কষ্ট পেলে কাঁদার জন্যও আশ্রয় লাগে। সে আশ্ৰয় মা ছাড়া কেউই হতে পারে না কখনো। কিন্তু যাদের মা নেই বা যে মা নিজেই বারো মাস অসুস্থ, সেই মায়ের সন্তানদের কষ্ট ভাগ করতে হয় বাথরুমের চার দেওয়ালের মধ্যে! এটাও বাস্তবতা। গভীর ক্ষত নিয়ে যারা হাসে, তারাই তো যোদ্ধা। কুমুদও যোদ্ধা। হ্যাঁ সে প্রকৃতই যোদ্ধা। নাহলে এতকিছুর পরও কেউ বেঁচে থাকে! কুমুদও এগিয়ে চলে। না চলে তো উপায়ও তার নেই। মন্দ কপালি কুমুদ জীবনের সংগ্রামটাই তার একার। কেউ নেই পাশে। বেচারী মরতে চেয়েছিল কিন্তু মরাটাও তো সহজ নয়। অত্যাচারী স্বামীই সে পথ বন্ধ করেছে। এটাও এক গল্পই বটে! স্বামীর ঘরে অত্যাচারিত হতে হতে যখন কুমুদ ভাবলো, এবার না হয় জীবনকে শেষ করাই যাক। তখনই স্বামী বলে বসলো, তুই মরলে আমার কিছু যায় আসবে না। ভাববো কোনো এক অজানা গ্রামের রহিমা কি সখিনা মরেছে।
কুমুদ আজীবন বড় অভিমানী মেয়ে। কী আর করা! সেই কুমুদের ঘুরে দাঁড়ানো। তপ্ত জল যখন ঠোঁটের কাছে গড়িয়ে পড়লো তখনই কুমুদ ঝামটা দিয়ে উঠলো! বাইরে প্রচণ্ড গর্জন। আকাশে ঘনকালো মেঘ ভর করেছে। পাখিগুলো ছটফট করছে। হয়তো সঙ্গীর খোঁজে। এখনো বৃষ্টির দেখা নেই। তাই হয়তো এমন তোলপাড় করা তুমুল গর্জন ও বাতাসের দোলায় লণ্ডভণ্ড হচ্ছে চারিদিক। কিন্তু কুমুদের কী করার! কুমুদের একবার মনে হলো প্রকৃতি কী তার মনের রূপ ধরে এসেছে। আসতেও পারে। যার দুঃখ পৃথিবীর মানুষের নয় তার তো ওই প্রকৃতি-স্রষ্টায় আছে। তারাও যদি না থাকে তবে কুমুদের আশ্রয় কোথায়!
ঝড়ের গতি যত বাড়ছে কুমুদের মনের চাঞ্চল্য ততই বেড়ে চলেছে। আজ পৃথিবীকে খান খান করে চিরে ফেলবে তার আর্তনাদ কিন্তু না গলা দিয়ে স্বরও বের হয় না। এ বড় নিদারুণ কষ্ট। কেউ যদি দেখে ফেলে। সমাজে তো তাকে শক্তি নিয়ে চলতে হবে। একা মেয়ে। তারওপর স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি। জোরে কাঁদলে লোকে কী বলবে! কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরের সব জল আজ কুমুদের চোখে। সে শান্তি চায়। কুমুদ হারিয়ে যাচ্ছে অতলে। আজ এতদিন পর কী তার বেদনা। না এ বেদনা তার নিত্যদিনের। কারণ সে আজও পৃথিবীর চতুর্দিকে খুঁজে চলেছে সেই বীজের দুর্লভ চারা। সেই তো পুঁতেছিল মনের গহীনে।
হ্যাঁ, ভালোবাসার খোঁজে কুমুদ হন্যে হয়ে পথে নেমেছে। নিজে মনের সবটা উজাড় করে দিলেও যে ভালোবাসা সে পায়নি, তারই খোঁজ কুমুদ করে চলেছে।
