আশ্বিনের শেষ দিন। পড়ন্ত দুপুর থেকেই চৌধুরী বাড়িতে ব্যস্ততার শুরু। ততক্ষণে গাছ থেকে নারকেল পেড়ে বাড়ি বাড়ি ভাগ বাটোয়ারা শেষ। গোটা বিশেক পরিবারের এই বাড়িতে সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ মানুষটি প্রিয়ব্রত চৌধুরী। বাইরের বারান্দায় পলকহীন সামনের দিকে তাকিয়ে তিনি কী খোঁজেন, বোঝা দায়। ছোট ছেলেরা উঠোনে সাতচাড়া খেলায় ব্যস্ত। কন্যারা দল বেঁধে কলাপাতা, জবা ফুলোর কলি।, পাটখড়ি, তেলাকুচা পাতা জোগাড় করতে পুরো বাড়ি দাপিয়ে বেড়ায়। আমগুরুজেের লতা তাদের কারও চোখে পড়ে না। বিমলা আর নবীনাকে পাশেই মুন্সী বাড়িতে পাঠানো হয় আমগুরুজের লতার জন্য। তাদের সঙ্গে ছেলেদের মধ্যে নিলুকে সঙ্গে যেতে বলেন, সে ক্ষেপে ওঠে, দেখতাছো না খেলতাছি, যাইতে পারুম না। মুখে একরাশ বিরক্তি।
—আমার সোনা ভাই! দিদিরা কি মুন্সীগো বাড়ি একা যাইবো। তুই না ভাই! যা না একটু দিদিগো লগে। এই তো যাইবি আর আইবি, আইসা আবার খেলিস।
সুহাসিনী দিদির কথার অবাধ্য হবে নিলু, তা কি হয়! দিদি যে চৌধুরী বাড়ির সবার বড় আদরের।
উত্তর দিকের ভেতর বাড়ি থেকে কমলা রানী হাঁক দিতে দিতে হাতে একটি থালা নিয়ে উঠোনের দিকে আসেন। ছেলেরা মুহূর্তে খেলা ভুলে দৌড় লাগায় সেদিকে। আরে বাপুরা, তোগো হগলডির গতরে যে বালি। হাতটা ধুইয়া আয়।—হাসিমুখে বলেন কমলা রানী। কে শোনে কার কথা! জেঠিমা, আমারে দাও! না আগে আমারে। হুটোপুটি লাগায় শিশুরা। আরে বাবারা হক্কলে পাবি—মৃদু ধমক দেন কমলা রানী। হুড়োহুড়ি করে গরম গরম নারকেলের নাড়ু পটাপট মুখে দিতেই তাদের কানে আসে দোতারা আর ভাঙা গলার গানের সুর। ছেলেরা দৌড় দেয় দক্ষিণের পথে।
সচিকান্ত সুধারাম প্রতি গাস্বি উৎসবে আশ্বিনের এ দিনে এ বাড়ি ও বাড়ির উঠোনে উঠোনে তার পুরোনা দোতারাটা নিয়ে গান শোনায় আর অফলা গাছে ফল ফলানোর অভিনয় করে। দক্ষিণের পথ ধরে সচিকান্ত চৌধুরী বাড়ি এসে তার অভিনয় শেষ করে এবারের মতো। সচিকান্ত বলে, শেষ ভালা যার, সব ভালা তার। তাকে ঘিরে থাকা ছেলেপুলের দল মাথা দোলাতে দোলাতে বাড়ির বড় উঠোনে সমবেত হয়। সচিকান্ত ভাঙা গলায় গেয়ে যায়, আশ্বিনে রান্ধে-বাড়ে কার্ত্তিকে খায় যেই বর মাগে সেই বর পায়…সচিকান্তের গলা শুনে বাড়ির ভেতরের লোকজনও উঠোনে জড়ো হতে থাকে। মুড়ির মোয়া, নারকেলের নাড়ু বানাতে ব্যস্ত বউঝিরা ক্ষণিকের জন্য কাজ রেখে জড়ো হয় বাড়ির বাইরের বারান্দায়। সচিকান্তের সঙ্গে অভিনয়ে যোগ দেয় বাড়ির কয়েকটি ছেলে। মাটি খোঁড়া হয়। মাটি থেকে বেরিয়ে আসে এক দৈত্য। সে দৈত্য ফসল নষ্ট করে। সবাই হাত জোড় করে প্রার্থনা করে প্রকৃতি মা যেন দৈত্যের কাছ থেকে ফসল রক্ষা করে। মাগো, আমগোরে আশির্বাদ করো, সংগ্রামে দাও শক্তি। হত্যা করা হয় দৈত্যকে। সচিকান্তের জন্য বাড়ির ভেতর থেকে ততক্ষণে কাঁসার থালায় নারকেলের নাড়ু, কলা আর মুড়ির মোয়া আসে। খাবার শেষ হলে শূন্য থালা ভরে যায় পাঁচ,দশ, বিশ টাকার নোটে।
