হঠাৎ ঝড়ে ভেঙে যাওয়া বাঁশের মতো মট করে ভেঙে পড়ে রাত—এই মধ্যরাতে পিয়ানোবাজারের বাসিন্দারা জেগে ওঠে, তারা আর ঘুমাতে যায় না, তারা একে অন্যকে জিজ্ঞাসা করে—কী হইছে। পরস্পর মুখের দিকে চেয়েও কোনো উত্তর দিতে পারে না, ফের তারা জানতে চায়, কী হইছে?
রাত আর রাত হয় না, অন্ধকার-দিনের মতো তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বিছানায় পাতা কম্বল, লেপ ও কাঁথা গুছিয়ে রাখে, তবু কারও মুখে মধ্যরাত ভেঙে যাওয়ার কোনও কারণ শোনা যায় না। অনেকক্ষণ পর পাড়ার উত্তর-পশ্চিম দিকের জামে মসজিদের মাইক বেজে ওঠে—‘ভাইসব, আজ রাতে মুগলাইবাজার ওয়াজ মাহফিলে শিরক করা হইছে। আমাদের গ্রামের মজনু মিয়ার ছেলে মাওলানা নসিহতুর রহমান ওয়াজে শিরক করেছে। তাকে পাঁচের বাইর করা হলো।
রাতের বাসিন্দারা একে-অন্যের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, বলাবলি শুরু করে, ওমা, আসতাগফিরুল্লাহ। ক্যামনে মজনু মিয়ার ছেলে শিরক করলো? আলেম মানুষ!
এই রাতে নিজের বাড়িতে ঢুকে হতভম্ব সংসারের মুখে পড়ে মাওলানা। বাবা চৌকিতে বসে পা দোলাচ্ছে, মা বেতের মোড়া নিয়ে গালে-মুখে হাত দিয়ে শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে বসে আছে, আর একমাত্র ছোটভাই হাতে স্কুলের বই বন্ধ করে টেবিলমুখী চেয়ার ঘুরিয়ে বড় ভাইয়ের মুখে দিকে তাকিয়ে আছে পলকহীন। এই ঘরে কেউ কথা বলছে না।
বসার ঘরঘেঁষা পাকঘর থেকে চুলোয় জ্বলা কাঠের শব্দ আসছে, পট-পট করে ফুটছে আগুনে। সম্ভবত, শীতের রাতে স্বামী মজনু মিয়া ঠাণ্ডা ডাল খেতে পারে না বলেই মধ্যরাতে তার জন্য চুলায় আগুন জ্বালানো।
মাওলানা তার মাকে খাবার দিতে বলে নিজের রুমে প্রবেশ করে। পড়ার টেবিলে রাখা কোরআন শরীফের দিকে চোখ আটকে যায় তার। মনের ভেতর থেকে উগরে ওঠে—কোরানের আলো দিকে-দিকে ছড়িয়ে দেবে বলেই পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে নিজের গ্রামে ফেরা, এমনকী রাজধানীর সবচেয়ে বড় মাদ্রাসাটিতে কাজ করার সুযোগ পেয়েও।
এই মধ্যরাতে, শীতের ঠা্ণ্ডা হিমেল হাওয়া জানালায় পাক খেতে-খেতে পড়ে থাকতো বালিশের পাশে, শির-শির ঠাণ্ডা হাওয়ার তলায় লেপের নিচে কোনও নরম হাতওয়ালা ছাত্রের খেদমত চলতো মাওলানা’র উরুতে-পায়ে-চুলে-মাথায়, ভাবতে-ভাবতে তার চোখ ভরে উঠলো জলে। এই মধ্যরাতে লাল বাতির আলোয় যদিও মাওলানা’র চোখের পানি দৃশ্যমান হয় না।
