প্রবাসে থেকে দূরে থাকা প্রিয়জনদের জন্য হা-হুতাশ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই যাদের, হতভাগ্য আমিও তাদের একজন। দিল্লিতে বউ-ছেলে নিয়ে থাকলেও যার ত্যাগের বিনিময়ে-মমতায় আমি বড় হয়ে উঠলাম, কয়েক হাজার মাইল পেরিয়ে শিলচরে থাকা সেই মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকার অনুভূতি নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে এ জীবনে। বয়স্ক-অসুস্থ মাকে ছোট ভাইয়ের দায়িত্বে রেখে এসে, এখানে কাজ আর পারিবারিক দায়িত্ব পালনের তাগাদায় সময় পার হয়ে যায়। মায়ের খোঁজখবর নিতে ফোন করার জন্য একটু সময় বের করতেও মাঝেমধ্যে দেরি হয়ে যায়। কিন্তু যতবারই আমি ফোন করি, এক বিশেষ পরিস্থিতির সম্মুখীন হই, অহঙ্কারের আলখাল্লা খুলে মালতীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে চাই, হাতজোড় করে। হ্যাঁ, মালতী। কে-ই ছিল বা সে?
সেদিন দুপুরবেলা যখন আমাকে ফোন করা হলো, দিল্লিতে আমি অফিসেই ছিলাম। আমাকে জানানো হলো, মায়ের স্ট্রোক হয়েছে। তাকে নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়েছে। মায়ের শরীরের এক দিক প্যারালাইজড হয়ে গেছে। মুখ বাঁকা হয়ে গেছে কিছুটা, তাই কথাও ধরেছে। ছোটভাই টনি আমাকে সরাসরি আসতে বলেনি, বরং বলছিল, তুমি চিন্তা করিও না। কিন্তু ছোটবোন পাতার হাজব্যান্ড শুভ বলল, আপনি আসলে ভালো হতো। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে একটা জিনিসই আমার মাথায় কাজ করছিল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিলচরে পৌঁছানো।
সঙ্গে-সঙ্গে অফিস থেকেই রূপাকে ফোন করে বিষয়টা জানালাম। অফিসে গলাটা বার বার শুকিয়ে যাচ্ছিল, বাসায় চলে আসলাম তাড়াতাড়ি। তিন সদস্য বিশিষ্ট আমাদের পরিবারের আশ্রয় দুই বেডরুমের ফ্ল্যাটের প্রতিটি দেয়াল যেন মার মুখখানা টাঙ্গিয়ে রেখেছিল। আর আমার ভেতরে ঘণ্টায় চার শ কি.মি. বেগে ঝড় বইছিল। বাসায় বসে আলোচনা করার জন্য সন্ধ্যাবেলা রূপার বড়ভাই গুরগাঁও থেকে আসলেন। বয়সে আমার এক দুই বছরের ছোটই, কিন্তু আত্মীয়তার সম্পর্কে বড় আর আমার বিয়েতেও একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
রূপা বলল, ভালো করে খবর নাও। আসতে হবে কি না জিগ্যেস করো ভালো করে।
ভালো করে, ভালো করে শুনে-শুনে মাথা খারাপ হয়ে যাবে, তখন বিজিতদা বললেন, তোমার যাওয়া উচিত। এ সময় না গেলে সারাজীবনের জন্য কথা থেকে যাবে।
