রঞ্জুরা এভাবেই খুন হয়। কখনো সবচেয়ে কাছের কেউ, কখনো প্রিয় কেউ হাসতে হাসতে খুন করে অবলীলায়। আজ তেমন একটা দিন। রঞ্জু খুন হয়েছে। আজও সেদিনের মতো অরুন্ধতী হাসতে হাসতে বলে, রাগ করেছিস?
মেয়েরা আসলেই নিষ্ঠুর। ওরা হাসতে হাসতে খুন করতে পারে।
এটা কি তোর কথা, নাকি হুমায়ূন আহমেদের?
কার কথা সেটা মুখ্য না। হুমায়ূন আজাদেরও হতে পারে। তবে নিজে যেদিন খুন হবি, সেদিন এটা তোরও কথা হবে। এটা আসলে তোর-আমার মতো অনেক ছেলেই একদিন উপলব্ধি করে। আমি করেছি। তুইও হয়তো একদিন উপলব্ধি করবি।
কথাগুলো হেঁয়ালি মনে হয় রঞ্জুর। তবু আসাদ বিরতিহীন বলে যায়—ছেলেরাও খুন করে। অনেক সময়ই হুজুগে পড়ে করে। খুন করার সময় তাদের চোখে-মুখে হাসির আভা থাকে না। ওদের খুনে ভিকটিমের শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরে। খুন করে ছেলেরা জেলে যায়, ওদের ফাঁসি হয়। কিন্তু মেয়েদের খুনের ধরনটা ভিন্ন। অধিকাংশ সময়েই তারা প্ল্যান করে খুন করে, কিন্তু ভাবটা দেখায় যেন অসাবধানে হয়ে গেছে। ওরা হাসতে হাসতে খুন করতে পারে। সেই খুনে হয়তো ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরে না, কিন্তু ভিকটিমের ভেতরে ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়। এ সব খুনের দায়ে মেয়েদের জেল-জরিমানা কিছুই হয় না।
রঞ্জু এবারে বুঝতে পারে। নিশ্চয়ই মাইশার সঙ্গে আসাদের মান-অভিমান চলছে। ছেলেটা বড়ই অভিমানী। খুব ছোট্ট কিংবা তুচ্ছ কোনো কিছুতে কষ্ট পেয়ে যায়। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতে একটা সিগারেট এগিয়ে দেয় আসাদের দিকে আর ক্যাসেটে সামিনার গান ছেড়ে দেয়, ‘দেয়ালেও রাখিনি গো রাখিনি অ্যালবামে।’
মেয়েরা কত সহজে খুন করতে পারে তা বুঝতে অবশ্য রঞ্জুরও বেশি দেরি করতে হয়নি। টিএসসি’র মোড়ে মোবারকের ফুচকা খেতে খেতে কী অবলীলায়ই না অরুন্ধতী খাপ থেকে ছুরিটা বের করেছিল!
আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছেরে।
মানে?
রঞ্জু ওর দিকে একটা নির্লিপ্ত দৃষ্টি দিয়ে চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। অরুন্ধতীও নিশ্চুপ। কয়েক সেকেন্ডের এই মৌনতাকে মনে হলো কয়েক বছর। রঞ্জু তার চারিদিকে একটা কফিনের অস্তিত্ব টের পেলো। বরফে ঢাকা কফিন। সে অরুন্ধতীর দিকে তাকাতে পারে না। মেয়েটার মুখে প্রাপ্তির হাসি নাকি অপ্রাপ্তির বিষণ্নতা, তাতে রঞ্জুর কিছু যায়-আসে না তখন। অবশেষে অরুন্ধতীই নীরবতা ভাঙে।
রাগ করেছিস?
রাগ? না তো! আমি রাগ করার কে?
