গল্প লেখার প্রেক্ষাপট কিংবা গল্পপাঠের শেষকথা
বর্তমানটা ফেসবুকের সাথে দোস্তিপনা করে আছে গভীরভাবে। রাগ-বিরাগ, মান-অভিমান, এমনকি ব্যক্তিমানসের ঠুনকো আবেগ থেকে অভিরুচি পর্যন্ত ফেসবুকের শরীরে ভেসে ওঠে খেয়াল-বেখেয়ালে। গল্পকারের চোখ এসব এড়ায় না। এবং এর সাথে সংনিষ্ঠ অপরাপর চিহ্নগুলো হালের গল্পে দেখা যায়। বর্তমান গল্পটি কতিপয় যুবকের ফেসবুককেন্দ্রীক নানা আয়োজনকে সাক্ষী মানে। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সাথে আমরা এখানে প্রকৃতি ধ্বংস করে ক্রমশ আধুনিক নগর গড়ার হালহকিকত দেখি, দীর্ঘশ্বাসও। কিন্তু নির্বাচন নামক খেলা নিয়ে আমজনতার ব্যাপক জিজ্ঞাসার বাইরে যেতে পারে না গল্পের যুবকেরাও।
একচেটিয়া প্রভাব বা চর্চার আয়োজনে কত মারাত্মক জলখেলি শোনা যায়, তা পরখ করে যুবকেরাও। অথচ আরেকটু এগিয়ে গেলে আমরা হয়তো দেখতাম ডিজিটাল আইনের তামাশা অথবা তথাকথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো রাষ্ট্রিক রশি। একজন গল্পকারও এখানে সীমা অতিক্রম করতে পারে না, ফলে তার গল্প থামিয়ে দেয় ওসব বাস্তবতা দেখানোর আগেই। কৌতুকের গায়ে যদি সিরিয়াস কিছু পেয়ে যায় পাঠক, তাও গল্প হিসেবে চালিয়ে নেয়া ছাড়া উপায় নেই।
কৌতুকগুলো সিরিয়াস হয়ে যায় ॥ ইলিয়াস বাবর
খুব হৈচৈ পড়ে যায় মুহূর্তে। লাইক-কমেন্ট-শেয়ারের বন্যা বয়ে যাচ্ছে রোমেলের ফেসবুক ওয়ালে। অভিনন্দন জানাচ্ছে কেউ, কেউ বলছে অভিনব। কমিটি করার সময় তারা ভেবেছিল কিছু একটা হবে, বাস্তবে রেসপন্স হচ্ছে তারচে বেশি। সোজা বাংলায়, রোমেলদের উদ্যোগ হিট, টক অব দ্য এরিয়া, ভাইরাল অব দ্য ফেসবুক!
লকডাউনের আকালে বেরুবার জো নেই কোথাও। ঘরে বসে কাহাতক সময় ব্যয় করা যায়? অনলাইনে বেশিক্ষণ থাকলে বউ গাল ফুলায়; মা কানের ওপর ঝাড়ে খিস্তি। সামনের বারান্দা থেকে বাবার গরম কথায় নরম কানজোড়া না জেগে পারে না। রোমেল মাইনকার চিপায় পড়া মানুষের লাহান ঘামতে থাকে, ভিজতে থাকে, ঝিমুতে থাকে। ছোটখাটো বিদ্রোহ নিজের ওপর করে দুপুরে পেটতাজা করে ভাতঘুমের পরিবর্তে সোজা চলে যায় কর্ণফুলীর তীরে। তীর বেটারও শান্তি নেই। মহাপরিকল্পনার অংশ হয়ে সে এখন তুমুল ব্যস্ত। যেখানে গরু ঘাস খেতো নিশ্চিন্তে, লুইজাল ঠেলে ওয়াক্ত-খোরাকের ছোটমাছ ধরতো এলাকার রহিম-দুলালেরা, সেখানে আজ ট্রাক-লরির হাঁক। দৃশ্যমান হতে থাকে পাকা সড়ক, বাড়তে থাকে শব্দযন্ত্রণা।