আমার মনের সঙ্গে বিজিতদার কথা মেলাতে এই সিদ্ধান্তই নেওয়া হলো। দাদার মত শোনার পর রূপা আর কোনো কথা বলল না। তাহলে পরিবার? সংসারের বাজার তো রূপাই করে নেয় বিগ বাজার, স্টার বাজার থেকে। বাকি টুকিটাকি হাউজিংয়ে কিরানা থেকে। সোহম এখন স্কুলের বাস নিজেই ধরতে পারে, সেও বুঝতে পারছে, ঠাম্মার শরীর খারাপ হয়েছে। আর রূপা যখন এই শহরে একটা চাকরি করতে পারছে, তখন ছেলেকে নিয়ে কয়েকটা দিন নিশ্চয়ই কাটিয়ে দিতে পারবে।
অফিসের সঙ্গে কথা বলে আমি পরদিনই শিলচরের ফ্লাইট ধরলাম।
শিলচরে এসে দেখলাম প্রতিটি কথাই ঠিক। মাকে গ্রিনভিউ নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়েছে, শরীরের বাম দিক প্যারালাইজড হয়ে গেছে, তবে সংজ্ঞা এখনো আছে, আমাকে দেখেই চিনতে পারলেন। খুবই খারাপের মধ্যে একটু ভালো, প্যারালাইসিস জাঁকিয়ে বসেনি। হাতটা চলাতে পারেন, কিন্তু হাঁটতে গেলে পায়ে অসুবিধা হয়।
ডাক্তার বলল, ব্লাড প্রেশার আর ব্লাড সুগার দুটোই বেশি ছিল। একটু খেয়াল রাখা উচিত ছিল।
ডাক্তারের কথায় ভেতরে জন্ম নেয় আফসোস। মায়ের শরীরের দিকে খেয়াল রাখতে পারলাম না। ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে মাথা নিচু করি। ডাক্তার বলল, দুই তিন দিনের মধ্যেই রিলিজ দিয়ে দেব। ফিজিওথেরাপির ব্যায়াম শিখিয়ে দেওয়া হবে।
আমরা বাসায় চলে এলাম।
বাসায় মাকে নিয়ে আসার পর যেন আরেক ঝামেলার প্রত্যক্ষদর্শী হতে লাগলাম। বাসায় নিরামিষ খাওয়া হয়, নিরামিষ সব আইটেম কাজের মাসী ঠিকমতো রান্না করতে পারে না। ফলে আগে যে দায়িত্বটা আগ বাড়িয়ে মা করে নিতেন, রান্নাবান্না সামলানো, সেটা ছোটভাইয়ের বউয়ের ঘাড়ে এসে পড়ল। বাবার বিভিন্ন ওষুধ চলে, প্রতিবারই ওষুধ হাতে তুলে দিতে হয়। আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত লোকজন মাকে দেখতে আসে। তাদের একটু হলেও আপ্যায়ন করতে হয়।
মা যতদিন নার্সিং হোমে ছিলেন, ততদিন কিছু বলেনি রূপা। মাকে বাসায় আনার পরই প্রতিটি ফোন কলে তার প্রশ্ন, কবে আসবে? কিন্তু বাসার অবস্থা দেখে ফেরার কথা বলার সাহস পাই না। কেননা মাকে ধরে-ধরে বাথরুমে নিতে হয়, কাপড় বদলাতে সহায়তা লাগে। ডাক্তার বলেছে কিছু ব্যায়ামের কথা।
কিছু মহিলা পাওয়া যায়, যারা ঠিক কাজের মাসী হিসাবে কাজ করতে চায় না। বাড়িতে বাচ্চা দেখাশোনা বা বয়স্ক লোকের দেখভাল, এসব কাজে বাসায় আসে তারা। সে ধরনের লোকই খুঁজতে থাকলাম মার জন্য। কিন্তু প্যারালাইসিস রোগীর সঙ্গে থাকতে হবে আর রোগীর কী কী কাজ সামলে নিতে হবে—বৃত্তান্ত শুনে অনেকেই রাজি হতে চায় না।
একবার বাইরে থেকে বাসায় এসে চুপচাপ ঢুকে বুঝতে পারলাম অনিমেষ তার রুমে ফোনে কথা বলছে, এসেছে। দুই দিনের জন্য ফর্মালিটি মেন্টেইন করতে এসেছে!
