গতবছর জানুয়ারি মাসের ভেতর বেশ ঠুসে ঠুসে প্রচুর শীত ঢুকিয়ে জানুয়ারি মাসটাকে এখানে পাঠানো হয়েছিল। জানুয়ারি মাসটাও জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল লোকালয়টিতে। গোঁয়ার জানুয়ারি মাসটি তার বিপুল শীতরাশি নিয়ে এমন অহঙ্কারীভাব দেখাতে শুরু করেছিল যে, সে বুঝি আর এখান থেকে যাবে না। সারাবছর ধরে জানুয়ারি মাসই থেকে যাবে। কিন্তু জানুয়ারি মাসের অত ক্ষমতা নেই। ফেব্রুয়ারি মাস এসে হাজির হয়। তবে ফেব্রুয়ারি মাস যে খুব ফেরেশতা এমন নয়, সেও শয়তানের মতো ব্যাপক শীত নিয়ে আসে।
এবার মানুষ মাসের দোষ না দিয়ে শীতের দোষ দেওয়া শুরু করে এবং কিছু মানুষ শীতের প্রকোপে বা প্রতিবাদে মারা যায়। কেউ কেউ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে আর সব মানুষই মেলা কষ্ট পেয়েছে, এ কষ্টের কোনো ভাঙাচোরা নাই। একেবারে অখণ্ড ধরনের কষ্ট। এর মধ্যে মইফুল বুড়ি তার বুড়াকে হারায় শীতের মাচানের ওপর। শীতের ঘর থেকে তার বুড়াকে নামিয়ে এনে কবরের ঘরে রেখে আসে লোকজন আর সে পুরো ফেব্রুয়ারিজুড়ে গালি দেয় শীতকে—‘গোলামের ব্যাটা জাড়, বুঢ়াটাকে ধরে লিলে, মাইর্যা ফেললে। মিনস্যার মুখ চিপে মনে হইছে রস বাহির কর্য দিই।’ লোকজন তার গাল দেয়া দেখে হাসে, ‘কী গো বুড়ি, বুড়ো তোমার আর কী কাজেই বা লাগত এ বয়সে?’ বুড়ি মুখ খারাপ করে, ‘মিনসেরা তোরা মাগ-ভাতার মানে শুধু চুদাচুদিই বুঝিস।’
এ চুপ থাকাটাকে তারা আরও একটা প্রমাণ হিসেবে নেয়। তাকে তারা জোর করে ধরে নিয়ে আসে নাইট স্কুলের বারান্দায় আর তাৎক্ষণিক বিচার সভার মতো একটা বিচার বসে যায়।
নজু মুন্সি একদিন খুন্তা নিয়ে বের হয় ফেব্রুয়ারি মাসকে বা শীতকে গুঁতিয়ে খুন করার জন্য। পথিমধ্যে লোকেরা তাকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে। এতে করে একটা কিশোরের কপালে খুন্তার একটু গুঁতো লাগে আর রক্ত বেরিয়ে যায়। কিশোরের রক্ত বের হওয়া দেখে নজু মুন্সি ক্ষান্তি দেয়। সে খুন্তা ফেলে দিয়ে কিশোরটির কাছে মাফ চাইতে শুরু করে। কিশোরটি তখন বলে—‘না, থাক আপনাকে মাফ চাইতে হবে না। আমাদের ভালোর জন্যই তো আপনি শীতকে খুন করতে যাচ্ছিলেন।’ এসব কারণে হোক আর যে কারণেই হোক শীতটা চলে যায়। কিছুদিন ভালো কাটে।