সন্ধ্যে হতে আর বেশি দেরি নেই। হরিহর মুদির হাতভর্তি সওদাপাতি। কই গো বাড়ির লোকজন। তোমগো বাজার লইয়া আইছি। হাঁক শুনে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে সুহাসিনী। এই ধরো, তোমগো লিস্টি মতন কাঁচা হলুদ, শুন্দি আর সরষেয়র তেল। আর এই লও, ছয় টাকা ফেঁরত আইছে। আরও দুই বাড়িত জিনিস পৌঁছাইয়া দেওন লাগবো। সাঁঝ হইয়া আইলো, রাইতে তো আমি আবার যারে কয় রাইত কানা। আমার আরও ম্যালা কাম পইড়া আছে।এ টাকা কয়ডা তুমি রাইক্কা দাও মামা।—নরম গলায় বলে সুহাসিনী।
—নমস্কার জেঠা। প্রিয়ব্রত চৌধুরীকে লম্বা প্রণাম দিয়ে বেরিয়ে যায় হরিহর। দাদু সাঁঝ হইয়া আইছে, ভেতরে চলো। দাদুকে ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায় সুহাসিনী। কথা বলেন না প্রিয়ব্রত চৌধুরী। তার কী এক রোগ। অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছে। মুখের কথা আর ফেরেনি।
ননীবালা দেবী হাঁড়ির প্রথম খাবারটা খেতে দেন তাদের। ভাতের সঙ্গে সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হয় নারকেলের নাড়ু, কলা, টুকরো করা নারকেল।
কৃষ্ণপক্ষের এ সময়ে সূর্যটা ঝুপ করে হারিয়ে যায়, ঘন কালো অন্ধকার নেমে আসে। বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয় অশ্বিনী কুমারের ব্রতের রান্না। ননীবালা দেবী বরাবর পাঁচ পোয়া ওজনের চাল রান্নার জন্য চুলোয় বসান। বাড়ির হেঁসেল থেকে চিকন চালে রান্না করা ভাতের মিষ্টি ঘ্রাণ মাটির ঘরের দেয়াল ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে উঠোনে। ভাত রান্নার পর তিনি কলাপাতায় মুড়িয়ে রাখেন কড়াইয়ের মুখ। এক কাম কর রে মা, আর দুইডা কলাপাতা ছিইড়া লইয়া আয়। এই কলা পাতা দিয়া হাঁড়ির মুখ বাঁধন যাইবো না। ব্যাস্ত কণ্ঠে বলেন ননীবালা। সুহাসিনী চট করে কুপিবাতি জ্বালায়। কলাপাতা কাটার জন্য ছুরি আর কুপিবাতি নিয়ে বের হয় অন্ধকারে, পুকুরের ওপারে। কলাপাতা নিয়ে ফেরার সময় বাতিতে হাওয়া লাগে জোর। নিভে যায় বাতি। ভয় পাইয়ো না, আমি তিলক। ভয় পামু না! এমন ঘুটঘুইট্টা আন্ধার রাইতে কেউ এমুন করে! শহর থেইকা কখন আইছ?—সুহাসিনীর কণ্ঠে ঝাঁজ।
—এই তো এইমাত্র, বাড়ির দিকে ঢুকতাছিলাম, দ্যাখলাম তুমি বাত্তি লইয়া এই দিকেই আসতাছ। তাই তোমারে দেইখ্যা পিছু নিলাম। পিছু নিছ কেন? বেবাক শেষ হওনের পর এখন এত পিরিত দেখাইয়া হইব কী? যখন কওনের আছিল, আমি সুহাসিনীরে বিয়া করতে চাই, তখন কইতে পারো নাই, আইজ বিধবা মাইয়ার পিছু লইয়া কী হইবো? তোমার পরিবার কি মাইন্না নিবো?