স্বামীর অত্যাচারের সীমানা পার হলেও কুমুদ হার মানার পাত্রী নয়। তাই দিনযাপন করতে থাকে স্বামীর মতিগতি ঠিক হওয়ার। সবাই বলে সবুরে মেওয়া ফলে। কুমুদ কিন্তু মেওয়ার আশায় এভাবেই দীর্ঘ দিন পার করে। কিন্তু স্বামীর দেখা নেই। ফোন নেই। এমনকি কোনো হদিসও নেই। কোথায় থাকে, কী করে, আদৌ কেমন আছে, সে জানার ইচ্ছে থাকলেও অভিমানে কুমুদকে চুপ থাকতে হয়। আসলে অভিমান নয়। সেও এক শাস্তি। ভুলের শাস্তি। কুমুদ যে প্রেম করে বিয়ে করেছিল। সাত রাজার ধন মানিকের সন্ধান পেয়েছে ভেবে বাবা-মায়ের মতেরও তোয়াক্কা করেনি। মন দেওয়া-নেওয়া হয়েছিল। হ্যাঁ মন দেওয়া-নেওয়াই বটে। শরীর দেওয়ার বিষয়ে কুমুদ অরাজি না থাকলেও তা হয়ে ওঠেনি। কারণ সে দূরত্ব কেন জানি বজায়ই ছিল।
প্রেমিক জামিল যখন স্বামী হয়ে কাছে এলো, তখন কুমুদের সে কী আহ্লাদে আটখান হওয়ার অবস্থা। পরিবার-পরিজনকেও ভুলে যায় স্বামীকে সোহাগ করতে গিয়ে। মনে হলো কুমুদকে কোনো এক তুলার পালঙ্কে শুইয়ে সারা পৃথিবী পরিভ্রমণ করাচ্ছে কেউ। সে গভীর তন্দ্রায় আবার কখনো জাগরণে তার স্বপ্ন পুরুষের ঠোঁট চুম্বন করছে। বুকের সঙ্গে জাপটে ধরছে, যেন কেউ তাকে কেড়ে নিতে না পারে। কল্পলোকের রাজা তার স্বামী। তাইতো নিত্যই তাকে মহারানীর মতো সম্মানে ভাসিয়ে দিচ্ছে প্রজা-পরিজন। কুমুদ ভেসে চলেছে হওয়ার পালঙ্কে, মনি-মাণিক্য-জহরতে ভরপুর তার ঘর। চতুর্দিকে বিজয়ের ডঙ্কা বাজছে কুমুদ এ রাজ্যের রানী। না তার স্বামী ওত -শত ধনী ছিল না। কোনোরকম ছোট এক স্কুলে চাকরি করে কুমুদই খাওয়াতো। কিন্তু বাপের বাড়ির টাকা সে নেওয়ার মেয়ে নয়। স্বামীর আত্মসম্মান বলে কথা। আর যাইহোক কুমুদের স্বামী তো তার কাছে মহারাজাই বটে! কিন্তু সেও আজ কুমুদের কাছে স্বপ্ন।
রাত দশটা কী সোয়া দশটা কুমুদের জীবন নৌকার পাল খসে পড়লো। সমস্ত মন-প্রাণ-দেহ অসাড়। যেন কেউ ইচ্ছে করে এন্টার্কটিকা মহাদেশে ছুড়ে মেরেছে। বরফের টুকরো তার গা বেয়ে বেয়ে নামছে। একসময় গলা অব্দি সে জল উঠলো তার মধ্যেই কুমুদ বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। যেদিন স্বামী প্রথম কাছে বসিয়ে বললো, কুমুদ তুমি তোমারটা গুছিয়ে নাও। আমি সাহায্য করবো তোমার স্টাবলিশ না হওয়া পর্যন্ত৷ আসলে তোমার সঙ্গে আর থাকে সম্ভব হচ্ছে না। একটু খোলসা করেই বলি, আমি ডিভোর্স চাই। চোখে ঝাপসা দেখতে দেখতেই কুমুদ দেখলো যে, কেউ তার কাঁচা কলিজাটা টেনে বের করে খুব আত্মতৃপ্তির