পাঞ্জাবিটা গা থেকে ছাড়িয়ে দরজার পেছনে র্যাকে ঝুলিয়ে দেয় মাওলানা নসিহতুর রহমান। তার ঘরে ছোট্ট একটি বইয়ের আলমারি। আলমারিভরা তাফসিরের কিতাব, সীরাতে খাতামুল আম্বিয়া, ইসলামের ইতিহাস, উহুদের যুদ্ধ, শহীদের বাগান—ইত্যকার গ্রন্থ। চারকোণো ঘরে একপাশে খাট, এই খাটটি পুরনো বাড়ির বসার ঘরে ছিল, নানা বাড়ি বা কাকাদের বাড়িতে বেড়াতে আসা লোকেরা এই ঘরে এই খাটে থাকতো। দুই বছর আগে টিনের দোচালা বাড়ি নতুন করে ওঠার পর ওই বাংলাঘরটিও ভেঙে ফেলে মজনু মিয়া। আর খাটের জায়গা হয় মাওলানা’র কক্ষে।
দুজন মানুষ ছিমছাম গা এলাতে পারে এমন খাট। খাটের মাথার দিকে কাজ করা, একটা ফুলের ছবি আঁকা হয়েছে কাঠ কেটে। মাঝখানে ফাঁকা রেখে খোদাই করা। খাট যেখানে শেষ, একহাত সমান জায়গাটিতে বইয়ের আলমারিটি স্থাপন করে নসিহত। আর ঘরের দক্ষিণপাশে একটি টেবিল ও চেয়ার। এই-ই মাওলানার কক্ষের আসবাবপত্র। তবে তার মনে-মনে চিন্তা আছে, বিয়ের আগে-আগে রুমটিকে আরও আরও আসবাবপত্রে গোছাবে। মাওলানার নতুন বিয়ে করে আনা বউয়ের জন্য চারহাত লম্বা, দু হাত প্রশস্ত একটি আয়নার অর্ডার করবে। তার বউ যেন পুরো শরীর দেখতে পারে আয়নায়। বিশেষ করে বউয়ের লম্বা আঙুল দেখে মাওলানা নসিহতুর রহমানের ধারণা, বউ লম্বা হবে, তার শরীর সুন্দর হবে। মাদ্রাসার বন্ধুদের কাছে আগেই শুনেছে, লম্বা আঙুলওয়ালা মেয়েদের শরীর বেশি সুন্দর হয়। তাদের স্তন বেঁকে থাকে না, লেগে থাকে না পেটের সঙ্গে। তাদের পেটে ভাঁজ পড়ে কম। লম্বা মেয়েদের যোনি দেখতে অনেক লম্বাটে হয়, এটা পুরুষের কাছে আকর্ষণীয়।
মাওলানা তার বউ হিসেবে যাকে পছন্দ করেছে, তাকে এই কক্ষেই দেখেছে সে। যদিও ওই আঙুল। তাও মাত্র পাঁচটি। মেয়েটির বাকি পাঁচটি আঙুল আছে কি না, মেয়েটি তার মনের মতো কি না, এসব ভাবনা থাকলেও মনে-মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, পাঁচ লম্বা আঙুলওয়ালা মেয়েটিকেই বিয়ে করবে সে।
মাওলানা তার পছন্দের কথা বাবা-মাকে জানিয়ে দেবে বিয়ের প্রস্তুতি নিতে, আর এমন চিন্তা-ভাবনা সময়টিতেই কিনা হঠাৎ ধাক্কাটা এসে সোজা তার গায়েই লাগলো। মাওলানা চুপ থেকে পাঞ্জাবি ছেড়ে খাবার খেতে আম্মার ডাকের অপেক্ষা করতে লাগলো।
মধ্যরাতে বিধ্বস্ত মাওলানা নসিহতুর রহমানের সঙ্গে আর কথা বলতে চায় না বাবা মজনু মিয়া। ভাবছে, ফজরের নামাজের পরই ছেলের সঙ্গে কথা বলা যাবে। এই ভাবনা প্রকাশের আগেই মাওলানা নসিহতুর রহমানের মা ভাত বেড়ে দেয় স্বামী মজনু মিয়াকে। বলে, আসো, খাইতে। এই নসিহত, তুইও আয়, ঠাণ্ডা হয়া যাইতেছে।