জানি,তুই অনেক রাগ করেছিস। রাগ করারই কথা। আমি হলেও অনেক রাগ করতাম। তোর সাথে হয়তো কথাই বলতাম না। কিন্তু কী করবো বল! বাসা থেকে বারবার বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল। পরীক্ষা শেষ। রেজাল্ট বেরুলে হয় চাকরি, না হয় বিয়ে। বাঙালি মিডল ক্লাসের ডেসটিনি তো ওই একটিই। বলেছিল আমার পছন্দ থাকলে জানাতে। না হয় বাবা মায়ের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতে। তোর সাথে সেই অর্থে প্রেম করিনি সত্যি। তাই বলে আমাদের বন্ধুত্বটা তো মিথ্যে নয়। যেমন তেমন বন্ধুত্ব নয়। প্রেমাশ্রয়ী বন্ধুত্ব—এটাও মানি। বিয়ের কথা ভাবলে একজন বন্ধুর মতো মানুষের কথাই এতদিন ভেবে এসেছি। তোর মতো বন্ধু। কোনো মানুষই পারফেক্ট না। হয়তো তুইও না। কিন্তু তোর মতো করে আমাকে কেউ বুঝতে পারবে না—এর মধ্যে এক বিন্দুও মিথ্যে নেই। কী করবো বল! আজকের বাংলাদেশে অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করার জন্য যে সাহস থাকতে হয় কিংবা যেটুকু ঝামেলা সামলাতে হয়, সেটুকু সামলানোর সাহস আমার নেই। তুইতো জানিস আমি কতটা ভীতু। আমার বাবা যতই প্রোগ্রেসিভ হোন না কেন, আর তার যতই বাম রাজনীতির ব্যাকগ্রাউন্ড থাকুক না কেন, তিনিও রাজি হবেন না। চেষ্টা যে করিনি, তা নয়। সীমা আপুকে দিয়ে মা’কে বলিয়েছিলাম। বাবাকে কনভিন্স করা কিংবা বলা তো দূরের কথা, মা’ই উলটো আমার সাথে দু’দিন কথা বলেননি। ঘরে-বাইরে সবদিকের প্রতিকূলতা সত্যিই আমি সামাল দিতে পারবো না। আমার কোনো উপায় নেই রঞ্জু। তুই রাগ করিস না। মাফ করে দিস।
তলে তলে এত কিছু ঘটেছে। কই, আমাকে তো কিছু বলিসনি এতদিন!
সাহস পাইনি। তোকে কষ্ট দেওয়ার সাহস পাইনি। অথবা বলতে পারিস দিতে চাইনি। কিন্তু না চাইলেই কি ঠেকিয়ে রাখা যায়? নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করেছি। কোনোভাবেই সম্ভব কিনা ভেবেছি। কিন্তু কোনো পথ পাইনি রঞ্জু। তোকে বিয়ে করার কোনো পথ নেই।
অরুন্ধতী ভেবেছিল রঞ্জু বেসামাল হয়ে পড়বে। হয়নি। খুব ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করেছে—তা, ছেলেটা কে? আমি চিনি? ক্যাম্পাসের কেউ?
নারে। ছেলেটা ডাক্তার। গাইনিতে এফসিপিএস করেছে গতমাসে। রংপুর মেডিক্যালে পড়েছে।
ও!
আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবি রঞ্জু? তোর ছোঁয়া পেতে খুব ইচ্ছে করছে।
বলিস কী? সবার সামনে? আমি জড়িয়ে ধরলে তোর বিয়ে ভেঙে যাবে না? যা! আর ন্যাকামি করতে হবে না।
সত্যি ন্যাকামি করছি না রে। তুই বুঝবি না।
বাজে বকিস না। যা।
রঞ্জুকে অরুন্ধতীর ভিষণ নিষ্ঠুর মনে হয়। ওর চোখ থেকে টুপটুপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। আর কথা বাড়ে না তেমন। রঞ্জু বুকের বাঁ দিকে অরুন্ধতীর ছুরিটা টের পায়। ভেতরে ভেতরে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। বহুদিন আগে আসাদ যেমনটা বলেছিল, অনেকটা সেরকম।