শব্দগুলোর তরঙ্গ বলে দেয় ইঙ্গিতগুলো আমাকে নিয়েই। ছোটভাই, যার প্রতি স্নেহ আমাকেই আত্মপ্রসাদ এনে দিত, অনেক বছর দূরে থাকার ফলে সে আমার থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।
বাবাকে বললাম, অফিস থেকে পাঁচ দিনের ছুটি নিয়ে এসেছি। সেটা আরও দুদিন বাড়ানো হয়েছে শিলচরে আসার পর। এখন তো না গেলে হয় না।
_________________________________________________________________________________________________
দেখতে-দেখতে ঘোরের মধ্যে যেন সময় কেটে গেল। তিন তিনজন ভাইবোন বিয়ে করে সংসারী হলাম সেটাই কি সহজ কথা! এখন মায়ের এই অসুখের সময়ও কিছু করতে পারলাম না। রূপা বলল, আমরা যদি শিলচর থাকতাম , তাহলে তো আমরাই দায়িত্ব পালন করতাম। এখান থেকে তো আর কোনো কিছু করা সম্ভব নয়।
_________________________________________________________________________________________________
বার্ধক্যে উপনীত একটি কাঠের চেয়ারকে প্রায় স্থায়ী ঠিকানা করে ফেলা বাবা বললেন, তোর মাকে দেখবে কে? টনির সঙ্গে আলোচনা কর।
টনির সঙ্গে কী আলোচনা করব, সে তো আমাকে কাঠগড়ায় দাড়ঁ করিয়েই বসে আছে। আমার মাথা গরম হয়ে যায়। আমিও তো মানুষ, কয়দিক রক্ষা করব আমি? তবু টনিকে বললাম যাওয়ার কথা। সে বিকালবেলা কোনও খবর না পড়লেও পত্রিকার পাতার দিকেই চেয়ে থাকল।
টনির নীরবতায় অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, আচ্ছা, দেখি, এখন যাই। কয়েকদিন পর অফিসে ব্যবস্থা করে আবার আসব।
হয়ত অফিসের বাধ্যবাধকতা বুঝতে পেরে টনি বলল, দেখো, যা ভালো হয় করো।
দিল্লিতে এসে কাজে যোগ দিলাম, কিন্তু মন পড়ে থাকল আমাদের শেকড় শিলচরে। পড়াশোনা শেষ হওয়ার পরই শিলচরের বাইরে বের হয়ে যেতে হয়। পরিবারের বড় ছেলে ছিলাম বলে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে সময় কাটাব সে রকম অবস্থা ছিল না। দেখতে-দেখতে ঘোরের মধ্যে যেন সময় কেটে গেল। তিন তিনজন ভাইবোন বিয়ে করে সংসারী হলাম সেটাই কি সহজ কথা! এখন মায়ের এই অসুখের সময়ও কিছু করতে পারলাম না। রূপা বলল, আমরা যদি শিলচর থাকতাম , তাহলে তো আমরাই দায়িত্ব পালন করতাম। এখান থেকে তো আর কোনো কিছু করা সম্ভব নয়।
কিন্তু ঘড়ির কাটা যেন অনেক ভারী হয়ে একেকটা মিনিট এক ঘণ্টায় পার করছে। টনিকে বলে আসা কথাটা কিভাবে রক্ষা করব বুঝতে পারি না। আর কিছু কথা কাউকে বলতে পারি না।
পাতা আমাকে ফোন করল, তুমি দেখি সবকিছু ফেলে চলে গেলে। মা-বাবাকে এখন কে সামলাবে?
আমি বলি, কেন, টনি আর তার বউ আছে না? কাজের লোক আসে না? আর নার্স রাখার কথা যে বলে এলাম!
খুব সহজেই কথাগুলো বলে দিলে। পাতাও এখন সংসারী এবং সে রকমই তার কথাবার্তা। বাবা-মাকে দেখার দায়িত্ব শুধু ওর একার ? তুমি বড় ছেলে। তোমার কোনো দায়িত্ব নেই?
আমি চুপ থাকি। কথাগুলো কি তার একার, নাকি টনিরও, নাকি পরিবারের অন্য সদস্যদেরও?
পাতা বলে, ঠিক আছে, বুঝলাম, তুমি তো আর দিল্লি থেকে চলে আসতে পারবে না। কিন্তু এখানে তো ম্যানেজ করে দিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।
আচ্ছা তোমরা যখন এ রকম বলছ, তখন আমি চাকরি ছেড়ে চলে আসব শিলচর। রাগত স্বরে আমি হয়ত অভিমান দেখাতে চাই। আবার নিজেকেই বলি, বড় হয়ে এভাবে কি চলে?
তোমরা যদি মাকে দেখে রাখতে না পারো, তাহলে আমাদের বাসায় এনে দিয়ে যাও। ওপারে পাতা অভিযোগ করে অবাস্তব সমাধানের কথা বলে। আমি যে রকম পারি দেখব।
মাথা কাজ করে না। সদ্য অতীতের স্মৃতিগুলো খুব সহজেই ভেসে ওঠে। বিয়ের পর রূপাকে দিল্লিতে নিয়ে আসার পর বছর, দেড় বছরে একবার বাড়িতে যেতাম অতিথি পাখির মতো। আর মা তার ছেলে, ছেলে বৌ এবং পরে তার সঙ্গে যোগ হলো নাতি। আর নাতি পেয়ে আদরের ডালা মেলে ধরতেন। ঘরে এসে রূপাকে সব কথা বলি। সেও যখন সারাদিনের ডিউটি শেষে এসব কথা শুনে, আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
বড় ছেলে, ছোট ছেলে, তুমি কি পাল্লায় মাপতে পারবে কার কতটুকু দায়িত্ব? কেন, বাবা যে দিল্লিতে বেড়াতে এসেছিলেন তুমি বাবাকে ভালো ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছ না? রূপা আমার পক্ষ নেয়।
একজন প্যারালাইসিস রোগীর কথা আলাদা। তার সঙ্গে সবসময় একজন মানুষ লাগে। আমি বোঝাতে চাই।
আমাদের এখানে ঘরভাড়া দিতে হয়, কিন্তু শিলচরে তো ঘর ভাড়া লাগে না। এবার রূপার যুক্তি অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে। বরং ঘরভাড়ার ইনকামও আছে। ফিক্সড ডিপোজিটের ইনকাম আছে। ওদের এতটুকু সাপোর্ট যখন করা হচ্ছে, তখন ওরা করবেই না বা কেন?
