বদরপুর গ্রামে একটাই সাঁকো, আরও সাঁকো ছিল। বাকিগুলো ছোট ছোট ব্রিজে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। শুধু আমাদের এদিকে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এখনো মুখ তুলে তাকাননি।
আমাদের বেপারি বাড়ির দিকে যেতে সেই সাঁকো পার হতে হয়। সাঁকোটা নড়বড়ে।
ওই সাঁকোতে উঠতে আমি ভয় পেতাম। আমি যখন ছোট ছিলাম আব্বা আমাকে কোলে নিয়ে সাঁকো পার হতেন। এক কোমরে আমাকে আটকে, আরেক হাতে সাঁকোটা ধরে ধরে পার হতেন। আব্বা যখন হাঁটতেন সাঁকোর বাঁশগুলো ক্যাঁচক্যাঁচ করে আওয়াজ করতো।
সাঁকো পার হলেই আব্বার দোকান। আব্বা দোকানদার, পান-বিড়ি বেচেন, সঙ্গে চা-বিস্কুটও। একটা রেডিও আছে আব্বার দোকানে। সংবাদের সময়ে সংবাদ ছাড়েন, নইলে সারাক্ষণ ওয়াজ মাহফিলের ক্যাসেট বাজে। আব্বা কোথা থেকে যেন ওয়াজ মাহফিলের ক্যাসেট জোগাড় করতেন। সারাদিন বাজতো। মানুষ আসতো, পান-বিড়ি খেতো। কেউ কেউ মনোযোগ দিয়ে ওয়াজ শুনতো। বাকিদের কথা জানি না, আব্বার ঠিকই মনোযোগ ছিল ওয়াজে।
আমার আব্বার নাম মহসিন উদ্দীন বেপারি। গ্রামের লোকে তাকে ডাকে বিড়ি বেপারি। আমার চাচার নাম মতিউর উদ্দীন বেপারি। তার মাছের ব্যবসা। লোকে তারে ডাকে জাইল্লা বেপারি।
তো, আমি হলাম বিড়ি বেপারির একমাত্র ছেলে মকলেস উদ্দীন বেপারি। আমার আগে এক বোন ছিল। সে নাকি জন্মের সময়ই মারা গিয়েছিল। তার কোনো নাম দেওয়ার দরকার হয়নি। আমার পরেও এক বোন হইছিল। বেঁচে ছিল ছয় মাস। হঠাৎ জ্বর-ঠাণ্ডায় আমার ওই বোনটা মরে গেলো। তার নাম ছিল সখিনা বেগম।
সখিনা যেদিন মারা গেলো, সেদিন আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিল। সখিনার নামের সঙ্গে বেপারি টাইটেল ছিল না কেন? এই বেপারি টাইটেল কোথা থেকে আমাদের নামে যুক্ত হলো–এই প্রশ্নের উত্তর এখনো আমার কাছে অজানা।
অনেকবার ভেবেছিলাম আব্বাকে জিজ্ঞেস করবো। সাহসে কুলায়নি। ভয় ডরে আমি আব্বার পাশে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম মনে হয় ক্লাস সিক্স না সেভেনে।
যেদিন স্কুলের মাস্টার আব্বারে বলছিলেন, আন্নের হোলাগার মাতাত বুদ্ধি আছে, বদমাইশির লাই হইড়তে হারে না। সেদিন আব্বা ঘরে এসে এমন মাইর দিলেন, এরপর থেকে আব্বার সামনে যেতেই ভয় পাই। ওই থেকে ভয় আমাকে কাবু করলো, আব্বা যেদিকে, আমি তার ত্রি-সীমানার বাইরে। আব্বা অবশ্য বুঝতেন। মাঝে মাঝে আমাকে দেখলেই কাছে ডেকে বলতেন- মকু চাই এমুই আয়।
আমি ভয়ে ভয়ে আব্বার কাছে যেতাম। আব্বার আমার হাতটা ধরে পাশে বসাতেন। তারপর জিজ্ঞেস করতেন, আইজ কিয়া হইড়লি? মাস্টর হড়ায়নি ঠিকমতো?
আমি হাত ধরতাম না। আব্বার হাতের তালু খসখসে। ভালো লাগতো না। উত্তরে আমি মাথা নাড়তাম।
আব্বা আবার জিজ্ঞেস করতেন, কথা কচ্চা কিল্লাই? মাথা লাড়াচ কা?