কিন্তু এপ্রিল-জুন মাসের দিকে গরম তার আগুনের জুতো পরে পূর্ণাঙ্গ শরীর নিয়ে এসব মাংসের তৈরি প্রাণীদের লোকালয়ে নেমে আসে। ‘মানুষতো মৃত মাংস সিদ্ধ করে, গ্রীষ্মটা দেখছি জীবিত মাংসই সিদ্ধ করবে’—কথাটা বলে কপাল থেকে আঙুল দিয়ে মুছে ঘাম ফেলে নজু মুন্সি আর হাঁসফাস করে। আঙুলের ডগা দিয়ে আঙুরের মতো ঘাম পড়ে টপটপ করে। সে আরও বলে ‘শীতই না পারতে ভালো ছিল, বালের গরম’।
মইফুল বেওয়া নিমগাছের তলে তার ভাঙা খাটলি বের করে মুখ ব্যাজার করে শুয়ে থাকে—‘কোনো কিছুর কোনো হিসাবই নাই, এত গরম দ্যায় নাকি। শীতের চাইতে এই গরমের স্বভাব খুব ভালো লয়। এ গরম চরম ধরণের বেয়াদপ।’
বর্ষা আসলেও মানুষদের কথার খুব হেরফের হয় না। প্রতিবছর এ ব্যাপারটা থাকে।
কিন্তু গতবছর অন্য একটি কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে। কারণ, সেবার একটা ঘটনা ঘটে। না, সে অর্থে একটা ঘটনা নয়, আসলে প্রতিটা মুহূর্তে অজস্র ঘটনা ঘটে। কিন্তু ওই ঘটনাটির জন্য গেলো বছরটাকে বেশি মনে আছে মানুষের।
হ্যাঁ, গত বছর, মোকাশ্বেরদের বাড়িতে গোলা থেকে ধান চুরির একটা ব্যাপার ঘটে। ভোরে উঠে মোকাশ্বের তার কাটা গোলা দেখে, গলা ফাটা চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করে। যেন তার গোলা কাটা হয়নি, তার গলা কাটা হয়েছে। তার চিৎকার আর কান্নার রেলগাড়িতে লোকজন চড়ে বসে আর তার বাড়ির কাছে এসে নামে। তার কাছে থেকে জানতে পেরে কী করবে, বুঝতে পারে না। বেলা বাড়ে ধীরে ধীরে, লোকজন বাড়ে তার দ্বিগুণ গতিতে।
ভিড়ের মধ্যের একজন বলে ওঠে—‘মহব্বত মিস্ত্রিকে রাত দুটার দিকে এখান দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছি, তখন আমি মুতার জন্য বাইরে বের হয়েছিলাম।’ লোকজন একটু আশার ঝিলিক দেখে। তারা আশাটাকে ধরে নেয় আর আশাটাকে সকলে আলাপ-আলোচনা করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে একটা বড় বেলুন তৈরি করে। তারা সকলেই সেই বেলুনে চড়ে উড়ে মহব্বত মিস্ত্রির বাড়িতে গিয়ে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পায়। বেশিরভাগ মানুষ ভোরের দাঁত মেজে ভোরের মুখ ধুয়ে দিচ্ছে। আর মহব্বত মিস্ত্রি তখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। ‘সারারাত ধরে জেগে থাকলে কে ঘুমাবে না সকালে’—দারুণ এক যুক্তি পাওয়া গেছে মনোভাব নিয়ে কোনো একজন বললো কথাটা। সবাই কথাটিকে একটি যুক্তি হিসেবে নিয়ে নেয়।
