রাত তেমন হয়নি। এরই মধ্যে অন্ধকার জেঁকে বসেছে কোটবাড়ি এলাকাটিতে। সদ্য গড়ে ওঠা আবসিক এলাকার মতো এখানকার সড়কগুলো অল্প রাতেই মানুষ শূন্য হয়ে যায়। সুনশান নীরবতাকে একটু ঝিরিয়ে নেবার সুযোগ দিয়ে; মাঝে মধ্যে শালবন বিহার পেরিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে দু-একটা অটোরিকশা এখানে দেখা যায় কদাচিৎ।
শালবন বিহারের দিকেই যাচ্ছে রাজিব। এতক্ষণ একটা অটোরিকশার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। অবশেষে হতাশ হয়ে দেখলো ঘড়ির কাটা চল্লিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। তার আর ধৈর্যে কুলালো না। ভাবলো—এইটুকুন তো পথ। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে না থেকে হেঁটে গেলে অনেক আগেই সে তার গন্তব্যে পৌঁছে যেতো। নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই বিড়বিড় করে গালি দেয়—‘ধ্যাৎ দাঁড়াইয়া না থাইক্কা এতক্ষণে হাঁটলেই অইতো।’ রাজিবের মনের কথা মনেই থাকে। বাইরে বের হয় না। বের হতে দেয় না রাজিব। বের হয়েই বা কী হবে! এই তন্দ্রাচ্ছন্ন পথে নিজের পায়ের আওয়াজ শুনতে শুনতেই যখন তাকে হাঁটতে হচ্ছে, তখন কে আর শুনবে তার কথা। মনে মনে ভাবে—সময়ের কাছেই তো আমরা সব অকপটে বলে দেই। ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়। এই একটু বমির তৃপ্তি পাওয়ার জন্যই শ্রেণীবৈষম্য ভুলে, আভিজাত্যের অহঙ্কার ভুলে, ঝুপড়ির মধ্যে বেড়ে ওঠা কিশোরীর বাড়ন্ত স্তনের দিকে চোখ চলে যায় সমাজের। হয়তো তাই হবে! তারপরও বমি করা যায় না। বমি করার জুঁতসই জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় না।
রাজিবের হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে। ব্যাগ ডানহাত-বামহাত করে নেয়। দুইটি ব্যাগের ওজন তেমন একটা তারতম্য নেই। তারপরও হাত পাল্টে নিজেকে একটু সান্ত্বনা দেওয়া। রাজিব একটু দাঁড়ায়। তার আরও দ্রুত হাঁটা উচিত। আরও দ্রুত। কিন্তু দূরের পথে অল্প ওজনও শেষ পর্যন্ত ভারী হয়ে ওঠে। দূরের পথ মানে—কতটা দূরের পথ! মনে মনে মাপতে চেষ্টা করে রাজিব।
ঘণ্টাখানেক আগে যখন সে কোটবাড়ি বিশ্বরোড নেমে সিএনজির জন্য অপেক্ষা করছিল, তখনো বুঝতে পারেনি যে, কোটবাড়ি থেকে শালবনের দিকে যেতে আসলে কিছু পাওয়া যাবে না। তাকে শেষ পর্যন্ত সেই আদম গাড়িতেই দৌড়াতে হবে! বিশ্বরোডে বাইশ মিনিট অপেক্ষা করে একটা সিএনজি পেলো। কিন্তু সিএনজিটি কোটবাড়ি বাজার পর্যন্ত যাবে। শালবনের দিকে যেতে রাজি হলো না। রাজিব কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে সিএনজিতে উঠে পড়লো। ভাবলো অন্তত ওই পর্যন্ত যাওয়া যাক, তারপর কিছু না কিছু তো পাওয়াই যাবে।
ঢাকা থেকে এসে কোটবাড়ি বিশ্বরোড নামা পর্যন্ত তার মধ্যে এক ধরনের চিন্তা ঢেউ তুলেছিল। কিন্তু রয়েল কোচ থেকে নামার পর সিএনজির জন্য অপেক্ষার বাইশ মিনিট তাকে হাঁটিয়েছে প্রায় এগারোটি বছর। যে এগারোটি বছরের প্রতিটি মাস, সপ্তাহ, দিন, ঘণ্টা, মিনিটেরা পর্যন্ত রাজিবের কানে মুখ ঘষেছে। তবে তারা কোনো কথা বলেনি। শুধুই ঘোঙাচ্ছিল। তাহলে কি তারা বোবা হয়ে গেছে! রাজিব নিজের মধ্যে ডুব দেয়। তুলে আনতে চায় সেই কথাবলা সময়। যারা পর্যায়ক্রমে কথা বলা শেখাবে এই বোবাঘড়িকে। যে টিকটিক করে বাজবে। আর সিনেমার দৃশ্যের মতো কথা বলে যাবে অনর্গল। কথা বলবে, শিফা-সীতাকুণ্ড, সেই বহদ্দারহাট, সেই অদম্য উচ্ছ্বাস।