রঞ্জুর হয়তো এতটা কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। সনাতন অর্থে প্রেম বলতে যা বোঝায়, ওদের সম্পর্ককে ঠিক তেমনটি বলা যাবে না। অনেকটাই স্ফোটন্মোখ কলির মতো। হয়তো এ ধরনের কলি থেকে শতাব্দীতে একবারই ফুল ফোটে। রঞ্জুর আর অরুন্ধতীর একজীবনে তা ফোটার নয়।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফলিত পদার্থবিদ্যার নবীন বরণে পাশাপাশি বসেছিল দু’জন। সেই থেকে পরিচয়।
আমার নাম রঞ্জন চক্রবর্তী। সবাই রঞ্জু নামে ডাকে।
আমি অরুন্ধতী। কেউ কেউ অরুও বলে।
রঞ্জুর কাছে অরুর চেয়ে অরুন্ধতীই বেশি শ্রুতিমধুর মনে হয়। ভাবে, মেয়েটির নাম অরুন্ধতী মিত্র কিংবা রায়। ওর নাম যে অরুন্ধতী হোসাইন হতে পারে, তা তার মাথায় আসেনি। তাই বলে তাদের বন্ধুত্ব এগিয়ে যেতে তা কোনো বাধা হয়নি এতদিন। ভালো লাগার অনুভূতি তো আর অঙ্ক কষে আসে না! তাই ওদের ক্যাম্পাসে, লাইব্রেরিতে, ল্যাবে, কফিশপে আর টিএসসি’র মোড়ে ফুচকার দোকানে প্রায়ই একসঙ্গে দেখা যায়। এই সম্পর্কের ব্যপ্তি নিয়ে অরুন্ধতী কতটা ভেবেছে, তা কখনো জানতে চায়নি রঞ্জু। তবে সে এই ভাবনার খুব একটা গভীরে কখনো যেতে চায়নি, পাছে নিজেকে সমীকরণের ভুল প্রান্তে আবিষ্কার করে এই ভয়ে।
সেসব গল্প অনেক দিন আগের। এতদিনে দু’জন থিতু হয়েছে দুই সংসারে। রঞ্জু নাসায় চাকরি নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। সেখানেই বিয়ে করেছে এক ল্যাটিনাকে। অরুন্ধতী ডা. জামিলের সংসার সামলায়। চার ছেলেকে সামলায়। চার ছেলে মানে তুহিন, হীরক, ডা. জামিল আর তুহিনের দাদাভাই আশিক মজুমদার। অরুন্ধতী তাদের সবাইকে দেখে আপত্য স্নেহে, ভালোবাসায়। যদিও পেটে ধরেছে দু’জনকে, কিন্তু চারজনই তার সন্তান। মেয়েটির এই একগুণ। যাকে ভালোবাসে নিমিষেই তার মা হয়ে উঠতে পারে। সংসার সামলে চাকরিও করছে একটা বেসরকারি কলেজে। কখনো বেতন পায়, কখনো পায় না। সেটা নিয়ে তার ভ্রূক্ষেপ নেই। কলেজ কর্তৃপক্ষ জানে, বেতনের টাকায় অরুন্ধতীর নির্ভরতা নেই। চাকরিটা তার নিছকই আলঙ্কারিক। সময় কাটানোর মাধ্যম। তারাও সেই সুযোগ নেয়। যদি একজনের বেতনও বকেয়া থাকে সেটা অরুন্ধতীর।
