের মতো। আর এরকম একজন পঞ্চাশোর্ধ নারীর লাবণ্য কতটা আর পেলব থাকতে পারে? কিন্তু আমার একার তো একটা গৌরবের জায়গা আছে, আমি শিল্পমগ্ন মানুষ। বিধাতা প্রদত্ত ছাড়াও আমার নিজের কিছু অর্জন আছে। তুমি কি অবশেষে আমাকে শুধুই চামড়া ছিলা গরু-ছাগলের মাংসের দামে নামিয়ে আনলে?
দেখলাম, দু’দিনেও তার উত্তর নেই। বুঝলাম, ছ্যাঁক খেয়েছি। সেই দুঃখে একটা কবিতা লিখে পোস্ট করলাম। বুঝলি?
কম্পিউটারের বাটনে থেকেই কত কী পেছনের কথা মনে উদয় হতে লাগলো। একবার আমাদেরই গ্রামের একজন ঢাকায় যাকে বলে খুব জাঁদরেল পেশায় নিয়োজিত। পেশাটা এখানে এখনই লিখলে ঢিঁঢিঁ পড়ে যাবে। তো তিনি আমাদের বাসায় ঘনঘন আসতে লাগলেন। ভাববাচ্যে বোঝাতে লাগলেন, তিনি আমাকে খুব ভালোবাসেন। আমি তার সামনে চা রেখে পায়ের ওপর পা তুলে বসে বোঝাতে চেষ্টা করি, ভালোবাসার মতো মানুষকে তো ভালোই বাসতে হয়। তাই আমাকে আপনিও বাসেন। এ আর নতুন কথা কী! রূপে ভোলাতে পারব না, কিন্তু গুণ উৎপন্ন করে মনে হয়, স-ব পুরুষের নজর আমাকে কেন্দ্র করে থাকুক!
কিন্তু তিনি আমার তাচ্ছিল্য গায়ে মাখেন না! শেষে দু’চারজনকে বলেই ফেলি, তিনি ওকালতি পাস করছেন কী করতে? কাউকে কিছু বলে ফেললেও কখন থামতে হবে এটুকুও তিনি বোঝেন না! রামছাগলের অধিক একটা। এই বমি বমিভাবের ভেতর আমার এক সরকারি কর্মকর্ত্রী বান্ধবী, জরুরি কথা আছে বলে আমাকে একদিন ডেকে পাঠালেন তার অফিসে। গেলাম। বান্ধবী মুচকি হেসে বললেন, আপনার ওই একই গ্রামের কাজিন আপনাকে ভালোবাসে। বান্ধবীকে আমিই তার বাড়িতে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। পরে দেখলাম, তারা তারা খুব খাতির! অবশ্য তাতে আমার ভালোই লেগেছিল। কিন্তু সেদিন মেজাজ এত খারাপ হলো যে, আমি তার সামনেই গলার নিচ থেকে একদলা থুথু টেনে বের করলাম। তারপর দূরে গিয়ে ওয়াক করে ফেলে এসে, সেই বান্ধবীকে বললাম, এই থু তোমার জন্য! কারণ আমি বলছি না, ভালোবাসাবাসি খারাপ কিছু। কিন্তু তুমি যে এসবের ঘটকালি শুরু করেছ, তাতেই আমার বমি। ভালোবাসা যদি দুর্ঘটনার মতো করে আসে, সেটাতে কোনো গ্লানি নেই। কিন্তু শেয়ালের মতো ওঁৎ পেতে থেকে কেউ যদি কাউকে কব্জা করে, সেটা একেবারে গ্লানিকর ঘায়েল। আমি বান্ধবীকে আরও বললাম, এই সেদিনও তার স্ত্রী আমার গলা ধরে বললো, ও ননদিনী, শোনো, আমি যতই কালো হই, তোমার কাজিন যতই ফর্সা হোক, সে আমাকে রেখে কোনোদিন কারও দিকে তাকায়নি। তাকাবেও না!
