শুদ্ধতা তার মোবাইল সেটটি বন্ধ করে রিভলভিং চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। তখন রাত পৌনে বারোটা। স্টাডি রুমে পিসিতে বসে সে অফিসের কিছু কাজ সারছিল। তবে ঠিকঠাক মতো কাজ না হলেও কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল বলা চলে। তখনই এলো সৈকতের ফোন। সৈকত খুব সংক্ষেপে বলল, সিট বেল্ট বাঁধা হয়ে গেছে, এখনই আমাকে মোবাইল সেটটি অফ করে দিতে হবে। ভালো থেকো। আশা করি, আমার অনুপস্থিতি এ ক’দিন তোমাকে অনেক স্বস্তি দেবে। সৈকতের তীব্র শ্লেষমাখা কথাগুলো ওর বুকে তীরের মতো বিঁধলো। কিন্তু সৈকতের কথার পৃষ্ঠে সে কোনো জবাব খুঁজে পেলো না। আসলে আজ সকাল থেকেই শুদ্ধতা নিজেকে আবিষ্কার করেছে এক অন্যরূপে। সকালে ঘুম ভাঙতেই ওর মনে হয়েছিল সৈকত আজ অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। দেড় মাসের প্রোগ্রামে সৈকতের অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা আর তাতেই ওর মনে হচ্ছে এটা একটা বিশাল বিচ্ছেদ। নিজের মনের লাগাম টেনে ধরতে না পেরে শুদ্ধতা নিজেই সৈকতকে অফিস থেকে ফোন করেছিল, কিন্তু ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলছি, বলে সৈকত ফোন রেখে দিলো। আশ্চর্য! তারপর সারাদিনে ওর আর একবারও সময় হলো না শুদ্ধতাকে ফোন করার। শুদ্ধতা বেশ বুঝতে পেরেছে যে, সৈকত ইচ্ছে করে তাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই এ রকম আচরণ করছে। কেননা অন্যদিন অফিস কিংবা বাড়িতে যত কাজই থাকুক এর ফাঁকেই সে শুদ্ধতাকে হাজারও বার রিং দেয়। আর শুদ্ধতাকেও সে ফোন কল রিসিভ করতে হয় যখন যেখানে যেভাবেই থাকুক। একদিন কাজের বুয়াকে নিয়ে সংসারের টুকিটাকি সারছিল, এমন সময় বেডরুম থেকে মোবাইল ফোনের রিং শোনা গেল। শুদ্ধতা ওখান থেকে সরে আসতেও পারছিল না, ফোন কলটি রিসিভ করতেও পারছিল না। ও ভাবলো হাতের কাজটি সেরে এসে পরে রিং ব্যাক করবে। কিন্তু না! রিং একটানা বেজেই চললো। শুদ্ধতা শেষ পর্যন্ত সব কাজ বন্ধ রেখে ফোন রিসিভ করে সৈকতকে একটা ধমক লাগালো, দেখছো যে ফোনটা ধরছি না, তার মানে ব্যস্ত আছি। সৈকত ততোধিক জোরে শুদ্ধতাকে পাল্টা ধমক দিয়ে বলল,কী হাতি-ঘোড়া নিয়ে ব্যস্ত আছ তুমি! পৃথিবীর যত কাজই থাক, আমার ফোন কল যদি তুমি রিসিভ না করো, তো আমি চারিদিকে আগুন লাগিয়ে দেব বুঝলে!