ওরা মানে অনিমেষের কথা বলছে, মানে অনিমেষের বউকেও দায়িত্ব নিতে বলছে। অনিমেষও সদ্য বিবাহিত। আমি সকলের সীমাবদ্ধতার কথা বুঝতে চেষ্টা করি। তবু একটু স্বস্তি পাই মনে, যখন বাবা জানালেন মার অবস্থা, এখন আগের থেকে একটু ভালো। নিজের হাতে খেয়ে নিতে পারেন। তবে বাথরুমে এখনো ধরে নিয়ে যেতে হয়।
কথার তোড়ে বাবাকে বলে ফেলি, তুমি তোমার ওষুধ ঠিকমতো খাইও। দেখি আসা যায় কি না।
সিদ্ধান্তটা বেশ কঠিন ছিল। বিজিতদার সঙ্গে অনেকবার আলোচনা করলাম। অফিসে বসের সঙ্গে আলোচনা করে ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের সঙ্গেও কথা বললাম। বিশেষ করে মা’র অসুস্থতার ব্যাপারে বিস্তারিত শুনে আমার প্রস্তাব মতেই একমাস আনপেইড লিভ মঞ্জুর হলো।
মেয়েমানুষেরা হয়ত স্বভাববশতই নিজেরটা একটু বেশি বুঝতে চায়। তবু রূপাকে বোঝালাম, একজন সর্বক্ষণের কাজের মহিলা বা নার্স, যাই বলা হোক না, যদি পাওয়া যায়, মা’র সঙ্গে থাকার জন্য, তাহলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে। ওর শুধু একটাই কাজ, মার সঙ্গে থেকে তাকে সহযোগিতা করা।
হয়ত আমাদের বিয়ের ইতিহাসের কারণেই রূপা আমাকে বুঝতে চেষ্টা করে। দিল্লিতে আসার প্রথম দিকে বিজিতদার সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে একবার পুজার সময় শিলচরে গেলে যখন জানলাম সেও বাড়িতে এসেছে, ওদের বাড়িতে বেড়াতে যাই। সেখানেই রূপাকে প্রথম দেখি।
তারপর পরিবার পর্যায়ে যখন কথাবার্তা শুরু হলো, দেখা গেল কোষ্ঠী ততটা মিলছে না। এম কম পাস ছেলের জন্য আরও পাত্রী পাওয়া যাবে, এই ভাবনা শুরু হয়ে গেল আমাদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে। কিন্তু আমি বললাম, কোষ্ঠী দেখে সবকিছু হবে না। আর রূপাদের বাড়িতে বিজিতদা বিদ্রোহ করল।
শিলচরে পৌঁছেই কাজের লোক পাওয়ার সম্ভাব্য সব উপায়ের পেছনে খাটতে লাগলাম। নার্সিংহোমগুলোতে গিয়ে জানালাম, যারা বাসায় রান্নার কাজ করে তাদের বললাম। সবকিছু দেখে একটা আইডিয়া হয়ে গেল কয়েকদিনের মধ্যেই। লোক ম্যানেজ করতে হলে চা বাগানের ওপর, গ্রামের সাপ্লাইয়ের দিকেই ভরসা করতে হবে।
এমনকি গ্রামে আমাদের মূল বাড়ি বারইগ্রামেও গেলাম বরাক উপত্যকার চূড়ান্ত বাজে রাস্তার সাক্ষী হয়ে। ওখানে যাতায়াত তো কমেই গিয়েছিল, একটা উপলক্ষে স্বজনদের সঙ্গে আবার নতুন করে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হলো। একে তো আমরা শহরবাসী, তার ওপর আমি দিল্লিতে চাকরি করি, তাই সবাই গুরুত্ব সহকারে বিষয়টা শুনল। সম্পর্কে হয়ত খুব কাছের নয়, কিন্তু ওদের আন্তরিকতা কাছে টানল। বয়সে কনিষ্ঠ এ রকম দুই একজনকে বিশেষভাবে দায়িত্ব দিয়ে এলাম।
অফিস থেকে আনপেইড ছুটি নিয়ে এসেছি, আর প্রাইভেট কোম্পানিতে সবসময় চাকরির একটা অনিশ্চয়তা থাকে, তাই আমি কিছু না বললেও সবার মনে একটা চিন্তা জন্ম নিল, আমার চাকরির ব্যাপারে। তারপর সোহম আর রূপাকে একা রেখে এসেছি দিল্লির মতো শহরে, যেখানে মেয়েমানুষের নিরাপত্তা, বাসাবাড়ির নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ। অনি, পাতা সবাইকে একটু অপরাধবোধে আক্রান্ত বলে মনে হলো।