নিজের ওপর আমার আস্থা আছে। তাই তাকে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললাম, তোমার আস্থা অটুট থাকুক ভাবি! মহিলার একার ওপর নয়, ওই রকম নারীদের সবার প্রতি আমার করুণা হলো, না হিংসে হলো, নিজেই বুঝলাম না। শুধু মনে মনে বললাম, ভাবি, আজ আমাকে যা বললে, এই আমি, আমি হলে হয়তো তোমার স্বামীকে সেই অন্য কেউ তোমার চোখের চামড়া তুলে চিনিয়ে দিতো। কিন্তু সেই লেজেগোবরে কাজটি আমি না করার সংযমটি অর্জন করে ফেলেছি। কারণ নিজেকে আমার স্বয়ম্ভূ ভাবতে ভালো লাগে।
আমার সে বান্ধবীটা ভীষণই মারমুখী। তবু আমার তখন দৃঢ়তা দেখে তার অবস্থা চুপসানো বেলুনের মতো হয়ে গেলো। তার ধারণা ছিল, আমি তার প্রস্তাব এই প্রথম শুনলাম এবং শুনেই বর্তে যাব। আমিও যে থুতু টুতু বের করে ওইসব তখন বলতে পারব, তা নিজেও ভাবিনি। এইসব ঘটনার মেলাদিন পর সেই কাজিন আমার বাসায় এলো। আমি তার সামনে দাঁড়াতে বিব্রত বোধ করছিলাম। দাঁড়ানো দূরে থাক পিপহোল দিয়ে দেখার পর হয়তো দরজাই খুলতাম না। কিন্তু তার সঙ্গে ছিল কমলার মতো এক টসটসে নারী। আমি সেই নারীর সৌজন্যে দ্রুত চা-নাস্তা নিয়ে তাদের সামনে এসে সেই তেমনি আগের মতো পায়ের ওপর একটু বেশিই পা তুলে বসলাম। নবাববাড়ির গিন্নি নয়, যেন দেখতে প্রচণ্ড দাম্ভিক লাগে। আর ওরকম দম্ভ জাহির করার সময়ে আমি ভুলেই যাই, আমার লায়েক লাযেক চারটে ছেলেমেয়ে আছে। আমি তখন দুর্ধর্ষ তরুণীমেজাজে থাকি! তখন হাবভাব দেখে ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম, অবশেষে কাজিন ওই নারীকে মরিয়া হয়ে বশ করেছেন, আমাকে দেখাতে, যে দেখো আমার হ্যাডম, তোমার চেয়ে ফিটফাট, কম বয়সী একজনকে জোগাড় করে ফেলেছি! কাজিনের নিজের ছেলেমেয়ে বুয়েট, মেডিক্যালে পড়ে। সেই হিসাবে তার জন্য বিন্দু পরিমাণ মান্যতা তবু কোথাও ছিল। আমি সেটুকু মাথায় রেখেই যুবতী নারীটিকে এমনিই জিজ্ঞেস করলাম, কী করো তুমি?
বিদ্যুৎ কবিতাটিতে যা কমেন্ট করেছে, তা ওই কবিতার বিষয়ের ধারেকাছে নেই। কী আর করি! একটা আস্ত কবিতা লেখার চনমনে ভাবটা মনের ভেতর থিতিয়ে গেলো আর আজীবনের বিষের ফেনার জাবর কাটা মন সহজে থামাতে পারলো না।
নারীটি কিশোরীর মতো কাচুমাচু করে বললো, একটি শাড়ির দোকনের সেলস্ গার্ল সে। কাজিনের দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে একপলক চেয়ে ভাবলাম, এমন একটা রাম ছাগলের সঙ্গে পারিবারিক সূত্রে পরিচয় আছে, এটা ভাবতে আমার গা ঘিনঘিন করে উঠলো। আমি সে কাজিনকে বললাম, ভাবিকে নিয়ে আমার বাসায় যখন তখন আসেন, ওয়েলকাম! কিন্তু কখনো একা বা এরকম কাউকে নিয়ে আর যেন না আসেন!
কাজিন লেজকাটা শেয়ালের মতো চলে গেলে আমি সেই বান্ধবীকে ফোন দিয়ে বললাম, আমার ওই কাজিন সম্পর্কের কলঙ্ক আমার বিকল্প একজনকে পেয়ে গেছে এবং বেড়াতে আসার ছলে তাকে আমাকে দেখিয়েও নিয়ে গেছে।
বান্ধবী ওপাশ থেকে হতভম্ব উত্তর দিলেন, তাই নাকি?
আমি বললাম, শালা-শুয়োরের বাচ্চার সাহস কত বড় দেখেছ? বান্ধবী নিজেও আর্ট-কালচারের মানুষ। তেমন কিছু না বললেও দপদপ করে জ্বলছে বুঝতে পারলাম তার নিঃশ্বাসের শব্দে! তার ওপর আমি আবার তাকে বললাম, জানো, আমার হাজব্যান্ড বলতো, আগের তুমি আর আজকের তুমি এক তুমি নও! তোমার আজকের তুমির মূল্য আমার কাছে অতি উচ্চ! আমি বলেছিলাম, কেন?
সে বলেছিল, শব্দ দিয়ে যে শিল্প গড়তে জানে, সে অতুলনীয়। শিল্পের যত শাখা আছে সাহিত্য হচ্ছে সবার সেরা। সেই শব্দশিল্পের যে সাধক, তার আর কোনো রূপ, গুণ, যোগ্যতার দরকার নেই!
না, বিদ্যুতের কোনো সাড়াই নেই। অধিক মানুষ কবিতাটি পড়ে ফেললে, তারপর আর সংশোধন করে হবে টা কী! কতক্ষণ অপেক্ষা করে মেজাজ গরম হলো। সবুজ বাতি জ্বলছে কিন্তু বিদ্যুতের না আসছে ‘কাক’-এ কমেন্ট। না দিচ্ছে মেসেঞ্জারে উত্তর। আমি কিছুক্ষণ তীর্থের কাকের মতো তার ইনবক্সে তাকিয়ে থেকে, সার্চ দিয়ে বাশিরুল আমিনকে বের করলাম। এরপর অস্ফূট প্রেমের মুকুলেই বিপর্যয়ের সব ঘটনা তাকে আবার লিখে, বিদ্যুৎ বিহারিকে কী লিখেছি, তাও লিখলাম। লিখলাম, এমন একটা মেসেজ পড়ে বিদ্যুৎ কোথায় হো হো করে হাসির কার্টুন পাঠাবে, তা না। তার কোনো হেলদোল টের না পেয়ে আমার খুব গায়ে জ্বালা ধরছে। তাই আমি তোকে খুঁজে বের করলাম। তোকে কমেন্ট করতে হবে না। তুই দেখ তো কবিতাটা হলো কি না। তাহলে কোনো পত্রিকায় ছাপতে দেই!
