গল্পের কথা
সালটা সম্ভবত ২০১৪ তখন। টঙ্গীর বাসা আর স্কুলের চাকরি ছেড়ে ঢাকার মিরপুরে চলে এসেছি। এরমধ্যেই একটা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’ বলে পুরোপুরি বেকার হয়ে তীব্র ডিপ্রেশনে ডুবে গেছি। অয়নকে সময় দেওয়া, পড়া আর লেখা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই তখন। প্রতিদিন বিকেল হলে আমি অয়নকে নিয়ে বের হই, উদ্দেশ্যহীন হাঁটি, রিকশায় ঘুরি। একসময় বিরক্তি আসে তাতেও। রুটিন পাল্টে বাসার কয়েকগজ দূরে শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে যাওয়া শুরু করলাম হঠাৎ।
প্রায়শই ওখানে যাই, সারাবিকেল শওকত ওসমানের কবরের পাশে ঝিম ধরে বসে থাকি, সন্ধ্যায় ফিরি। অয়ন বিরক্ত করলে তাকে হাবিজাবি খেলনা কিনে দেই। মাঝে মাঝে ঝালমুড়ি বা বাদাম কিনে দেই। তেমনি একদিন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় অয়নের রিমোট কন্ট্রোল প্লেনটা নিয়ে বের হলাম।
উদ্দেশ্য অয়নকে ব্যস্ত রেখে আপনমনে সময়টা কাটানো। সেদিন গিয়ে দেখি, কোনো এক বীরশ্রেষ্ঠের জন্মদিন সেদিন। ওদিকটায় কাঙালিভোজের আয়োজন চলছে। পাঞ্জাবি, পাজামা আর টুপি পরা অনেক বাচ্চাদের ভিড়, কোনো মাদ্রাসা থেকে এসেছে তারা। আমি ওদিকে না গিয়ে উল্টোদিকের খোলা জায়গাটাতে বসলাম। যথারীতি অয়ন তার প্লেন নিয়ে ব্যস্ত। আমি বসে তার দিকে নজর রাখছি।
হঠাৎ খেয়াল করলাম ছোট্ট একটা বাচ্চা, পাজামা-পাঞ্জাবি আর টুপি পরা, একা, একটু দূরে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগে অয়নের প্লেন উড়ানো দেখছে আর নিজের মনে বিড়বিড় করছে। তারপর অনেকদিন দৃশ্যটা মনের ভেতর নিয়ে ঘুরেছি। ফেরার সময় আমাদের পেছন পেছন ছেলেটার সেই ভীরু, ত্রস্তপায়ে ছুটে আসা আর প্লেনটার দাম জিগ্যেস করার সেই করুণ ভঙ্গিটা আমাকে অনেক রাত নির্ঘুম রেখেছে। তারপর একদিন লিখতে বসেছি, লিখেছি। জানি না কতটা পেরেছি অথবা পারিনি।
কয়েকটি কুকুর বেড়াল ও এক মানবশিশু ॥ শিল্পী নাজনীন
কী আচানক কথা! কেমন সাঁই সাঁই ঘুরছে ওপরের দুটো পাখনা! শব্দ উঠছে ভন ভন ভন! চকচকে রুপালি শরীরে মাখা গাঢ় খয়েরি রঙটা চোখে এক অদ্ভুত ধাঁধা তৈরি করে দেয় রুবেলের। সে অবাক চোখে ঊর্ধ্বে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে একই সঙ্গে ভাসে ঈর্ষা, হতাশা, লোভ, বিস্ময় আর আনন্দ! বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক কষ্ট আর শিহরণ নিয়ে সে তাকিয়ে থাকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়ানো তারই বয়সী ছেলেটির হাতের মুঠোয় ধরে রাখা রিমোট আর সে রিমোটের নির্দেশে বেশ ক’ফিট ওপরে সাঁই সাঁই সাঁই করে অভিজাত, আহ্লাদি শব্দ তুলে উড়তে থাকা খেলনা হেলিকপ্টারটির দিকে। অবাক বিস্ময়ে সে দেখে কী অবলীলায়, অনায়াস ভঙ্গিতে ছেলেটি তার রিমোটটি চালনা