হাত থেকে ব্যাগ রাস্তার পাশে রাখে। তলপেটে জমে ওঠা অনেকক্ষণের পানি বিসর্জনের জন্য দাঁড়ায়। যে চাপ সেই পথের মধ্য থেকে এই কোটবাড়ি পর্যন্ত বয়ে এনেছে। এখন হাঁটতে গিয়ে সেটা আবার ফুলে ব্যথা হয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার বাম পাশে একটা বাড়িতে লাইট জ্বলছে। সেদিকে চোখ যায় রাজিবের। বাড়ির সামনে একটি কুকুর। রাজিব হাসে। মনেমনে গালি দেয়—‘আরে শালার কুত্তা! জগতের সব পাল্টে গেলো তোরা পাল্টাইলি না। এখনো ফেন খাওয়ার মজুরি দেও বাড়ি পাহারা দিয়ে। তার চেয়ে মানুষ হয়ে যা—সময় সময় চেহারা পাল্টে ফেলতে পারবি।’
রাজিবের এসব চিন্তা সামনের বাড়ির দরজা জানালা পেরিয়ে এঘর ওঘর ঘুরে একেবারে বেডরুমের মধ্যে চলে যায়। সে দেখতে পায় ড্রিম লাইটের আলোয় একটা বস্তা নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে বিপরীত লিঙ্গের একজোড়া মানুষ। তাদের চোখে মুখে রহস্য। রাজিব সামনে আগায় না। নিজেকে থামিয়ে রাখে। যেমনভাবে গত পাঁচটি বছর নিজেকে থামিয়ে রেখেছে। সেই পাঁচ বছর আগে শিফার বোন নিতুর কাছ থেকে শুনেছিল মাহবুবের মৃত্যুর খবর। শিফার বর মাহবুবের সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি রাজিবের। কিন্তু তার মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর মাহবুবকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। ইচ্ছেকে দমিয়ে রেখেছে রাজিব। দেখতে ইচ্ছে করলেই সে দেখতে পারতো না। তখন সে অবস্থা ছিল না। তাছাড়া অনেক যুক্তির সামনে দাঁড়াতে হতো তাকে। তখন সেই যুক্তি দাঁড় করানো এই সমাজকে, প্রচলিত দেশ নামক কলকে মনে মনে অনেক গালি দিয়েছে। যে গালি কখনো কোনো মানুষের সামনে সে দিতে পারেনি। পারবেও না। কারণ সেই সাহস রাজিবের মতো মানুষের থাকে না। যারা হামাগুড়ি ভুলে দাঁড়িয়েছে। মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে যাদের অনেক ভাবতে হয়। রাজিব সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কিছুই করতে পারেনি। কখনো নিজেকে ছাড়িয়ে যেতেও আর ইচ্ছে করেনি তার। সেই চেষ্টাও করেনি। ভাবে, কীই-বা হবে ব্যর্থ দৌড়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখে! এইসব কঠিন সিদ্ধান্ত তার নিতে হয়েছিল আরও নয় বছর আগে।
তার মনে হয়েছিল নবম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ের কম বয়সের কারণে কিডন্যাপিং কেসে ফেঁসে বিয়েটা টেকাতে পারেনি। তবে শিফার বয়স আঠেরো হলে তারা আবার বিয়ে করবে। কিন্তু তা আর কখনোই হয়নি।