কিন্তু বাশিরুল আমিন বোধহয় তার লেবারদের সঙ্গে ঢালাই কাজের তদারকিতে ব্যস্ত। সে ছোট করে উত্তর দিল, ‘মজা পাইলাম!’ ওর ওইটুক মেসেজে আমার পরান ভরলো না। আমি ‘ধ্যাৎ’ বলে আবার বিদ্যুতের ইনবক্স টেনে বের করলাম। দেখি, বিদ্যুৎ লিখেছে, মাদকের চালান ধরা পড়ছে গো আফা। সেই নিয়ে আছি। চেম্বারে ম্যালা মানুষ। সবাই যাউক।
বিদ্যুৎ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে চাকরি করে। চাকরিরও মেলা আগে থেকে তার সঙ্গে আমার চেনাজানা। প্রসঙ্গত সে আমার অনেক লেখায় এসেছে। আবার লিখলে রিপিটেশন হবে। সেটা আমার পুরনো পাঠকের ভালো লাগবে না। তারচে’ বরং বাশিরুল আমিনের কথা কিছু লিখি!
ক্ষমতাধর আমলা থেকে সুদর্শন চেহারার ফেসবুকীয় যত মাকাল আছে, যাদের থেকে একজন লেখকের অন্তত কিছু পাওয়ার নেই, আর সেই বোধ যখন উদয় হলো, তাদের ডিলিট করে করে তরুণ-তরুণীদের ভেতর যত তুখোড় আছে, যারা নতুন কিছু বলার চেষ্টা করছে, তেমনি যাদের আমি নিজে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বন্ধু বানিয়েছি, বাশিরুল আমিন বোধহয় তাদের একজন। একদিন সে পোস্ট দিয়েছিল, বাসে কোথায় যাচ্ছিল, তার কাছে ভাড়ার দশ টাকা ভাঙতি ছিল না। পরে পাশের এক মহিলাকে বলেছিল, আপা, আমার ভাড়াটা আপনি দিয়ে দেন। তিনি দিয়ে দিলেন। বাশিরুল তাতে খুশি হয়েছে দেখে, আমি বুঝলাম, এইটা আমার মতো সরলসিদা! নইলে আবার এটা অন্য মানুষের পড়ার জন্য লেখেও! তাই আমি কমেন্ট বক্সে লিখলাম, যদি কোনোদিন ওই মহিলার সঙ্গে দেখা হয়, ওই টাকাটা ফেরত দেবে। কারণ ছোট ছোট ঋণে বড় বড় প্রাপ্তিগুলো কাটা যায়। বাশিরুল দ্বিমত পোষণ না করে লিখলো, ঠিক! সেই থেকে যে ওর সঙ্গে আমার একটা আত্মিক যোগাযোগ হয়ে গেলো। এরপর টের পেলাম সে মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেছে। মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা ছেলেমেয়ে যদি সচেতনভাবে লেখালেখি করে, তাহলে সাহিত্যের চলমান ধারায়, আরও ভিন্নমাত্রা যুক্ত হতে পারে। কারণ মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা অধিকাংশই মুক্তবুদ্ধির না হয়ে গোঁয়ার হতে বাধ্য হয়। আর বাশিরুলের ভেতর ব্যাতিক্রম এক তেজও আমি লক্ষ করেছি। ও মারাত্মক পড়ুয়া এবং মুক্তচিন্তার তরুণ!
আর সেটা লক্ষ করেই তাকে আমি পটিয়ে পটিয়ে কুরিয়ারে নিজের বই গছিয়েছি। যখন তার কাছে টাকা হলো, তখন সে বইখানার দাম বিকাশে পাঠিয়ে নিজের সম্পর্কে ধারণাটা সুস্পষ্টও করে নিয়েছে। তারও আগে ফেসবুকে সে বইটির একটি আলোচনাও লিখেছে। প্রতিনিয়ত ছেঁড়া খোঁড়া প্রশ্ন করতে করতে আরও জানলাম, আপাতত সে মামার বাড়ি থাকে। মামার আটতলা বাড়ির কাজ হচ্ছে। সে সেই বিত্তবান মামার ভাগ্নে হওয়ার সুবাদে আপাতত আছে মামার বাড়ি নির্মাণ কাজের তদারকি নিয়ে। ফজরের নামাজ পড়েই লেবারদের সঙ্গে থাকতে হয়। মামার চার চারটে কুকুরের দেখাশোনাও তাকে করতে হয়। কুকুরগুলোর সেবাযত্ন করতে করতে এখন সে কুকুরপ্রেমিকও বটে! আরও একটা কী কাহিনী সে দেখা হলে আমাকে বলবে বলেছে। যা নিয়ে আমি উপন্যাস লিখতে পারবো। উত্তরে আমি জানিয়েছি, সবারই মনে হয়, তার কাহিনী দিয়ে করুণ একেকখানা উপন্যাস হয়। আসলে লেখকের নিজের ভেতরই অসংখ্য কাহিনী কিলবিল করে। শুধু লিখে উঠতে না পারার কারণে চরিত্রগুলো অকরুণ ও বিস্মৃত হয়ে যায়।