হ্যাঁ, আসলেই সময় কাটানোর মাধ্যম। সংসার যে তাকে খুব একটা সামলাতে হয়, ঠিক তেমনটিও নয়। পেশাগত ব্যস্ততার কারণে ডা. জামিল বের হয়ে যান সকাল সাতটায়। হাসপাতাল থেকে সাড়ে ৩টায় ফিরে নাকেমুখে বিলম্বিত লাঞ্চ সেরে চেম্বারে দৌড়। ফেরেন রাত দশটা অবধি। সিজার বা অন্য অপারেশন থাকলে তো কথাই নেই। বিছানা ছাড়া অন্য কোথাও কিংবা অন্য সময়ে অরুন্ধতীকে সময় দেওয়ার সময় কই! ঘরে কাজের লোক তিনজন। ছেলেদের জন্য সময় করে টিউটর আসে। তার কিছুই করতে হয় না তেমন। কাজের লোকদের তদারক করা, তুহিন আর হীরকের পড়াশুনার খোঁজ নেওয়া আর মাঝে মধ্যে শ্বশুরের খবর নেওয়া, তার সাথে গল্প করা—এটাই অরুন্ধতীর সংসার সামলানো। কলেজের এই চাকরিটা না থাকলে সময় কাটানো সত্যিই কঠিন হয়ে পড়তো।
অরুন্ধতীকে কিছুতেই অপূর্ণ রাখেনি জামিল। এখানে ‘কিছুতেই’ শব্দটি হয়তো পুরোপুরি প্রযোজ্য নয়। সে তাকে কখনোই ইমোশনালি পূর্ণ করতে পারেনি। বিত্ত, নিরাপত্তা, নিশ্চিন্ত জীবন আর রুটিন করে শারীরিক পরিতৃপ্তি—এ সবের বাইরেও যে মেয়েদের মনের চাহিদা থাকতে পারে, রোবটস্বভাবী গাইনোকোলজিস্ট তা বুঝতে পারে না। জামিলের কাছে প্রেম মানে দাম্পত্য প্রেম, শরীর তার বহিঃপ্রকাশের একমাত্র মাধ্যম। এই রুটিনবাঁধা একঘেয়েমির জীবনে শ্বাসরুদ্ধ হয় অরুন্ধতী। এই কলেজটা তার নিঃশ্বাস নেওয়ার অবলম্বন। সেই সঙ্গে তার খোলা জানালা হয়ে উঠে রঞ্জু।
আটলান্টিক পাড়ি দিলেও অরুন্ধতীর সঙ্গে রঞ্জুর যোগাযোগটা কখনো ফিকে হয়ে যায়নি। ফোনে নিয়মিত কথা হয়। বছরে দুই বছরে রঞ্জু দেশে এলে ওদের দেখা হয় রেস্টুরেন্টে, কফিশপে। দুই-একবার ক্যাম্পাসের ধূলিমাখা স্মৃতি হাতড়ে মোবারকের ফুচকাও খেতে গেছে টিএসসি’র মোড়ে। মোবারককে চেনাই যায় না। এই কয়বছরে এতটাই বুড়িয়ে গেছে। অমলিন হাসিটাই শুধু ধরে রেখেছে।
ওদের সম্পর্কটা আগের মতোই রয়ে গেছে। হয়তো বা তার চেয়েও বেশি। দূরালাপনী ওদের ক্রমেই আরও নিকটে নিয়ে এসেছে। প্রায় প্রতিদিনই কথা হয়। সংসারের খুঁটিনাটি আটপৌরে কথা। মান অভিমান আর অপ্রাপ্তির কোনো কথাই অজানা থাকে না কারোই। অপ্রাপ্তি রঞ্জুরও কম নেই। বাসায় সে আর মিশেল ইংরেজিতে কথা বলে। একজন বাংলা একসেন্টে আরেকজন পর্তুগিজ একসেন্টে। রঞ্জু জানে, বাংলার মতো প্রেমময় ভাষা আর নেই। কিন্তু মিশেলকে বাংলা শেখাবে কে! শেখানো বাংলায় প্রেম হয় না। তার জন্য বাংলাকে মাতৃভাষা হতে হয়। সুতরাং, অনিবার্যভাবেই পরস্পরের অবলম্বন হয় ওঠে ইংরেজি। একজনের প্রতি আরেকজনের ভালোবাসা আর মায়ার কমতি নেই। প্রয়োজনে একজন আরেকজনকে ইমোশনাল সাপোর্ট দেয়। নিজেদের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির গল্প হয়। কী হয়নি, কী হতে পারতো এই নিয়ে কথা হয়। আবার নিজেদের মধ্যে মান অভিমানও হয়। অরুন্ধতী এই খেলার নাম জানে না। তবে রঞ্জুর কাছে তা ‘প্রেম’ হয়ে উঠতে থাকে একসময়। একটা ঠুনকো দেয়াল ছিল সেই ক্যাম্পাসজীবন থেকেই। সেটা ভাঙতে গিয়েও দু’জনই থমকে দাঁড়িয়েছে বার কয়েক। কিন্তু ফোনে একদিন কথা না হলেই দু’জনের পৃথিবীই থমকে দাঁড়ায় অন্যভাবে। গন্তব্য জানা নেই। কিন্তু ইথারের দুই প্রান্তে দু’জনই পাশাপাশি হাঁটে। ‘পথ চলাই আনন্দ’।