শিফার সঙ্গে বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পর দু’বছর কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারেনি রাজিব। আর সেই দু’বছরের প্রতিটি কঠিন মুহূর্ত রাজিবের কোমল মনটাকে আস্তে আস্তে পাথরে পরিণত করে দিয়েছে। সেই পাথর আরও শক্ত হয়ে যায়, যখন সে জানতে পারে শিফা আবার বিয়ে করেছে। লেফটেন্যান্ট পদবির একজন অফিসারের কাছে শিফা কেমন থাকবে? কেমন করে তাদের বাতিবন্ধ সিনেমা বা বাতি জ্বালা নাটক চলবে! এসব খুব বেশি ভাবায়নি রাজিবকে। কিন্তু সে ভাবাতো শিফা যেমন ছেলে মানুষ—অফিসারের সঙ্গে সংসারটা হয়তো ভেঙেই যাবে। আবার একটা নাটকের গল্প জানতে হবে তাকে। কিন্তু তেমন কোনো নাটক জানতে হয়নি রাজিবকে। দু’বছর যেতে না যেতেই অফিসারের ঘরে একটি মেয়ের জন্ম দেয় শিফা। এরপর আর কোনো রকম আশার জায়গা থাকে না রাজিবের।
তখন থেকে রাজিবের বেঁচে থাকার নতুন মিশন শুরু হয়। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানোর পণ থেকে সরে আসে। অকপটে টাকার টানে ঢাকার গলিপথে চলতে থাকে, দৌড়াতে থাকে। কোথায় চলছে! কেন চলছে? মনের মধ্যে ফুঁসে ওঠা এসব প্রশ্নকে পাত্তা দেয়নি সে। কেবল মনকে বুঝিয়েছে তাকে বাঁচতে হবে। বাঁচাতে হবে একটি পরিবারকে। এত বছরের মধ্যে রাজিবের সঙ্গে কারও কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, ঠিক তা নয়। তবে সেগুলোর কোনোটাই শরীর অতিক্রম করতে পারেনি। একসময় প্রেমহীন শরীরে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে রাজিবের শরীর। অনেক বছর আর শিফার কোনো খোঁজ নেওয়া হয় না তার। প্রথম দিককার শিফার ওপর অভিমান-অভিযোগ ছিল না রাজিবের। কিন্তু অফিসারের সঙ্গে স্বেচ্ছায় বিয়ে করা, বাচ্চা হওয়ায় অনেক রাগ, ক্ষোভ, অভিযোগ জমা হয় শিফার প্রতি। রাজিবের কাঠগড়ায় অনেক বড় অপরাধী হয়ে ওঠে শিফা। আবার দিনে দিনে শরীর পাল্টে পাল্টে সেগুলো ঢিলেও হয়ে যেতে থাকে রাজিবের মনের অজান্তেই।
শিফার সঙ্গে রাজিবের পরিচয়টা অনেকটা সিনেমার মতোই। সীতাকুণ্ডের জোড়া পাহাড় চন্দ্রনাথ থেকে নামছিল দুই বন্ধু। এই প্রথম এত উচ্চতার কোনো পাহাড়ে ওঠা সমতল ভূমিতে বেড়ে ওঠা দুই যুবকের। ক্লাসের পাঠ্য বাদে কখনো কোনো কবিতা, গল্প পড়ার মতো ইচ্ছে জাগেনি রাজিবের। পাহাড়ের এই সবুজ আর ডালে ডালে হাওয়ার নাচন দেখে মনটা নিসপিস করে ওঠা ছেলেদের কাতারে সে না। সেই কারণেই এই দৃশ্য তাকে উদাস করে দিতেও পারেনি। কেবল দেখার জন্য দেখা আর ঘাম ঝরানো। হঠাৎ করে শুরু হওয়া এরকম বৃষ্টির এত বড় ফোঁটা এর আগে দেখেনি কখনো। শুনেছে পাহাড়ি বৃষ্টি ভয়ঙ্কর। তবে বৃষ্টিটা স্থায়ী হলো না। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ওরা টের পাচ্ছিল এই সিঁড়ি কতটা পিচ্ছিল হয়ে গেছে। একবার পিছলে পড়লেই শেষ।
শৈশবের দৌড়-ঝাঁপ আর প্রথম যৌবন কেটেছে ক্রিকেট প্রেমে। যে কারণে মা-বাবার তির্যক বাক্যবাণেরও কমতি ছিল না তার প্রতি। কিন্তু বরাবরই বড় বোনের ওকালতিতে বেঁচে যেতো রাজিব। বড় বোন মেধাবী ছাত্রী হওয়ায় পরিবারে তার একটা আলাদা গুরুত্ব ছিল। সে যখন রাজিবের পক্ষে ওকলাতি করতো, তখন একবারে বেকসুর খালাস হয়ে যেতো রাজিব। তবে পড়াশোনা বেশি দূর হয়নি রাজিবের। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে আর কলেজমুখী করা যায়নি তাকে। সে কারণে তার উকিলকেও বকাঝকা খেতে হয়েছে শেষের দিকে। সে সব অনেক বছর আগের গল্প। এখন জামাইয়ের চাকরি-সূত্রে রাজিবের সেই বোন সীতাকুণ্ড থাকে। তার বাসায় বেড়াতে এসেছিসে রাজিব।