সঙ্গে কচমচ করে চিবোচ্ছে। আর সেই রক্ত ছিটেফোঁটা কুমুদের সারা মুখ, বক্ষদেশ ভাসিয়ে নিয়েছে। কুমুদ ঘোরের মধ্যেই গোঁ-গোঁ করলেও কেউ সে শব্দ শুনছে না। গলা ধাক্কা দিয়ে অপমান-অপদস্ত করার চেয়ে কম কী। স্বামী যে তার মস্ত কথা বলেছে! কুমুদ তো নারী। এ সমাজ তাকে খুবলেই খাবে। কোথাও যাওয়ার জায়গা তো কুমুদের নেই। বাপ-মা বিয়ে দিয়েই বলেছে, যাচ্ছ যাও, তবে মনে রেখো স্বামীর ঘরই মেয়েদের সব। একবার লাল শাড়ি পরে ঢুকছো, সাদা কাফনের কাপড় পরে তবেই বের হবে। কুমুদও কিন্তু একথা ফেলেনি। তাই তো খুঁজেছে।
বিয়ের আগে স্বামীর মধ্যে কুমুদ খুঁজতে চেয়েছিল সুপুরুষ। যে মায়ায় আগলে রাখবে আবার প্রয়োজনে শাসনও করবে। কিন্তু জামিলের মধ্যে শুধু রূঢ়তায় দেখেছে, ভালোবাসা নয়। কী যে হয়েছিল কুমুর, নাহলে এভাবে খোঁজ করতে করতে অন্দরমহলে ঢোকার কী দরকার ছিল। কথায় আছে, একটা ভাত টিপলে সবটা বোঝা যায়। কুমুদ এতই বোকা ছিল যে, বুঝেও সে কিছুই বোঝেনি। ভালোবাসার অন্ধকার অতলে ডুবে সে শুধু মঙ্গল চেয়েছে। নিজেরও যে কিছু চাওয়ার আছে, পাওয়ার আছে কুমুদ তা বোঝেনি। আজ কুমুদ বোঝে। কিন্তু আজও কুমুদ খুঁজে চলেছে। হ্যাঁ, ভালোবাসার খোঁজে কুমুদ হন্যে হয়ে পথে নেমেছে। নিজে মনের সবটা উজাড় করে দিলেও যে ভালোবাসা সে পায়নি, তারই খোঁজ কুমুদ করে চলেছে।
সে খুঁজে চলেছে জামিলকে দেওয়া সেই ভালোবাসা। যা একেবারে পরিশুদ্ধ ছিল। কেউ কি কুমুদকে আগলে রাখবে তারই ভালোবাসায়? বাইরের গর্জন এখনো কমেনি। সেইসঙ্গে এখন তুমুল বর্ষণ। এই বৃষ্টি কুমুদের চোখের, না কি আকাশের; বোঝা দায়!
জামিলের চলাফেরা রকম-সকম কিছুই কুমুদের বুঝে আসেনি। বাঙালি নারী স্বামী অন্তপ্রাণ। কুমুদ ব্যতিক্রম হবে কেন! সে ঠিক বাঙালি আর দশটা নারীর চেয়েও বেশি আবেগীই ছিল। একেবারে ভালোবাসায় গদগদ যাকে বলে। প্রেমিক জামিল ছাড়া ছাত্র জীবনে কাউকেই তার পুরুষ মনে হয়নি। চোখে ধরা তো দূর। কিন্তু আজ সেই জামিলের মধ্যে পুরুষত্ব অনেক বেশি। বউকে এখন আর তার ভালো লাগে না। কী যে অজমূর্খকে সে বিয়ে করেছে। একথা কুমুদের নিজ কানে শোনা। চিৎকার করে জামিল জানিয়ে দিয়েছে, কুমুদ এক অশিক্ষিত। হ্যাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরুলে কী হবে, তার তো ন্যূনতম বোধও নেই। কাজের মেয়েকে তো সে বিয়ে করতে চায়নি। কিন্তু কুমুদের কী করার ছিল। বাড়ির কাজ, বাইরের চাকরি সবই সামলাতে হতো। সাবলেট রুমটার ভাড়া তো এই খণ্ডকালীন স্কুলের চাকরিটায়! স্বামী তো তার আজও বেকার। বেচারা চাকরির জন্য দিনরাত খাটছে। এ আর এমন কী কুমুদ সব সামলে নেবে। কুমুদকে যে একসময় হৃদয়রাজ্যের রানি বলতো, আজ সেই জামিলের হঠাৎ কী হলো! কুমুদের তো কিছুই পরিবর্তন হয়নি। শুধু কাছাকাছি এসেছে এই যা।
