[নাহিদা নাহিদ, এ সময়ের আলোচিত কথাশিল্পী। ইতোমধ্যেই গল্পে নিজস্ব বুননশৈলী সৃষ্টিতে তিনি সাফল্য দেখিয়েছেন। তার ছোটগল্পগ্রন্থ ‘যূথচারী আঁধারের গল্প’-এর জন্য পেয়েছেন কালি ও কলম পুরস্কার-২০১৮। সম্প্রতি লেখা শুরু করেছেন অনুগল্প। আর এই অনুগল্পেও তিনি রেখে চলেছেন তার স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর। আজ ৫ জানুয়ারি। আজ এই গুণী শিল্পীর জন্মদিন। এই উপলক্ষে চিন্তাসূত্রে প্রকাশিত হলো তার তিনটি অনুগল্প—গল্পত্রয়ী।]
হ্যাপিনেস
সে ছিল এক প্রেম, দেয়াল কাঠের মতো শক্তপোক্ত, নুরি, নিক্তিতে মাপতে গেলেও পেতল কাঁসার চেয়ে শক্ত ঠেকে; ধাতব খুব! রিমা আর মিরাজ দাম্পত্য প্রেমে রসুনের কোয়া; পেঁয়াজের খোসা। সাদা সাদা দুধ দুধ। অফিসে যাওয়ার আগে রিমা তাকায় একবার ঘরে, চৌকাঠ, বসার ঘর পড়ার টেবিল, কোনাকুনি করে রাখা সোফা; দেয়াল; টিভিতে চলা বিজ্ঞাপনের মতো সুখ সুখ। সংসার এক বিচিত্র সুন্দর।
মিরাজও দেখে, অগোছালো নেই কিছুই, ফ্রিজের মশলার বাটি যেন, খুব করে গোছানো। বাচ্চারা আদা, জিরা ধনিয়া। সৌরভ! মঁ মঁ চারপাশ৷ গায়ে মাথায় যা কিছু বয়ে বেড়ানো যায় সবই বয়ে যায় তারা; সকাল দুপুর, সন্ধ্যা। শুধু রাত হলে বিস্ময়, অপেক্ষা!
সৌরভ ঘুমায়, রিমা ঘুমায়, বাচ্চারা ঘুমায় তার আগে মিরাজ ল্যাপটপ, রিমা ফোন, বাচ্চারা টিভি।
মিরাজের নারী অপ্সরা; ভার্চুয়াল।
রিমার কৌশিক; কলিগ।
বাচ্চাদের; সুপারম্যান ব্যাটম্যান ওইসব।
মিরাজ লেখে, সেন্ড মি ন্যুড অপ্সরা আই অ্যাম ফিলিং হট;
রিমা লেখে, স্বামী ঘুমাক তারপর…
বাচ্চারা আঁকে প্যান্টের ওপর জাঙ্গিয়া, ঘাড়ের ওপর পাখনা উঁ উঁ উঁ।
তারও পরের আগে তারা একসঙ্গে ডিনার করে, লাস্টনাইট কিসও। হাগ করে ঘুমায় পরস্পরে, এইটাই তাদের হ্যাপিনেস। এমনকি লাভলি লাভলি সুখও
অতপর। চঞ্চল প্রাণী ইঁদুরের দৌড়! জনে জনে চকচকা কাপড়ে ফেনা ফেনা ঘাম। শূন্য দশমিক শূন্য শূন্য বাড়তি উষ্ণতায় চাপ অথবা তাপ।
তারও আগে রিমা টেবিল সাজায়; ভাত গোছায়, মাছের ঝোল,করলা; সালাদ রাখে পাতে।
-রিমা টকে গেছে ঝোল, মাছটার দোষ।
-উহু, তাজাই দেখলাম, তপড়ালো খুব।
-মশলা!
-ফ্রিজড ছিল তো!
-অন্ধের মতো দিয়ে দিলে, না শুঁকে?