কিছুদূর নামার পর একটা ছাউনির মতো জায়গায় রাজিব সিগারেট ধরানোর জন্য দাঁড়ায়। সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে রাজিবের চোখ আটকে গেলো পনেরো-ষোল বছরের এক মেয়ের প্রতি। তার সঙ্গে আরও দু’জন। একজন মেয়ে ও একজন ছেলে। পরে রাজিব জেনেছিল খালাতো বোনের প্রেমের পাহারাদার হিসেবে শিফাকে তারা সঙ্গে এনেছিল সেদিন।
গল্প, উপন্যাসের মতো প্রথম দেখায়ই শিফার চোখে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল রাজিব। যদিও সে কোনোভাবেই প্রথম দেখায় মেয়েটির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। অবশ্য সেরকম খুব বেশি চেষ্টাও তখন তার ছিল না। কিন্তু রাজিব হিসাব-নিকাষ না করেই মেয়েটিকে তার বাড়ি পর্যন্ত অনুসরণ করলো। একথা না বলে এটা বলা ভালো যে—শিফার চোখ রাজিবকে তার বাড়ি পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিল। দুই বন্ধু মিলে অনেক কৌশল করে দ্বিতীয় দিনই শিফার সঙ্গে দেখা করলো। কথা বললো। তৃতীয় ও চতুর্থ দিন শ্রম দিয়ে পঞ্চম দিনে শিফাকে রাজি করিয়ে ফেলেছিলো রাজিব। আর বাকি ঘটনাগুলো ঘটে গিয়েছিল মাত্র একমাস সাত দিনের মধ্যে। পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করা, ঢাকায় এক অপরিচিত লোকের বাসায় বাসর রাত কাটানো, মেয়ের বাবার করা মামলায় জেলে যাওয়া, সব যেন চোখের পলকের মধ্যেই হয়ে গিয়েছিল।
সেই মামলায়ও রাজিবের ত্রাণকর্তা তার শৈশবের উকিল বোন। রাজিবকে রক্ষা করে একটা মীমাংসার ব্যবস্থা করেছিল সে। শিফাকে দিয়ে ডিভোর্স দিইয়ে ছিল তার প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বাবা। মামলা তুলে নেওয়ার আগে শর্ত ছিল—তার মেয়েকে কোনো রকম বিরক্ত করতে পারবে না রাজিব। রাজিব কখনোই শিফাকে আর বিরক্ত করেনি। তার মনে হয়েছিল নবম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ের কম বয়সের কারণে কিডন্যাপিং কেসে ফেঁসে বিয়েটা টেকাতে পারেনি। তবে শিফার বয়স আঠেরো হলে তারা আবার বিয়ে করবে। কিন্তু তা আর কখনোই হয়নি।
মাথা ঘুরতে থাকে রাজিবের। রাস্তার মধ্যেই বসে পড়ে সে। বারবার পেছনে তাকিয়ে একটু আগে চলে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজে উড়তে থাকে তার চোখ।
এইচএইচসি পাসের পরই যোগ্য পাত্র খুঁজে শিফাকে বিয়ে দিয়ে দেয় তার বাবা। এই খবর জানার পর রাজিবের কলিজায় চোট লাগে ঠিক; কিন্তু মনে হয় পাত্র তো সত্যিই যোগ্য। লেফটেন্যান্ট অফিসার। রাজিবের মনে হয় তার সম্পর্কে কোনো তথ্যই হয়তো দেওয়া হয়নি এই পাত্রকে। আর পাত্রও শিফার মতো ওই রকম আগুন রূপসী দেখে হয়তো গলে গেছে। অথবা শিফাও অফিসারের কাছে সব কিছু লুকিয়েছে।
রাজিব হাতের ভারসাম্য রক্ষা করতে আবার ব্যাগ পাল্টায়। হাত লাল হয়ে গেছে। ব্যথা করছে। নিজেকে বুঝায় সে—‘আর তো সামন্যই জায়গা। একটু কষ্ট না হয় করি।’