আমি তখন হুম হুম করতাম। মুখ দিয়ে কথা বের হতো না ভয়ে।
আব্বা ছোটবেলা থেকেই আমাকে ভোর হলে উঠিয়ে দিতেন।
ফজরের সময় ওজু করতে উঠতেন আব্বা, তখন আমাকে ডাকতেন—চিৎকার করে ডাকতেন। বলতেন, মকু উড, নামাজ হইড়বি আয়।
ছোটবেলায় আব্বার হাত ধরে রওনা দিতাম। আব্বার হাত খসখসে, বড় হতে হতে খসখসে হাত আর ধরতে ভালো লাগতো না। আব্বা চাইতেন হাত ধরতে, প্রথমে ধরতেন, তারপর আমি সুযোগ মতো ছেড়ে দিতাম। কিন্তু ক্লাস সেভেন এইটের সময়ে আব্বা ভোরে ডাকলেই বিরক্ত লাগতো। এভাবে আমি যত বড় হতে থাকলাম আব্বার গলার জোর ততই বাড়তে লাগলো। তবু আমি উঠতাম। না উঠলে আম্মাও আসতেন। আমার গালে হাত বোলাতে বোলাতে বলতেন, এর-ই উড বাজান, দেরি করিচ্চা। হেতেনে ঘরে ঢুকলে ক্যান, এমুন হিডানি দিব।
আমি বিরক্ত হয়ে উঠতাম, আসলে ভয়ে উঠতাম। জামা বদলে, আব্বার পিছু পিছু মসজিদে যেতাম। নামাজ পড়ে ঘরে এসে আবার ঘুম দিতাম।
এরপর ঘণ্টা না যাইতে আব্বা আবার চিল্লাইয়া উঠতেন, তখন আবার বলা শুরু করতেন, এ-রে তুই ইশকুলে যাতি ন?
এভাবেই সকাল থেকে আব্বার বিরক্ত চিৎকারে আমার জীবন চলতো। আব্বা বুঝতেন আমি বিরক্ত হই। তবু বিরক্ত করতেন।
আমি স্কুলে যাওয়ার সময় কিংবা আসার সময় সাঁকো পার হতাম, আব্বা গভীর মনোযোগ দিয়ে আমাকে দেখতেন। আমি পেছনে তাকাতাম না। কিন্তু বুঝতাম আব্বার গভীর নজর আমার দিকে।
আব্বার দৃষ্টি আমার কাছে বড় ভয়ঙ্কর ছিল। আমি যেখানেই যেতাম মনে হতো আব্বার ধ্যানমগ্ন লাল চোখ আমার ওপর। কোনো অপরাধ করতে গেলেও আব্বার চোখগুলো আমার মাথায় চলে আসতো, মনে হতো আব্বা দেখছেন। তাই অপরাধ করার বহু চেষ্টা করেও আমি হেরে যেতাম। যেমন, আমি যখন ক্লাস টেনের শেষে মেট্রিক পরীক্ষা দেব, তখন একদিন আমার বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিলো আজ বিড়ি টানবে। তাদের সঙ্গে দলবলে রওনা দিলাম বিড়ি টানবো বলে। স্কুল থেকে একশ হাত দূরে আমগাছ তলায় এক বিড়ি দোকানদার বসে। আমরা সেখানে গেলাম বিড়ি কিনবো। মেট্রিকের আগে আমরা বড় হতে চাইলাম। বিড়ির দোকানের সামনে গেলে আমার মধ্যে এক অনন্ত বিষাদ নেমে এলো। ওই দোকানদারকে দেখে আমি বিড়ি টানার আগ্রহ হারিয়ে বসলাম। ওই দোকানদারকে দেখে আমার আব্বার কথা মনে পড়ে গেলো। আমার আব্বাও তো বিড়ি দোকানদার। আমি বন্ধুদের থেকে দলছুট হয়ে ফেরত এলাম।
এভাবেই জীবনের কোনো প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমি বিড়ি সিগারেটে আগ্রহ পাইনি। ইচ্ছা যে জাগেনি তাতো নয়, জেগেছে, কিন্তু যখন দোকানে গিয়েছি ওই দোকানদারকে মনে হয়েছে আমার আব্বা।