—সুহাসিনী আমার ভুলের লাইগ্যা আইজ তোমার জীবনডা শেষ হইয়া যাইতাছে, আমারে আরেকটা বার সুযোগ দ্যাতও।
—তিলক, তোমার মুখের পানেই তাকাইয়া আছিলাম। তখন কিচ্ছু করতে পারো নাই তুমি। মা চুলায় ভাতের রান্না বসাইছে। যাইতে দাও। পথ ছাড়ো।
সুহাসিনীর আবছা ছায়া তিলকের পাশ দিয়ে চলে যেতেই তাকে কাছে টানতে চায় তিলক। সুহাসিনী নিজেকে যত ছাড়িয়ে নিতে চায় দূরত্ব কমে আসে তত। হাসু, অশ্বিনী কুমারের কাছে বর মাগুম তুমি যেন আমার হইয়া যাও—ধরা গলায় বলে তিলক।
—এখন ছাড়ো তো! তিলককে আলতো হাতে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত ছুট লাগায় সুহাসিনী। রাতে স্নানের জন্য তেলাকুচার পাতা, আমগুরুজের লতা, হলুদ আর পানপাতা বাটা শুরু হয়।
ভোরের আলো তখনো পরিষ্কার হয়নি। বাড়ির পুরুষ ও ছেলেরা স্নানের জন্য পুকুর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। আশ্বিনের ভোরে ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীর শির শির করে। ছেলেরা গায়ে হলুদ বাটা মেখে একে একে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুকুরে। পুরুষেরা কোনো রকমে দুয়েকটা ডুব দিয়ে উঠলেই বাঁচে। বাড়ির উঠোতে গর্ত করে ধানের চারা পুঁতে রাখে। ব্রাহ্মণ নলিনী চক্রবর্তী এসেই হাঁকডাক শুরু করেন, আপনাগো আয়োজন এখনো হইলো না। ম্যালা বাড়ির পূজা পইড়া আছে। আগামী বছর থেইক্যা এ বাড়িতে আর প্রথম পূজা করুম না। বড় দেরি করে এ বাড়ির লোকজন।—ব্রাহ্মণের ব্যূস্তসমস্ত কণ্ঠে বিরক্তি উপচায়। কচি ধানগাছে কাঁচা হলুদ, শুন্দি আর সরিষা একসাথে মাখিয়ে দেওয়া হয়। পূজার সময় বাড়ির সবাই সমবেত হয়। করজোড়ে প্রার্থনা জানায় ভালো ফলনের। ননীবালা দেবী সুহাসিনীর ওপর বিরক্ত খুব। গতরাতে সুহাসিনী ঋতুবতী হওয়ায় উৎসবের কোনো কাজে সে আর মাকে সাহায্য করতে পারছে না। ননীবালা দেবীকে একা একা সামলাতে হচ্ছে সব। বিরক্তি তে মনে মনে গজগজ করেন তিনি। পূজা শেষ হলে ব্রাহ্মণ নলিনী চক্রবর্তী দক্ষিণা নিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে পড়েন। আজ তার জিরোনোর সময় নেই। বাড়িতে বাড়িতে শুরু হবে অশ্বিনী কুমারের ব্রতের ভাত খাওয়া। ননীবালা দেবী ভাতের কড়াই থেকে কলা পাতার বাঁধন খোলেন। একসঙ্গে খেতে বসেন প্রিয়ব্রত চৌধুরী, স্বামী পরিমল আর সুহাসিনীর ছোট ভাই বিমল। ননীবালা দেবী হাঁড়ির প্রথম খাবারটা খেতে দেন তাদের। ভাতের সঙ্গে সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হয় নারকেলের নাড়ু, কলা, টুকরো করা নারকেল।
খাওয়া শেষ হলে বিমলকে ননীবালা দেবী তাড়া দেন মুন্সী বাড়িতে খাবার নিতে। বলেন, তোর তিলক দাদাকে দেখলে ব্রতের ভাত খাইতে আইতে কইস।
সকাল গড়িয়ে যেতেই জয়নাল, দিদার, কোহিনুর, রোকসানা দল বেঁধে আসে চৌধুরী বাড়ি। এখানকার একেকটি ঘরে বন্ধুদের আমন্ত্রণে তারা আনন্দে মেতে ওঠে গাস্বি উৎসবের খাবার নিয়ে। সুহাসিনী, শিউলি, কোহিনুর ছোটবেলার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। গাস্বি উৎসবে ব্রতের ভাত খাওয়া উপলক্ষে শিউলী স্বামীসহ এখন বাপের বাড়ি। চার মাসের পোয়াতি সে। কোহিনুর ব্রতের ভাত খেতে খেতে শিউলিকে জিজ্ঞেস করে, কী রে, ব্রতের ভাত খাওনের সময় কী বর চাইলি?