রোমেলের ভাই-ব্রাদার্স সম্প্রদায় আসবে বেলা আরও বুড়ো হলে। ততক্ষণ না-ভাবনায় থাকার লোক না রোমেল। অবশ্য বাড়ি থেকে বেরুবার পর থেকেই অভিনব এক চিন্তা তার মাথায় ভর করে আছে। কত রকমের কমিটি আজকাল দেখা যায় ফেসবুকে! টুকটাক লেখার সুবাদে রোমেলের বন্ধুতালিকায় অতি-নামকরা, অল্প-নামকরা, এমনকি অনেকান্তে নতুন লেখকও আছেন। লেখার জগতের হালহকিকত না চাইলেও ফেসবুকের ওয়াল তাকে জানিয়ে দেয় প্রকাশ্য ও গোপন সুড়ঙ্গের আলোছায়া। কদিন বেশ বিরক্তই লাগতো তার, ফেসবুকে লেখক-গ্রুপের ভার্চুয়াল সনদ দেখে। এসব নিয়ে আবার ওয়ালে গালভরা ভাষায় পোস্ট, চিনপরিচিতদের বাহবামার্কা কমেন্ট। এ ওকে, ও একে, বাহারি ডিজাইনের ভুল বানানে ভরা এসব সনদ ও কমিটির মেলা দেখে রোমেল সিদ্ধান্ত নেয়, তারাও একটা কমিটি করবে, নাম জাতীয় মাল্যদান কমিটি (জামাক)।
দুধকলা পর্ব শেষ হয়েছে কি না, বর তার বন্ধুদের নিয়ে খেয়েছে কি না তার গুষ্টি কিলিয়ে রোমেল তার বন্ধুদের নিয়ে জয়ের আনন্দে উদ্বেল।
কমিটির কাজ হবে যে কোন পর্যায়ে নির্বাচনে বিজয়ী ও তার নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী পরাজিত প্রার্থীকে যথাযথ সম্মানের সঙ্গে মাল্যদান করা। ক্রমশ সারাদেশে বিস্তৃত হবে জামাকের কার্যক্রম, গঠন করা হবে বিভাগওয়ারি কমিটি। নিজের অমন ভাবনায় রোমেল রীতিমতো শিহরিত, এই প্রথম নিজ প্রতিভা সম্পর্কে তার ধারণা হলো ফকফকা হলো; আহারে, জন্ম যদি তবে হতো ইউরোপ-আমেরিকায়! হালকা আফসোস শেষে আশা করে, তাদের সংগঠন আনুষ্ঠানিক যাত্রার পর যেকোনো কার্যক্রমেই ফোকাস পাবে আঞ্চলিক ও জাতীয় অনলাইন কি প্রিন্ট মিডিয়ায়। সময় যেখানে অখাদ্য-কুখাদ্যকে ভিউ বানান হাজারে হাজার, সেখানে কিছুটা নিউজ তো হবে!
ভাই-ব্রাদার্স সম্প্রদায় বুড়ো বিকেলকে সাক্ষী মেনে রোমেলের এই উদ্যোগকে মহতি জ্ঞান করে আরও কিছু প্রস্তাবনা পেশ করে। ফেসবুকে একটা পেজ করতে হবে, জামাকের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হবে কর্ণফুলী তীরের এই আড্ডাখানা। গ্রিন অ্যাক্টিভিটির আওতায় এখানে কাজ করার মধ্য দিয়ে কেন্দ্রে না গিয়েও প্রান্ত থেকে লড়াই করা লোকেরা উৎসাহ পাবে, এই প্রকল্প দেখে, হতে পারে দেশি-বৈদেশি গবেষণা। অভিনব এই চিন্তাপদ্ধতির পুরোধা রোমেল, সে-ই হোক জামাকের সভাপতি, বাকিদের মতো। তেরো সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে থাকবে ভাই-ব্রাদার্স গ্রুপের সবাই। কোন মুরব্বি, কোনো উপদেষ্টার প্রয়োজন নেই এই সংঘে।
সবার চোখেমুখে টিকরে পড়ছে উত্তেজনা। রাজ্য জয় না হোক বড় কিছু বিজয়ের ঘোরে তারা উদ্ভাসিত। রোমেল ভাবে, একবার যদি চিক্কুর দেওয়া যায়, ইউরেকা! থাক, সভাপতি বলে কথা। বুড়ো বিকেল গাঢ় সন্ধ্যায় মিলিয়ে গেলে কালুর ঘাটের ব্রিজের দিকে তাকিয়ে রোমেলেরা হর্ষধ্বনি ছেড়ে যে যার বাড়িতে হাজিরার নিয়তে চলে যায় কর্ণফুলী তীরের চঞ্চল কর্মষজ্ঞকে পেছনে রেখে।