ফোনে কখনো নিতান্ত মামুলি কথাবার্তা হয়। কখনো সিরিয়াস কিছু। অরুন্ধতীকে ঠিক ছিঁচকাদুনে বলা যাবে না। তবু কখনো সখনো ফোনে ফুঁপিয়ে কান্না জুড়ে দেয়।
আমি মস্ত বড় ভুল করেছি রঞ্জু।
আবার ঝগড়া হলো কী নিয়ে? তোদের ঝগড়া হয়েছে বলে এটা মনে হচ্ছে এখন। ঝগড়া মিটে গেলেই এমনটা মনে হবে না। তখন তো প্রেমে টুইটম্বুর থাকবি। আমার কথা মনে থাকবে না।
না রে। সেটা না। ওকে ভালোবাসি না সেটা তো বলিনি। কিন্তু আসলে আমরা মিসম্যাচ। ভালো মানুষেরা সব সময় ভালো স্বামী কিংবা ভালো প্রেমিক হতে পারে না। আমি তো শুধু ওকে স্বামী হিসেবেই চাইনি, প্রেমিক হিসেবেও চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম, কখনো আমার মন খারাপ হলে ও আমার মন ভালো করে দেবে। কিন্তু ব্যস্ত মানুষ। বউয়ের সাথে প্রেম করা তো দূরের কথা, তার মনের খবর নেওয়ারও সময় নেই। ও ভালো মানুষ বটে। কিন্তু একটা রোবট। আমি একজন মানুষকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। রক্ত মাংসের মানুষ, রোবটকে নয়। আমার অর্থ সম্পদ সামাজিক নিরাপত্তা কিছুরই অভাব নেই। ও আমাকে ভালোও বাসে। আমাকে আগের মতোই কেয়ার করে, কিন্তু সারাক্ষণ আমাকে ডমিনেট করে। কোনো বিষয়েই আমার মত নেয় না। আমার সাথে শেয়ার করে না। সংসারে প্যাসিভ অবস্থান আর বিছানা ছাড়া মনে হয় আমি আর কোথাও এক্সিস্ট করি না। রোগী আর হাসপাতাল ছাড়া ওর মাথায় আর কিছু থাকে না সারাদিন। ওর কাছে সংসার মানে টাকা পয়সা, আমাদের কোনো অভাব বুঝতে না দেওয়া। কিন্তু আমার যে কিসের অভাব, সেটা তো সে বুঝতে পারে না, চায়ও না কখনো। মাঝে মাঝে আমার টায়ার্ড লাগে। আমাদের এই সম্পর্কে হয়তো বা ভালোবাসা আছে, কিন্তু সম্পর্কটা সমতাভিত্তিক না। এই ভালোবাসায় প্রেম নেই রে রঞ্জু। আমার তোকেই বিয়ে করা উচিত ছিল।
এখন এই কথা বলে লাভ কী বল! আমাদের তো যার যার ডেস্টিনির সাথে এডজাস্ট করেই চলতে হবে।
ওদের এ ধরনের কথোপকথন হয় প্রচুর। কেউ কেউ হয়তো একে ‘প্রেম’ বলবেন। আবার কেউবা বলবেন স্রেফ ‘নির্ভরতা’। ইমোশনাল ডিপেন্ড্যান্স।
সেদিন অফিসে যাওয়ার পথে ফোন আসে অরুন্ধতীর। ওকে বেশ উদ্বিগ্ন মনে হয়। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে এক হাত রেখে ব্লুটুথ স্পিকার অন করে রঞ্জু।
কী রে! এই ভর সন্ধ্যায় আমার কথা মনে হলো?
তোদের তো এখন সকাল। আর তোর কথা তো সবসময়ই মনে হয়। বল, হয় না?
তা হয় বৈকি! তবে ডা. জামিলের সাথে মান অভিমান হলে আমার কথা একটু বেশি মনে হয়। চেম্বার থেকে ফেরেনি বুঝি?
সে কথা বলতেই তো তোকে ফোন করলাম। আমি তো এপোলোতে। ওকে নিয়ে এসেছি।
বলিস কী! কী হয়েছে? এখন কী অবস্থা? উনি কোথায়? তুইই বা কোথায়?
