অফিস থেকে বাসায় ফিরে সেলফোনটা অফ করে রেখেছিলাম। রাত নয়টার দিকে অন করতেই কয়েকটি টেক্সট ম্যাসেজের টোন। মিসকল অ্যালার্ট জানিয়ে দিচ্ছে তিলোত্তমা ফোন করেছে কয়েকবার। ম্যাসেজগুলো পড়া হতে না হতেই আবার ফোন। বিস্ময়ের ঘোর তখনো কাটেনি। তার আগেই ফোন আসাতে আমি খানিকটা হতভম্ব। ধরব কি ধরব না, অভিমান দেখানো ঠিক হবে কি, হবে না এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে রিসিভ করে ফেলেছি…
তুমি কোথায়?
কেন বাসায়!
একটু আসতে পারবে?
এত রাতে! কেন!
আসতে পারবে কি-না তাই বলো।
গেলাম তিলোত্তমার কাছে। তিলোত্তমা নিয়ে গেল ডাক্তারের চেম্বারে। তার জন্য নয়। তিন বছরের কন্যার জন্য। আজ পারভিনকে বলেছি, তার কাছে একটা সত্য স্বীকার করব। আমাকে রাত দশটার পর ফোন করার কথা।
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে রিকশায় উঠতেই বেনজিনের ফোন। হাত থেকে মুঠোফোনটি নিয়ে রাগত স্বরে তিলোত্তমা বলে, ও তোমাকে এত রাতে ফোন করে কেন? স্বর্পরাণী কোথাকার!
আমি কিছুই বলি না। ফোনটা সাইল্যান্ট করে পকেটে রেখে দেই।
রিকশাকে থামতে বলে তিলোত্তমা। মূল রাস্তা থেকে বের হওয়া আরেকটা শাখা রাস্তার মাথায় রিকশাটা থেমে যায়। হালকা অন্ধকার আর স্ট্রিট লাইটের ঝাপসা আলোয় স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে। মেয়েকে নিয়ে রিকশা থেকে নামতে তার একটু কষ্টই হয়। আমার পিঠে ওড়নাটার চাপ লেগে ছিল। বেবিকে নিয়ে নামতে ঝোঁক সামলানোয় সেটা রয়ে যায় আমার পিঠ আর রিকশার সিট বরাবর। সে একটু আড়ালে দাঁড়ায় যাতে চাঁদেও আলোয় প্রকাশিত না হয় তার গোপন সৌন্দর্য। আমি দ্রুত নেমে ওর দিকে তাকাই। দেখি সে তার মায়াবী চোখের সবক’টি দীর্ঘপল্লব মেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কী যে আছে ও চোখে! কী যে বলতে চায়!
আমি মূল রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। একটা মোটর সাইকেল চলে গেল দ্রুত। তিলোত্তমার ভাড়া বাসার মেইন গেট খুলে গেল। তারপর লাইট নিভে গেল। আমি রাস্তাটির সাথে লাগোয়া একটি উঁচু প্রাচীরের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। পুকুরের জলে হালকা ঢেউ। পানির ওপরে অন্ধকারের আবেশ।
ওড়নাটা ওর গলায় ঝুলিয়ে দেই। কী যে সুবাস! যখন ওটা আমার শরীর বরাবর আটকেছিল, মনে হয়েছিল যেন ওড়নাটা ওর না।