-রোজই তো দেই, চেখে দেখি না চুলোয়।
-আহা এ যুগের রসুন! পচে তো যেতেই পারে।
-হুঁ, পারেই তো পারেই, মাছ-মশলা দুটোই।
-রঙ দেখেছ কেমন?
-হুঁ। বেশ চকচকে!
এরপর তারা দুজনই তাকায় দেয়ালে, দাম্পত্য ফ্রেমে। তারও পর, মিরাজের মেসেঞ্জারে টুক করে ন্যুড আসে অপ্সরার। রিমার টেক্সট। বাচ্চারা ভাসে অন্যান্য আহ্লাদে। তারও পরের আগে তারা একসঙ্গে ডিনার করে, লাস্টনাইট কিসও। হাগ করে ঘুমায় পরস্পরে, এইটাই তাদের হ্যাপিনেস। এমনকি লাভলি লাভলি সুখও।
মিচুয়াল ট্রাস্ট
ঝুন ঝুন ময়না নাচো না, তাথৈ তাথৈ নাচো না, ঝুন ঝুন ময়না নাচো না তাথৈ তাথৈ নাচো না বুলবুল পাখি গাও না গুনগুন গুনগুন গাও না-টুনি আর শোনে না কান থেকে হেডফোনের ফিতা টেনে ছিঁড়ে খুলে ফেলতে পারলেই যেন বাঁচে। এই তাথৈ-তাথৈ ঝুনঝুন-ঝুনঝুন শুনে তার কী লাভ, এই পাগলা বাউল বোঝে না ক্যান বাল। পলাশ; ছেলেটা এখানে রোজ আসে; রোজ। ভিড়ের মধ্যে টুনিকে গিলে। এ গেলাটা অশ্লীল নয় মোটেও, শুধু যেন দেখা। দেখে দেখে ওর আশ মেটে না। সস্তা পাউডার, টকটকা লিপিস্টিকে টুনিকে এই শিক্ষিত ঘরের পোলা কোনো সুখে এভাবে চাটে কে জানে, টুনি বিরক্ত হয়, ‘আরে ভাই বুক হাতাইতে চাইলে আয়, এর বেশি চাইলেও আয়, তয় তোর ভদ্রলোকামির কারণেই সেইটা অবশ্যই গোপনে, এই ওপেনে তোর ঠ্যাটামির কী কারণ!’ পরে দোষ হইবো তার। টুনি আজ বেশ ক্ষেপে যায়; আইছে এউ ছ্যাঁচরা পোলা এক গান নিয়া, হেডফোন দিয়া পরপর তিনবার শুনাইয়াও এর শান্তি নাই, এর সাথে নাচলে নাকি তারে বড় ভালো লাগবো তার। শালা মাইগ্যা! টুনি ছেপ ফেলে জোরে। মরার পাগল-ছাগলে দ্যাশ ছয়লাব!