যুক্তির দড়ি তৈরি করে তারা মহব্বত মিস্ত্রিকে তার বউয়ের কান্নার কোল থেকে তুলে বেঁধে নিয়ে আসে বাড়ির বাইরে। তাকে জানিয়ে দেয়া হয়. সে চুরি করেছে। সে বলে—‘আমি এই পশ্চিমমুখো হয়ে বলছি চুরি করিনি।’ তখন, যে বলেছিল যে তাকে রাতে দুটার দিকে দেখেছে তার দিকে সবাই তাকায়। মানুষের তাকানোগুলো ছিল মৌমাছির মত। এসব মৌমাছি রাত ২টা সম্পর্কিত উক্তিকারী লোকটির পুষ্পমুখের দিকে ছুটে যায়। লোকটি বলে—‘শালাকে দুচার বাড়ি লাগাও সব বলে দেবে।’ আরও একটা যুক্তি যোগ হয়ে গেলো ঘটনার সঙ্গে। তার কথার যুক্তিটা সবার মনে ধরে। যুক্তিটা সবার মনকে ধরে টান দিলে তাদের মন বের হয়ে আসে আর মহব্বত মিস্ত্রিকে লাত কিল মারা শুরু করে। ‘ওরে বাবা রে, ওরে মা রে, মরে গেলাম রে’—বলে চিৎকার করে ওঠে মহব্বত। কিছুক্ষণ তারা মার দেওয়া থেকে থামে, তার কাছে থেকে স্বীকারোক্তি বের করার জন্য। একজন বললো—‘তুই যে চুরি করিসনি কহছিস, তো অত রাইতে কুণ্ঠে গেছিলি বল?’ এ প্রশ্নে মহব্বত মিস্ত্রি হতচকিত হয়। এ প্রশ্নের উত্তর না করে সে চুপ করে থাকে। তাকে চুপ থাকতে দেখে লোকজন আশাবাদী হয়। এ চুপ থাকাটাকে তারা আরও একটা প্রমাণ হিসেবে নেয়। তাকে তারা জোর করে ধরে নিয়ে আসে নাইট স্কুলের বারান্দায় আর তাৎক্ষণিক বিচার সভার মতো একটা বিচার বসে যায়।
ফজু বিল্লি বলে—‘না ব্যাপারটা তা নয়। তোমরা যতবার মহব্বত মিস্ত্রিকে মারছিলে ততবার আমাকেও ব্যথা লাগছিল আর বারবার শুনতে পাচ্ছিলাম—‘কেন চুরি করেছিস বল?’ এই দেখুন, আমার শরীর রক্তাক্ত হয়ে গেছে। আমি থাকতে না পেরে ছুটে এসেছি।’
তাকে আবার নতুন করে প্রশ্ন করা হয়—রাত দুটোর সময় তবে তুই কোথায় গেছিলি বল।’ মহব্বত মিস্ত্রির কাছে বলে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। মহব্বত মিস্ত্রি বলতে শুরু করে—‘রাত একটার দিকে আমার ঘুম ভেঙে যায় এবং বউকে বলি—বউ তোমার পরিচয় নেবো, তোমার পরিচয় নিতে খুব ইচ্ছে করছে। তখন আমার বউ পরিচয় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় এবং বলে আমি প্রস্তুত তুমি পরিচয় নাও। তখন আমি উঠি আর যেখানে আমাদের কনডম থাকতো, সেখানে যাই কনডম নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু দেখি কনডম শেষ হয়ে গেছে। তাই বের হয়ে কলিমের দোকানে যাই কেনার জন্য। কলিম সম্ভবত ঘুমিয়ে গেছিল বা দোকানে ছিলই না বা ইচ্ছে করে সাড়া দিচ্ছিল না। তাকে বার বার ডেকেও তার সাড়া পাইনি। পৃথিবী এমন অনেক সন্তান আছে যাদের জন্ম হয়েছে কনডম না থাকার কারণে বা পরিচয় নেওয়ার সময় কনডম ফেটে যাওয়ার কারণে। আমার ভাবতেই অবাক লাগে এ পৃথিবীতে একটা মানুষ চলে এলো শুধু ফাটা কনডমের জন্য বা কনডম না থাকার জন্য। আমার ক্ষেত্রেও