শালবন বিহারের প্রত্নতত্ত্ব জাদুঘর পার করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোড় এখনো পার হয়নি রাজিব। এর মাঝামাঝি জায়গাটা অতিক্রম করছে মাত্র। রাজিবের পাশ দিয়ে সাঁই করে একটা অ্যাম্বুলেন্স চলে গেলো। অন্যমনস্ক রাজিব চমকে ওঠে। অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনলে রাজিবের মনটা খারাপ হয়ে যায়। তার মায়ের কথা মনে পড়ে। নিজেকে বারবার অপরাধী মনে হয়। মনে হয় আরেকটু সচেতন হলেই সে তার মাকে বাঁচাতে পারতো। রাজিব সামনে হাঁটতে থাকে।
লেফটেন্যান্ট থেকে মেজর হয়ে ওঠা মানুষটা আবারও তার ভাবনার মধ্যে চলে আসে। এই মানুষটার প্রতি কখনো ঈর্ষা হয়নি তার। আর এখন মরে যাওয়া মানুষের প্রতি ঈর্ষা পুষে কী করবে। সব রাগ, ক্ষোভ ঝেড়ে ফেলেছে রাজিব। অফিসারের মরে যাওয়া ছাড়াও অনেক বছর তাকে কোনোভাবে তেমন প্রভাবিত করেনি শিফা। রাজিবের সবসময় মনে হয়েছে—প্রাণ-আরএফএলের টিএসএম আর কোথায় মেজর! কিন্তু বিডিয়ার বিদ্রোহের ছয় দিন পর রাজিবকে শিফার ছোট বোন ফোন করে মেজরের মৃত্যুর খবর দিয়েছিল। কেন দিয়েছিল! সেটা রাজিব জানে না। হয়তো শিফার ছোট বোনও জানে না। সেটা ওই শোনা পর্যন্তই।
এইসব জানার পরও রাজিব শিফার সঙ্গে একবারের জন্যও যোগাযোগ করেনি। সে হয়তো তাকে সান্ত্বনা দিতে পারতো। কিন্তু কী সান্ত্বনা দিতো! কিছুই তো আর করার ছিল না তার। হাঁটতে হাঁটতে অনেক প্রশ্নের জবাব খোঁজে রাজিব।
সন্ধ্যায় আসা ফোনের মানুষটিকে প্রথমে চিনতে পারেনি। ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে নারীকণ্ঠ, ‘আমি শিফা। তুমি কি একটু কুমিল্লা আসতে পারবে? কোটবাড়ি। কুমিল্লা ইউনিভার্সিটি পার হয়ে সোজা রাস্তায় এসে ফোন দিও।’ রাজিবকে কোনো কথার সুযোগ না দিয়েই অন্যপ্রান্তের নারীকণ্ঠ ফোন রেখে দেয়। রাজিব ততক্ষণে চিনে নেয় নারী কণ্ঠের মানুষটিকে। আর তখনই অফিসের বসকে একটা ম্যাসেজ দিয়ে বাসায় চলে যায় সে। দুপুরে না খাওয়া পেটের কথা ভুলে গেলেও যার জন্য বাসায় এসেছিল তাকে নিয়ে বের হয়ে যায় কুমিল্লার পথে। সিএনজির দৌড়ে অবশেষে নয়টার শেষ বাসটা পেয়ে যায় রাজিব।
সারা পথে মাথাটা ঘুরেছে তার। মাথা ঘুরছে—না চোখ খেলছে; সেটা বুঝতেও কষ্ট হয়েছে রাজিবের। সব এড়িয়ে একটাই চিন্তা তার—শিফা ডেকেছে। তার কাছে যেতে হবে। শিফার কাছে যাচ্ছে রাজিব। রাস্তার মাঝে একটা খাদে পড়ে দেশের উন্নয়নের অংশীদার হয় রাজিব। পা তুলে দাঁড়াতে গিয়ে খেয়াল করলো ব্যথা লাগছে। সহজ করে কদম ফেলতে পারছে না। অনেক কষ্টে ব্যাগ থেকে বের হয়ে পড়া আট বছর আগে কিনে রাখা শাড়ি, শিফার প্রিয় বডি স্প্রে ব্যাগে ভরে উঠে দাঁড়ায়। এত বছর সঙ্গে করে ঘ্রাণ নিয়েছে। কিন্তু এই শাড়িটা আজ শিফাকে ছোঁবে। হয়তো রাজিবও শিফার ঘ্রাণ উড়তে থাকা হাওয়ায় নিজেকে উড়াবে! পা টেনে টেনে হাঁটতে থাকে রাজিব। কোথায় যাচ্ছে সে!
ইউনিভার্সিটি পার হয়ে সেই নম্বরে ফোন দেয় রাজিব। অন্যপ্রান্তের কণ্ঠস্বরটা আলাদা। তবে সেই কণ্ঠস্বরকেও চেনে রাজিব। এখন অন্যপ্রান্তে যে কথা বলছে, সে শিফার ছোট বোন নিতু। ফোন রিসিভ করে রাজিবকে কিছু বলতে সুযোগ দেয় না সে। যা বলার নিতুই বলে দেয়। মাথা ঘুরতে থাকে রাজিবের। রাস্তার মধ্যেই বসে পড়ে সে। বারবার পেছনে তাকিয়ে একটু আগে চলে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সের খোঁজে উড়তে থাকে তার চোখ।
আরও পড়ুন: জলকথা ॥ রোমেনা আফরোজ