শাখা রাস্তা থেকে সামান্য দূরেই ওর ভাড়া বাসা। রাস্তাটির পাশে একটা পুকুর। পুকুরের ওপারেই পাঁচতলা বাড়িটা। ওর বেবি ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি ওর দিকে দু’হাত বাড়াই। খুব সাবধানে ওর শরীরের স্পর্শ বাঁচিয়ে বেবিকে কোলে নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমার সকল সাবধানতাকে সে ধূলিসাৎ করে দিয়ে এত ঘনিষ্ঠভাবে আমার কোলে তার বেবিকে তুলে দেয় যে তার সুঢৌল বুকের চূড়ায় আমার আঙুলের স্পর্শ লেগে যায়। এত নরম! এই তাল তাল কোমলতার ভেতর থেকে এক অপরূপ সুবাস আমার সকল চেতনাকে ছেয়ে ফেলে। আমি একটু সরে দাঁড়াই। তিলোত্তমা ওড়নাটা ঠিক করে হাঁটতে থাকে।
মানুষের হাঁটাও এত সুন্দর হয়! এমন অপরূপ ছন্দ কোনোদিন দেখিনি আমি। এই ছন্দ কি আজ আমাকে তার গোপন মাত্রার ভেতরে লীন করবে! তা কী করে হয়! সেটাও ভাবি।
কিছুদূর গিয়েই ছন্দ থেমে যায়। সে পেছনে ফিরে দুই কদম এগিয়ে এসে আমার মুখোমুখি হয়ে ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়ায়। মাঝখানে তার বেবি আমাদের সেতু হয়ে থাকে। ও ফিসফিস করে বলে, আর এসো না।
আমি সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলাম। ও ঘুরে আমার দিকে তাকালো। তিলোত্তমাকে একটু ক্লান্ত লাগছে। না-কি তার ভেতরে জেগে ওঠা কামনাকে ছাই চাপা দেওয়ার আহত অভিমান! ওড়নাটা এলোমেলো। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। বুকটাও চোখ এড়ালো না। আমি চাইনি তাকাতে। তবুও কী যে হয়ে যায়! বারবার বিস্মিত বিদ্যুৎ খেলে যায় তিলোত্তমার গায়। তিলোত্তমা ঘাড়টা একটু কাত করে আবারও ফিসফিস করে বলে, ধন্যবাদ দেব? আমিও ফিসফিস করে বলি, না।
আমি মূল রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। একটা মোটর সাইকেল চলে গেল দ্রুত। তিলোত্তমার ভাড়া বাসার মেইন গেট খুলে গেল। তারপর লাইট নিভে গেল। আমি রাস্তাটির সাথে লাগোয়া একটি উঁচু প্রাচীরের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। পুকুরের জলে হালকা ঢেউ। পানির ওপরে অন্ধকারের আবেশ।
দাঁড়িয়ে আছি কতক্ষণ! জানি না।
তিলোত্তমার শোবার ঘরের বেলকুনির দরোজায় সামান্য আলোর চলাচল। পুকুরের পানিতে বিম্বিত হওয়ার মতো সুদীর্ঘ নয়। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। রেলিং-এ বুঝি হাত পড়ল কারও! এতক্ষণে মনে হলো হালকা চাঁদের আলোতে ছায়া পড়ছে আমাদের। আমরা যদিও তা জানি না। হঠাৎ জোনাক পেকার মতো জ্বলে উঠল তার জিরো ফিগারের নাকফুল। আমি বুঝলাম পৃথিবীর সকল সুবাস নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে বেলকুনিতে।
একটু পর হালকা নীল রঙের লাইট জ্বলে উঠল সেখানে। খোলা চুলের অরণ্যের মাঝে মায়াবি একটা মুখ। দুই হাত দিয়ে আহ্বান করে তার দিকে। আর এক হাত নিয়ে যায় তার বুকের অন্ধগলির ওপর।
আমি তখন ওই সুদীর্ঘ প্রাচীরের ছায়ার ভেতর আমার নিজের ছায়ার দৈর্ঘ্য বাড়াই না। চলে আসি।
দুই.