আমার যেদিন মেট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো। আব্বা তার দোকানে মিষ্টি এনে রাখলেন। সেদিন তার দোকানে যারাই এসেছিল তারেই একটা মিষ্টি দিয়েছিলেন। আর বলছিলেন, আঁর হোলা মেট্রিক ফাস কইচ্চে, দোয়া কইরবেন।
আব্বার জন্য কেন যেন সেদিন হৃদয়ে এক তীব্র ভালোবাসা জন্মে উঠেছিল। মনে হয়েছিল এক বিড়ি দোকানদার আব্বা তার ছেলেরে নিয়ে বড় কোনো স্বপ্ন দেখেন। তবে কী স্বপ্ন দেখেন, তা আব্বা কখনো আমাকে ডাক দিয়ে বলেননি। আমার সেদিন আব্বার কাছে যাইতে ইচ্ছা করছিল, তার খসখসে হাতটা ধরে থাকতে ইচ্ছা করছিল। আমি পারিনি।
এরপরই আব্বা আমাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল। আমি ইন্টারে যেন ভালো পড়াশোনা করি, এজন্য ঘরে এক মাস্টারও রাখতে বললেন।
আমাকে একদিন সাঁকো পার হওয়ার সময় ডাকলেন, জিজ্ঞেস করলেন, মাইনষ্যে কয় চাইন্স কডিন? আমি মাথা নাড়াই। তিনি বলেন, একা হড়ি না হাইরলে মাস্টর রাখ ঘরে।
আমি তখনো মাথা নাড়ি। তারপর আমাদের পাশের গ্রামের ডিগ্রি পাস কুদ্দুছ ভাই আমারে পড়াইতে আসতো। মাসে ৮০০ টাকা নিতো। বুঝতাম না, আব্বা আমারে এতটাকা কেমনে দিতেন?
এক রাতে আব্বা আফসোস করে আম্মারে বলতেছিলেন, আঁর এইগগা মাত্র হোলা, ওর লাই কিছু করি দিতাম হারি নো, হড়ালেয়া করাই দিই আরি।
আমার কেন যেন সেদিন কান্না পাচ্ছিল। ইচ্ছা করছিল, আব্বার খসখসে হাতটা ধরি, পারিনি।
আমার যেদিন ইন্টারের রেজাল্ট দিলো, সেদিন আব্বা কাউরে মিষ্টি দিলেন না। সারাদিন দোকানে বসে বসে শুধু কাঁদলেন। যেই আসে জিজ্ঞেস করে, কীরে বেফারি, কান্দো কিল্লাই?
আব্বা চোখ মুছেন আর কাঁদেন।
বলেন, আঁর এইগগা হোলা। ইন্টার ফাস করি হালাইছে, এহন তো ঢাহা পাডাইতে হইবো। কেন্নে কী করি বুঝি হারি না। সুখে আর দুঃখে কান্দন আয় আরি।
আমিও জানতাম, ইন্টারের পর ঢাকা যেতে হবে। আমিও চাইতাম। আমার আব্বার এই কষ্ট ভালো লাগতো না। তবে আমি যতই শিক্ষিত হতে থাকলাম আব্বার বিড়ি বিক্রি আমার ইজ্জতে লাগতো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একদিন আমি বড় হবো আর আব্বার বিড়ি দোকানদারি বন্ধ করে দেব। আমার আব্বা বুক উঁচাইয়া এই গ্রামের পথ দিয়ে হাঁটবেন। তখন তার ইজ্জত হবে। এই ইজ্জত আমি আমার হাতে এনে দেব।
কিন্তু এখন তো আব্বার উপায় নেই। ওই বিড়ি বিক্রির টাকা দিয়াই তো আমাকে পড়তে হবে। আব্বা একদিন আমারে ডাকলেন, হাতে তিন হাজার টাকা দিলেন।
বললেন, তুঁই কাইল ঢাহা রওনা দাও। দেহ কই হইড়বা, আঁই তো বুঝিনো এগিন। ঢাহা যাইয়া চিডি দিও, টিয়া লাগলে হরে হাডাই দিয়ুম।
আমার সেদিন খুব কান্না পায়। কাঁদতে পারি না। তবে সেদিন আম্মা আমারে জড়িয়ে ধরেন। খুব কাঁদেন।
