লোকটিকে খুব চেনা মনে হয়। যেন বহুকালের আলাপ পরিচয় ছিল কোনো এককালে। মাঝে ঝাপসা চর পড়েছে, অপরিচয়ের, ভুলের। এখন বিস্মৃতির হালকা রূপালি চর সরিয়ে আবার সে পরিচয়ের ভিত মাথা তুলতে চায়, দাঁড় করাতে চায় আপন কাঠামো। সে আড়চোখে তাকায়, বারবার। পাছে দৃষ্টিকটূ হয়ে ওঠে তার এই বাহুল্য মনোযোগ, সে ভয়ে আবার তটস্থ হয়ে ওঠে নিজেই। কেবলই মনে হতে থাকে, তার আচরণে বিরক্ত, সন্দিগ্ধ হয়ে উঠছে লোকটি, বাহারি গোঁফের নিচে লোকটির ঠোঁটদুটি যেন বিরক্তি আর রাগে বাঁকা হয়ে উঠছে ক্রমশ।
কোথায় দেখেছে লোকটিকে? কোথায়? প্রশ্নটা নিজেই নিজেকে করে আর দ্রুত স্মৃতি হাতড়ে চলে আলতাফ হোসেন। তার টাকসদৃশ বৃহৎ কপালটায় এই মধ্য নভেম্বরেও বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করে, কুঁতকুঁতে চোখের কোণে জেগে থাকা পিচুটি আরও বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে এই হঠাৎ মনোযোগের মাত্রাতিশয্যে। শুকনো, ঝুলেপড়া ঠোঁট দুটি ঘন-ঘন নড়ে। দেখে মনে হয়, কঠিন কোনো মন্ত্রোচ্চারণে সে দুটি চোখ ঘোর ব্যস্ত। তারপর, যেন হঠাৎই ঘোর কেটে যায় তার। কিংবা সজোরে সে ভেঙে ফেলে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কঠিন দেয়াল। নিজের বোধের কাছে ধাক্কা খেয়ে আলতাফ হোসেন নিজেকে যেন ফিরে পায় আচমকা। ভূতগ্রস্তের মতো সে উঠে দাঁড়ায়, এই মধ্য-সত্তরে এসে যতটা সোজা হওয়া সম্ভব, ঠিক ততটাই টানটান হয়ে সে লোকটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মাফলারে জড়ানো লোকটির মুখ তখন ঈষৎ ঝুলে পড়েছে নিচের দিকে, ট্রেনের মৃদু দুলুনির তালে তালে দুলছে অল্প। লোকটির চোখ বোজা, আলতাফ হোসেনের বাহুল্য মনোযোগাতিশয্যকে থোড়াই কেয়ার ক’রে লোকটি ততক্ষণে নাক ডাকতে শুরু করেছে প্রায়। জানালার পাশে, ঝিরঝিরে হাওয়ার প্রকোপে সে, মাফলারটি আচ্ছাসে বেঁধে নিয়েছে মুখ-গলা পেঁচিয়ে। তবু ট্রেনের বগিতে জ্বলা আলোয় তার খাড়া নাক, খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি নজরে পড়ে। মুখের আদলটি কাছ থেকে চেনা মনে হয় আরও। আলতাফ হোসেন লোকটির ওপর ঝুঁকে পড়ে খানিকটা। এরপর অদ্ভুত, কাঁপা গলায় বলে ওঠে, মাধব!