মৌসুমের প্রথম বৃষ্টির একটা আলাদা মাহাত্ম্য আছে। প্রথমে সামান্য ধূলিঝড় হবে। তারপর হালকা বৃষ্টি। রাস্তা ভিজবে। বৃষ্টি থেমে যাবে। তারপর বের হবে মাটির এক বিচিত্র গন্ধ। বৃষ্টি যদি বিকেলের দিকে হয় তাহলে সন্ধ্যায় ফুটবে কনে দেখা আলো। যে আলোয় সবাইকে সুন্দর দেখায়।
ওই কনে দেখা আলোর জন্য নয়। মাটির ওই সোদাগন্ধ পেতে আমি এই বৃষ্টির জন্য প্রতিবছর অপেক্ষা করি। যখন ছাত্র ছিলাম তখন তো কোনো সমস্যাই ছিল না। এখন চাকুরি করার জন্য সমস্যা হয়েছে। ওইদিন যদি ছুটির দিন না হয় তাহলেই তো গেছে।
অজ্ঞাত কারণে আমি এই সময়টা আযিযুল হক কলেজের ক্যাম্পাসে কাটাই। ধূলিঝড় থেমে যাবে। শুরু হবে বৃষ্টি। আমি ওই বৃষ্টির ভেতরে ভিজব। তারপর কোথাও বসে পড়ব। গন্ধের জন্য প্রতীক্ষা।
এ রকম একটি দিনে যখন ধূলিঝড়ের আয়োজন শেষ। কোত্থেকে এক রিকশা এসে সামনে থামে। হুড খুলে ভেতর থেকে এক নারী এসে হাত ধরে বলে ‘রিকশায় ওঠো।’ তিলোত্তমা।
এক গোলাপি আলো ক্রমশ হারিয়ে গেল তার নীল জামার ভেতরে। তার আগে সূক্ষ্ণ জ্যামিতিক এক বিশাল ঢেউ নীল সুতোর সাথে মিশে গেল। তারপর নীল অন্ধকারের ভেতর থেকেই জানান দিলো কতটা তীক্ষ্ম সে উচ্চতা।
হুডটা ওপরে উঠে যায়। সে বলে, এই রিকশা যাও।
আমি বলি, কী হলো?
সে বলে, কিছু না।
তাহলে এ রকম করলে কেন?
এমনি
এমনি মানে? এমনি কেন?
তুমি রিকশায় উঠলে কেন?
তুমি এসে রিকশা থামালে কেন? আমাকে ডাকলে কেন?
তুমিই তো থামালে?
থামালাম মানে? তুমি ফোন করলে কেন?
হ্যাঁ করলাম। তাতে কী?
তাতে কী মানে?
তুমি ফোন ধরলে কেন?
কেন ফোন ধরলে কী হয়? তোমার সাথে কী আমার শত্রুতা?
তাই বলে কেউ রিকশায় উঠতে বলবে আর উঠতে হবে?
একটু পর সে আবার বলে,
দুষ্টু কোথাকার। রিকশায় উঠেছে। আর কোথায় উঠবে?
তাহলে ফেলে দাও।
দেবোই তো।
দাও।
এখন না।
কখন?
সময় হলে।
কখন সময় হবে?
যখন ওপরে ওঠা শেষ হবে।
মানে?
মানে কিছু না।
তুমি আমাকে একটা কাজ করতে দিলে না।
ওমা। কী করতে চাইলে তুমি আর আমিই বা কী করতে দিলাম না! একবার হলেও কিছু করতে চাও। চাও না একবার!
তিলোত্তমা আসলে কিসের ইঙ্গিত করে আমি ঠিক বুঝতে পারি না। আমি একটু গম্ভীর হয়ে বলি, আমার গন্ধ নেওয়া হলো না এবার।
তিলোত্তমা বলে, আমার তো নেওয়া হলো। আমি তো গন্ধ পাচ্ছি।
আমি পাচ্ছি না।
তিলোত্তমা আমার দিকে মুখ করে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে নাকের কাছে তার গলা এনে ফিসফিস করে বলে, সত্যি গন্ধ পাচ্ছ না?
তিলোত্তমার থুতনি আমার মাথার ওপরে। সে কি আমার চুলের ওপরে শূন্যে চুমু খেল! কি জানি! তবে আমার চোখ ঠিকই তার গলা বেয়ে বুকের দিকে যেতে থাকল। এক গোলাপি আলো ক্রমশ হারিয়ে গেল তার নীল জামার ভেতরে। তার আগে সূক্ষ্ণ জ্যামিতিক এক বিশাল ঢেউ নীল সুতোর সাথে মিশে গেল। তারপর নীল অন্ধকারের ভেতর থেকেই জানান দিলো কতটা তীক্ষ্ম সে উচ্চতা। অন্ধ গলির ভেতর থেকে যে আলোর ইশারা তা কেবল আগুনে লীন হওয়ারই দুরন্ত উচ্ছ্বাস। রিকশার হালকা দুলুনিতে সমুদ্রের নোনা ঢেউ। সে ঢেউয়ে শুধুই অবগাহনের ইশারা।
তিলোত্তমাকে রিকশা থেকে নামিয়ে দিয়ে সাত মাথায় এলাম। স্টেশন রোডে এসে বৃষ্টির ঝাপটা তীব্র হলো। ভিজে গেলাম সম্পূর্ণ। ভেজা শরীর নিয়েই হাঁটতে থাকলাম। আহ! কী প্রশান্তি। গতকাল প্রাকসন্ধ্যায় ঘুমের ভেতরে হালকা মেঘের ভাঁজে তাকে দেখেছিলাম। এই বৃষ্টির ফোটা যখন মাথায় এসে পড়ছে তখন মনে হচ্ছে জলেশ্বরীর জলগণিত আমার সঙ্গে। মনে হচ্ছে সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কী প্রশান্তি! মাথায় যে অনেক যন্ত্রণা আমার। সাতমাথা থেকে বাসা পর্যন্ত হেঁটে এলাম ভিজতে ভিজতে। এক ফোঁটা পানিও মোছার চেষ্টা করিনি। জলেশ্বরীর পবিত্র স্পর্শ। মোছা যায়! যায় না। কখনো না
তিন.