এমন হোক আমি চাইনি। তাতে যদি আজ বউয়ের পরিচয় নেওয়া থেকে আমাকে বিরত থাকতে হয়, তাও স্বীকার। তারপরেও শেষ চেষ্টা হিসেবে আমি ভাবলাম, একটু হেঁটে বাজারেই চলে যাই, কোনো না কোনো দোকান খোলা পাওয়া যাবে। সেখান থেকে ফিরতে দুটা বেজে যায়। কনডম নিয়ে ফিরে এসে বউয়ের পরিচয় নিই। বউয়ের পরিচয় নেওয়া এবং রাতে হাঁটাহাঁটির কারণে ভোর হয়ে গেলেও আমার ঘুম ভাঙেনি।’
বিচারসভাতে গরিবুল্লা মোল্লা ছিল। গরিবুল্লা মোল্লা বলে—‘তুমি বেধর্মী জিনিস ব্যবহার করো কেন, তুমি কি বাচ্চা নিতে চাও না? ইচ্ছে করে বাচ্চা বন্ধ রাখা, এটা তো বিরাট গুনাহের কাজ।’ তখন মহব্বত বলে—‘আমি বাচ্চা নিতে চাই না। মানুষ শীত দ্বারা অপমানিত হয়, গ্রীষ্ম দ্বারা নির্যাতিত হয়, মানুষ দ্বারা অপমানিত হয়। আমি বেঁচে থেকে বিভিন্নভাবে কষ্ট পাচ্ছি। আমার বাচ্চাও এই পৃথিবীতে এসে এমন কষ্টকর বিষয়ের মধ্যেই পড়বে। যদি কষ্টের ভেতর না পড়ে তবে নিশ্চয় সে কাউকে কষ্ট দেবে। কষ্ট পাওয়া যেমন খারাপ, তেমনভাবে কষ্ট দেওয়াও খারাপ। সুতরাং এসব কথা বলে আমাকে লাভ নেই, আমি জেনে শুনে আমার সন্তানকে এ কষ্টের কারখানা পৃথিবীতে এনে ফেলতে চাই না। আমি আমার সন্তানকে খুব ভালোবাসি, জেনে বুঝে তাকে কষ্ট অবশ্যই দেব না।’
গরিবুল মোল্লা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। মোকাশ্বের তাকে থামিয়ে দেয়। মোকাশ্বের দেখে ধানের বিচার বাদ দিয়ে প্রাণের বিচার শুরু হতে যাচ্ছে। ফলে সে বলে ওঠে—‘ভাইয়েরা এগুলো নিয়ে কথা বলা বাদ দিয়ে আমার ধানের সুরাহাটা করেন।’ লোকজন আবার ধানের দিকে মনোযোগ দেয়। তাকে আবার মারা শুরু করে। মহব্বত চিৎকার করতে থাকে—‘আমি ধান চুরি করিনি’। এসময় লোকজন খেয়াল করে, ও পাড়ার ফজু বিল্লি চিৎকার করতে করতে এদিকেই আসে। সে বলে—‘ভাই মাফ করে দাও আমিই চুরি করেছি।’ তখন সবাই অবাক হয়। কেন চুরি করেছে বা কোথায় ধান রেখেছে, এসব কথা বাদ দিয়ে জিজ্ঞাসা করে—‘তুমি ধান চুরি করেছ কিন্তু এসে বলছ কেন? তবে তো তুমি ভারেঅ লোক।’ ফজু বিল্লি বলে—‘না ব্যাপারটা তা নয়। তোমরা যতবার মহব্বত মিস্ত্রিকে মারছিলে ততবার আমাকেও ব্যথা লাগছিল আর বারবার শুনতে পাচ্ছিলাম—‘কেন চুরি করেছিস বল?’ এই দেখুন, আমার শরীর রক্তাক্ত হয়ে গেছে। আমি থাকতে না পেরে ছুটে এসেছি।’
বিচারের লোকজন মহব্বত মিস্ত্রির দিকে তাকিয়ে থাকে মুগ্ধ হয়ে বহুক্ষণ। মহব্বত মিস্ত্রির মুখ থেকে আলো মাখা একটু হাসি চুয়ে পড়ে ছুয়ে নেয় সবা মানুষকে।