পরদিন সকালে আব্বা আর আমি এক রিকশায় উঠি। আব্বা আমার পাশে। দু’জন পাশাপাশি, যেন এক অবিরাম নিস্তব্ধতা পিতা-পুত্রের মাঝে। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলি না। অনুভব করি, আমার আব্বার চোখ বেয়ে পানি পড়ে। কিন্তু নিঃশব্দ জায়গা করে নিয়েছে আব্বার চোখ। আমার একবার ইচ্ছা হয় আব্বার খসখসে হাতটা একটু ধরি, শক্ত করে। ধরা হয় না।
আমাকে বাসে তোলেন আব্বা। দৌড়ে নিচে গিয়ে একটা চিপস কিনে নিয়ে আসেন। আমাকে দিয়া বলেন, রাস্তায় খাইয়ো। ভালো মতো হড়ালেখা কইরো, আব্বার যেন আর বিড়ি বেইচতে না অয়।
বলেই আব্বা দৌড়ে বাস থেকে নেমে যান। আমি দেখি দশ টাকার সেন্ডেল পায়ে, গায়ে কমদামি খয়েরি পাঞ্জাবি, আর ময়লা চেক লুঙ্গি, কাঁধে গামছা নিয়ে আড়াল হয়ে যান আব্বা। আব্বা সেদিন থেকে আমাকে তুমি ডাকছেন। আব্বা কি আমাকে পর করে দিলেন?
আমি মনে মনে আব্বাকে ডাকি, আব্বা, আব্বা, আব্বা…।
ইচ্ছা করে বলি, আব্বা আপনি আমার দুনিয়া। বলতে পারি না, বাস ছেড়ে দেয়, আব্বা তো আড়াল হলেন সেই কখন। তবু আমার চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। আমি পারি না।
দুই.
আমার জন্য ঢাকা এক বিরাট ডায়নোসর। এই যন্ত্রমানব শহরে আমি ক্রমেই হারিয়ে ফেলি আব্বাকে, আম্মাকে। চিঠি লিখে লিখে আব্বাকে তিন চার লাইনে বলি আমি কেমন আছি। এই শহর নিয়ে, মানুষ নিয়ে আব্বাকে খুব বেশি বলা হয় না।
আমার আব্বা পড়াশোনা জানেন না। আমি চিঠি লিখি, জানি আব্বা পড়তেও তো পারেন না। কেউ না কেউ দোকানে বসে চিঠি পড়ে শোনায়।
আব্বা কখনো আমাকে চিঠি লেখেনি। আমিই লিখতাম। যখন এসেছিলাম সপ্তাহে একবার, তারপর ধীরে ধীরে মাসে দুইটা, ধীরে ধীরে দুই মাসে একটা। এভাবে আমি আব্বা-আম্মার আড়াল হয়ে যন্ত্রমানবে রূপান্তরিত হলাম।
আগে ঈদে বাড়ি যেতাম। পরে তা এক ঈদে নেমে এলো। যখন যেতাম, আব্বা বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতেন আমার অপেক্ষায়। আমি বাস থেকে নামলে আব্বা বাচ্চাদের মতো আমার দিকে ছুটে আসতেন। মাঝে মাঝে মনে হতো আব্বা জড়িয়ে ধরতে চায়। আমিও চাইতাম, কিন্তু কেন যেন কেউ কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারতাম না।
আব্বা আমার ব্যাগটা নিতে চাইতেন। আমি দিতেই চাইতাম না। আব্বা তবু জোর করে নিতেন। তারপর দু’জন রিকশায় উঠতাম। সেই অফুরান পরিচিত নিস্তব্ধতা। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলি না।
রিকশা চলে।
ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। সেই সাঁকোর কাছে এসে রিকশা থামে। আমরা নামি। আব্বা আগে যেমন আমারে কোলে নিতেন, ঠিক তেমনি আমার ব্যাগ কোলে নিতেন। আমি আব্বার সামনে সাঁকোতে চড়ে পার হতাম।
তিন.