রাতের বয়স বাড়তে থাকে রোজকার মতো। ঘুম আসে না জামাকের সভাপতির চোখে। বিছানার ওপাশে মৃদু নাক ডাকার শব্দে বউ জানান দিচ্ছে সে আর এই জগতে নাই। এতদিনে অবশ্য তাছলিমার জানা হয়ে গেছে, স্বামী তার শিক্ষকতায় থাকলেও মন পড়ে থাকে কবিতার করিডোরে। কবিদের রাতজাগা দোষের না। বেশিরভাগ রাতেই তাছলিমা তাই ঘুমের দেশে চলে যায় বরের অনেক আগে। দুজনেই মাস্টারিতে বেরিয়ে যায় সকালে গ্রামের সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। বেরুবার আগে তাছলিমা তৈরি করে নেয় সকালের নাস্তা, বাচ্চার খাবার, দুপুরের ভাত-তরকারি। শ্বশুর-শাশুড়ি দোষ ধরার মানুষ না তবু তাছলিমা মুখে অনতি-চওড়া একটা হাসি লটকে রেখে সংসারের প্রায় সব কাজ গুছিয়ে তবেই স্কুলপথে রওয়ানা দেয় রোমেলের মোটর বাইকের পেছনে বসে।
প্রথম প্রথম বেশ শরমিন্দা হতো তাছলিমা বরের পেছনে বসতে। রোমেল বয়সে বছর তিনেকের ছোট তাছলিমার, ওরকম একটা জোয়ানের ঘরে আগের চার বছরের সংসার জীবন অতীত করে আসা, তার ওপর স্কুলমাস্টারির মতো পেশায় থাকা যেন সামাজিক নিয়মে কালি ঢেলে দেওয়া! চলতি পথের যত বাঁকা কথা, যত টিটকারি আজ গ্রীষ্মকালে আইলের মতো মুছে গেলেও তাছলিমাকে পীড়া দেয় মাঝেসাজে। ঘুমন্ত তাছলিমার দিকে তাকালে কত স্মৃতিই না আজ কিলবিল করে রোমেলের মনে! তাছলিমা, যে কিনা তার স্ত্রী, রিহানার মা, তাকেও পাওয়া গেছে একরকম মুহূর্তের উত্তেজনায়। সে এক ভয়ানক ইতিহাস। রোমেল তখনো বেকার, মাস্টার্স শেষ করে চাকরির নানা পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। ভাই-ব্রাদার্স গ্রুপেরই একজন তাকে ক্ষেপায় এই বলে, পারলে এই নাম্বারে ফোন দিয়ে পটাও তো দেখি! কতজনে পারেনি, তুমিও পারবে না নিশ্চিত। বন্ধুদের হল্লা রোমেলকে জানার অবসর দেয়নি নাম কিংবা ওপারের পরিচয়। মুহূর্তের দুষ্টুমিতে মাথায় ভর করে দুর্বুদ্ধি। অচেনা নাম্বারে ফোন দিয়ে অকপট আলাপ চালিয়ে যায় রোমেল।
কথার ভিড়ে জানা হয় নাম-ধাম। ততদিনে এ প্রান্তের মায়া উপছে পড়ে ও প্রান্তে; ও প্রান্ত ছুঁয়ে যায় এ প্রান্তের সর্বসত্ত্বা। বেকারত্বের দিন শেষে রোমেল যখন সরকারী সোনার হরিণ পেয়ে যায় হাতের মুঠোয়, তাছলিমাকে বলে বসে হৃদয়ের আবেদন। চোরাস্রোত এবার বহিরাঙ্গে এসে রাঙিয়ে দিতে চায় দিনলিপি। কে বোঝাবে রোমেল অবিবাহিত আর তাছলিমা এক সন্তানের জননী! বয়সের ব্যবধান, বিন্যাসের তারতম্য ডিঙিয়ে পাগলপ্রায় দুটি মনের বাঁধভাঙা আবেগ তখন মিলে যায় এক বিন্দুতে। সমাজের রীতি উপেক্ষা করে চড়াদামে তারা কিনে নেয় নতুন সম্পর্ক। সেই থেকে রোমেলরও সন্তান তাছলিমার আত্মজা রিহানা।