বেশ তুমি চারিদিকে আগুন লাগিয়ে দাও, আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখি—শুদ্ধতাও জবাব দিলো।
তো এমন পাগলটে যে মানুষ তার প্রতিদিনের রুটিন আজ হঠাৎ করেই পাল্টে গেলো। আর এটাই হয়তো শুদ্ধতাকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে দিয়েছে।
শুদ্ধতা পিসি থেকে উঠে ডাইনিং স্পেসের নীলাভ ডিম লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে বারান্দায় এসে বসলো। সমস্ত বাড়িটাকে এখন ওর নিস্তব্ধ নীল স্বপ্নপুরী মনে হচ্ছে। আশেপাশের অধিকাংশ বাসা-বাড়ির আলোও নিভে গেছে। শুদ্ধতা ভাবলো, দিনের বেলা অসংখ্য মুখোশ পরা মানুষ তার মতোই কি এই রাতে নিজেদের মুখোমুখি হয়েছে, নাকি তারা সেটুকুও করতে না পেরে ঘুমের ভান করছে? আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘগুলো ধোঁয়ার মতো এলামেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাড়া-শব্দহীন রাতের পৃথিবীর এই রূপ ও আগে কখনো এভাবে দেখেনি। শুদ্ধতা দেখতে পেলো দূর আকাশে একটা এরোপ্লেন নক্ষত্রের মতো মিটিমিটি আলো নিয়ে দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। আর সাদা মেঘগুলো প্লেনের যাওয়ার পথের রেখা এঁকে দিচ্ছে। শুদ্ধতা টের পেলো ওর দু’চোখ বেয়ে গরম জল নেমে আসছে। আশ্বর্য! সৈকতের জন্য শুদ্ধতার কষ্ট হচ্ছে। আর কষ্টের ভার নেমে যাওয়ার সময় অদ্ভূত একটা আনন্দও হচ্ছে একই সঙ্গে।
আমাকে কষ্ট দেওয়ার অপরিসীম ক্ষমতা আছে তোমার!—শুদ্ধতা বিড়বিড় করে বলল।
সৈকতের জন্য শুদ্ধতা কাঁদছে, এটা সৈকত কিছুতেই বিশ্বাস করবে না, সেটা শুদ্ধতা জানে। কেননা গত এক বছরে ঘটনাগুলো ঘটেছে ঠিক উল্টো দিক থেকে। সৈকত অন্তত হাজার বার বলেছে, ভালোবাসি। শুদ্ধতা বিশ্বাস করেনি। আসলে ওদের পরিচয়টিই হয়েছিল অদ্ভুত রকমভাবে। বছর খানেক আগে অফিসের বিভাগীয় একটি সম্মেলনে শুদ্ধতার সঙ্গে সৈকতের পরিচয়। এরপর মাস খানেক বাদেই যখন ওদের আবার দেখা হলো, সৈকতের ব্যবহারে শুদ্ধতা অবাক হয়েছিল। সেদিনই সে জেনে ছিল সৈকত কবিতা লেখে। আর অবাক হয়েছিল এটা জেনে যে, সৈকত তাকে নিয়ে কবিতা লিখেছে। মাত্র এক মাসের পরিচয়ে শুধু টেলিফোনের কথার সূত্র ধরে মানুষটি তাকে ভালোবেসে কবিতা লিখেছে, ব্যাপারটা শুদ্ধতা মোটেও স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। তাই কখনো মানুষটিকে মনে হয়েছে ভণ্ড, কখনো নারীলোভী-কামুক। কিন্তু সত্য এই যে, সে কিছুতেই সৈকতের জাল থেকে নিজেকে মুক্ত করতেও পারেনি।
শেষ পর্যন্ত সৈকতের ভালোবাসার ওজন পরীক্ষা করতে ওর সবক’টা কাব্যগ্রন্থ সে অল্পসময়ে পড়ে ফেললো এবং সৈকতের কাব্যগ্রন্থগুলো পড়ে তার যা উপলব্ধি হলো, তা হচ্ছে সে সৈকতের সাহিত্যের ল্যাবরেটরির একটা উপাদান মাত্র। কেননা সৈকতের অন্যান্য কাব্যগ্র্ন্থের শরীর জুড়েও অসংখ্য নারীর উপস্থিতি খুবই লক্ষণীয়। সুতরাং শুদ্ধতাকে ঘিরে সৈকতের সাহিত্যের পাত্র খানিকটা পূর্ণ হলেই সে যে আবার অন্য উপাদান খুঁজে নেবে, ভিন্ন মাত্রায় সাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে মনোযোগী হবে এটাই স্বাভাবিক। ব্যাপারটি সৈকতকে একদিন বলতেই, সে হো হো করে হেসে উঠে এর সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেছিল, আমি জানি আমি একটা হেরে যাওয়া যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তারপরেও আমার পথ চাওয়াতেই আনন্দ।
কী বলতে চাও তুমি? আমাকে সত্যি ভালোবাসো? কাব্যগ্রন্থের পাতা ছাড়া বাস্তব জীবনের কোথাও কি তুমি আমাকে এইটুকু জায়গা দেবে?—শুদ্ধতা স্পষ্ট করে বলেছিল।
জানি না। তবে কবিতা বানিয়ে লেখা যায় না বুঝলে হে সুন্দরী। কবিতা হৃদয় থেকে উৎসারিত হতে হয়। আর সে হৃদয়েই তোমাকে আসন দিয়েছি এটুকু বলতে পারি।