নিজের কণ্ঠে নিজেই চমকে ওঠে আলতাফ হোসেন। ট্রেনের দুলুনি অগ্রাহ্য ক’রে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা শরীরটা তার ভার ছেড়ে দেয় কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই। আলতাফ হোসেনের কণ্ঠে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় লোকটি। কিন্তু লোকটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার শরীরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আলতাফ হোসেনের পলকা শরীর। বিব্রত, বিরক্ত লোকটি হাত বাড়িয়ে ধ’রে ফেলে আলতাফ হোসেনকে। সিট ছেড়ে বসিয়ে দেয় নিজের জায়গায়।
ভারসাম্য হারানোর এই হঠাৎ বিপত্তিতে খানিকটা অপ্রস্তুত, লজ্জিত দেখায় আলতাফ হোসেনকে। বেচারা দেখায় খুব। কুঁতকুঁতে চোখে সে সামনে দাঁড়ানো লোকটির মাফলারে ঢাকা মুখের দিকে তাকায়। লোকটির বিরক্তির মাত্রাটা বোঝার চেষ্টা করে প্রাণপণ। কিন্তু মাফলারে ঢাকা মুখে তেমন কোনো অভিব্যক্তি ফোটে না। নিতান্তই ভাবলেশহীন, নৈর্বক্তিক একটি মুখের খানিকটা শুধু চোখে পড়ে ধূসর, পুরোনো মাফলারের অপ্রতুল ফোকর থেকে। আলতাফ হোসেন দ্বিধাগ্রস্ত হয় পুনরায়। তারপর ভয় আর সংশয়ের অদ্ভুত মিশেলে, ঘড়ঘড়ে, কাঁপা গলায় আবার বলে ওঠে, তুই, আপনি, মাধব না?
লোকটি এবার অদ্ভুত, ক্ষ্যাপাটে গলায় হেসে ওঠে। ট্রেনের দুলুনিতে, নাকি হাসির প্রকোপে ঠিক বোঝা যায় না, কেঁপে ওঠে, দুলে ওঠে লোকটির মজবুত, বয়স্ক শরীর। দুলতে দুলতে টাল সামলে নেয়, ধীরলয়ে হেঁটে গিয়ে বসে পড়ে আলতাফ হোসেনের ফেলে আসা সিটে। আগেরমতোই আবার মুখোমুখি দুজন, আড়ালহীন, আচ্ছাদনহীন। তবু আলতাফ হোসেন বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকে লোকটির মাফলারে ঢাকা মুখে। ভীষণ রহস্যময় মনে হতে থাকে লোকটির আচরণ। লোকটিকে মাধব বলে সন্দেহ নয় এখন আর, বরং লোকটি মাধব ছাড়া অন্য কেউ হতেই পারে না, তেমন ধারণা বদ্ধমূল হয় ক্রমশ।
লোকটি ততক্ষণে ঝোলা থেকে সিগারেট, লাইটার বের করে জ্বেলে নিয়েছে, আয়েশ ক’রে ধোঁয়া ছাড়ছে পৃথিবীর নাক বরাবর। ধোঁয়ায় আলতাফ হোসেন খুকখুক করে কাশে। তার সিগারেট বারণ, নেশাভাঙ ছেড়েছে সে বহুদিন। শরীরে এসব আর সয় না এখন। কাশতে কাশতেই সে আবার বলে, তবে ফিরে এলি মাধব?