টনি বলল, আমি তো আছি, এত চিন্তা করার কি আছে? অনেকের তো এর থেকে আরও সিরিয়াস কত কিছু হয়। আমি নিরামিষাশী নই, বরং এটা ওটা খাওয়ার দিকে ঝোঁক আছে। পাতা তাই মাঝে মধ্যেই ওদের বাড়িতে রান্না করে নিয়ে আসে।
_________________________________________________________________________________________________
ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসকে অক্ষুণ্ন রাখতেই যেন দুই দিন পর দেবেশ সত্যি সত্যি হাজির হলো মালতীকে নিয়ে। স্বামী মারা যাওয়ায় অকাল বৈধব্য নিয়ে বাপের বাড়িতে একটা ঘর তুলে কোনোরকম থাকছে। আসা মাত্রই দেখলাম, মালতী মার কাজগুলো বেশ উৎসাহ নিয়ে শুরু করে দিয়েছে। বাথরুমে নিয়ে যাওয়া, কাপড় বদলানো এসব জিনিস মহিলা মানুষ হলে একটু সুবিধা হয়।
_________________________________________________________________________________________________
শ্বশুর নেই, কাকাশ্বশুর দেখা করতে এলেন। যাওয়ার সময় বললেন, অনির্বান, এদিকে একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলে দেরি করিও না। দিল্লিতে তারাও তো একলা আছে।
আমি চুপ থেকে ভাবতে থাকি একটা ব্যবস্থা কবে, কিভাবে হবে? টনি, পাতা ওরাও চেষ্টা করছে। অন্যান্য আত্মীয় স্বজনকেও বলা হলো। কিন্তু কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
সংসার বোধহয় এভাবেই চলে। একটি পথ বন্ধ হলে আরেকটি খোলে, যার ওপর আশা সে নিরাশা করলে অপ্রত্যাশিত সাহায্য এসে পড়ে। বারইগ্রাম থেকে আত্মীয় সম্পর্কে ভাই দেবেশ আমাকে ফোন দিল, দাদা, একজন মানুষ পেয়েছি। কিন্তু…।
আমার কণ্ঠে তখন উত্তেজনা। কোনো কিন্তু না। যেভাবেই হোক রাজি করিয়ে নিয়ে আয়। বেতন কোনো অসুবিধা হবে না।
বেতনের ব্যাপার না। যারে পাইছি সে বলে, এত দূর ।
আমি বললাম, শিলচর থেকে বারইগ্রাম দূর নাকি? মানুষ টাকা উপার্জনের জন্য কোথায় দিল্লি, বাঙ্গালোর যাচ্ছে।
ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসকে অক্ষুণ্ন রাখতেই যেন দুই দিন পর দেবেশ সত্যি সত্যি হাজির হলো মালতীকে নিয়ে। স্বামী মারা যাওয়ায় অকাল বৈধব্য নিয়ে বাপের বাড়িতে একটা ঘর তুলে কোনোরকম থাকছে। আসা মাত্রই দেখলাম, মালতী মার কাজগুলো বেশ উৎসাহ নিয়ে শুরু করে দিয়েছে। বাথরুমে নিয়ে যাওয়া, কাপড় বদলানো এসব জিনিস মহিলা মানুষ হলে একটু সুবিধা হয়।
রূপাকে ফোন করে মালতীর ব্যাপারে বললে সেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কয়েকদিন কেটে গেলে দিল্লিতে ফেরার ব্যাপারে অংক কষা যখন শুরু করে দিয়েছি তখন ঘরে কানে এলো, মালতী নাকি বলছে, সে থাকবে না, সে বাড়িতেই চলে যাবে।
একটা ঘোষণাই আমাদের মাথার সমস্ত পরিকল্পনা স্তব্ধ করে দিল। মায়ের রুমেই ডাকলাম ওকে।
তোর কোনো অসুবিধা হইলে ক আমারে।
অসুবিধা কিচ্ছু না।
তাইলে চলে যাবি কেন?