কুমুদ খুঁজছে তার ভালোবাসা। দিনের পর দিন নিজেকে কষ্ট দিয়ে যে ভালোবাসা সে জামিলকে গছিয়ে দিয়েছে জোর করে, সেই ভালোবাসা। কখনো কুমুদ ভাবেনি তার মনের জন্য তাকে ভাবতে হবে। নিজের ক্যারিয়ারের জন্য নিজেকে ভাবতে হবে। শহরে সাবলেট থাকাকালীন বাড়িওয়ালা আপা বলেছিল, কুমুদ তোমার খারাপ লাগে না! নতুন জামাকাপড় পরো না। ভালো সাজ-পোশাক নেই। কুমুদ হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, আপা আমি ভালোই আছি। শুধু ভালো না খুব ভালো আছি। জানেন তো, জামিল খুব ভালো মানুষ। খুব ভালো। আমার তো আর কিছু লাগে না আপা। কিন্তু আজ কুমুদ খুঁজছে! সত্যি কি জামিল ভালো ছিল? তার হৃদয় তোলপাড় হয়ে যায়। সেই কী অতি আহ্লাদে জামিলকে ভালো করে তোলেনি! অন্ধের মতো ভালোবেসে জামিলকে আগলে রাখেনি? নিজে না খেয়ে তাকে শান্তিতে রাখেনি? তবে কেন আজ তার এই পরিণতি! কুমুদ সত্যি খুঁজছে!
কুমুদ অভাগী। হ্যাঁ অভাগীই বটে। নতুবা জড়িয়ে ধরে কাঁদারও কেউ থাকবে না! কোথাও তো কেউ নেই। মায়ের অসুস্থতা নিয়েই তিনি জ্বলছেন। কুমুদ মায়ের কথাও ভাবে। মা তার আজীবন খাটলো পরিবারের জন্য। এখন প্রায় শয্যাশায়ী তাকে কে সময় দিচ্ছে! না কুমুদ কেন, কেউই সময় দেয়নি, দেয় না। সবার জীবনের তাড়া। নিজের জীবন সাজাতে তটস্থ। কুমুদ খুঁজে চলেছে! তার মা আমিনা বেগম কী পেলো এই পঞ্চান্ন বছরে যাদের জন্য ত্যাগ সেই সন্তানেরা, স্বামী তাকে কী দিয়েছে। কুমুদের যদি সংসার টিকতো তারও তো সন্তান হতো! তাহলে সেই সন্তানও কি এমনই হতো।
কুমুদ খুঁজে চলে। মায়ের পাওয়া-না পাওয়া কুমুদকে ভাবায়। আবার সে যখন নিজের ভালোবাসা-স্বস্তি খোঁজে, সেখানেও শূন্যতা। পথচলতি যাদের সঙ্গে তার দেখা হয়, কাজ করে সবাই তাকে প্রপোজ করে বসে। শুধু প্রোপজ বললে ভুল হবে। বলা যায়, সুযোগ নিতে চায়। একা নারী তো! হ্যাঁ। কুমুদ আজ একা। সে খুঁজে চলেছে জামিলকে দেওয়া সেই ভালোবাসা। যা একেবারে পরিশুদ্ধ ছিল। কেউ কি কুমুদকে আগলে রাখবে তারই ভালোবাসায়? বাইরের গর্জন এখনো কমেনি। সেইসঙ্গে এখন তুমুল বর্ষণ। এই বৃষ্টি কুমুদের চোখের, না কি আকাশের; বোঝা দায়!