টুনি নিজেকে শান্ত করে অশ্লীল ইঙ্গিতে পলাশের আন্তরিকতায় ফিরতি হাসি দেয় তাকে।
না ভাইয়া, এইসব গানে আমরা নাচি না, আমাগো নাচ দিলবর দিলবর, ও মেরা বাবু চ্যান, আপনে গো এইসবে আমাগো পোষায় না। দেখলে কন দেখাই। রাইতে আসেন আরও কিছু দেখাই।
এরপর হারিকেনের আলোয় এক নেশাসক্ত যুবককে ভেসে যেতে দেখা যায় জলে। দূরে বেদে নৌকার মতো কিছু একটা সরে যায় রাতের আঁধারে।
‘বন্ধু যদি আমার ভ্রমর হইতো শ্রমিক বিড়ি আমায় কিনিয়া দিতো’, ‘দিলে বড় জ্বালারে শ্রমিক বিড়ি ওলারে, দিলে বড় জ্বালা!’ টুনি পলাশের গালে টোকা দিয়ে তার ছেনালি হাসিসমেত ফিরে আসে ভিড়ে।
পলাশের হৃদয় তবু থেমে থাকে এখানেই, কেন থেমে থাকে? মেয়েটার চোখ কি নিভু নিভু? ক্লিওপেট্রাকে মনে পড়ে তার, ঠোঁট কেমন; মোনালিসা! মেয়ে শব্দটায় হাসি পায়। নিজেকে বেশ একটু বেকুবও লাগে, আদতে টুনি নারী না কি নারী সেজে থাকা পুরুষ, তাও জানে না সে অথচ প্রেমে ভেঙে ভেঙে চুর-চুর। অদ্ভুত! এ এক অন্যরকম যৌনতাবোধ তার। না মোহ না আসক্তি! পলাশ জানে সে ওকে চায়। নারী বা পুরুষের আসক্তিতে নয়। ভিন্ন রকম মানবশরীরে প্রেম। যৌনতাবোধের এই নতুন নিরীক্ষায় পলাশ জানে না তার গন্তব্য শুধু জানে এই এক তীব্র অমোঘ আকর্ষণ!
ওদের এইগ্রুপে মোট পাঁচজন। সর্দার, ছোট টুনি, বড় টুনি, তবলাদার আর সালসা বনজি ওষুধের ক্যানভাসার। ওরা বিভিন্ন বাজারে মাসকাবারি যায়, নাচে গায়, অল্প টাকায় বাজারের লোকজনের কাছে পান-বিড়ি, জর্দা বিক্রি করে আবার ছিপিতে করে ওষুধও দেয়; সালসা। সে এক ভজঘট বেচাবাদ্য। মেয়ে বা মেয়েরূপী অথবা হিজড়া দুই টুনি চোখ টিপে, ঘাগড়া উঁচু করে কাস্টমার জমিয়ে রাখে। ক্যানভাসাররা টাকা ওঠায়। আর রাতে নৌকায় সে এক অন্য অধ্যায়। ছোট টুনির এখনো বুক ওঠেনি তবু কাপড় গুঁজে উঁচু করে রাখে, ভারী ভারী ভঙ্গিমায় ছোট টুনি যখন নাচে হাঁটের লোকজন ভেঙে পড়ে মজমা সুখে, পলাশের ওসব ভাল্লাগে না, পলাশ ধৈর্য ধরে আছে একদিন ঠিক সে বড় টুনিকে নিয়ে পালাবে, সর্দার লোকটা দেখেও দেখে না এসব। টুনি ঠোঁট বাঁকায় চোখ নাচায়, এই ওর সব। চলছে তো চলুক।
এমনি করে চলতে চলতে একসময় পটেও যায় পলাশের ময়না। পোষও মানে। পলাশ ভাবে সময়ের দামে সে বিশ্বাস পেয়েছে, টকবে না নিশ্চয়ই আর টুনি ভাবে, ধৈর্যের পরীক্ষায় সে বিশ্বাস বেচেছে ঠকাবে না নিশ্চয়ই।