বাশিরুল ওর কাজের ধরণ বলে যায় আর আমি ইট-বালি-সিমেন্টঘনিষ্ঠ জীবনের গল্প বুনতে থাকি। যে জীবন আমার অনেকখানি চেনা। কারণ বাশিরুল তার মামার দায়িত্ব পালন করে চলেছে। আমি বিয়ের পর থেকে স্বামীর হোক, নিজের হোক আর যৌথ হোক, প্রাণ গলিয়ে সেই দায়িত্ব পুরোটাই পালন করেছি। আর পালন করতে করতে বুঝেছি, বাড়ি করার কাজ হলো জুয়া খেলার চেয়ে মারাত্মক নেশার। বাশিরুলের সঙ্গে নানা বিষয়ে মতোবিনিময় করতে করতে আমি ভুলে যাই, আমার বয়স ওর চেয়ে আনেক বেশি। মনে হয়, জন্মেছি আগে তবে ও আমার এমন সতীর্থ যার সঙ্গে এসব সুচাল-কুটচাল সমানভাবে চলে। ওর প্রজ্ঞা তা ডিজার্ভ করে।
বাশিরুরের ছোট কমেন্টে বিমুখ হয়ে পরে দেখি, বিদ্যুৎ কবিতাটিতে যা কমেন্ট করেছে, তা ওই কবিতার বিষয়ের ধারেকাছে নেই। কী আর করি! একটা আস্ত কবিতা লেখার চনমনে ভাবটা মনের ভেতর থিতিয়ে গেলো আর আজীবনের বিষের ফেনার জাবর কাটা মন সহজে থামাতে পারলো না।
পরদিন কুইন্সল্যান্ডে মেয়ের কাছে বেড়াতে আসা বাংলাদেশের মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সাঈদা রোকেয়া আমাকে নিয়ে যাবে এখানে কোনো এক হলে অনুষ্ঠিত পিঠা উৎসবে। সেরকমই জোরদার কথা হয়ে আছে। সাঈদা রোকেয়ার সঙ্গে পরিচয় এখানে এসে। ও একসময় টেলিভিশনে খবর পড়তো। এরপর একমাত্র মেয়ে ঐশীর বিয়ে দিয়ে নাতি হওয়ায় জীবন করে ফেলেছে একেবারেই নাতিকেন্দ্রিক! তবু ভিসার মেয়াদ ফুরালে আমার পরপর তাকেও দেশে চলে যেতে হবে! তবে আবার আসবে, সেই আশার বাণী সব সময় বকুলের মতো ঝরে।
নায়িকা জেনেশুনে তার দিকে এগিয়ে পা পিছানো সে নায়কের দুই গালে ঠাসঠাস করে কয়েকটা থাপ্পড় কষিয়ে বললো, একজন স্ত্রী একজন স্বামীর বিশ বছরের ছোট হলে তা কারও চোখে লাগে না। কিন্তু একজন স্বামী একজন স্ত্রী’র থেকে পাঁচ বছরের ছোট হলে পৃথিবীর নিয়ম উল্টে যায়, তাই না?
এদিকে, বাশিরুল আমিন আর বিদ্যুৎ বিহারির সঙ্গে এইসব মেসেজ চালাচালির ভেতর দীর্ঘ একটি মৌলিক গল্পও এডিট করছিলাম। গল্পটা লিখছিলাম অনেক আগে। অনেকদিন পর চরিত্রগুলো আমাকে নাগালে পেয়ে কাঁটার মতো আঁচল টেনে ধরছিল—আরও কিছুক্ষণ তাদের সঙ্গে থেকে যেতে। অন্যদিন টানলে থাকি না। কিন্তু সেদিন থাকলাম। এদিকে নিজেকে গালমন্দ করতেও ছাড়ছি না। যে অন্যদিন লেখার তাড়া নাও না। কাল সকালে একজন তোমাকে সঙ্গে করে এক জায়গায় নিয়ে যেতে আসবে। এর আগে তোমার ঘরে নাতি-নাতনি, মেয়ে-জামাইয়ের জন্য রান্না করে যেতে হবে। যে শাড়িটা পরে পিঠা উৎসবে যাবে, তাও তো ইস্ত্রি করে রাখোনি। ম্যাচিং ব্লাউজও তো খুঁজে রাখোনি! তুমি তো আবার যা পাও এক শাড়ির সঙ্গে আরেক ব্লাউজ গায়ে সেঁধিয়ে দৌড় দাও!
রাত তিনটা বাজলো বিছানায় যেতে। এরপর আইপ্যাডে চোখ বোলাতে বোলাতে এক অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক, তিনি এই অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যাবেরাতে থাকেন, মাঝে মাঝে আমি লেখা পাঠালে খুশি হয়ে ছাপেন। শেষ গল্পটা পাঠিয়ে জানানো হয়নি। তাই তাকে দেখে নক করতে তিনি বললেন, তিনি একটি কবিতা লিখেছেন। তা আমাকে পাঠাবেন। কিন্তু তিনি আমাকে লিখলেন, আগে প্রমিজ করেন, কার জন্য লিখেছি, তা জানতে চাইবেন না। উত্তরে দম ধরে থেকে আমি লিখলাম, আপনি এমন করে অনুরোধ করছেন যে, আমি তা জানতে না চাই কী করে!
