রমজান মাসের মাগরিবের আজান শুরুর আগে মোয়াজ্জিনের দেওয়া প্রথম ফু একজন রোজাদারের কাছে সবচে সুমধুর সঙ্গীত, সবচে মিষ্টি শরবতের মতো। এটা তেমনই একটা সন্ধ্যা। সামনে ইফতার নিয়ে এরফান ভাদা বসে আছে। তার কান দুটোকে বাতাসের সঙ্গে চরমভাবে যুক্ত করে বসে আছে সে। সে তার চোখ দুটোকে পরমভাবে বেঁধে রেখেছে সামনে থাকে খাবারগুলোর সঙ্গে।
একসময় আলো আর অন্ধকারের সন্ধ্যা ফুঁড়ে একগ্লাস ঠাণ্ডা শরবতের মতো মোয়াজ্জিনের আজান দেওয়ার আগে যে ফু, তা ভেসে আসে। সন্ধ্যার সন্ধ্যাত্ব ভাঙা, সন্ধ্যার বন্ধ্যাত্ব ভাঙা মোয়াজ্জিনের ফুয়ের আঘাতে সামনে থাকা গ্লাসের ঠাণ্ডা পানি সচকিত হয়ে এরফান ভাদার দিকে ভয়ার্তভাবে তাকায়। এরফান ভাদা গ্লাসের পানির দিকে জ্বলন্ত আঙ্গার চোখে চেয়ে শান্তভাবে হাত বাড়ায়। পানির গ্লাসটা ধরার সঙ্গে সঙ্গে পানিগুলো মাথা এদিক ওদিক করে দোলায়—না না না। সে গ্লাসটা গ্লাসের স্থলে রেখে দিলে আবার স্থির হয় পানি। এরফান ভাদা হাসে পানির দিকে তাকিয়ে আর মনে মনে বলে—আমার তৃষ্ণার্ত চোখ দেখে ভয়ে পানির কলজে শুকিয়ে গেছে।
আজান শেষ হলেও সে বসেই থাকে। সে চেষ্টা করে শান্ত হতে, যেন পানি তাকে দেখে ভয় না পায়। আজানের পর বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে গেলেও তার চেষ্টা সফল হয় না। তার চোখমরুর দিকে তাকিয়ে জলগুলো তির তির করে কাঁপতেই আছে। সে জলের দিক হতে চোখ সরিয়ে নেয়। অন্যকিছু দিয়ে রোজা খুলতে হবে।
তার চোখ পড়ল খেজুরের দিকে। খেজুর খেয়ে ইফতার করা সুন্নাত—কথাটি সে বিড় বিড় করে বলে অনেকটা নামাজে বা মোনাজাতের সময় আরবিতে দোয়া পড়ার মতো করে। সে খেজুরের দিকে হাত বাড়ানো মাত্র একটা তেলাপোকা এসে পড়ে খেজুরের প্লেটে। তেলাপোকাটি প্লেটে বসেই বাড়ানো হাত দেখতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে উড়ে পালায় আর তেলাপোকা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই এরফান ভাদাও হাত টেনে নেয়। হাত বাড়ানো ও তেলেপোকার উড়ে এসে পড়া এবং হাত টেনে নেওয়া ও তেলাপোকার উড়ে পালানো একসঙ্গেই প্রায় ভোজবাজির মতো ঘটে যায়। একমুহূর্তের মধ্যে এমন কাণ্ড ঘটে গেলে এরফান ভাদা সন্দেহের চোখে তার সামনে থাকা প্লেটটার খেজুরের দিকে তাকায়। খেজুর আর তেলাপোকার রঙ আর গঠনও প্রায় একই। তেলাপোকার মাথা আর খেজুরের বোঁটার দিকটাও প্রায় একই। সে সন্দেহের দেহের ভেতর পড়ে যায়। তার মনে হয়, জল যেমন ভয় পেয়ে গেছিল তেমনই ভয় পেয়ে খেজুরটা পালিয়ে গেছে? না, তেলাপোকাটা পালিয়ে গেছে? সে বুঝে উঠতে পারছে না। একবার তার মনে হলো, খেজুরটা উড়ে পালিয়ে গেছে আর খেজুরটা যেখানে ছিল, সেখানে তেলাপোকাটা বসে বসে শুঁড় নাড়ছে। এরফান ভাদা তেলাপোকাটা বা খেজুরটা যেটা প্লেটে আছে সেটা খাবে না বলে ঠিক করলো।