মাওলানা’র ঘরে যখন শান্তিপূর্ণ বিমূঢ়তা, আর তখনই পিয়ানোবাজার গ্রামের বাকি মানুষেরা ঘুমাতে পারে না, জেগে থাকে। গ্রামের মানুষদের হৈহৈয়ে একমাত্র পুকুরটির নীরবতা ভাঙতে থাকে। ঝাঁকে-ঝাঁকে বেয়ে চলা তেলাপিয়া মাছগুলো লেজ নাড়িয়ে যায়। ইতিউতি প্রস্রাব করে গ্রামের ছাব্বিশ বছরের পোলা মেতোলেব পুকুরের কিনারে বসে লিঙ্গে পানি দিলে সড়ৎ-সড়াৎ করে পানি সরিয়ে ডুব দেয় তেলাপিয়া মাছগুলো। পিয়ানোবাজার গ্রামের উত্তর-পূর্ব দিকে তিন কানি জমির ওপর খোদাই করা পুকুর। গ্রামের এই পুরুষেরা এর উৎপত্তি না জানলেও পুকুরের তেলাপিয়া তিনপুরুষের জিভে জল ধরে রাখছে। বছরে একবার করে মাছ ধরার নিয়ম থাকলেও বর্ষার রাতে জাল ফেলে শিকার করে ভোরে-ভোরে শাহজাহান চোরের বাড়িতে বসে কড়া মশলায় তেলাপিয়া মাছ ভাজি খায় গ্রামের সবুজ, জিগার, সুবহানরা। পুকুরে বাইম মাছ, রুই, মাগুর, শিং, পুঁটি, কাতল মাছও আছে। তবে তেলাপিয়ার সংখ্যা এত বেশি, অপরিচিত কারও কাছে পুকুরের পানি গভীর মনে হবে কালো দেখে। মসজিদ আর পুকুরের মাঝখান দিয়ে গ্রামে প্রবেশ করে লোকজন।
মাওলানা’র শিরক পিয়ানোবাজারের মানুষেরা মানতে পারে না। তারা জেগে-জেগে একে-অন্যের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে আর পরস্পরকে বলতে থাকে, এর একটা বিহিত করতে হবে। পরস্পরে আবার সম্মতি জানাতে থাকে।
মজনু মিয়া রাতেই গ্রামবাসীদের এমন তৎপরতার কথা আঁচ করতে পারে না, যদি না তার ঘরে চাদরমুড়ি দিয়ে রফিক মিয়ার আগমন ঘটতো। দ্রুতপায়ে মজনু মিয়ার পুকুরের দক্ষিণপাড়ঘেঁষা বাড়িতে এসে বলে দিয়ে যায় রফিক মিয়া, মজনু! তোমাদের একঘরে করা হইতে পারে। তোমরা কী করবা, কইরা লাও।
রফিকমিয়ার দ্রুত খবরের পর মজুন মিয়ার বুঝতে বাকি থাকলো না, গ্রামের মানুষ ইতোমধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে আর মসজিদের মাইকে মতিনউদ্দিনের ঘোষণায় কোনও ফাঁরাক নেই।
দুই.
দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলেকে মাদ্রাসায় ভর্তি করেছিলো মজনু মিয়া। বিশেষ করে পিয়ানীবাজারের মতো ধর্মপ্রাণ এলাকায় যেখানে ধর্মের অনুসারীরা বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে মারামারিতে লিপ্ত। এক ঈদগাহে হয় দুইবার ঈদের জামাত। ইউনিয়নের ঈদগাহে পাশের মুগলাইপুর গ্রামের বাসিন্দারা নামাজ পড়ে দিনের শুরুতে, আর পিয়ানোবাজারের বাসিন্দারা জামাত বাঁধে সকাল দশটায়। এক গ্রাম কিয়ামের পক্ষে, অন্য গ্রাম কিয়ামকে শিরক মনে করে। আর এ কারণে নবীর নামে দরুদ পড়ে দাঁড়িয়ে, মুগলাইপুরের বাসিন্দারা দরুদ পড়ে বসে।