শিউলির উত্তরের অপেক্ষা না করে অন্য বান্ধবীরা বলে ওঠে, কী আর বর চাইবো? বুঝোস না বুঝি, একখান সোনার টুকরা পোলা চাই গো, পোলা! বলে হেসে লুটোপুটি খায় সবাই। শিউলির মুখে হঠাৎ আলোর ছটা।
দুপুরের দিকে কোকিলের কণ্ঠে বাজে মন খারাপের সুর। গাছের কোনো ডালে পাখিগুলোর স্থিরতা নেই। হৈমন্তিকার মাঠে আজ থেকে তিনদিনের মেলা। সুহাসিনী মেলায় যাবার জন্য বাবার অনুমতি নেয়। বিমল সঙ্গে যাবে, সন্ধের মধ্যেই বাড়ি ফিরবে তারা। দু’ভাই-বোন বাড়ি থেকে বের হতে বড্ড দেরি করে। ননীবালা দেবী নিষেধ করেন, বেলা পইড়া গেছে, মেলায় আর যাওন লাগবো না। তোগো বাপে রাগ করবো।
শেষবারের মতো তিলকের কথাগুলো কানে বাজে সুহাসিনীর, যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসে, হাসু, অশ্বিনী কুমারের কাছে বর মাগুম, তুমি যেন আমার হইয়া যাও।
সুহাসিনী মাকে বোঝায়, এত চিন্তা কইরো না তো, যামু আর ফেরত আমু। দিন শেষে ক্লান্ত মহিষপাল সারা শরীরে কাদা নিয়ে ধীর পায়ে ফিরে যাচ্ছে অমসৃণ পথ বেয়ে। সেদিকে তাকিয়ে মন কেমন করে সুহাসিনীর। সেটা কাটাতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, বিমল, জোরে পা চালা। তাড়াতাড়ি যাই চল! আজ সুহাসিনীর পরনে হালকা লাল পাড়ের শাড়ি। কপালে ছোট্ট টিপ। ভালো করে খেয়াল না করলে চোখে পড়ে না। বাড়ি থেকে প্রায় মাইল খানেক ভ্যানে এবং বাকিটা পায়ে হেঁটে তারা পৌঁছায় হৈমন্তিকার মাঠে। পশ্চিমের লালচে আকাশ ধূসর তখন। মেলা সুহাসিনীকে টানে না। অনেক দূর পর্যন্ত কিছু একটা খোঁজে সে। দিদি,আমি সার্কাস দেখুম।—বায়না জোড়ে বিমল।
—আইজ না রে ভাই। দেরী হইয়া যাইবো। প্রবোধ দেয় সুহাসিনী।
—তাইলে নাগরদোলা চড়াও। পোলাডা বড্ড জ্বালায়! হুন কাইল আবার আমু। আইজ তাড়াতাড়ি ফিরন লাগবো। নাছোড়বান্দা বিমলের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় সুহাসিনী।
বাড়ি ফেরার চিন্তা মাথায় অনবরত ঘাই মারে তার। বিমলের মন খারাপ। তার কিশোর মন মেলার মনভোলানো আয়োজনে চঞ্চল হয়ে ওঠে ভীষণ। বিন্নি ধানের খই দেখে বিমলের হাত ধরে দাঁড়ায় সুহাসিনী—ভাই, অই দেখ খই, মার বড় পছন্দের। বলেই সেদিকে এগোয় সুহাসিনী।
দিদির কথা বিমলের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। দারুণ গোলাপি রঙা হাওয়াই মিঠাইয়ে চোখ আটকে যায় তার, মন্ত্রমুগ্ধের মতো দিদির হাত ছাড়িয়ে সেদিকে এগোয়। ভিড়ের ভেতর মিশে যায় পলকে। খই কেনার ব্যরস্ততায় সেদিকে খেয়াল করে না সুহাসিনী। খইঅলাকে টাকা মিটিয়ে বিমলকে পাশে না দেখে চমকে ওঠে সে, পাগলের মতো খোঁজে। নেই। এত ভিড়ের মধ্যে কোথাও চোখে পড়ে না তাকে। সন্ধ্যাে গড়িয়ে যায়। সার্কাস, নাগরদোলা, সবজায়গায় তন্ন তন্ন করে খোঁজে আবার। কোথাও দেখা নেই বিমলের। এদিকে রাত নামছে