পলাশের মা কাপড়ে কী যেন ছিটিয়ে দেয় মাঝে মাঝে, মা বলেন নেপথলিন, কাপড় পোকায় কাটা থামায়। পলাশের ভাল্লাগে না ওসব, সুগন্ধে মাথা ধরে। ওর মনে হয় উৎকট গন্ধে ঘর ভরে যাক, কেটে কুটি কুটি হোক কাপড়, লালে লাল হোক দেয়াল; টুনির ঠোঁটের মতো; কেন এমন হয়! পলাশ কলেজ পালায় ছুটে ছুটে। এই হাট থেকে ওই হাট, এই নদী থেকে ওই নদী। বাবার ঘড়ি, মায়ের গয়না, ঘরের এটা সেটা কোথায় যে গায়েব হয় একে একে কেউ জানে না, কাজের লোক বিদায় হয় কত, তাদের পলাশ তো ভালো ছেলেই। বছর শেষে ঈদ আসে। ঈদ যায়, এবারও এসেছে তবে পলাশের জন্য তা অন্যরকম! টুনি বলেছে ওকে নেবে পুরোপুরি। এসব বাজারি কাজ ছেড়ে দেবে ও, সর্দারও জানে সব। আহা এরপর বাকিটা জীবন শুধু ঝুন ঝুন ময়না নাচো না তাথৈ-তাথৈ নাচো না।
ভাগ্য ভালো বাবার মানিব্যাগ এসময় থাকে ফোলা ফোলা। ঘরে মোবাইল সেট মোটে চারটা, সঙ্গে মায়ের গয়না। এক্সট্রা বাবার ঈদ বোনাস।
এই বাজারে এই তাদের শেষরাত। নৌকায় আয়োজন শেষ। রাতে নৈশভোজ। মাঝের ঝোল, লাল ভাত, টকটক ঝাল। মুগ্ধ পলাশ ঘোরগ্রস্ত।
এরপর হারিকেনের আলোয় এক নেশাসক্ত যুবককে ভেসে যেতে দেখা যায় জলে। দূরে বেদে নৌকার মতো কিছু একটা সরে যায় রাতের আঁধারে। ডুবে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যুবকটির গায়ে ছিল না কোনো বস্ত্র এমনকি লজ্জাস্থানও ছিল উন্মুক্ত। কারণ, তার পরনের প্যান্টের ওজনও ছিল যথেষ্ট! গুলিস্তান বেঁচে দিলেও মূল্য উঠবে প্রায় দেড়-দুইশো।
অ্যা ফেইলর
আলো পড়ে চকচক করছে মহুয়ার গাল। রুপালি ইলিশের মতো কেমন ঔজ্জ্বল্য তার, কিছুক্ষণ পর শো। শো-স্টপার সে। সত্যি তো? মেকাপ রুমে কেউ আসছে না কেন? মহুয়া চেঁচায় হোয়াই হোয়াই হোয়াই সো সাইলেন্স! চোখের কনটাক্ট লেন্স বসেনি তার। কটকটাচ্ছে চোখ। ব্রার ফিতা আট হয়ে বেঁধে আছে পিঠে, কেটে বসে যাবে হয়তো। আচ্ছা মহুয়ার কী ওয়েট বাড়ছে! জিমে তো সে রোজই যায়। তো? মহুয়া অস্বস্তি কাটাতে চায়, কাটে না, পায়ের হিলগুলো ভয়ঙ্কর চোখে তাকিয়ে থাকে, পারবে তো সে আজ! তাকে পারতেই হবে। এসময় ওয়াইনের গ্লাস তার নার্ভাসনেস কমায়। কতদিন হলো এখনো ফ্লাশ জ্বলে উঠলে কেঁপে যায় বুক। ধুকপুক। আজও! আচ্ছা আজ কি কোনো দিন বিশেষ দিন, কেউ কি মারা যাচ্ছে? মেকাপ রুম একদম খালি কেন? অথচ সে প্রস্তুত। এমন কিছু তো হয়ই। না না কেউই মরছে না, আসলে তার বয়স বেড়েছে কি ভুলভাল ভাবছে। ওই