রাতে একটা স্বপ্ন দেখি। চলে যাচ্ছি কোথাও। আমার কর্মস্থল ছেড়ে। আমার চলাচলের ব্যপ্তি থেকে। আমার চোখ-চেনা জগৎ থেকে। যাবার আগে অশ্রুরুদ্ধ চোখ আমার, বাষ্পরূদ্ধ কণ্ঠ। দেখছি অফিসে ফেয়ার ওয়েল হচ্ছে। অনেক কিছু বলতে গিয়ে বলতে পারছি না। কান্না পাচ্ছে। কাঁদছি আমি। আমার চোখের পানিতে কনফারেন্স রুমের টেবিল ভিজে যাচ্ছে। আমি কারো দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছি না।
সকালে তিলোত্তমার ফোন পেয়ে ঘুমটা ভেঙে গেল। ওরে বাব্বা। একেবারে আল্টিমেটাম। শোনো, আজ সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যেই বের হতে হবে।
আমি বলি, সেটা কি সম্ভব!
তিলোত্তমা আমার কথা আমাকেই ফেরত পাঠায়। বলে, আন্তরিকভাবে চাইলেই সম্ভব।
কেন হঠাৎ এমন আল্টিমেটাম?
এমনি।
অবশ্যই এমনি না।
আগে বলো।
আমি ফোন রাখলাম।
তুমি এখন ফোন রাখলে আমি যাব না।
আমার এ রকম কঠিন কথা শুনে সে কোনো কথা বলে না। একটা হালকা দীর্ঘনিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া যায় মোবাইল ফোনে। পরিস্থিতি হালকা করার জন্য আমি তার মতো করে একটি দাবি পরপর তিনবার বলি,
আমি এখুনি শুনব। আমি এখুনি শুনব। আমি এখুনি শুনবো।
একটা রিনিঝিনি হাসির শব্দ ভেসে আসে মোবাইল ফোনে। তুমি তো কোনোদিনই নিজে থেকে কিছু করলে না। আমার ভঙ্গিটাও নকল করছ। কবে তোমার জ্ঞান হবে?
আমি তখনও সিরিয়াস। বলি, তাহলে তুমি বলবে না?
এখন তো বেশ অস্থির। অন্য সময়ে দুধ-বাচ্চা হয়ে থাকো কেন?
আমার মাথায় একটা চক্কর দিয়ে ওঠে। রক্তে একটা শিহরণ বয়ে যায়। সুপ্ত আগ্নেয়গিরিতে বেড়ে যায় লাভার চাঞ্চল্য। আমি বুঝি না, তিলোত্তমা আমার এ সময়ের অনুভূতি টের পাচ্ছে কি-না।
তিলোত্তমা ফিসফিস করে বলে, শোনো কাল আমার হাসব্যান্ড আসবে। তাই আজ তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে চাই। ও কয়েকদিন থাকবে।
আর কোনো কথা বলল না সে। শুনলও না। কেটে দিল ফোন।
তখন থেকেই আমার ভেতরে এক ধরনের ঈর্ষা কাজ করতে শুরু করেছে। ওর হাসব্যান্ড আসবে! তখন তো তার জগতে আমি থাকব না। মানুষ যে এত অন্যের জগতে নিজেকে দেখতে চায় তিলোত্তমার সঙ্গে সম্পর্ক না হলে বোঝাই যেত না। আচ্ছা ওর হাসব্যান্ড তো অনেকদিন পর আসছে। কতটা পিপাসা নিয়ে আসছে সে? তিলোত্তমার পিপাসা কেমন? তিলোত্তমা কিভাবে উজাড় করবে নিজেকে! করবে কি? না-কি করবে না? পারবে সে! কেনই বা পারবে না!