ওকে এডমিট করেছে। এখন ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে।
এইটুকু বলে অরুন্ধতী হাঁপাতে থাকে। রঞ্জু ওকে থামিয়ে দেয়।
একটু দম নে। তারপর মাথা ঠাণ্ডা করে আমাকে বল তো কী হয়েছে।
আজ সকালে বাথরুমে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। বিছানা ছেড়ে ওঠার সময় বললো, বমি বমি লাগছে। আমি ভেবেছি এসিডিটি। ভাগ্যিস বাথরুমের দরজা বন্ধ করেনি। প্রথমে বেসিনে বমির শব্দ পেলাম। তারপরই পড়ে যাওয়ার শব্দ। আমি আর তুহিন ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বিপি চেক করে দেখলাম ৮০/৫০। সাথে সাথে অ্যাম্বুলেন্স কল করে এপোলোতে। এখন ডেঙ্গু ধরা পড়েছে।
বলিস কী!
কয়েকদিন ধরে জ্বরজ্বর বলছিল। মাথাব্যথা, গায়ে ব্যথাও ছিল। এই নিয়ে হাসপাতাল, চেম্বার, অপারেশন সবই করেছে। বলেছিলাম, দু’এক দিন রেস্ট নাও না হয়। ঝাড়ি খেলাম। বলে, আমার শরীরের খবর কি তুমি বেশি জানো? তুমি কি ডাক্তার? তেমন কিছু হলে আমি নিজেই বুঝবো। আমার অবস্থাটা বোঝ! আমিও ভেবেছি হয়তো ভাইরাস হবে। সিজন চেঞ্জ হচ্ছে। চারিদিকে লোকজনের সর্দি কাশি হচ্ছে। হয়তো তেমন কিছু। সকালে বাথরুমে বমি করে যখন পড়ে গেল, ভয়ে আমার হাড় মাংস সব ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ভাবলাম, স্ট্রোক করলো কি না। ওর চাচাও এভাবেই মারা গেছে। ভয় পেলে আমার সব সময় খারাপ কিছু মাথায় আসে। আমি যে কত ভীতু সেটা তো তুই জানিস। তোকে পছন্দ করি, শুধু এই কথাটা সাহসের অভাবে বাবাকে বলতে পারলাম না।
ও সব ন্যাকামি বাদ দে। কাজের কথা বল।
ও, তোকে পছন্দ করি, এটা ন্যাকামি বলছিস? তাই তো! তুই আমার কে? তোকেই বা কেন ফোন করেছি। আমার ভুল হয়েছে। রাখছি।
ধুর গাধা! এগুলো নিয়ে পরে ঝগড়া করিস। এখন বাকিটা বল।
এপোলোর ইমার্জেন্সিতে এনে ডাক্তাররা এক্সামিন করলো, ব্লাড টেস্ট করিয়ে দেখে ডেঙ্গু। এর মধ্যে বলেছে গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। বিকেলের দিকে সারা শরীরে র্যাশ বের হয়েছে। জ্বরও অনেক বেশি। মনে হয় গা পুড়ে যাচ্ছে। এখন হাই পাওয়ারের ব্যথার অষুধ দিয়েছে। ঘুমাচ্ছে।
রাতে তুই থাকবি হাসপাতালে?
তো আর কে থাকবে? আমি কেবিন থেকে এক চুলও নড়বো না। আমার ভীষণ ভয় লাগছে রঞ্জু।
ধুর পাগল! ডেঙ্গু তো এখন তেমন কোনো রোগ না। এপোলোর স্ট্যান্ডার্ট তো খুব ভালো শুনেছি। সাহস রাখ। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি এখন অফিসে ঢুকছি। আমাকে আপডেট দিস। চিন্তা করিস না।
না রে রঞ্জু! ভয় তাড়াতে পারছি না। ডেঙ্গুতে এখনো হরদম মানুষ মারা যাচ্ছে। আচ্ছা, বলতো ওর বিপি এত লো হয়ে গেলে কেন?