করে আর তার নির্দেশে কপ্টারটিও কেমন লক্ষ্মী, বাধ্য ছেলের মত ছন্দ তুলে ঘুরে চলে বন বন বন! সামনে দাঁড়ানো ছেলেটিকে কোনো জাদুকর মনে হয় তার, কপ্টারটি যেন আস্ত এক জাদুর কৌটো! রুপালি আর খয়েরি রঙের মিশেলে তৈরি কপ্টারটিতে ঘূর্ণন তৈরি হওয়ায় রুবেলের মাথার মধ্যেও যেন অমনি করে ঘুরতে থাকে হঠাৎ। সে ভুলে যায় অদূরে তার সঙ্গীদের ভোজ সারা হতে চলল প্রায়, যে ভোজের প্রতীক্ষায় সে উন্মুখ হয়ে কাটিয়ে দিয়েছে পুরো একটি সপ্তাহ।
রুবেল মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, মোহগ্রস্ত হয়ে চেয়ে থাকে। তার মন থেকে মুছে যায় সকল দুঃখ ও হতাশা, বেদনা ও শোক। সে অবাক বিস্ময়ে দেখে অল্প দূরে দাঁড়ানো তারই বয়সী ছেলেটির হাতে থাকা রিমোট আর তার মাথার ওপর দারুণ গতিময় ছন্দে ঘুরতে থাকা হেলিকপ্টারটি। তার দুচোখে এক অনির্বচনীয় ঘোর এসে হামাগুড়ি দেয়, অপার্থিব স্বপ্ন এসে লুটোপুটি খায়, রঙিন এক আশার প্রজাপতি এসে দারুণ খুশিতে দোলে।
গত এক সপ্তাহ রুবেল পথ চেয়ে ছিল আজকের এই বিকেলটির জন্য। যেমন অন্য সময়গুলোতেও থাকে। সে মাদ্রাসায় পড়ে। দ্বিতীয় শ্রেণী। প্রায় প্রত্যেক শুক্রবার তাদের মাদ্রাসার ছেলেদের দাওয়াত থাকে কোনো না কোনো মিলাদে বা মাহফিলে, কিংবা কোনো কাঙালি ভোজের অনুষ্ঠানে। সপ্তাহে পেটপুরে খাওয়া বলতে ওই একদিনই। ভালো খাওয়া বলতেও। আগে সে থাকতো গ্রামে। সেখানকার স্কুলে পড়েছে প্রথম শ্রেণী অবদি। হঠাৎ তার বাবা বিয়ে করেছে আরেকটা। মা, ছোট বোন মৌসুমি আর তাকে বের করে দিয়েছে বাড়ি থেকে। কিছুদিন এদিক-ওদিক ভেসে, মা তাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে এসে পড়েছেন রাজধানী শহর ঢাকায়। মা এখন বাসায় বাসায় কাজ করেন। রুবেলকে দিয়েছেন মাদ্রাসায়। সেখানে থাকার ব্যবস্থা আছে। সেখানে সে ছিলও বেশ কিছুদিন। কিন্তু মাদ্রাসার এক শিক্ষক রাতে তাকে ত্যক্ত করতো খুব। মুখ বুঁজে বেশ কদিন সে সহ্য করেছে সেসব। পরে চলে এসেছে। মা তার পিঠে চ্যালাকাঠ ভেঙেছেন বেশ ক’ বার। তা-ও সে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিয়েছে। তার পরিষ্কার কথা, সে মাদ্রাসায় পড়বে কিন্তু থাকবে না সেখানে। না খেয়ে থাকবে, তবু বাসায় মার সঙ্গেই থাকবে। ক্লান্ত, বিরক্ত হয়ে মা শেষে মেনে নিয়েছে তার আবদার।
মা থাকেন বস্তির একচালা একটা ঘরে। একটু বৃষ্টি হলেই এক হাঁটু জল জমে যায়। নোংরা আর দুর্গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে। ঠিকমতো খাবার জোটে না তিন বেলা। তবু তাই সই। রুবেলের খুব আপত্তি নেই তাতে। মাঝে মাঝে সময় পেলে সে বস্তির অদূরে ডাঁই করে রাখা প্রতিদিনের ফেলে যাওয়া ময়লা ঘাঁটে। তার ভেতর থেকে খুঁজে খুঁজে বের করে কাগজ, পলিথিন, টুকরো ধাতব পদার্থ, কাঁচের বোতল, এরকম আরও আরও ফেলে দেওয়া বর্জ্য। সেগুলো সে বিক্রি করে বস্তির এক ভাঙড়ির দোকানে। যা টাকা পায়, তা দিয়ে সে মাঝে মাঝে ছোটবোন মৌসুমির জন্য টিপ, চুলের ক্লিপ বা ঠোঁটে মাখার লিপস্টিক কেনে। মায়ের কাছে সেজন্য খায় বেদম মার। বেশিরভাগ সময় সে তাই কোনো খাবার জিনিস কেনে আজকাল। মা কাজে গেলে দুই ভাই-বোন চুপি চুপি খেয়ে ফেলে। মা আর টের পায় না কিছু।