আনিসুর রহমান, রিহানার বাবা ভদ্রলোক; অবস্থা ভালো, ব্যবসা করে তবে ভালো রাখেনি তাছলিমাকে এই প্রবোধে ধুম করে অতীত হয়ে যায় কবুলের স্মৃতি! রোমেলের বাবা উচ্চস্বর হয়, মা হয় বিরাগ। ছেলে তাদের বয়েস কম, নষ্ট করলো ওই মাস্টারনী! অদ্ভুত লাগে রোমেলের, কত কথা তখন শোনাতো তাছলিমাকে, ফোনের ও প্রান্ত থেকে কথাগুলোকে কবিতা ভেবে কত হাসি আর হর্ষ প্রেমিকার! কবিতা কিংবা কথার এমন ক্ষমতায় রোমেল চমকে উঠতো; তাছলিমাকে নিয়ে হারিয়ে যেত কল্পনার দূর কোন রাজ্যে, যেখানে বয়সের চেয়ে শব্দ বড়, পেশার চেয়ে বড় স্বপ্ন। মিয়া-বিবির কঠিন সংকল্পে গলে যায় রোমেলের পরিবার, দূষিত কথা বাড়বার আগেই চুপসে যায় তার বাবার রাগী-বেলুন। আজ কেন জানি রোমেলের মনে হয়, সেই মহৎ ভুলটা না হলে তাছলিমার মতো দারুণ বন্ধু পাওয়া হতো না, রিহানার মতো কিউট একটা বাচ্চা পাওয়া যেত না! তাছলিমা মধুর ঝামটা দিয়ে কখনোসখনো বলেও বসে, তুমি তো হাদারাম মিথ্যে দিয়ে সত্যকে দখল করলে!
স্মৃতিদের এ-এক সমস্যা, একা আসতে পারে না; দলবল নিয়ে ভর করে কারো উপর। রোমেল আওড়ানের চেষ্টা করে প্রেমের কবিতা অথচ তার মনের খাতায় জ্যান্ত হতে থাকে স্মৃতিদের ছা-পোনা। তখন রোমেল পড়তো ক্লাস টেনের ঘরে, দাওয়াত ছিল রমিজ কাকার বিয়ের। বাবা সে-বার রোমেলকে বিয়েতে পাঠায় পরিবারের পক্ষ থেকে। সে-ই প্রথম পরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে দেখার চোখ গজায় রোমেলের। কারো বিয়ে হলে সমাজের প্রতি ঘর থেকে দাওয়াতে যাবার নিয়মে রোমেলের বন্ধু বলয়ের প্রায় সবাই কন্যালয়ে নেমন্তন খেতে যায় বরযাত্রীর গাড়ি করে। খাওয়া শেষে, বন্ধুরা দল বেঁধে ঘুরছে এদিক-সেদিক। পাহাড়ী এলাকায় সবুজের গলাগলি আর গাছে লিচুর বাম্পার ফলন দেখা শেষে তারা আবিষ্কার করে, তাদের রমিজ কাকার মুখের সমুখে শালা-শালী সম্প্রদায় ধরে আছে কাঁটা-চামচ। বেচারা মুখে পুরার আগেই হৈহৈ করে চামচ টেনে নেয় শালীরা। মজার সেই সময়েই সামাদ রোমেলের কানে মন্ত্রণা দেয়, শালীরা যদি দুলাভাই নিয়ে মশকারা করে, আমরা কেন বাদ যাবো বাপু? স্টেজের নিচে চকচক করা ওই জুতোজোড়া তোর পায়ে নিতে পারলে বিকেলে পেটপুরে নাস্তা করাবো।
রোমেল নিজের পায়ের জুতোর দিকে তাকায়, রং কিছুটা মলিন, ভেসে উঠছে বয়সের বলিরেখা। এই সুযোগে যদি চকচকে ওই জুতোজোড়া নিজের করে নেয়া যায় আর বিকেলে পাওয়া যায় মাগনা নাস্তা, ভালোই। শালা-দুলাভাইয়ের হাসাহাসি-মাখামাখি পর্বের ব্যস্ততার ভেতর আলগোছে রোমেল নির্দিষ্ট জুতো পায়ে দিয়ে চম্পট! দুধকলা পর্ব শেষ হয়েছে কি না, বর তার বন্ধুদের নিয়ে খেয়েছে কি না তার গুষ্টি কিলিয়ে রোমেল তার বন্ধুদের নিয়ে জয়ের আনন্দে উদ্বেল। পরদিন স্কুলে যাবার পথে গ্রামের চা-দোকানে রোমেল শুনতে পায়, বিয়েবাড়িতে জুতোজোড়া নিয়ে হয়েছে লঙ্কাকাণ্ড!