আমি তো ডাক্তার না। ওদের সাথে আলাপ কর। ওরা ভালো বলতে পারবে।
এভাবে আরও আট দিন কেটে যায়। এর মধ্যে জামিলের শরীর আরও খারাপ হয়েছিল। একদিন দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তপাত হয়েছে, আরেকদিন এতটাই শ্বাসকষ্ট হয়েছে যে, অক্সিজেন দিতে হয়েছে। রক্তও দিতে হয়েছে দুই ব্যাগ। একটা অনিষ্ট চিন্তা অরুন্ধতীকে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রেখেছে। মনে হয়েছে যেকোনো সময় ওর নিজেরই প্যানিক অ্যাটাক হবে। মূর্ছা যাবে।
মন খারাপের সময় তো ওই একই নির্ভরতা। ও রঞ্জুকে ফোন করে। সর্বশেষ আপডেট দেয়। এখন অনেকটাই ভালো সেটা বলে। হয়তো কাল রিলিজ করে দেবে। বাসায় কয়েকদিন রেস্টে থাকতে বলেছে।
জানিস, আজ একটা কথা মনে হলো।
কী কথা!
আমার জীবনে এখন একটাই চাওয়া।
কী!
আমি যেন ওর আগে মরে যাই।
কেন?
ও আমার পাশে নেই, এটা আমি সইতে পারবো না। ওকে ছাড়া আমার একদিনও চলবে না।
বাহ! এত সুন্দর একটা প্রেমের কথা বলেছিস। জামিলের সাত জন্মের ভাগ্য এমন একটা প্রেমময়ী বউ তার আছে। বলেছিস তাকে? খুব খুশি হবে শুনলে। এটা তো আর মৃত্যুচিন্তা না। তুই যে তাকে কতটা ভালোবাসিস তার এক্সপ্রেশন।
রঞ্জু কথাটা বললো বটে। কিন্তু তার ভেতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেল। ফোনের অন্যপ্রান্তে অরুন্ধতী যেন তার পাণ্ডুর মুখটা দেখতে পেলো। হয়তো তার অনুভূতিটা সত্যি। কিন্তু এভাবে না বললেও হতো। পরিস্থিতি হাল্কা করতে বললো, হা হা। রাগ করেছিস? আমার বলা উচিত ছিল আমি তোদের দু’জনেরই আগে মরতে চাই। আমি দেখতে চাই তোরা আমাকে কেমন মিস করিস। আমি আসলে তোদের দু’জনের কথাই বলতে চাচ্ছিলাম।
শোন, অরুন্ধতী! আমি রাগ করিনি। তোর মনে যেটা এসেছে, সেটাই তো বলেছিস। যেটা সত্যি, সেটাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসে। ভালোই হয়েছে, রিয়্যালিটি চেক হলো। রিয়্যালিটি হচ্ছে তোর ইকোয়েশনে আমি এক্সিস্ট করি না। তাই না?
রাগ করিস না রঞ্জু। আমার মনের অবস্থা তো তুই বুঝতে পারছিস। কী একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি! এ সময় মাথা ঠিক থাকে?
যা, আর ভ্যালিডেট করতে হবে না। তুই মরলে আমার কি! তোরা কে আগে মরতে চাস, সেটা তোদের ব্যাপার।
হা হা হা—অরুন্ধতী হাসে। বলে, তুই একটা আস্ত পাগল। তুই আমার নির্ভরতা,তুই আমার আশ্রয়। তোকে আমার আগে মরতে দেবো ভেবেছিস? আমি তাহলে কোথায় যাবো?
কেন? তোকে নির্ভরতা আর আশ্রয় দিতে তো জামিল আছে। আমি তোর কে?
রঞ্জুর কথা বলতে ইচ্ছে হয় না। ও ফোন কেটে দেয়। বুকের বাম পাশে চিকন একটা ব্যথা টের পায়। শরীরে ঘামঘাম লাগছে। বারান্দা থেকে দ্রুত নিজের টেবিলে এসে বসে ফুল স্পিডে এসি ছেড়ে দেয়। এটাই কি রিয়্যালিটি চেক? অরুন্ধতীর সমীকরণে কোথাও সে নেই? কানে তখনো বাজছে হাজার হাজার কিলোমিটার দূর থেকে ইথারে ভেসে আসা হাসির শব্দ। হাসতে হাসতেই খাপ থেকে ছুরিটা বের করেছে অরুন্ধতী। বহু আগে বলা আসাদের কথা মনে পড়ে যায় রঞ্জুর।