তো ও ঘরে সবাই আছে। ওটাই আসল গ্রিনরুম। মহুয়ার মাথা ঝিমঝিম করে, কে তাকে কি খাইয়েছে কে জানে, সে তো জানেই এভরিবডি জাস্ট জেলাস টু হার। এমন লাগছে কেন। হুটহাট মনে পড়ে যাচ্ছে সব। ওই তো ক্যামেরা, আলো, রঙ মুখ-মুখোশ। খচখচ করে তার; ওখানে জুবুথুবু ভঙ্গিতে ডিরেক্ট করছে একটা ছেলে। ছেলে না পাকা বুড়ো। রাহাত হাসান, বেশ দেখতে৷ সুপুরুষ! নাহ বেশ না, এই ছেলে একদিন তাকে উন্মাদ ক্ষ্যাপাটে বুড়ি বলেছে। হাহ্। মহুয়া জানে সে টপ। হোক অতীত। সুপার তো ছিলই। এক-দুই তিন, লেটস হ্যান্ডস টুগেদার উইথ তানিয়া, তানিয়া তানিয়া। আলো জ্বলে উঠছে সহস্র আলো একটা দুইটা তিনটা। মাথায় সুঁই ফোটানো অনুভূতি নামে তার! তানিয়া কেন? সে নয়? আলো জ্বলছে, মহুয়া অবাক হয় সে কোথায়! মহুয়া অনেক কিছু মনে করতে চায়। অথচ ভোঁতা মাথায় শুধু শব্দ। আহা মোজার্ট! এটা কী ক্যাসিনো, এত হই হট্টগোল গেলো কোথায়। পিন, পিন, পিন! এক দুই তিন, লেটস হ্যান্ডস টুগেদার উইথ তানিয়া, ক্ল্যাপ ফর হার। ক্ল্যাপ, ক্ল্যাপ, ক্ল্যাপ। তানিয়া কে? মহুয়ার অন্তর্বাস খুলে যাচ্ছে? কে খুলছে টেনে? চারপাশে অজস্র চোখ। চকচক। ওমা উলঙ্গ মহুয়া একাই নাচছে, কেউ তাকে দেখছে না। স্টেজে এত আলো তবু অন্ধকার। তবে কী সে অন্ধ! পা উঁচু করো, এই এভাবে তুলে দাও দুই ঠ্যাং,এইভাবে হয় ডগি! তোলো তোলো। মহুয়া ল্যাবঘরে উল্টে থাকা অর্ধমৃত ব্যাঙের মতো হাত নাড়ায়, পা নাড়ায়, ঠোঁট নড়ায়, কুমুরের মাটির চাকার মতো ঘুরছে তার শরীর। কেন সে এখানে, হোয়াই দিস। ইজ ইট ক্যাসিনো বার, সো হু ইজ তানিয়া?
অম্ল মধুর নোনা, কিছুই নেই। আস্ত নিরেট দানায় নেই সুগন্ধী, নেই স্বাদ। এত সহজে বাদ পড়া যায়। দান এখন তানিয়ার ঘরে।
বেগুনী, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল। লাল লাল লাল—তাকান এইদিকে, দেখুন লাল। বেছে নিন একটা লাল! গাঢ় লাল, ফিকে লাল, কমলা লাল, খয়েরি লাল। লোকটা বলে যায় ক্রমাগত, বলেই যায়। কতক্ষণ এমন চলছে? অনেকগুলো বাক্স তার চোখের সামনে । কোনোটায় ত্রিভুজ, কোনোটায় চতুর্ভুজ, কোনটায় বৃত্ত! বৃত্তের মাঝে নীল, বৃত্তের মাঝে সবুজ, বৃত্তের মাঝেই লাল। চোখের সামনে ঘুরছে। একঘণ্টা দুঘণ্টা তিনঘণ্টা। মহুয়ার চোখ ক্লান্ত, মন ক্লান্ত। লোকটা কি ডিরেক্টর না ডক্টর? বাক্সগুলো নড়তে নড়তে সেগুলো চোখের ভেতর দিয়ে মগজে ঢোকার পথ পেয়ে যায় তার। মগজে ব্যথা পিনপিন৷ তলপেট অনুভূতিহীন! ঘরটা অদ্ভুত সাদা! এটা কী ঘর? নড়ে না কেন দেয়াল ! কানে কথা বাজছে চোখের রেপিড মুভমেন্ট মাপতে হবে। মাপতে হবে। মাপতে হবে। রোগীর শ্বাস পড়ছে ঘন! কে লোকটা? কার নির্দেশে এমন বলছে লোকেরা।