জুতোজোড়া ছিল রোমেলের প্রবাসী দুলাভাইয়ের; তার ধারণা তাকে অপমান করতেই বিদেশী জুতোজোড়া গায়েব করেছে কনেপক্ষ। যুক্তি দিয়ে যতই বোঝায় কন্যপক্ষ, বুঝবার পাত্র নয় বরের দুলাভাই! জুতো খুইয়ে দুলাভাইয়ের গলা ক্রমশ চড়া হতে থাকলে কন্যাপক্ষের জোয়ানগোছের কেউ একজন সমানতালে পাল্লা দিতে থাকে। হট্টগোলে একজন বলেও বসে, এই পরিবারের মেয়ে নেয়া যাবে না! পরিস্থিতি কোনমতে সামাল দেয় মুরব্বিরা। ঘটনার ঘনঘটায় কন্যাপক্ষ বাড়ির ছেলেপুলেদের পায়ের জুতো পরখ করেছিল ভরা মজলিসে। ভাগ্যিস রোমেলেরা চলে এসেছিল! বৃতান্ত শুনে রোমেলের ভিড়মী খাওয়ার দশা, তবুও কিছু হয়নি ভাব ধরে রোমেল স্কুলের দিকে পথ দিতে দিতে ভাবে, এমনতরো দুষ্টুমি বন্ধুদের পাল্লায় পড়লেও কেউ করে? সত্যিই যদি তার কারণে ভেঙে যেত বিয়েটা! শালারা নাস্তা তো করায়নি উল্টো খেয়ে দিছে কাকুর দোকানে গরম ছোলা-পেঁয়াজু।
কালুর ঘাট ব্রিজের দিকে তাকিয়ে তারা বোঝে, এখানে কৌতুক বুঝবার অনুভূতিগুলো ভোতা হয়ে হিংস্র ফলার জন্ম দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
কড়া স্বরে ফোনের ও প্রান্ত থেকে কেউ একজন পরিচয় দেয়, সে সিকদার কাউন্সিলরের চ্যালা। রোমেলকে এক দফা শাসিয়ে জিজ্ঞেস করে, তুই কি নতুন পাগল পয়দা হইছোস, মরার ভয় নাই দিলে? কেন ফুল দিতে গেলি ওই শালারে, পাত্তা পেতে? দিলে নির্বাচিত কাউন্সিলরকে দিবি, হারাদের না, বুঝছোস? তোদের মোড়লগিরি ছোটাবো। রোমেল ভদ্রভাষায় চেষ্টা করে লোকটাকে বোঝানোর। নিজের জ্বাল ঝেড়ে টুপ করে লাইন কেটে দেয় ফোনের ও প্রান্তে। জামাক নেতারা অবশ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এমন, প্রথমে মাল্যদান করবে নির্বাচিত মেয়রকে, তারপর পরাজিত মেয়র প্রার্থীদের। গ্রুপ থেকেই একজন বলে বসে, নতুন মেয়র তো খুব ঝামেলায় থাকবেন আজ, পয়লা ঘরের মানুষকে দেয়াই ভালো। এলাকার যেকোনো কাজে প্রথমে যেতে হবে কাউন্সিলরের কাছে, তাই নির্বাচিত কাউন্সিলরকে আগে মাল্যদান করা উচিত।