মালতী চুপ থাকে, আমার কারণ খোঁজার চেষ্টা পণ্ডশ্রমে পরিণত হল।
ওকে বোঝানোর চেষ্টা করি। তুই আমাদের বাসায় সারাজীবন থাকতে পারবি। এখানে তো তোর অসুবিধা হবার কিচ্ছু নাই।
অনিও বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। অবশেষে বলল, আচ্ছা কয়েকটা দিন থাক। আমরা অন্য কাজের লোক পেলে চলে যাবি।
কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে অন্য কাজের লোক? আমাদের সর্বক্ষণের কাজের লোক দরকার, যে রাত্রেও আমাদের বাসায় থাকবে। শিলচর শহরে তো এমন কেউ পাওয়া যাবে না, গ্রাম থেকেই নিয়ে আসতে হবে। আবার একটু শক্ত সামর্থ্য না হলেও চলবে না। আর একজন রোগী সামলানো সোজা কথা নয়। তবু মনের ভেতর একটা আশা তেল শেষ হয়ে আসা প্রদীপের মতো টিমটিম করে জ্বলতে থাকে, হয়ত সে সিদ্ধান্ত পাল্টাবে।
কিন্তু মালতী মানতে চায় না। বুঝতে পারি গরিব মানুষ গরিব হয় কেন। ওদের সুখে থাকতে পোকায় কামড়ায়। বাসায় ক্যাবল লাইন আছে, টাইলসের বাথরুম। মহিষ গাছের তলায় কি বিশ্রাম নেয়? কাদা আর গর্তের মধ্যে গড়াগড়ি করেই তার সুখ।
কিন্তু প্রত্যেক মানুষেরই অধিকার আছে তার নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কেউ না থাকতে চাইলে তাকে তো জোর করে রাখা যাবে না। ভেতরের ভদ্রলোক মানবাধিকার নিয়ে কথা বললে বাস্তবের আমি বুঝতে পারি, অন্য হিসাব কষতে হবে।
একজন লোক রাখা যাবে দিনের বেলার জন্য, আরেকজন রাতের জন্য। সেই রাতের বেলার লোক পাওয়া নিয়ে সমস্যা। কোনো মহিলা মানুষ এ রকমভাবে রাতের বেলা অন্যের বাসায় দিনের পর দিন থাকবে? আর তাদের বেতনও একটা ব্যাপার। নার্সের মতো যারা বাসায় এসে কাজ করে, তারা রোজ হিসাবে বেতন চায়। সেই হিসাবে ত্রিশ দিন মাসে তাদের বেতন অনেক দাঁড়ায়। বাসায় ডিউটি করলে তাদের তো আর না খাইয়ে রাখা যাবে না। এখন যদি দুজন লোক রাখতে হয়. তবে তাদের থাকা-খাওয়া-বেতন নিয়ে খরচ তো অনেক। তার ওপর বাবা ও মার ওষুধপত্র , ডাক্তার খরচা তো আছেই। দিল্লিতে স্বামী-স্ত্রী দুজন চাকরি করেও যা পাই, পরিবার খরচের তুলনায় অপ্রতুল মনে হয় চারিদিকে বিত্ত আর ব্যবহার্য বস্তুর বাড়বাড়ন্ত দেখে।
এসব অনিশ্চয়তা চলছে, তার মধ্যে একদিন আমি বাইরে গিয়েছিলাম, এসে দেখি প্যান্টের পকেট থেকে সাতশো টাকা নাই। নাই, নাই, নাই। খুঁজলাম, অনেক খুঁজলাম। নাই। আমি নিশ্চিত, মানি ব্যাগ থেকে সাতশ টাকা বের করে প্যান্টের এক পকেটে মানিব্যাগ, আরেক পকেটে সাতশো টাকা রেখেছিলাম। প্যান্টটা ঘরেই ছিল, কেননা আমি বাইরে গিয়েছিলাম বারমুডা পরে। কিন্তু কে করবে এই কাজ? একমাত্র মালতী ছাড়া তো সবাই ঘরের লোক, আর কারও তো সাতশোর জন্য পকেট চুরির দরকার নাই।
আমি মনে মনে নিশ্চিত হতে থাকি, এটা মালতীর কাজ। সে তো কিছুদিন পরেই চলে যাবে, তাই কাজটা করেছে। কিন্তু সে এত ছোটমনের লোক? হতেও পারে, তার দোষ আর কি, তার অভাবের দোষ!