মজনু মিয়ার চিন্তা ছিল, নিজের সন্তানটিকে ধর্মীয় শিক্ষায় বড় করবেন, যেন দ্বিনের আসল খেদমত করে, আসল দাওয়াত দেয়—এ কথাটি ছেলে নসিহতুর রহমানও বুঝতে সক্ষম হয়ে বাপের খুশির জন্য নিজের এলাকাতেই ফিরে আসতে বাধ্য হয়। যে মাদ্রাসা থেকে দাওরায়ে হাদিস শিক্ষিত নসিহতুর রহমান, ওই প্রতিষ্ঠানে ক্লাসে টানা ছয় বছর নাম্বার ওয়ান হিসেবে ছিল। পড়াশোনা, বিতর্ক, দেওয়ালিকাচর্চা—কোনও ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল না নসিহতুর। অনায়াসে ওই প্রতিষ্ঠানে হাদিসের কেতাব পড়ানোর সুযোগ পেতো আর বছর দুয়েক গেলে বড় মসজিদে ভালো বেতনে ইমামতি। কিন্তু বাপের কথা রাখতে গিয়ে নিজের সঙ্গে ত্যাগ স্বীকার করে মাওলানা নসিহতুর রহমান। আর এই ত্যাগ স্বীকার আক্ষরিক অর্থেও। মাদ্রাসার ছাত্রদের খেদমত, কাপড় ধুয়ে দেওয়া, মধ্যরাত অবধি পায়ে-পিঠে ডলাডলি—এসব। আর এতে ছাত্রদের সওয়াবও হতো বেশ। বিশেষ করে ইলমে দ্বীন অর্জনে ছাত্ররা খেদমতকে বিশেষ প্রাধান্য দেয় মাদ্রাসায়। মাওলানা অনায়াসে এসব সুযোগ-সেবা পরিত্যাগ করে নিজের বাড়িতে এসে দ্বীনের দাওয়াতে প্রবেশ করে। প্রথম দিকে তাবলীগ জামাতে কিছুদিন সময় দিয়ে স্থানীয় মাদ্রাসায় চাকরি নেয়। আর চাকরি নেওয়ার প্রথম বছরের শীতেই পাশের মোগলাইপুর গ্রাম থেকে ডাক আসে, সেখানকার পিয়ারী যুবসংঘ আয়োজনে তিনদিনব্যাপী ওয়াজ মাহফিল। আর এই সংঘের বাৎসরিক মাহফিলে উদ্বোধনী দিনেই ওয়াজ করতে হবে এলাকার সন্তান মাওলানা নসিহতুর রহমানকে। মোগলাইপুর গ্রামের বাসিন্দারা মাদ্রাসায় পড়ুয়া ভেবে নিজেদের তরিকাকে এগিয়ে রাখার বাসনায় নসিহতকে দাওয়াত দেয়। আর ব্যাপারটি মানতে পারে না নিজের পিয়ানোবাজারের মানুষেরা। সাতপুরষের তরিকা রেখে আরেক গ্রামে ওয়াজ করতে গিয়ে প্রথম দিনেই মানুষের ক্ষোভের অনলে পড়লো নসিহত।
তিন.
মজনু মিয়া জানেন, তার ছেলেকে পাঁচের বাইরে রাখার কথা তার কানে গেলে কষ্ট পাবে এমনকী দুঃখ পাবে বেশি বাপের কথা চিন্তা করেই। তারই স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলো নসিহতুর রহমান। আর সে ভেবে ফজরের নামাজের পর ছেলেকে ডেকে মসজিদের বারান্দায় বসিয়ে ধীরে-ধীরে বলেন, ‘আমি তো তোর কোনও কাজেই আসতে পারলাম না। তুই বরং ঢাকায় চলে যা। সেখানেই তুই ইসলামের খেদমত কর। সেখানে কাজের মধ্যেও অনেক গতি আছে। আরও-আরও বড় আলেমের কাছ থেকে শিখতে পারবি।’ ছেলেকে বুঝিয়ে কোনও পাল্টা কথা না শোনেই মজুন মিয়া বেরিয়ে পড়ে মসজিদ থেকে আর জানার চেষ্টা করে কী কারণে শিরক হলো তার ছেলের? মজনু মিয়া মসজিদ থেকে বেরিয়ে গ্রামের পূর্ব দিক ধরে হাঁটা শুরু করে। পথের পাশে টমেটো ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করতে দেখে মোতালেব সর্দারকে।