দ্রুত, অন্ধকার ঘন হচ্ছে ক্রমশ। উপায়ন্তর না পেয়ে সুহাসিনী একাই মেলা থেকে বের হয় অগত্যা্। কষ্টে কান্না চেপে এগোয় সামনের দিকে। দ্রুত উঠে পড়ে বড়ইতলী গ্রামের দিকে যাওয়ার ভ্যানে। শান্তির বাজার পর্যন্ত এলে ভ্যান আর সামনে এগোয় না। সরু কাঁচা রাস্তার ওপর একটি ট্রাক চাকা ভেঙে কাৎ হয়ে আছে। হেঁটে যেতে হবে বাকি পথ। একই পথে আরও একজনকে যেতে দেখে সুহাসিনী মনে ভরসা পায়। মিনিট পাঁচেক পর লোকটি ডানের পথে মিলিয়ে যায় হঠাৎ। সুহাসিনী জোরে পা চালায় আর বিমলের হঠাৎ অদৃশ্য হওয়ার কথা ভাবে। বাড়িতে না জানি কী মহাকাণ্ড ঘটবে আজ। ভেবেই তার বুক শুকিয়ে আসে, কান্না পায়। ভাই ঠিক বাড়ি চলে গেছে এতক্ষণে আমাকে খুঁজে না পেয়ে, বিড়বিড় করে কথাগুলো নিজেকেই নিজে শোনায় সুহাসিনী, সান্ত্বনা পেতে চায়। এই ঘুটঘুটে অন্ধকার পথে দিশেহারা লাগে তার, সেইসঙ্গে বিমলের চিন্তা তাকে অস্থির করে তোলে। অন্ধের মতো সামনের দিকে এগোতে থাকে সে। আরেকটু এগোতেই মানুষের কণ্ঠস্বর কানে আসে। কিছুটা সাহস পায় মনে। ছোট একটি কালভার্টের ওপর পা রাখে সুহাসিনী। নিজের শরীরের ভার বোঝা মনে হয় নিজের কাছেই। পথ যেন শেষ হতে চায় না আর। কালভার্টটা পেরিয়ে মাটির রাস্তায় পা পড়তেই সে বুঝতে পারে কণ্ঠস্বরগুলো ক্রমশ নীরব হয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। কিছু বোঝার আগেই তাকে জাপটে ধরে অনেক হাত। বিন্নি ধানের খই মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে মাটিতে, তাকালেই যেন ফুটে থাকে সাদা সাদা ফুল । চিৎকার আর নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টায় শরীরের সবটুকু শক্তি শৃঙ্খলিত হয় সুহাসিনীর।
অদেখা, জান্তব মুখগুলো তাকে রাস্তা থেকে দূরে, দিঘির পাড়ের পুরোনো ঝোপের ভেতর নিয়ে যায়। সুহাসিনীর শরীরে আদিম ভোগের খেলায় মাতে, অবশেষে তৃপ্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে থাকা সুহাসিনীর শরীর শেষবারের মতো ম্যাচের আলোয় দেখে বহুদিনের তৃষ্ণা মিটিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় পলকে, যাবার আগে মুখ মুছে নেয় তাারই শাড়ির আঁচলে। অবশ, চেতনাহী ন পড়ে থাকে সুহাসিনী। অবচেতন মনে স্মৃতি বিলি কাটে, তাকে নিয়ে যায় বিয়ের ছয় মাসের মাথায় স্বামীর নিথর শরীর চিতায় তুলে দেওয়ার মুহূর্তটুকুতে। তার মনে হয় কোথাও ঝড় উঠেছে ভীষণ, ঘৃণা আর ক্ষোভের তীব্র তোলপাড়ে ডুবে যাচ্ছে তার বোধের পারদ। চোখের কোণ বেয়ে নামা গরম জলের ধারায় শুকনো মাটি ভিজে ওঠে অনেকটা। মাটিতে লেপ্টে থাকে ছোপ ছোপ রক্ত। শেষবারের মতো তিলকের কথাগুলো কানে বাজে সুহাসিনীর, যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসে, হাসু, অশ্বিনী কুমারের কাছে বর মাগুম, তুমি যেন আমার হইয়া যাও।