এবার সে ফোলা বেগুনিটার দিকে তাকাল। বেগুনি দিয়েও ইফতার শুরু করা যেতে পারে। সে বেগুনির দিকে হাত বাড়াল কিন্তু বেগুনির দুটো পিঠকেই ব্যাঙের পেটের মতো মনে হলো। তার মন ঘিনঘিনে একটা ভাব নিয়ে এসে তার জিভের ওপর ব্যাঙের মতো লাফালাফি করতে লাগলো। ব্যাঙের ফোলা পেটের মতো বেগুনি দিয়ে ইফতার খোলার কথা চিন্তা সে বাদ দেবার চিন্তা করলো।
বেশক্ষণ হয়ে গেল আজান হয়েছে। আজানের এতক্ষণ পরেও রোজা না খোলাটা ঠিক নয়। রোজা ঢিল হয়ে যায়। রোজাটাকে বাঁচানো দরকার আগে। সে কিছুটা চিনি দেখতে পেল সামনে। চিনি দিয়েই আগে রোজাটাকে বাঁচিয়ে নেওয়ার চিন্তা করলো। সে এক চিমটি চিনি মুখে নিলো। মুখটা লবণাক্ত হয়ে গেলো। তার মন বিষণ্ন হয়ে গেলো—আহা, খাবারগুলো কী মিথ্যুক! মিথ্যে বলছে সব খাবার। তারপরেও সে লবণাক্ত থুথুযুক্ত ঢোকটা গিলে নেয় আর বলে—আলহামদুলিল্লাহ রোজা পূর্ণ হলো।
রোজা হয়তো পূর্ণ হয়েছে কিন্তু কিছু খাবার খাওয়া দরকার। এরফান কিসমিসের দিকে হাত বাড়ায়। কিসমিস হাতে নেয় কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার বউয়ের কথা মনে পড়ে যায়। রাতের চেরাগের আধা আলো আধা অন্ধকারের ভেতর বউয়ের স্তন, স্তনাগ্রের কথা মনে পড়ে যায়। যে স্তন দেখলে, স্তনাগ্র দেখলে কামভাব আরও উগ্র হয়ে ওঠে। ইফতার অবস্থায় কামচিন্তা সহি হচ্ছে না বলে এরফানের মনে হয়। তার কামভাব জেগে ওঠার আগেই সে হাত থেকে কিসমিস দুটো কিসমিসের স্থানকে ফিরিয়ে দেয়। কিসমিসের পাত্রটা একটু স্বস্তি পেলো যেন এমন মনে হলো এরফান ভাদার।
তার সবকিছুই লোকটা সাবাড় করে দিয়েছে
এবার মুড়ির দিকে তাকানোর চেষ্টা করে সে এবং মুড়িগুলোকে পায়খানার ট্যাংকে থাকা সাদা সাদা পোকা মনে হওয়ার আগেই চোখ টেনে নেয়। গরু ছাগল মরে যাওয়ার পর কয়েকদিন পড়ে থাকলে সে মড়ার গায়েও এমন পোকা হতে দেখেছে সে। তার মনে আসে আইয়ুব নবীর কথা। তার গায়েও এমন পোকা হয়েছিল। আইয়ুব নবী পোকা শরীর থেকে নিচে পড়ে গেলে নিজে নিজে তুলে রাখতেন। এরফানের গা ঘিন ঘিন করে ওঠে। সাদা কিলবিলে পোকার মতো মুড়ির দিকে আর চেয়েই দেখে না।
এবার সে চেষ্টা করে কলার দিকে তাকাতে। হলুদ মোটা কলা। নিখুঁত ধরনের মসৃণ, নিখুঁত ধরনের হলুদ রঙ। হলুদ কলাগুলোকে ডাইনিং টেবিলে বসে ইফতার করা লোকগুলোর মোটা গু বলে মনে হয় তার। সে কলা খেতে পারে না। তার রুচিতে বাধে। তার রুচি তার ক্ষিধের চেয়ে বড় হয়ে উঠছে।
সারাদিন রোজা রেখে এখন এমন এক অবস্থার মধ্যে পড়েছে যে, সে নিজেই অবাক হয়ে যায়। সে নিজের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। পেট থেকে, কলজে থেকে ক্ষুধা, পিপাসা যেন উবে গেছে কিন্তু তার পেট জ্বলছে, পেট জ্বলাটা বেশ ভোঁতা ধরনের। শরীর দুর্বল লাগে। কিছু খেয়ে পানি না খাওয়া পর্যন্ত ঠিক হবে না। সে ছোলা বুটের দিকে হাত বাড়ায় এবং কিছু ছোলা বুট হাতে তুলে নেয়। তার হাতের ভেতর দিয়ে বকরির নাদী নাড়ছে এমন একটা অনুভূতি, গন্ধ ঢুকে যায় একেবারে মগজের ভেতর। ছোলাও খাওয়া হয় না তার।