কোনো আঠা শক্ত করে আটকে রাখে তার চোখদুটিকে ওই খেলনাটির ধাতব শরীরে, কেন্দ্রীভূত করে রাখে তার সমস্ত বোধ ওই খেলনাটির দিকে। সম্মোহিত, আচ্ছন্ন হয়ে সে চেয়ে থাকে, চেয়েই থাকে।
গ্রাম থেকে দুম করে শহরে এসে প্রথম প্রথম বড় ধন্দে পড়েছিল সে। বড় আজব লাগতো সব। মানুষগুলো সব যেন কেমন। কেউ কারও কথা শোনে না। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না অকারণে। তারা যে বস্তিতে থাকে, সেখানে শুধু ঝগড়া ফ্যাসাদ আর মারামারি। সে অবাক হয়ে দেখে তার মা বেশ কদিনেই মানিয়ে নিয়েছে সেখানে। কেমন সামান্য কারণেই পাশের নারীদের সঙ্গে গলা ফুলিয়ে ঝগড়া করে, খিস্তিও! শুধু সে কোনো খারাপ কথা বললে, কিংবা মৌসুমি কোনো খারাপ গালি শিখলেই মা মেরে তক্তা বানিয়ে ছাড়ে। ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত লাগে তার। যেটা মা বলছে, সে কথাই সে বললে কেন অমন তেড়ে আসে মা, তার মাথায় ঢোকে না কিছুতেই। তারা বস্তিতে উঠেছে প্রায় একবছর। এই একবছরে অনেক কিছু শিখেছে সে। জেনেছে, দেখেছেও। বস্তিতে এমন অনেক কিছু ঘটে যা খারাপ, খুব খারাপ, সে টের পায়। তার শিশুমন সে সেসব কল্পনা করে ভারি অবাক হয়ে যায়। বড়রা অনেক খারাপ, অনেক অনেক খারাপ, রায় দেয় সে বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে। তার ইচ্ছে সে বড় হলে কিছুতেই মা আর মৌসুমিকে বস্তির এই খারাপ লোকগুলোর সঙ্গে থাকতে দেবে না, দূরে, যেখানে বড়লোকেরা থাকে, গাড়ি হাঁকিয়ে, জুতা মসমসিয়ে চলে, সেই এলাকায়, উঁচু কোনো বড় বিল্ডিং এ চলে যাবে, আরামসে থাকবে। বস্তির লোকগুলোকে দেখিয়ে দেবে কত ভুল তারা ভেবেছিল রুবেল আর তার মাকে, মৌসুমিকে।
ফেলে আসা বাড়ির জন্য, গ্রামটার জন্য এমনকি বাবার জন্যও মাঝে মাঝেই খুব মন কেমন করে রুবেলের। শহরের এই নোংরা পরিবেশ, নোংরা মানুষ বড্ড হাঁপিয়ে তোলে তাকে। মৌসুমি কিন্তু বেশ খুশি! সে তিন বেলা পেটপুরে খেতে না পেলেও শহরের ঝলমলে বিজলি বাতি আর সারাদিন টিভি দেখার সুযোগে যারপর নাই আনন্দিত! মৌসুমিটা বোকা! মনে মনে মৌসুমির কথা ভেবে স্নেহে, ভালোবাসায় আর্দ্র হয়ে ওঠে রুবেল। বুকের মধ্যে কেমন একটা চাপ অনুভব করে সে। ইচ্ছে করে মৌসুমিটাকে কাঁচা খেয়ে ফেলে! বেশ করে তাকে চটকে দেয় একবার! মৌসুমি বিরক্ত হয়। আদর করতে গেলে সে ভ্যাঁ করে কেঁদে দেয়! কখনো কখনো কামড়েও দেয়। বলে, তুই সারাক্ষণ আমারে মারোছ ক্যান ভাইয়া? মারে কইয়া দিমু দেহিস! মা তোরে খুব মারবো!