লোকটি ধোঁয়া ছাড়ে আরেক মুখ। চোখ-মুখ কুঁচকে তাকায় জানালা দিয়ে। বাইরে ছুটন্ত পৃথিবী, ফুটন্ত সকাল। আঁধার কাটিয়ে সকালটা আলোর খই ফোটাচ্ছে খুব। জানালা গলে হিমেল হাওয়া আসছে। লোকটি ক্ষণকাল আলতাফ হোসেনের মুখের দিকে গভীর চোখ রাখে, কী একটা ভাবে। শেষে গম্ভীর, বিষণ্ন গলায় বলে, কোথাও ফেরার নেই আমার। আমি আপনার চেনা কেউ নই। আলতাফ হোসেন বিস্মিত, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে।
লোকটির কণ্ঠে আরও চমকিত হয়ে সে এবার পুরোপুরি নিশ্চিত হয় যে, লোকটি আর কেউ নয়, বরং সে তার আবাল্য পরিচিত, মাধব। আলতাফ হোসেন লোকটির চোখে চোখ রাখে। কিছু একটা খোঁজে। হয়তো সে আপনার হারিয়ে যাওয়া শৈশব খোঁজে, কিংবা খোঁজে যৌবনের সেই অমোচনীয় কালির দাগ। কিন্তু সে অবাক হয়ে লক্ষ করে, কিছুই নেই, ভাবলেশহীন, সাদা সেই চোখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, মাছের চোখের মতো পলকহীন, মৃত সেই চোখ। আলতাফ হোসেন ভাবনায় পড়ে এবার। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবে, হয়তো সত্যিই কোথাও ভুল হচ্ছে তার, লোকটি হয়তো সত্যিই মাধব নয়, অন্য কেউ। ভাবনাটা তাকে বহুবছর আগে নিয়ে যায়।
জানালার ওপাশে ছুটন্ত পৃথিবী আর ফুটন্ত সকালকে পাশ কাটিয়ে, সামনে বসে থাকা মাধবসদৃশ লোকটিকে উপেক্ষা করে, সেইসঙ্গে চলন্ত ট্রেনের গর্জন আর তার ভেতরের কোলাহল ফেলে আলতাফ হোসেন চলে যায় বহুবছর আগের পৃথিবীতে। যেখানে মাধবের সঙ্গে তার নিত্য খুনসুটি, বন্ধুত্বের নিবিড় গাঁটছড়া। সে মাধবের হাত ধরে স্কুলে যায়, খেলার মাঠে তুমুল দৌড়ায়, খোলা মাঠে গিয়ে গবাদি চড়ায়, গাঁয়ের গাঘেঁষা নদীটিতে উদ্দাম সাঁতরায় আর শৈশবের গন্ধডোবা স্মৃতির পুকুরটাতে আপাদমস্তক ডুবে যায়, হাবুডুবু খায়। তারপর সে ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠে যৌবনে। যেখানে অম্লান ফুটে থাকে ‘৭১, আর তার পাশেই ভীষণ বিসদৃশভাবে জেগে থাকে আমোচনীয় কালির দাগ, তার নিজের হাতে জড়ো করা, একজীবন বয়ে বেড়ানো শোচনার দুর্বহ বোঝা। সে দেখে মাধবের ছোটবোন মহুয়ার ব্যাকুল, ভয়ার্ত চোখ, সেই চোখে ফুটে থাকা সীমাহীন ঘৃণা। পাকিস্তানি মিলিটারির পুরোভাগে পথনির্দেশক হয়ে সে পৌঁছে যায় মাধবদের বাড়ির উঠোনে, সেখানে ভর সন্ধ্যায় তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালাতে থাকা মহুয়া তাকে, তাদের দেখে ভূত দেখার মতো চমকে চিৎকার করে ওঠে। মুহূর্তেই শান্ত, স্নিগ্ধ সেই সন্ধ্যাটা নরক হয়ে ওঠে, মহুয়াকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে দুজন পাকিস্তানি সেনা তাদের জিপে নিয়ে তোলে, আর দাওয়ায় পড়ে থাকে মাধবের সাদা শাড়িপরা বিধবা মায়ের লাশ, রাইফেলের রক্তে লাল হয়ে ওঠে যা নিমেষেই। মাধব তখন মুক্তিসেনা, দেশের জন্য সে তখন ঘর