এভাবেই আমি শহরের প্রাণীতে রূপান্তরিত হতে থাকলাম। এই শহরে আমার টিকে থাকার যে সংগ্রাম তা আব্বাকে কোনোদিন বলা হয়নি, বললে আব্বা ভয় পেতেন, হয়তো বলতেন, চলি আয়।
তার একমাত্র ছেলেকে মাত্র তিন হাজার টাকা দিয়ে ঢাকা পার করে দিয়েছেন, এই তো অনেক। এই শহরের চাকচিক্যে আমি প্যান্ট-শার্ট পরা এক রঙিন যুবকে ক্রমেই পরিণত হয়ে গেলাম। টিউশনি করে কম দামি এক মোবাইল নামক যন্ত্র প্যান্টের পকেটে ঢোকালাম। কী বিস্ময় সে যন্ত্র আমার কাছে। ওই ফোনে আব্বার সঙ্গে কথা হওয়া শুরু হলো।
আমাদের কুদ্দুছ ভাই প্রতিদিন বিকালে আব্বার দোকানে যেতো। আমাকে মিসকল দিলে আমি ফোন দিতাম। কথা হতো আব্বার সঙ্গে। বেশি কথা বলতে পারতেন না আব্বা। আমি সালাম দিতাম, আব্বা সালামের উত্তর দিতেন। আমার পড়াশোনা ঠিকঠাক চলে কি না, জিজ্ঞেস করতেন।
আব্বার কণ্ঠ ভারী হয়ে আসতো, আমারও চোখে জল জমে যেতো, দ্রুত রেখে দিতাম। ভালো লাগতো না। আমার কঠিন আব্বাকে দুর্বল দেখতে ভালো লাগতো না। আমি চাইতাম আব্বাকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ হিসেবে দেখতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে চরকির মতো ঘুরে ঘুরে একটা চাকরি জোগাড় করে নিলাম। মাস দুয়েক যাওয়ার পর ভাবছিলাম আরও কিছুদিন পর আব্বাকে বলবো, বিড়ির দোকানটা বন্ধ করে দেন আব্বা। চাইলে ঢাকা চলে আসেন। বিশ্রাম নেন।
চার.
আমি এখন বাসে, একটু পর কচুয়া বাসস্ট্যান্ড নামবো। বাড়ি যাবো। যেখানে আমার আব্বার জীবন কেটেছে এক স্বপ্নভরা হৃদয়ে।
এসব চিন্তা করতে করতেই বাস থামে। আমি বাস থেকে নামি। মনে হয় একটা হাত আমার ব্যাগটা নিতে এগিয়ে আসবে, আমি দেব না। কিন্তু কেউ সেই ব্যাগ নিতে আসে না। আমি একটা রিকশা ডাকি, রিকশায় উঠি। দুই ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে পাকা রাস্তায় রিকশা চলে।
রিকশা চলার ক্যাঁচক্যাঁচ একটা শব্দ হয়, মনে হয় ওই নিস্তব্ধতা ভেদ করতে চায় সে। মনে হয় পাশে আমার আব্বা বসে আছেন। যেভাবে এক নিস্তব্ধ নীরবতার মায়ায় দু’জন এই ক্ষেতের মাঝ দিয়ে আগেও গিয়েছি। আব্বার বন্ধ থাকা বিড়ির দোকানের সামনে রিকশা পৌঁছায়, সুনসান নীরবতা সেখানে। সাঁকোটিও তো এখন আর নেই। ছোট্ট একটা ব্রিজ তৈরি করে দিয়েছে গ্রামের চেয়ারম্যান।
বাড়ির দিকে এগোয়।
উঠানে একটা কাঠের চৌকিতে সাদা ধবধবে কাপড়ে জড়িয়ে শুয়ে আছেন আব্বা। আমি কেন যেন তখনো চিৎকার করতে পারি না।
সাদা কাপড় থেকে আব্বার হাতটা খোঁজার চেষ্টা করি। আব্বার দীর্ঘ জীবন সংগ্রামের পরিণতি ওই খসখসে হাত। হাতটা ধরি। কী ঠাণ্ডা! যেন বরফে মুড়িয়ে ছিল। আমার খুব ইচ্ছা হয় আব্বার হাতের তালুটা আবার ধরে দেখতে। মৃত্যুর পরও কি খসখসে থাকে? এই প্রথম আব্বা আমার হাতটা শক্ত করে ধরলেন না। অথচ আমি ধরে রাখতে চাই কিন্তু আব্বা ধরেন না। যেভাবে আগে আমি আব্বার হাত ছাড়িয়ে নিতাস সুযোগ বুঝে। সেভাবে আব্বাও ছাড়িয়ে নেন। আমার হাতও কি তাহলে আব্বার মতো খসখসে হয়ে উঠলো?