এরফান ভাদার কান্না আসার উপক্রম হয়। খাবারকে এত নিকৃষ্ট মনে হওয়াটা একধরনের পাপ তারপরও সে এটাকে কোনোভাবেই নিবৃত্ত করতে পারছে না। মনটাকে এসব ফালতু ভাবনা থেকে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা বিফল হয়ে যাচ্ছে। সে মনে মনে আল্লাহর কাছে চিৎকার করে—হে আল্লাহ তুমি আমাকে এ কোন গজবের মধ্যে ফেললে। গরিব বলে কি কোনো খাবারেই আমার অধিকার নেই? তুমি রক্ষা করো।
এবার সে একটা ভাঙা ডিমের দিকে নজর দেয় এবং চোখ বন্ধ করে খাবার চেষ্টা করে, যেন ডিম দেখে তার কিছু মনে না হয়। চোখ বন্ধ করে মুখে দিতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাক দিয়ে মানুষের পাদের একটা বিকট গন্ধ তাকে ধরাশায়ী করে ফেলে। তার হাত আর এগোয় না, ফিরে আসে ডিমের বাটির মুখের কাছে। ডিমটাকে বাটিটা আবার গিলে ফেলে। তার মেজাজ শুধু চোখ নয়, নাকের ওপরও বেশ খেপে গেলো। সে তার অঙ্গগুলোকে খারাপ করে গাল দিতে শুরু করতে যাবে, এমন সময় মনে হলো থাক মুখ খারাপ করা ঠিক হবে না।
সে একটা বাড়ির ডাইনিং রুমের মেঝেতে বসে আছে এসব ইফতারের সরঞ্জাম নিয়ে। প্রত্যেকটা খাবারকে তার কোনো না কোনো ইল্লতের মতো মনে হচ্ছে অথচ যে লোকগুলো ডাইনিং টেবিলে বসে ইফতার করছে তারা দিব্যি খেয়ে চলেছে, গল্প করছে, হাসছে। তারা তাকে দয়া করে এগুলো দিয়েছে। তারপর তারা ঘুরেও দেখছে না লোকটা খাচ্ছে কি না। এরফান ভাদার সবশেষে দুধকে চুনগোলা পানি এবং পায়েসকে বমির মতো মনে হলে কোনো কিছু খাওয়া তার জন্য অসম্ভব—এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে বড় করুণ মনে।
সে আবার পানির দিকেই তাকায়। পানি যতই ভয় পাক, যতই ‘না না’ করুক, এবার সে পানি খাবেই—এই মনে করেই সে তাকায় পানির দিকে। মনে তার বড় আশা, সে এবার পানি পান করতে পারবেই। পানির ভীত হওয়া দেখে সে আর ভীত হবে না, পানির ভীত হওয়া দেখে তার মায়া হবে না। সে পানির গ্লাসটা হাতে তুলে নেয়। ঠোঁটের কাছে ধরে। বড় বড় ঢোকে গিলতে থাকে। কিছুটা পানি পান করামাত্রই তার মাথা চনমন করে ওঠে, মাথা ঘোরে অথবা চারপাশের সবকিছু ঘোরে সে স্থির থাকে।
অনেকক্ষণ ধরে ইফতার করার পর ডাইনিং টেবিলের লোকগুলো তার দিকে তাকায় আর খেয়াল করে, যে লোকটা মাগরিবের আগ দিয়ে তাদের কাছে ইফতার করতে চেয়েছিল সে লোকটা অজ্ঞান অবস্থায় বা ঘুমন্ত অবস্থায় বা মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। তার কাছে যে সব খাবার ছিল, তার সবকিছুই লোকটা সাবাড় করে দিয়েছে, কোনো খাবারের কোনো একটা কণাও পড়েনি।