সম্পাদক সাহেব ‘হা হা হা’ হাসি পাঠালেন। কিন্তু অনেকক্ষণ সময় পার হলেও তার কবিতার ক’য়েরও দেখা নেই। আমার ঘুম আসছিল না। কিন্তু কালকের প্রোগ্রামের কথা মনে রেখে নিজেকে ধরেবেঁধে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা তো করতে হবে! আর সেই কাজটিই দ্রুত করতে আমি সম্পাদক সাহেবকে দ্বিধা-জড়তা-লজ্জা গুঁড়িয়ে বাশিরুল আর বিদ্যুৎকে পাঠানো মেসেজ দু’খানা তাদের ইনবক্স থেকে ফরোয়ার্ড করে পরপর দিলাম। বোঝালাম, আপনি কি নিয়ে এত লজ্জা পাচ্ছেন হে? দেখেন, আমি আমার অনুজ ও সন্তানতুল্যদের সঙ্গে কী সব বিষয় তুলোর মতো ধুনে শেয়ার করি! এগুলো করি, যেন মগজ খোলে। যেন পল্গু হয়ে না যাই । জগতে রোমান্টিকতার চেয়ে মধুরতা আর আছে নাকি! রোমান্টিকতা মানে আমি খালি প্রেম বুঝি না। বুঝি কিছুটা বখাটেপণা! আরে এ বয়সে একটু আধটু রোমাঞ্চ করবেন, তো বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে এত রাখঢাকের কী হলো! বিয়ে তো আর কারও ভাঙছেন না এতে!
এরপর দেখলাম সম্পাদক সাহেব লিখলেন, দু’জনকে পাঠানো আপনার মেসেজ দু’খানা পড়ে দারুণ মজা পেলাম! তারও পর শাঁ করে তার সেই কবিতা এলো। ছয়/সাতখানা সরু লাইনের একটি অণুকবিতাই বলা চলে তাকে। তিনি যে হারে লজ্জা পাচ্ছিলেন, শেষে তার কবিতা পড়ে আমি নিজেই লজ্জা পেলাম। কারণ বার্লির ভেতরও তো কিছু পুষ্টিগুণ থাকে। ও কবিতাতে তা কিচ্ছুটি নেই! বুঝলাম, এই লোক প্রেম করলে আর কদ্দুর যাবে! আর যাকে পাঠালেন, তিনিই বা ধুয়ে কী জল খেলেন!
আমি মনে হয় সম্পাদক সাহেবকে তার শেষ বয়সে প্রেম শেখাতেই লিখলাম, এই কবিতা পাঠাতে আপনার এতক্ষণ লাগলো? তাহলে দেখেন, আমি আরেকটি গল্পে কী লিখেছি? বলে একজনকে ইনবক্সে লেখা অণুগল্প তাকে ফরোয়ার্ড করলাম। যেন একেবারে ঘাড় ধরে শেখানো, দেখেন, রোমাঞ্চ কাকে বলে!
গল্পটি এমন, বয়সে বড় এক নারীর প্রেমে পড়েছে তার থেকে বয়সে ছোট এক পুরুষ। কিন্তু নারীটি তার প্রেমে না পড়লেও আলোড়িত হতে শুরু করেছে তার কথায়। তাই বুঝি নিজের অজান্তেই তাকে পরখ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। এর ভেতর নারীটি একদিন ফেসবুকে গনগনে একটি প্রেমের কবিতা পোস্ট দেয়। আর ওই প্রেমিকপ্রবর তাতে কমেন্ট করে ফেলে, এখনো এই বয়সে এতো ভালোবাসার জোর আছে? নারীটি ক্ষুব্ধ হলেও রয়েসয়ে কমেন্টের উত্তর লিখলো, ভালোবাসা একটি বোধের নাম। এটা তো ফুরোনোর নয়! যার তা ফুরোয় এই পৃথিবীতে সে অপাঙ্ক্তেয়! বাঁচার ক্ষমতা তার নষ্ট হয়ে গেছে।
কিন্তু নারীটি টের পেলো, তার রাগ মেটেনি। কিন্তু কমেন্ট বক্সে তো এর থেকে বেশি লেখা যায় না! সে নায়ককে আবার ইনবক্সে আক্রমণ করলো। কিন্তু সবুজ বাতি গনগন করে জ্বললেও ওপাশ থেকে নায়কের কোনো উত্তর নেই! আলো নিবিয়ে নায়িকা শুয়ে পড়লো। কিন্তু ঘুম আসছে না। সে ঠান্ডা পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে এলো। কিন্ত মেজাজ তাতেও নামছে না। শেষে সে আচমকা হুড়মুড় করে বিছানা থেকে উঠে ড্রাইভারকে ফোন করলো। বললো, তোমার সাইকেলে করে পনের মিনিটের ভেতর চলে এসো।
রাত দুটো। রাস্তা তখন পুরোই ফাঁকা। নায়িকা ইনবক্স ঘেঁটে নায়কের ঠিকানা বের করলো। নায়ক সেঁধেই দিয়েছিল, কোথায় থাকে তা তাকে জানাতে। কল্যাণপুর কোনো বাড়ির দোতলার ওপরে একটা রুম। মানে চিলেকোঠা। সহজেই পেয়ে গেলো। তারপর হনহন করে নায়িকা সিঁড়ি ভেঙে উঠে কলিংবেল নয়, দরজায় রঙতুলি নিয়ে তার ছবি আঁকার আঙুলগুলো দিয়ে যাকে বলে আঙুলাঘাত করলো।
আপনার গল্পটা আমার সেই রকমই ছেলেমি মনে হচ্ছে। মেয়েদের আসলে অত ক্ষমতা নেই। আপনি দু’জনের মিল করে দেন। অন্তত নায়ক নায়িকাকে টেনে ধরুক! অত রাতে তাকে একা পেয়ে একজন পুরুষ মানুষ ছেড়ে দেয় কী করে?