এই রকম বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলছিল ওদের জীবন গত এক বছর ধরে। বিগত প্রতিটি রাত্রি-দিনে ঘটে যাওয়া মনের বিভিন্ন অনুভূতি নিয়ে একের পর এক অসংখ্য কবিতা লিখে গেছে সৈকত, যার অনেকগুলোই জাতীয় দৈনিকে ছাপা হবার পর পাঠক জনপ্রিয়তা পেয়েছে ভীষণ মাত্রায়। আর প্রতিবারই শুদ্ধতার নিজেকে মনে হয়েছে গিনিপিগ। ওর প্রচণ্ড রাগ হয়েছে সৈকতের ওপর। অথচ আজই প্রথম সৈকতের অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ার মুহূর্তে শুদ্ধতা অনুভব করলো যে, সে নিজেই সৈকতকে কতখানি ভালোবেসে ফেলেছে। প্রতিদিনের পরিচিত দিনরাত্রি যেন হঠাৎ করেই বদলে গেছে। ঘুমন্ত রাতের পৃথিবীর কাছে তাই তার জানতে ইচ্ছে করল, আসলে সুখী কারা? ওই মানুষগুলো, যারা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে, না কি যারা হৃদয়ের দহন নিয়ে নিজেকে পোড়াচ্ছে? সে সিদ্ধান্তে আসতে পারলো না। কিন্তু ওর মনে হলো, যে হৃদয়ের দহন থেকে শিল্প সৃষ্টি হয়, সে দহন থেকেই হয়তো সৈকত কবিতা লেখে। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার ক’দিন আগে বসুন্ধরার সিনেপ্লেক্সে সৈকত শুদ্ধতাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সিনেপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে ওরা বসেছিল একটি রেস্টুরেন্টে। মুখোমুখি বসে আমেরিকান চপসি নাড়াচাড়া করতে করতে সৈকত ওকে বলল,যদি তুমি আমার স্রোতস্বিনী হও, আমি জলের খোঁজে আর কোথাও যাব না। আমার অখণ্ড অবসরে সেই জলে ডুব দেব।
সে তো হওয়ার নয়। আমি বড় জোর চাঁদ হতে পারি। দূর থেকে তোমায় আলো দেবো, সে আলোয় পথ চিনে তুমি পৃথিবীর পথ হাঁটবে।
ওহে অহঙ্কারী অধরা চাঁদ তুমি মৃন্ময় পৃথিবীর ঘ্রাণ এখনো পাওনি। আকাশের নীল থেকে তোমায় সবুজে নামিয়ে আনব আমি। তখন দেখো জীবনটা কত রঙিন!
আমি নীলকে নীল আর সবুজকে সবুজ বলেই চিনি। চোখে রোদ চশমা পরে চারদিক রঙিন দেখতে পছন্দ করি না।
এ বিতর্কের যেন কোনো শেষ ছিল না। সৈকতও সেদিন শুদ্ধতার শক্ত কথার কোনো জবাব দেয়নি। শুদ্ধতা এক ধরনের আত্মতুষ্টি নিয়ে ফিরে এসে ছিল। কেননা হৃদয় নিয়ে যে কোনো বালখিল্য আচরণ ওর কাছে ব্যক্তিত্বের দুর্বলতা বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু সৈকত চলে যাওয়ার পর ওর মনের পটভূমিতে যে পরিবর্তন এলো, তাতে সমর্পণের ইচ্ছা জাগলো সবার আগে। সমর্পণে যে এতো সুখ তা ওর জানা ছিল না। তবে সমর্পিত হওয়ার আগ মুহূর্তের যে যন্ত্রণা তারও বুঝি কোনো ভাষা নেই শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া।
একটি সপ্তাহ পার হয়ে গেল। সৈকত যোগাযোগ করলো না। শুদ্ধতা মোবাইল ফোন সেটটির দিকে অনিমেষ তাকিয়ে থাকলো, অথচ ওটা বেজে উঠলো না একবারও। শূন্য দুপুর, স্নিগ্ধ সকাল আর ক্লান্ত বিকেল নিস্তব্ধ হয়ে রইলো। কালো মেঘের নিচ দিয়ে বলাকারা উড়ে গেল দূর থেকে দূরে অথচ ঝড়ের বাতাস বইলো না। দিন আর রাত্রির পার্থক্য ঘুচে গেল। তারপর একদিন সকালে কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্য তখনো ওঠেনি। শুদ্ধতা অনুভব করলো তার সাইল্যান্ট মোডে রাখা মোবাইল ফোন সেটটি যেন নড়ে উঠেছে। খুব সন্তর্পণে ফোনটি নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে সে উঠে এলো একদম ছাদে। সকালের মায়াবি আলোয় ও তাকিয়ে দেখলো একটি অপরিচিত নম্বর থেকে রিং আসছে।
হ্যালো…
হ্যালো। আমি জানি তুমি এখনো ঘুমে। কিন্তু আমি যে প্রশান্ত মহাসাগরের তীর থেকে আমার প্রিয়ার কণ্ঠস্বর শুনতে চাই। আমাকে দু’ লাইন গান শোনাও। গমগম করে উঠলো প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে থাকা সৈকতের কণ্ঠস্বর।
প্রথমে শুদ্ধতা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।কী বলবে সে সৈকতকে? এত কষ্ট দিলে কেন? কেন আমার আকাশে এত মেঘ জমতে দিলে? না কোনো অনুযোগ নয়, বরং তার কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হলো রবীন্দ্রসঙ্গীত সুর— খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভিতরে/ কত রাত তাই তো জেগেছি বলব কী তোরে…