ছাড়া, নিরুদ্দেশ। তন্ন তন্ন করে তাকে খোঁজা হয় সারাবাড়ি, নেই সে। কোত্থাও নেই। আলতাফ হোসেন তাকে মিলিটারিদের হাতে তুলে দেওয়ার ওয়াদা করে ফিরে যায় সে-যাত্রা। সঙ্গে নিয়ে যায় মহুয়ার মায়ের আহাজারি, অভিশাপ, আর মহুয়ার দুচোখভরা ঘৃণা। মাধব ফেরে না আর। যুদ্ধ শেষে সে নাকি ফিরেছিল শোনা যায়। বিধবা মা আর একমাত্র বোনের করুণ পরিণতি শুনে, বাল্যবন্ধুর চরমতম বিশ্বাসঘাতকতার অবিশ্বাস্য কিন্তু রূঢ় বাস্তবতার কথা শুনে, সে ফিরে গেছিল আবার সীমান্তের ওপারে। হারিয়ে গেছিল চিরতরে।
আলতাফ হোসেন নিজেকে ফিরে পায় মাধবদের শূন্য বাড়িতে, যেখানকার দখল নিয়ে সে কাটিয়েছে, কাটাচ্ছে একজীবন। বাধাহীন, প্রতিবন্ধকতাহীন। তবু, অনুশোচনা এসে ভর করে বুকে হঠাৎ হঠাৎ। মাধবের সঙ্গে কাটানো শৈশব ভারী হয়ে চেপে ধরে বুক। মাধবের মা আর তার বোন মহুয়া চোখভরা ঘৃণা নিয়ে তাকে ফিরিয়ে দেয় কেঁচো আর কেন্নোর জীবন। এমন অসংখ্য মাধব আর তাদের মা ও বোনেরা সময়ে, অসময়ে, কণ্ঠ চেপে ধরে তার, বুকের ভেতর চাপিয়ে দেয় পাহাড়ের ভার। ফলত এই অভিশপ্ত জীবন তাকে বয়ে বেড়াতে হয় নিতান্ত অনিচ্ছায়, মাসান্তে চিকিৎসার্থে ছুটতে হয় ঢাকা টু কলকাতা। এই ট্রেন তার কষ্ট কিছুটা লাঘব করেছে, সহজ করেছে অসুস্থ শরীর ও মন নিয়ে বাধ্য হয়ে করা এইসব ক্লান্তিকর ভ্রমণ। কিন্তু এই ভ্রমণে আজ কী যে হয় সহসা, কে একজন মাধব আজ জলজ্যান্ত এসে ঠিক তার মুখোমুখি বসে, ধূসর মাফলারে আড়াল করে রাখে মুখের দুই তৃতীয়াংশ আর আলতাফ হোসেনকে উড়িয়ে নিয়ে যায় তার শৈশবের আঙিনায়, যৌবনের উঠোনে। তাতে প্রথমটায় আমোদে চনমন করে ওঠে তার মন আর পরক্ষণেই প্রবল অপরাধবোধে ছেয়ে যায় শরীর-মন। যেন স্বর্গ থেকে তাকে নিদারুণ রোষে কেউ আছড়ে ফেলে নরকে। সেই বেমক্কা আছাড়ে নাজেহাল হতে হতে ঠিক তখন সম্বিত ফেরে আলতাফ হোসেনের, যখন বিষম সুরে হুইসেল তুলে হঠাৎ থেমে যায় ট্রেন। আর আলতাফ হোসেন দেখে, ট্রেন থেকে ঝোলা কাঁধে দরজার দিকে এগিয়ে যায় লোকটি। ভ্যাবাচেকা খেয়ে সে নিজের কুঁতকুঁতে, ক্ষীণদৃষ্টির চোখে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। লোকটির হাঁটার ভঙ্গি অবিকল মাধবের। আলতাফ হোসেন যখন পুরোপুরি নিশ্চিত হয়, লোকটি আর কেউ নয়, মাধব, ততক্ষণে লোকটি ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের জনারণ্যে মিশে গেছে।
আলতাফ হোসেন জানে না, মাটির টানে মাধব প্রায়ই অনাহুত যাত্রী হয় এ ট্রেনে, নামে কমলাপুর স্টেশনে, মিশে যায় জনারণ্যে আর তারপর, জন্মভূমির মাটির সোঁদা গন্ধ নাকে নিয়ে আবার পাড়ি জমায় ওপারে। শেকড়হীন বাঁচে, বাঁচে প্রাণহীন। আলতাফ হোসেন জনারণ্যে চোখ রেখে হারিয়ে যাওয়া মাধবকে খোঁজে। মাটি নয়, রক্তের কটূ গন্ধে শরীর গুলিয়ে ওঠে তার। ট্রেনের সিটে সে বসে থাকে শাপগ্রস্তের মতো স্থবির, অনড়।