রুবেল হাসে। মৌসুমিটা সত্যিই বোকা। আদরটাও বোঝে না। তার বাপটাও বোকা। নইলে কি করে তার মাকে রেখে অমন ধুমসি, দাঁত উঁচু, কালো এক বেটিকে বিয়ে করে! বাবার কথা মার সামনে সে বলতে পারে না। বললেই মা খুব মারে। কিন্তু সে আর মৌসুমি গোপনে ঠিক করে রেখেছে একটু বড় হলেই তারা চলে যাবে বাবার কাছে। তারা অনুরোধ করলে বাবা নিশ্চয়ই ওই ধুমসি বেটিকে বের করে দেবেন বাড়ি থেকে। তখন মা-ও আর বাবার সঙ্গে থাকতে আপত্তি করবেন না। কিন্তু তার মা টাও কেমন বদলে যাচ্ছে ইদানীং। সেদিন মাদ্রাসা থেকে তাড়াতাড়ি ফিরেছিল সে। ফিরেই মাকে দেখেছিল খুব খারাপ অবস্থায়। মৌসুমি ঘুমাচ্ছিল তখন। লোকটাকে চিনতে পারেনি রুবেল। মা তাকে দেখেনি। সে ছিটকে বের হয়ে এসেছিল। সারাদিন বসেছিল নির্জন শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের জল থৈ থৈ সুইমিং পুলের পাশে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল খুব। সারাদিন খাওয়া হয়নি আর। খিদেও পায়নি। সেদিন মাকে খুন করতে ইচ্ছে হয়েছিল তার। ওই লোকটিকেও। লোকটিকে চিনে রেখেছে সে। শোধ নেবে! অবশ্যই শোধ নেবে সে! প্রতিজ্ঞায় সেদিন ছোট্ট হাত মুষ্টিবদ্ধ করেছে আর বারবার আলগা করেছে রুবেল।
এরপর থেকে সে সুযোগ পেলেই সেখানে গিয়ে বসে থাকে। তার বয়সী আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হয় তার, কথা হয়। বেশ ভালো বন্ধুত্বও হয়েছে তার বেশ ক’জনের সঙ্গে। তার মতো গল্প আরও অনেকের আছে, শুনে সে স্বস্তি পায় খানিকটা। হাসিও পায় মাঝে মাঝে। তাহলে তার কান্নাটা নেহাত বোকামি, ভাবে সে। এই নির্জন কবরস্থানে সে তার ফেলে আসা গ্রামটির টুকরো একটি অবয়ব ফিরে পায়। ফিরে পায় তার সেই দুরন্ত দিনগুলোও। শুধু পুরনো বন্ধুদের খুব মনে পড়ে তার। বিল্টু, হাসান, জীবন, সোহেল আরো কত কত নাম! ওরা নিশ্চয়ই তাকে ভাবে না আর! নিশ্চয়ই ভুলে গেছে তাকে। এখানকার কৃষ্ণচূড়াগুলোকে আরও বেশি সবুজ লাগে তার, আরও বেশি লাল লাগে তাতে ঝুলতে থাকা ফুলের থোকা। অনেক গাছের নামও জানে না সে। কাঠবাদাম গাছগুলো তার চেনা। তালগাছগুলোও। কড়ই গাছগুলো অচেনা লাগে খুব। গ্রামের কড়ই গাছের ফুলগুলো হয় সাদা মাঝখানে হালকা হলুদ আর টিয়া রঙের ছোপ। কিন্তু এখানকারগুলো অন্যরকম। সাদার মাঝে টকটকে গোলাপির ছোপ। রুবেল অবাক তাকিয়ে থাকে। তার এক বন্ধু বলেছে ওগুলো নাকি বিলেতি কড়ই, তাই অমন। প্রথমদিন এখানে এসে সে ভীষণ রকম চমকে উঠেছিল। সে সিনেমার পোকা, নাটকও দেখে খুব। একটি কবরের ওপর ‘হুমায়ূন ফরীদি’ নামটা দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিল রুবেল! এই নামটা তো খুব চেনা তার! এই লোকের একটা সিনেমা আছে ‘পালাবি কোথায়’! দেখে হেসে গড়িয়েছিল