মাথার ভেতরে কেমন করে ওঠে।
থাক এখন এসব ভাবলে চলবে না। অফিসে যেতে হবে। গোসলে ঢুকেও তিলোত্তমা আর ওর হাসব্যান্ডের বিষয়টি মাথা থেকে যায় না। এখন নিজের ওপর রাগ লাগছে। কেনই বা ওরকম জেদ করতে গেলাম! ওর হাসব্যান্ডের আসার কথা না শোনাই তো ভালো ছিল। সময়টা দারুন উপভোগ করা যেত! এখন তো আশঙ্কা জাগছে, মাথার ভেতর এই বিষয়টি থাকলে তো সবকিছুই মাটি হয়ে যাবে।
গোসল করতেও দেরি হয়ে গেল। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে দেখি নয়টা ত্রিশ। ওরে সর্ব্বনাশ! আজ নির্ঘাত লাল কালি। খুব দ্রুত রেডি হয়ে বের হলাম। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি তিলোত্তমা একটা টেক্সট করেছে, আমার আশ্চর্য চকোলেট, তুমি কখনো চুইংগাম হয়ো না…
অফিসে এসে সিটে বসার পর একটা ফোন এলো। ইন্টারকম। তিলোত্তমা বলে, নাস্তা করোনি কেন?
আমি বেশ হতভম্ব হয়ে যাই। আরে! মেয়েটা জ্বিন না-কি। সবকিছু বুঝে! আমি কিছু একটা বলতে যাব তখনই সে বলে, দুধ খাবে? আমার কাছে দুধ আছে। বলেই কেটে দেয় সে।
প্রায় ঘণ্টাখানেক পর তিলোত্তমার ফোন, কই তুমি? আমি কত কষ্ট করে বের হলাম। তুমি জানো না আমার আরেকটা আলাদা জগৎ আছে? সেখানে স্বামী-সংসার বেবি সবকিছু সামলে রাখতে হয়? তোমার তো ওসব কিছু নেই। আমি যদি এগুলো সামলে আসতে পারি তুমি কেন পারবে না?
অফিস থেকে বের হতে হতে সাতটা বেজে গেল। আমি ফোন দিলাম। সে জানালো, বাসা থেকে বের হতে পারছে না। একটু দেরি হবে। আমি যেন মনে কিছু না করি।
যেহেতু হাতে সময় আছে সেহেতু এই ফাঁকে একটু কাজ করা যেতে পারে। জলেশ্বরীতলায় শখ নামের দোকনে এক বিচিত্র ধরনের ব্যাগ পাওয়া যায়। ব্যাগটাকে গোছালেই লাল গোলাপ। মেললে ব্যাগ। ব্যাগের মাঝখানে আবারও লাল গোলাপ থাকে একটা। ভাবলাম ওটা কিনে গিফট করব তিলোত্তমাকে। শখে ঢোকার আগে দেউড়ি নামের বিশেষ রেস্টুরেন্ট কাম শোপিসের দোকানে ঢুকলাম। শোপিসগুলোতে একনজর চোখ বুলিয়ে নেওয়ার মতো কিছু না পেয়ে যেই ভেতরের বিশেষ রেস্টুরেন্টের দিকে চোখ ফেলেছি, দেখি তিলোত্তমা রাতুল নামের আমার এক সহকর্মীর সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে বসে হেসে হেসে গলিয়ে পড়ছে। আমি এক মুহূর্ত দেরি না করে বের হয়ে এলাম।
আমি বের হয়ে আড়ালে দাঁড়ালাম। একটু পরই ওরা বের হয়ে একটা রিকশায় উঠে হুড তুলে দিল। আমিও আরেকটি রিকশায় উঠে ফলো করতে লাগলাম।
তারা শহরে সদ্য উদ্বোধন করা একটি বিনোদন পার্ক শাহনেওয়াজ বিনোদনের গেটে এসে নেমে পড়ল। এই রাতে একমাত্র কাপলদেরই এখানে প্রবেশাধিকার থাকে। বেবি এলাউ না। ওরা টিকিট কেটে দুজন দুজনের হাত ধরে ভেতরে ঢুকে পড়ল। আমি শাহনেওয়াজ পার্কের ভেতর থেকে গজিয়ে ওঠা এক বিশাল বৃক্ষের ছায়ায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম
প্রায় ঘণ্টাখানেক পর তিলোত্তমার ফোন, কই তুমি? আমি কত কষ্ট করে বের হলাম। তুমি জানো না আমার আরেকটা আলাদা জগৎ আছে? সেখানে স্বামী-সংসার বেবি সবকিছু সামলে রাখতে হয়? তোমার তো ওসব কিছু নেই। আমি যদি এগুলো সামলে আসতে পারি তুমি কেন পারবে না?