নায়ক খালি গা, ঘুমে জড়ানো চোখে দরজা খুলতেই সে নায়িকাকে দেখে চিনতে পারলো। যদিও আগে কোনোদিন বাস্তবে দেখেনি। নায়িকাকে চিনতে পেরে তার কবিতায় তার নিজের কমেন্টের কথা মনে পড়ে গেলো। সে ভয়ে ঘরের ভেতরের দিকে দু’পা পিছিয়ে গেলো নিজের অজান্তে। আর নায়িকা জেনেশুনে তার দিকে এগিয়ে পা পিছানো সে নায়কের দুই গালে ঠাসঠাস করে কয়েকটা থাপ্পড় কষিয়ে বললো, একজন স্ত্রী একজন স্বামীর বিশ বছরের ছোট হলে তা কারও চোখে লাগে না। কিন্তু একজন স্বামী একজন স্ত্রী’র থেকে পাঁচ বছরের ছোট হলে পৃথিবীর নিয়ম উল্টে যায়, তাই না? তাই বারবার আমাকে আমার বয়স মনে করিয়ে দিতে হবে? আমার পেছনে লেগেও থাকবি আবার একটুতে বয়সও মনে করিয়ে দিবি, তোর থেকে আমার বয়স বেশি! ডু ইউ নো, আই ক্যান মেইক টেন ম্যান লাইক ইউ কাম এট দ্য সেইম টাইম? বলে চিত্রশিল্পী সে নায়িকা আর দাঁড়ায় না।
নায়িকাকে যেমন পাঠিয়ে ছিলাম ইতিহাসের অধ্যাপক ডিভোর্সী নায়ককে শিক্ষা দিতে, তেমনি হনহন করে ফিরিয়েও আনলাম। আর অধ্যাপক, নিরীহ সে নায়ককে রেখে দিলাম সেইখানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায়। শেষ পর্যন্ত তাদের মিলও দেখাইনি!
শেষরাতে ইনবক্সে পাঠোনো এই গল্প পড়ে তো অনলাইন পত্রিকার সম্পাদকের মাথা গরম হয়ে গেছে! তিনি বারবার মেসেজ পাঠাচ্ছেন, গল্পে আমি যেন ওইখানে নায়ককে দিয়ে নায়িকাকে টেনে ধরাই। তাকে বিছানায় নেওয়াই! এত রাগের পরে একটা বড় আদর লাগে।
আমি লিখলাম, তাহলে তো আর গল্প হবে না। দু’জনের এক সার্থক বাসর হবে সেটা!
কিন্তু তিনি আমাকে ফোর্স করতে লাগলেন। আমি বললাম, গল্পটি তো সিলেট থেকে প্রকাশিত ‘বিহান’ নামের একটি ছোট পত্রিকায় মুতিউল মুরসালিন নামে এক লিটলম্যাগ সম্পাদক ছেপে ফেলেছেন!
এরপর অনলাইনের সম্পাদক সাহেব বললেন, আমি কি আপনাকে মেসেঞ্জারে কল দিতে পারি? এতকথা লিখে বোঝাতে পারছি না!
আমার তখন দারুণ অপারগ সময়। কারণ তখন ভোর প্রায় চারটে। পাশের ঘরে জামাই-মেয়ে। আর এইদেশের, মানে অস্ট্রেলিয়ার বাড়িঘর সব নিশ্ছিদ্র হওয়ায় এতটুকু শব্দও সব মানুষের কানের ছিদ্রে বহুগুণ হয়ে পশে যায়। এর ওপর আমার এমন কণ্ঠ যে, প্রেমিকদের সঙ্গেও কথা বলতে হয় বন্ধুত্বের স্বরে। দেশে থাকতে একদিন ছোট মেয়ে বলেছিল, আম্মা, তুমি যাদের সাথে কথা বলো তারা সবাই কি বয়রা?
বলেছিলাম, কেন?
মেয়ে বলেছিল, তাহলে এত জোরে কথা বলো কেন?
সম্পাদক সাহেবকে তবু কল দিতে বললাম। কারণ আমার কোনো অপারগতা কারও কাছে প্রকাশ করতে ভালো লাগে না। সম্পাদক সাহেব কল দিলে, কত বিষয় ছেড়ে বিষয়ান্তরে আমরা চলে গেলাম। কী ছিল না সেই আলাপে! কিন্তু সব কথার ভেতর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তার ওই এক কথা, গল্পটাতে আপনি ওদের দু’জনের মিল দেখান। তিনি এও বললেন, নায়িকা দম্ভ করে নায়ককে যা বলেছে, তাতে তো তার কোনো ক্রেডিট দেখি না!