এলাকা তো জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি মাল্য পাবার সামনের হকদার। কিন্তু সিকদার মঞ্জিলের গেইটে গিয়ে রোমেলদের চক্ষু চড়কগাছ! লোকে লোকারণ্য সিকদার মঞ্জিলের বড় উঠোনে নবনির্বাচিত কাউন্সিলর কারো ফোন রিসিভ করছেন, কাউকে খাইয়ে দিচ্ছেন মিষ্টি। কাছে ঘেষা দূরে থাক গেইটের ভেতরে যাওয়াই মুশকিল। চ্যালা টাইপের কাউকে পেলে কাজ হতো, এখন তারাই তো একেকটা রায়-বাহাদুর! তাদের দাপট নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের আগের রাত পর্যন্ত মোটামুটি থাকলেও এখন কাঁধে ভর করেছে হর্স পাওয়ার।
গ্রামের স্কুলের মাস্টারি করা রোমেলের রুচিতে বাঁধে ভীড় ঠেলে ভেতরে যাওয়ার। হয়তো চোখাচুখি হবে কোন গার্ডিয়ানের; স্কুলের সভাপতিকে দেখা যাচ্ছে কাউন্সিলরের পাশের চেয়ারে, তিনি নির্ঘাত মাইন্ড করবেন রোমেলকে দেখলে। কাঁচা ফুলের মালা ফ্রেশ থাকবে না আগামী রাত পর্যন্ত, সে ঝরবে, পড়বে। ঝাঁকের কৈয়ের একজন তখন প্রস্তাব দেয়, পরাজিত নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আসমান আলীকেই দেয়া হোক মালাটা। সাংগঠনিক কার্যক্রম চলমান রাখার এই তাগিদে সভাপতি বেশ খুশি হয়, বোঝা যায়। দলবল নিয়ে অটো ডেকে রওয়ানা দেয় আসমান আলীর বাড়ির দিকে। মরা বাড়ির পরিবেশ ঘিরে রেখেছে আসমান ভাইয়ের বাড়ি, বোঝা যায় ঝড়ের আঘাত প্রবলবেগে ধাক্কা দিয়েছে এখানে।
মূক-সময়ে রোমেলদের উপস্থিতি আসমান আলীকে দিয়েছে ভোট-জয়ের কিছু কম আনন্দ। জাতীয় মাল্যদান কমিটির (জামাক) আসমান ভাইকে মাল্যদানের সেই ছবি এখন ফেসবুকে ঘুরছে প্রবল প্রতাপে। লাইক-কমেন্ট-শেয়ারের জোয়ারে ভাসছে রীতিমতো। সিকদারের কানে এই খবর নিশ্চয়ই কেউ দিয়েছে। আরে বাবা, দিনটা যেতে দিবি তো! দিনে রোমেলের স্কুল, অন্যদের ব্যবসা-চাকুরি, তাছাড়া কাউন্সিলরও দিনে ব্যস্ত থাকবেন নানা কাজে, যুৎসই সময় হিসেবে রাতকে চয়েজ করে জামাক নেতারা। দিনের শুরুতে ফোনকলে এমন ধমক খেয়ে রোমেলের কানের লথি গরম হয়ে যায় চরম রকমের। নিজেদের খেয়ে, নিজের টাকাকড়ি খরচ করে আনন্দ খরিদ করার এই আয়োজন যদি মন্দকথা শোনানোর উৎসমুখ হয় তার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন না তুলে পারা যায় না।
সন্ধ্যায় ভাই-ব্রাদার্স গ্রুপ নিয়ে বসে কর্ণফুলীর তীরে। উত্তুরে মৃদু হাওয়ায় শীত অনুভূত হলেও অপমানে তারা জেরবার। কালুর ঘাট ব্রিজের দিকে তাকিয়ে তারা বোঝে, এখানে কৌতুক বুঝবার অনুভূতিগুলো ভোতা হয়ে হিংস্র ফলার জন্ম দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।