সে! শালা! বহুত হারামি মাল ছিল! সে কবরটার গায়ে সাবধানে হাত বুলিয়েছিল বেশ অনেকক্ষণ! কান পেতে শুনতে চেষ্টা করেছিল ভেতরে কোনো শব্দ আছে কি না। না, কোনো শব্দ সে পায়নি। বেশ হতাশ হয়েছিল সে মনে মনে। সে জানে, এই লোকটা খারাপ ছিল, নাটক আর সিনেমা দেখে তেমন ধারণা সে পেয়েছে। আর খারাপ মানুষ কবরে গেলে তাদের অনেক কষ্ট দেওয়া হয়, তাও অজানা নেই তার।
সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, মাথায় সাদা টুপি, পায়ে রঙজ্বলা প্লাস্টিকের পাতলা চটি রুবেল শেষ বিকেলের আলোয় ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে সামনে দাঁড়ানো ছেলেটির হেলিকপ্টারের তুমুল ঘূর্ণন। তার আশেপাশে তার মতো আরও অনেকেরই ভিড় জমে যায়। পশ্চিম দিগন্তে সূর্যটা ক্লান্ত হয়ে হেলে পড়ে, তার ক্লান্ত, রক্তাভ মুখ থেকে লালচে আলো এসে রুবেলের মুখে, চোখে ছড়িয়ে পড়ে। রুবেলের ঘাম চকচকে মুখটা খুব অদ্ভুত দেখায় তাতে। তার চোখেও অন্যরকম এক আলো জ্বলে ওঠে। সে সেখানে দাঁড়িয়ে তারই বয়সি নাদুস নুদুস বড়লোকের ননীগোপাল ছেলেটিকে দেখে ঠিকই, কিন্তু তার মাথার মধ্যে অন্য হিসাব চলে। ছেলেটিকে সে তীব্রভাবে ঈর্ষা করে, ভীষণ রকম রেগে যায় সে মনে মনে ছেলেটির প্রতি। ওরকম একটি খেলনা কপ্টার তারও হতে পারতো, কিন্তু হয়নি, ছেলেটির আছে, কেন আছে? তার কেন নেই? কেন নেই? সে নিজের ভাগ্যকে অভিসম্পাত দেয়, অভিসম্পাত দেয় নিজের বাবা ও মাকে। ছেলেটিকে সে ঈর্ষা করে। তার ইচ্ছে করে একছুটে গিয়ে সে কেড়ে নেয় ওই খেলনাটি, ছেলেটির গালে মারে ঠাটিয়ে এক চড়! প্রবল হতাশা তাকে আঁকড়ে ধরে। হেলিকপ্টারটিকে করায়ত্ত করা কিংবা চড় কষা কোনোটিই তার আয়ত্তে নেই, সে জানে। খুব লোভ হয় অমন একটি খেলনা তার একান্ত নিজের করে পেতে। তার মধ্যে মাথাচাড়া দেয় অপার বিস্ময়! কী করে হেলিকপ্টারটি অমন জীবন্ত হয়ে ওঠে, অমন সাঁই করে শূন্যে উঠে গিয়ে কিভাবে তা চক্রাকারে ঘুরে চলে অবিরাম, তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক সেই হিসাব কষতে ব্যর্থ হয় ।
নিজের মধ্যে একই সাথে বিষাদ ও আনন্দ টের পায় সে। রুবেল বুঝতে পারে, অমন একটি খেলনা অদূর ভবিষ্যতে তার নিজের হওয়ার কোনো আশা নেই। তবু এই যে এত কাছে দাঁড়িয়ে সে দেখতে পাচ্ছে, অমন অভিজাত একটি খেলনার তুমুল ঘুর্ণন, সে-ও খুব কম কিছু নয় তার কাছে। অপ্রত্যাশিত এই হঠাৎ পাওয়া আনন্দটুকু তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে সে।