আমি বললাম, তিলোত্তমা, আমি একটু ব্যস্ত আছি।
তিলোত্তমা বলল, রাগ করো না জান। প্লিজ। একটু বোঝার চেষ্টা করো।
আমার নীরবতা।
প্লিজ সোনা, এসো না! আজ তোমাকে এমন একটা জিনিস দেব যা তুমি কোনোদিন পাওনি।
আমি না-পাওয়া জিনিসটি নিয়ে ভাবতে থাকি। না-পাওয়া জিনিসটি কি প্রথম বৃষ্টিতে ভেসে আসা মাটির গন্ধ! না-কি রিকশারোহী তিলোত্তমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে চলে যাওয়া! আর তাতে হারিয়ে যাওয়া কণে দেখা আলো! না-পাওয়া জিনিসটি কি পেয়ে পেয়ে অভ্যস্ত গন্ধটির হঠাৎ হারিয়ে হাওয়া হাহাকার! না-কি পেয়ে পেয়েও না পাওয়ার প্রবল তৃষ্ণা? নাকি পিপাসা আর রহস্যের গন্ধে মাতোয়ারা হতে হতে আরেক গন্ধের জন্ম দেওয়া? না-কি না-পাওয়াটা হলো হালকা নীল আলোর ভেতরে বেলকুনি থেকে আগত ইশারা! না-কি ইশারায় বুকের অন্ধগলিতে ডুবে যাওয়ার আহ্বান দেখে অনভিজ্ঞ যুবকের ফিরে আসা? না-কি শুধুই নরম মাংস শক্ত মাংসের কারবার?
ঘোর লাগে আমার। খনিকটা বিস্ময়। কিন্তু তিলোত্তমা সেই জোঁক যার নিকট থেকে নিস্তার নেই।
চার.
হাসনের নাওয়ের মতো রিকশা ছুটে চলছে। কোথায় যাচ্ছে জানি না। এই মফস্বল শহরের যে রাস্তাগুলো খুব তাড়াতাড়ি গভীর রজনী হয়ে যায় সে-সব রাস্তা দিয়ে ছুটে চলছে রিকশা। তিলোত্তমা খুব ঘনিষ্ট হচ্ছে আমার সঙ্গে। আমার কাঁধে মাথা রাখার চেষ্টা করছে। আমার শরীরের সঙ্গে তার বুক লেপ্টে ধরছে। রিকশার গতি আর বাতাসের ধাক্কায় তার ওড়না এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে তার খেয়ালও নেই। কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত সে আমার স্পর্শে থাকতে চাচ্ছে। ঘাড় থেকে তার মুখটি আমার মুখের দিকে আসতে চাচ্ছে।
আমি বললাম, তুমি কি সত্যিই বাসায় ছিলে? না-কি অন্য কোথাও?
তিলোত্তমার নীরবতা।
তুমি বাসায় ছিলে না-কি পার্কে ছিলে?