মালতী বেরিয়ে গেলে আমি ওর ব্যাগ চেক করা শুরু করি। দুই সাইডে দুই প্যাকেট, শাড়ি, অন্যান্য কাপড়। পুরা ভাঁজ না খুললেও যথাসমভব চেক করার চেষ্টা করি। কিন্তু সেখানে নাই।
তাহলে সে কি ঘরের অন্যত্র লুকিয়ে রেখেছে, হয়ত বাড়িতে যাওয়ার সময় সেখান থেকে সুযোগ বুঝে বের করে নেবে? নাকি ঠিকে ঝি ময়না কাজটা করল? কিন্তু সে তো আমাদের বাসায় অনেক দিন ধরে কাজ করছে।তার গলায় তুলসীর মালা।
তবু ঘরে কথাটা তুলি না। বিশেষ করে, বাবার কানে গেলে চিল্লাচিল্লি করবেন। ঘর থেকে টাকা চুরি হয়ে যাচ্ছে, মানে ঘরের কেউ না কেউ টাকা চুরি করেছে। লজ্জার কথা। আর মালতী যখন টাকা সরিয়ে নিতে পেরেছে তখন কি আর স্বীকার করবে? সাতশো টাকা বড় কিছু না। কিন্তু যাদের সঙ্গে এক সঙ্গে থাকি, বা, যাদের ঘরে ঢুকালাম তারা কাজটা করার আগে একবারও ভাবল না? ভেবেছিলাম মালতীকে একটা শাড়ি কিনে দেব। কিন্তু সাতশো টাকা চুরি হওয়াতে সে প্ল্যান বাদ দিলাম। এক দিক দিয়ে তো পুষিয়ে নিতে হবে।
পরের দিন মালতী আবার বাইরে গেলে তার ব্যাগের পকেট আর ব্যাগে রাখা কাপড়ের ভাঁজগুলো আরেকটু বেশি করে খুলে দেখার চেষ্টা করি। তবে টাকাগুলো সেখানে নেই।
তবু মায়ের কাজের প্রতি মালতীর নিষ্ঠাকে অকৃত্রিম সাব্যস্ত করে কিছুটা হলেও মাপ করে দেই, বা মনে থাকে না বিষয়টা। এই কয়দিনেই অনেক কিছুই মালতীর ঘাড়ে এসে পড়েছে। বাবাও সামান্য কোনো কিছুর দরকার পরলেই—‘মালতী’! বুঝতে পারি, আমি যে মার জন্য চিন্তিত সেটা তাকেও চিন্তিত করছে।
অবশেষে একলা ঘরে একদিন মালতীকে ডেকে ফেলি। চরম অসহায়তা প্রকাশ পাচ্ছিল গলায়।
একটা কাজ কর না। আমি কোম্পানি থেকে একমাসে ছুটি নিয়া এসেছি। তোর বৌদিদেরও বাসায় একলা রেখে এলাম। তুই আরও কিছুদিন থাক। দেখি কোনও মানুষ পাওয়া যায় কি না।
মালতী আবার চুপ থাকে, সেই নীরবতার অর্থ কি আমি বুঝতে পারি না। হয়ত বলতে চায়, যতই অনুরোধ করো, আমাকে টলাতে পারবে না। অথবা প্রশ্ন করতে চায়, আপনারা মানুষ না পাইলে আমি কি যাব না?
একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলি, না পাইলে আর কী করব। দিল্লির চাকরি ছেড়ে তোর বউদিদের সবাইকে নিয়া চলে আসব।
আমার নিরূপায় অবস্থার বর্ণনা শুনেও মালতী নিরুত্তর থাকলে আমি সত্যি অন্ধকার দেখতে শুরু করি।
দুদিন পর দেবেশ আমাকে ফোন করলে আশঙ্কা করি মালতী বোধহয় ওকে তাড়া দিচ্ছে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
দেবেশ বলল, বড়দা, মালতী তো রাজি হয়েছে থাকার জন্য।
কঠিন খরায় আক্রান্ত জমিতে হঠাৎ করেই যেন জমজম বৃষ্টি। কথাগুলো অবিশ্বাস হচ্ছিল। তোকে বলেছে?