মাথার ওপর দিয়ে গমগম তীব্র আওয়াজ তুলে সত্যিকারের একটা হেলিকপ্টার ছুটে যায়। অন্যসময় অধীর আগ্রহে সে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে, ছুটে যায় যতক্ষণ না কপ্টারটি দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়। আজ সে ফিরেও তাকায় না সেদিকে। তার দৃষ্টি, মনোযোগ, আগ্রহ সব কেড়ে নেয় কয়েক হাত দূরে মাথার ওপর বন বন বন ঘুরতে থাকা ওই খেলনা কপ্টারটি। কোনো আঠা শক্ত করে আটকে রাখে তার চোখদুটিকে ওই খেলনাটির ধাতব শরীরে, কেন্দ্রীভূত করে রাখে তার সমস্ত বোধ ওই খেলনাটির দিকে। সম্মোহিত, আচ্ছন্ন হয়ে সে চেয়ে থাকে, চেয়েই থাকে।
তার সঙ্গে আসা সহপাঠীদের ভোজ সাঙ্গ হয়ে আসে, সূর্যও পাটে বসে যায় প্রায়, সে তবু বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাকিয়ে থাকে শূন্যে ভাসমান খেলনাটির দিকে। সে ভুলে যায় মাদ্রাসার সহপাঠী আর শিক্ষকদের সঙ্গে সে এখানে এসেছে কোনো এক বীরশ্রেষ্ঠের শাহাদাত বার্ষিকি উপলক্ষে আয়োজিত কাঙালি ভোজ অনুষ্ঠানে। সে আর তার বাকি সাথীরা, পুরো সপ্তাহ পথ চেয়ে ছিল, থাকে এমনি এক একটি অনুষ্ঠানের। আজও অনেক আশা নিয়ে সে এসেছে এই ভোজ খেতে, দুপুরে তার আজ খাওয়া হয়নি তেমন। অন্যান্য দিনের মতো আজও সে পেটপুরে খাবে এমন একটি সুখস্বপ্ন সে মনে এঁকেছে এই ক’দিন । সময় মতো সে তৈরি হয়েও চলে এসেছিল। কিন্তু বাদ সাধল ওই রুপালি-খয়েরিরঙা হেলিকপ্টারটি। সহপাঠীরা তার জন্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, বিরক্ত হয়ে, শেষে চলে গেছে যে যার মতো। শুধু সে একা মোহগ্রস্ত হয়ে, ঘোরলাগা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে খেলনাটির দিকে। আলো মুছে আসে। হঠাৎ অসার হয়ে দুম করে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় কপ্টারটি। ঘোর কাটে রুবেলের, চমকে ওঠে সে। কী অইলো? প্রশ্ন করে সে অবাক গলায়।
নিয়ন লাইটের আলো কোনো বৈষম্য বোঝে না। সে সমানভাবে ঝরে পড়ে কয়েকটি কুকুর, বেড়াল ও এক মানব শিশুর ওপর। রাত গাঢ় হয়ে আসে। তীব্রতর হয় একটি শিশুর ক্ষুধা, স্বপ্ন।
চার্জ শেষ! গলায় তাচ্ছিল্য আর করুণা ঢেলে, অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দেয় খেলনার মালিক ছেলেটি। খেলনাটি নিতান্তই অবহেলাভরে হাতে তুলে সে তার মায়ের হাত ধরে হাঁটে, সন্ধ্যা নামছে, বাসায় ফিরবে এবার।
বুকের মধ্যে কেমন ধড়ফড় করতে থাকে রুবেলের। সে পায়ে পায়ে অনুসরণ করে ছেলেটি আর তার মাকে। তারপর, প্রায় ব্যাকুল হয়ে সে প্রশ্ন করে, তোমরার খেলনাডির দাম কত?
পেছন ফিরে মা ও ছেলে বেশ কৌতূহলে দেখে তাকে। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে তাদের রূপকথার কোনো চরিত্র মনে হয় রুবেলের। সুয়োরানি আর তার ছেলে যেন সশরীরে তার সামনে হাজির হয় আজ! নারীটির চোখে কৌতূক চিকচিক করে, তাচ্ছিল্যও। সে রুবেলের দিকে তাকিয়ে বলে, দাম শুনে কী করবি তুই? কিনবি?