লম্বা-ফর্সা, ছোট করে কাটা নখ, হলুদ-সাদা আঙুলের মাথায় দুধরঙা নখ।
মাওলানার চোখজুড়ে মেয়েটির লম্বাটে পাঁচ আঙুল।
পিয়ানোবাজার গ্রামটিতে যেতে হয় পিরোজপুর বাজার পার হয়ে। নৈটংবৈরই জেলার মিয়ামনবাজার উপজেলার গ্রাম পিয়ানোবাজার। জনগোষ্ঠীর দিক থেকে পাশের মোগলাইপুর গ্রামকে পেছনে ফেলতে না পারলেও আশেপাশের সব এলাকাকে ছাড়িয়েছে শিক্ষায়। এই শিক্ষা ধর্মীয় দিকটিকেও সচেতন করে রেখেছে অনেক বেশি। সাতবংশের ধর্মচিন্তা কেউ-ই এড়িয়ে যেতে পারে না চাইলেও, লাইন ধরে মসজিদেই যেতে হয় গ্রামের পুরুষদের। এমনকী নামাজ শেষে সুন্নাত নামাজও সময়মতো পড়তে হয়।
মোতালেব সর্দারকে লম্বা করে সালাম দেয় মজনু মিয়া। সর্দার ঘাড় উঠিয়ে সড়কের দিকে আসতে থাকে, বলে, মিয়া বলো দেখি, তোমার ছেলে এইডা ঠিক কাম করলো? কী করছে, সেইটাই তো জানলাম না—মজনু মিয়া উচ্চকণ্ঠে বলার ইচ্ছা করলেও সর্দার তার কথা চালিয়ে যেতে থাকে, আরে বাপদাদার ধর্ম। আমরাও কি বুঝি নাই। কোত্থেকে তোমার ছেলে আইসা, আমরার বিরোধী পার্টির ওয়াজে গিয়া কইলো কিয়াম করা যাইবো না। হাত থেকে কুয়াশায় ভেজা ছেঁড়া ঘাস আর লেগে থাকা মাটি সরাতে থাকে সর্দার, কোমরে গামছা বেঁধে মজনু মিয়ার কাঁধে বাম হাত রেখে নিচু স্বরে বলে, শোনো মিয়া, ওরে ঠিক অইতে কও। ওকে সময় দাও। পাঁচের বাইরের ঘোষণা অইলেও তুমরার তো কুনু সমস্যা নাই। ওরে পাঠাও, আরও ভালো কইরা ধর্ম শিখুক। আর তুমি মিজান মিয়ার সঙ্গে কথা কইও। ও একটু খেপছে বেশি।
কিয়াম করেনি—এই অপরাধেই ছেলে শিরক বলে প্রচার হয়েছে, মজুন মিয়া ছেলের ভুল বুঝতে পারলো। বুঝলো, ঠিক কেন তার ছেলে মাওলানা হওয়ার সত্ত্বেও গ্রামের লোকেরা তাকে বিদায় করতে চায়। আফসোস করতে লাগলো মজুন মিয়া।
চার.
শোনেন আব্বা, ইসলামে কেবল আল্লাহই একমাত্র প্রভু—যিনি হাজির ও নাজির। তিনি সর্বত্র। আর কেউ-ই তার মতো সর্বত্র বিচরণ করতে পারে না। ফলে, অন্য কারও অপেক্ষায় চেয়ার ফাঁকা করে রাখা’র মানে গুনাহ, এইটা শিরক। আল্লাহ’র সাথে শিরক করা। এটা কোরানের কথা, এটা হাদিসের কথা। বুঝতে হবে না। গ্রামের মানুষেরা কইলেই তো ধর্ম বদল হয়া যাইবো না। মানুষ ভুল করতেছে। এক নিঃশ্বাসে চৌকির ওপর আসনপেতে বসে পিতা মজনু মিয়াকে ধর্মের ব্যাখ্যা শুনিয়ে দিলো মাওলানা নসিহতুর রহমান।
মজনু মিয়া এই ব্যাখ্যার পর আর কোনও কথা বলে না। সন্তানের ব্যাখ্যা তার মনঃপুত হয়, ছেলে তার মিথ্যে কথা বলার ছেলে নয়। আর যে যখন কোরান-হাদিস বলে কথা বলছে, তখন তো বলতেই পারে না। মজুন মিয়ার ইচ্ছে করে, ছেলের টেবিলে রাখা কোরান শরিফ খুলে জিজ্ঞেস করতে, কোন আয়াত বল, দেখি।