অয়, রাজি হয়েছে। আমিও বুঝিয়েছি, বড়দা থাকতে কোনো অসুবিধা হইত না।
মালতীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় আমার একটা ভূমিকা আছে জানতে পেরে ভালোই লাগল। তবে বড় ছেলে হিসেবে পরিবারের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে আমাকেই যখন মূল ভূমিকা নিতে হবে, তখন এ আর বিশেষ কি!
রাজি যখন হয়েছে, বেতন পাঁচশ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে দেব। আমি বলি।
না, না। বেতনের কথা কিছু বলেনি। কী দরকার আগ বাড়িয়ে বলার।
আমিও ভাবি, কী দরকার। বুঝেই হয়ত ফেলেছে কাজের লোক ছাড়া আমাদের চলবে না। পরে যদি আরও মাথায় চড়ে!
শেষের কয়েক দিন যথাসম্ভব চেষ্টা করলাম মালতীকে ট্রেনিং দিতে, ডিজিটাল প্রেশার মাপার মেশিন দিয়ে কিভাবে প্রেশার মাপতে হয়, ব্লাডসুগার মাপার মেশিনের স্ট্রিপে কিভাবে রক্ত নিতে হয় ইত্যাদি।
আসার সময় অনিমেষ অফিসে ছিল। ট্যাক্সি বুক করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছি, ফোনে কিছু টাকা ভরা উচিত বলে গলির মুখে থামলাম। মোবাইল রিচার্জের দোকানের ছেলেটা যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
অনিদা, তোমাকে পাওয়ায় ভালো হয়েছে। আমার একটা ভুল হয়ে গেছে। বেশ কয়েক দিন আগে তুমি সাতশো টাকা দিয়ে চলে গিয়েছিলে তোমার মোবাইলে রিচার্জ করার জন্য। দোকান খুলে দেখি সাতশোর কার্ড নাই।
_________________________________________________________________________________________________
ঘটনাটা মনে পড়ে। সাতশো টাকায় ফুল টকটাইমের অফারটা নিতে চেয়েছিলাম। যাক, সাতশো টাকা লস হয়নি। নতুন করে আর রিচার্জের পয়সা দিতে হলো না। অযথাই অনেককে সন্দেহ করেছি। মনে মনে ভাবি, মালতী কি বুঝতে পেরেছিল, ওর ব্যাগের কাপড় কেউ নড়াচড়া করেছিল?
_________________________________________________________________________________________________
আমি সে ঘটনার কথা মনে করার চেষ্টা করি।
পরে করে দেব বলে রেখে দিয়েছিলাম টাকাটা। দোকানদার বলতে থাকে। কিন্তু ক্যাশে টাকা রেখে দেওয়াতে মনে নাই। কালকে বাকির খাতা খুলে দেখি দেনার ঘরে তোমার টাকা লেখা। আমি এখনই রিচার্জ করে দিচ্ছি।
ঘটনাটা মনে পড়ে। সাতশো টাকায় ফুল টকটাইমের অফারটা নিতে চেয়েছিলাম। যাক, সাতশো টাকা লস হয়নি। নতুন করে আর রিচার্জের পয়সা দিতে হলো না। অযথাই অনেককে সন্দেহ করেছি। মনে মনে ভাবি, মালতী কি বুঝতে পেরেছিল, ওর ব্যাগের কাপড় কেউ নড়াচড়া করেছিল?
একটার পর একটা দিন, তারপর সপ্তাহ, কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে মাস কেটে যায়। দিল্লিতে চাকরিতে থাকলে শিলচরে আসা খুব একটা সহজ ব্যাপার না। পাতা মালতীকে একটা মোবাইল কিনে দিয়েছে।
পাতা বলল, শুধু মালতীর মতো মানুষ বলে। একজন রোগীর সঙ্গে দিনের পর দিন থেকে তাকে দেখভাল করা সোজা কথা না। সে তো আর আমাদের আত্মীয় না।
বাবা জানালেন, প্যারালাইসিস রোগীর জন্য তেল মালিশ ভালো। মালতী করে দেয় অবশ্য।
মনের জমি একটু হলেও সিক্ত হয়। সত্যিই তো, আত্মীয় কে, কিভাবে হয়? কয়েকদিন মার সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে মনে পড়ে, কিছু কাজ মমতা ছাড়া হয় না।
মায়ের কুশল সংবাদের জন্য মালতীকেই ফোন করতে হয়।
মালতী জানায়, মাসীর জন্য আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমি তো আছি।
যতবার ফোন করি, কেউ আমাকে ভারী হাতে একটা চড় মারে। বুঝতে পারি এ চড়, এ অপমান আমার প্রাপ্য।