সশব্দে কে যেন এলো, নিঃশব্দ হয় আবার! তার ইচ্ছে হয় বাইরে গিয়ে জোরে একটা চিৎকার দেয়, ডাকে রাহাত রাহাত। না না রাহাত হবে কেন চ্যাংরা ছেলে তাকে ক্ষ্যাপাটে বুড়ি বলে তাড়িয়ে দিলো অথচ সে সিনিয়র আর্টিস্ট! হায় হায় আজকের শো কি শেষ! কখন হলো? কড়া ঘুম আবার তার চোখ আটকে দিতে ধেয়ে আসছে, ঘুমুবে না সে, একদম না। আচ্ছা মেকাপ রুমে কেউ তাকে দেখেনি তো স্টিক নিতে? অদ্ভুত ক্রোধ তাকে অধৈর্য করে। তানিয়াকে মনে পড়ে, লেটস হ্যান্ডস টুগেদার উইথ তানিয়া। ভিবোর টপ। স্টাইল ওয়ার্ল্ড টপ। কারোয়া টপ। মহুয়া কুকরে যায়, কুকুরের মতো ছটফট করে। মেয়েটা তার মতো সুন্দর নয়, অথচ কী তার দর! মেয়েটাকে ভেবে ভেবে সে এমন এক খাদের কিনারায় চলে যাচ্ছে যেখান থেকে একদিন সে সীমাহীন অধৈর্যে ফেলে দেতে পারবে আলো, পর্দা, মিউজিক, ক্যামেরা ফ্লাশ সব। কেউ তাকে ঠেকায় না কেন? নট-সম্রাজ্ঞী বিনোদিনীর মতো এক্সপ্রেশন তার, তাকে ছুড়ে ফেলা এত সহজ । লোকটার মুখ বরাবর ছুড়ে দেয় সে টেবিল ল্যাম্প, কে লোকটা, ডক্টর না ডিরেক্টর? মহুয়ার ভালো লাগে, উল্লাস হয়; লোকটাকে দেখানো দরকার তার ক্রোধের দৈত্য বের হচ্ছে এবার। পানির গ্লাসের দৈত্য, খাবার প্লেটের দৈত্য, আয়নার দৈত্য পরনের কাপড়ের দৈত্য সব। নটী-বিনোদিনীর ভূত হয়ে আসবে সে। ঘাড় মটকে দেবে সবার। যৌবনের সওদা? শেষ হলেই ছুড়ে ফেলা। হু ইজ তানিয়া, হু ইজ শি। মহুয়া আর মনে করতে চায় না কিছু, হাতড়ে শরীরে খোঁজে তার। এই তো তার স্তন, যোনী, পায়ুপথ। আছে তো সব এখনো। বারের চাকা উল্টে গেছে। চুষে চুষে নিঃশেষ শরীর এখন। অম্ল মধুর নোনা, কিছুই নেই। আস্ত নিরেট দানায় নেই সুগন্ধী, নেই স্বাদ। এত সহজে বাদ পড়া যায়। দান এখন তানিয়ার ঘরে। ক্ল্যাপস ফর তানিয়া, লেটস হ্যান্ডস টুগেদার। মহুয়া আর কিছু ভাবতে পারেনা এক নিস্তেজ অনুভূতিতে ঘুমিয়ে পড়ে সে৷ শ্যামলীর তৃতীয় শ্রেণির ইমার্জেন্সি, হসপিটাল অখ্যাত। মহুয়া পড়ে রয় একা ঝাঁঝহীন আবরণহীন। পরদিন পত্রিকার পাতায় এককোণায় দেখা গেলো—
মহুয়া: অ্যাট্যাম্পট টু সুইসাইড; অ্যা ফেইলর অব সাকসেস!