রুবেল লজ্জায় মিইয়ে যায়। হতাশ গলায় বলে, না, আমগো অতো ট্যেকা নাই। এমনেই জিগাই। হুনবার মন চায়।
নারীটি হাসে। মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা শুরু করে। পরে আবার কী ভেবে, দয়াপরবশ হয়েই হয়তো, মুখ ফিরিয়ে বলে, পনেরো শ টাকা! তারপর চলে যায় নিজের পথে, ছেলেটি মায়ের হাত ধরে পরম নির্ভরতায় কী সুন্দর দুলে দুলে হাঁটে, মাঝে মাঝে হাত ছেড়ে শূন্যে ব্যাট চালানোর ভঙ্গি করে। রুবেল সেখানেই থেমে যায়। শূন্য চোখে তাদের চলে যাওয়া দেখে। তার ঠোঁট নড়ে। নিজের অজান্তেই সে বিড়বিড় করে চলে, পনেরো শ ট্যেকা, পনেরো শো ট্যেকা।
হতাশ, ক্ষুধার্ত রুবেল ফিরে যায় সামিয়ানা টাঙানো স্থানটিতে, যেখানে ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। ফাঁকা পড়ে আছে সব। ছড়ানো ছিটানো খালি পানির বোতল, বিরিয়ানির খালি প্যাকেট, পড়ে থাকা টুকরো খাবার আর খাবারের সুগন্ধ, সবকিছু মিলিয়ে চোখে জল আসে তার। প্রচণ্ড খিদে তার পেটের মধ্যে তালগোল পাকায়। আজ সে এখান থেকে খেয়ে যাবে, মা জানে। রাতে তাই তার জন্য ভাত রাখবে না মা। রুবেল ফুঁপিয়ে কাঁদে। মাথার ওপরে কয়েকটি চিল হুটোপুটি করে, মারামারি করে, ডাকে। শেষবারের মতো, ঘরে ফেরার আগে নিজেদের বচসা সেরে নেয়। রুবেল কী করবে, ভেবে পায় না। একদিকে পেটের মধ্যে প্রবল খিদে খলবল করে অন্যদিকে তার মাথার মধ্যে বনবন করে ঘুরতে থাকে পনেরো শ টাকা দামের একটি খেলনা হেলিকপ্টার। অনেকদিন হলো সে শহরে, প্রায় একবছর।
এই কবরস্থানে তার আসা যাওয়াও আজ নতুন নয়। কিন্তু এমন অভিনব খেলনা সে এই প্রথম দেখলো আজ। তার মনের মধ্যে খেলনাটি পাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগে। সে মনে মনে ভাবে, কিভাবে সে পনেরো শ টাকা জোগাড় করতে পারে, আদৌ তা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে কি না! হতাশায় নিজেই সে মাথা নাড়ে। অসম্ভব! এত টাকা সে কোথায় পাবে! যেখানে পনেরো টাকা জোগাড় করতেই নাস্তানাবুদ হতে হয় তাকে। কিন্তু সে খেলনাটিকে মন থেকে সরাতে পারে না। মৌসুমির মুখটাও ছলকে ওঠে মনে। মৌসুমিকে যদি এমন একটি খেলনা সে দিতে পারে, তাহলে কেমন হবে তার মুখটা? ভাবতেই প্রবল উত্তেজনা ভর করে মনে। ভীষণ রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে সে। সন্ধ্যার অন্ধকার চিরে দেওয়া স্ট্রিট লাইটের আলোয় সে পথ হাঁটে দ্রুত। পেটের মধ্যে জেগে ওঠা প্রবল খিদেটাকে অগ্রাহ্য করে সে পৌঁছে যায় রাস্তার পাশে ডাঁই করে রাখা ময়লার স্তূপের সামনে। অনেকগুলো কুকুর আর বেড়াল ময়লা ঘাঁটছে, খাবার খুঁজছে। তাকে দেখে জ্বলজ্বলে চোখে তাকায়। প্রতিদ্বন্দ্বী বাড়লো দেখে মৃদু প্রতিবাদ করে। তারপর আবার নিজেদের কাজে মন দেয়। রুবেল একটু ভাবে। একটু ইতস্তত করে। তারপর বসে পড়ে। হাতড়ে খুঁজে ফেরে তার আকাঙ্ক্ষিত বস্তুগুলো। ভাঙড়ির দোকানে যাবে। তার দরকার টাকা…প নে রো শ টাকা।
নিয়ন লাইটের আলো কোনো বৈষম্য বোঝে না। সে সমানভাবে ঝরে পড়ে কয়েকটি কুকুর, বেড়াল ও এক মানব শিশুর ওপর। রাত গাঢ় হয়ে আসে। তীব্রতর হয় একটি শিশুর ক্ষুধা, স্বপ্ন।