আমি বললাম, কেন? ক্রেডিট দেখবেন না কেন? দশ নারীকে ঠান্ডা করার ওই ক্রেডিট কি একা শুধু পুরুষের থাকতে হবে? নারীর থাকলে সেটা পুরুষের অপছন্দ?
সম্পাদক সাহেব বললেন, শোনেন, ছোট ছোট দুটো ছেলেমেয়ে একসঙ্গে খেলছিল। একসময় ছেলেটি খেয়ালের বশে মেয়েটিকে তার পেনিস বের করে দেখিয়ে বললো, এই দেখ, আমার এইটা আছে, তোর আছে? মেয়ে প্যান্ট খুলে দেখে, তারটা নেই। সে তার মায়ের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। মা’কে বললো, ওর ওটা আছে, আমার নেই কেন? মা ওই ছেলেশিশুর ওপর রাগ করে নিজের মেয়েকে শিখিয়ে দিলো, ওকে বলগে, আমার যেটা আছে সেটা দিয়েই তোর মতো দশটা আসবে! সম্পাদক সাহেব বললেন, তো, আপনার গল্পটা আমার সেই রকমই ছেলেমি মনে হচ্ছে। মেয়েদের আসলে অত ক্ষমতা নেই। আপনি দু’জনের মিল করে দেন। অন্তত নায়ক নায়িকাকে টেনে ধরুক! অত রাতে তাকে একা পেয়ে একজন পুরুষ মানুষ ছেড়ে দেয় কী করে?
আমি বুঝতে পারছি, ষাটোতিক্রান্ত সম্পাদকের নিজের মাথায়ই আগুন উঠে গেছে। কিন্তু তার সেই আগুন নামানো দায়, বিশ্বাস টলিয়ে আমাকেই নিতে হবে কেন? আমি মনে মনে বললাম, আপনি যতই বলেন সম্পাদক ভাই, কস্মিনকালেও সেটি হওয়ার নয়! পুরুষের দম্ভ চূর্ণ করার সময় এসেছে। তুই দেখি আমার সঙ্গেই পারিস না, আবার অন্যের দিকে হাত বাড়াস কেন? শুধু কোনো মেয়ে এ যাবৎ তার স্বামীকে এমনটি বলেনি বলে এতদিন পুরুষের রক্ষে ছিল। এখন অন্তত গল্পের নায়িকারা মুখ খুলুক!
দ্বিধাদ্বন্দ্ব তাড়িয়ে তবু বললাম, আগে বলা হতো মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি। এখন যে সময় উল্টে গেছে, তা দেখেছেন?
সম্পাদক সাহেব বললেন, যেমন?
বললাম, আগে মেয়েরা নিজেদের খাবার-দাবারের খেয়াল রাখতো না। অসুখ হলে চিকিৎসা নিতো না। বছর বছর ছেলেমেয়ের জন্ম দিতে বাধ্য হতো! এখন ছেলেমেয়ের জন্ম দিতে তারা বাধ্য তো নয়ই, এখন নিজেদের যত্ন নেওয়া শিখে গেছে। বিউটি পার্লারে গিয়ে আবার পুরো শরীর টেপাটিপি ঘষামাজা করায়! খেয়াল করে দেখেন, এখন প্রতিটি ঘরে বউয়েরা যুবতীর মতো দেখতে। কিন্তু তাদের স্বামীগুলোকে দেখেন? মনে হয় না তাদের চাচা চাচাভাব!
সম্পাদক সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, আপনার সঙ্গে আমি কথায় পারবো না জানলে এত রাতে কল দিতাম না। এই বলেই পট করে লাইন কেটে দিলেন।
আর আমি পরদিন পিঠা উৎসব থেকে ফিরে এসে সম্পাদকের সংলাপগুলো টাইপ করে, বাশিরুল আমিনকে মেসেজ দিলাম, তোর জলজ্যান্ত নামটা আমি একটা হযবরল গল্পে লিখে ফেলেছি। কিন্তু আমি তো তোর তেমন কিছু জানি না! মরার পর যদি বিখ্যাত হয়ে যাই, আমার পাঠক তোকে নিয়ে গবেষণা করবে। পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের ‘আসমানী’র মতো তোর নামও রটতে পারে। তাই পাঠকের কাজটা আমি এগিয়ে রেখে যাই। আর কাউকে নিয়ে লিখতে হলে, বাড়িয়ে লিখতে আমি রাজি আছি। কিন্তু কাউকে খর্ব যেন না করে ফেলি। মনে কর, আমি উঠতি বয়সের কাউকে একটা জামা কিনে দিলাম। জামাটা বড় হলে সে সেটা ট্রাংকে রেখে তার উপযুক্ত হওয়ার আশায় রাখবে। কিন্তু ছোট জামা দিলে তো সে তা তখনই ফেলে দেবে! তাই কাউকে নিয়ে তার থেকে কম লিখলে তো সে নিজেই তার থেকে পালিয়ে বাঁচবে! তাকে নিয়ে অন্যের ছোট করা লেখা সে বইবে কেন?
দেখিস, নাক বরাবর ঘুষি দিয়ে রক্ত যদি না ছুটিয়ে দেই। পাড়া-পড়শী ভাইদের সঙ্গে আমি বড় হয়েছি। তাই মারামারি করা এখনো আমার অভ্যাসে রয়ে গেছে। এ মেসেজ এখনো পাঠাইনি, বুঝলি! খালি আঙুলের এতটুকু টাচ্ দিলেই চলে যাবে!