মজনু মিয়া ছেলেকে প্রশ্ন করার সাহস হারিয়ে ফেলে। ছোটবেলায় পিয়ানোবাজারে নোয়াখালী হুজুরের মক্তবে আলিফ-বা-তা-ছা আর ত্রিশতম পাড়ার ছোট-ছোট সূরা ছাড়া কিছুই পারে না। আর এ কারণে মাওলানা ছেলের ব্যাখ্যার পর নিজের ওপর অনীহা আসে। কিন্তু গ্রামের মানুষেরা ছেলের এই বক্তব্যে কিছুই মানবে না। বরং তাদের সিদ্ধান্তের উল্টো হলে পরিবারের ওপর হামলা আসতে পারে।
আসন পেতে বসা ছেলের বাম হাঁটুতে হাত রাখে মজুন মিয়া। নিজের মুখ ঘুরিয়ে রেখে ছেলেকে বলে, তুমি বরং আরও দ্বিন শিখার জন্য রাজধানীতে চলে যাও। ওখানে বড় মাদ্রাসায় আবার পড়াও।
মাওলানা নসিহতুর রহমান বাপের প্রস্তাবে সরাসরি উচ্চস্বরে ‘নাহ’ বলে বসে। পাশের ঘরে মা, ছোটভাই দুজনেই তড়িঘড়ি করে মাওলানার কক্ষে প্রবেশ করে। মায়ের আঁচলঘেষে ছোটভাই রহমতুল্লাহ দাঁড়িয়ে থাকে। এই প্রথম নসিহত বাপের কথার বিরোধিতা করে। বলে, আমি আগে বিবাহ করব, এরপর বাকি সব।
নসিহতুরের কথা শোনে বাপ-মা-ভাই; কেউই বিস্ময় লুকিয়ে রাখতে পারে না। সামাজিক এই বয়কটের সময়ও চিলতে হাসি তিনজনের মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
পাঁচ.
বড়ছেলের মুখে বিয়ে কথা শুনে সাবেকুন্নেসার খুশি যেন ধরে না গায়ে। লাল পাড়ের শাড়ি এই তার মাথা থেকে পড়ে যায়, আবার টান মেরে উঠিয়ে দেয়। হালকা লাল রেখা আর সাদা আঁচলে নিজের মুখখানি ঢেকে নেয়। বড় রুমে পড়ার টেবিলে চলে যায় রহমতুল্লাহ। এবার দরোজায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সাবেকুন্নেসা ছেলের শরীর ধরে বসে, মাওলানার হাঁটুতে বাম হাত রেখে, সহাস্যে জানতে চায়, কারে পছন্দ হইছে তোর? এই গ্রামেরই ফুরি? মায়ের মুখে হাসি মাওলানা’র বুকে সাহস আরও বাড়িয়ে দেয়।
আম্মা, ওই যে পূবের পাড়ার মিজান কাকার মেয়ে, চাচিআম্মার সাথে পানিপড়া নিতে আসে মাঝে-মাঝে। মেয়েটাতো মনে হয় সুন্দরই।
সাবেকুন্নেসার হাসি উবে যায়, শাড়ির আঁচলে ভাঁজ পড়ে, মুখ থেকে সলাজ ভাব গায়েব। মনে-মনে ভাবেন, ছেলেকে গ্রামছাড়া করতে মিজানুর রহমানই মূল।
আয়, ভাত খাইতে আয়। বলে খাট ছেড়ে ওঠে সাবেকুন্নেসা।
পাশ থেকে মা উঠে গেলেও মাওলানা’র চোখেমুখে মিজানুর রহমানের মেয়ের হাতের আঙুল ভাসতে থাকে। লম্বা-ফর্সা, ছোট করে কাটা নখ, হলুদ-সাদা আঙুলের মাথায় দুধরঙা নখ। মাওলানার চোখজুড়ে মেয়েটির লম্বাটে পাঁচ আঙুল। আঙুলের ভাবনা মাখা হাসিখুশি চেহারায় মাওলানা টেবিলের ওপর দিয়ে দুহাতে ঘরের জানালা খুলে দেন। শির-শির করে শীতান্তের বাসন্তি বাতাস মাওলানার গায়ের লোম ছুঁয়ে যায়।