এলোমেলো তিলোত্তমা এবার খানিকটা গুছিয়ে যায়। সোজা হয়ে বসে। আমি তার মুখের দিকে তাকাই না। তারপর আবারও শিথিল হয়ে যায় সে। আমি তার মুখের দিকে এবারও তাকাই না।
ভাবছি আমি। আমি কি ফেলে এসেছি কিছু? কী ফেলে এসেছি আমি? (উৎপল দা কিছু মনে করবেন না, কেউ কি ব্যক্তিগত চটি ফেলে আসে বাদাম পাহাড়ে!) । তবুও মনে হয় আমি যেন কী হারালাম। আমি কী হারালাম! বুকের ভেতর অনেক ব্যথা। বুকের ব্যথাগুলো চোখের কাছে যায়। চোখের ভেতরে কয়েকফোঁটা পানি।
‘আমি একটা কাজ করব’ বলে সে এবার খানিকটা সোজা হয়ে বসে। তারপর আমার দিকে একটু ফিরে দুই হাত দিয়ে মাথাটি ধরে তার মুখের দিকে এনে নিচের ঠোঁটটি তার ঠোঁটের ভেতর নিয়ে নেয়। তার গালের ত্বক আর নিঃশ্বাসের গন্ধ আমার নাকে এসে লাগে, চেতনা ছোঁয় না। বেলকুনি থেকে হাতের ইশারা দিয়ে বুকের যে অন্ধগলিতে যাওয়ার আহ্বান করেছিল সে, সে-ই অন্ধগলিতে এখন অনেক আলো। আলগা হয়ে যাওয়া জামার ওপর দিয়ে আমার চোখ খুব সহজেই পরিভ্রমণ করে সে-ই গলি আর গলির পাশের মনোরোম পাহাড়, পাহাড়ের গা ভেদ করে আসা উপচে পড়া গোলাপি আলো। কিন্তু ঝাপসা অন্ধকারে না-জানা চাঁদের আলোর ভেতরে যে গন্ধটি পেয়েছিলাম, বেলকুনি থেকে হাত ইশারায় প্রাপ্তির উষ্ণতায় যেভাবে ভিজে উঠেছিলাম তার কোনোকিছুই নেই এখানে। ফলে তাঁর ঠোঁট আমাকে পেল শুধু, আমার ঠোঁট তাকে নিল না একটুও।
ঠোঁট ছেড়ে দিল সে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ তার। বলল, এখন থেকে আমাদের সকল সম্পর্ক শেষ। এই রিকশা থামো।
রিকশাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো থেমে গেল। নেমে গেল সে রিকশা থেকে। চলতে শুরু করল । আমি কিছু বলতে যাব, তখনই রিকশাওয়ালা বলল, এই রাস্তায় কয়েক চক্কর দিয়েছি। নিজের বিপদ আর ডেকে আইনেন না।
পাঁচ.
পরদিন অফিসে যাওয়ার একটু পরই জানলাম আমার ট্রান্সফার অর্ডার চলে এসেছে। আজই আমার এখানে শেষ অফিস। তড়িঘড়ি করে ফেয়ার ওয়েলের আয়োজন করা হলো। দুপুরের পর বের হলাম। ঢাকায় পোস্টিং। ঢাকাগামী গাড়িতে উঠে যখন সিটে বসলাম তখন বিকেল সাড়ে চারটা। একটু পরই এক তরুণী এসে আমার পাশে বসল।
ভাবছি আমি। আমি কি ফেলে এসেছি কিছু? কী ফেলে এসেছি আমি? (উৎপল দা কিছু মনে করবেন না, কেউ কি ব্যক্তিগত চটি ফেলে আসে বাদাম পাহাড়ে!) । তবুও মনে হয় আমি যেন কী হারালাম। আমি কী হারালাম! বুকের ভেতর অনেক ব্যথা। বুকের ব্যথাগুলো চোখের কাছে যায়। চোখের ভেতরে কয়েকফোঁটা পানি।
এক্সকিউজ মি, আপনি কাঁদছেন কেন? উচ্ছল তরুণীর উৎকণ্ঠাময় কিশোরী কিশোরী কণ্ঠ
আমি তার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ বুজলাম। বললাম, দুর্ঘটনা।
কী দুর্ঘটনা? আপনার খারাপ কিছু হয়েছে কি?
মানুষ নিজেই এক দুর্ঘটনা। রবি ঠাকুরের জন্ম যেমন বাংলা সাহিত্যের জন্য দুর্ঘটনা, তেমন।
সিট থেকে উঠে চোখ কপালে তুলে সে বলে, কী! কী বলছেন আপনি এসব!
নাবিলা, আপনার সঙ্গে আমার কোনোদিন দেখা না হওয়াই ভালো।