আমার মেসেজের পর বাশিরুল উৎসাহী হয়ে একের পর এক তীরের মতো মেসেজ ছুড়তে লাগলো—আমি মূলত একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাংলাদেশ স্টাডিজ পড়াই। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্ম (সোস্যাল ওয়ার্ক)য়ে অনার্স ও মাস্টার্স। মাদ্রাসা থেকে টাইটেল পাস। উন্নয়নকর্মী হিসেবে কাজ করেছি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও কাজ করেছি। ‘পলিমাটি’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করি!
বাশিরুলের মেসেজ দেখতে দেখতে আমি চিৎকার করে উঠি প্রায়। লিখি, তোকে এতকিছু কে করতে বলেছে? তোর এইসব গুরুগম্ভীর বিষয়ের ভিড়ে আমার বুদ্বুদের মতো বিষয়টি চাপা পড়ে যাক আর কী! যেন আমার কিছুই ঘটেনি, তুই-ই সব!
বাশিরুল হো হো হো হাসির ইমো পাঠিয়ে লিখলো, চা বাগানে কুলি, সীমান্তে গারো ও খাসিয়াদের কাজও করেছি। আমি লিখলাম, তোকে নিয়ে অনেক হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।
ও আবার লিখলো, আমি সন্ধ্যার পর ফরেইনারদের বাচ্চা পড়াই। আবার ফজরের পরপর লেবারদের সঙ্গে বালু-সিমেন্ট মাখাই! এবার কষে ধমকের মতো মেসেজ পাঠাই, লিখি, চুপ থাক!
কিন্তু ও তবু আরেকখান ছুড়ে দিল, টেস্ট পেপার রাঙতা দিয়ে মুড়িয়ে গিফট বানিয়ে কত কত কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকে কত বিয়াও খাই!
আমি বাশিরুলকে আবার লিখলাম, এ দেখি তোকে দিয়ে সমাপ্তি টানা হয়ে যাচ্ছে। আমার অনেকগুলো গল্প এডিটিংয়ের কাজ বাকি আছে। এখন এই লেখার ভেতরের বিষয় দিয়ে একটু লেজ না ঝোলালে তো একেবারে খাপছাড়া হয়ে যায়, কী বলিস?
বাশিরুল লিখলো, তা আপনি পারবেন। নিজেকে নিয়ে মজা করার অদ্ভুত ক্ষমতা আপনার, যা কোনো পুরুষও সাহস করবে না!
বাশিরুলকে লিখলাম, আজ সাংবাদিক আদিত্য শাহীন আমার একটা বই আলোচনাতে কমেন্ট করে আমাকে যে বিশেষণটা দিয়েছেন, আমি তা মাথা পেতে নিলাম। কারণ বিশেষণটা আমার সঙ্গে মানিয়ে যায়।
বাশিরুল লিখলো, কী?
জানালাম, আদিত্য শাহীন লিখেছেন, অভিনন্দন। এ যুগে স্বাধীনতা নির্মাণ করে এমন লেখকসত্তা লালন করা কঠিন। আমি দীলতাজ আপাকে দেখি আর ভাবি, তিনি ভেতরে ভেতরে বড়ই ডানপিটে মানুষ!
আমি আবার লিখি, মানুষ তো নিজেরটা চেপে অন্যেরটা খুঁচে বের করে। আর আমি অন্যেরটা এনে নিজের ওপর আরোপ করি। আসল বিষয় হচ্ছে পাঠককে আমি মূল বিষয়ের সঙ্গে যথাযথ পরিচয় করাতে পারছি কি না! সেখানে আমি হলে ক্ষতি কী? আমি কি স্বর্গ থেকে এসেছি, যে আমার কোনো বোকামি, লোভ-পাপ, স্খলন থাকতে পারবে না?
বাশিরুল লিখলো, আপনি এবার ফিনিশিং দেন। দেখি কেমন হয়।
লিখলাম, আমি ওই কাকের ইনবক্সে লিখে রেখেছি, ওই, আমি কি তোকে দেখছি? তোকে দেখার পর, আমিই যে তোকে পছন্দ করতাম, সে কথা তুই বুঝলি কিভাবে? এত বিশ্বাস তোর আসে কোত্থেকে, তোর পছন্দই শেষকথা কেন হতে যাবে? আমার লিখে রাখা মেসেজ তুই নিরুত্তর রেখেছিস্। আমি দেশে আসি। দেখিস, নাক বরাবর ঘুষি দিয়ে রক্ত যদি না ছুটিয়ে দেই। পাড়া-পড়শী ভাইদের সঙ্গে আমি বড় হয়েছি। তাই মারামারি করা এখনো আমার অভ্যাসে রয়ে গেছে। এ মেসেজ এখনো পাঠাইনি, বুঝলি! খালি আঙুলের এতটুকু টাচ্ দিলেই চলে যাবে!
বাশিরুল লিখলো, আহা, একেবারে তুইতে নেমে গেলেন?
আমি ওকে লিখলাম, রাগলে আমি মুতিউলের ‘বিহান’ পত্রিকায় পাঠানো ওই গল্পের নায়িকার মতো ওইরকমই বলি!
বাশিরুল লিখলো, তাহলে আর কী করা!